॥ ৪ ॥
আজ বাবোই এপ্রিল, সোমবার। বেলা এখন বারোটা। কলকাতা থেকে ব্রেকফাস্ট খেয়ে বওনা হয়েছিলুম, আধঘণ্টা আগে আমরা চন্দননগরে এসে পৌঁছেছি। আমবা মানে ভাদুড়িমশাই, সদানন্দবাবু, কৌশিক আর আমি। পরশু সংক্রান্তি। কৌশিক মাত্র একটা দিনের জন্য এসেছে, কালই কলকাতায় ফিরে যাবে, সংক্রান্তি পর্যন্ত থাকবে না।
আমরা উঠেছি পরমেশ চৌধুরির বাড়িতে। ইনি ভাদুড়িমশাইয়ের বন্ধু। কালই ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে এঁর কথা শুনেছিলুম। বন্ধু বলে পৰিচয় দেওয়ায় ধরে নিয়েছিলাম যে, ইনি আমাদেরই বয়সী হবেন। তা কিন্তু নন। এর বয়স ষাট-বাষট্টিব বেশি হবে না। দেখে অন্তত সেইরকমই মনে হয়। ষাট-বাষট্টিতেও অনেকের শরীর অবশ্য ভেঙে যায়। এঁর ভাঙেনি। দোহারা চেহারার শক্তপোক্ত মানুষ। থুতনির নীচে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, মাথায় চকচকে টাক, মুখে সব সময়েই এক টুকরো হাসি লেগে আছে।
স্ট্যান্ডের ধারে এখানকার ট্রেজারি বিল্ডিংয়ের গা ঘেঁষে যে রাস্তাটি শহরে কেঁদের দিকে চলে গেছে, সেটা ধরে সামান্য কিছুক্ষণ হাঁটলেই পরমেশবাবুর বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া যায়। ফ্রেঞ্চ কলোনিয়াল আর্কিটেকচারের উঁচু ভিতের ও উঁচু ছাতের একতলা বাড়ি, সামনের বারান্দাটি বেশ বড়সড়, ছাত থেকে কাঠের জাফরি ফুট কয়েক নেমে এসে বারান্দার উপরের অংশটিকে তিনদিকে ঘিরে বেখেছে।
ঢালাও বাড়ি, সংলগ্ন জমির আয়তনও নেহাত কম হবে না, তাতে ছোটবড় কিছু গাছপালা। তার মধ্যে, ছোট-ছোট নীল রঙের ফুল দেখে, বৃহৎ একটি জাকারান্ডা গাছকে খুব সহজেই চিনে নেওয়া গেল। শুনলুম, বাড়ির ছাত থেকে গঙ্গা দেখা যায়। এও জানা গেল যে, একজন ভৃত্য ও একটি পাঁচককে নিয়ে পরমেশ এখানে একা থাকেন। ভদ্রলোকের ছোটখাটো একটা ব্যবসা ছিল, বছর কয়েক আগে সেটা বিক্রি করে দিয়েছেন। টাকা-পয়সার অভাব যে নেই, সেটা ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে শুনেছি। ব্যাঙ্কে জমানো টাকার থেকে যে সুদ মেলে, তারও একটা সামান্য অংশই খরচা করার দরকার হয়।
পরমেশবাবু নিঃসন্তান নন। দুটি ছেলে। বড়টি প্রবাসী, মার্কিন মুলুকে থাকে। ছোটটি থাকে দিল্লিতে। সেখানে সে একটি মালটিন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। বিয়ে করেনি, মা’কে নিজের কাছে নিয়ে রেখেছে। বাপকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পরমেশবাবু যাননি। তার কথা শুনে বোঝা গেল, চন্দননগরে থাকতেই তার ভাল লাগে, অন্য কোথাও তার মন টেকে না।
এর মধ্যে এমন দুটি ঘটনা ঘটেছে, যার এখানে উল্লেখ করা দরকার।
কাল দুপুরে বিমলভূষণ বিদায় নেবার পরেও বেশ কিছুক্ষণ আমাদের কথাবার্তা চলেছিল। তারপর আমাদের খাওয়ার ডাক পড়ে। খাওয়ার পর্ব শেষ হবার পরে ভাদুড়িমশাইয়ের খেয়াল হয় যে, তার সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। কৌশিককে তিনি মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট আনতে পাঠান। মিনিট কুড়ি-পঁচিশ বাদে কৌশিক ফিরে এসে বলে যে, বিমলভূষণকে সে ওই মোড়ের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তিনি কথা বলছিলেন। ভদ্রলোক বিদেশি। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল একটা পুরনো সিট্রোয়েন গাড়ি। কথা শেষ করে বিদেশি ভদ্রলোকটি সেই গাড়িতে উঠে পড়েন। “আর বিমলভূষণ?” ভাদুড়িমশাইয়ের এই প্রশ্নের উত্তরে কৌশিক জানায় যে, তিনি রাস্তা পেরিয়ে উল্টো দিকের ফুটপাথে ওঠেন। তারপরে আর আমি তাকে দেখতে পাইনি। বিদেশি মানুষটি ঠিক কোন দেশের মানুষ, তা সে বুঝতে পেরেছে কিনা, তাও জিজ্ঞেস করেছিলেন ভাদুড়িমশাই। কৌশিক তাতে বলে যে, তা সে বুঝে উঠতে পারেনি। সে শুধু এইটুকুই বলতে পারে যে, ভদ্রলোকের পরনে ছিল জলপাই রঙের প্যান্ট আর সাদা শার্ট। তা ছাড়া তাঁর বাঁ গালে একটা কাটা দাগও তার চোখে পড়েছে। হাইট মাঝারি, চুলের রং নুন মেশানো গোলমরিচের মতন, চোখের তারা নীল। এ ছাড়া আর কিছু তার চোখে পড়েনি।
এটি তো প্রথম ঘটনা। দ্বিতীয় ঘটনাটি আজ ঘটেছে। শ্রীরামপুরের রাস্তায় একটু জ্যাম ছিল। সেটা ছাড়িয়ে, চা খাওয়ার জন্যে আমরা রাস্তার ধারের একটা বাবার সামনে গাড়ি থামাই। ভাদুড়িমশাই কৌশিককে বলেন, “আমরা আর গাড়ি থেকে নামব না। তুই ভিতরে গিয়ে চার কাপ চায়ের অর্ডার দে। চা যেন গাড়িতেই দিয়ে যায়। কৌশিক কিন্তু ধাবার ভিতরে ঢোকে না। খানিকটা এগিয়ে গিয়েও আচমকা ফিরে এসে, গলার স্বর নামিয়ে বলে, “সেই লোক। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ধাবা থেকে যে লোকটি বেরিয়ে আসে, তার বাঁ গালের কাটা দাগটা দেখেই আমি বুঝতে পারি যে, সেই লোক’ বলতে কৌশিক কার কথা বোঝাচ্ছিল। বাঁ কানের গোড়া থেকে দাগটা তার ঠোঁটের বা কোণ পর্যন্ত নেমে এসেছে। মিলে যাচ্ছে আরও কিছু বর্ণনাও। তবে এর প্যান্টটা আজ হালকা ধূসর রঙের, শার্টটা লাল, চেক কাটা। পোশাকের বং যে মিলছে না, সেটা বিচিত্র নয়, মানুষ নিশ্চয় রোজ-রোজ একই শার্ট-প্যান্ট পরে না। তা না-ই পরুক, একেবারে হঠাৎই আমার মনে হতে লাগল যে, আর-একটা ব্যাপারেও যেন একটা বড় রকমের অমিল থেকে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা যে কোন ব্যাপারে, তক্ষুনি সেটা বুঝে উঠতে পারলুম না!
ভাদুড়িমশাই স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে বসে ছিলেন। লোকটি এগিয়ে এসে সামনে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে তাকে জিজ্ঞেস এল, “চন্দননগরে যেতে হলে কি এখান থেকেই ডাইনে গাড়ি ঘোরাব?”
“না,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখানে নয়। আরও খানিকটা সিধে গেলে একটা চৌরাস্তার মোড় পাবেন, সেখান থেকে ডান দিকের রাস্তা ধরতে হবে।…বাই দ্য ওয়ে, আপনি কি এদিককার রাস্তাঘাট ভাল চেনেন না?”
“না, আমার নাম মাতা লুমিয়ের, আমি মাত্র তিনদিন হল ফ্রান্স থেকে এসেছি, এখানকার রাস্তাঘাট সম্পর্কে কোনও ধারণাই আমার নেই। একটা রোড ম্যাপ পেলে ভাল হত।”
“দরকার হবে না।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “প্রায় তো পৌঁছেই গেছেন, বাকি পথটুকুও ঠিকই চলে যেতে পারবেন।
লোকটি আর কথা বাড়াল না। আমাদের ধন্যবাদ দিযে পথের ধারের একটা গাছতলায় দাঁড় করানো তার গাড়িতে গিয়ে উঠল। কৌশিক একটা পুরনো সিট্রোয়েন গাড়ির কথা বলেছিল। কিন্তু লক্ষ করলুম, এটা পুবনো গাড়ি তো নয়ই, সিট্রোয়েনও নয়, নতুন মডেলের ঝকঝকে একটা মারুতি এস্টিম।
লোকটি চলে যাবার পর কৌশিক বলল, “মামাবাবু, এই সেই লোক। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিমলভূষণ কাল এরই সঙ্গে কথা বলছিলেন।”
“বুঝেছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তুই এবারে গিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করতো। অনেকক্ষণ চা খাইনি।”
ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে মনে হল, মাতা লুমিয়েরের সঙ্গে এই হঠাৎ সাক্ষাৎকার নিয়ে তিনি কিছুই ভাবছেন না।
যেন ধরে নিয়েছেন যে, এ খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।
আমার ধারণা কিন্তু অন্যরকম। আমার বিশ্বাস, লোকটি মোটামুটি আঁচ করে রেখেছিল, যে, এই সময়ে এই পথ দিয়ে আমরা চন্দননগবে যাব। বিমলভূষণের কাছে ও আমাদের কথা শুনেছে। কেন আমরা চন্দননগরে যাচ্ছি, তাও ও জানে। এখানকার রাস্তাঘাট ওর অচেনা নয়। মোটেই ও ফ্রান্স থেকে সদ্য এ-দেশে আসেনি। যার কান থেকে ঠোঁট পর্যন্ত অমন একটা কাটা দাগ থাকে, সে মোটেই সুবিধের লোক হতে পাবে না। পথের হদিশ জিজ্ঞেস করাটা ওর একটা ছল মাত্র। এইভাবে ও আমাদের একটু বাজিয়ে দেখে নিল। লোকটিকে দেখামাত্র আমার মনে একটা অস্বস্তি জেগেছিল। সেটা এখনও যায়নি। খালি খালি মনে হচ্ছে, এর সঙ্গে আবার আমাদের দেখা হবে। এবং সেই দেখাটা খুব প্রীতিকর হবে না।
কথা বলতে বলতে একটু পিছিয়ে গিয়েছি, এখন আবার এগিয়ে আসা যাক। মার্তা লুমিয়েরকে যেমন আমার একটুও ভাল লাগেনি, মনে হয়েছে যে, এ খুবই বিপজ্জনক মানুষ, তেমনি আবার পরমেশ চৌধুরিকে আমার প্রথম থেকেই বেশ ভাল লেগে গিয়েছে। কথা শোনার দরকার হয় না, দেখলেই বোঝা যায় যে, ইনি স্বচ্ছ মনের মানুষ, এঁর মধ্যে কোনও পাঁচঘোচের ব্যাপার নেই। ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে আগেই শুনেছিলাম যে, পরমেশ চৌধুরির সঙ্গে তার সম্পর্ক নেহাত এক-আধ বছবের নয়, অনেক দিনের। এখন এদের কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল, সম্পর্কটা বেশ গভীরও বটে। পরমেশ বলছিলেন যে, চন্দননগর ছাড়া অন্য কোথাও তার মন টেকে না।
শুনে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু এখানে তো তুমি একলা থাকো। অসুখ-বিসুখ হলে দেখবে কে?”
“সে তো তোমার সম্পর্কেও বলা যায়, চারুদা।” পরমেশ হেসে বললেন, “বউদি কবেই স্বর্গে গেছেন। একটি মাত্র মেয়ে, সেও বিদেশে থাকে। এখন বলো, অসুখ-বিসুখ তো তোমারও হতে পারে, তখন তোমাকেই বা কে দেখবে।”
“কেন, মালতী দেখবে।”
“কিন্তু মালতী তো কলকাতায় থাকে, আর তুমি থাকো বাঙ্গালোরে। হঠাৎ যদি তোমার কঠিন একটা অসুখ হয়? নাকি সেটা হতেই পারে না?”
ভাদুড়িমশাই হোহো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “কথাটা নেহাত মন্দ বলোনি হে। সত্যি এক-এক সময় মনে হয় যে, যমরাজের সঙ্গে একটা চুক্তি করেছি, জগিং করতে করতে হঠাৎ একদিন পটাং করে মরে যাব, তার আগে কোনও অসুখ বিসুখ আমাকে ছুঁতে পারবে না।”
এনে সদানন্দবাবু হা-হাঁ করে উঠলেন। “অমন কতা বলবেন না, অমন কতা বলবেন না। ও সব নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতে নেই। অসুক তো হতেই পারে।”
“তা যদি হয়ই, তো কৌশিক রয়েছে কী করতে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অসুখ হলে যাতে এই বুড়ো বয়েসে একটু সেবাযত্ন পাই, তারই জন্যে তো কৌশিককে বাঙ্গালোরে আমার কাছে নিয়ে রেখেছি।”
কৌশিক বলল, “বাজে বোকো না তো। জ্বর হলে যে মাথায় জলপট্টি দেওয়ার কাজটাও আমার দ্বারা হবে না, সে তুমি খুব ভালই জানো।”
ভাদুড়িমশাই পরমেশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওর কথায় কান দিয়ো না, পরমেশ। সত্যিই যদি আমার কিছু হয়, তো কৌশিক তার মামাবাবুর জন্যে জান লড়িয়ে দেবে।….কিন্তু তুমি তোমাকে কে দেখবে? তোমার তো একটা ভাগ্নে পর্যন্ত এখানে নেই। তা হলে?”
পরমেশ হেসে বললেন, “তা হলে আমাকে কী করতে বলো?”
“দিল্লি চলে যাও। সেখানে তোমার বাদবাকি জীবনটা ছোট ছেলের কাছে থাকো।”
“দিল্লি গিয়ে আমি করবটা কী?”
“কেন, এই বয়েসে যা করা উচিত তা-ই করবে। সকালে ঘণ্টাখানেক হাঁটবে, খবরের কাগজ পড়বে, দুপুরে খাওয়ার পরে ঘণ্টা দুয়েক দিবানিদ্রা দেবে, তারপরে বিকেলে চা খেয়ে চিত্তরঞ্জন পার্কের কালীবাড়িতে গিয়ে বসে থাকবে।…কালীবাড়িটা দেখেছ?”
“চমৎকার জায়গা। টিলার উপরে পাশাপাশি তিনটি মন্দির। কালী, শিব আর রাধামাধবের। সামনে সবুজ ঘাসের লন। অতি সুন্দর পরিবেশ। চলে যাও হে পরমেশ, চলে যাও।”
“আর এই বাড়ি?” পরমেশ প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, “এই বাড়ির কী হবে?”
“বিক্রি করে দেবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যেমন ভিন্টেজ কার, তেমনি ভিন্টেজ বাড়িরও আজকাল খুব কদর। খদ্দেরের অভাব হবে না।”
শুনে হাঁ করে খানিকক্ষণ ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন পরমেশ চৌধুরি। তারপর সামনের দিকে আঙুল তুলে বললেন, “ওই গাছটা দেখছ?”
“দেখছি। ওটা জাকারান্ডা গাছ। কলকাতায় বিডন স্কোয়ারের উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা আছে। আর একটা দেখেছি ভি. আই. পি. রোডের ধারে। দিল্লিতে হেলি রোডে বঙ্গভবনের কাছেও একটা দেখেছি। ওটা দক্ষিণ আফ্রিকার গাছ।…গুঁড়ি দেখে মনে হচে, বয়েস নেহাত কম হল না।”
‘নব্বুই চলছে।” পরমেশ বললেন, “শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় কেন, আফ্রিকার আরও কয়েকটা জায়গায় হয়। যেমন ধরো মিড়ল কঙ্গোয়। এককালে যেটা ছিল ফ্রেঞ্চ কলোনি। তো আমার ঠাকুর্দা তো এখানকার ফরাসি সরকারের কাজ করতেন। তার ওপরওয়ালা কঙ্গো থেকে এখানে বদলি হয়ে আসার সময় সঙ্গে করে কারান্ডার গুটিকয়েক চারা নিয়ে। এসেছিলেন। তার থেকে একটা তিনি ঠাকুর্দাকে দেন। অন্যগুলো বেঁচেছিল কি না জানি না, তবে এটা দিব্যি বেঁচে আছে।”
আমি বললুম, “কঙ্গো তো ছিল বেলজিয়ানদেব দখলে।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সবটা নয়। খানিকটাতে ফরাসি শাসন চলত। মিডল কঙ্গো, গ্যাবন আর উবাঙ্গি শারি–এই তিনটে জায়গা নিয়ে যে এলাকা, তাকে বলা হত ফ্রেঞ্চ ইকুয়েটরিয়াল আফ্রিকা।…তো পরমেশ, এই বাড়িটা তো আরও পুরনো। কত হল এর বয়েস?”
“তা অন্তত শ দেড়েক বছর।” পরমেশ বললেন, “এক ফরাসি সাহেব তাঁর নিজের জন্যে বানিয়েছিলেন। তার কাছ থেকে আমব ঠাকুর্দা যখন কেনেন, শুনেছি তখনই এই বাড়ির বয়েস নাকি পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে।“
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন পরমেশ চৌধুরি। তারপর বললেন, “হুট করে এই বাডি কি বেচে দেওয়া যায়? এর সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িয়ে বয়েছে। আমার ঠাকুর্দা আর ঠাকুমার স্মৃতি, আমার বাবা আর মায়ের স্মৃতি, আমার নিজের গোটা জীবনের স্মৃতি। জাকারান্ডা গাছটা তো আমার ঠাকুর্দার লাগানো। বাড়ির পিছনে একটি মস্ত ছাতিম গাছ রয়েছে, সেটা লাগিয়েছিলেন আমার বাবা। আর সামনের গেটের দু’পারে যে দুটি গোলমাথা বকুল গাছ দেখছ, এই দুটিই আমার মা লাগিয়েছিলেন। গাছগুলি দেখি, আর তাদের কথা মনে পড়ে। এ সব ছেড়ে আমি যাব কোথায়? আর তা ছাড়া, এই বাড়ি আর এই গাছপালার কথা যদি ছেড়েও দিই, এত চেনা লোকজনই বা কোথায় পাব? বলতে গেলে এখানকার প্রায় প্রত্যেকটি লোককে আমি চিনি।”
হঠাৎই একেবারে সরাসরি পরমেশের দিকে তাকালেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “বিমলভূষণ সেনকে চেনো?”
মনে হল পরমেশ একটু হকচকিয়ে গেছে। ভুরু কুঁচকে বললেন, “কোন বিমলভূষণ? মন্দিরবাড়ির?”
“হ্যাঁ। যে মন্দিরে হরপার্বতীর মূর্তি রয়েছে। দু’জনেরই থার্ড আই নাকি হিরের। সত্যি?”
“সত্যি।” পরমেশ বললেন, “শুনেছি বিমলভূষণের গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার ওই হিরেজোড়া নাকি এক গুজরাটি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনেছিলেন। কিন্তু হরসূন্দরবাবু সেকথা বিশ্বাস করেন না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কে হরসুন্দরবাবু?”
“হরসুন্দর মুখুটি। বয়েস বিরানব্বই। বলতে গেলে এই চন্নননগরের গেজেট।” পরমেশ বললেন, “তার কাছে পাবে না, এমন খবর নেই।”
ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ দেখলুম সরু হয়ে এসেছে। বললেন, “ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার দেখা করা যায়?”
“বিলক্ষণ। তবে তিনি এখানে থাকেন না।”
“তা হলে কোথায় থাকেন?”
“দূরে নয়,” পরমেশ চৌধুরি হাত তুলে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “খুবই কাছে। গড় পেরিয়ে ভদ্রেশ্বরে ঢুকে খানিক এগিয়ে ডাইনে একটা গলি। গলি ধরে এই ধরো মিনিট দুই-তিন হাঁটতে হবে, বাস।”
সদানন্দবাবু বললেন, “হাঁটতে হবে কেন?”
পরমেশ বললেন, “সরু গলি, গাড়ি ঢুকবে না। কী চারুদা, যাবে?”
“যাব তো অবশ্যই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু কখন যাব।”
“যাওয়া তো এখুনি যায়।” পরমেশ বললেন, “কিন্তু আমি বলি কী, এই ভরদুপুরে গিয়ে কাজ নেই। বুড়ো এই সময়ে একটু জিরিয়ে নেয়। তা সেও জিরোক, তোমরাও খেয়েদেয়ে একটু জিরিয়ে নাও, তারপর এই ধরো চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়া যাবে। রাজি?”
“রাজি।”
.