পাহাড়ি বিছে – ১৫

১৫

রেডিয়াম ডায়ালের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, রাত এখন পৌনে দুটো বাজে। সদানন্দবাবু যে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন, এটা বুঝে নিয়ে পৌনে একটার সময় নিঃশব্দে আমি ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে চলে আসি। আসার আগে বাইরে থেকে ও-ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এসেছি। ভাদুড়িমশাই জেগেই ছিলেন। ঘর একেবারে অন্ধকার। আমি যে এসেছি, অন্ধকারের মধ্যেই সেটা টের পেয়ে গিয়ে চাপা গলায় বললেন, “দরজাটা বন্ধ করবেন না, ভেজানোই থাক। শব্দ-টব্দ না-করে চুপচাপ আমার ডান দিকের খাটে এসে শুয়ে পড়ুন। তবে ঘুমিয়ে পড়বেন না।”

ঘুমোব কী, উত্তেজনায় আমার বুকের মধ্যে দুবদুব করে শব্দ হচ্ছিল। এ-ঘরের কোথায় খাট, কোথায় ওয়ার্ডরোব, কোথায় চেয়ার, কোথায় টেবিল, তা যে জানি না, তা নয়, তবে অন্ধকারে সবই কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়। তবু তারই মধ্যে যতটা সম্ভব হুঁশিয়ার হয়ে পা ফেলতে-ফেলতে খাট পর্যন্ত এসে পৌঁছনো গেল। সেই থেকে চুপচাপ শুয়ে আছি আর আকাশপাতাল চিন্তা করে যাচ্ছি। ভাদুড়িমশাই কেন যে আমাকে এ-ঘরে এসে শুতে বললেন, এখনও পর্যন্ত তার কিছুই আমি জানি না। একটু আগে একটা কুকুর কোথাও ডেকে উঠেছিল, তারপরে আর কোথাও কোনও শব্দ নেই। উত্তরবঙ্গের মুকুন্দপুর আর গিরিডির মহেশমুন্ডার কথা মনে পড়ল। সেখানেও ঠিক এইভাবেই আমাদের রাত জাগাতে হয়েছিল। এখানেও কি তেমন-কিছু ঘটবে?

যেমন ও-ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে এসেছি, তেমনি এ-ঘরের দরজাতেও ভিতর থেকে ছিটকিনি তুলে দিইনি। তবে কেন যে ভাদুড়িমশাই দরজাটা স্রেফ ভেজিয়ে রাখতে বললেন, সেটা বুঝতে পারছি না। তিনি কি ধরেই নিয়েছেন যে, এমন-কেউ আজ এ-ঘরে এসে ঢুকবে, দরজাটা যার জন্যে খুলে রাখা দরকার! তা-ই যদি হয়, তো সে কে?

দূরে কোথাও একটা পেটা-ঘড়িতে দুটো বাজল। অন্ধকারটা ইতিমধ্যে চোখে অনেকটাই সয়ে এসেছিল। দরজাটা যে কোথায়, সেটা জানি। সেইদিকে চোখ রেখে একেবারে নিস্পন্দ শুয়ে আছি। বুকের মধ্যে সেই দুবদুব বাজনাটা বেজেই চলেছে।

খুট করে যে সামান্য আওয়াজটা হল, সেটা অবশ্য দরজার দিক থেকে আসেনি, এসেছে, বারান্দার দিকের জানালা থেকে। নিঃশব্দে সেদিকে তাকাতেই যা চোখে পড়ল, তাতে হৃৎপিণ্ডটা যেন হঠাৎই একটা লাফ মেরে উঠে এল আমার গলার কাছে। মুখ দিয়ে অবশ্য কোনও শব্দ বার হল না। দম বন্ধ করে দেখতে লাগলুম যে, জানলার গ্রিলটা আস্তে-আস্তে ফ্রেম থেকে সরে যাচ্ছে। পরক্ষণেই একটা ছায়ামূর্তি খোলা জানালা দিয়ে আমাদের ঘরের মধ্যে নেমে এল।

কিন্তু নেমেই যে সে ডান হাত দিয়ে ঢেকে ফেলল তার চোখ, তার কারণ আর কিছুই নয়, চার-সেলের একটা জোরালো টর্চের আলোয় তার চোখ হঠাৎই ধাঁধিয়ে গিয়েছে। বাঁ হাতে টর্চ, ডান হাতে রিভলভার, চাপা কিন্তু কঠিন গলায় ভাদুড়িমশাই বললেন, “নো মাংকি ট্রিকস! চোখ থেকে হাত নামাও, তারপর যে-ভাবে দাঁড়িয়ে আছ, ঠিক সেইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকো! পালাবার চেষ্টা করলেই আমি গুলি চালাব। …কিরণবাবু, বেড-ল্যাম্পের সুইচটা আপনার মাথার কাছেই রয়েছে, ওটা টিপে দিন।”

সুইচ টিপতেই আলো জ্বলে উঠল। যে-লোকটি ঘরে ঢুকেছে, এতক্ষণে স্পষ্ট দেখতে পেলুম তাকে। দেখে চমকে উঠলুম। আজই বিকেলে মন্দির থেকে বাড়িতে ফিরে একেই ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলুম। জনার্দন বলেছিল, এ তার দেশের লোক। পরনে চেক-কাটা একটা গাঢ় লাল রঙের শার্ট আর ছাই-রঙের ট্রাউজার্স। বয়েস মনে হল বছর তিরিশের মতো হবে। চোখ থেকে হাত সরিয়ে লোকটি বলল, “মেহেরবানি করকে আপকি টর্চ বুঝা দিজিয়ে, নেহি তো মুঝে কুছ ভি ন নেহি আ রহা হ্যায়।”

মার্জিত উচ্চারণে কথা বলছে, কে এই লোকটি? এর কথার ভঙ্গিতে যে কিঞ্চিৎ পরিহাসের ছোঁয়া লেগে রয়েছে, সেটাও বুঝতে পারছি। টর্চ নিবিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কে তুমি?”

জানলার পাশের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে লোকটি হেসে বলল, “উয়ো তো ইলাহাবাদকা পোলিস-সাহাবনে হি আপকো বাতা দিয়া হোগা।”

(অতঃপর হিন্দিতে যে কথাবার্তা হল, এখানে সেটা বাংলায় বলছি। তাতে পাঠকদেরও সুবিধে, আমারও সুবিধে।)

লোকটির কথা শুনে ভাদুড়িমশাই হাসলেন। বললেন, “বুঝতে পারছি, তুমি ত্রিলোক সিং। কিন্তু ও নাম তো তুমি পুলিশের খাতায় লিখিয়েছ, ওটা তোমার আসল নাম নয়। হরিনন্দন মিশ্রের ছেলের নাম কি ত্রিলোক সিং হতে পারে?”

চমকে উঠে লোকটি বলল, “আপনি জানেন দেখছি! কে জানাল? দাদু?”

চমকে আমিও কিছু কম যাইনি। এই লোকটি হরিনন্দনের ছেলে? রঘুনন্দন তা হলে কে?

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না, তোমার দাদু কিছু জানাননি। কী করে জানাবেন, তিনি তো কথাই বলতে পারেন না।”

“তা হলে কি জনার্দন বলেছে?”

“না, সেও কিছু বলেনি।” মুখের হাসিটাকে মিলিয়ে যেতে না দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “নৈনিতালে তোমার মামাবাড়িতে ফোন করেছিলুম।”

“কোথায় আমার মামাবাড়ি, তাও জানেন?”

“জানি। তোমার বাবাই আমাকে জানিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার নেহাতই অল্প সময়ের পরিচয়। তারই মধ্যে এটাও তাঁর কাছে শুনেছিলুম যে, তোমার মামার নাম ডঃ ত্রিপাঠী, নৈনিতালে তিনি একজন নাম-করা ডাক্তার। এ-সব পঁচিশ বছর আগেকার কথা, কিন্তু আমি ভুলে যাইনি।”

“আপনি তা হলে সবই জানেন?”

“জানি। হরিনন্দনের ছেলে হয়েও এ-বাড়িতে তোমাকে চোরের মতো ঢুকতে হয় কেন, তাও জানি। …কিন্তু তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন? বোসো। বসে আমার একটা কথার জবাব দাও।”

জানলার পাশেই চেয়ার ছিল একটা। ছেলেটি তাতে ধপ করে বসে পড়ল। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছল। তারপর বলল, “কী জানতে চান আপনি, বলুন।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বারবার তুমি এ-বাড়িতে আসছ কেন? কী খুঁজছ তুমি? তোমার বার্থ-সার্টিফিকেট, তা-ই না?”

“ঠিকই ধরেছেন।” ছেলেটি ম্লান হেসে বলল, “কী করে ধরলেন, তা অবশ্য জানি না। তবে হ্যাঁ, বার্থ-সার্টিফিকেটটাই আমি খুঁজছি। ওটা আমার পাওয়াই চাই।”

“তার জন্যে এত মেহনতের কী দরকার? যে নার্সিং হোমে তুমি জন্মেছিল, তার নাম জানো না?”

“জানি। মামাবাবুর কাছেই শুনেছি।”

“তা হলে সেই নার্সিং হোমে গিয়ে সার্টিফিকেটের একটা কপি চাইলেই তো হয়। কয়েকটা টাকা দিলেই সেটা পেয়ে যাবে।”

“তা জানি,” আবার ম্লান হেসে ছেলেটি বলল, “কিন্তু সেই নার্সিং হোমটা অনেক বছর আগেই উঠে গেছে। কী একটা বে-আইনি কাজের খোঁজ পেয়ে পুলিশ সেখানে হানা দিয়েছিল, তার পরেই সেটা বন্ধ হয়ে যায়। তার মালিকও বেঁচে নেই।”

“বুঝেছি।” একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু ওরিজিন্যাল সার্টিফিকেটটা পেয়েই বা তুমি কী করবে?”

“মামলা করব।” ছেলেটি হঠাৎ ফুঁসে উঠে বলল, “মামলা করে এই বাড়ির অংশ দাবি করব।”

“কিন্তু বাড়ি তো তোমার দাদুর। ইচ্ছে করলে তিনি তো তোমায় এই বাড়ির অংশ থেকে বঞ্চিত করতেই পারেন।”

“বেশ, করুন। কিন্তু মিউজিয়াম? মামার কাছে শুনেছি, ওখানে যা-কিছু রয়েছে, তার বেশির ভাগই জোগাড় করেছেন আমার বাবা। অন্তত সেগুলি তো আমি দাবি করতে পারি।”

ভাদুড়িমশাই ফের হেসে বললেন, “তা পারো। কিন্তু মামলা করলেই কি ও-সব ফেরত পাওয়া যাবে? আর তা ছাড়া, ওগুলো নিয়ে তুমি করবেই বা কী? এ তো আর সোনাদানা নয় যে গয়নার দোকানে গিয়ে বেচে দেবে। আবার চোরাই পথে যে বিদেশে পাঠাবে, তারও অনেক ঝক্কি। পুলিশকে বোকা ভেবো না, তোমার উপরে তারা নজর রেখেছে, চোরাই চালান করতে গিয়ে যদি ধরা পড়ো তো দশ-পনেরো বছর ঘানি ঘুরিয়ে ছাড়বে। …না না, ও-সব মতলব ছেড়ে দাও।”

“তা হলে আমি কী করব?”

“আপাতত এই বাড়ি থেকে নিঃশব্দে তুমি বেরিয়ে যাবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর আমি কী করব, সেটাও বলি। যাতে আবার এখানে তুমি ফিরে আসতে পারো, তোমার দাদুর সঙ্গে কথা বলে আমি তার ব্যবস্থা করব। কিন্তু তোমাকে কথা দিতে হবে যে, অ্যাদ্দিন যা করেছ, করেছ, কিন্তু তোমাদের পরিবারের মুখে কালি পড়তে পারে, ভবিষ্যতে আর কখনও এমন কোনও কাজ তুমি করবে না। …নাও জানকীনন্দন, এবারে উঠে পড়ো। জানলা দিয়ে বেরোবার দরকার নেই, দরজাটা খোলাই আছে।…আর হ্যাঁ, বাড়ি ফাঁকা পেয়ে গ্রিলের স্ক্রু তো তুমি আর জনার্দন মিলে আজই বিকেলে আলগা করে রেখেছিলে, কষ্ট করে ওটা আর লাগাতে যেয়ো না, শব্দে হয়তো অন্যদের ঘুম ভেঙে যেতে পারে।”

মুখ নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ছেলেটি। ভাদুড়িমশাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “খুব অবাক হয়ে গেছেন মনে হচ্ছে?”

বললুম, “তা হয়েছি। কিন্তু ওর নাম যে জানকীনন্দন, তা আপনি কী করে জানলেন?”

“বাঃ, নৈনিতালে ফোন করেছিলুম না? নামটা ওর মামাই জানিয়ে দিয়েছেন।”

“রঘুনন্দন তা হলে হরিনন্দনের ছেলে নয়?”

“তা যে নয়, রঘুনন্দনের কথা থেকেই সেটা আপনার বোঝা উচিত ছিল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অবিশ্যি বুঝবেন কী করে? যত বয়েস বাড়ছে, ততই যে দিনে-দিনে আপনি একটা বাঁধাকপিতে পরিণত হচ্ছেন। কিন্তু আর নয়, এবারে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন দিকি। বাকি রাতটা আমাকেও একটু ঘুমিয়ে নিতে দিন।”