৮
কলকাতা থেকে তাড়াহুড়ো করে চলে আসতে হয়েছিল বলে দরকারি কয়েকটা জিনিস কিনে আনার সময় পাওয়া যায়নি। নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে সে-সব কেনা হল। বাড়ি ফিরতে-ফিরতে এগারোটা। গাড়ি থেকে আমরা নেমে পড়লুম। রঘুনন্দন নামল না। বলল, মিশ্রজি অসুস্থ হয়ে পড়ায় গতকাল মিউজিয়ামে যেতে পারেননি, এখন বেশ কিছুদিন পারবেনও না, তাই তার একবার সেখানে যাওয়া উচিত। তবে বেশিক্ষণ সে মিউজিয়ামে থাকবে না। সেখানকার যারা কর্মী, তাদের সঙ্গে দরকারি কিছু কথাবার্তা সেরেই ফের বাড়িতে চলে আসবে। “আপনারা বিশ্রাম করুন, ব্রেকফাস্টে তো চা পাননি, এবারে এক রাউন্ড চা খেয়ে নিন, লাঞ্চ তো একটায়, আমি তার মধ্যেই ফিরে আসব।”
গাড়ি নিয়ে রঘুনন্দন বেরিয়ে গেল, আমরা দোতলায় উঠে এলুম।
নার্সিং হোম থেকে বাড়ির পথে রওনা হবার পর সদানন্দবাবু যে এ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে একটাও কথা বলেননি, নতুন কোনও জায়গায় গেলেই যিনি হাজার রকমের প্রশ্ন করে আমাদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন, আজ যে তিনি ভুলেও কোনও প্রশ্ন করছিলেন না, তার কারণ আর কিছুই নয়, সারাটা পথ খুবই নিচু গলায়, প্রায় ইষ্টমন্ত্র জপ করার মতন করে, স্রেফ তিনটি শব্দই তিনি ক্রমাগত জপ করে যাচ্ছিলেন : লন্ডন…মারমার কাটকাট। এবারে দোতলায় উঠে শোবার ঘরে ঢুকে খুবই গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, “মানে হবে না কেন, হয়।”
বললুম, “কীসের?”
“ওই লন্ডন মারমার কাটকাটের।”
“আপনি কি ওই নিয়েই এতক্ষণ ভাবছিলেন নাকি?”
“শুধুই যে ভাবছিলুম, তা নয়, ভেবে-ভেবে ওর মানেটাও বার করে ফেলিচি।”
“মানেটা কী?”
“আরে মশাই, তাও বুঝতে পারচেন না?” সদানন্দবাবু ভারিকে চালে বললেন, “এটা একটা কন্সপিরেসি…মানে চক্রান্তের ব্যাপার। লন্ডন থেকে এমন গোটাকয় দাঙ্গাবাজকে এখানে পাঠানো হয়েচে, যারা কিনা এঁয়াদের ওই মিউজিয়ামে ঢুকে মারামারি কাটাকাটি করে একটা খুব ভ্যালুয়েবল জিনিস লুট করবে।”
“সেটা কী?”
“বাঃ, সে তো একটা বাচ্চা ছেলেও বুঝবে। স্টোন-এজের ওই কুড়ুলটা। আগের দুটো কুড়ুল তো ওরা লন্ডনে নিয়ে গেসল, এবারে জোরজার করে এটাও নিয়ে যাবে।”
হাসি চেপে বললুম, “কথাটা নেহাত মন্দ বলেননি। যদ্দিন পরাধীন ছিলুম, সায়েব ব্যাটারা তো কোহিনুর থেকে শুরু করে আমাদের তাবৎ ভ্যালুয়েবল জিনিসই দু’ হাতে লুঠ করেছে। এখন মনে হচ্ছে স্টোন-এজের এই কুড়ুলটাও ওরা না-হাতিয়ে ছাড়বে না। তা ‘লন্ডন মারমার কাটকাট’-এর এই যে মানেটা আপনি ধরতে পেরে গেছেন, ভাদুড়িমশাইকে এটা জানাবার দরকার নেই?”
“তা তো আচেই, ব্যাপারটা আটকাতে হলে তো তিনিই আটকাবেন, তাঁকে না বললে হয়? এখুনি গিয়ে ভাদুড়িমশাইকে সব জানাচ্চি।”
ঘর থেকে সদানন্দবাবু বেরিয়ে গেলেন।
ভেবেছিলুম, স্টেশন থেকে কেনা স্পাই-থ্রিলারটার গোটা কয়েক পাতা এই ফাঁকে পড়ে ফেলা যাবে, কিন্তু তা আর হল না, কেননা ভাদুড়িমশাইয়ের ঘর থেকে তিনি ফিরে এলেন মাত্র মিনিট পাঁচেক বাদেই। এসে একগাল হেসে বললেন, “উনি তো খুবই ইমপ্রেসড। কী বললেন জানেন?”
“আপনি না-বললে কী করে জানব?”
“বললেন যে, আমি ঠিকই ধরিচি। তবে কিনা ‘মারমার’ কথাটা উনিই হয়তো ঠিক ধরতে পারেননি, ওটা ‘মারমার’ না-হয়ে ‘মায়ানমার’ও হতে পারে।”
“মায়ানমার তো বর্মা-মুলুকের এখনকার নাম। যেমন কঙ্গো হয়ে গেছে জাইরে, শ্যাম হয়ে গেছে তাইল্যান্ড, তেমনি বার্মা হয়ে গেছে মায়ানমার।”
“জানি।” সদানন্দবাবু বললেন, “মানে আগে জানতুম না, এই একটু আগে ওঁরই কাছে জানলুম। কিন্তু ব্যাপারটা কি এর ফলে আরও গোলমেলে হয়ে যাচ্চে না?”
বললুম, “তা তো হচ্ছেই। এতক্ষণ শুধু লন্ডনের সায়েবরা ছিল, এবারে বার্মিজরাও এর মধ্যে ঢুকে পড়ল।”
“কথাটার অর্থ তার ফলে কী দাঁড়াচ্চে?”
“এই দাঁড়াচ্ছে যে, এটা একটা বিরাট মাপের ইন্টারন্যাশনাল কন্সপিরেসি। যার জাল ছড়ানো হয়েছে ইংল্যান্ড থেকে মায়ানমার পর্যন্ত। সায়েব গুণ্ডাদের সঙ্গে বার্মিজ গুণ্ডারা হাত মিলিয়েছে; তারা এককাট্টা হয়েছে। এবারে কাটাকাটি করে ওই কুড়ুলটা তারা হাতিয়ে নেবে!…উরে বাবা, এ তো খুবই ভয়ংকর ব্যাপার!”
শুনে একটু থমকে গেলেন সদানন্দবাবু। কলকাতা থেকে মনের আনন্দে আমাদের সঙ্গে চলে এসেছেন, সম্ভবত ধরে নিয়েছিলেন যে, এ আর এমন কী কাজ, চটপট শেষ হয়ে যাবে, তারপর বিন্ধ্যেশ্বরীর মন্দিরে পুজো দিয়ে, প্রয়াগে একটা ডুব মেরে, দামদস্তুর করে শস্তায় একটা মির্জাপুরী গালচে কিনে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরবেন, তার মধ্যে যে সায়েবরা ছাড়া গোটাকয় বর্মি গুণ্ডাও ঢুকে পড়তে পারে, এতটা তিনি তাঁর অতি বড় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। ঢোক গিলে বললেন, “কুড়ুলটা কি খুবই দামি? মানে সোনার তো নয়, পাথরের কুড়ুল! তার দাম আর কত হতে পারে?”
“কত হতে পারে, সে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। ভুলে যাবেন না যে, এটা যে-সে কুড়ুল নয়, আর্লি স্টোন এজের একটা রেয়ার ইমপ্লিমেন্ট। ইউরোপ আর আমেরিকার বড়-বড় সব মিউজিয়ামগুলো তো বটেই, প্রাইভেট কালেক্টররাও এর জন্যে কত খর্চা করতে রাজি আছে জানেন?”
সদানন্দবাবু আবারও ঢোক গিলে বললেন, “কত?”
“তা অন্তত কয়েক কোটি টাকা তো বটেই।” শুধু এইটুকু বলেই থামলুম না, ভদ্রলোককে যতটা সম্ভব ভয় পাইয়ে দেবার জন্যে বললুম, “আমার তো ধারণা ওই প্রাইভেট কালেক্টরদের কেউ এই গুণ্ডাগুলোকে লেলিয়ে দিয়েছে!”
সদানন্দবাবু টকটকে ফর্সা মানুষ। কিন্তু তাঁর মুখের রং ক্রমেই পাঁশুটে হয়ে যাচ্ছিল। বললেন, “কুড়ুলটা কি ওই মিউজিয়ামের মধ্যেই রয়েচে?”
“তা-ই তো ছিল বলে শুনেছিলুম। তবে কিনা, চোর তো প্রথমে মিউজিয়ামেই ঢোকার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পরে হয়তো তাদের ধারণা হয়েছে, প্রোফেসর-অ্যাজ আ প্রিকশনারি মেজার—ওখান থেকে ওটা সরিয়ে এনে এই বাড়িরই কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। তা নইলে আর এই বাড়ির মধ্যেই দু’ দু’ বার চোর ঢুকবে কেন?”
“ওটা এখন তা হলে এই বাড়ির মধ্যেই আছে?”
“থাকাই সম্ভব। আর তা যদি থাকে, তো এই বাড়িতে ফের চোর ঢুকবে। হয়তো আজ রাতেই তারা আবার আসতে পারে।”
“বলেন কী!”
“ঠিকই বলছি। বিশ্বাস না হয় তো ভাদুড়িমশাইকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসুন।”
শুনে, সদানন্দবাবুর মুখ দিয়ে খানিকক্ষণ কোনও কথাই বার হল না। তারপর শুকনো গলায় বললেন, “একটা কথা ভাবচি।”
“কী ভাবছেন?”
“ভাবচি যে, ভাদুড়িমশাই এ-কেসটা না-নিলেই…”
কথাটা শেষ হল না। তার আগেই ভাদুড়িমশাই দরজার পর্দা ঠেলে আমাদের ঘরে ঢুকে বললেন, “কী কথা হচ্ছিল?”
বললুম, “সদানন্দবাবু বলছিলেন যে, একে মারমার কাটকাট, তায় আবার লন্ডনের সায়েবদের পিছু-পিছু কিছু বর্মিও এর মধ্যে ঢুকে পড়েছে, তাই…..মানে…”
কথাটা শেষ করলেন সদানন্দবাবুই। “তাই বলছিলুম যে, সব কেসই যে নিতে হবে, তার তো কোনও মানে নেই। এটা বোধহয় না-নিলেই ভাল হত।”
“কেন?”
“না মানে বলছিলুম যে, আপনার কাছে যত কেস আসে, তার সবগুলোই কি আপনি নেন?”
“তা কী করে নেব, অত সময় কোথায়?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যে-সব কেস খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হয়, সেগুলো নিজে নিই, আর বাদবাকিগুলো আমাদেরই এজেন্সির অন্য লোকেরা হ্যান্ডল করে। তবে তাদেরও তো ক্যাপাসিটির একটা সীমা আছে, তাই কিছু-কিছু কেস ফিরিয়ে দিতে হয়।”
“এটা বোধহয় ফিরিয়ে দিলেই পারতেন।”
“সে কী! প্রোফেসর মিশ্রের মতেন মানুষ নিজে অনুরোধ করে পাঠিয়েছেন, তবু ফিরিয়ে দেব? তাও কি হয় নাকি?…আর তা ছাড়া ফিরিয়ে দেবই বা কেন?”
কথা শেষ করে সদানন্দবাবুর দিকে তাকালেন ভাদুড়িমশাই। তারপর তাঁর মুখে হঠাৎ এক টুকরো হাসি ঝিকিয়ে উঠল। কৌতুকের হাসি। বললেন, “বুঝেছি। আপনি ভয় পেয়েছেন। তো কীসের ভয় বলুন দেখি। বর্মি গুণ্ডার? আরে মশাই, ও তো আমি ঠাট্টা করে বলেছি।”
এতক্ষণে হাসি ফুটল সদানন্দবাবুর মুখেও। বললেন, “ঠাট্টা? সত্যি বলচেন তো?”
“তা ছাড়া আবার কী। আপনাকে একটু ভয় পাইয়ে দেবার জন্যে বলেছিলুম।”
“তা-ই বলুন,” সদানন্দবাবুর হাসিটা এবারে আরও বিস্তৃত হল, “এর মধ্যে তা হলে বর্মি গুণ্ডা ঢোকেনি? কিন্তু ‘মায়ানমার’ কথাটা তা হলে কোত্থেকে এল? ওটা তো আর উড়ে আসেনি।”
“ওটা আসেনি, আসার কোনও কারণও নেই। ‘মায়ানমার’ নয়, প্রোফেসর মিশ্রের ঠোঁট নাড়া থেকে আমি যা বুঝেছি, তাতে বলতে পারি, উনি ‘মারমার ই বলেছিলেন।”
“কিন্তু ‘লন্ডন’ শব্দটা? ওটা তো ঠিকই আন্দাজ করেচেন আপনি?”
“মনে হয় ঠিকই করেছি। কিন্তু ‘লন্ডন’ মানেই যে লন্ডনের গুণ্ডা, তা কেন হবে? হয়তো ‘লন্ডন’ বলে অন্য কোনও কথা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন।”
“কী বোঝাতে চেয়েছেন?”
সেটাই তো আন্দাজ করতে পারছি না। ভেবেছিলুম, রঘুনন্দন হয়তো এ-ব্যাপারে কিছু বলতে পারবে। কিন্তু সেও তো কিছু বুঝতে পারেনি।”
রঘুনন্দনকে যখন কলকাতায় প্রথম দেখেন, তখন ভাদুড়িমশাই যে চমকে উঠেছিলেন, সেই কথাটা হঠাৎ আবার মনে পড়ে গেল। বললুম, “একটা কথা বলুন তো? রঘুনন্দনের চেহারা কি ঠিক তার বাবা হরিনন্দনের মতন?…মানে দেউলগিরি থেকে যাঁর সঙ্গে আপনি বাই সি বোম্বাই এসেছিলেন?”
“রাইট।”
“কিন্তু সে তো অনেক বছর আগেকার কথা। অ্যাদ্দিন বাদেও হরিনন্দনের চেহারা আপনার মনে আছে?”
“স্পষ্ট মনে আছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “চোখ, মুখ, নাক, ভুরু, কমপ্লেকশন, হাইট—এভরিথিং। এমন কী, চাউনি পর্যন্ত। আর এতসব মনে আছে বলেই তো প্রোফেসর শ্যামনন্দন মিশ্রকে দেখেই আমি চমকে গিয়েছিলুম। তারপর এই সেদিন যখন রঘুনন্দন আমাদের কলকাতার ফ্ল্যাটে এল, তখন আমার দ্বিতীয়বার চমকে যাবার পালা। সত্যি বলতে কী, চমকে যাবার ধাক্কাটা এক্ষেত্রে আরও বেশি জোরদার হয়েছিল।”
“কেন?”
“তাও বুঝতে পারছেন না? আরে মশাই, শ্যামনন্দন আর হরিনন্দনের মধ্যে যে মিলটা আমার চোখে পড়েছিল, যতই চমকে যাই না কেন, সে তো বুড়োর সঙ্গে যুবকের মিল, চেহারার মিল না বলে তাকে আদলের মিল বলাই ভাল। সেক্ষেত্রে রঘুনন্দন আর হরিনন্দনের বেলায় তো বয়েসটাও মিলে যাচ্ছে। ফলে দু’ জনের মিলটা আরও স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছি।”
এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে হরিনন্দনকে যখন দেখি, তখন তার বয়েস এই ধরুন বছর তিরিশেক। আর রঘুনন্দনকে তো আপনারা দু’ জনেই দেখেছেন। কলকাতাতেও দেখেছেন, আবার এখানেও দেখছেন। কী মনে হয়? কত বয়েস হবে ওর?”
সদানন্দবাবু বললেন, “ওই একই বয়েস…মানে বছর তিরিশেকই হবে আর কি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ফলে, হরিনন্দনের যে-চেহারাটা আমার চোখে আজও লেগে আছে, এর সঙ্গে তার মিলটা তো আরও বেশি করে আমাকে চমকে দেবেই।…কী বলব, কলকাতায় যখন ওকে প্রথম দেখি, তখন আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, পঁচিশ বছর আগে যাকে দেখেছিলুম, সেই হরিনন্দনই ফের আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।”
আর একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “অথচ, প্রোফেসর শ্যামনন্দন মিশ্রের কাছে আজ থেকে পাঁচ বছর আগেই আমার জানা হয়ে গিয়েছিল যে, হরিনন্দন বেঁচে নেই, আমার সঙ্গে তো তার পরিচয় হয়েছিল একাত্তরের এপ্রিলে, তার মাত্র এক মাস বাদেই সে একটা কার-অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়। ভূতদর্শনের কথাটা যে কেন বলেছিলুম, এবারে সেটা বুঝতে পারছেন তো?”
সদানন্দবাবু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে সকালবেলার সেই লোকটি এসে ঘরে ঢুকল। ঘরের একদিকে একটা টানা সোফা, তার সামনে গ্ল্যাস-টপ টেবিল, তার উপরে ট্রে নামিয়ে রেখে বলল, “চায় কি আমি বানিয়ে দেব?”
“না না,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমরাই বানিয়ে দেব অখন।…রঘুনন্দনবাবু ফিরেছেন?”
“এখনও ফেরেননি, তবে থোড়া বাদেই ফিরে আসবেন।…একটায় খানা লাগিয়ে দেব।” বললুম, “তখন ঘণ্টা বাজবে না?”
“জরুর বাজবে। লেকিন বুড়াবাবু তো এখন কোঠিতে নাই, ইসি লিয়ে…”
ইসি লিয়ে যে কী, সেটা আর বলল না। সেই সকালবেলার মতোই চতুর হেসে লোকটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
চায়ের পট থেকে সদানন্দবাবু নিজের ও আমার জন্যে দুটো পেয়ালায় লিকার ঢেলে নিলেন। তারপর পটটা ভাদুড়িমশায়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনার তো আবার শুদু লিকারে চলবে না, দুধ-চিনি মেশানো চাই।”
“তা চাই।” নিজের পেয়ালায় লিকার ঢেলে নিয়ে তাতে দুধ-চিনি মিশিয়ে একটা চামচ দিয়ে নাড়তে-নাড়তে ভাদুড়িমশাই বললেন, “চা খাওয়া শিখেছি তো সায়েবদের কাছ থেকে। তারা যে-ভাবে শিখিয়েছিল, সেইভাবেই খেয়ে যাচ্ছি।”
সেই সক্কালবেলায় বেড-টি পেয়েছিলুম, তারপরে এই এতক্ষণ পর্যন্ত আর চা খাওয়া হয়নি, মাথাটা হয়তো সেই কারণেই একটু ধরে ছিল। এবারে পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললুম, “আঃ, এতক্ষণে যেন প্রাণ এল। এদের চা দেবার ফ্রিকোয়েন্সিটা আর-একটু বাড়াতে বলুন তো ভাদুড়িমশাই, নইলে তো এখানে থাকা যাবে না।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সবে তো কাল রাত্তিরে এখানে এসে পৌঁছেছি, এরই মধ্যে কলকাতায় ফেরবার জন্যে ছটফট করছেন? তাও কিনা ব্রেকফাস্টে চা পাননি বলে?”
“না না, শুধু চায়ের কথা বলছেন কেন, কলকাতায় অনেক কাজও তো ফেলে রেখে এসেছি। তা এ-কেসটার ফয়সলা করতে আর কদ্দিন লাগবে, কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?”
“কী করে পারব।” ভাদুড়িমশাই আবারও হাসলেন। “কেসটা কী, তা-ই তো এখনও বুঝে উঠতে পারলুম না। দেখি, লাঞ্চের সময় তো রঘুনন্দনকে পাওয়া যাচ্ছে, তখন কথা বলে দেখব।” তারপর একটু থেমে থেকে বললেন, “অবিশ্যি একেবারেই যে কিছু আন্দাজ করতে পারিনি, তাও নয়। আন্দাজ একটা করেছি ঠিকই, কিন্তু সেটা ভুল না নির্ভুল, তা-ই নিয়ে আমার ধন্ধটা এখনও কাটছে না।”
“আন্দাজটা কী?”
“সেটা এই যে, মিউজিয়াম নিয়ে প্রোফেসর মিশ্রের একটা সমস্যা আছে ঠিকই, তবে সেটাই যে মূল সমস্যা, তা হয়তো নয়।”
বললুম, “মূল সমস্যা তা হলে কী নিয়ে?”
“বোধহয় রঘুনন্দনকে নিয়ে।”
“তার মানে?”
ভাদুড়িমশাই তৎক্ষণাৎ কোনও উত্তর দিলেন না। তাঁর চা খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। পেয়ালা নামিয়ে রেখে একটা সিগারেট ধরালেন। সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে ধোঁয়া ছাড়লেন কিছুক্ষণ। ধোঁয়া দিয়ে শূন্যে গোটাকয় রিং বানালেন। তারপর বললেন, “যে-ঘরে আমাকে শুতে দেওয়া হয়েছে, কাল রাত্তিরে যে সেখানে একটা জিনিস পেয়ে গেছি, তা আপনি জানেন। ওটা আমার পাবার কথা ছিল না, একেবারে হঠাৎই পেয়ে গেলুম।’
বললুম, “তা তো আপনি বলেছেন, কিন্তু জিনিসটা কী?”
“একটা চিঠি।”
“কার চিঠি?”
“প্রোফেসর মিশ্রের। অ্যান ইনকমপ্লিট লেটার। চিঠিখানা তিনি পুরোটা লিখে উঠতে পারেননি, খানিকটা পর্যন্ত লিখে তারপর একটা বইয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছিলেন। বইখানা তাঁর বিছানার পাশে একটা সাইড টেবিলে ছিল। বড় মাপের বই নয়, প্রস্তর-যুগ সম্পর্কে প্রোফেসর মিশ্রেরই লেখা একটা মনোগ্রাফ। নেহাতই কৌতূহলের বশে বইখানা খুলতেই তার ভিতর থেকে এই চিঠিখানা বেরিয়ে পড়ে।”
“চিঠিখানা কাকে লেখা?”
“আমাকেই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “চিঠির উপরে তারিখ লেখা রয়েছে ৪ এপ্রিল। অর্থাৎ যেদিন আমরা কলকাতা থেকে রওনা হই, সেই দিনের চিঠি।”
“চিঠিখানা শেষ করেননি কেন?”
“হয়তো করে উঠতে পারেননি। হয়তো চিঠি লিখতে-লিখতেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর শরীর যে ভাল যাচ্ছিল না, চিঠির মধ্যেই তার উল্লেখ রয়েছে।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “এনিওয়ে, চিঠিখানা আমি আপনাদের দিচ্ছি। রাত্তিরে এটা আপনারা পড়ে দেখুন। পড়ে একটা আন্দাজ করে নিন। তারপর কাল সকালে এই নিয়ে আপনাদের সঙ্গে আমি কথা বলব। দেখব, আপনাদের আন্দাজের সঙ্গে আমার আন্দাজ মেলে কি না।”
পকেট থেকে একখানা ভাঁজ-করা কাগজ বার করে ভাদুড়িমশাই আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
কাগজখানা খুলে দেখতে যাচ্ছিলুম, ভাদুড়িমশাই আমাকে বাধা দিয়ে বললেন, “রাত্তিরের আগে ওটা খুলবেন না। আপাতত পকেটে পুরে ফেলুন।”
তা-ই করলুম। করে যে ভালই করলুম, সেটা বুঝতে দেরি হল না। কেন না, তার দু-এক সেকেন্ডের মধ্যেই দরজায় টোকা পড়ল।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাম ইন।”
পর্দা সরিয়ে রঘুনন্দন এসে ঘরে ঢুকল। ঢুকে একটা চেয়ার টেনে তাতে বসে পড়ে বলল, “মিউজিয়াম থেকে ঘুরে এলুম। একটা মুশকিল হয়েছে।”
“কী হয়েছে?”
“কাল রবিবার। রবিবারে মিউজিয়াম বন্ধ থাকে। কিন্তু কাল খোলা রাখতে হবে।”
“কেন?”
“ডি. এম. সায়েব ফোন করেছিলেন। বাইরে থেকে একটা ডেলিগেশন এসেছে। মিউজিয়ামটা দেখতে চায়। কিন্তু কালকের দিনটা ছাড়া তাদের সময় হবে না। ডি. এম. নিজেই তাদের সঙ্গে করে নিয়ে আসছেন।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার মানে তো কাল আপনাকে একটু ব্যস্ত থাকতে হবে। বাইরে থেকে যখন ডেলিগেশন এসেছে…
“ব্যস্ততা আমার আজ থেকেই শুরু হয়ে গেছে, মিঃ ভাদুড়ি।” রঘুনন্দন বলল, “ডি. এম. মিঃ শর্মার সঙ্গে এখনও আমার আলাপ-পরিচয় হয়নি, তিনি যে কেমন মানুষ, কিছুই জানি না, আসলে ভদ্রলোক এর আগে বেনারসে ছিলেন, মাত্র মাসখানেক হল এখানে বদলি হয়ে এসেছেন, তা তিনি ও আমাদের মিউজিয়ামে এই প্রথম আসছেন, তাই…”
“তাই কী?”
“তাই বুঝতেই পারছেন, সব কিছু একটু সাফসুতরো করে রাখতে হবে। যে-ছেলেটি আমাদের ওখানে গাইডের কাজ করে, তাকেও একটু তালিম দিয়ে রাখা দরকার।”
এক মুহূর্ত চুপ করে রইল রঘুনন্দন, তারপর বলল, “আসলে ব্যাপারটা কী জানেন, সরকার থেকে আমাদের মিউজিয়ামের জন্যে একটা মোটা টাকা বরাদ্দ করার কথা আছে…বাট অফ কোর্স উইদাউট এনি কন্ডিশন…তাই ডি. এম. সাহেবের ফার্স্ট ইমপ্রেশনটা যাতে ভাল হয়, সেদিকে তো নজর না-রেখে উপায় নেই। টাকাটা যখন তাঁরই রিপোর্টের উপর নির্ভর করছে, তখন হি হ্যাজ টু বি কেপট ইন গুড হিউমার।”
“তার মানে লাঞ্চ করেই আপনি আবার বেরিয়ে যাবেন, কেমন?”
“না-গিয়ে উপায় কী। এদিকে আবার আর-এক ঝঞ্ঝাট হয়েছে। সিকিওরিটির ইলেকট্রনিক সিস্টেমটা ঠিকমতো কাজ করছে না। এলাহাবাদের যে কোম্পানিকে দিয়ে ওটা বসানো হয়েছে, তাদের খবর দিয়েছি, তিনটে নাগাদ তারা এক জন মেকানিক পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফলে…বুঝতেই তো পারছেন…লাঞ্চ সেরেই আমাকে ফের বেরিয়ে পড়তে হবে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু আমাকে যে-কাজের জন্যে আপনারা ডেকে এনেছেন, তাই নিয়েও তো আপনার সঙ্গে দু-একটা কথা বলার দরকার ছিল।”
ঢং ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল। রঘুনন্দন তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা বাজে। চলুন, খেতে-খেতেই কথা বলা যাবে।”