১৭
আজ ৯ এপ্রিল, মঙ্গলবার। গতকাল বিকেলে এই বাড়ির লাইব্রেরি-ঘরে, অর্থাৎ মিশ্রজি এখন যেখানে আছেন সেখানে একটা ছোটখাটো নাটক হয়ে গেল। মিলনান্তক নাটক। বিপথগামী নাতি যেখানে মাথা নিচু করে তার দাদুর কাছে ফিরে এসেছে আর আপাতকঠোর দাদুটিও যেখানে কঠিন ব্যক্তিত্বের বর্ম থেকে বেরিয়ে এসে অনুতপ্ত নাতিটিকে তাঁর বুকে টেনে নিচ্ছেন—খোলা মঞ্চে অভিনয়ের ব্যবস্থা হলে নাটকের এই শেষ দৃশ্যে যে তুমুল হাততালি পড়ত, তাতে সন্দেহ নেই।
আজ সকালে ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে আর-একটা কথা শুনলুম। মিশ্রজির বয়েস হয়েছে। তাই আপাতত তাঁকে নিয়ে আর চিন্তার কিছু নেই বটে, কিন্তু সারাক্ষণ তাঁর দেখাশোনা করার জন্য একজন লোক তো দরকার। সেইজন্যে ঠিক হয়েছে যে, রমা দেবী…মানে ওই নার্স-ভদ্রমহিলা এখন থেকে এই বাড়িতেই থাকবেন।
রঘুনন্দন অবশ্য এখনও জানে না যে, সে হরিনন্দনের ছেলে নয়। পারিবারিক মিলনপর্ব চুকে যাবার পর রাত্তিরের দিকে আমরা মিশ্রজির সঙ্গে দেখা করি। তিনিই তখন বললেন যে, রঘুনন্দনকে এখনই কিছু বলার দরকার নেই। তাকে বলা হয়েছে যে, তার একটি দাদা ছিল, ছেলেবেলায় সে কুম্ভমেলায় হারিয়ে যায়, এখন আবার ফিরে এসেছে। “আসল কথাটা পরে কখনও জানিয়ে দিলেই হবে।”
ঠিক ছিল যে, আজই আমরা কলকাতায় ফিরব। কিন্তু সদানন্দবাবু বললেন যে, তা কী করে হয়, “প্রয়াগে ডুব দেবার কাজটাই তো বাকি পড়ে রয়েচে।” মিশ্রজিও বললেন, “না না, অন্তত আর দুটো দিন থাকুন।” শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছে যে, আজই বিকেলে সদানন্দবাবুকে এলাহাবাদ থেকে ঘুরিয়ে আনা হবে, তারপর আগামীকাল ওই এলাহাবাদ থেকেই ডাউন বম্বে মেলে আমরা কলকাতায় ফিরব। এখন সকাল দশটা বাজে। ব্রেকফাস্ট খেয়ে এখন আমরা ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে বসে গল্প করছি। গল্প যে এই ক’দিনের ঘটনা আর তার ব্যাখ্যা নিয়ে, সে-কথা বলাই বাহুল্য।
সদানন্দবাবু বললেন, “একটা কতা আমার মাতায় ঢুকচে না মশাই। রঘুনন্দন যে হরিনন্দনের ছেলে নয়, এটা আপনি বুঝলেন কী করে?”
“বুঝলুম ওরই…মানে রঘুনন্দনেরই কথা থেকে।”
“কীরকম?”
“এইজন্যেই বলি যে, অনেক কথাই আপনাদের জানাই বটে, কিন্তু কিছুই আপনারা মনে রাখেন না।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আরে মশাই দেউলগিরি থেকে যখন বোম্বাই আসি, তখন জাহাজেই হরিনন্দন আমাকে জানিয়েছিল যে, তার ছেলে নৈনিতালে তার মামাবাড়িতে মানুষ হচ্ছে, আর তার মামা ডঃ ত্রিপাঠী সেখানকার নামজাদা ডাক্তার। তা এটা আপনাদের বলেছিলুম কি না?”
সদানন্দবাবু মাথা চুলকে বললেন, “হ্যাঁ, তা বলেচিলেন বটে।”
“তা যার মামার পদবি ত্রিপাঠী, তার মায়ের পক্ষে বাঙালি না হওয়াই কি স্বাভাবিক নয়? … অবিশ্যি বাঙালিদের মধ্যে ত্রিপাঠী-পদবির লোক যে নেই, তা বলছি না, ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠীর মতো পণ্ডিত বাঙালিই তো রয়েছেন, তবে কিনা ওই পদবির বাঙালি খুব-একটা দেখা যায় না।”
“তা যায় না ঠিকই, কিন্তু তাতে কী হল?”
“গত শনিবার সকালে ব্রেকফাস্টের ঘণ্টা পড়ার আগে রঘুনন্দন কী বলেছিল, সেটা তা হলে আপনার মনে নেই।
“কী বলেছিল?”
“রঘুনন্দন যে এত ভাল বাংলা জানে, তার একটা কারণ হিসেবে সে বলেছিল যে, তার মা বাঙালি। কথাটা শুনেই আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে, তা কী করে হয়? ডঃ ত্রিপাঠী কি তা হলে রঘুনন্দনের মামা নন? আর তা যদি তিনি না হন, তা হলে রঘুনন্দন যে হরিনন্দনের ছেলে, এই কথাটাই বা আমি মানি কী করে?”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “রঘুনন্দন সেদিন আরও কয়েকটা কথা বলেছিল। সবই তার মায়ের কাছে শোনা। মা যা বলেছিলেন, তাতে রঘুনন্দনের বাবা সম্পর্কে দুটো কথা জানা যায়। এক, তিনি কাউকে কিছু দিতে চাইতেন না। অর্থাৎ তিনি ছিলেন স্বার্থপর মানুষ। আর দুই, তিনি খুব ভাল সাঁতার কাটতে পারতেন।”
বললুম, “হ্যাঁ, আমার মনে আছে।”
“কিন্তু কথা দুটো যদি সত্যি হয়, তা হলে তো বুঝতে হবে, হরিনন্দন কিছুতেই রঘুনন্দনের বাবা হতে পারে না। জানেন, একটা লোক স্বার্থপর কি না, আমাদের দৈনন্দিন নানা খুঁটিনাটি কাজ আর ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই সেটা প্রকাশ পেয়ে যায়। বোম্বাইয়ের জেটিঘাট থেকে কেম্পস কর্নারে আমার হোটেল পর্যন্ত আমরা একই ট্যাক্সিতে এসেছিলুম, ভাড়া নেহাত কম নয়, কিন্তু আমি যদিও ট্যাক্সিভাড়াটা শেয়ার করতে চেয়েছিলুম, হরিনন্দন আমার কাছ থেকে এক পয়সাও নেয়নি। এমন লোককে কী করে স্বার্থপর বলব? তার চেয়েও বড় কথা, হরিনন্দন আদৌ সাঁতার কাটতে জানত না।”
“তা-ই?”
“হ্যাঁ, তা-ই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যে-লোক সাঁতার জানে মাঝসুমুদ্দুরেও যদি জলে পড়ে যায়, তা হলে বাঁচবার আশা নেই জেনেও সে যতক্ষণ সম্ভব জলে ভেসে থাকার চেষ্টা করবে। হরিনন্দন কিন্তু সাঁতার কাটা তো দূরের কথা, হাত-পা ছোড়ারও চেষ্টা করেনি। দেউলগিরি থেকে জাহাজে ওঠার সময় ওই যে সে জলে পড়ে যায়, পড়ামাত্র সে একেবারে ইট কিংবা পাথরের মতো তলিয়ে যেতে বসেছিল। পরে জাহাজে উঠে এই নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলুম যে, সে সাঁতার কাটতে জানে না। অর্থাৎ রঘুনন্দন তার বাবার সম্পর্কে মায়ের কাছে যা-যা শুনেছে, হরিনন্দনের সঙ্গে তার কোনওটাই মেলানো যাচ্ছে না।”
সদানন্দবাবু বললেন, “কিন্তু হরিনন্দনের যে একটা ভাই আছে কিংবা ছিল, আর রঘুনন্দন যে সেই ভাইয়ের ছেলে, এটা আপনি কী করে জানলেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “জানতে তো পারিনি, স্রেফ আন্দাজ করে নিয়েছিলুম। আন্দাজ করেছিলুম রঘুনন্দনের চেহারা দেখে। তার কথা শুনে তো বুঝলুম যে, হরিনন্দনের ছেলে সে হতেই পারে না। তা হলে শ্যামনন্দন আর হরিনন্দনের সঙ্গে তার চেহারার এই যে মিল, এটা সে কোত্থেকে পেল! তা হলে কি মিশ্রজির আরও একটি ছেলে আছে কিংবা ছিল, যার কথা তিনি আমাকে বলেননি? নার্সিং হোমের আইসিইউতে মিশ্রজিকে এই প্রশ্নটা আমি করেওছিলুম। তিনি তখন কথা বলতে পারতেন না। তা না-ই পারুন, মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ কি ‘না’ তো জানাতে পারতেন। কিন্তু তিনি মাথা না-নেড়ে সামান্য একটু হাসলেন মাত্র। তাতেই মনে হল, আমার আন্দাজটা হয়তো মিথ্যে নয়। আর তার পর থেকে যা-কিছু ঘটেছে, তা তো আপনারা জানেনই।”
বললুম, “একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
“করুন।”
“জানকীনন্দনের বার্থ-সার্টিফিকেট কোথায় লুকোনো রয়েছে, তার হদিশ আপনি নাকি মিশ্রজির কাছেই পেয়েছিলেন। কী করে পেলেন? মিশ্রজি কী বলেছিলেন আপনাকে?”
“তাও তো আপনারা জানেন।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “মিশ্রজি বলেছিলেন ‘লন্ডন…মারমার…কাটকাট’। কী, জানেন না?”
“তা জানি, কিন্তু ওর মানে কী? ওটা কি কোনও সাংকেতিক কথা?”
“আরে না মশাই, সাংকেতিক কথা-টথা নয়, বিশুদ্ধ তিনটে তৎসম শব্দ। ব্যাপার কী জানেন, মিশ্রজি তো তখন স্পষ্ট করে কিছুই বলতে পারছিলেন না, যা-কিছুই বলতে চাইছিলেন, জিভে জড়িয়ে যাচ্ছিল। ফলে, প্রথমটায় আমিও কিছুই বুঝতে পারিনি। পরে একটু ভাবতেই অবশ্য আসল ব্যাপারটা ধরতে পারা গেল।”
“কী ধরতে পারা গেল?”
“ওই যে বললুম, আসল ব্যাপারটা। উনি যা বলতে চাইছিলেন, জিভে জড়িয়ে যাওয়ায় সেটা ওইরকম শোনাচ্ছিল বটে, কিন্তু কথা তিনটে আসলে ‘লন্ডন…মারমার…কাটকাট’ নয়।”
“তা হলে কী?”
“কথা তিনটে হল ‘নন্দন…মর্মর…কর্কট’। নন্দন মিউজিয়ামে যে শ্বেতপাথরের একটা কাঁকড়াবিছে রয়েচে, উনি আসলে সেই মর্মর কর্কটবৃশ্চিকের কথাই বলতে চেয়েছিলেন। তা পরশু রাত্তিরে কেন মিউজিয়ামে গিয়েছিলুম, সেটা আশা করি বুঝতে পেরেছেন।”
“তা কেন পারব না,” সদানন্দবাবু একগাল হেসে বললেন, “ওই কাঁকড়াবিছেটার মধ্যে কী আচে, সেটা জানার জন্যেই তো?”
“বাঃ, দিব্যি বুঝে গেছেন দেখছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কনফারেন্স-হলে আপনাদের বসিয়ে রেখে তাই মিনিট কয়েকের জন্যে আমি মিউজিয়ামের ভিতরে চলে গেসলুম। বিছেটার ভেতরটা যে ফাঁপা, তা আমার জানাই ছিল। পেটের তলার একটা জায়গায় চাপ দিলেই ওটা খুলে যায়। বছর পাঁচেক আগে যখন আসি, তখন মিশ্রজিই সেটা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তবে না, মিউজিয়ামের মধ্যে আর খোলাখুলির ঝুঁকি নিইনি, কাঁকুড়াবিছেটাকেই থলের মধ্যে পুরে নিয়ে আমি বেরিয়ে আসি।”
“এইজন্যেই চটের থলে কেনার দরকার হয়েছিল?”
ভাদুড়িমশাই উত্তর না দিয়ে হাসতে লাগলেন।
আমি বললুম, “ওরই মধ্যে পাওয়া গেল সেই বার্থ-সার্টিফিকেট?”
“ওরই মধ্যে পাওয়া গেল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কলকাতায় ফেরার আগে সার্টিফিকেটখানা মিশ্রজির হাতে তুলে দেব। …আর হ্যাঁ, এরই মধ্যে এক সময় মিউজিয়ামে গিয়ে কাঁকড়াবিছেটিকেও আবার নিঃশব্দে যথাস্থানে রেখে আসতে হবে। …ও হ্যাঁ, কাল রাত্তিরে আপনারা তো মিশ্রজির ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপরে তিনি আমাকে কী বললেন জানেন?”
“কী বললেন?”
“বললেন যে, রঘু তো একটা কলেজে পড়ায়, তার পক্ষে তাই সারা দিন মিউজিয়ামে থাকা সম্ভব নয়। অথচ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে তিনিও মিউজিয়ামে যেতে পারছেন না। এখন থেকে তাই জানকীই দু’বেলা ওখানে গিয়ে সব দেখাশোনা করবে।”
আমি বললুম, “এ তো ভালই হল। কিন্তু আমি এখন অন্য কথা ভাবছি।”
“কী ভাবছেন?”
“ভাবছি যে, মিশ্রজি সত্যিই খুব নরম মনের মানুষ। না না, জানকীর সব দোষ ক্ষমা করে দিয়েছেন বলেই যে এ-কথা বলছি, তা নয়! তিন-বছরের রঘুকে ওই যে এককথায় উনি বুকে তুলে নিয়েছিলেন, সেই কথাটাও ভেবে দেখুন। শুধু একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না। রঘুর সঙ্গে রঘুর মা’কেও তিনি এ-বাড়িতে আশ্রয় দিলেন না কেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “হয়তো এই কথা ভেবে দেননি যে, রঘু যে হরিনন্দনের ছেলে নয়, সেটাকে গোপন রাখা তা হলে শক্ত হবে। …আর তা ছাড়া এ-বাড়িতে আশ্রয় দেননি বলেই যে জয়নন্দনের বিধবা স্ত্রীকে অর্থাৎ রঘুর মা’কে তিনি দূরে সরিয়ে দিয়েছেন, তাও হয়তো নয়। মিশ্রজিরই ব্যবস্থা-মতো এতদিন তিনি অন্য জায়গায় ছিলেন বটে, তবে এখন থেকে হয়তো তিনি এই বাড়িতেই থেকে যাবেন।”
চমকে উঠে বললুম, “তার মানে?”
“এটাও বুঝিয়ে বলতে হবে?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আরে মশাই, রমাদেবী…মানে ওই নার্স-ভদ্রমহিলাই যে আমাদের রঘুনন্দনের মা, তাও আপনি বুঝতে পারেননি?”
রচনাকাল : ১৪০৩