ভুতুড়ে ফুটবল – ১

॥ ১॥

“এ তো বড় অদ্ভুত ব্যাপার, মামাবাবু!” হাতের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই কৌশিক বলল, “আমাদের জার্নালিস্টদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? এদের কি কাণ্ডজ্ঞান বলে। কিছু থাকতে নেই?”

কথাটা ভাদুড়িমশাইয়ের উদ্দেশে বলা হয়েছিল, কিন্তু তিনি কোনও উত্তর দিলেন না। সম্ভবত কিছু শুনতেই পাননি। না-পাওয়াই স্বাভাবিক। কেন না, নিবিষ্টচিত্তে তিনি এখন ইস্টার্ন কুরিয়ার’-এর আজকের ওয়ার্ড-জাম্বলের উত্তর খুঁজছেন।

নিজে যেহেত খবরের কাগজে কাজ করি, তাই কী খবর দেখে জার্নালিস্টদের কাণ্ডজ্ঞান সম্পর্কে কৌশিকের হঠাৎ সন্দেহ দেখা দিল, এই পালটা প্রশ্নটা করতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু মুখ খুলবার ফুরসত পেলুম না, সদানন্দবাবু একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে বললেন, “ঠিক বলেচ, লাক কতার এক কর্তা বলেচ! আরে ছ্যা ছ্যাঁ, এই কি তোদের কাণ্ডজ্ঞান? দেকতে পাস না চোকের সামনে কী হচ্চে?”

অরুণ সান্যাল একটা সদ্য-আসা মেডিক্যাল জার্নালের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। সেটা সরিয়ে রেখে বললেন, “কী হচ্ছে বোসদা?”

“বাঃ, তাও বলে দিতে হবে?” সদানন্দবাবু তার গলার পর্দা আরও এক ধাপ চড়িয়ে বললেন, “শহরটা যে চোর ছ্যাচড়ে আর গুণ্ডা-বদমাসে ভরে গেল, মশাই! আজ এখোনে ফ্ল্যাটে ঢুকে বন্দুক উঁচিয়ে ডাকাতি করছে তো কাল ওভেনে দিন-দুপুরে বোম ফাটিয়ে টাকার থলে কেড়ে নিচ্ছে! আর খবরের কাগজের লোকগুলোও হয়েছে তেমনি। এই যে ল-লেসনেস, কোতায় এর এগেস্টে রোজ একটা করে কড়া এডিটোরিয়েল লিকবি, তা নয়, তোরা আছিস শুদু পলিটিকস নিয়ে! কে কাকে নিকম্মার ধাড়ি বলেচে আর কার বউ। সরকারি বাড়িতে খাটাল বসিয়ে লাখ টাকার দুধ বিক্রি করচে! তা বলুক না, করুক না! নিকম্মাই বলুক আর অকম্মাই বলুক, দুধই বেচুক আর রাবড়িই বেচুক, তাতে তোর কী! খালি পলিটিক্স আর পলিটিকস! ঠিক বলেচ কৌশিক বাবাজি, এই পলিটিক্সই আমাদের ডুবিয়ে ছাড়ল!”

কৌশিক বলল, “যাব্বাবা! আমি মোটেই পলিটিকসের কথা ভাবছি না।”

সদানন্দবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, “পলিটিক্স নয়? তা হলে?”

ভাদুড়িমশাইয়ের জাম্ব মিলে গিয়েছিল। মৃদু গলায় বললেন, “হয়েছে। একটা ‘ই’ পাচ্ছিলুম না। তা উলটে-পালটে ‘সেনল্যাক’ যদি ক্যানসেল হয় তো তার মধ্যেই তো ‘ই’ পেয়ে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে ম্যাজিক ওয়র্ডটা তা হলে দাঁড়াল ‘ক্রিকেট’। ও হ্যাঁ, তুই যেন কী বলছিলি কৌশিক?”

“আমি পলিটিক্‌সের কথাও ভাবছিলুম না, ক্রিকেটের কথাও ভাবছিলুম না। যেখানে মাত্তর একশো কুড়িটা রান দরকার, সেখানে একশো রান তুলতেই যাদের কালঘাম ছুটে যায়, তাদের নিয়ে আবার ভাববার কী আছে?”

অরুণ সান্যাল বললেন, “তা হলে?”

“আমি ভাবছিলুম ফুটবলের কথা।”

“অ্যাঁ, ক্রিকেটের তুলনায় ফুটবলটা কি আমরা ভাল খেলছি নাকি?”

“চুনি-পি কেবলরামের সময়ে যা খেলতুম, সেই তুলনায় অর্ধেক ভালও খেলছি না; তবে হ্যাঁ, মাঝখানে যে অধঃপতনটা ঘটেছিল, সেটা একটু সামলে নেওয়া গেছে। এবারকার ন্যাশনাল লিগ আর নেহরু কাপের খেলা দেখে অন্তত সেইরকমই মনে হল।”

একটুক্ষণ চুপ করে রইল কৌশিক। তারপর বলল, “কিন্তু মুশকিলটা কী হয়েছে জানো বাবা?”

অরুণ সান্যাল ফুটবল বলে কথা নেই, কোনও খেলারই খবর বিশেষ রাখেন না। মাঠ-ময়দানের ব্যাপার-ট্যাপার নিয়ে আসলে কোনও উৎসাহই নেই তার। তবু ছেলের কথার উত্তরে কিছু একটা না বললে ভাল দেখায় না বলেই আমতা-আমতা করে বললেন, “কেন, আবার কী মুশকিল হল?”

“কী মুশকিল হল, সেটা কিরণমামাকে জিজ্ঞেস করো।” বলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই তোমরা মানে জার্নালিস্টরাই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। ফুটবলে আমাদের পারফরম্যান্সের গ্রাফের লাইনটা যেই না একটু উপরে উঠতে শুরু করেছে, অমনি তোমরা এমন হই-হই বাধিয়ে দিলে যে, আর দেখতে হবে না, লাইনটা আবার মুখ থুবড়ে পড়ল বলে!”

কথার ঝাঁঝ থেকেই বোঝা যাচ্ছিল কৌশিক বেশ রেগে গেছে। কিন্তু রাগের কারণটা যে কী, সেটাই ঠিক ধরতে পারছিলুম না। ভাদুড়িমশাই, সদানন্দবাবু আর অরুণ সান্যালের মুখ দেখে মনে হল, তারাও কিছুই ধরতে পারেননি। ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু বুঝিয়ে বলবি?”

সদানন্দবাবু বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু বুজিয়ে বলো তো।”

“এর মধ্যে আর বোঝাবুঝির কী আছে?” কৌশিক তার হাতের ‘বিশ্ববার্তা’ কাগজখানা আমার দিকে এগিয়ে ধরে, খেলার পাতার একটা তিন-কলম-জোড়া হেডলাইনের উপরে আঙুল রেখে বলল, “পড়ে দ্যাখো, তা হলেই সব বুঝতে পারবে।”

বিশাল টাইপের বিরাট হেডলাইন, ‘যে গোল দেখলে পেলে আর মারাদোনাও তাজ্জব হয়ে যেত!

সদানন্দবাবু বললেন, “পড়ে শোনান, পড়ে শোনান, আমরাও শুনতে চাই।”

অগত্যা যেমন হেডলাইন তেমন কোচি থেকে পাঠানো প্রতিবেদনও পড়ে শোনাতে হল। বিশ্ববার্তার স্পোর্টস রিপোর্টার ধনঞ্জয় চাকলাদার লিখছেন : “উজবেকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের আই, এম, বিজয়ন যে গোলটি করলেন, তাকে বিশ্বমানের গোল বললেও খুব কমই বলা হয়, কেন না ইউরো কাপ আর কোপা আমেরিকার কোনও খেলাতেই এমন অত্যাশ্চর্য গোল দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়নি। এমন কী, গত তিন বারের বিশ্বকাপেও না। দুদিকে দুই হুমদো-জোয়ান উজবেক ডিফেন্ডার, ভাল করে ঘুরে দাঁড়াবার জায়গাটুকু না রেখে তারা বিজয়নের গায়ের সঙ্গে একেবারে আঠার মতন সেঁটে রয়েছে, অথচ তারই মধ্যে সামান্য একটু টলে গিয়ে, বলটাকে অল্প তুলে নিয়ে, মুখ না ঘুরিয়েই বিজয়ন যে বাইসিকল কিক করলেন, গোলকিপারের মাথার উপর দিয়ে তাতেই বল গিয়ে জালে জড়িয়ে গেল। এ একেবারে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ। দর্শকরা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেননি, তারপরেই তারা উল্লাসে ফেটে পড়েন। উন্নাস স্বাভাবিক, কেন না অনেক ভাগ্য করে জন্মালে তবেই এমন একটি গোল দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। সত্যি বলতে কী, পেলে আর মারাদোনাও এই গোল দেখলে তাজ্জব হয়ে যেতেন। তবে আমার ধারণা, ভারতের মাঠে এই ধরনের গোল হয়তো আমরা আর দেখতে পাব না, কেন না বিদেশিরাও বিজয়নের এই খেলা টিভির পর্দায় দেখেছে নিশ্চয়, এবং এই গোলের পরে ব্রিটেনের ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড, স্পেনের রিয়েল মাদ্রিদ, হল্যান্ডের আয়াক্স, ইতালির এ সি মিলান ও আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্স থেকে বিজয়নের ডাক পড়তে বাধ্য। আসন্ন, অনিবার্য সেই দিনটিকে আজ আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এইসব বিশ্ববিখ্যাত ক্লাবের ধনকুবের কর্তারা যখন চেকবই হাতে নিয়ে বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনের জাম্বো জেট থেকে দিল্লি, কলকাতা, মুম্বই কি চেন্নাই এয়ারপোর্টে এসে নামবেন ও নেমেই কানেকটিং ফ্লাইট ধরে যাত্রা করবেন তিরুবনন্তপুরমের দিকে, এবং…”

.

“থাক্, থাক্‌, কিরণমামা, আর পড়ার দরকার নেই।” পুরো সেনটেন্সটা কমপ্লিট করার আগেই কৌশিক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “যেটুকু পড়েছ, তাতেই তোমাদের জার্নালিস্টদের কাণ্ডজ্ঞানের বহরটা টের পাওয়া যাচ্ছে, এর পরে তুমি নিজেই বোধহয় বিষম খেতে শুরু করবে!”

কাগজ থেকে মুখ তুলে দেখলুম, ভাদুড়িমশাই আর অরুণ সান্যাল মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাসির বেগ সামলাচ্ছেন। তারই মধ্যে সদানন্দবাবুকে দেখে একটু অবাক হতে হল। কেন না, একমাত্র তারই মুখে হাসি নেই। গম্ভীর গলায় বললেন, “এতে এত হাসির কী আচে?”

কৌশিক বলল, “নেই? তার মানে আপনিও মনে করেন যে, ভাল একটা গোল করেছে বলেই বিশ্ববিখ্যাত এইসব ক্লাব অমনি বিজয়নকে নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দেবে?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ডেসক্রিপশান থেকে তো মনে হচ্ছে…মানে অন্য সব কাগজও দেখলুম তো…তাতে তো বলতেই হয় যে, গোলটা সত্যিই চমৎকার দিয়েছে।”

“আহা-হা, আমি কি বলছি যে, ওটা চমৎকার গোল নয়? অফ্ কোর্স ইট ওয়াজ আ ব্রিলিয়ান্ট গোল! কিন্তু তাই বলে যদি কেউ বলে যে, পেলে আর মারাদোনাও এই গোলটা দেখলে তাজ্জব হয়ে যেত, তো আমি বলব তার কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিসসু নেই!”

“দ্যাকো কৌশিক, সদানন্দবাবু বললেন, “এর মদ্যে তুমি দু-দুবার পেলে আর মারাদোনার নাম করেছ। তো একটা কতা তোমাকে জিগেস করতে পারি?”

“করুন।”

“এঁয়ারা কারা?”

“যাব্বাবা,” হতভম্ব হয়ে কৌশিক বলল, “এরা কারা, আপনি জানেন না? এঁরা হচ্ছেন সেই তারা, ফুটবলে যাদের অল-টাইম গ্রেট বলা হয়। কেন, টিভিতে আপনি মারাদোনার খেলা দেখেননি?”

সানন্দবাবুর মুখ দেখে মনে হল না যে, কৌশিকের কথা শুনে তিনি বিন্দুমাত্র দমে গিয়েছেন। একই রকমের গম্ভীর গলায় বললেন, “না হে, দেকিনি। কিন্তু তাতে হলটা কী?”

কৌশিক হেসে বলল, “কী আর হবে, একজন জিনিয়াস কীভাবে ফুটবলটাকে নিয়ে যা-খুশি তা-ই করতে পারে, সেটা দেখতে পাননি, এই আর কী।”

“বটে? তা ফুটবল নিয়ে যা-খুশি তা-ই কি একা ওই লোকটাই করতে পারত?”

“আর-কেউ পারত…মানে পেলের পরে এক ওই মারাদোনা ছাড়া আর কেউ পারত বলে তো জানি না।” ঠাট্টার গলায় কৌশিক বলল, “কেন, আপনি কি জানেন নাকি?”

সদানন্দবাবু তক্ষুনি এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। চা এসে গিয়েছিল। নিজের পেয়ালায় আলতো একটা চুমুক দিয়ে পেয়ালাটাকে ধীরেসুস্থে পিরিচের উপর নামিয়ে রেখে তিনি কৌশিকের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “হাবল। বাঁড়ুজ্যের খেলা দেকেচ?”

এবারে কৌশিকেরই ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার পালা। আমতা-আমতা করে বলল, “না

“কী করেই বা দেকবে।” ঠোঁট বেঁকিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “তোমার তো কতাই ওটে না, তোমার বাবাও তখনও জন্মাননি।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “অ্যাঁ, বলেন কী! তিনি কবেকার মানুষ?”

“ফাস্ট ওয়ার্লড ওয়ার তো ১৯১৪ সালে লাগে, তিনি তারও বারো বছর আগে, অর্থাৎ নাইনটিন হানড্রেড টু’তে জন্মেছিলেন। ছেলেবেলায় আমরা তার খেলা দেকিচি। উঃ, সে কী খেলা রে বাবা, হরিচরণ মেমোরিয়াল শিল্ডের খেলায় উঁচড়ো ইউনাইটেডকে একাই এক ডজন গোল দিয়েছিলেন।”

কৌশিক বলল, “কলকাতায় খেলতেন?”

“আমাদের ময়দানের কতা বলছ তো? মাত্তর একবারই এখেনে খেলতে নেবেছিলেন। এ হল নাইনটিন টুয়েন্টির কতা। গোরা টিমের সঙ্গে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। সায়েবগুলোকে তাতেই এমন কঁদিয়ে ছাড়েন যে, সেই রাত্তিরেই গলির ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তারা একজন মেসেঞ্জার পাটিয়ে দেয়। মেসেঞ্জার গিয়ে হাকিমকে বলে, স্টপ দিস হালা বাঁড়ুজ্যে, ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া আইনে ওর মুভমেন্ট রেসট্রিকট করো, ওকে যদি কলকাতায় আসতে দাও, তা হলে এখেনে ল অ্যান্ড অর্ডার মেনটেন করা যাবে না, ব্রিটিশ গবরমেন্টের প্রেস্টিজ ও একেবারে পাংচার করে দেবে। ব্যস, হালা বাঁড়ুজ্যে তার পরদিন তারকেশ্বর লাইনের নসিপুরে তার বাড়িতে ফিরতেই কুম জারি হয়ে গেল যে, হুগলি জেলার চৌহদ্দি ছেড়ে তিনি কোতাও যেতে পারবেন না। তার ফল কী হল, ভাবতে পারো?”

“কী হল?”

“নাইনটিন টুয়েন্টিতেই মোহনবাগান ফর দি সেকেন্ড টাইম আই এফ এ শিল্ড জেতার যে চেষ্টা চালাচ্ছিল, আর তার জন্যে হাবলা বাঁড়ুজ্যেকে টিমে ঢোকাবার ব্যবস্থা একেবারে পাকা করে ফেলেছিল, সেটা আর সাকসেসফুল হল না।”

“এ সব কথা আপনি কার কাছে শুনলেন?”

“কেন, আমার বাবার কাছে।” চায়ের পেয়ালায় শেষ চুমুক দিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “ওহে বাপধন, সারা জীবন সায়েব চরিয়ে খেয়েচি, সায়েব চিনতে আর আমার বাকি নেই। ওদের মদ্যে আমাদের কোম্পানির জেঙ্কি সায়েবের মতো ভাল মানুষ যেমন আচে, তেমনি কুচুটে বজ্জাতও কি কিছু কম আচে নাকি? তা যদি না থাকত, তো মারাদোনার নাম না কপচে তোমরা আজ হাবলা বাঁড়ুজ্যেকে মাথায় তুলে নাচতে।”

ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলুম, তার চোখের মধ্যে ঈষৎ কৌতুকের ছোঁয়া লেগেছে, তবে হাসিটাকে তিনি ঠোঁট পর্যন্ত আসতে দিচ্ছেন না। বললেন, “একটু আগে বলছিলেন যে, ছেলেবেলায় আপনি তার খেলা দেখেছেন। এটা কোথায় দেখলেন?”

“সিঙুরে।” সদানন্দবাবু বললেন, “তারকেশ্বর বলতে যে জায়গাটা আপনারা বোজেন, আমরা তো ঠিক সেখেনকার লোক নই। ওর খুব কাঁচেই হচ্ছে সিঙুর। আমরা সেই সিঙুরের বাসিন্দা। সেখানকার মাঠে হাবলা বাঁড়ুজ্যের খেলা আমি ফর দি ফাস্ট টাইম দেকি। আমার বয়স তখন আব কত হবে, মেরেকেটে পাঁচ কি ছয়। সেদিনকার খেলার ডিটেলস আমার মনে নেই, তবে এটা ভুলিনি যে, হাফটাইমের আগেই একটা লোক দমাদ্দম চার-পাঁচটা গোল হাঁকড়ে দিয়েছিল। পরে শুনলুম, সে-ই হচ্চে হাবলা বাঁড়ুজ্যে।”

“দ্বিতীয়বার তাঁর খেলা কবে দেখলেন?”

“ইন দি ইয়ার নাইনটিন ফফটি টু।” সদানন্দবাবু বললেন, “জাপানিরা হাতিবাগানে বোমা ফেলেছিল বলে আমরা সেবার কলকাতার পাট তুলে দিয়ে মাস ছয়েকের জন্যে আমাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যাই।”

“নাইনটিন ফর্টি টু?“ ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনারই হিসেবে হাবলা বাঁড়ুজ্যের বয়েস তো তখন চল্লিশ হয়ে গেছে!”

“তা তো হয়েইছে। কিন্তু এই বুড়ো হাড়েই যা ভেলকি দেকালেন না…উফ!” সদানন্দবাবু দু’ হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন, “অপূর্ব, অপূর্ব! সেই খেলাতেই তো চুচড়ো ইউনাইটেডকে গুনে-গুনে এক ডজন গোল দেন! কী বলব মশাই, খেলাটা যেন এখনও আমার চোকের সামনে ভাসচে! ইদিকে হাল্লা, ওদিকে হালা, সিদিকে হাল্লা…যেদিকে তাকাই, শুধু হাল্লা আর হাল্লা! গোটা মাঠে তাকে ছাড়া কাউকে দেতে পাই না! ভাবা যায়?”

একটুক্ষণের জন্য চুপ করলেন সদানন্দবাবু। তারপর একটু গলা নামিয়ে বললেন, “কিন্তু তার এক হপ্তা বাদেই ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা! উঃ, সেকতা ভাবলে এখনও গায়ে কঁটা দেয়।”

কৌশিক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সদানন্দবাবুর শেষ কথাটায় একটা রোমাঞ্চকর গল্পের গন্ধ পেয়ে যাওয়ায় অরুণ সান্যাল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আঃ, তুই দেখছি বকরবকর করেই সক্কলের মাথা ধরিয়ে দিবি। একটু চুপ কর তো। …নিন বোদা, কী ঘটেছিল বলুন।”

আজ রবিবার, ৬ এপ্রিল। কৌশিককে সঙ্গে নিয়ে ভাদুড়িমশাই গত শুক্রবার কলকাতায় এসেছেন। কৌশিক বুধবার বাঙ্গালোরে ফিরে যাবে, কিন্তু ভাদুড়িমশাই তাঁর সি বি আই অর্থাৎ চারু ভাদুড়ি ইনভেস্টিগেশনসের একটা আপিস যেহেতু এখানেও খুলতে চান, তাই পুরো মাসটাই তার কলকাতায় কাটাবার সম্ভবনা। কথা শুরু হয়েছিল এই আপিস ভোলার ব্যাপার নিয়েই। শুনলুম ক্যামাক স্ট্রিটে একটা আপিস বাড়ির দোতলায় বেশ খানিকটা ফ্লোর স্পেস পেয়েও গেছেন। তাতে পাটিশানের ব্যবস্থা করে দিব্যি তিনটে ঘর আর একটা অ্যাটাচড বাথ করে নেওয়া যাবে। চেনা একজন কন্ট্রাকটরের সঙ্গে তা-ই নিয়ে কথাও হয়ে গেছে তার। এখন একজন রিসেপশনিস্ট কাম টাইপিস্ট আর মোটামুটি কাজ জানা দু’জন লোক পেয়ে গেলেই হয়।

গত বছর এই সময়ে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে দিন কয়েকের জন্যে একটা তদন্তের কাজে ইউ পি-র মির্জাপুরে যেতে হয়েছিল। তার পরে আর কোথাও যাওয়া হয়নি। শিগগির যে যাওয়া হবে, এমনও মনে হয় না। একে ভাদুড়িমশাইয়ের শরীর ইদানীং বিশেষ ভাল যাচ্ছে না, তার উপরে আবার এই নতুন আপিস নিয়ে বেশ কিছুদিন তাঁকে এখন ব্যস্ত থাকতে হবে। তাতে অবশ্য আমাদের বেজার হবার কিছু নেই। বরং আপাতত যে তিনি এখান থেকে নোঙর তুলবেন না, তাতেই আমরা খুশি।

কথাবার্তা দিব্যি এগোচ্ছিল। ইতিমধ্যে একগাদা খবরের কাগজ এসে যাওয়ায় সবাই তার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ভাদুড়িমশাই ইস্টার্ন কুরিয়ারের ফাস্ট পেজের হেডলাইনগুলো দেখে নিয়ে ভিতরের পাতা খুলে জাম্বলের সমাধান করতে লেগে যান। সেন্টারে যুক্তফ্রন্ট থেকে কংগ্রেসের সমর্থন প্রত্যাহারের ফলে দেশের রাজনীতি এবার কোন দিকে মোড় নেবে, তা-ই নিয়ে অরুণ সান্যাল, কৌশিক, সদানন্দবাবু ও আমার মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। অরুণ সান্যাল তাতে বিশেষ উৎসাহ না পেয়ে খানিক বাদে একটা মেডিক্যাল জার্নাল টেনে নেন। কৌশিক ‘ধুর, রাজনীতি আবার ভদ্দরলোক করে!’ বলে খেলার পাতায় চলে যায়। আর তার পরে-পরেই তোলে সাংবাদিকদের কাণ্ডজ্ঞান নিয়ে সেই প্রশ্ন, যার উল্লেখ এই লেখার একেবারে গোড়াতেই করেছি।

অরুণ সান্যাল বললেন, “কী বোদা, চুপ করে আছেন কেন, গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো কী হয়েছিল, বলুন, এইভাবে দগ্ধে মারবেন না তো।”

মালতী রান্নার কাজে ব্যস্ত। তাই পার্বতী, মানে কাজের মেয়েটিকে দিয়ে ইতিমধ্যে সে এক প্লেট পকোড়া পাঠিয়ে দিয়েছিল। সদানন্দবাবু প্লেট থেকে আলগোছে একটি পকোড়া তুলে নিয়ে মুখের মধ্যে চালান করে বললেন, “ওরে ভাই, সে এক ভয়ংকর ব্যাপার! ওই যে খেলার কথা বললুম না, তার এক হপ্তা বাদেই কামারকুণ্ডুর যজ্ঞেশ্বর শিল্ডের সেমিফাইনালে আমাদের সিঙুরের টিম নাবাতে হবে এগেস্ট গুপ্তিপাড়া বুলেটুস। তো হাবলার সেদিনকার খেলা দেখেই আমাদের সিঙুর অ্যাথলেটিক ক্লাবের সেক্রেটারি রতনমণি সাঁতরা বললেন, ‘কোনো কতা নয়, এই নাও পঞ্চাশটা টাকা, এ আমি নিজের গাঁট থেকে দিচ্চি, এই টাকা নিয়ে কাল সকালেই নসিপুরে গিয়ে হালা বাঁড়ুজ্যেকে হায়ার করে ফ্যালো, নয়তো গুপ্তিপাড়ার যা মারকাটারি টিম, সেমিফাইনালে তারা আমাদের কাদিয়ে ছাড়বে। তো তা-ই হল।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা-ই হল মানে গুপ্তিপাড়া আপনাদের কাঁদিয়ে ছাড়ল?”

“আরে না মশাই, তা-ই হল মানে হাবলাকে আমরা হায়ার করে ফেললুম। আর সেমিফাইনালের খেলায় কোতায় গুপ্তিপাড়া আমাদের কাঁদিয়ে ছাড়বে, তা নয়, হাফ-টাইমের আগেই সাত-সাতটা গোল খেয়ে তারাই হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল। তাদের ক্যাপ্টেন এসে বলল, “মশাই, ম্যাচটা আমরা সারেন্ডার করে দিচ্চি। হালার সেভেন্থ গোলটা আটকাতে গিয়ে আমাদের গোলকিপারের পাজরার একখানা হাড় বোধহয় ভেঙে গেচে, রাইট আউট ন্যাংচাচ্চে, লেফট ব্যাকেরও কিছু একটা হয়েছে নিশ্চই, নয়তো ও ওরকম নেতিয়ে পড়ে কাতরাত না! এবারে আমাদের ভালয়-ভালয় বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে দিন। বাস, ড্যাংডেঙিয়ে আমরা ফাইনালে উঠে গেলুম।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “তারপর ফাইনালে ক’ গোলে জিতলেন?”

সদানন্দবাবু নিমপাতা-চিবোনো মুখ করে বললেন, “জিতলুম কোতায়, হেরে ভূত হয়ে গেলুম বাঁশবেড়ের হংসেশ্বরী স্পোর্টিং ক্লাবের কাছে। সেমিফাইনালে সাত গোলে জিতেছিলুম, তাও আদ্ধেক খেলা বাকি থাকতেই, আর ফাইনালে খেয়ে গেলুম আট গোল। কামারকুণ্ডুর স্পেক্টেটররা একেবারে ছ্যা ছ্যা করতে লাগল।”

“তার মানে হাবলা বাঁড়ুজ্যেকে আপনারা ফাইনাল খেলার দিন মাঠে নামাতে পারেননি?”

‘না মশাই, পারিনি।” সদানন্দবাবু বললেন, “অবিশ্যি সেমিফাইনালের দিনও যে তিনিই মাঠে নেমেছিলেন, তাও বলতে পারছি না।”

“তার মানে?”

প্লেট থেকে আর-একটা পকোড়া তুলে মুখের মধ্যে ফেলে দিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “বেড়ে করেছে কিন্তু। সকালে আমার সেকেন্ড কাপ খাওয়া হয়ে গেছে ঠিকই, তবে কিনা এর সঙ্গে আর-এক কাপ চা হলে মন্দ হত না।”

ভাদুড়িমাশাই হেসে বললেন, “এসে যাবে, এসে যাবে। তার আগে গপ্পোটা শেষ করুন তো। সেমিফাইনালের দিন কে তা হলে মাঠে নেমেছিল?”

“তা যদি বলতে পারতুম, তবে তো ল্যাটা চুকেই যেত। কিন্তু বলতে পারছি কোতায়?”

অরুণ সান্যাল সেই একই কথার পুনরুক্তি করলেন, “তার মানে?”

কাজের মেয়েটি দ্বিতীয় রাউন্ডের চা দিয়ে গেল। ট্রে থেকে লিকারের কাপটা তুলে নিয়ে তাতে আলতো করে ঠোঁট ঠেকিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “বলচি, বলছি। সেমিফাইনালেই হাবলার দাপট দেখে আমাদের সাঁতরা মশাই তক্ষুনি-তক্ষুনি ঠিক করে ফেলেছিলেন যে, ফাইনালের খেলাতেও একে চাই। খেলা শেষ হয়ে যেতেই তাই গাঁট থেকে আরও পঞ্চাশ টাকা বার করে হাবলার দিকে এগিয়ে ধরে তিনি বললেন, ‘ফাইনালের জন্যে এই টাকাটা দিয়ে তোমাকে বুক করে রাকলুম। জেতাতে পারো তো

আরও পাঁচশ টাকা দোব। কিন্তু তাতে কী হল জানেন?”

“কী হল?”

“হাবলা বাঁড়ুজ্যে বলল, নিজের হাতে তো আমি টাকা নিই না। কাল সকালে বরং এই টাকাটা আপনারা আমার মায়ের হাতে দিয়ে আসবেন। বাস, তারপর আর একটাও কতা না বলে হাবলা তার সাইকেলে উঠে চলে গেল।”

“পরদিন সকালে আপনারা তা হলে ফের নসিপুরে গেলেন?”

“তা গেসলম বই কী। গিয়ে দেকি হালার মা শুকনো মুকে বারান্দায় বসে আছেন। আমরা তাকে কিছু বলারও সুযোগ পেলুম না। তার আগেই তিনি তার আঁচলের গিট খুলে দশ টাকার পাঁচখানা নোট বার করে বললেন, ‘কিছু মনে কোরো না বাবারা, পরশু রাত্তির থেকেই আমার ছেলের ধুম জ্বর, তাই তোমাদের হয়ে কাল খেলতে যেতে পারেনি। যে টাকাটা দিয়ে গেলে, সেটা ফিরিয়ে নে যাও, বাবা। শুনে তো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! হাবলা বাঁড়ুজ্যে কাল তা হলে সেমিফাইনালের খেলায় নামেনি? একেবারে তার মতন দেকতে যে-লোকটা কাল সাত-সাতটা গোল দিল, তাও হাফটাইমের আগেই, সে তা হলে কে?”

কৌশিক তার বাপের বকুনি খেয়ে চুপ করে ছিল। কিন্তু কতক্ষণ আর মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে। বলল, “যাচ্চলে, হচ্ছিল ফুটবলের গল্প, তো দুম করে সেটাকে আপনি ভূতের লাইনে ঠেলে দিলেন! এটা কী রকমের ব্যাপার হল বোস-জেই?”

সদানন্দবাবু বললেন, “এতে এত আশ্চজ্জি হবার কী আছে? ভূতেদের কি ফুটবল খেলার শখ হয় না? নরমুণ্ড দিয়ে গেণ্ডুয়া খেলার ব্যাপারটা তা হলে এল কোথথেকে? ওহে বাপধন, আমাদের ময়দানে যারা বল পেটায়, তাদের সবাই যে তোমার-আমার মতন জেনুইন মানুষ, তা কিন্তু ভেবো না। অচেন, ওই ভিড়ের মধ্যে তেনারাও দু’চারজন আচেন।”

কথাটা আর এগোল না, কেন না এই সময়েই কলিং বেল বেজে উঠল। তার মিনিট খানেক বাদেই কাজের মেয়েটি এসে জানাল, এক ভদ্রলোক দেখা করতে চান। “বললেন যে, শক্তিগড় থেকে এয়েচেন।”

নাম বললেন না?” প্রশ্নটা অরুণ সান্যালের।

“বললেন তো। তবে সে আমি বলতে পারবনি।”

.