১৬
আজ ৮ এপ্রিল, সোমবার। কাল রাতে নিজেদের ঘরে ফিরে আসার সঙ্গে-সঙ্গেই যে ঘুমিয়ে পড়তে পেরেছিলুম, তা নয়। একটু আগে ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে যা ঘটে গিয়েছে, তার পরে আর চট করে ঘুমিয়ে পড়া সম্ভবও ছিল না। ঘুম এসেছিল একেবারে ভোরবেলার দিকে। সম্ভবত সেই কারণে বেড-টির ঘণ্টাও শুনতে পাইনি। জনার্দন অবশ্য সাইড টেবিলে এক কাপ চা ঠিকই রেখে গিয়েছিল। সাড়ে সাতটায় ঘুম ভাঙার পরে প্লেটে-ঢাকা সেই চায়ের পেয়ালা মুখেও তুলেছিলুম আমি, কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই যে পেয়ালাটা নামিয়ে রাখতে হয়েছিল, সে-কথা বলাই বাহুল্য।
মুখহাত ধুয়ে, জামাকাপড় পালটে আটটা নাগাদ নীচে নামি। ভাদুড়িমশাই আর সদানন্দবাবু দেখলুম বাগানের ধারে যথাস্থানে বসে আছেন। কাল রাত্তিরে যেমন আমার, তেমনি ভাদুড়িমশাইয়েরও তো নিদ্রার বেশ বড়-রকমের ব্যাঘাত হয়েছিল। কিন্তু মানুষটিকে দীর্ঘকাল ধরে দেখছি বলে জানি যে, তাঁর পক্ষে সবই সম্ভব। আজও নিশ্চয় রোজকার মতো ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে যথারীতি ঘণ্টাখানেক জগিং করে এসেছেন। আর সদানন্দবাবু? আমাকে দেখে ভদ্রলোক যে-রকম অর্থপূর্ণ হাসলেন, তাতে মনে হল, কাল রাত্তিরে যা ঘটেছে, ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে ইতিমধ্যে তা তিনি শুনেছেন নিশ্চয়
কিছুক্ষণ গল্পগুজবের পর ব্রেকফাস্টের ঘণ্টা শুনে আমরা ডাইনিং রুমে গিয়ে ঢুকলুম। রাধিকাকে নিয়ে রঘুনন্দন নীচে নামল তার একটু বাদেই। ঘরে ঢুকেই রঘুনন্দন বলল, “কাণ্ড দেখেছেন মিঃ ভাদুড়ি?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন, কী হয়েছে?”
“আপনার ঘরের জানলার গ্রিল কে যেন খুলে নীচে নামিয়ে রেখেছে! কালও চোর এসেছিল নিশ্চয়।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “চোর-টোর নয়, ওটা আমিই করেছি। মাঝরাত্তিরে জানলা খুলতে গিয়ে দেখি, স্ক্রু আলগা হয়ে গিয়ে গ্রিলটা নড়বড় করছে; যে-কোনও সময়ে পড়ে যেতে পারে। তাই ফ্রেম থেকে খুলে ওটা নীচে নামিয়ে রাখি। আবার লাগিয়ে নিলেই হবে।”
জনার্দন প্লেটে-প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিল। ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে চকিতে একবার তাঁর দিকে তাকিয়েই সে ফের চোখ নামিয়ে নিল।
রাধিকা বলল, “তা-ই বলুন! আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম।”
রঘুনন্দন বলল, “ও হ্যাঁ, ব্রেকফাস্ট করেই আমি নার্সিং হোমে চলে যাচ্ছি, দাদুকে নিয়ে এই ধরুন দশটা নাগাদ ফিরব।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওঁর ঘরটা তো তা হলে ছেড়ে দিতে হয়। ঠিক আছে, পাশের ঘরে তো কিরণবাবু আর সদানন্দবাবু আছেন, ওখানে একটা এক্সট্রা বেডের ব্যবস্থা করে দিলে আমরা তিনজনেই থেকে যেতে পারব।”
“আরে না না,” রঘুনন্দন বলল, “সে-সবের কোনও দরকারই হচ্ছে না। আপনারা যে যেখানে আছেন, সেইখানেই থাকুন। দাদুকে এখন নাকি দোতলায় তোলা ঠিক হবে না। ডঃ চতুর্বেদী বলেছেন, দু-চার দিন বাদেই ওঁকে বাগানে নিয়ে রোজ একটু-একটু হাঁটাতে হবে, সেইজন্যে ওঁকে একতলায় রাখাই ভাল।”
“কিন্তু একতলায় উনি থাকবেন কোথায়?”
“কেন,” রাধিকা বলল, “এত বড় লাইব্রেরি-ঘরটাই তো রয়েছে। ওর একদিকে যদি একটা বেডের ব্যবস্থা করে দিই তো দিব্যি হবে।”
জনার্দনকে সেই ব্যবস্থা করিয়ে দিতে বলে রঘুনন্দন আর রাধিকা নার্সিং হোমে রওনা হল।
মিশ্রজিকে নিয়ে তারা বাড়িতে ফিরল দশটার একটু আগেই।
নার্সিং হোম থেকেই অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে একটা স্ট্রেচার আর দু’জন লোকও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া মধ্যবয়সি একজন নার্সও রয়েছেন। শুনলুম, নার্সিং হোমে ইনিই মিশ্রজির দেখাশুনো করতেন।
কাজেকর্মে ভদ্রমহিলা দেখলুম দিব্যি পটু। তাঁরই তত্ত্বাবধানে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে মিশ্ৰজিকে স্ট্রেচারে করে লাইব্রেরি ঘরে নিয়ে আসা হল। কাজ শেষ করে অ্যাম্বুলেন্সটি চলে গেল বটে, কিন্তু নার্সটি সেইসঙ্গে ফিরে গেলেন না। রঘুনন্দন বলল, “এখন তো চব্বিশ ঘণ্টার জন্যেই নার্সের দরকার হবে। ডঃ চতুর্বেদীর সঙ্গে কথা বলে তাই ওঁকে নিয়ে এলুম। যদ্দিন দরকার হয়, উনি এখানেই থাকবেন।”
মিশ্রজিকে বেশ প্রফুল্ল বলেই মনে হল। এটাও লক্ষ করলুম যে, হাত-পা নাড়তে তাঁর খুব-একটা অসুবিধে হচ্ছে না। এটাও শুনেছি যে, যে-হাতটা অসাড় হয়ে গিয়েছিল, সেই ডান হাতে খুবই কাঁপা-কাঁপা হস্তাক্ষরে হলেও দু-চারটে কথা তিনি এখন লিখতে পারছেন। তবে কথা তো এখনও স্পষ্ট করে বলতে পারেন না, তাই ভাদুড়িমশাইকে দেখে হাসলেন মাত্র। আমাদের দিকে তাকাতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার দুই বন্ধু, কাজেকর্মে এঁদের কাছে আমি যথেষ্ট সাহায্য পাই, তাই কলকাতা থেকে আমার সঙ্গে এসেছেন।” শুনে মিশ্রজি আবার হাসলেন।
ঘর থেকে একে-একে সবাই বেরিয়ে গেছে। আমরাও বেরিয়ে আসছি, এমন সময় নার্সটি বললেন, “আপনাদের মধ্যে মিঃ ভাদুড়ি কার নাম?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি চারু ভাদুড়ি। কিছু বলবেন?”
“হ্যাঁ।” ভদ্রমহিলা বললেন, “নার্সিং হোম থেকে রওনা হবার আগে একটা চিরকুটে কয়েকটা কথা লিখে উনি আমাকে দিয়েছেন। পড়ে জানলুম যে, বাড়িতে ফিরেই উনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।”
“কিন্তু উনি তো এইমাত্র বাড়ি ফিরলেন,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখন কি ওঁর সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে?”
“না, ঠিক হবে না। এখন একটা ওষুধ খাওয়াবার আছে। সেটা খেয়ে উনি বরং একটু বিশ্রাম নিন।” কব্জি তুলে হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন, “এখন তো সাড়ে দশটা বাজে, আধ ঘণ্টা বাদে আপনি আসুন।”
মিশ্রজি নিশ্চয় ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে একান্তে দেখা করতে চান। এগারোটার সময় আমি আর সদানন্দবাবু তাই ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে মিশ্রজির ঘরে ঢুকতে চাইছিলুম না। কিন্তু ভাদুড়িমশাইকে সে-কথা বলতে তিনি হেসে বললেন, “আরে না না, আপনারাও চলুন। তা ছাড়া, কথা তো হবে যার জন্যে উনি ডেকে পাঠিয়েছেন, সেই কাজ নিয়ে। আর এ-সব কাজে আপনারা যে আমায় সাহায্য করে থাকেন, তা তো ওঁকে জানিয়েছিই। তা হলে আর আপনারা থাকলে অসুবিধে কীসের?”
অগত্যা আমরাও ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে মিশ্রজির ঘরে গিয়ে ঢুকলুম।
আমরা তিনজনেই যে আসব, নার্স সেটা আঁচ করেছিলেন। তা নইলে নিশ্চয় মিশ্রজির বেডের ধারে তিনখানা চেয়ার সাজিয়ে রাখতেন না। আমরা ঠিক হয়ে বসার পরে মিশ্রজির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “আপনারা কথা বলুন, বাইরে থেকে আমি দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি, আধ ঘণ্টার মধ্যে আর-কেউ এ-ঘরে ঢুকবে না। তবে কিনা কথা যত কম বলা যায়, ততই ভাল।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সিস্টার, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, ওঁর যাতে কোনও এগজার্শন না হয়, সে-দিকে আমি খেয়াল রাখব। ইন ফ্যাক্ট ওঁকে দিয়ে কথা বলাবার কোনও চেষ্টাই আমি করব না। কথা যা-কিছু বলার, সেটা আমিই বলব, উনি যদি শুধু মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ জানিয়ে দেন, তাতেই কাজ চলে যাবে।”
এর পরে যা ঘটল, তাতে শুধু আমি আর সদানন্দবাবু কেন, ভাদুড়িমশাইও চমকে গেলেন। স্পষ্ট কিন্তু নিচু দুর্বল গলায় মিশ্রজি বললেন, “কেন, শুধু মাথা নাড়ব কেন, কাল রাত্তির থেকেই তো দিব্যি আমি কথা বলতে পারছি।”
শুনে, কয়েক মুহূর্ত ভাদুড়িমশাই এমন বিস্ফারিত চোখে মিশ্রজির দিকে তাকিয়ে রইলেন যে, মনে হল, তাঁরই বাকশক্তি সম্ভবত লোপ পেয়েছে। বিস্ময়ের ধাক্কাটা কেটে যাবার পরে তিনি শুধু একটি কথাই বলতে পারলেন। “তা-ই?”
নার্সটি হেসে বললেন, “হ্যাঁ, তা-ই। তবে ব্যাপারটা শুধু ডঃ চর্তুবেদী আর ডঃ আমেদ জানেন। আর হ্যাঁ, আমিও জানি। তবে কিনা, কথা বলার ক্ষমতা যে উনি ফিরে পেয়েছেন, মিশ্রজি এখানে একমাত্র আপনাদের ছাড়া আর কাউকে আপাতত এটা জানাতে চান না।”
ভদ্রমহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মিশ্রজি বললেন, “কথা বলতে পারছি, লিখতে পারছি, হাত-পায়ের সাড়ও প্রায় পুরোপুরি ফিরে এসেছে, এদিকে প্রেশারও একদম নর্মাল, সুতরাং আপনাদের চিন্তার কিছু নেই। যা বলার বলুন, সবই আমি শুনতে চাই। কে বারবার চুরি করতে আসছে, আর কী চুরি করতে আসছে, তা যে আমি আঁচ করতে পারিনি, তা নয়, তবে কিনা আপনার মুখেই সেটা আমি শুনতে চাইছি।”
“শুনতে যখন চাইছেন, তখন বলব নিশ্চয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তার আগে একটা প্রশ্ন করি। হরিনন্দন ছাড়াও যে আপনার আর-একটি ছেলে রয়েছে, কই, তা তো আপনি আমাকে বলেননি। কোনও অসুবিধে ছিল?”
“অসুবিধে নয়, অস্বস্তি ছিল।” মিশ্রজি বললেন, “যার চরিত্র কিংবা বিবেক বলে কিছু নেই, তার উপরে যে কিনা ঘোর স্বার্থপর, যে একটা বিয়ে করেছে বটে কিন্তু স্ত্রীপুত্রের কোনও খোঁজ পর্যন্ত কখনও নেয়নি, তার কথা জানাতে আমার অস্বস্তি হবে না? তবে হ্যাঁ, অস্বস্তি থাকলেও রাগ আর নেই।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন মিশ্রজি। তারপর বললেন, “জয়নন্দন তো কবেই মারা গেছে। একটা মরা মানুষের উপরে রাগ করে থাকার কোনও মানে হয়? আপনিই বলুন, হয়?”
প্রশ্নটার উত্তর না-দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “হরিনন্দনের তিনি ছোট ভাই?”
“হ্যাঁ, মাত্রই এক বছরের ছোট। মারাও গেল হরি মারা যাবার ঠিক এক বছর বাদে। সেভেন্টির মে মাসে। …তাজ্জব ব্যাপার, হরির মতনই জয়ও শেষ পর্যন্ত অ্যাকসিডেন্টেই মারা পড়ল!”
“সেও রোড-অ্যাকসিডেন্ট?”
“না।” মিশ্রজি ম্লান হেসে বললেন, “দুটোই ডেথ ডিউ টু অ্যাকসিডেন্ট, অথচ দুটোর মধ্যে কত তফাত দেখুন। হরি মারা গেল ফসিলের খোঁজে বেরিয়ে ট্রাকের ধাক্কায়, আর জয়? পুলিশের তাড়া খেয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে সে লাফিয়ে পড়েছিল, সিগন্যাল পোস্টে ধাক্কা লেগে মাথা থেঁতলে যায়।”
আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন মিশ্রজি। তারপর বললেন, “লোকে জানে যে, জয়নন্দন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি জানি যে, সেটা সত্যি নয়। বাপের চোখকে ফাঁকি দেওয়া কি সহজ? কাগজে তার ডেডবডির যে ছবি বেরিয়েছিল, সেটা দেখে আর-কেউ তাকে চিনতে না-পারলেও আমি পেরেছি। …তার শ্রাদ্ধও করেছি। তবে হ্যাঁ, গোপনে।”
“গোপনে কেন?”
“কারেন্সি নোট জাল করার জন্য পুলিশ যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, প্রকাশ্যে, সবাইকে জানিয়ে কি সেই ফেরারি আসামির শ্রাদ্ধ করা যায়? করা সম্ভব?”
ভাদুড়িমশাই এই কথাটারও কোনও উত্তর দিলেন না। বললেন, “কিন্তু সে যে বিয়ে করেছিল, সেটা আপনি জানতেন, কেমন?”
“আগে জানতুম না। কী করেই বা জানব?” মিশ্রজি বললেন, “তার যখন বছর-কুড়ি বয়স, নেহাতই কলেজের ছাত্র, তখনই সে একটা ছিনতাইয়ের মামলায় জড়িয়ে পড়েছিল। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সেটা আমাকে জানাবার সঙ্গে-সঙ্গেই জয়নন্দনকে আমি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিই। তখন থেকেই তার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক আমার ছিল না। তা হলে আর তার বিয়ের কথা আমি কী করে জানব? সেটা জানলুম সে মারা যাওয়ার পর।”
“কী করে জানলেন?”
মিশ্রজি ফের ম্লান হাসলেন। বললেন, “যেমন বাপের চোখকে ফাঁকি দেওয়া যায় না, তেমনি ফাঁকি দেওয়া যায় না বউয়ের চোখকেও। তার বউও কাগজে সেই ডেডবডির ছবি দেখেই তাকে চিনেছিল। জয়নন্দনের মৃত্যুর মাসখানেক বাদে অল্পবয়েসি একটি বউ এই বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে। কোলে একটি বাচ্চা ছেলে। মেয়েটি বলল, সে জয়নন্দনের বউ। তারপর কোলের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, জয়নন্দনের ছেলে।”
“বউটি বাঙালি?”
ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে মিশ্রজি বললেন, “আপনি কী করে জানলেন?”
বলতে গেলে মিশ্রজির প্রায় কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিচ্ছিলেন না ভাদুড়িমশাই। এটারও দিলেন না। বললেন, “আর রঘুনন্দনই সেই ছেলে, মানে জয়নন্দনের ছেলে, কেমন?”
মিশ্রজি একেবারে অবাক হয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে। তারপর, গলার স্বর আরও একটু নামিয়ে নিয়ে বললেন, “কথাটা যে আস্তে-আস্তে এইদিকেই এগোবে, সেটা আমার বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু না, কী করে এতসব কথা আপনি জানলেন, তা আর আপনাকে আমি জিজ্ঞেস করছি না। এ তো আমি বুঝতেই পারছি যে, ইউ হ্যাভ ইয়োর ঔন্ ওয়ে অভ নোয়িং থিংস শুধু একটা কথা আমার জানাই দরকার। রঘু যে জয়ের ছেলে, তা সে জানে না তো?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “নিশ্চিন্ত থাকুন মিশ্রজি, রঘুনন্দন কিছুই জানে না। তার ধারণা সে হরিনন্দনের ছেলে।”
ঘরের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হওয়ার খানিক বাদেই নার্সটি বাইরে চলে গিয়েছিলেন। এবারে ঘরে ঢুকে দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়ে মিশ্রজির কাছে এসে তিনি বললেন, “আপনার নাতি আর নাতবউ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, আমি ঢুকতে দিইনি। বলেছি, ‘একটু পরে আসুন।’ কিন্তু আপনারা আর কতক্ষণ কথা বলবেন?”
মিশ্রজি বললেন, “রমা বেটি, হোয়াই ডোঞ্চ আন্ডারস্ট্যান্ড ওয়ান থিং? আমি ভাল হয়ে গেছি, এখন আমার যতক্ষণ খুশি এঁদের সঙ্গে কথা বলব।”
“ঠিক আছে,” ভদ্রমহিলা বললেন, “কিন্তু ওষুধটা তো খেতে হবে। নিন, এটা খেয়ে নিন।”
শিশি থেকে একটা ক্যাপসুল বার করে মিশ্রজিকে খাইয়ে দিয়ে ভদ্রমহিলা ফের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মিশ্রজি বললেন, “রঘুনন্দনের কথা হচ্ছিল। সত্যি ও কিছু জানে না তো!”
“কিচ্ছু জানে না।”
হঠাৎই যেন একটু উদাস হয়ে গেলেন মিশ্রজি। তারপর, যেন কাউকে উদ্দেশ করে নয়, নেহাতই আপন মনে কিছু বলছেন, এইভাবে বললেন, “মাঝে-মাঝে বড় অবাক হয়ে যাই। ভাবি যে, আমার ছেলে দুটো পরস্পরের এত বিপরীত স্বভাব পেল কী করে? আরও অবাক হই, যখন ভাবি যে, যার জন্যে আমার লজ্জার শেষ নেই, সেই জয়নন্দনের ছেলে এত ভাল, আর যার স্বভাব ছিল ফুলের মতো নিষ্পাপ, সেই হরিনন্দনের ছেলে এরই মধ্যে পুলিশের খাতায় নাম তুলে ফেলেছে! কেন এমন হয়!”
আবার একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন মিশ্রজি। তারপর বললেন, “এও বড় তাজ্জব ব্যাপার যে, জয়নন্দনের চেহারা তো মোটেই আমার মতো ছিল না, অথচ তার ছেলে রঘুকে দেখুন। ওর মুখে যেন অবিকল আমারই মুখ বসানো।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “রঘু যখন তার মায়ের কোলে উঠে প্রথম এ-বাড়িতে আসে, তখনই এই আদলটা আপনার চোখে পড়েছিল?”
“পড়েছিল বলেই তো ওর মায়ের কথা আমি অবিশ্বাস করিনি। সে যেই বলল, এ আপনার নাতি, সঙ্গে-সঙ্গে আমি হাত বাড়িয়ে সেই তিন বছরের ছেলেকে কাছে টেনে নিলুম। ছেলে আমার চেহারা পেল না, অথচ নাতি পেল, বলুন, আশ্চর্য ব্যাপার নয়?”
“তা কেন হবে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অ্যাটাভিজ্ম বলে একটা কথা আছে না? পূর্বপুরুষের চেহারা অনেক সময়েই একটা-দুটো জেনারেশন বাদ দিয়ে ফের ফিরে আসে। তবে শুধু আপনার চেহারার সঙ্গে নয়, ওর জ্যাঠামশাই হরিনন্দনের চেহারার সঙ্গেও রঘুর মিল রয়েছে ষোলো-আনা। আমি তো কলকাতায় রঘুকে দেখে চমকে গিয়েছিলুম। মনে হয়েছিল যেন হরিনন্দনকেই দেখছি।”
মিশ্রজি বললেন, “অথচ কাণ্ড দেখুন, হরিনন্দনের নিজের ছেলেটা না-পেল তার বাপের স্বভাব, না তার চেহারা। মিঃ ভাদুড়ি, মিল দেখে তো চমকে গিয়েছিলেন, এবার বলি, হরিনন্দনের ছেলের সঙ্গে তো আপনার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবু যদি কখনও দেখা হয়ে যায় তো মিলের বদলে অমিল দেখে আপনাকে চমকে যেতে হবে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “জানকীনন্দনের কথা বলছেন তো? তার সঙ্গে কিন্তু কাল রাত্তিরেই আমার দেখা হয়েছে।”
এতক্ষণ আমি একটাও কথা বলিনি। এবারে সুযোগ পেয়ে বললুম, “রাত দুটোয়, টু বি প্রিসাইজ।”
শুনে, মিশ্রজির চোখেমুখে যা ফুটে উঠল, আতঙ্ক ছাড়া তাকে আর কিছুই বলা যায় না। সত্যি বলতে কী, মিশ্রজিকে দেখে আমার ভয় হল যে, আবারও বোধহয় তিনি তাঁর বাক্শক্তি হারাবেন। কিন্তু না, সে-সব কিছু হল না, একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি অস্ফুট গলায় বললেন, “রাত দুটোয়? কোথায়?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এই বাড়িতেই। …না না, ভয়ের কিছু নেই। আপনার ইনকমপ্লিট চিঠিখানা তো আমি পেয়েছি, তাতে আপনি লিখেছিলেন যে, রঘুনন্দরের উপরে নজর রাখাই হবে আমার প্রথম কাজ। তা, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, রঘুর কোনও ক্ষতি সে করবে না। ইন্ ফ্যাক্ট জানকীনন্দনের দ্বারা আপনাদের কারওই কোনও ক্ষতি হবার আশঙ্কা নেই।”
“তা হলে সে এই বাড়িতে এসেছে কেন?”
“কালই যে প্রথম এসেছিল, তা তো নয়,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এর আগেও এ-বাড়িতে দু’-দু’বার এসেছে। আর কেন যে আসছিল, সে তো আপনি বুঝতে পেরেছিলেন। আসছিল তার বার্থ-সার্টিফিকেটের খোঁজে।”
“সেটা সে পেয়েছে?”
“কী করে পাবে? সার্টিফিকেটটা যে কোথায় আছে, তা-ই তো সে জানত না। জানলেও অবশ্য লাভ হত না। তার কারণ, শনিবার সকালে আপনার কাছেই আমি জায়গাটার হদিশ পেয়ে গিয়েছিলুম।”
“কিন্তু শনিবার সকালে তো আমি ঠিকমতো কথাই বলতে পারছিলুম না।”
“পারছিলেন, তবে এত অস্পষ্ট উচ্চারণে যে, রঘুনন্দন তার মানে বুঝতে পারেনি। আমারও তার মানে বুঝতে বেশ-কিছুটা সময় লেগে গেল। যা-ই হোক, জায়গার হদিশ তো আপনি দিয়েছিলেন, কাল রাত্তিরেই সেখান থেকে সার্টিফিকেটটা আমি সরিয়ে ফেলি।”
শুনে, মস্ত একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন মিশ্রজি। বললেন, “জানকীর মামাবাড়ি থেকে তাকে ওশকানো হচ্ছিল, সার্টিফিকেটটা পেলেই সে সম্পত্তির ভাগ চেয়ে মামলা করে দিত।”
“মামলা করলেই কি আর জেতা যায়? আপনি কনটেস্ট করতেন না?”
“তা হয়তো করতুম। কিন্তু আমাকে সেক্ষেত্রে আদালতে গিয়ে সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হত, নিজেরই নাতির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে হত, কাগজে তা-ই নিয়ে ফলাও করে খবর ছাপা হত, লোকজন হাসাহাসি করত, এক কথায় আমাদের পারিবারিক সম্মানের কিছুই তা হলে বাঁচত না। …ওটা কোথায়?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমারই কাছে আছে। কিন্তু ওই সার্টিফিকেট ছাড়াও যে মামলা করা যায়, সেটা আপনি বুঝছেন না কেন?”
“তা হলে আমি কী করব?”
“ভয় পাবার কিছু নেই।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তার সঙ্গে আমার যে কথা হয়েছে, তাতে আশা করতে পারি, মামলা সে করবে না। ইন ফ্যাক্ট, এ-বাড়ির কোনও ক্ষতি হতে পারে, এমন কিছুই সে করবে না। কিন্তু তার একটা শর্ত আছে।”
“বলুন।”
“আপনাকে বুঝতে হবে যে, রঘুকে যেমন কাছে টেনে নিয়েছেন, জানকীকেও যদি সেইভাবেই আপনি কাছে টেনে নিতেন, তা হলে সে বিগড়ে যেত না। প্রথম থেকেই সে যদি আপনার সান্নিধ্য পেত, একটা সুস্থ পরিবেশে বড় হবার সুযোগ পেত, তা হলে সেও রঘুর মতোই দায়িত্ববান আর বিবেচক একজন মানুষ হয়ে বেড়ে উঠত। কিন্তু সেই সুযোগটাই তো সে পায়নি।”
“হরির মৃত্যুর পর আমি তো তাকে আমার কাছেই নিয়ে আসতে চেয়েছিলুম, কিন্তু তার ওই মামাই তো তাকে আটকে রাখল। দু’-দু’বার আমি নৈনিতালে গিয়েছিলুম, কিন্তু দু’বারই আমাকে তারা ফিরিয়ে দিয়েছে।”
“সেটা যে আমি আঁচ করিনি, তাও নয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তবু বলব যে, এখনও সময় যায়নি। যেমন রঘু, তেমনি জানকীও খুব অল্পবয়সেই পিতৃহীন হয়েছে। রঘুকে আপনি রক্ষা করেছেন, এবারে জানকীকেও রক্ষা করুন। আপনার উপরে একটা অভিমান তো তার থাকতেই পারে। সেটা বুঝুন। সেও তো আপনার নাতি। তাকে কাছে টেনে নিন।
মিশ্রজির মনের মধ্যে যে একটা সংঘাত চলেছে, তাঁর মুখ দেখেই সেটা বোঝা যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “জানকী এখন কোথায়, আপনি জানেন?”
“না, তা জানি না। তবে এমন একজনকে জানি, যে তার খবর রাখে। আপনি যদি চান তো তার মারফত খবর পাঠিয়ে জানকীকে এখানে আসতে বলতে পারি। বলব?”
“বলুন।” মিশ্রজির মুখে সামান্য একটু হাসি ফুটে উঠেই ফের মিলিয়ে গেল। বললেন, “কিন্তু খবর পাঠালেই কি সে আসবে?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আসবে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।”
মিশ্রজির ঘর থেকে বেরিয়ে এলুম আমরা। দরজার বাইরে নার্সটি একটা মোড়ায় চুপচাপ বসে ছিলেন। ভাদুড়িমশাই তাঁকে বললেন, “এবারে আপনি রঘুনন্দন আর রাধিকাকে ভিতরে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে বলতে পারেন।”
উপরে উঠে এসে ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে ঢুকে দেখলুম, জনার্দন সেখানে বিছানার চাদর পালটে দিচ্ছে। আমাদের দেখে বলল, “আপনারা বসুন, মালিক। আমার কাজ এখুনি শেষ হয়ে যাবে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও-সব কাজ রেখে যা বলছি শোনো। জানকী কোথায় আছে, তা তুমি জানো নিশ্চয়।….না না, অস্বীকার করে লাভ নেই, তোমার সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারটা আমি জানি। কিন্তু তার জন্য আমি রাগ করছি না। আমি জানি যে, যা-কিছু তুমি করেছ, সেটা তাকে ভালবাসো বলেই করেছ। নাও, এখন চটপট তার কাছে চলে যাও। গিয়ে তাকে বলো যে, আজই বিকেলে সে এসে যেন তোমার বুড়োবাবুর সঙ্গে দেখা করে। …ও কী, হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন? যাও।”