পাহাড়ি বিছে – ৬

আজ ৬ এপ্রিল, শনিবার। সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে কখন যে কাল ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, জানি না কাছেই কোথাও একটা ঘণ্টা বাজার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটা তুলে দেখলুম ছ’টা বাজে। পাশে তাকিয়ে সদানন্দবাবুকে দেখা গেল না। সম্ভবত মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছেন। যেখানেই যান, ভদ্রলোকের এই প্রাত্যহিক কাজটায় কখনও ছেদ পড়তে দেখিনি।

পাশ ফিরে ফের চোখ বুজবার উপক্রম করছি, এমন সময় হাতে ট্রে নিয়ে একজন কাজের লোক এসে ঘরে ঢুকল। “চা এনেছি, সাব।”

তাড়াতাড়ি অ্যাটাচড বাথরুমটায় ঢুকে, চোখেমুখে জল ছিটিয়ে এসে ট্রে থেকে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে বললুম, “কাছেই কোথাও মর্নিং ইস্কুল-টিস্কুল আছে নাকি?’

“না, সাব।”

“তা হলে ঘণ্টা বাজছিল কোথায়?”

“ওটা এই বাড়িতেই বাজছিল, সাব।”

“কেন?”

“বুড়াবাবুর হুকুম। রোজ সকাল ছ’টায় কিচেন থেকে ঘণ্টা বাজিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, বেড-টি আসছে। তার পরে আর কারও ঘুমিয়ে থাকা চলবে না।”

“রঘুনন্দনবাবু ঘুম থেকে উঠেছেন?”

বেয়ারাটি চতুর হেসে বলল, “না, সাব। বুড়াবাবু তো বাড়িতে নেই, ছোটবাবু তাই দেরি করে ঘুম থেকে উঠবেন। ওঁকে সাতটার সময় চা দেব।”

“আমার সঙ্গে যে আর-দুজন সাব এসেছেন, তাঁরা কোথায়?”

“তাঁরা তো পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়েছিলেন। একটু আগে ফিরে এসে একতলায় বসে গল্প করছেন। ওঁদের বেড-টি সেখানেই দিয়ে এসেছি।”

আমার চা-খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ট্রের উপরে পেয়ালা-পিরিচ তুলে নিয়ে বেয়ারাটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে বলে গেল যে, সাড়ে আটটায় আবার ঘণ্টা বাজবে। ব্রেকফাস্টের ঘণ্টা।

দাড়ি কামিয়ে, স্নান সেরে, জামাকাপড় পালটে নীচে নামতে-নামতে ঠিক সাতটা। দেখি, লনের ধারে লোহার একটা গার্ডেন-বেঞ্চিতে বসে ভাদুড়িমশাই আর সদানন্দবাবু কথা বলছেন। জিজ্ঞেস করলুম, “আপনাদের জগিং আর মর্নিং ওয়াক সারা?”

“ও-সব আমরা ছ’টার মধ্যেই চুকিয়ে ফেলেছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এমনকি স্নানের পর্বও শেষ। সদানন্দবাবু আর আপনাকে বিরক্ত করেননি; আমার বাথরুমেই স্নান সেরে নিয়েছেন। তারপর এই ধরুন মিনিট পনরো আগে আবার নীচে নেমেছি।…দিব্যি বাড়ি, কী বলেন?”

বললুম, “জগিং কোথায় করলেন? সামনের রাস্তায়?”

“আরে না, মশাই। গঙ্গার ধারে। চমৎকার জায়গা। পাড়টা বেশ শক্ত করে বাঁধানো। লোকজনও কম। তার উপরে আবার ফুরফুরে বাতাস দিচ্ছে। তুলনা হয় না।”

“কাল থেকে আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন, মশাই।” সদানন্দবাবু বললেন, “মর্নিং ওয়াক জিনিসটা তো খারাপ নয়, একবার না হয় ট্রাই করেই দেকুন।”

বললুম, “আরে দূর, অত ভোরে তো আমার ঘুমই ভাঙে না।”

সদানন্দবাবু বললেন, “সে আমি ঠেলেঠুলে আপনাকে তুলে দেবখন। আমাদের মতো অতটা ডিসট্যান্স অবিশ্যি এখুনি আপনি কভার করতে পারবেন না। তা না-ই পারুন, ওটা আস্তে-আস্তে বাড়িয়ে নিলেই হবে। আসল কতা হল গঙ্গার হাওয়া। ভোরবেলার সেই হাওয়াটা গায়ে লাগিয়ে দুটো-চারটে পাক অন্তত দিন। দেকবেন, তাতেই দিব্যি উদ্‌গার পাচ্চেন।”

“গঙ্গা এখান থেকে কাছে?”

“এই বাড়ির ঠিক পিছনে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “রাস্তায় বেরিয়ে বাঁয়ে ঘুরে দু’ পা হাঁটলেই গঙ্গা।… বাই দ্য ওয়ে, আমি এ-বাড়ির যে-ঘরটায় আছি, তার জানলা থেকেই পতিতোদ্ধারিণীকে দেখতে পাওয়া যায়। শুনলুম ওটাই নাকি প্রোফেসর মিশ্রের ঘর। কিন্তু তিনি তো নার্সিং হোমে, আপাতত তাই আমার জন্যে ওটা বরাদ্দ হয়েছে।”

একটুক্ষণের জন্যে চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে, মৃদু হেসে বললেন, “ভাগ্যিস বরাদ্দ হয়েছিল। নইলে তো জিনিসটা পেতুমই না।”

জিনিসটা যে কী, তা আর জানা হল না, কেননা ঠিক তখনই চোখে পড়ল যে, সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নেমে রঘুনন্দন লনের দিকে এগিয়ে আসছে। আমাদের কাছে এসে দাঁড়াতে সদানন্দবাবু বললেন, “কী, এতক্ষণে ঘুম ভাঙল?”

“আর বলবেন না,” রঘুনন্দন লজ্জিত হেসে বলল, “আমার দাদুর সঙ্গে তো আপনার আলাপ-পরিচয় নেই। থাকলে বুঝতেন, হি ইজ আ ডিক্টেটর! বেনিভোলেন্ট নো ডাউট, বাট আ ডিক্টেটর অল দি সেম। এ-বাড়ির কুকুর-বেড়ালরা অব্দি তাঁর হুকুম মেনে চলে!…না না, বাড়িয়ে বলছি না। দাদুর একটা বক্সার কুকুর ছিল, বছর দুই আগে মারা গেছে, তো দুষ্টুমি করার জন্যে দাদু তাঁকে একবার ছোট্ট করে একটা ধমক দিয়েছিলেন…বাস্, তারপর সে-বেচারা হপ্তাখানেক আর মাথাই তোলেনি, সামনের দুই থাবার মধ্যে মাথা গুঁজে পড়ে থাকত!”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তিনি তো এখন বাড়িতে নেই।”

“নেই বলেই তো হঠাৎ-পেয়ে-যাওয়া স্বাধীনতাকে একটু এনজয় করে নিচ্ছি। নইলে কি আর সকাল সাতটা পর্যন্ত শুয়ে থাকতে পারতুম?”

‘এনজয়’ কথাটা ভাল লাগল না। বললুম, “অন্য দিন ছ’টার মধ্যেই উঠে পড়েন?”

“উঠতেই হয়। দাদুর স্ট্যান্ডিং অর্ডার, শীতকালই হোক আর গ্রীষ্মকালই হোক, সকাল ছ’টায় সবাইকে বেড-টি খেয়ে নিতে হবে। তার মধ্যে যদি ঘুম না ভাঙে তো ওটা আর পাওয়া যাবে না।”

“কিন্তু আমি তো প্রোফেসর মিশ্রকে দেখেছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কই, আমার তো তাঁকে এত কড়া ধাতের মানুষ বলে মনে হয়নি।”

“ওটাই তো মজা!” রঘুনন্দন বলল, “তা ছাড়া ভাবুন, আপনি তাঁকে পাঁচ বছর আগে দেখেছিলেন, তাও যতক্ষণ আপনি মিউজিয়ামে তাঁর সঙ্গে ছিলেন, ততক্ষণই দেখেছিলেন। মানুষকে তাতে কতটুকুই বা বোঝা যায়! বিশেষ করে তাঁর মতন মানুষকে। ভিতরে-ভিতরে যতই কড়া ধাতের লোক হোন, বাইরে থেকে তা তো টের পাওয়া যেত না। কাজেকর্মে যেমন ধীরস্থির, কথাবার্তাতেও তেমন শান্ত। শুনেছি আমার বাবা যে মারা গেছেন, এই খবর পেয়েও তিনি ভেঙে পড়েননি। অথচ আমার বাবা তাঁর একমাত্র সন্তান।”

“একমাত্র সন্তানের মৃত্যুসংবাদ পেয়েও তিনি ভেঙে পড়েননি, এটা আপনি কার কাছে শুনেছিলেন?”

“বাবার পিসিমা’র কাছে। খুব কম বয়সে তিনি বিধবা হন, ছেলেপুলে হয়নি, শ্বশুরবাড়িতে তাঁর উপরে খুব অত্যাচার চলছে শুনে দাদু তাঁকে নিজের কাছে আনিয়ে নেন। তখন থেকে দাদুর সংসারেই ছিলেন। ঠাকুমা তার বেশ কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছিলেন বলে তিনিই সব দেখাশুনো করতেন। বছর পাঁচেক আগে তিনি মারা গেছেন।

“এখন তা হলে সংসারের ভার কার উপরে?”

“আমার স্ত্রীর উপরে। দিন কয়েকের জন্যে লখনউ গিয়েছিল, তবে পরশুই ফোন করে দাদুর অসুখের খবর তাকে দিয়েছি। আজ বিকেলে ফিরে আসছে। এটা বোধহয় কালই আপনাদের বলেছিলুম।”

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “আপনার বাবা যখন মারা যান, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?”

“দার্জিলিংয়ে। বাবা মারা যাবার মাস কয়েক আগেই ওখানকার একটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে আমাকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। পুরো দশ বছর ছিলুম ওখানে। উইন্টার ভেকেশনটা দাদুর কাছে এসে কাটাতুম। তারপরেই আবার দার্জিলিংয়ে ফিরে যেতে হত।”

কথা শেষ করে রঘুনন্দন হাসল। তারপর বলল, “আচ্ছা, এই যে আমি আপনাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলছি, এতে কোনও ভুল-টুল দেখতে পাচ্ছেন?”

“একদম না।” আমি বললুম, “কোনও খুঁত নেই। আপনার কথা শুনে কেউ বুঝতেই পারবে না যে, আপনি বাঙালি নন।”

সদানন্দবাবু বললেন, “শিকলেন কোতায়?”

“দার্জিলিংয়ে। সেখানে…আই মিন আমাদের ইস্কুলে তো কলকাতার ছেলেও কিছু কম ছিল না। তাদের সঙ্গে সব সময়ে বাংলায় কথা বলতুম। গোড়ায়-গোড়ায় ভুলভাল বলতুম, তাই নিয়ে তারা আমাকে ঠাট্টাও করত খুব। পরের দিকে আর অসুবিধে হত না।”

“কিন্তু লোকে যেমন ভাষা শেখে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তেমনি আবার চর্চার অভাবে ভুলেও তো যায়।…আপনি দেখছি কিছুই ভোলেননি। এটা কী করে হল?”

“বাঃ, এখানেও আমার বিস্তর বাঙালি বন্ধু রয়েছেন যে! মির্জাপুরে অবশ্য বাঙালি খুব বেশি নেই, কিন্তু ইলাহাবাদে তো প্রচুর বাঙালি। তাঁদের অনেককেই আমি চিনি। তা ছাড়া, ইলাহাবাদের যে কলেজে আমি পড়াই, সেখানেও আমার দু’-চার জন্য বাঙালি কলিগ রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে যখনই কোনও ব্যাপারে কথা বলবার দরকার হয়, বাংলায় বলি।…চর্চার কথা বলছিলেন না, ওটা বন্ধ হয়ে যায়নি, এখনও আছে।”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তা হলে সত্যি কথাটাই বলা যাক। কলকাতায় আপনি যেদিন আমার সঙ্গে এসে দেখা করেছিলেন, আপনার বাংলা শুনে সেদিন আমরা সবাই বেশ অবাক হয়ে গেসলুম। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনাও হয়েছিল।”

“আমাকে বললেই তো পারতেন।”

“সংকোচ হয়েছিল। যা-ই হোক, কী করে এত স্বচ্ছন্দে বাংলা বলেন, সে তো আপনি নিজেই জানিয়ে দিলেন।”

“সবটা জানাইনি।” রঘুনন্দন বলল, “আমার বাংলা জানার আরও একটা কারণ আছে। আমার মা ছিলেন বাঙালি। মেবি ইট্স ইন মাই ব্লাড।”

বললুম, “তা-ই?”

“হ্যাঁ। অবশ্য মা’কে আমার খুব-একটা মনে পড়ে না, আমার ছেলেবেলাতেই তিনি মারা যান। আমার বয়েস তখন আর কতই বা হবে। এই ধরুন বছর তিনেক।”

“ওই বয়সের কিছু-না-কিছু স্মৃতি তো থেকেই যায়। তাও নেই?”

“আছে। তবে খুবই ভাসা-ভাসা। কিছু কথা, দু-একটি ছবি, এই আর কি। সেও খুব ঝাপসা।”

“যেমন?”

“যেমন ধরুন, মা একদিন আমাকে দুটো প্যাড়া দিয়ে বলেছিলেন, ‘একটা তুই খা, আর একটা আমাদের মালির ছেলেকে দিয়ে আয়।’ আমি দিইনি। তাতে মা বলেছিলেন, “তুই দেখছি তোর বাবার মতোই হয়েছিস, সেও কাউকে কিছু দিতে চায় না।’ মা খুব রেগে গিয়েছিলেন।”

“এই রকমের আর কোনও কথা কি ছবি মনে পড়ে?”

‘পড়ে। আমাদের বাড়িতে এক দিন এক জন সাপুড়ে সাপের খেলা দেখাতে এসেছিল। সে তার ঝাঁপি খুলতেই দুটো সাপ ফোঁস করে ওঠে। তাতে আমি ভয় পেয়ে মা’কে আঁকড়ে ধরতে তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘তোর এত ভয় কেন রে?’…আর এক দিনের কথা বলছি। এটা বোধহয় আমাদের এই বাড়ির কথা নয়, অন্য কোনও বাড়ির কথা। যে-বাড়ির কথা, সেখানে একটা পুকুর ছিল। মা সেই পুকুরে নেমে সাঁতার কাটছিলেন। সাঁতার কেটে স্নান করে পাড়ে উঠে আমাকে বলেছিলেন, ‘তোর বাবা দারুণ সাঁতার কাটে। আর-একটু বড় হ, তার পরে তোকেও সাঁতার শেখাব।’ কিন্তু আমার আর সাঁতার শেখা হয়নি। সেই বছরই হঠাৎ অসুখ হয়ে আমার মা মারা যান।”

রঘুনন্দনকে আরও দু-একটা প্রশ্ন করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তার আর সময় হল না। হঠাৎ আবার সেই ভোরবেলাকার মতোই ঢং-ঢং করে ঘণ্টা বেজে উঠল।

রঘুনন্দন বলল, “ব্রেকফাস্টের ঘণ্টা। চলুন, খেয়ে নেওয়া যাক।”

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটা বাজে।