ভুতুড়ে ফুটবল – ২

॥ ২॥

পার্বতী, মানে এ-বাড়ির কাজের মেয়েটি বলেছিল, ভদ্রলোক। ফলে আমি ধরে নিয়েছিলুম যে, দর্শনপ্রার্থী ব্যক্তিটি নিশ্চয় একজন বয়স্ক মানুষ হবেন। কিন্তু অরুণ সান্যাল তাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিতে বলার একটু বাদে ডান হাতে একটা বড় সাইজের মাটির হাঁড়ি ঝুলিয়ে যে-ছেলেটি এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকল, তার বয়স বোধহয় বছর কুড়ির বেশি হবে না। পরনে চকোলেট রঙের ট্রাউজার্স আর সাদা হাফহাতা শার্ট, পায়ে কাবুলি চপ্পল, হাইট প্রায় ছ’ ফুট, চোখ দুটি ঝকঝকে, চাউনি দেখে বেশ বুদ্ধিমান বলে মনে হয়। হাতের হড়িটি আলগোছে মেঝের উপরে নামিয়ে রেখে, শার্টের বুকপকেট থেকে একটা খাম বার করে আমাদের উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের মধ্যে মিঃ ভাদুড়ি কার নাম?”

কোনও ব্যাপারে সন্দেহ বা ভয়ের কারণ ঘটলে সদানন্দবাবু সাধারণত যা করে থাকেন, এক্ষেত্রেও একটু আগে ঠিক তা-ই করেছিলেন। সম্ভবত তার ধারণা হয়েছিল যে, হাঁড়ির মধ্যে সাপ কিংবা কাকড়া বিছে থাকা কিছু বিচিত্র নয়। ফলে, মেঝের উপরে ছেলেটি হাঁড়ি নামিয়ে রাখার সঙ্গে-সঙ্গেই সদানন্দবাবু মেঝে থেকে সড়াক করে তার পা দু’টি সোফার উপরে টেনে নিয়ে একেবারে জোড়াসন হয়ে বসে পড়েছিলেন। সেই অবস্থায় আঙুল তুলে ভাদুড়িমশাইকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “উনি।”

হাতের খামখানা ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে ছেলেটি বলল, “আমার নাম ভূতনাথ দত্ত। শক্তিগড়ের ডাক্তার কৃপানাথ দত্ত আমার জ্যাঠামশাই। তিনি এই চিঠিখানা আপনাকে পাঠিয়েছেন।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বোসো।” তারপর খাম থেকে চিঠি বাব করে চটপট তার উপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে চিঠিখানাকে সেন্টার টেবিলের উপরে রেখে তার উপরে একটা পেপারওয়েট চাপা দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “কৃপানাথ কেমন আছে?”

“এখন ভালই আছেন।’ ছেলেটি বলল, “মাঝখানে জন্ডিস হয়ে মাস দুয়েক খুব ভুগলেন। ভীষণ দুর্বল হয়ে গেলেন। তারপর একটু থেমে থেকে বলল, “বললুম বটে এখন ভাল আছে, তবে দুর্বলতা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। নয়তো তিনি নিজেই আসতে।…আপনি যাবেন তো? আমরা কিন্তু সবাই খুব আশা করে আছি।”

যাবার প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কৃপানাথ তো তোমার জ্যাঠামশাই। তা তুমি ওর কোন ভাইয়ের ছেলে?”

“ছোট ভাইয়ের।”

“তার মানে বিশ্বনাথের। বিশ্বনাথ যে ফুটবলটা দারুণ খেলত, তা নিশ্চয় জানো?”

“জ্যাঠামশাইদের কাছে শুনেছি। বড় জ্যাঠামশাই আর মেজো জ্যাঠামশাই দু’জনেই বলেন যে, বাবার মতন স্ট্রাইকার নাকি ও তল্লাটে খুব বেশি ছিল না।”

“শুধু ও তল্লাটে কেন, কোনও তল্লাটেই খুব বেশি ছিল না।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তোমার ঠাকুর্দা তো বিশ্বনাথকে কলকাতায় আসতে দিলেন না। তা যদি দিতেন তো এখানকার বড়-বড় ক্লাবগুলোতে ওকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত।”

ভূতনাথ বলল, “তার খেলা আপনি দেখেছেন?”

“দেখেছি বই কী।” একটু যেন আনমনা হয়ে গেলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে মৃদু হেসে বললেন, “তোমার বয়েস এখন কত ভূতনাথবাবু?”

লজ্জিত গলায় ভূতনাথ বলল, “আমাকে বাবু’ বলবেন না, বাড়িতে সবাই আমাকে ভুতে বলে। আপনারাও তা-ই বলবেন।”

“ঠিক আছে, তা-ই বলব, তবে ‘বাবু’টাও ছাড়ব না। ধরে নাও যে, বাবুটা আমি আদর করে বলছি। তা ভুতোবাবু, তোমার বয়েস কত তা তো বললে না।”

“আজ্ঞে উনিশ চলছে। বর্ধমানে রাজ কলেজে পড়ি, এবারে বি, এ, ফাস্ট পার্টের পরীক্ষা দেব।”

“বাঃ, তা এখন তোমার যা বয়েস, তোমার বাবাকেও ঠিক সেই বয়েসেই আমি প্রথম দেখেছিলুম। সেও তখন ওই রাজ কলেজেই পড়ত। যেমন ছিল লেখাপড়ায় ভাল, তেমন খেলাধুলোয়। বল ট্র্যাপিং, ড্রিবলিং, শুটিং, কোনও ব্যাপারেই খামতি ছিল না। বডি সোয়ার্ভ করে, বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের ঝটকা দিয়ে যেভাবে বেরিয়ে যেত, সে তো আমার চোখে আজও ভাসছে। তা ভুতোবাবু, ফুটবলটা তুমিও খেলল তো?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, খেলি।” সেই একই রকমের লজ্জিত ভঙ্গিতে ভূতনাথ বলল, “তবে বাবার কথা যা শুনি, তত ভাল খেলতে পারি না।”

মেঝেতে যে হাঁড়িটা নামিয়ে রাখা হয়েছে, সে সম্পর্কে সদানন্দবাবুর সন্দেহ ইতিমধ্যে কেটে গিয়ে থাকবে, নয়তো সোফা থেকে তিনি ফের মেঝেতে পা নামাতেন না। তবে সন্দেহের জায়গায় এখন যে কৌতূহল দেখা দিয়েছে, সেটা আর তিনি চেপে রাখতে পারছে না। কিছুক্ষণ ধরেই উশখুশ করছিলেন, এবারে গলা খাঁকরে বললেন, “একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী জিজ্ঞেস করবেন, সে তো বুঝতেই পারছি। হাঁড়ির খবর জানতে চান, এই তো? তা শক্তিগড় থেকে যে হাঁড়ি এসেছে, তার মধ্যে কী থাকতে পারে বলে আপনার ধারণা?”

ভূতনাথের মুখ থেকে লজ্জার ভাবটা কেটে গিয়েছিল। হেসে বলল, “শক্তিগড়ের হেম ঘোষের দোকানের ল্যাংচা। বড় জ্যাঠামশাই আপনাদের জন্যে পাঠিয়েছেন।”

“তা তো হল,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু যেতে পারব কি না, হুট করে এখুনি তা তো বলা সম্ভব নয়। তুমি কি আজকের দিনটা কলকাতায় থাকবে?”

“আজ্ঞে না, কাল আমাদের খেলা রয়েছে, আজই আমাকে শক্তিগড়ে ফিরে যেতে হবে।”

“বেশ তো, তা-ই যেয়ো। কিন্তু দুপুরের ট্রেনেই যে ফিরতে হবে, তার তো কোনও মানে নেই। খেয়ে-দেয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে তারপর বিকেলের ট্রেন ধরলেই চলবে।… ওরে কৌশিক, তোর মাকে বল যে, ভুতোবাবু দুপুরে এখানেই খাবে। আর হ্যাঁ, ল্যাংচার হাঁড়িটা ভিতরে নিয়ে যা।”

কিন্তু কৌশিককে আর উঠতে হল না, একটা ট্রের উপরে মিষ্টি আর চায়ের কাপ নিয়ে পার্বতী ইতিমধ্যে ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকেছিল। ট্রেটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে মেঝে থেকে মিষ্টির হাঁড়ি তুলে নিয়ে সে জানাল যে, একটু বাদেই আমাদের খেতে বসার ডাক পড়বে। ভাদুড়িমশাই বললেন, “মা’কে বলে দে, এই দাদাবাবুটিও দুপুরে আমাদের সঙ্গে খাবেন।”

ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে-যেতে পার্বতী বলল, “মা’কে কিছু বলতে হবেনি মামাবাবু, সব দিকে তেনার নজর থাকে।”

ভূতনাথ অবশ্য দুপুরের খাওয়াটা এখান থেকে খেয়ে যেতে রাজি হল না। চা জলখাবার খেয়েই সে উঠে পড়ল। বলল, মানিকতলায় তার এক মাসির বাড়ি, তাকে বলা আছে যে, দুপুরে সে ওখানেই খাবে।

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে, কিন্তু আমার পক্ষে তোমাদের টুর্নামেন্টের খেলা দেখতে যাওয়া সম্ভব হবে কি না, সেটা তা হলে কী করে জানাব? এদিকে যে-সব কাজ জমে রয়েছে, তার একটা বিলিবন্দোবস্ত না করে তো যেতে পারছি না। তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব কী করে?”

“আপনি কেন যোগাযোগ করবেন,” ভূতনাথ হেসে বলল, “আপনাকে কিছু করতে হবে না। যেতে আদৌ পারবেন কি না, সেটা আপনি কখন বুঝতে পারবেন?”

“বিকেলের মধ্যেই বুঝে যাব।”

“ঠিক আছে, বড়-জ্যাঠামশাই তা হলে আজ রাত্তিরে… এই ধরুন নটা-দশটা নাগাদ আপনাকে ফোন করে সব জেনে নেবেন।”

“কৃপানাথ কোত্থেকে ফোন করবে?”

“কেন, আমাদের বাড়ি থেকে। গত বছরেই আমাদের বাড়িতে ফোন এসে গেছে।”

কথা শেষ করে ভূতনাথ আর দাঁড়াল না। ভাদুড়িমশাইকে প্রণাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

এতক্ষণ আমরা সবাই চুপ করেছিলুম। কথাবার্তা যা হবার, তা ভাদুড়িমশাই আর ভূতনাথের মধ্যেই হচ্ছিল। সদানন্দবাবুর কৌতূহলই সবচেয়ে বেশি, তাই তিনিই প্রথম মুখ খুললেন। “কৃপানাথবাবু কে মশাই?”

“বর্ধমানের বিখ্যাত ডাক্তার।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “লোকে বলে বর্ধমানের বিধান রায়। কৃপানাথের পৈতৃক বাড়ি অবশ্য বর্ধমান শহরে নয়, শক্তিগড়ে। সেখান থেকে রোজ দু’ বেলা বর্ধমানের খোসবাগানে ওর চেম্বারে গিয়ে বসে। দুর্দান্ত প্র্যাকটিস, দম ফেলার ফুরসত নেই। এদিকে আবার তারই মধ্যে এই ফুটবল টুর্নামেন্টের ঝক্কি সামলাতে হচ্ছে। অথচ বয়েস তো নেহাত কম হল না!”

বললুম, “আপনার বন্ধু?”

“ছেলেবেলার… মানে সেই যখন কলেজে পড়তুম তখনকার বন্ধু। ভাদুড়িমশাই বললেন, “আই এসসির দুটো বছর একসঙ্গে পড়েছি। আই এসসি পাস করে ও গিয়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়। কিন্তু কলেজ আলাদা হলে কী হবে, কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিন আর মির্জাপুর স্ট্রিটের ফেভারিট কেবিনে তখনও রোজ আড্ডা দিয়েছি। ময়দানে গিয়ে ফুটবল খেলাও দেখেছি একসঙ্গে। তারপরে যা হয় আর কি, ডাক্তারি পাস করে ও চলে গেল শক্তিগড়ে, তারপর পশার একটু জমে উঠতে বর্ধমানে গিয়ে চেম্বার খুলল। বাস্, “আমরা দুজনে দুই কাননের পাখি।”

সদানন্দবাবু বললেন, “দ্যাকাসাক্ষাৎ হয়?”

“কালেভদ্রে। শেষ দেখা হয়েছিল নাইনটিন সিক্সটি সেভেনের অক্টোবরে। ওদের শক্তিগড়ের বাড়িতে সেবারে একটা উইকএন্ড কাটিয়ে আসি।”

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “আঃ, সে-দুটো দিনের কথা এখনও ভুলিনি। পুকুরে মাছ ধরা হল, চড়ুইভাতি করা হল, গানে গল্পে ছুটির দুটো দিন যে কোথা দিয়ে কেটে গেল, টেরই পেলুম না।”

আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। বুঝলুম, স্মৃতি রোমন্থন করছে। খানিক বাদে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “কৃপানাথের ছোটভাই বিশ্বনাথের কথা হচ্ছিল না? বিশ্বনাথের খেলা সেবারেই দেখি।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “একটু আগে আপনি যা বলছিলেন, তাতে তো মনে হয় দুর্ধর্ষ স্ট্রাইকার ছিলেন। সত্যি?”

“ষোলো আনার উপরে আঠারো আনা সত্যি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি একটুও বাড়িয়ে বলিনি অরুণ। উনিশ বছরের ছেলেটা দেখলম চুনির মতন ঝটকা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, আবার শুটিং পাওয়ারও প্রদীপের মতো। তা ছাড়া দরকারমতো নিজের স্পিড যেভাবে বাড়িয়ে কমিয়ে খেলছিল, আসলে সেটাই চিনিয়ে দিচ্ছিল ওর জাত। বুঝতে পারছিলাম যে, ফুটবলটা ওর রক্তের মধ্যে রয়েছে।”

কৌশিক দেখলুম মুখ টিপে হাসছে। বললুম, “হাসছ যে? বড়মামার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?”

“না না, বিশ্বাস হবে না কেন?” কৌশিক বলল, “তবে কিনা আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলুম। মানে একটু আগেই বোস-জেঠুর কাছে আমরা নসিপুরের হালা বাঁড়ুজ্যের গপ্পো শুনেছি তো, তাই ভাবছিলুম যে, শক্তিগড়ের বিশ্বনাথ দত্তও কি সেই গোত্রের খেলোয়াড়।”

শুনে সদানন্দবাবু হাঁ করে ঝাড়া এক মিনিট কৌশিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “সেই গোত্রের মানে?”

“মানে হালা বাঁড়ুজ্যে তো আর নিজে খেলতেন না, ভূতেরা তাঁর হয়ে খেলে যেত। তা শক্তিগড়ের বিশ্বনাথ দত্তের হয়েও কি তেনারাই খেলতেন নাকি?”

কৌশিকের কথা শুনে ভাদুড়িমশাই হোহো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “না রে কৌশিক, আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না। বুঝতে পারছি, চুনি আর প্রদীপের সঙ্গে তুলনা টেনেছি বলে তুই চটে গেছিস, কিন্তু যেমন চুনি তেমনি প্রদীপকেও তো আমি ভালই চিনি, তাই হলফ করে বলতে পারি যে, বিশ্বনাথের খেলা দেখলে ওরা কিন্তু একটুও চটত না, বরং মফসল থেকে ছেলেটাকে যাতে কলকাতার ময়দানে নিয়ে আসা যায় তার চেষ্টা করত।”

কৌশিক বলল, “সে-চেষ্টা কেউ কখনও করেনি?”

“করেছে বই কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কৃপানাথের কাছে শুনেছি, কলকাতার অন্তত একটা বড় ক্লাব ওকে এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল।”

“মোহনবাগান?’

“ওই তো তোদের মুশকিল, বড় ক্লাব বলতে তোরা আজকাল শুধু মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গলকেই চিনিস। কিন্তু এ হল ত্রিশ বছর আগেকার কথা। তখন ফুটবলের মাঠে ইস্টার্ন রেলেরও দাপট নেহাত কম ছিল না। প্রদীপ মানে পি কে বরাবর কোথায় খেলত জানিস? মোহনবাগানেও না,ইস্টবেঙ্গলেও না, ওইইস্টার্ন রেলে। তোইস্টার্ন রেলেরই এক কর্তা—যদুর মনে পড়ছে, কে দাশ-ওকে চাকরি দিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কেন যে বিশ্বনাথের কলকাতায় আসা হল না, তাও তো একটু আগেই বলেছি। আসলে কৃপানাথের বাবাই তার এই ছোট ছেলেটিকে কলকাতায় আসতে দিলেন না।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “সে একপক্ষে ভালই হয়েছে। ময়দানের নানা নোংরামির খবর আজকাল কাগজে খুব বড়বড় টাইপে ছাপা হচ্ছে। কিন্তু ভাবের ঘরে চুরি করে তো কোনও লাভ নেই, নোংরামিটা নেহাত গত দু-চার বছরের ব্যাপার নয়, ওটা আগেও অল্পবিস্তর ছিল। যেমন এখন রয়েছে, তেমনি সেভেন্টিজেও ছিল। বিশ্বনাথ দত্ত তখন যদি কলকাতায় খেলতে আসনে তো সেই নোংরা কাদার একটু-আধটু ছিটে কি আর তারও গায়ে লাগত না?”

আমি বললাম, “অরুণ, তুমি ভুল বলোনি। তবে কিনা নোংরামি তখনও ছিল বটে, কিন্তু আজকের মতন এতটা ছিল না। তা ছাড়া নোংরামির চরিত্রও যে ইতিমধ্যে পালটেছে, সেটাও খেয়াল করো। স্পিড আর স্ট্যামিনা বাড়াবার জন্যে খেলোয়াড়রা ওই যে কী সব গোলমেলে ট্যাবলেট খেয়ে মাঠে নামছে বলে শুনতে পাই, এরকম কথা কি আগে কখনও শোনা যেত?”

অরুণ সান্যাল বললেন, “কিন্তু ও-সব যারা খায়, খানিকক্ষণের জন্যে আর্টিফিশিয়ালি ওতে করে কিছুটা সুবিধে হয় ঠিকই, কিন্তু আলটিমেটলি তো স্বাস্থ্যের একেবারে বারোটা বেজে যায়, কিরণদা। আর তা ছাড়া ড্রাগ-অ্যাডিক্ট হয়ে পড়ারও তো একটা ভয় রয়েছে। বঁড়শিতে একবার আটকে গেলেই তো সর্বনাশ!”

“সে তো ঠিকই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মারাদোনার যা হয়েছিল আর কী। অত বড় খেলোয়াড়, কিন্তু ওয়ার্ড কাপে ইউরিন টেস্টে ধরা পড়ল যে, ডোপ করে মাঠে নেমেছে। তখন তো বেইজ্জতির একশেষ!”

সদানন্দবাবু বললেন, “আরে ছা ছ্যা, কৌশিক আবার এর সুখ্যাত করছিল! আরে বাবা, খেলতে নেবেছিস তো নিজের জোরে খেলে যা! সেই যেমন শিবে ভাদুড়ি আর বিজয় ভাদুড়ি খেলত, সামাদ খেলত, লক্ষ্মীনারায়ণ আর মুর্গেশ খেলত! তা নয়, তোরা কিনা নেশা করে মাঠে নাবছিস? আরে ছ্যা ছ্যা, এ-রকম নোংরামির কথা কি আগে কখনও ভাবা যেত?”

অরুণ সান্যাল বললেন, “শুধু খেলোয়াড়দের দোষ দিযেই বা লাভ কী, সাপোর্টাররাও সব তেমনি হয়েছে! কী না, আমি যার সাপোর্টার, সব খেলাতেই তাকে জিততে হবে, একটা খেলাতেও তার হারা চলবে না! আরে মশাই, তা-ই কখনও হয়? এ তো খুবই সহজ কথা, কিন্তু শুনছে কে? হারলেই মারদাঙ্গা লাগিয়ে দেব, দল বেঁধে মাঠে নেমে খেলা ভণ্ডুল করে ছাড়ব, তারপর মাঠের বাইরেও দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে দিতে ছাড়ব না।”

“দক্ষযজ্ঞ বলতে পারো, লঙ্কাকাণ্ডও বলতে পারো,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সাপোর্টারদের যা-সব স্যা ‘দেখছি, তাতে তো মনে হয়, প্যান্টুল খুললেই অনেকের ন্যাজ বেরিয়ে পড়বে!”

কৌশিক বলল, “শুধু কলকাতার সাপোর্টারদের দোষ দিচ্ছ কেন, ইংরেজ সাপোর্টারদের তুলনায় তো এরা পারফেক্ট ভদ্দরলোক। ইংল্যান্ড যখন অন্য দেশে খেলতে যায়, এই সাপোর্টাররা তখন সেখানে গিয়ে যা-সব কাণ্ড করে, তা আর কহতব্য নয়। সেই জন্যে তো ওদের বাইরে যাওয়াই বন্ধ করে দিতে হয়েছে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তো ইংরেজদের নকল করার ঝোঁক ক্রমেই বাড়ছে। আমাদের মধ্যে কেউ-কেউ তো দেখি ইংরেজদের চেয়েও বেশি ইংরেজ! তা এবাবে খেলার মাঠে বাঁদরামির ব্যাপারেও বোধহয় ওদের আমরা ছাড়িয়ে যাব।”

আমি বললুম, “মফসসলের খেলা কিন্তু আমাদের এই কলকাতার তুলনায় অনেক ভাল। গ্রামের পুজোয় যেমন একটা শান্ত ভদ্র চেহারা এখনও চোখে পড়ে, মফস্সলের ছোটখাটো গাঁ-গঞ্জেও তেমনি দেখবেন শহরের খেলার মাঠের এই উচ্ছল ব্যাপারটা এখনও ঢোকেনি।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশ তো, তা হলে আমার সঙ্গে চলুন।”

“তার মানে?”

“কৃপানাথের চিঠিখানা পড়ুন, ভাদুড়িমশাই ঠোঁট টিপে হেসে বললেন, “মানেটা তা হলেই বুঝতে পারবেন।” বলে, ভূতনাথ তার বড়-জ্যাঠামশাইয়ের যে চিঠিখানা ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিল, সেন্টার টেবিল থেকে সেটা তুলে তিনি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। চিঠিখানা এখানে তুলে দিচ্ছি :

ভাই চারু,

সেই যে বছর ত্রিশ আগে তুমি আমাদের শক্তিগড়ের গ্রামের বাড়িতে একবার এসেছিলে, তারপরে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে মোটরযোগে যাতায়াতের পথে বার কয়েক বর্ধমানে আমার চেম্বারে এসে দেখা করে গিয়েছ বটে, কিন্তু গ্রামের বাড়িতে আর-কখনও আসোনি। অথচ যখনই দেখা হয়, তখন তো বটেই, চিঠিতেও বহুবার তুমি জানিয়েছ যে, শক্তিগড়ের বাড়ির সেই মধুর স্মৃতি তোমার চিত্তে এখনও অম্লান, এবং আবার তুমি সেখানে এসে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে চাও। কিন্তু কাজের চাপে কিছুতেই তোমার আসা হয় না।

কিন্তু ভাই, এবারে আর কাজের অজুহাত দিয়ো না। আজ রবিবার। আর ক’টা দিন বাদে সামনের উইকএন্ডটা এখানে এসে কাটিয়ে যাও। শনিবারের বদলে যদি শুক্রবার সকালে ট্রেনে অথবা মোটরযোগে এখানে পৌঁছে যাও তো আরও ভাল। তা হলে বিশ্বনাথের নামে আমরা এখানে যে ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু করেছি, তার সেমিফাইনাল ও ফাইনালের খেলা তুমি দেখতে পাবে। ফাইনাল হচ্ছে রবিবার বিকেলে। তুমি প্রিসাইড করবে ও পুরস্কার বিতরণ করবে।

শক্তিগড় এখন আর সেই শক্তিগড় নেই, তুমি ভালই জানেনা। তবে আমাদের পুকুরটা আছে। তাতে মাছও আছে প্রচুর। শনিবারে খেলা থাকবে না, সেদিন ছিপ ফেলে মনের আনন্দে মাছ ধরতে পারবে।

এসো ভাই, নইলে আমার মুখরক্ষা হবে না। ইতি :

কৃপানাথ।

পুনশ্চ। বাঙ্গালোরে ফোন করে জানলাম যে, তুমি এখন কলকাতায়।

কাঁকুরগাছির ফ্ল্যাটের ঠিকানা তাঁরাই দিয়েছেন।–কৃপা

চিঠিখানা জোরে-জোরে পড়ে শোনাতে হল, যাতে সবাই শুনতে পান। পড়া শেষ হয়ে যাবার পরে সদানন্দবাবু বললেন, “আজ হল গে রোববার, ৬ এপ্রিল। তার মানে শুক্রবার হল ১১ এপ্রিল। তিনটে দিন… মানে এগারো, বারো আর তেরোই এপ্রিল শক্তিগড়ে কাটিয়ে চোদ্দো তারিখ সোমবার সকালে কলকাতায় ফিরে আপিস করা যাচ্চে। মন্দ কী!”

কৌশিক বলল, “আপনি তো রিটায়ার্ড ম্যান বোস-জেই, আপনার আবার আপিস কিসের?”

“আরে বাবা, আমি কি আর আমার কতা ভাবছিলুম?”

আমি বললুম, “সম্ভবত আমার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু নেমন্তন্নটা তো আপনারও নয়, আমারও নয়, ভাদুড়িমশাইয়ের। আপনার-আমার যাবার কথা অতএব উঠছেই না।”

“আরে না না, আমি একা যাব কেন?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যদি যাই তো সবাই মিলেই যাওয়া হবে। কী রে কৌশিক, যাবি?”

“অসম্ভব।” কৌশিক বলল, “টিকিট কাটা হয়ে গেছে, রিজার্ভেশন কনফার্ড, বুধবারে আমি বাঙ্গালোরে ফিরছি। আমার যাওয়ার কোনও কথাই উঠছে না।”

“কিরণবাবু, আপনি?”

“গেলে তো ভালই হয়।” আমি বললুম, “দিব্যি একটা আউটিং হয়ে যায়। ফাইভ-ডে উইকের শনি আর রবি তো ছুটি, বাকি রইল শুক্রবার। ও একটা দিন ক্যাজুয়াল নিয়ে নেব।”

“সদানন্দবাবু?”

“আমি তো যাবার জন্যে এক পা তুলে রেডি হয়েই আছি।” সদানন্দবাবু বললেন, “তা যাব কিসে? হাওড়া থেকে লোকাল ট্রেনে, না বাড়ি থেকে টানা মোটরগাড়িতে?”

“গাড়িতেই যাব। সকাল ছ’টা নাগাদ বেরিয়ে পড়ব, লেবেল ক্রসিংয়ে যদি আটকে না যাই তো শক্তিগড়ে পৌঁছতে দু’ঘণ্টার বেশি লাগবে না।”

পার্বতী এসে বলল, “মা বললেন, টেবিলে খাবার দেওয়া হয়ে গেছে, আপনারা এসে বসে পড়ুন।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ রে পার্বতী, যে ছেলেটা দেখা করতে এসেছিল, তোকে যখন তার নাম বলতে বললুম, তখা তুই বললি, “সে আমি বলতে পারবনি। তার মানে তোর স্বামীর নাম নিশ্চয় ভূতনাথ। তাই না?”

শুনে, মুখ নিচু করে পার্বতী যেভাবে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল, তাতে বুঝলুম, ভাদুড়িমশাই ব্যাপারটা ঠিকই আঁচ করেছেন।

টেবিলে খেতে বসে শক্তিগড়ে যাওয়ার ব্যাপারে আর কোনও কথা হল না। খাওয়া শেষ হবার পরে ড্রয়িংরুমে ফিরে এসে বললুম, “আচ্ছা, ফুটবল টুর্নামেন্টটা বিশ্বনাথ দত্তের নামে হচ্ছে কেন? উনি কি…”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ, বেঁচে নেই। পনরো বছর আগে মারা গেছে। ভূতনাথ তখন নেহাতই বাচ্চা। বাবার কথা ওর কিছু মনে নেই।

.