৭
একতলার এক দিকে বিশাল লাইব্রেরি আর ড্রয়িং রুম, অন্য দিকে কিচেন, ডাইনিং হল আর বাথরুম। বাথরুমটিও বেশ বড়সড়। আমরা সেখানে হাত ধুয়ে ডাইনিং হলে এসে ঢুকলুম। ব্রেকফাস্ট এরই মধ্যে টেবিলে সার্ভ করা হয়ে গেছে। পশ্চিমা প্রাতরাশ। পরোটা আর আলু-মটরের একটা তরকারি।
রঘুনন্দন সংকুচিত ভঙ্গিতে বলল, “ওমলেট আর টোস্টের কথা বলেছিলুম, কিন্তু এখানকার বেকারিতে ধর্মঘট চলছে, তাই ডবল-রুটি পাওয়া গেল না। আপনাদের অসুবিধে হবে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “ডবল-রুটিটা কী জিনিস?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আমরা যাকে পাউরুটি বলি, এদিকে সেটাকেই ডবল-রুটি বলা হয়।” তারপর রঘুনন্দনের দিকে তাকিয়ে : “না না, অসুবিধে হবে কেন? এ তো দিব্যি ব্রেকফাস্ট।…কিন্তু আপনার দাদু এখন কেমন আছেন? খবর নিয়েছিলেন?”
রঘুনন্দন বলল, “নীচে নামবার আগে নার্সিং হোমে ফোন করেছিলুম। ড. আমেদ ডিউটিতে ছিলেন, বললেন, যে, রাত্তিরে ঘুমিয়েছেন, অবস্থাও অনেকটা স্টেবিলাইজ করেছে।”
“প্রেশার?”
“প্রায় নর্মাল।”
“কথা বলতে পারছেন?”
“বলতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু জিভের আড়ষ্টতা কাটেনি বলে কী বলতে চান, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দেখা যাক, আমরা গিয়ে যদি কিছু বুঝতে পারি।
“আমরা কখন যাব?”
“ভিজিটিং আওয়ার্স তো সকালে ন’টা থেকে এগারোটা,” রঘুনন্দন বলল, “আপনারা ব্রেকফাস্ট করে তৈরি হয়ে নিন, সাড়ে ন’টার মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যাবে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু উনি তো এখন ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রয়েছেন। সেখানে কি আমাকে যেতে দেবে? যাওয়া উচিত হবে কি না, তাও তো বুঝতে পারছি না।”
“নার্সিং হোমে ফোন করার পরে ড. চতুর্বেদীকেও তাঁর বাড়িতে ফোন করেছিলুম। তিনি বলছেন, রোগীর কন্ডিশন যদি ভাল বোঝেন তো আজ বিকেলের মধ্যেই আইসিইউ থেকে তাঁকে ক্যাবিনে ট্রান্সফার করবেন। আইসিইউতে আমাদের যাওয়ার ব্যাপারেও অবশ্য তাঁরা বাধা দেবেন না, বাট অন ওয়ান কন্ডিশন।”
“সেটা কী?”
‘একজন-একজন করে যেতে হবে, আর বেশিক্ষণ সেখানে থাকা চলবে না, রোগীকে খুব বেশি কথা বলাবার চেষ্টা করাও চলবে না। ইন ফ্যাক্ট, রোগী তো কিছু-না-কিছু বলার চেষ্টা করবেনই। শুধু সেইটুকু শুনে আর নিজে কোনও কথা না-বলে ভিজিটর যদি বেরিয়ে আসেন তো সেটাই সবচেয়ে ভাল।”
শুনে, একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “আমরা যখন নার্সিং হোমে যাব, ড. চতুর্বেদীও তখন সেখানে থাকবেন তো?”
“তা তো থাকবেনই। এমনিতেই উনি রোজ অন্তত দু’বার ওঁর নার্সিং হোমে যান। একবার সকাল সাড়ে আটটায়, আর-একবার বিকেল পাঁচটায়। দু’ বেলাই অন্তত ঘণ্টা দুয়েক ওখানে থাকেন। তার উপরে কাল সকালে আমি আরও বিশেষ করে থাকতে বলেছি, যাতে আপনার সঙ্গে ওঁর দেখা হয়ে যায়। দাদু কেমন আছেন, সেটা ওঁর কাছেই শুনতে পারবেন।”
পরোটা আর আলু-ছোলার পরে চা আসবে ভেবেছিলুম। তার বদলে এল লস্যি।
সদানন্দবাবু লস্যির গেলাশে চুমুক দিয়ে বললেন, “আপনারা চিনি খান না দেকচি। ব্লাড শুগারের প্রবলেম থাকে তো বলুন, ওর খুব ভাল কবরেজি ওষুদ আচে।”
রঘুনন্দন হেসে বলল, “চিনি কেন খাব না, রোজই তো গোটা পাঁচ-ছয় প্যাঁড়া আর কালাকাঁদ খাই, চায়েও চিনি কিছু কম খাই না। তবে লস্যিটা খাট্টাই খাই। আপনিও খেয়ে দেখুন…গরম পড়তে শুরু করেছে তো, শরীরটা সুস্থ থাকবে।”
আমি একটু ইতস্তত করে বললুম, “চা হয় না?”
“হবে না কেন, এখুনি বানাতে বলে দিচ্ছি।”
রঘুনন্দন চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল। ভাদুড়িমশাই তাকে বাধা দিয়ে বললেন, “থাক, থাক, এখন আর চায়ের হাঙ্গামায় গিয়ে কাজ নেই। ন’টা বাজতে চলল, আর দেরি করা ঠিক হবে না।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে : “হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলবেন না মশাই, লস্যিটা খেয়ে নিন, তারপর চলুন তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়া যাক।”
লস্যি শেষ করে দোতলায় উঠে এলুম আমরা। তৈরি হতে বিশেষ সময় লাগল না। নীচে নেমে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম ন’টা দশ। বাড়ির ড্রাইভার ইতিমধ্যে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বার করে পোর্টিকোর নীচে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল। আমাদের দেখে দরজা খুলে দিয়ে বলল, “আইয়ে সাব।”
রঘুনন্দন বলল, “তুম কোঠিমেই রহ যাও লছমন। ম্যয় হি ইনকো লে জাউঙ্গা।…নিন, আপনারা উঠে পড়ুন।”
পুরনো ফ্যামিলি অস্টিন। রঘুনন্দন স্টিয়ারিং হুইলের সামনে বসল। ভাদুড়িমশাই বসলেন তার পাশে। আমি আর সদানন্দবাবু পিছনের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়লুম। গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার পরে ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ-সব গাড়ি তো আজকাল আর দেখাই যায় না।”
রঘুনন্দন হেসে বলল, “কী করে যাবে। একে তো পার্টস পাওয়া যায় না, তার উপরে তেলও খায় রাক্ষসের মতো। আ ভেরিটেবল গাজলার! কতবার বলেছি যে, দাদু, বাড়িতে আমরা লোক তো মাত্র তিন জন, একটা মারুতি কিনে এটাকে এবারে ছুটি করে দাও। তা তিনি কী বলেন জানেন?”
“কী বলেন?”
ছোট রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় পড়ে, গিয়ার পালটে, গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে রঘুনন্দন বলল, “বলেন যে, আগে আমার ছুটি হোক, তারপর এই গাড়ির ছুটি হবে। আসলে গাড়িটাকে ভীষণ ভালবাসেন, কিছুতেই এটাকে বিদেয় করবেন না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ-সব ভিন্টেজ কারের একটা আলাদা রকমের ইজ্জত রয়েছে তো, হয়তো সেই কারণেই এটাকে উনি ছাড়তে পারছেন না। তা ছাড়া, মায়াও তো পড়ে যায়।”
রঘুনন্দন বলল, “তা ঠিক। কিন্তু ওই যে বললুম, টোটালি আনইকোনমিক। বাড়িতে না-রেখে এটাকে এখন মিউজিয়ামে রাখলেই ঠিক হয়।” তারপর একটু হেসে যোগ করল, “দাদুও হয়তো তা-ই রাখতেন। তবে কিনা গাড়িটা তো আর পাথরের নয়, তাই বোধ করি আমাদের নন্দন মিউজিয়ামে এটার জায়গা হচ্ছে না।”
মন্তব্যটা আমার ভাল লাগল না। ভাদুড়িমশাইয়েরও ভাল লাগার কথা নয়। সম্ভবত তিনি কিছু বলতেও যাচ্ছিলেন। কিন্তু বলা হল না। কেননা, তার আগেই বাগানওয়ালা দোতলা একটা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রঘুনন্দন বলল, “আমরা এসে গেছি।”
গাড়ি থেকে নেমে, বাগানের মাঝ বরাবর টানা মোরামের পথ পেরিয়ে আমরা ‘বিন্ধ্যেশ্বরী নার্সিং হোম’-এর ভিতরে গিয়ে ঢুকলুম।
কলকাতায় আজকাল যে সব হাল ফ্যাশনের নার্সিং হোম হয়েছে, তার ওয়েটিং রুমে ঢুকে আচমকা মনে হয় যেন কোনও পাঁচতারা হোটেলের লাউঞ্জে এসে ঢুকেছি। তার সঙ্গে তুলনা না-ই চলুক, বিন্ধ্যেশ্বরী নার্সিং হোমের রিসেপশনে ঢুকেই যে একটু চমক লাগে, তার কারণ আর কিছুই নয়, এর পরিচ্ছন্নতা। উত্তর ভারতে যেখানেই যাই, সর্বত্র পানের পিকের দাগ চোখে পড়ে। মির্জাপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। এই নার্সিং হোমের দেওয়ালে, পানের পিক ফেলার দাগ তো দূরের কথা, সামান্য একটা ময়লা ছোপ কি ঝুলকালিও কোথাও চোখে পড়ল না। জনাকয় ভিজিটর চুপচাপ বসে আছেন, বোঝাই যায় যে, এঁদের সঙ্গী-সাথিরা ভিতরে গিয়েছেন, তাঁরা বেরিয়ে না-আসা পর্যন্ত এঁরা ভিতরে যেতে পারছেন না। দু-এক জন ভিজিটর রঘুনন্দনকে দেখে হাসলেন। মফস্বল শহর, এখানে প্রায় সবাই সবাইকে চেনে। দেওয়ালের গায়ে পাহাড়ে সূর্যোদয়ের একটি মস্ত মাপের রঙিন ছবি। তা ছাড়া যে নিষেধবাক্যটি নজর কাড়ে, তাতে বড়-বড় নাগরি হরফে লেখা : ধূম্রপান মানা হ্যায়
রিসেপশনে যে অল্পবয়সী মেয়েটি বসে আছে, তার পরনে সাদা ব্লাউজ ও নীল পাড়ের সাদা খোলের শাড়ি। মাথায় কানা-তোলা সাদা টুপি। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে, মিশ্রজির ক্রাইসিস কেটে গেছে, তাঁর অবস্থা এখন অনেক স্টেবল, ড. চতুর্বেদী তাঁকে আইসিইউতে গিয়ে দেখেও এসেছেন। “আপনারা একটু বসুন, ড. চতুর্বেদী তাঁর অফিস-রুমেই আছেন, আমি তাঁকে খবর দিচ্ছি।”
খবর দেবার মিনিটখানেকের মধ্যেই ড. চতুর্বেদী ভিতর থেকে রিসেপশনে বেরিয়ে এলেন। ভদ্রলোকের বয়স বছর ষাট-পঁয়ষট্টি হবে। পরনে ধবধবে সাদা ওভারল, গলায় স্টেথোসকোপ কপালে চন্দনের প্রলেপ দেখে মনে হল, ধার্মিক মানুষ, সকালবেলার পুজোপাঠ না-সেরে বাড়ি থেকে বেরোননি। রঘুনন্দন আমাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেবার পরে সামান্য হেসে বললেন, “মিশ্রজিকে নিয়ে ভাবনার কিছু নেই, দ্য ওয়র্স্ট ইজ ওভার, এবারে সুস্থ হয়ে উঠবেন। বাট দেন ইট উইল টেক টাইম।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “লোক চিনতে পারছেন?”
“সেটা খুব ভালই পারছেন। চেনা লোককে দেখে হাসছেনও। তবে কথা বলতে পারছেন না।…মানে গলা দিয়ে যে আওয়াজ বেরুচ্ছে না তা নয়, তবে ওয়র্ড-ফর্মেশনটা ঠিকমতো হচ্ছে না।…ওটা হয়ে যাবে, শরীরের যে-দিকটা পড়ে গেছে, একটু-একটু করে তাতে সাড়ও ফিরে আসবে।…কিন্তু ওই যে বললুম, খুব তাড়াতাড়ি কিছু হবার নয়, সময় লাগবে।”
জিজ্ঞেস করলুম, “মাথার মধ্যে হেমারেজ হয়েছে?”
“তা তো হয়েছেই। একটা কট বেঁধে আছে। সেটা ডিজলভ না করা পর্যন্ত কমপ্লিকেশনগুলো কাটবে না।
‘ডিজলভ করতে সময় লাগবে?”
“তা লাগবে বই কী। আগেকার দিনে মাথা ন্যাড়া করে জোঁক লাগিয়ে রক্ত মোক্ষণ করাবার ব্যবস্থা হত, তাতে যে কাজ হত না তাও নয়, তবে এখন সে-সব চলে না, এখন স্পেসিফিক ড্রাগস রয়েছে, তার এফিকেসি নিয়েও সন্দেহের কোনও কারণ নেই। মোট কথা, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, যা-কিছু করা দরকার, সবই আমরা করব।”
রঘুনন্দন বলল, “আপনি বলেছিলেন, আজ বিকেলেই হয়তো ওঁকে ক্যাবিনে ট্রান্সফার করবেন। সেটা কি করা যাবে?”
“ভেবেছিলুম তো করব। তবে ড. আমেদ তো ওঁকে দেখছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হল, আরও দু-একটা দিন আইসিইউতে অবজারভেশনে থাকুন, সেটাই ভাল হবে ওঁর পক্ষে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু আইসিইউতে আমাদের যাওয়া কি ঠিক হবে?”
“এমনিতে আমরা এ-ব্যাপারে একটু কড়াকড়ি করি ঠিকই,” ড. চতুবেদী বললেন, “তবে আপনাদের যেতে দেব। বাট দেন দেয়ার ইজ আ কন্ডিশন। রঘুনন্দন হয়তো সেটা আপনাদের জানিয়েও রেখেছে। আইসিইউতে আপনাদের একসঙ্গে যাওয়া চলবে না, এক-এক করে যেতে হবে।…আপনারা এখানেই একটু বসুন, আমি ভিতরে গিয়ে একটা অ্যাডমিট কার্ড দিয়ে এক জন নার্সকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, সে-ই আপনাদের এক-এক করে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাবে।”
কথা শেষ করে ভিতরে যাবার জন্যে পা বাড়িয়েছিলেন ড. চতুর্বেদী। সেই অবস্থাতেই ফের ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আর-একটা ব্যাপার…ওঁর সঙ্গে দেখা করুন, উনি যদি কিছু বলেন…আই মিন বলার চেষ্টা করেন তো সেটা শুনুন…কিন্তু ওঁকে দিয়ে জোরজার করে কথা বলাবার চেষ্টা করবেন না।”
ড. চতুর্বেদী ভিতরে ঢুকে গেলেন। তার মিনিট কয়েক বাদেই মাঝবয়সী একজন নার্স ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “আপনারা কে মিশ্রজির সঙ্গে দেখা করবেন, প্লিজ কাম উইথ মি।”
আমি আর সদানন্দবাবু ঠিকই করে রেখেছিলুম যে, মিশ্রজির সঙ্গে এখনও তো আমাদের পরিচয় হয়নি, তাই আমরা আর আইসিইউতে তাঁকে দেখতে যাব না, যাওয়ার কোনও অর্থও নেই। প্রথমে তাঁকে দেখতে যাবে রঘুনন্দন, আর রঘুনন্দন বেরিয়ে আসার পরে যাবেন ভাদুড়িমশাই। ভাদুড়িমশাইকে মিশ্রজি চেনেন, তাঁরই কথায় ভাদুড়িমশাই কলকাতা থেকে এখানে এসেছেন, তা ছাড়া তাঁকে হয়তো মিশ্রজির কিছু জানাবারও থাকতে পারে, তাই তাঁর যাওয়া দরকার।
নার্সের সঙ্গে রঘুনন্দন ভিতরে চলে গেল। আমরা বাইরে বসে তার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলুম। বসে থাকতে-থাকতেই হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল যে, আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন নীচে আসি, ভাদুড়িমশাই তখন কী একটা জিনিস পেয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। এমন জিনিস, মিশ্রজির শোবার ঘরটা তাঁর জন্যে বরাদ্দ না-হলে যা নাকি পাওয়া যেত না। জিনিসটা কী, জিজ্ঞেস করতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন নয়, রাত্তিরে বলব, জিনিসটা তখন দেখতেও পাবেন।”
রঘুনন্দন ফিরে এল মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই। নার্স বললেন, “এর পরে যিনি যাবেন, আমার সঙ্গে আসুন।” ভাদুড়িমশাই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। নার্সের পিছন-পিছন তিনি সুইং ডোর ঠেলে ভিতরে চলে গেলেন।
রঘুনন্দন এসে আমার পাশে বসতে জিজ্ঞেস করলুম, “কেমন দেখলেন?”
পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখটা মুছে নিয়ে রঘুনন্দন বলল, “দেখে তো ভালই মনে হল। তবে অবস্থা সত্যিই ইমপ্রুভ করছে কি না, তা তো আমার বুঝবার কথা নয়।”
“আপনাকে চিনতে পেরেছেন তো?”
“তা পেরেছেন। মনে হল, একটু যেন হাসলেনও।”
“কিছু বললেন আপনাকে?”
“বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু বলে উঠতে পারলেন না।…আমি অবশ্য ওঁকে জানিয়েছি যে, মি. ভাদুড়ি কাল রাত্তিরেই এখানে এসে গেছেন। এটা শুনেও একটু হাসলেন, কিছু বোধহয় বললেনও। কিন্তু কী যে বললেন, কিচ্ছু বুঝতে পারিনি। গুঙ্গারা যে-ভাবে কথা বলার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের গলা থেকে কিছু অর্থহীন আওয়াজ ছাড়া আর-কিছুই বার হয় না, অনেকটা সেইরকম। অথচ কিছু যে বলতে চাইছেন, তাও ঠিক।”
সদানন্দবাবু বললেন, “শুনিচি, কথা শোনবার দরকার হয় না, সেরেফ ঠোঁটের নড়াচড়া দেকেই অনেকে বুঝতে পারে যে কে কী বলতে চাইচে। এখেনে অমন কেউ নেই?”
রঘুনন্দন বলল, “থাকতেই পারে। তবে বাইরের লোকের কাছে উনি কিছু বলার চেষ্টা করবেন বলে আমার মনে হয় না। যখন সুস্থ ছিলেন, তখন পুলিশকেই তো উনি কিছু জানাতে চাননি।”
সদানন্দবাবু বললেন, “তা বটে।” আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ভাদুড়িমশাই বললেন, “নার্সকে আমি বলে দিয়েছি যে, আমরা এখন আর-কেউই ওঁর সঙ্গে দেখা করব না।…চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।”
নার্সিং হোম থেকে বেরিয়ে আসতে-আসতে ভাদুড়িমশাইকে জিজ্ঞেস করলুম, “আপনাকে চিনতে পারলেন?”
“বিলক্ষণ।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আপনারা সম্ভবত জানেন না, আমি তো একটু-আধটু লিপ-রিডিং করতে পারি, হালে এটা শিখে নিয়েছি, তাই যা উনি বলতে চাইছেন, মোটামুটি সেই শব্দ ক’টা ধরতেও পারা গেছে, কিন্তু কী যে তার অর্থ, সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না।”
রঘুনন্দন বলল, “শব্দগুলি কী বলুন তো, দাদু তো আমাকে অনেক কথাই বলতেন, তাই আমি হয়তো বুঝতে পারব।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে তো ভালই হয়। শব্দগুলো হল ‘লন্ডন, মারমার, কাটকাট’। বাস, আর-কিছু বলতে পারেননি।”
শুনে, রঘুনন্দন খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে। তারপর চোখ নামিয়ে, মাথা চুলকে বলল, “নাঃ, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”