মধুবালার গৃহে মুসাফিরের প্রবেশ
বিষপুরের শেষে, বল্লভপুরের শুরুর সীমানায় নয়না নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে এই জঙ্গলের মধ্যস্থলে যে কোনো মানুষের বাস আছে এটা ঠিক জানতেন না প্যাট্রিক। এ চত্বরে বছরের কোনো একটা বিশেষ সময়ে জনসমাবেশ ঘটে এটুকুই জানতেন তিনি। সেটাও অবশ্য জেনেছিলেন বিশেষ কারণে।
.
কয়েক বছর আগে যখন প্যাট্রিক দিল্লি থেকে সোজা বাংলায় পদার্পণ করেছিলেন তখনই একবার এসেছিলেন বিষপুরের সেই জনসমাবেশে। এখানে লোক অবশ্য তাকে মেলা বলে। প্যাট্রিক তখনও বাংলা ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেননি। বাংলা ভাষা বুঝতে পারলেও বলতে পারতেন না সঠিক উচ্চারণে।
গ্রীষ্মের দাবদাহে চারিদিক যখন উত্তপ্ত তখনই বিষপুরের এই নীলকণ্ঠের মেলাটা অনুষ্ঠিত হয়।
.
প্যাট্রিক রুদ্রনগরের একটি আস্তাবলে ঘোড়ার দরদাম করছিলেন। এমন সময় একটি পুরুষ হন্তদন্ত হয়ে ঢুকেছিলো আস্তাবলে। মালিককে বলেছিলো, একটা তেজী ঘোড়া লাগবে। আমার ভাই অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। হাকিমকে ঘোড়ায় চাপিয়ে ছুটতে হবে বিষপুরের মেলায়। আমার ঘোড়াটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একটা তেজী আরবি ঘোড়া কিনে ছুটছিল পুরুষটি।
প্যাট্রিক আধা বাংলায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ভাইয়ের কি হয়েছে? মানুষটা থমকে দাঁড়িয়ে বলেছিল, জ্ঞান হারিয়েছে। সর্বক্ষণের সঙ্গী ঔষধের কাঠের ভারী বাক্সটা নিয়ে উনি চেপে বসেছিলেন ছেলেটির ঘোড়ায়। বলেছিলেন, আমি একজন চিকিৎসক। দ্রুত চলুন সেই স্থানে। একজন সোনালী চুলের, নীল চোখের বিদেশিকে বিশ্বাস করতে সমস্যা হচ্ছিল মানুষটির। তাই প্যাট্রিক তার ঔষধের বাক্সটা খুলে নানাবিধ ঔষধের সরঞ্জাম দেখিয়ে বলেছিলেন, আর দেরী নয়। রোগী আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আর দ্বিমত না করে সে ঘোড়া ছুটিয়েছিলো।
পথ চলাকালীন প্যাট্রিক জানতে পেরেছিলেন পুরুষটির পরিচয়। সে বিষপুর নামক এক স্থানের জমিদার বংশোদ্ভূত। তার নাম সুজয় নারায়ণ রায়চৌধুরী। তারা বংশপরম্পরায় বিষপুরের জমিন্দার বংশ। বিষপুরের মেলার জনসমাবেশ তখনও কিছু মাত্র কমেনি। মেলার হাটে পসরা সাজিয়ে বসে আছে দোকানিরা। মানুষজন নিজেদের প্রয়োজনীয় ও শখের জিনিস ক্রয় করে চলেছে।
ঘোড়া থেকে নেমে সুজয় নারায়ণকে অনুসরণ করে চলছিলেন প্যাট্রিক। দেখলেন একটি প্রশস্ত চাতালে একটি অতীব সুন্দর পুরুষ অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে। তার পরনে গেরুয়া বস্ত্র। বস্ত্রে ধুলো, কাদা লেগে নোংরা হয়ে রয়েছে। সুজয় নারায়ণের পোশাক বেশ দামি এবং যথেষ্ট পরিপাটি। তার ভ্রাতার এমন ভিক্ষুকের দশা কেন হলো সেই কথা ভাবতে ভাবতেই প্যাট্রিক সিঁড়ি দিয়ে ওই পাথরের চত্বরে উঠলেন।
.
আচমকা বিদেশি দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে একজন বয়স্ক ব্যক্তি বললেন, বৈদ্য কোথায় সুজয়? সুজয় নারায়ণ অপরাধীর কণ্ঠে বললেন, বিষপুরের বৈদ্য আজ বাড়িতে নেই। রুদ্রনগরের এক হাকিম আসবেন না জবাব দিয়ে দিয়েছেন। আমি ঘোড়া কিনে রুদ্রনগরের শেষ প্রান্তে আরেকজন হাকিমের নিকট যাবো বলে যখন মনস্থির করলাম, তখনই সাহেব ডাক্তার বললেন, রোগী বিপদজনক অবস্থায় রয়েছে। এখন সময় অপচয় করা উচিত নয়। উনি একজন চিকিৎসক জেনেই নিয়ে এলাম।
বয়স্ক মানুষটি বিড়ম্বনার গলায় বললেন, আমি শশাঙ্ক নারায়ণ রায়চৌধুরী। আমি স্বয়ং একজন ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে ম্লেচ্ছর ছোঁয়া স্পর্শ করবো? এ যে চরম অন্যায়।
ঠিক তখনই একজন পুরোহিত বললেন, বাবু, সন্তানের জীবন বাঁচাতে হবে। নীলকণ্ঠের দুয়ারে আজ অবধি কেউ এভাবে জীবন ত্যাগ করেনি। নীলকণ্ঠ মেনে নেবেন না। আপনি আর দ্বিমত করবেন না। শশাঙ্ক নারায়ণ ইতস্তত করে বললেন, চিত্তহরণ, তুমি একটা প্রায়শ্চিত্তের বন্দোবস্ত করে রেখো। প্যাট্রিক কালবিলম্ব না করে রোগীর নাড়ি দেখলেন। অতি মৃদু চলছে শ্বাস। খুবই দুর্বল।
প্যাট্রিক ভাঙা বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলেন, ওর কি আজ খাওয়াদাওয়া হয়নি? একজন অবগুণ্ঠনবতী মহিলার কোলেই মাথা দিয়ে শুয়েছিল ছেলেটি। সেই মহিলাই খুব ধীর গলায় বললেন, সুশান্তের আজ তিনদিন উপবাস চলছে। প্যাট্রিক জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
শশাঙ্ক নারায়ণ গম্ভীর গলায় বললেন, এসব আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ, আপনি বিদেশি বুঝবেন কি! আমার কনিষ্ঠ সন্তান সুশান্ত জন্ম থেকে বোবা। সে কথা বলতে পারে না। প্রতিবারই নীলকণ্ঠের কাছে মানত থাকে, তিনদিন উপোস করে দণ্ডী কেটে পুজো দেওয়ার। নীলকণ্ঠের করুণা দৃষ্টি যেদিন সুশান্তের ওপরে পড়বে সেদিনই ওর স্বর ফিরে আসবে। আর যদি নীলকণ্ঠের ইচ্ছে হয় ওর প্রাণটা নেবে তাহলে আমরা তাই সইবো।
অবগুণ্ঠনবতী মহিলা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। ইনি সম্ভবত সুশান্তের মা।
প্যাট্রিক অবাক হয়ে শুনছিলেন ভদ্রলোকের কথা। ইনিই বিষপুরের জমিদার, এটুকু এতক্ষণে পরিষ্কার।
কথা না বাড়িয়ে প্যাট্রিক চিকিৎসায় মনোনিবেশ করলেন। পনেরো মিনিট অতিক্রান্ত হবার পরে সুশান্ত প্যাট্রিকের চিকিৎসায় সাড়া দিলো। খুব দুর্বল দুটো চোখের পাতা একটু খুলে জানান দিলো সে এখনও মরেনি। আচমকা সকলে মিলে নীলকণ্ঠের নাম ধরে উচ্চস্বরে চিৎকার করতে শুরু করলো। জয় নীলকণ্ঠের জয়। বাবা ফিরিয়ে দিলেন তার সন্তানের জীবন।
প্যাট্রিক একটু চমকে উঠে মনে মনে বললেন, এখানে মানুষের মনে এখনও কত অন্ধবিশ্বাস বাসা বেঁধে বসে আছে নিশ্চিন্তে। সুশান্তকে পরীক্ষা করে প্যাট্রিক বেশ বুঝতে পারলেন, এই ছেলেটিকে কেউ কোনোদিন কথা বলাতে পারবে না। কারণ এর জিহ্বার একটি অংশ অসম্পূর্ণ। তবুও প্রতি বছর এর শরীর ও মনের ওপর চলবে এই অত্যাচার।
প্যাট্রিকের দিকে তাকিয়ে ছেলেটি হাত জোড় করে ইশারায় বোঝালো, ও ঋণী রইলো।
শশাঙ্ক নারায়ণ রায়চৌধুরী তার জমিদার সুলভ ভঙ্গিমায় একশত স্বর্ণমুদ্রা প্যাট্রিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আপনার পুরস্কার। প্যাট্রিক তার মধ্যে থেকে দুটি স্বর্ণমুদ্রা গ্রহণ করে বললেন, এটাই আমার পারিশ্রমিক। শশাঙ্ক নারায়ণ বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি তো আমায় বিস্মিত করলে হে ভিনদেশী। মানুষ এখনও এমন নির্লোভ আছে!
তারপরে অবশ্য বিষপুরের শশাঙ্ক নারায়ণের বাড়ির ফিটন গাড়িতে চেপে প্যাট্রিক বেশ কয়েকবার ওনার বাড়িতেও গিয়েছেন। ওনাদের পরিবারের বেশ কয়েকজনকে চিকিৎসা করে সুস্থও করে তুলেছেন। প্যাট্রিকের ঔষধ গ্রহণ করার পরে সে ব্যক্তি চিত্তহরণ পণ্ডিতের বিধান মত প্রায়শ্চিত্ত করে নিজেকে শুদ্ধও করে নিয়েছে। কিন্তু তবুও কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে শশাঙ্ক নারায়ণ প্যাট্রিককেই ডেকে পাঠান।
.
কি হলো দাঁড়িয়ে রইলে কেন প্যাট্রিক, এসো। মধুবালার হাঁটার ছন্দেই নৃত্য রয়েছে প্যাট্রিক। একে বেগম রূপে না পাই কাঞ্চনী করে রাখতে মন চায়। মুসাফিরের কথায় সম্বিৎ ফিরলো প্যাট্রিকের।
এই মন্দির চত্বরে তিনি আগে একবার এলেও এখানে যে মানুষের বাস আছে সেটা ভাবতেও পারেননি।
নয়না নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ আর বন্য প্রাণীর শব্দ ছাড়া তেমন কিছুই এসে পৌঁছায় না এ চত্বরে।
.
মধুবালা দুটো কম্বলের আসন দাওয়ায় পেতে দিয়ে বললো, বসুন।
এই মেয়ে বহিরজগৎ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হওয়ার কারণ বোধহয় এটাই। এমন জনমানস বর্জিত অঞ্চলে বাস করার হেতুই মধুবালা আর পাঁচটা এই বয়েসী মেয়ের মত অভিজ্ঞ নয়। অভিজ্ঞ যে নয় সেটা সুস্পষ্ট হয় দুজন সম্পূর্ণ অপরিচিত পুরুষকে আপ্যায়ন করে নিজের গৃহপ্রান্তে আহ্বান করা দেখে।
পাথরের বাটিতে মিষ্টান্ন ও পাথরের পাত্রে শীতল জল নিয়ে এসে সামনে রেখে নরম গলায় বললো, পান করুন। আপনারা আমার অতিথি। কিন্তু অতিথি সেবার মত পর্যাপ্ত সামগ্রী আমার গৃহে মজুত নেই। তাই আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
মুসাফিরের লোভাতুর দৃষ্টি ঘুরছে মধুবালার অঙ্গের ভাঁজে। মধুবালার ঠোঁটে সরল হাসি। প্যাট্রিক আরেকবার তাড়া দিয়ে বললেন, হুজুর এবারে আমাদের প্রস্থান করা উচিত। সুজান খান দীর্ঘক্ষণ আপনাকে শিবিরে অনুপস্থিত দেখলে চিন্তান্বিত হয়ে পড়বেন। বিরক্তির স্বরে মুসাফির বললেন, বাদশাহ কে প্যাট্রিক? আমি না সুজান খান? সুজান খান আমাকে আদেশ করার কে? সে আমার অধীনস্ত কর্মচারী বৈ তো নয়।
প্যাট্রিক এ রমণী তো নয়না নদীর জলের ন্যায় স্বচ্ছ। একে নিয়ে কাব্য রচনা করা যায় অনায়াসে।
মধুবালা হঠাৎ প্যাট্রিকের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনি ভিনদেশী রাজকুমার তাই না? আমার স্বপ্নে অবিকল আপনার মতোই এক ভিনদেশী আসেন। ঘোড়ায় চাপিয়ে আমায় নিয়ে যান বহুদূর। আমি সেই ভিনদেশীকে চিনি না বিন্দুমাত্র। তবুও তাঁর আন্তরিক কথা শুনে মনে হয় তিনি আমার বহুযুগের পরিচিত। আগ্রহের বশেই প্যাট্রিক জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলেন, সে কি বিষয়ে কথা বলে আপনার স্বপ্নে?
মধুবালা একটু অন্যমনস্ক হয়ে বলেছিল, ঘোড়ায় করে আমাকে একটা বড় রাজপ্রাসাদে নিয়ে যান তিনি। আমিও যাই তাঁর সঙ্গে, তাঁকে যে ভালোবাসি আমি। তিনি যে রোজ আসেন আমার খোঁজ নিতে। আর কেউ তো আসে না আমার এখানে। শুধু ঘুম এলে তিনিই আসেন। তারপর সেই প্রাসাদে গিয়ে আমি যখন আমার কক্ষ খুঁজি তখন সেই ভিনদেশী আমার হাত ধরে নিয়ে যান এক রাজসভায়, সেখানে সিংহাসনে বসে থাকেন এক রাজা। তাঁর হাতে আমায় সমর্পণ করে কোথায় যেন চলে যান। আর আসেন না।
রোজ এই অবস্থায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি তাঁকে অনেক খুঁজি। কিছুতেই পাই না। আবার পরের দিন নির্দিষ্ট সময়ে তিনি আসেন তন্দ্রা এলে। তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করি, কে ওই রাজা? কেন তিনি আমাকে অর্পণ করছেন ওই রাজার হস্তে? ভিনদেশীর চোখে জল, অধরে করুণ অসহায়তা, কিন্তু কোনো কথা বলেন না। আমার হাতে একটা আংটি দিয়ে বলেন, অন্যের শয্যাসঙ্গিনী হবার পূর্বে আমি যেন ওই আংটিটি মুখে চুষে নিই। তাহলেই অমরত্ব পাবে আমাদের ভালোবাসা।
মধুবালার মুখে কষ্টের প্রতিচ্ছবি। প্যাট্রিক বুঝলেন, মধুবালা তার মানে জানে ওই আংটির ভিতরে বিষ থাকে। মুসাফির হেসে বললেন, প্যাট্রিক মধুবালার স্বপ্ন তবে তুমিই সত্যি করে দাও। রুদ্রনগরের চত্বরে আমার সুহৃদ আর কোনো বিদেশি বিরাজ করে বলে অবগত নই। তুমিই একমাত্র আমার সুহৃদ এবং ভিনদেশী। মধুবালাকে সাদা ঘোড়ায় বসিয়ে রুদ্রনগর প্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার কাজটি তবে আমি তোমার ওপরেই অর্পণ করলাম। চলো হে, যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। রুকসানা বেগমকে খুশি করতে গেলে এ যুদ্ধ আমাকে জিততেই হবে। যুদ্ধ বড় অপছন্দের কাজ আমার প্যাট্রিক। কেন যে বাদশাহ হলাম!
মধুবালা তখনও প্যাট্রিকের সঙ্গে ওর স্বপ্নে দেখা ভিনদেশীর মিল-অমিল বিচারে ব্যস্ত। সেটা ওর দৃষ্টির বিহ্বলতাই প্রমাণ করে। মুসাফির এগিয়ে গেলেন কিছুটা। প্যাট্রিক মধুবালার কানের কাছে ফিসফিস স্বরে বললেন, আবার আসবো আপনার দ্বারে।
মধুবালা লজ্জা পেতে জানে। তার গাল দুটি আরক্ত হলো।
.
মহিলা সম্পর্কে উদাসীন, অর্থ-প্রতিপত্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নির্লোভ প্যাট্রিক এযাবৎ কাল অবধি জানতেন, তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় ভালোবাসা হলো—বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি এবং চিকিৎসা। মানুষকে নতুন জীবন দান করাতেই তাঁর আনন্দ। তাই অন্য ফরাসিরা ব্যবসাবাণিজ্য করে নিজ দেশে ফিরে গেলেও বাংলার মাটি ছেড়ে ফিরতে মন চায়নি প্যাট্রিকের।। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছিলেন প্যাট্রিক। বাবা পেশায় ব্যবসাদার। এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়ানো তাঁর নেশা। সঙ্গে অনেক অর্থ উপার্জনের নেশাটাও তাঁর মারাত্মক। তাই একাকীত্বকে সঙ্গী করেই মহাপ্রাচুর্যে মানুষ হয়েছিলেন প্যাট্রিক। সেই থেকেই অর্থের প্রতি ওঁর একটা তীব্র বিতৃষ্ণা জন্মে গিয়েছিলো। ছোট থেকেই বুঝতে পারতেন, ঐশ্বর্য শুধু লোভ বাড়ায়, শান্তি দেয় না। স্কুলেও প্যাট্রিক ছিলেন সকলের থেকে আলাদা। গাছ-গাছালি, ফুল-ফল ওঁর বন্ধু ছিলো। ওঁদের বাড়ির বিশাল বাগানের গাছগুলোর সঙ্গে উনি গল্প করতেন। গাছেরা সাড়াও দিতো ওঁর কথায়। লোকে ওঁকে পাগলা বলতো।
তখন উনি বছর বারোর ছেলে, ওঁর চোখের সামনে একটা পাখি মাটিতে পড়ে ছটফট করছিলো। অনেক শুশ্রুষা করে পাখিটিকে সুস্থ করে তুলেছিলেন প্যাট্রিক। তখন থেকেই উনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ডাক্তার হবেন। সকলের প্রাণ বাঁচাবেন। এতদিনেও প্যাট্রিকের মন কখনও লক্ষ্য থেকে সরে যায়নি। মতিভ্রষ্ট হয়নি কোনো প্রলোভনে। আজ তবে এ কিসের দামামা বাজছে অন্তরে! কেন মুসাফিরের লোভাতুর দৃষ্টি মধুবালার অঙ্গ স্পর্শ করলে প্যাট্রিকের অন্তরে রক্তক্ষরণ চলছে? মধুবালার চাহনিতে যেন মুক্ত আকাশের হাতছানি। প্যাট্রিকের ইচ্ছে করছে ওই হাতছানিতে সাড়া দিতে।
নিজেকে অতিকষ্টে সম্বরণ করে প্যাট্রিক বললেন, সে পরে হবে খন। আপনি এখনই শিবিরে ফিরুন হুজুর। মুসাফির বিরক্তির গলায় বললেন, উফ, বেরসিক বৈদ্য। চলো তবে। কিন্তু মনে রেখো, তোমার হাতে মাত্র একমাস সময় রইলো। মধুবালাকে আমার নিজস্ব মহলে আমি কাঞ্চনী রূপে দেখতে চাই। পদ্ম সরোবরের সম্মুখে ওর নৃত্য পরিবেশিত হবে। প্যাট্রিক বললেন, জি হুজুর।
ওঁরা উঠে পড়লেন দালান থেকে। বাইরে ওঁদের ঘোড়া অপেক্ষা করছিলো। আর কোনো প্রহরী নেই। প্যাট্রিক পিছন ঘুরে দেখলেন, মধুবালার চোখে তখনও বিস্ময়। ও বোধহয় স্বপ্নের ভিনদেশীর সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করে চলেছে প্যাট্রিককে। মধুবালার অপলক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই প্যাট্রিক এগিয়ে চললেন নয়না নদীর ধার বরাবর। গাছের ছায়ায় পথ ঘন অন্ধকার। গোধূলিবেলার আলোর রেশটুকু অপসৃত হতেই সন্ধে নামে বিষপুরের জঙ্গলে। মুসাফির স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করতে করতেই ঘোড়ার লাগামে টান দিলেন। সম্মুখে সাপ জাতীয় কোনো প্রাণী পথ পার করছিলো।
প্যাট্রিকের মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। নিজের আচরণের জন্য নিজের ওপরেই জন্মেছে আক্রোশ। কেন অহেতুক মধুবালাকে বিপদজনক পরিস্থিতির শিকার করে ফেললো সেটা ভেবেই রাগের জন্ম হচ্ছিলো। মুসাফিরের নজর থেকে মধুবালাকে বাঁচাতে স্বয়ং ওর সৃষ্টিকর্তাও পারবে না। ওর পিতা তো নেহাতই দুঃস্থ ব্রাহ্মণ। মুসাফিরের রাজ্যের সীমানায় যার বাস, তার কন্যার কাঞ্চনী হওয়া আটকায় কে। প্যাট্রিক মুসাফিরকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন বলেই জানেন, মুসাফির কোনো কিছুই অতি সহজে ভুলে যান না। মনে রাখেন দীর্ঘদিন।
.
শিবিরে প্রবেশ করতেই সুজান খান রুষ্ট দৃষ্টিতে তাকালেন প্যাট্রিকের দিকে। রাগত কণ্ঠে বললেন, আপনি ভিনদেশী। এখনও এদেশের রীতিনীতি রপ্ত করে উঠতে পারেননি। তাই যে কোনো মুহূর্তে বল্লভপুরের সীমানার নিকটবর্তী স্থানে বাদশাহের জীবন যে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে তা বিবেচনা না করেই এমন কার্য করেছেন আপনি। বাদশাহের বন্ধুস্থানীয় না হলে আপনার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করতে সুজান খান সময় নিতো না।
প্যাট্রিক দেখলেন, মুসাফির অন্যমনস্ক হয়ে সোনার কলম দোয়াতে চোবাচ্ছেন আর তুলছেন। মধুবালার ভাবনায় তিনি যে এখনও বিভোর হয়ে আছেন তা বেশ বুঝতে পারছেন প্যাট্রিক। তাই সুজান খানের ভর্ৎসনা শুনেও বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করলেন না বাদশাহ। প্যাট্রিকেরও বিশেষ ইচ্ছে নেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার। তাই তিনি নিজের শিবিরে প্রবেশ করলেন।