৩
কাজের মেয়েটি যে ভদ্রলোককে ড্রয়িংরুমে এনে পৌঁছে দিয়ে গেল, তাঁর বয়েস মোটামুটি বছর তিরিশেক হবে। পরনে চুস্ পাজামা ও কলার-তোলা হাল্কা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি, গায়ের রং টকটকে ফর্সা, নাকটি পাতলা ও টিকোলো, চোখ দুটি আয়ত ও ঝকঝকে, হাইট অন্তত ফুট ছয়েক। শরীরের গড়ন ছিপছিপে বলে হাইটটা চট করে চোখেও পড়ে যায়। দরজা পেরোনোর সময় মাথাটা যে-ভাবে একটু নিচু করলেন, তাতে বোঝা গেল, নিজের শারীরিক দৈর্ঘ্য সম্পর্কে ইনি একটু সচেতনও বটেন।
ঘরে ঢুকে নমস্কার করে ভদ্রলোক বললেন, “আমার নাম রঘুনন্দন মিশ্র। আমি মিঃ ভাদুড়ির সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
ভাদুড়িমশাই যে আগন্তুককে দেখবামাত্রই একটু চমকে উঠেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। পরক্ষণেই অবশ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “বসুন। আমিই চারুচন্দ্র ভাদুড়ি। আপনি কোত্থেকে আসছেন?”
“ইউ. পি. থেকে। আজই সকালে কলকাতায় পৌঁছেছি। আছি হাওড়া স্টেশনের একটা রিটায়ারিং রুমে। সেখানেই স্নান আর ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছি। ফিরতি পথের টিকিটও কাটা হয়ে গেছে। রিজার্ভেশনের ব্যাপারে আপাতত ওয়েটিং লিস্টে আছি। সেটা কনফার্মড হয়ে গেলে রাত্তিরের ট্রেনেই ফিরে যাব। তবে তার আগে আপনার সঙ্গে আমার কথাটা হয়ে যাওয়া দরকার।”
“কিন্তু এখন কি আপনি মির্জাপুর স্ট্রিট থেকে আসছেন না?”
ভদ্রলোকের মুখ দেখে মনে হল, ভাদুড়িমশাইয়ের কথায় তিনি একটু বিভ্রান্ত বোধ করছেন। বললেন, “মির্জাপুর স্ট্রিট? এখানকার একটা রাস্তার নাম বুঝি?”
“হ্যাঁ,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমাদের মেডটি তো বলল, আপনি সেখান থেকেই আসছেন।”
হঠাৎ হোহো করে হেসে উঠলেন রঘুনন্দন মিশ্র। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, “বুঝেছি। মির্জাপুর স্ট্রিট নয়, আসলে আমি আসছি মির্জাপুর থেকে। …মানে ওই যে জায়গাটা কার্পেটের জন্যে বিখ্যাত। আপনারা নিশ্চয়, কখনও-না-কখনও গেছেন ওদিকে।”
ভাদুড়িমশাই আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বুঝুন ব্যাপার! কোথায় মির্জাপুর আর কোথায় আমাদের মির্জাপুর স্ট্রিট, যার নাম বদলে গিয়ে এখন সূর্য সেন স্ট্রিট হয়েছে।” তারপর আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রঘুনন্দন মিশ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা অন্তত বার তিন-চার গিয়েছি। গঙ্গার এ-পারে মির্জাপুর আর ও-পারে এলাহাবাদ। অতি চমৎকার জায়গা। শহরটা অবিশ্যি একটু ঘিঞ্জি, রাস্তাঘাটও খুব-একটা সুবিধের নয়, তবে বছর পাঁচেক আগেও তো একবার গিয়েছিলুম, নদীর ধারটা সেবারেও খুব ভাল লেগেছিল।”
রঘুনন্দন বললেন, “পাঁচ বছর আগে যদি গিয়ে থাকেন, তো মির্জাপুরের মিউজিয়ামটাও হয়তো দেখে থাকবেন।”
“তা দেখেছি বই কী। নন্দন মিউজিয়ামের কথা বলছেন তো?”
“হ্যাঁ।”
“অসাধারণ সংগ্রহশালা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “একেবারে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা এমন কালেকশন এক পুণে ছাড়া অন্তত এ-দেশে আর কোথাও আমি দেখিনি। সত্যি বলতে কী, ঠিক এই ধরনের প্রাইভেট কালেকশন বিদেশেও বড়-একটা চোখে পড়ে না।”
“ওখানে যত রকমের যা-কিছু পাথর আর পাথুরে আর্টিফ্যাক্টস আপনি দেখেছেন, তার সবই কিন্তু মাত্র এক জন লোক…আই মিন আমার ঠাকুর্দা তাঁর একার চেষ্টায় কালেক্ট করেছিলেন।
“দাঁড়ান, দাঁড়ান,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার মানে আপনি প্রোফেসর শ্যামনন্দন মিশ্রের নাতি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ,” রঘুনন্দন সামান্য হেসে বললেন, “অ্যান আনওয়র্দি গ্র্যান্ডসন অভ অ্যান ইলাসট্রিয়াস গ্র্যান্ডফাদার। তাঁর কাজের কথা যখন ভাবি, নিজেদের অযোগ্যতার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তখন লজ্জার অবধি থাকে না। আপনি তাঁকে চিনতেন?”
“নামে তো অবশ্যই চিনতুম, তা ছাড়া ‘নিয়োলিথিক ইমপ্লিমেন্টস ডিসকভার্ড ইন ইন্ডিয়া’ বলে বছর দশেক আগে টাইমস অভ ইন্ডিয়ায় তাঁর একটা লেখাও পড়েছিলুম। সাক্ষাৎ পরিচয়টা অবশ্য বছর পাঁচেক আগে হল। ওই যে শেষ যে-বারে মির্জাপুরে গিয়েছিলুম, তখন তিনিই যে আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাঁর কালেকশনটা দেখিয়েছিলেন, এটা ভুলিনি। আ রিমার্কেব্ল ম্যান! কিন্তু তখনই তো তাঁকে বয়েসের ভারে বেশ কাবু বলে মনে হয়েছিল। বেঁচে আছেন?”
“তা আছেন, তবে বাড়ি থেকে আর আজকাল বিশেষ বেরোন না। বছরখানেক আগেও অবশ্য রোজ অন্তত একবার তাঁর মিউজিয়ামে গিয়ে বসতেন। ডাক্তারের অ্যাডভাইসে সেটাও ইদানীং বন্ধ রাখতে হয়েছে। বয়েস তো কম হল না, সাতাশি।”
কেউ এক জন দেখা করতে এসেছেন শুনেই মালতী ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এবারে কাজের মেয়েটি ঘরে ঢুকে সেন্টার টেবিলের উপর এক পেয়ালা চা ও এক প্লেট বিস্কুট নামিয়ে রাখতে বুঝলুম, অতিথির কথাটা মালতী ভুলে যায়নি বটে, তবে তৃতীয় রাউন্ডের চা আর আজ আমাদের জুটবে না। রঘুনন্দন নিজেও একটু সংকুচিত হয়ে পড়েছিলেন। বললেন, “সাড়ে এগারোটা বাজে, এখন আবার চায়ের হাঙ্গামা করতে গেলেন কেন?”
কথাটাকে আমল না-দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমাদের তো ইচ্ছে, দুপুরের খাওয়াটাও আপনি এখান থেকে খেয়ে যাবেন। আমিষে আপত্তি নেই তো?”
“ওটা কোনও ব্যাপার নয়।” চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে রঘুনন্দন বললেন, “আমরা ইউ. পি. ব্রাহ্মণ, তবে মাছ-মাংস খাই, আর আমার ঠাকুর্দা তো এ-ব্যাপারে আমাদের থেকেও এক কদম এগিয়ে আছেন, বাবুর্চির রান্না ছাড়া তিনি মুখে কিছু তুলতেই চান না।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “তা হলে আর কথা কী, দুপুরের খাওয়াটা আমাদের সঙ্গেই সেরে নিন।” রঘুনন্দন হাত জোড় করে বললেন, “ওটা আর-এক দিন হবে। স্টেশন থেকে এক বন্ধুকে ফোন করেছিলুম, তিনি হাওড়ার রিটায়ারিং রুমে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবেন, বাড়ি থেকে আমার জন্যে লাঞ্চ নিয়ে আসবেন বলেছেন। সো আই হ্যাভ টু গো ব্যাক। কিন্তু তার আগে আমার কাজের কথাটা সেরে নিই।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশ তো, কাজটা কী, সেটা বলুন।”
“আপনাকে একবার মির্জাপুরে যেতে হবে।”
“কেন?”
“আমাদের মিউজিয়ামে দিন সাতেক আগে একটা চুরির অ্যাটেম্৳ হয়েছিল। শেষ-রাতের ঘটনা। বাইরে থেকে পাঁচিল টপকে দু’জন লোক ওখানে ঢুকেছিল, কিন্তু মূল বাড়িতে ঢুকতে পারেনি, নাইট গার্ডদের তাড়া খেয়ে তারা পালিয়ে যায়।”
“পুলিশে খবর দিয়েছিলেন?”
“না। দাদুই দিতে দেননি। বললেন, ‘কিছু যখন চুরি যায়নি, তখন আর পুলিশকে জানিয়ে কী হবে? বরং সিকিউরিটিতে যাতে কোনও ফাঁক না থাকে, তার ব্যবস্থা করো।’ তো সেটা পরদিনই করেছি। নাইট-গার্ড আগে ছিল দু’ জন, সেখানে আরও দু’ জন লোক নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া, এলাহাবাদের একটা কোম্পানিকে দিয়ে মূল বাড়ির দরজায় একটা ইলেকট্রনিক অ্যালার্ম সিস্টেমও বসিয়ে নিয়েছি। কিন্তু…”
“কিন্তু কী? আবার চোর এসেছিল?”
“না, মিউজিয়ামে আসেনি। কিন্তু আমাদের বাড়িতে এসেছিল। এটাও রাত্তিরের ঘটনা। তবে রাত্তিরে আমরা কিছু বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারি পরদিন সকালে। দাদুর লাইব্রেরি-ঘরে ঢুকে দেখি, আলমারির তাবৎ বই মেঝের উপরে ছড়িয়ে রয়েছে। ওই মেঝেরই একপাশে ডাঁই হয়ে আছে তাঁর রাইটিং টেবিলের কাগজপত্তরও। শুধু চিঠিপত্তর নয়, ব্যাঙ্কের পাশবই, ডিপোজিট বই, চেকবই—স-ব। আলমারিগুলোর পাল্লা খোলা, টেবিলের ড্রয়ারগুলো মেঝের ওপর ওলটানো, দেখে মনে হয়, ঘরের উপর দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে।”
“বাড়ির মধ্যে এত বড় একটা কাণ্ড হয়ে গেল, অথচ আপনারা কিছুই টের পেলেন না?”
“না,” রঘুনন্দন হাত উলটে বললেন, “কিচ্ছু টের পাইনি। শুনেছি, গেরস্তের যাতে ঘুম না ভাঙে, চোরেরা নাকি তার জন্যে আজকাল কী এক রকমের গ্যাস ছড়িয়ে দেয়। হয়তো সেইরকম কিছু ছড়িয়ে দিয়ে থাকবে। ইন ফ্যাক্ট, পরের দিন একটু বেলা করেই আমাদের ঘুম ভেঙেছিল। সাধারণত অত বেলা পর্যন্ত আমরা ঘুমোই না। বিশেষ করে দাদুর ঘুম তো সকাল পাঁচটার মধ্যেই ভেঙে যায়।”
“এটা কবেকার ঘটনা?”
“মিউজিয়ামের কম্পাউন্ডে যেদিন চোর ঢুকেছিল, তার ঠিক দু’ দিন বাদে এটা ঘটে।”
“এই ঘটনাটার কথাও পুলিশকে জানাননি?”
“না। দাদু বললেন, এবারেও তো কিছু খোয়া গেছে বলে মনে হচ্ছে না, তা হলে আর পুলিশের কাছে গিয়ে কী হবে। তবে হ্যাঁ, থানায় যেতে না-দিলেও দাদুকে এবারে একটু চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে। মাঝে-মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন, কথাও বলছেন খুব কম। এরই মধ্যে গত শুক্রবার আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি বরং কলকাতায় গিয়ে মিঃ ভাদুড়ির সঙ্গে দেখা করে অন্তত কয়েকটা দিনের জন্য তাঁকে এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করো। পারলে আজই চলে যাও।’ মিঃ ভাদুড়ি, সেইজন্যেই আমি এসেছি।”
ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “আমাকে তাঁর মনে আছে?”
“খুব ভালই মনে আছে,” রঘুনন্দন বললেন, “বুড়ো হলে কী হয়, হি হ্যাজ আ ফেনোমেনাল মেমারি। আপনার এমন দু-একটা কাজের কথা বললেন, যা হয়তো আপনার নিজেরই মনে নেই, কিন্তু উনি ঠিকই মনে রেখেছেন। এও বললেন যে, পুলিশের দ্বারা কিছু হবে না, কিছু করতে পারলে মিঃ ভাদুড়িই পারবেন, সো ট্রাই টু ব্রিং হিম হিয়ার।”
“কিন্তু আমি যে এখন কলকাতায় আছি, এটা তো ওঁর জানার কথা নয়।”
“জানতেনও না। তাই বৃহস্পতিবার আপনাদের হেড-অফিস বাঙ্গালোরে ফোন করেছিলেন। তাঁরাই জানালেন যে, এখন কয়েকটা দিন আপনি কলকাতায় থাকবেন। এখানকার ঠিকানাটাও তাঁদেরই কাছে পাওয়া গেল।…কিন্তু আপনি যাবেন তো?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “প্রোফেসর মিশ্র যখন যেতে বলেছেন, তখন যেতেই হবে। কিন্তু এক্ষুনি বোধহয় যেতে পারব না, দু’-একটা দিন পরে যাব।… আপনাদের মির্জাপুরের বাড়িতে ফোন আছে তো?”
“তা আছে।”
“তা হলে নম্বরটা আমাকে দিয়ে যান,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কবে কোন্ ট্রেনে যাব, পরশুদিনই আপনাদের ওখানে ফোন করে সেটা জানিয়ে দিচ্ছি। এখানে যে কাজ নিয়ে এসেছি, তার আগে বোধহয় সেটা শেষ করে উঠতে পারব না।”
“থ্যাঙ্কস আ লট!” রঘুনন্দন মিশ্র উঠে দাঁড়িয়ে হাতঘড়ি দেখে বললেন, “এবারে আমি হাওড়ার দিকে দৌড় লাগাব। দেখি যদি রিজার্ভেশনটা পেয়ে যাই।”
দরজার কাছ পর্যন্ত গিয়ে, মাথাটা সামান্য নামিয়ে, রঘুনন্দন ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কৌশিক বলল, “আমাদের দরজার হাইট সাত ফুট, ক্লিয়ার। স্বচ্ছন্দেই মাথা না নামিয়ে টান হয়ে বেরিয়ে যেতে পারত।”
আমি বললুম, “ওটা অভ্যেসের ব্যাপার। সব বাড়িতে তো আর দরজার হাইট এতটা রাখা হয় না, সে-সব জায়গায় দু’-চার বার ঠোক্কর খেয়ে হয়তো সাবধান হয়ে গেছে। এখন দরজা দিয়ে ঢুকতে-বেরুতে মাথাটা আপনা থেকেই একটু ঝুঁকে যায়। ঢ্যাঙা লোকদের ওটা হয়।”
মালতী ইতিমধ্যে আবার ফিরে এসেছিল। বলল, “দিব্যি দেখতে ছেলেটিকে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “যাবেন নাকি মির্জাপুরে? যান তো আমিও সঙ্গে যেতে পারি। অবিশ্যি যাবার জন্যে আপনি যদি রিকোয়েস্ট করেন। নদীর ওপারেই যকন এলাহাবাদ, তকন ফাঁকতালে একদিন প্রয়াগে গিয়ে একটা ডুব দিয়েও আসতে পারব।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “বিন্ধ্যেশ্বরীর মন্দিরও মির্জাপুরের খুব কাছেই।…যান দাদা, ঘুরেই আসুন।”
আমি বললুম, “কী ভাদুড়িমশাই, কবে যাচ্ছেন?”
রঘুনন্দন বিদায় নেবার পর থেকেই একেবারে চুপ করে গিয়েছিলেন ভাদুড়িমশাই। এবারে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “লোকে ভূত দেখার কথা বলে, আর আমি ঠাট্টা করি। কিন্তু আজ আমার নিজেরই ভূতদর্শন হয়ে গেল।”