॥ ৯ ৷৷
আজ তেরোই এপ্রিল, মঙ্গলবার। সারাটা দিন নানা কাজে আর হরেকরকম লোকের সঙ্গে কথা বলে কেটেছে। এরই মধ্যে বিকেলে একবার স্ট্র্যান্ড থেকেও এক চক্কর বেড়িয়ে আসা গেল। এখন রাত ন’টা বাজে। একটু আগে বিমলভূষণ, তার স্ত্রী ও মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে এঁদের বসতবাড়ির দোতলার ডাইনিং রুমে বসে রাতের খাওয়া সেরে নিয়েছি। তারপর চলে এসেছি এই গেস্ট হাউসের দোতলায়। দোতলায় দুটি ঘর। মাঝখানে বাথরুম। দুদিকের ঘর থেকেই বাথরুমে যাওয়া যায়। যে-দিক থেকেই যিনি যান, অন্য দিকের দরজাটা বন্ধ করে দিলেই হল।
এখন বলি, আজ সকাল থেকে কী কী ঘটেছে।
সকালের ট্রেনেই কৌশিক কলকাতায় ফিরে গেছে। শেষ রাত্তিরে স্ট্র্যান্ড থেকে জগিং সেরে এসে ভাদুড়িমশাই তাকে ঘুম থেকে তুলে দেন। রিকশাওয়ালাকে পরমেশ তো বলেই রেখেছিলেন, সেও ঠিক-সময়ে এসে কৌশিককে নিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দিয়েছে।
কথা ছিল পরমেশ চৌধুরির বাড়িতে ব্রেকফাস্ট করেই আমরা সরাসরি সেনেদের বাড়িতে চলে আসব। ব্রেকফাস্ট শেষ করি সাড়ে আটটায়। মহকুমা সদর হলেও চন্দননগর যে খুব ছোট শহর, তা নয়, আসানসোলের কথা ছেড়ে দিলে আর-পাঁচটা মহকুমা-সদরের তুলনায় মোটামুটি বড়ই বলতে হবে। রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়ার ভিড় লেগেই আছে। দোকানপাটও বেশ জমজমাট। তবু, কথা অনুযায়ী কাজ হলে ন’টার মধ্যে আমরা সেনেদের বাড়িতে পৌঁছে যেতে পারতুম। কিন্তু কথা অনুযায়ী কাজ হয়নি। ভাদুড়িমশাই কাল রাত্তিরে বলেছিলেন যে, ব্রেকফাস্ট সেরে সরাসরি আমরা এখানে চলে আসব। কিন্তু পরমেশবাবুর বাড়ি থেকে রওনা হবার পরই তার প্ল্যান পালটে যায়। পথের মধ্যে তিন জায়গায় তিনি গাড়ি থামান। প্রথমে একটা চশমার দোকানে ঢুকে হালকা মভ কালারের একজোড়া রোদ-চশমা কেনেন। তারপর থামেন আরও দু’জায়গায়। দুটোই নাকি তার পুরনো বন্ধুর বাড়ি। বললেন, অনেক দিন বাদে চন্দননগরে এসেছেন, আবার কবে আসা হবে তার ঠিক নেই, তাই এই সুযোগে বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎটা সেরে নিতে চান।
দুই বন্ধুর সঙ্গে কী কথা হয়েছিল, আমরা জানি না। তার কারণ, আমি ও সদানন্দবাবু গাড়ির মধ্যেই সারাক্ষণ বসে ছিলুম, দুটি বাড়ির কোনওটিতেই আমরা ঢুকিনি। তবে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে তাদের নেহাত কুশল বিনিময় হয়ে থাকলে এক-একটা সাক্ষাৎকারে নিশ্চয় ঘণ্টা দেড়েক করে সময় লেগে যেত না। কথা শেষ হবার পর ভাদুড়িমশাইকে বিদায় জানাতে তারা যখন রাস্তায় নেমে আসেন, তখন অবশ্য এক পলকের জন্যে হলেও দু’জনকেই আমরা দেখেছি। দু’জনেরই বয়স মনে হল সত্তর-বাহাত্তর হবে। দ্বিতীয় বাড়ির বন্ধুটির একটা কথাও শুনেছি আমরা। কথাটা হল : “তা ধরো লাখ দশ-বারো তো হবেই। কিছু বেশিও হতে পারে।”
প্রথমে চশমা কেনা, তারপর দুই বন্ধুর সঙ্গে অতক্ষণ ধরে কথা বলা, ফলে সেনেদের বাড়িতে যেখানে ন’টার মধ্যে পৌঁছবার কথা, সেখানে বারোটারও একটু পরে আমরা পৌঁছই।
পৌঁছে আমি প্রথমটায় একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলুম। পরক্ষণেই অবশ্য মনে হয় যে, এমনটা যে দেখব, তা আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। বসতবাড়ির পাশের জমিতে মন্দির। জমির অন্য দিকে ছোট্ট একটি দোতলা বাড়ি। মাঝেখানের বাধানো বিশাল চত্বর জুড়ে মস্ত বড় ম্যারাপ খাটানো হয়েছে। এখন চলছে নকশাকাটা সাদা কাপড় দিয়ে বাঁশ ও তেরপলকে ঢাকা দেওয়ার কাজ। ডেকরেটরের লোকজন ছুটোছুটি করছে, বাঁশে পেরেক ঠোকার ঠকঠক শব্দ উঠছে সারাক্ষণ। তারই মধ্যে জনা তিন-চার লোক পায়জামা পাঞ্জাবি-পরা একজন বছর-পঁয়ত্রিশ বয়সের রোগামতন ভদ্রলোককে ঘিরে ধরে বলছে যে, এদের কাজ যদি না বিকেলের মধ্যে শেষ হয় তো তারা আলোর ব্যবস্থা করবে কখন?
আমরা গাড়ি থেকে নামতে ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “আপনারা?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমরা কলকাতা থেকে আসছি। বিমলবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
“ও, বুঝতে পেরেছি।” ভদ্রলোক বললেন, “আপনারা আমার সঙ্গে আসুন। মামাবাবু এখানেই ছিলেন, একটু আগে বাড়ি গেছেন। আসুন।”
বুঝলুম যে, এই হচ্ছে নুটু, অর্থাৎ বিমলভূষণের সেই ভাগ্নে। বাড়ি বলতে এ যে সেনেদের বসতবাড়ির কথা বোঝাচ্ছে, তাও বোঝা গেল।
মন্দিরপ্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে একটা গেট পেরিয়ে বসতবাড়ির এলাকায় ঢুকে পড়া গেল। মস্ত বড় কম্পাউন্ডওয়ালা চুন-সুরকির সেকেলে বিশাল দোতলা বাড়ি। বিলিতি ম্যাগাজিনের ইলাসট্রেশনে ম্যানর হাউসের যে-সব ছবি দেখা যায়, এটিও দেখতে অনেকটা সেইরকম। কম্পাউন্ডের জমিতে অনায়াসেই বাগান করা চলত, কিন্তু সেসব করার কোনও চেষ্টা কখনও হয়েছে বলে মনে হয় না, সর্বত্র শুধু ঘাসই চোখে পড়ে। বাড়িটিও ল্যাপাপোঁছা ধরনের। তবে মেনটেন্যান্সে যে কোনও ত্রুটি নেই, সেটা বোঝ যায়। ত্রুটি ঘটলে এখানে-ওখানে ফাটল চোখে পড়ত। দেখা যেত যে, ফাটলের মধ্যে বট-অশথের চারা গজিয়ে গেছে। সে-সব চোখে পড়ল না। সদ্য বাড়িটির কলি ফেরান হয়েছে, তাও বুঝলুম। তবে, বাড়িটির আর্কিটেকচারাল প্যাটার্ন যতই না শ্রীহীন হোক, আয়তনে এটি এতই বিশাল যে, তাতেই খানিকটা সম্ভ্রমের উদয় হয়।
সামনের দরজাটিও বেশ বড়। টুর পিছন-পিছন ভিতরে ঢুকে দেখলুম, বেশ চওড়া একটি কাঠের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। নটু অবশ্য দোতলায় উঠল না, আপনারা উপরে উঠে যান, মামাবাবু দোতলায় থাকেন বলে ডানদিকের একটা ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। পর্দার আড়ালে-একটি তরুণী ও বাচ্চা একটি ছেলের মুখও চকিতে চোখে পড়ল আমার। সম্ভবত নুটুর বউ ও ছেলে।
আমরা দোতলায় উঠে ডোর-বেলের বোতাম টিপবার কয়েক সেকেন্ড বাদে যিনি এসে দরজা খুলে দিলেন, তাকে যেহেতু আগেই আমরা দেখেছি, তাই চিনতে অসুবিধে হল না। বিমলভূষণ আজ অবশ্য অন্য পোশাক পরেছেন। তার পরনে আজ সিল্কের পায়জামা ও পাঞ্জাবি। পায়ে শুড়-তোলা চটিজুতো। আমাদের দেখে যে একটু অবাক হয়েছে, তা তার চোখ দেখেই বোঝা গেল। বললেন, “আসুন, আসুন। কিন্তু আপনাদের তো কালই আসার কথা ছিল। এলেন না যে? কাজে আটকে গেসলেন?”
এর উত্তরে সত্য কথা বললে স্পষ্ট জানাতে হত যে, আমরা কালই এসেছি বটে, কিন্তু উঠেছিলুম অন্য জায়গায়। ভাদুড়িমশাই অবশ্য সত্যও বললেন না, মিথ্যে বললেন না। প্রশ্নটাকে বেমালুম এড়িয়ে গিয়ে বললেন, “চুরিটা আটকে দেওয়াই হচ্ছে আসল কথা। আশা করি, আটকে দিতে পারব। চলুন, আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে।”
বিমলভূষণের যেন হঠাৎই খেয়াল হল যে, আমাদের তখনও দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে, বসতে বলা হয়নি। শশব্যস্ত হয়ে বললেন, “আরে কী কাণ্ড, আপনারা দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, আসুন, আসুন, ভিতরে এসে বসুন।”
দরজা পেরোলেই মস্ত ড্রয়িংরুম। এক দিকে একটি ডিভান। মাঝখানে বড়সড় সেন্টার টেবিল ঘিরে গোটা কয়েক শসোফা। দেওয়াল ঘেঁষে জানালার-তেলাঞ্চি-সমান-উঁচু টানা কাঁচের আলমারি। তাতে দেশি ও বিদেশি নানারকমের পুতুল সাজানো। অন্যদিকের দেওয়ালে পাশাপাশি তিনটি তেলরঙা পোর্ট্রেট। আমরা সেদিকে তাকিয়ে আছি দেখে বিমলভূষণ বললেন, “বাঁদিক থেকে আমার বাবা, ঠাকুর্দা আর ঠাকুর্দার বাবা।”
সদানন্দবাবু বললেন, “অর্থাৎ চন্দ্রভূষণ, কীর্তিভূষণ আর কালীভূষণ। ঠিক বলিচি?” বিমলভূষণ বললেন, “ঠিকই বলেছেন।…কিন্তু কলকাতা থেকে আপনারা স্নান সেরে বেরিয়েছেন তো? নাকি এখানেই স্নান করে নেবেন?”
“ও-সব সেরে তবেই রওনা হয়েছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি ব্যস্ত হবেন না। বরং কাজের কথা শুরু করা যাক।”
“কাজের কথা পরে হবে।” বিমলভূষণ হেসে বললেন, “অনেক বেলা হয়ে গেছে। আপনারা আগে খেয়ে নিন। আমরাও দুপুরের খাওয়া এখনও খাইনি। সবাই একসঙ্গে বসে খেয়ে নেব। কাজের কথা তার পরে হলেও ক্ষতি নেই। কথা সেরে তারপর গেস্ট হাউসে যাবেন। ওখানেই আপনাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।”
তা-ই হল। বিমলভূষণ ভিতরে চলে গিয়ে মিনিট দুই-তিন বাদে আবার ঘুরে এসে বললেন, “আপনারা আসুন। খেতে দেওয়া হচ্ছে। আমার স্ত্রী সবাইকে ডাইনিং রুমে নিয়ে যেতে বললেন।”
ডাইনিং রুমটি দোতলার একেবারে শেষ প্রান্তে। এটিও মস্ত বড় ঘর। মাঝখানে ওভাল ডাইনিং টেবিল। টেবিল ঘিরে খান দশেক হাই-ব্যান্ড চেয়ার।
পাশাপাশি তিনটি চেয়ারে বসে যাঁরা কথা বলছিলেন, আমরা গিয়ে ঘরে ঢুকতে তারা দাঁড়িয়ে উঠে নমস্কার করলেন। পরমেশ চৌধুরির কাছে এই সেন-পরিবারের একটা আন্দাজ কাল পেয়েছি, তাই খুব সহজেই এঁদের চিনে নেওয়া গেল। মহিলা দুটি বিমলভূষণের স্ত্রী ও কন্যা। তৃতীয়জন পুরুষ। সম্ভবত এ বাড়ির জামাতা। বিমলভূষণ পরিচয় করিয়ে দিলেন। দেখলুম, অনুমানে ভুল হয়নি। বিমলভূষণের স্ত্রী কনক প্রৌঢ়বয়সিনী। কিন্তু এক
পলক দেখলেই বোঝা যায় যে, এই মহিলা এককালে অসামান্য রকমের রূপবতী ছিলেন। সেই রূপের রেশ এখনও সম্পূর্ণ মিলিয়ে যায়নি, অস্তগামী সূর্যের রশ্মির মতো এখনও তার মুখেচোখে একটা মায়াজাল ছড়িয়ে রেখেছে। মেয়েটি তার মায়ের রূপ পায়নি। তার মুখে একটা অসন্তোষ ও অতৃপ্তির ভাবও দুর্লক্ষ্য নয়।
ঘরোয়া খাওয়া। ভাত, ডাল, দু’রকমের ভাজা, মাছ ও টক। সেই সঙ্গে শেষপাতে দই। খেতে-খেতে খুব একটা কথাও হল না। দেড়টার আগেই খাওয়ার পর্ব সমাধা হল। একটি ভূত এসে একটা মশলার বাটি এগিয়ে ধরল, তা থেকে এক চিমটি করে মশলা তুলে নিয়ে আমরা আবার বাইরের ঘরে এসে বসলুম।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে। কিন্তু আপনার তো এখন বিশ্রাম করার সময়, তাই না?”
বিমলভূষণ হেসে বললেন, “এই সময়ে একটু গড়িয়ে নিই ঠিকই, তবে ও নিয়ে ভাববেন না। কী বলবেন বলুন?”
“হিরে দুটো আপনি বলেছিলেন সিন্দুকে ভোলা থাকে। সিন্দুকটা কোথায়?”
“এই বাড়িতেই। আমার শোবার ঘরের দেওয়ালে-গাঁথা সিন্দুকে। তার চাবি থাকে আমার কাছেই।”
“সে দুটো একবার দেখা যায়?”
“তা কেন যাবে না? আপনারা একটু বসুন, আমি এখুনি নিয়ে আসছি।”
বিমলভূষণ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন মিনিট পাঁচেক বাদে। হাতে একটা ভেলভেটের বাক্স। আমাদের সামনে এসে বাক্সের ডালা খুলে ধরতেই চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। ভাদুড়িমশাই খুব মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করলেন হিরে দুটিকে। তারপর বললেন, “ঠিক আছে, এবারে এ দুটিকে যথাস্থানে আবার রেখে আসুন।”
বাক্সের ডালা বন্ধ করে বিমলভূষণ আবার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এবং এবারেও ফিরে এলেন খানিক বাদেই। ফিরে এসে সোফায় বসে বললেন, “আর কী জানতে চান বলুন।”
“হরপার্বতীর চোখে ওই হিরে দুটো কাল কখন পরাবেন?”
“ভোর পাঁচটায়।” বিমলভূষণ বললেন, “তার আগে তো তোকজন আসা শুরুই হয় না।”
“হিরে দুটো যে সম্বচ্ছর আপনার শোবার ঘরের সিন্দুকে থাকে, আমি ধরেই নিচ্ছি যে, আপনার স্ত্রী আর মেয়ে-জামাই তা জানেন। কথা হচ্ছে আর-কেউ জানে কি না। এই ধরুন আপনার বাড়ির কাজের লোকেরা। তারা জানে?”
“জানে বলে মনে হয় না। বিমলভূষণ বললেন, “তবে হ্যাঁ, অনুমান তো করতেই পারে।”
“রাত্তিরে ওরা কোথায় থাকে?”
“এই বাড়িরই একতলায়। একতলার একদিকে ওরা থাকে আর অন্যদিকে থাকে আমার ভাগ্নে, নুটু।”
“হিরে দুটো যে সিন্দুকে থাকে, নুটু তা জানে?”
“মনে তো হয় না।” বিমলভূষণ বললেন, “ওকে বলেছি যে, হিরে থাকে ব্যাঙ্কের লকারে, চোত-সংক্রান্তির আগের দিন ব্যাঙ্কে গিয়ে লকার থেকে আমি বার করে আনি। আজও দশটা নাগাদ বাড়ি থেকে একবার বেরিয়েছিলাম। নুটুকে তখন বলে গিয়েছিলাম যে, ব্যাঙ্ক থেকে হিরে নিয়ে আসতে যাচ্ছি।”
শুনে, একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “মাতা লুমিয়ের বলে কাউকে আপনি চেনেন?”
বিমলভূষণের মুখ দেখে মনে হল, এই প্রশ্নটার জন্যে তিনি তৈরি ছিলেন না। বললেন, “তাঁকে আপনারা চিনলেন কী করে?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমরা চিনলাম কী করে, সেটা কোনও কথা নয়। আপনি চেনেন কি না বলুন।”
“চিনি।”
“কী করে চিনলেন? মানে সূত্রটা কী?”
“বলছি।” বিমলভূষণ বললেন, “আমার জামাই আদিত্যনাথ কলকাতার একটা এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানির ম্যানেজার। আপিসের কাজে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওকে ইউরোপে যেতে হয়। সেই সময়ে ফ্রান্সের ভিসা করাবার জন্যে ওকে একদিন কলকাতার ফ্রেঞ্চ কনস্যুলেটে যেতে হয়েছিল। আমি ওর সঙ্গে গিয়েছিলাম। তো সেইখানে মাতা লুমিয়েরের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ও গিয়েছিল ওর পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়াতে। কথায় কথায় জানতে পারি যে, ও রিসার্চ-স্কলার, এ-দেশে এসেছে টেরাকোটার মন্দির নিয়ে কাজ করতে। আমি ওকে আমাদের মন্দিরের কথা জানাই। বলি যে, চোত-সংক্রান্তিতে আমাদের মন্দিরে খুব বড় একটা উৎসব হয়। ও সেই উৎসব দেখতে এসেছে।”
“এখানে এসে উঠেছে কোথায়?”
“এই বাড়িতেই উঠত।” বিমলভূষণ বললেন, “তবে কিনা সাহেব বলে কথা। ওদের হরেক রকম বায়নাক্কা। এদিকে আমরা তো সাহেবি কেতায় অভ্যস্ত নই। কে অত ঝক্কি পোয়াবে। তাই এই চন্নননগরেই আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে ওর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আশা করছি, সেখানে ওর কোনও অসুবিধে হবে না। আজ সকালে ব্যাঙ্কে যাবার নাম করে যখন বেরোই তখন আসলে ওরই সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
“এর আগে শেষ কবে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?”
উত্তর দেবার আগে এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন বিমলভূষণ। একটু ভেবে নিলেন। তারপর বললেন, “মনে পড়েছে। গত রবিবার। ওই যেদিন কলকাতায় আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাই। আপনার ওখান থেকে চলে আসছি, এমন সময় রাস্তায় একেবারে হঠাৎই ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এয়ারপোর্টে কাকে যেন রিসিভ করতে যাচ্ছিল। পথে আমাকে দেখে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।”
“আপনাদের হিরের কথা ও জানে?”
“সে তো আমিই ওকে বলেছি। সেই হিরের চোখের হরপার্বতী দেখতেই তো ওর আসা। কাল ভোরেই ঠিক এখানে এসে যাবে।”
“এবারে শেষ প্রশ্নটা করি। নুটু লোকটি কেমন? ওকে আপনি কতটা বিশ্বাস করেন?”
“পুরোপুরি বিশ্বাস করি।” বিমলভূষণ বললেন, “না করে উপায় আছে? ওই তো সব সামলাচ্ছে।”
“বাস,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অনেকক্ষণ আপনাকে আটকে রেখেছি, এবারে আপনার ছুটি। সন্ধের দিকে একবার আসব। এখন যান, একটু গড়িয়ে নিন।
বিমলভূষণ সোফা থেকে উঠে দরজা পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিলেন। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে আমরা নীচে নেমে এলুম। রওনা হলাম গেস্ট হাউসের দিকে।
গেস্ট হাউসের মুখে নুটুর সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, “দোতলায় চলে যান, ওখানে আপনাদের জন্যে দুটো ঘর রেডি করে রেখেছি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনাদের পুজুরি ঠাকুরটির সঙ্গে একটু কথা বলব। তাকে পাওয়া যাবে?”
“নিশ্চয়ই যাবে।” নুটু বললেন, “নীচেই আছেন। আপনারা ঘরে যান, আমি তাঁকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
আমরা উপরে উঠে সিঁড়ির পাশের ঘরটা আমার ও সদানন্দবাবুর জন্য রেখে ধারের ঘরটা ভাদুড়িমশাইকে ছেড়ে দিলুম। গাড়ি থেকে আমাদের হ্যান্ডব্যাগ তিনটি উপরে তুলে দেওয়া হয়েছিল। জামাকাপড় পাল্টে ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে বসে সবে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেছি, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল।
দরজা খুলে যাকে দেখা গেল, তার বয়স বছর তিরিশ-বত্রিশের বেশি হবে না। গৌরবর্ণ যুবা পুরুষ, পরনে গরদের ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, গলায় ধবধবে সাদা উপবীত। নমস্কার করে বললেন, “আমার নাম শ্রীগৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য। আমিই এই মন্দিরের পূজারি। নুটুবাবু বললেন, আপনারা আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।”
ঘরে একটিমাত্র চেয়ার। গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্যকে সেটায় বসতে বলে আমরা তিনজন খাটের উপরে বসলুম। ভাদুড়িমশাই কোনও ভণিতার মধ্যে না গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এখানে কত দিন আছেন?”
“পাঁচ বছর।” গৌরাঙ্গ বললেন, “আগে আমার বাবা এখানে পূজো-পাঠ করতেন। তিনি অসুস্থ হয়ে দেশের বাড়িতে চলে যান। তখন থেকে আমিই এখানে কাজ করছি।”
“আপনাদের দেশ কোথায়?”
“বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ে। সেখানে রেলগাড়ি থেকে নেমে মাইল পাঁচেক সাইকেল রিকশায় যেতে হয়। গ্রামের নাম বড় চণ্ডীপুর।”
ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। দেশলাই কাঠিটা নিভিয়ে ঘরের মধ্যে অ্যাশট্রে না থাকায়, জানলা দিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করলেন। তারপর বললেন, “ভটচাজমশাই, আপনি কি নিত্য গঙ্গাস্নান করেন?”
গৌরাঙ্গ বললেন, “শরীর ভাল থাকলে নিত্যই করি। তবে শরীর তো নিত্য ভাল থাকে না। তখন এক-আধ দিন বাদ যায়।” জোড়া ভাদুড়ি-৪
ভাদুড়িমশাই আর কথা না বাড়িয়ে এবারে সরাসরি চলে এলেন হিরের প্রসঙ্গে। বললেন, “বিমলবাবু বলছিলেন যে, গঙ্গার ঘাটে দুজন লোককে আপনি হিরে নিয়ে বলাবলি করতে শুনেছিলেন। এটা কবেকার কথা?”
“গত মাসের মাঝামাঝির।” একটুক্ষণ চিন্তা করে গৌরাঙ্গ বললেন, “মার্চ মাসের চোদ্দো-পনেরো তারিখের।”
“তারা কী বলছিল।”
“বলছিল যে, ও-হিরে সেনেদের নয়, ওরা এক সায়েবের কাছ থেকে হাতিয়েছে, তাই চুরি করলে পাপ হবে না।”
“ঠিক এই কথাই আপনি বিমলভূষণকে বলেছিলেন?”
“আজ্ঞে না।” গৌরাঙ্গ সামান্য হাসলেন। বললেন, “ওভাবে কি বলা যায়? আমি শুধু বলেছিলাম যে, হিরে নিয়ে দু’জন লোককে কথা বলতে শুনেছি, তাই সাবধান হওয়া দরকার।”
“লোক দু’জন কোথাকার বলে মনে হয়?”
“তা তো জানি না। তবে চেহারা আমার মনে আছে। একজন ঢ্যাঙা, অন্যজন বেঁটে। দুজনেই কালো। বেঁটে লোকটার গালে একটা আঁচিল আছে। আবার দেখলে ঠিক চিনতে পারব।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে ভটচাজমশাই, আপনি যেতে পারেন।” গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য চলে গেলেন।
ভেবেছিলুম, জামাকাপড় পালটে ভাদুড়িমশাইও এবারে একটু বিশ্রাম করে নেবেন। কিন্তু তিনি জামাকাপড় পালটালেন না। দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, “আপনারা বিশ্রাম করুন, গাড়িটা নিয়ে আমি একটু বেরুচ্ছি। পাঁচটা নাগাদ ফিরব।”।
কোথায় কী কাজে তিনি বেরিয়ে গেলেন, তা জানি না, তবে ফিরে এলেন পাঁচটার মধ্যেই। আমি ও সদানন্দবাবু ইতিমধ্যে একটু ঘুমিয়ে নেবার চেষ্টা করেছি। তবে সদানন্দবাবুর ক্ষেত্রে চেষ্টাটা কিঞ্চিৎ সফল হলেও আমার ক্ষেত্রে একেবারেই হয়নি। ভাদুড়িমশাই ফিরে এসেই বললেন, “চলুন, স্ট্যান্ড থেকে এক চক্কর ঘুরে আসা যাক।”
যেতেই হয়েছিল। সেখানে পরমেশ চৌধুরির সঙ্গে দেখাও হয়ে গেল আবার। ভদ্রলোক একটা বেঞ্চিতে বসে তারই বয়সী জনা তিনেক বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলেন। ভাদুড়িমশাইকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “তোমার কাজ কেমন এগোচ্ছে?” তাতে ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ভালই।” শুনে খুশি হলেন পরমেশ। বললেন, “কলকাতায় ফেরার আগে কিন্তু একটা দিন আমার বাড়িতে কাটিয়ে যেয়ো।”
স্ট্যান্ড থেকে ফিরতে-ফিরতে রাত হয়ে যায়। ফিরে সেনেদের মূল বাড়িতে যাই। সেখানে বিমলভূষণের সঙ্গে ভাদুড়িমশাইয়ের একান্তে কিছু কথা হয়। তারপর ওখানেই রাতের খাওয়া চুকিয়ে একটু আগে গেস্ট হাউসে ফিরেছি। ফিরে ভাদুড়িমশাইকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, বিমলভূষণের সঙ্গে তার কী কথা হল। তাতে তিনি হেসে বললেন, “কথা তো বিশেষ হয়নি। তবে হ্যাঁ, ওঁর শোবার ঘরে ঢুকে সিন্দুক খুলিয়ে ওই হিরেজোড়া আর একবার দেখে এলুম।” তারপর এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন। রাত জাগবেন না। কাল ভোর পাঁচটার আগেই নীচে নামতে হবে।”
কিন্তু শুয়ে পড়লেই কি ঘুম আসে? ডেকরেটরদের কাজ শেষ হয়নি। ইলেকট্রিক মিস্ত্রিরা সমানে চেঁচামেচি করছে। পেরেক ঠোকার শব্দেরও কামাই নেই। কেন যে ওরা শেষ মুহূর্তের জন্য সব কাজ ফেলে রাখে। এর মধ্যে ঘুমুনো সম্ভব?
অথচ, এত হই-হল্লা আর ঠকাঠক হাতুড়ি পেটার শব্দের মধ্যেও সদানন্দবাবু দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছেন। ভদ্রলোককে হিংসে হয়।
.