॥ ১২ ॥
সেনেদের বাড়িতে চৈত্র-সংক্রান্তির দিনে মাছ-মাংস খাওয়া হয় না। ধাতব কিংবা চিনামাটির থালাবাসনও ব্যবহার করা হয় না। দ্বিপ্রহরিক আহার্য কলার পাতায় পরিবেশন করা হল। আহার্য বলতে আতপ চালের ভাত, মুগের ডাল, দুতিন রকমের ভাজাভুজি, ধোঁকা ও ছানার দালনা, দই ও সন্দেশ। খাবার জল দেওয়া হল মাটির গেলাসে। খেয়ে বেশ তৃপ্তি পাওয়া গেল।
ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে শুধু একটা পারিশ্রমিকের খাম ধরিয়ে দিয়েই বিমলভূষণ ক্ষান্ত থাকেননি। বারবার অনুরোধ করেছিলেন যে, রাতটাও যেন আমরা তার ওখানে কাটিয়ে আসি। কিন্তু ভাদুড়িমশাই কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, “আজও আমরা চন্দননগরে থাকব ঠিকই, তবে এখানেই আমার এক পুরনো বন্ধুকে কথা দিয়েছি যে, বিকেল আর রাতটা তার সঙ্গে কাটাব। কিন্তু যাবার আগে একটা কথা বলে যাই, হিরে দুটো ইনসিওর করে ফেলুন। এ নিয়ে আর গড়িমসি করবেন না।”
নীচে নেমে আমরা গাড়িতে উঠে পড়লুম। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “নুটু বোধহয় পরমেশের বাড়িতে এতক্ষণে পৌঁছে গেছে।”
শুনে আমি অবাক। বললুম, “জানলেন কী করে?”
“খাওয়ার ডাক পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে যে আমি ডাইনিং হলে যাইনি, গিয়েছিলাম আপনাদের একটু পরে, সেটা লক্ষ করেছিলেন?”
“তা করেছিলুম। ড্রয়িং রুমে বসে আবার একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন বুঝি?”
“না,” ভাদডিমশাই বললেন, “বিমলভূষণের সঙ্গে আপনাদের খেতে রওনা করিয়ে দিয়ে চটপট নীচে নেমে একবার নুটুদের ঘরে যাই। আশা করেছিলুম, নুটুর সঙ্গে দেখা হবে। হলও। তার বউয়ের কাছে নুটু সব শুনেছে। বলল যে, বউ যে এ কাজ করবে, সে তা জানত না। আমি বললুম, খেয়ে আমরা পরমেশ চৌধুরির বাড়িতে চলে যাব, সে যেন সেখানে গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করে। পরমেশকে নুটু চেনে, বাড়ি চিনতে কোনও অসুবিধে হবে না। এতক্ষণে পৌঁছে গিয়ে থাকবে।”
সত্যিই তা-ই। নটু সত্যিই পরমেশবাবুর বৈঠকখানায় বসে অপেক্ষা করছিল। আমরা গিয়ে ঢুকতেই সে চেয়ার থেকে উঠে এসে ভাদুড়িমশাইয়ের পা জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তারপর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, “আমার বউ যা করেছে, আমার কথা ভেবেই করেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি এর বিন্দুবিসর্গও জানতুম না। আপনি যদি সব কথা শোনেন…”
নুটুর কথা শেষ হল না। ভাদুড়িমশাই তাকে বাধা দিয়ে বললেন, “মোটামুটি সবই আমি জানি। এখন যদি বেচে দেন, তা হলে লোকসানের অঙ্কটা কীরকম দাঁড়াবে?”
“তা প্রায় দশ-বারো লাখ।”
“তা হলে এখন বিক্রি করবেন না। এতদিন যখন ধরে রেখেছেন, তখন আরও কিছুদিন ধরে রাখুন।
“তা হলে এখন যে দাম পাচ্ছি, দেরি করলে তো তাও পাব না। বাজার খারাপ।”
“এখা খারাপ। কিন্তু এই অবস্থা তো চলতে পারে না। পরে নিশ্চয়ই ঘুরবে। নার্ভ শক্ত রাখুন, ভেঙে পড়বেন না।”
“কিন্তু ইতিমধ্যে যদি…”
“জানাজানি হয়ে যায়?” ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “আমি কথা দিচ্ছি, কাউকে জানাব না।”
ভাদুড়িমশাইয়ের মুখের দিকে তাকাল নটু। কয়েক মুহূর্তের জন্য তাকিয়েই রইল। তারপর চোখ নামিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।
বাইরে থেকে একটা ভটভট শব্দ ভেসে এল। বুঝলুম যে, নুটু এখানে মোটরবাইকে করে এসেছিল, এখন আবার ফিরে যাচ্ছে। শব্দটা মিলিয়ে যাবার পরে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে সদানন্দবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার বলুন দিকি? হতে পারে নকল হিরে, কিন্তু এই যে সেটা চুরি হল, আর আপনি সেটা উদ্ধার করে দিলেন, এর মধ্যে নো ফ্রেঞ্চ কানেকশন?”
ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। এক মুখ ধোয়া ছাড়লেন। তারপর সেই আগের মতোই মৃদু হেসে বললেন, “ভেবেছিলাম একটু গড়িয়ে নেব, কিন্তু আপনার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, সবকিছু না-জানলে আপনার পেটের ভাত হজম হবে না।..না, এর মধ্যে কোনও ফ্রেঞ্চ কানেকশন নেই।”
“তার মানে লুই আঁতোয়ান ওই যে টাকা চেয়ে চিঠি লিখেছিল?”
“টাকা তাকে দেবে কে? চন্দ্রভূষণ? তিনি তো চিঠিতে কী আছে, তা জানতেও পারেননি। তার আগেই তিনি জ্বরে পড়েন। মারাও যান সেই জ্বরেই।”
বললুম, “কিন্তু টাকা না-পেয়ে ব্যাপারটাকে লুই আর পার্স করেনি?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “মনে তো হয় না। আমার ধারণা, ধার শোধ করতে না-পারায় লোকটার জেল হয়, আর জেলের মধ্যেই সে মারা যায়। অবশ্য এটা আমার ধারণা মাত্র, ঠিক কী যে হয়েছিল, তা তো জানার উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, আর-কোনও চিঠি সে বোধহয় লেখেনি। লিখলে সেকথা বিমলভূষণ নিশ্চয় জানাত।”
“আর ওই মার্ত্যাঁ লুমিয়ের?”
“ও তত নেহাতই একজন রিসার্চ স্কলার। হিন্দু টেম্পল নিয়ে রিসার্চ করতে এসেছে, কাজ শেষ করে দেশে ফিরে যাবে।…না না, চুরি-বাটপাড়ির সঙ্গে ওর কোনও সম্পর্ক নেই।”
আমার সন্দেহ কাটছিল না। বললুম, “কৌশিক ওকে প্রথমবার দেখে বলেছিল, লোকটার চোখ নীল। পরে আমি শ্রীরামপুর পেরিয়ে দেখলুম নীল নয়, বাদামি। এটা কী করে হয়?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “হতেই পারে। কনটাক্ট লেন্স পালটালেই হয়। আজকাল তো ওটাই ফ্যাশন।”
পরমেশ চৌধুরি ইতিমধ্যে বাড়ির ভিতরে গিয়ে চায়ের কথা বলে এসেছিলেন। ভৃত্য এসে সেন্টার টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে দিয়ে গেল। সদানন্দবাবু নিজের পেয়ালায় লিকার ঢেলে নিলেন। অন্যেরা যিনি যেমন পছন্দ করেন, সেইমতোবানিয়েও দিলেন অন্যদের চা। তারপরে নিজের পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে বললেন, “একটা কব্জিজ্ঞেসকরব?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “মাত্র একটা কেন, যে কটা খুশি।”
“গতকাল সকালে এখান থেকে রওনা হয়ে, সরাসরি সেনেদের বাড়িতে না গিয়ে, তিন জায়গায় আমরা থেমেছিলুম। প্রথমে একটা চশমার দোকান থেকে আপনি একজোড়া সান- গ্লাস কেনেন। ওটা কেনার কি তখনই খুব দরকার ছিল?”
“ছিল বই কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কলকাতা থেকে নিয়ে আসিনি, তাই কিনতে হল। সানগ্লাসের মত্ত সুবিধে। ওটা পরলে আপনি সবাইকে দেখতে পান, কিন্তু আপনার চোখ কেউ দেখতে পায় না। ফলে কেউ বুঝতে পারে না যে, ঠিক কোন দিকে আপনি তাকিয়ে আছেন বা ঠিক কার উপরে নজর রাখছেন।”
“বুঝলুম। কিন্তু তারপরই দুই বন্ধুর বাড়িতেও আপনি গেছলেন। তারা কে?”
“আপনার আগের প্রশ্নটা ভাল ছিল। এটাও বেশ ভাল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “প্রথম জনের নাম আদিনাথ ঘোয় আর দ্বিতীয় জনের নাম শ্ৰীমন্ত বসাক।…ওহে পরমেশ, তোমরা তো এখানকার পুরনো বাসিন্দা, এঁদের চেনো না?”
“কেন চিনব না?” পরমেশ বললেন, “ওঁরা দুজনেই তো স্ট্র্যান্ডে প্রায়ই হাঁটতে আসেন।”
“ওঁরা কী করেন, তাও জানো আশা করি?”
“জানি বই কী। আদিনাথবাবু শেয়ার মার্কেটের ব্রোকারি করতেন। কলকাতায় ওঁদের ছোটখাটো একটা আপিসও আছে। তবে আজকাল আর উনি বেচাকেনার কাজটা নিজে করেন না। কলকাতার আপিসের কাজকর্মও ওঁর ছেলেই দেখছে। ভদ্রলোকের শেয়ারের জ্ঞান শুনেছি টাটনে। এও শুনেছি যে, আদিনাথবাবু কাজকর্ম থেকে অবসর নিলে কী হয়, কোন শেয়ারটা কেনা ঠিক হবে আর কোনটা হবে না, সেটা বোঝার জন্য এখনও অনেকেই ওঁর কাছে যায়।”
“কারেক্ট। আর শ্ৰীমন্ত বসাক?”
“উনি এখানকার একজন নামজাদা জুয়েলার।” পরমেশ বললেন, “গয়নার ব্যাবসা ছাড়া নানা রকমের প্রেস স্টোনের একটা সাইড বিজনেসও আছে বলে শুনেছি।”
“কারেক্ট এগেন।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তুমি বলেছিলে, বিমলভূষণের বিষয়। আশয় নুটু যেভাবে সামলাচ্ছে, তাতে তাকে একজন ঝানু লোক বলেই তোমার মনে হয়। তোমার কথা শুনে আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে, এত বড় সম্পত্তির দায়িত্ব যার হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, তলে-তলে সে নিজের আখের গোছাচ্ছে না তো? কিংবা, জুয়া-টুয়া খেলতে গিয়ে কোনও বড় রকমের আর্থিক সমস্যায় পড়ে যায়নি তো? তা এক ঝানু লোকের সম্পর্কে জানতে হলে আর-এক ঝানু লোকের কাছে যাওয়াই ভো নিয়ম, তাই না?”
সদানন্দবাবু বললেন, “বুজিছি। সেই জন্যেই আপনি আদিনাথবাবুর কাঁচে গেসলেন।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক ধরেছেন। আসলে, হিরের দিকে কে কে হাত বাড়াতে পারে, সেটা ভাবতে গিয়ে নুটুকেও আমার লিষ্টি থেকে আমি বাদ দিইনি। তা আদিনাথ যা বলল, তাতে মনে হল, আমার সন্দেহটা মিথ্যে নয়।
“অর্থাৎ যে রক্ষক, সে-ই ভক্ষক! বিমলভূষণের সম্পত্তির একটা মস্ত অংশ টু হাতিয়ে নিয়েছে, কেমন?”
“না, সদানন্দবাবু,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এটা আপনি ঠিক কথা বললেন না। সম্পত্তি নই হাতায়নি। টাকাকড়িও না। শুধু তা-ই নয়, পুরনো সম্পত্তি তো সে আগলে রেখেছেই, তার উপরে নতুন সম্পত্তি যা কিছু কিনেছে, তা সবই কিনেছে বিমলভূষণের নামে। সেদিক থেকে সে মোলো-আনার উপরে আঠারো-আনা সৎ। অথচ এক্ষুনি যে তার লাখ-লাখ টাকা দরকার, তাও ঠিক।”
সদানন্দবাবুর মুখ দেখে মনে হল, তিনি ধাঁধায় পড়ে গেছেন। বললেন, “তা কী করে হয়?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী করে হয়, তা আদিনাথের কাছেই জানা গেল। সে-ই বলল যে, বছর পাঁচেক আগে বিমলভূষণের নামে সে লাখ পঁচিশেক টাকার শেয়ার কিনেছিল, অ্যাট পার। শেয়ারগুলোর দাম আস্তে-আস্তে বাড়ছিলও। ইন ফ্যাক্ট যদি বছর দুয়েক আগেও বেচে দিত, তা হলে লাভ নেহাত খারাপ থাকত না। কিন্তু তখন বেচেনি। আর তারপরেই দাম হঠাৎ পড়তে শুরু করে।”
জিজ্ঞেস করলুম, “পড়তির মুখেও ছেড়ে দেয়নি?”
‘না। ভেবেছিল এটা সাময়িক ব্যাপার, দাম আবার উঠবে। কিন্তু ওঠা তো দূরের কথা, দাম আরও পড়ে যায়। দশ টাকার যে শেয়ার বাইশ টাকায় উঠেছিল, তা এখন পাঁচ থেকে ছ’টাকার মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে।”
“ওরে বাবা,” পরমেশ বললেন, “সে তো অনেক টাকার লোকসান।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আদিনাথ বলল, দাম যেখানে উঠেছিল, সে-কথা ভুলে গিয়ে যদি পারচেজ-প্রাইসের কথাও ভাবা যায়, তো লোকসান তা ধরো দশ-বারো লাখ টাকার।”
একটুক্ষণের জন্যে চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “তো আমার সন্দেহ হল, হিরে দুটো হাতিয়ে গোপনে বেচে দিয়ে সেই টাকায় নুটু ওই দশ-বারো লাখের ঘাটতি মেটাবার কথা ভাবছে না তো? আজ ভোরে হরপার্বতীর চোখে যখন হিরে পরানো হয়, গেস্ট হাউসের বারান্দা থেকে নুটুর উপরে তখন তাই কড়া নজর রেখেছিলুম। দেখছিলুম, হিরের দিকে সে হাত বাড়ায় কিনা।” ।
আমি বললুম, “সে-দুটো অবশ্য আসল হিরে নয়, নকল হিরে।”
“তা হোক,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “নুটু তো সেকথা জানত না। হাত বাড়ালে সে আসল হিরে ভেবেই বাড়াত।”
সদানন্দবাবু বললেন, “অথচ অন্ধকারে নুটুর বদলে হাত বাড়াল তার ওয়াইফ! হরি হরি!”
ঠাট্টা করবেন না, ঠাট্টা করবেন না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সাধ্বী স্ত্রীর যা করা উচিত বলে নুটুর বউয়ের মনে হয়েছিল, সে তা-ই করেছে। নুটু নিজের আর্থিক সমস্যার কথা তাকে জানিয়েছিল কি না, তা আমি জানি না। হয়তো জানিয়েছিল, হয়তো জানায়নি। কিন্তু যদি নাও জানিয়ে থাকে, তবু সে আঁচ করেছিল নিশ্চয়। তা নইলে কেন বিগ্রহের চোখের দিকে সে হাত বাড়াবে? নুটুকে তার আর্থিক সমস্যা থেকে সে উদ্ধার করতে চেয়েছিল। তবে আমার বিশ্বস টু সেকথা জানত না।”
আমি বললুম, “তা তো হল, কিন্তু অত তাড়াতাড়ি ওই নকল চোখজোড়া আপনি জোগাড় করলেন কীভাবে? সাইজ আর শেপ তো বলতে গেলে একেবারে একইরকম। চট করে কোনও পার্থক্যও তো কেউ ধরতে পারবে না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার কৃতিত্ব আমার দ্বিতীয় বন্ধুটির, অর্থাৎ শ্ৰীমন্ত বসাকের। সে যে এখানকার একজন নামজাদা জুয়েলার, তা তো পরমেশের মুখেই শুনলেন। এও শুনলেন যে, সে সোনার গয়না ছাড়া নানারকম প্ৰেশাস স্টোনেরও কারবারি। তা কাজ করা কাঁচের স্টকও তার কম নয়। আংটি কিংবা দুলে কিংবা নাকছাবিতে যারা নানা রঙের পাথর বসিয়ে নেয়, তাদের সবারই কি আর হিরে-চুনি-পান্না বসাবার মতো পয়সা আছে? পয়সা না থাকলে মধ্বভাবে গুড়ং দদ্যাৎ, অর্থাৎ হিরে-চুনি-পান্নার বদলে তারা কাঁচ বসায়।”
একটুক্ষণের জন্যে চুপ করলেন ভাদুড়িমশাই। ফের একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর তার আগের কথার জের টেনে বললেন, “তা কাল দুপুরে সেনেদের বাড়িতে গিয়ে হিরে দুটিকে যখন প্রথম দেখি, তখনই বেশ ভাল করে তার শেপ আর সাইজ আমি দেখে নিই। গেস্ট হাউস থেকে কাল দুপুরে ফের একবার বেরিয়েছিলুম, আপনাদের মনে পড়ে?”
বললুম, “হ্যাঁ, গৌরাঙ্গ ভট্টচাজের সঙ্গে কথা শেষ করার পরেই আপনি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান। তারপর পাঁচটা নাগাদ গেস্ট হাউসে ফিরে আসেন। কোথায় গিয়েছিলেন?”
“তাও বলতে হবে?” ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাঃ কিরণবাবু, আপনাকে নিয়ে আর পারা গেল না। সত্যিই আপনি দিনে দিনে একটি বাঁধাকপি হয়ে যাচ্ছেন!”
সদানন্দবাবু বললেন, “নিশ্চয় আপনার সেই জুয়েলার বন্ধুর বাড়িতে গেলেন?”
ভাদুড়িমশাই ফের আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই দেখুন, সদানন্দবাবু ঠিক ধরেছেন।…হ্যাঁ, শ্ৰীমন্তের কাছেই গেসলাম। তবে তার বাড়িতে নয়, দোকানে। সেনেদের হিরের সাইজ আর শেপ তো আমার স্মৃতিতে একেবারে গাঁথাই ছিল, তাই কাগজে সে দুটোকে এঁকে দেখাতে কোনও অসুবিধেই হল না। শ্ৰীমন্তও সঙ্গে-সঙ্গে নানান সাইজের নানান শেপের আর নানান নকশার কাজ করা এক বাক্স কাঁচ আমার সামনে এনে বলল, এর থেকে বেছে নাও।”
“বেছে নিলেন?”
“আমাকে আর কষ্ট করে বাছতে হল না। ওর দোকানেরই এক কর্মচারী এসে আমারই আঁকা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে আমাকে বেছে দিলেন। দেখলুম, যা চেয়েছিলুম, একেবারে সেই জিনিসটিই পেয়েছি।
পরমেশ বললেন, “তারপর?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তারপর আর কী, কাল রাত্তিরে তো সেনেদের বাড়িতে খেতে গেসলুম। তখন আসল হিরেজোড়া আমার হাতে চলে এল, আর নকল হিরে ঢুকে গেল ভেলভেটের বাক্সে। এটা কীভাবে হল, সেটা আজই এঁদের সামনে একবার বলেছি, তুমি এঁদের কাছ থেকে জেনে নিয়ো। কিন্তু আর নয়, যা গরম পড়েছে, এইভাবে আর বসে থাকা যাচ্ছে না। চলি হে পরমেশ, ঘরের জানলাগুলো বন্ধ করে, ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে একটু গড়িয়ে নেওয়া যাক্। আর হ্যাঁ, বুঝতেই তো পারছ, এর সঙ্গে একটা ফ্যামিলির মান-সম্মানের প্রশ্নও জড়িয়ে রয়েছে। তাই যা-যা শুনলে, তা যেন কক্ষনো কাউকে বোলো না।”
পরমেশ হেসে বললেন, “পাগল! তা কখনও বলা যায়?”
সোফা থেকে উঠে ভাদুড়িমশাই তার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। যেতে-যেতেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “চুরির ব্যাপারে না থাক, ও-বাড়ির চেহারায় কিন্তু ফ্রেঞ্চ কানেকশনটা রয়েই গেল। সেটা লক্ষ করেছেন সদানন্দবাবু?”
সদানন্দবাবু বললেন, “তা করিচি বই কী। দেওয়ালে টাঙানো অয়েল পেন্টিংয়ের কতা বলচেন তোতাতে কালীভূষণের চোক কালো হলে কী হয়, তার ছেলে কীর্তিভূষণের চোক নীল।”
“তারপর এক পুরুষ অর্থাৎ চন্দ্রভূষণকে বাদ দিয়ে আমাদের বিমলভূষণের চোখেও সেই নীল রং এসে ঢুকে পড়েছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “একে কী বলে জানেন তো? আটাভিজম।”
বলে আর অপেক্ষা করলেন না ভাদুড়িমশাই, দরজার পর্দা সরিয়ে তার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
ঘণ্টা দুয়েক গড়িয়ে নিয়ে বিকেলে একবার সবাই মিলে ভদ্রেশ্বরে যাওয়া হয়েছিল। লুই আঁতোয়নের চিঠিখানা হরসুন্দরবাবুকে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি। ভদ্রলোককে বড়ই বিমর্য মনে হল। মানতের চুল আগেভাগেই কেটে দিয়েছেন বলে যেমন পাড়ার পাঁচজনের কাছে তেমন নিজের বাড়িতেই তাকে বোধহয় খুবই হোস্তা হতে হয়েছে।
ভদ্রেশ্বর থেকে একেবারে সরাসরি আমরা চন্দননগরের স্ট্র্যান্ডে চলে যাই। সেখানে গঙ্গার ধারে রাত প্রায় আটটা অব্দি বসে গল্পগুজব করি। একটু আগে পরমেশের বাড়িতে ফিরে স্নান করে রাতের খাওয়া সেরে নিয়েছি। এখন ছাতের উপরে মাদুর বিছিয়ে বসে চলছে আড্ডা।
তারই মধ্যে হঠাৎ ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা ব্যাপার কিন্তু বোঝা গেল না। আজ সকালে মন্দির-চত্বরে ওই যে মেন সুইচ অফ করে আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, ওটা কে করল?”
সদানন্দবাবু বললেন, “তা জানি না, তবে আলো নিববার আগে কিন্তু একটা লোককে খুবই সন্দেহজনকভাবে আমি ওখানে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিলুম। লোকটা যেমন বেঁটে, তেমনি কালো। তা ছাড়া তার গালে বেশ বড়সড় একটা আঁচিলও দেখেছি।”
আমি বললাম, “এ তো গৌরাঙ্গ ভটচাজের দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। গঙ্গার ঘাটে গৌরাঙ্গ অবশ্য দু’জন লোককে হিরে নিয়ে কথা বলতে শুনেছিল। অন্যজনও কালো, তবে বেঁটে নয়, ঢ্যাঙা।”
“ঢ্যাঙাটা হয়তো ভিড়ের মধ্যেই ছিল।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “হয়তো দু’জনে মিলে প্ল্যান এঁটেছিল যে, বেঁটেটা মেন-সুইচ অফ করে দিলেই ঢ্যাঙাটা অমনি অন্ধকারের মধ্যে ছিনিয়ে নেবে হরপার্বতীর চোখ। ইতিমধ্যে আরেকজনও যে হিরে চুরির ধান্ধায় আছে, তা তারা জানত না।….তবে আমার কী মনে হয় জানেন? নুটুর বউ যে হিরে চুরির প্ল্যান এঁটেই মন্দিরে এসেছিল, তা নয়। হঠাৎ একটা সুযোগ এসে যাওয়ায় অন আ সাডেন ইমপালস সে ওটা করেছে। মানে অন্যেরা জমি তৈরি করে দিল, অ্যান্ড শি জাসট রিপড় দ্য হারভেস্ট!”
পরমেশ চৌধুরি বললেন, “একেই বলে চোরের উপর বাটপাড়ি?”
আমরা হেসে উঠলুম।
***
রচনাকাল : ১৪০৪