॥ ১০ ॥
আজ চোদ্দোই এপ্রিল, চৈত্র-সংক্রান্তি, বুধবার। ডেকরেটরের লোজন ও ইলেকট্রিক মিস্ত্রি-মজুরদের যে চিৎকার-চেঁচামেচি আর সেইসঙ্গে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠোকার যে অবিশ্রান্ত ঠকঠক শব্দের মধ্যে গতকাল শয্যাগ্রহণ করেছিলুম, রাত দুটো নাগাদ তা খানিকটা স্তিমিত হয়ে আসে। সম্ভবত সেই সময়ে আমার দুচোখের পাতা ঘুমে জড়িয়ে এসেছিল। কিন্তু খুব বেশিক্ষণ আমি ঘুমোতে পারিনি। খানিক বাদেই শঙ্খধ্বনি আর কাসর ঘণ্টার আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙে যায়। হাতঘড়ির রেডিয়াম লাগানো ডায়ালের দিকে তাকিয়ে দেখি, চারটে বাজে। সদানন্দবাবু তখনও ঘুমোচ্ছেন। তাকে আর জাগাই না। ঝটপট মুখ হাত ধুয়ে, দাড়ি কামিয়ে, স্নান সেরে নিই। তারপর তাকে ঠেলে তুলে দিয়ে জামাকাপড় পালটে নীচে নামতে নামতে সাড়ে চারটে বাজে। নীচে নেমে দেখি, ভাদুড়িমশাই আমার আগেই একতলায় এসে দাঁড়িয়ে আছেন।
তখনও রাত কাটেনি। অথচ এরই মধ্যে পিলপিল করে তোক আসতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে চত্বরটা ভরে গেল। তার মধ্যে বুড়ো, বুড়ি, যুবক, যুবতী তো আছেই, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েও কিছু কম নেই। কোলে বাচ্চা নিয়েও এসে গেছে অনেক মা। তারা চত্বরের শানে হাত ঠেকিয়ে সেই হাত তাদের কোলের বাচ্চার মাথায় ঠেকিয়ে দিচ্ছে। বাইরে থেকে ওদিকে লোক আসছে তো আসছেই। এ দেশে ধর্মের যে কী টান, আর সেই টানে মানুষ যে কীভাবে ছুটে আসে, এই শেষ রাত্তিরে এখানে এসে না দাঁড়ালে তা বুঝতেই পারতুম না।
মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। গেস্টহাউসের একতলার বারান্দাটা বেশ উঁচু। তাই এখানে দাঁড়িয়ে, জনতার মাথার উপর দিয়ে হরপার্বতীর মূর্তিটিকে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য বেশ উঁচু গলায় শিবস্তোত্র পাঠকরতে করতে একটি ঘণ্টা নেড়ে যাচ্ছেন। তাঁর দু’পাশে দুটি যুবাবয়সী মানুষ। একজন শাঁখ বাজাচ্ছে, অন্যজন কাসর। এইসব দেখছি ও শুনছি, এমন সময় দোতলা থেকে নেমে সদানন্দবাবু আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললুম, “স্নান করে নিয়েছেন?” তাতে তিনি বললেন, “তার সময় পেলুম কোতায়?…ওরে বাবা, এ তো দেকচি ইন্দ্রপুরীবানিয়ে ছেড়েছে।”
সদানন্দবাবু খুব একটা বাড়িয়ে বলেননি। চত্বরের উপরকার তেরপলের ছাউনির তলা দিয়ে তিন-চার ফুট অন্তর অন্তর আড়াআড়ি ভাবে টানা বাঁশের বাতা থেকে ঝোলানো অজস্র ইলেকট্রিক বালবের মালা থেকে অতিশয় কড়া আলো তো বিরিত হবে, সেই সঙ্গে ব্যবস্থা করা হয়েছে বেশ জোরালো দুটি ফ্লাড লাইটের। ফলে যেমন মন্দির তেমনি গোটা চরটিও আলোয় ঝলমল করছে। চত্বরটিকে ঘিরে জ্বলছে কিছু আমোর চরকিও। চন্দননগরের আলোর কারিগরদের সুখ্যাতির কথা কে না জানে। সুযোগটা যখন নিজেদের এলাকাতেই পাওয়া গেছে, তখন অন্তত খানিকটা কেরামতি না দেখিয়ে তারা ছাড়বে কেন। এতক্ষণ যে হট্টগোল চলছিল, হঠাৎই যেন তার মাত্রা আরও বেড়ে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখলাম, ভলান্টিয়ার ছেলেরা চত্বরের ভিড়কে দু’পাশে খানিকটা ঠেলে দিয়ে মাঝ বরাবর একটা রাস্তা করে দিচ্ছে। কেন এমন করা হচ্ছে, জিজ্ঞেস করার জন্য ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাতে তিনি চাপা গলায় বললেন, “পিছনে তাকিয়ে দেখুন।”
ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলুম, সেনেদের বসতবাড়ির দিক থেকে ছোট্ট একটি মিছিল ধীরে ধীরে চত্বরে এসে ঢুকল। মিছিলের সামনে বিমলভূষণ। তার পিছনে পরপর তার স্ত্রী, জামাতা ও কন্যা। তারও পিছনে আট-দশ বছরের দুটি ছেলে, এবং সর্বশেষে একটি অল্পবয়সী বউ। বউটিকে দেখে চকিতে মনে হল, আগেও কোথাও একে দেখেছি। কিন্তু ঠিক যে কোথায় দেখেছি, তক্ষুনি তা মনে করতে পারলুম না। মিছিলের সামান্য পিছনে মাতা লুমিয়েরকেও দেখলুম। দেখেই বুকটা ছ্যাত করে উঠল। লোকটা কি সত্যিই মন্দিরের এই উৎসব দেখতে এসেছে? নাকি অন্য কোনও মতলব আছে ওর?
নুটু চত্বরের মধ্যেই ছিল। সেনেদের বাড়ির মিছিল চত্বরে এসে পৌঁছবামাত্র ভিড় ঠেলে সেইদিকে এগিয়ে গেল সে। শাঁখ, কাঁসর ও ঘন্টার শব্দ একটুক্ষণের জন্য থেমে ছিল, এবারে আবার ঘন ঘন শঙ্খধ্বনি হতে লাগল, কাসর-ঘণ্টা দ্বিগুণ উৎসাহে বাজতে থাকল, আর গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্যও তার গলা আরও উঁচুতে উঠিয়ে মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন।
বিমলভূষণ আজ সাদা গরদের ধুতি পরেছেন। গলার দু’দিক দিয়ে জরির পাড় বসানো। গরদের চাদর ঝুলছে। কপালে শ্বেতচন্দনের ফোঁটা। জুতো পরেননি। পা দুটি অনাবৃত। দু’হাতে ধরে আছেন সেই ভেলভেটে মোড়া বাক্সটিকে, যেটিকে কাল দুপুরে ওঁর বাড়িতে আমরা দেখেছি, আর যে বাক্সের মধ্যে মহার্ঘ সেই হিরে দুটি রয়েছে বলে আমি জানি।
ভিড়ের ভিতর দিয়ে সরু যে পথ করে দেওয়া হয়েছিল, সেনেদের বাড়ির মিছিল সামনে এগিয়ে গেল সেই পথ দিয়ে। তারপর একে একে সবাই মন্দিরের বারান্দায় উঠে পড়লেন। মাতা লুমিয়ের অবশ্য আর এগোল না। হাতে ক্যামেরা নিয়ে সে মন্দিরের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে রইল। বিগ্রহের অক্ষিকোটরে হিরে দুটি বসিয়ে দেবার সঙ্গে-সঙ্গেই সে তার ছবি তুলবে, ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে তার দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখেই তা বুঝতে পারলুম।
গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য এই মুহূর্তটির জন্য একেবারে তৈরি হয়েই ছিলেন। হাতে একটি মার পাত্র নিয়ে তিনি বিমলভূষণের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মন্ত্রোচ্চারণ করে তার কপালে আর-এক প্রন্ত চন্দন লেপে দিলেন। মাথায় ধানদুর্বা রাখলেন, সর্বাঙ্গে গঙ্গাজল ছেটালেন। তারপর সরে এলেন তার সামনে থেকে। বারান্দা থেকে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে গেলেন বিমলভূষণ।
সবই এখান থেকে দেখতে পাচ্ছি। ভেলভেটের বাক্স খুলে হরপার্বতীর তৃতীয় নয়নে হিরে দুটি পরিয়ে দেওয়ার দৃশ্যও স্পষ্ট দেখলম। কাঁসর-ঘণ্টা সমানে বাজছে ঘন ঘন শধ্বনি হচ্ছে, জনতা সোনাসে চিৎকার করছে–জয় শঙ্কর, জয় পার্বতী। ওদিকে মাতা লুমিয়েরের ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বা ঝলসে উঠছে বারবার। তারই মধ্যে দেখলুম, হরপার্বতীর যুগলমূর্তিকে জোড়হস্তে নমস্কার করে বিমলভূষণ খুবই ধীর পায়ে মন্দিরের ভিতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসছেন।
বিমলভূষণ বেরিয়ে আসার পর তার পরিবারের লোকেরা মন্দিরের মধ্যে ঢুকে বিগ্রহের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁদেরই বাড়ির অনুষ্ঠান, সুতরাং মন্দিরে ঢোকার অগ্রাধিকারও তাদেরই।
ঠিক এই সময়েই ঘটল একটি ভয়াবহ ঘটনা। মন্দির, চত্বর ও গেস্ট হাউসের একতলা-দোতলার সমস্ত আলো একেবারে একই সঙ্গে নিভে গেল। লোকজনেরা ছুটোছুটি শুরু করে দিল, বাচ্চারা তারস্বরে কাঁদতে লাগল, ভলান্টিয়াররা চেঁচিয়ে বলতে লাগল, “আপনারা ভয় পাবেন না, ছুটোছুটি করবেন না, যে যেখানে আছেন সেইখানেই চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন, আমরা জেনারেটর চালাবার লোক আনতে পাঠিয়েছি, সে এসে পড়লেই জেনারেটর চালু হয়ে যাবে।”
আমার ভয় হল, এক্ষুনি একটা স্ট্যাম্পিড শুরু হয়ে যেতে পারে। ভোর হয়েছে, সূর্য উঠেছে, চারদিকে আলো ফুটেছে, অথচ মাথার উপরে তেরপলের ছাউনি থাকায় আর টিন ও চট দিয়ে চারপাশ ঘিরে রাখায় এই চত্বরের মধ্যে এক ফোঁটাও দিনের আলো ঢুকতে পারছে না। চারদিকে একেবারে জমাট অন্ধকার। এর মধ্যে যদি স্ট্যাম্পিড শুরু হয় তো আর দেখতে হবে না, বিস্তর লোকের হাত-পা ভাঙবে, এক-আধটা বাচ্চাও হয়তো ভিড়ের চাপে পিষে গিয়ে মারা পড়তে পারে।
জেনারেটর অবশ্য পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চালু হয়ে গেল। ফটাফট আলো জ্বলে উঠল আবার। আর আলো জ্বলতেই গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্য আর্তনাদ করে উঠলেন : “আরে, হরপার্বতীর হিরে কোথায় গেল!”
বিমলভূষণ তার পরিবারের লোকদের সঙ্গে মন্দিরের বাইরের বারান্দায় সামনের দিকে তাকিয়ে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মনে হল, অন্যেরা যখন ছোটাছুটি করছিল, তখন তিনি বারান্দা থেকে নীচে নামেননি। গৌরাঙ্গ ভট্টাচার্যের আর্তনাদ শুনে তিনি মন্দিরের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, তারপর চকিতে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে, বারান্দা থেকে নেমে, প্রায় দৌড়ে চলে এলেন আমাদের কাছে। এসেই, ভাদুড়িমশাইয়ের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বললেন, “এ কী হল মিঃ ভাদুড়ি?”
ভাদুড়িমশাই শান্ত গলায় বললেন, “ধৈর্য ধরুন, উতলা হবেন না। আমার ধারণা, লোডশেডিং হয়নি, মেন সুইচটা কেউ অফ করে দিয়েছে। আপনি সেটা চাল করার ব্যবস্থা করুন।”
“কিন্তু হিরে দুটোর কী হবে?”
“হিরে আপনি ফেরত পাবেন।” ভাদুড়িমশাই সেই একই রকমের শান্ত গলায় বললেন, “এখন যা বলছি, সেই কাজটা করুন তো।”
বলে আর তিনি দাঁড়ালেন না। গেস্ট হাউসের বারান্দা থেকে নেমে, চত্বর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে চাপা গলায় আমাকে বললেন, “সদানন্দবাবুকে নিয়ে আমার সঙ্গে আসুন।”
বিনা বাক্যে আমরা তার সঙ্গ নিলুম। বুঝলুম যে, এখন কোনও প্রশ্ন করে লাভ নেই। প্রশ্ন করলেও জবাব পাওয়া যাবে না। লম্বা লম্বা পা ফেলে মন্দির প্রাঙ্গণ পেরিয়ে গেলেন ভাদুড়িমশাই, সেনেদের কম্পাউন্ড ওয়ালের গেট দিয়ে ঢুকে তাদের বসতবাড়ির পথ ধরলেন। এত জোরে তিনি হাঁটছিলেন যে, তার সঙ্গে তাল রেখে চলতে আমাদের বেশ কই হচ্ছিল। পিছন থেকে তবু বললুম, “ও বাড়িতে গিয়ে কী হবে? বিমলভূষণরা তো কেউ বাড়িতে নেই, ওরা তো মন্দিরে।”
ভাদুড়িমশাই আমার কথার কোনও জবাব দিলেন না। বসতবাড়ির সদর দরজা খোলাই ছিল, তিনি ভিতরে ঢুকে, দোতলার সিঁড়ির দিকে না গিয়ে, একতলারই ডানদিকের ঘরের দরজার কড়া ধরে জোরে-জোরে নাড়তে লাগলেন।
মিনিট খানেক ধরে ক্রমাগত কড়া নাড়ার পর যে বউটি এসে দরজা খুলে দিল, আজই কিছুক্ষণ আগে বিমলভূষণদের মিছিলের শেষে তাকে আমি দেখেছি। দেখে মনে হয়েছিল, আগেও কোথাও একে আমি দেখেছিলুম, কিন্তু ঠিক কোথায় যে দেখেছি, সেই মুহূর্তে তা মনে পড়েনি। এখন মনে পড়ল যে, কাল দুপুরে নুটু যখন আমাদের এই বাড়িতে নিয়ে এসে, দোতলার সিঁড়িটা দেখিয়ে দিয়ে একতলার এই ঘরে ঢুকে যায়, তখন পর্দার আড়ালে এরই মুখ আমি চকিতে একবার দেখতে পেয়েছিলুম।
বউটির মুখে ভয়ের ছাপ। দরজা খুলে আমাদের দেখে মুখ নামিয়ে স্বলিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনারা?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমরা কলকাতা থেকে এসেছি।”
“কিন্তু আমার স্বামী তো এখন বাড়িতে নেই।”
“আমরা আপনার স্বামীর কাছে আসিনি।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আমরা আপনার কাছেই এসেছি। চটপট হিরে দুটো বার করে দিন। কথা দিচ্ছি, কেউ কিছু জানবে না।”
মুখ তুলে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাল বউটি। কী দেখল, সেই জানে। তারপর আর কথা না বাড়িয়ে, ব্লাউজের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ছোট্ট একটা কাগজের পুরিয়া বার করে এনে সেটা ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, “আমার স্বামীকে আমি বাঁচাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারলাম না।”
“বাঁচাতে হবে কেন,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর তা ছাড়া, এই হিরে দিয়ে বাঁচানো যায়? এ তো নকল হিরে!”
বলে আর দাঁড়ালেন না। বসতবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের নিয়ে ফের মন্দিরের দিকে রওনা হলেন।
.