পাহাড়ি বিছে – ১৪

১৪

বারোটা নয়, রঘুনন্দন আর রাধিকা একটায় ফিরে এল। আমরা তিনজন ড্রয়িংরুমে বসে গল্প করছিলুম, একইসঙ্গে লাঞ্চের ঘণ্টা আর বাড়ির চত্বরে গাড়ি ঢোকার শব্দ শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলুম ওরা গাড়ি থেকে নামছে। ভাদুড়িমশাই বললেন, “মিশ্রজিকে কেমন দেখলেন? অবস্থা আরও স্টেবিলাইজ করেছে তো?”

রঘুনন্দন সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে-উঠতে বলল, “বলছি, সব বলছি।…জনার্দন, এক্ষুনি খেতে দিতে বলো, খেয়েই আবার বেরুতে হবে।”

মিশ্রজির সম্পর্কে যা-কিছু খবর, তা খেতে বসেই পাওয়া গেল। তাঁর কথা এখনও জড়িয়ে যাচ্ছে, হাতে আর পায়ে সাড়ও বিশেষ ফেরেনি, তবে জেনারেল কন্ডিশন নাকি আগের চেয়ে অনেক ভাল, সম্ভবত আজ বিকেলেই তাঁকে ক্যাবিনে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

ভাদুড়িমশাই বললেন, “মিউজিয়ামের খবর কী? ডি. এম. আসছেন তো?”

রঘুনন্দন বলল, “ডি. এম. তো আসছেনই, একটু আগে খবর পেলুম যে, দিল্লি থেকেও আমাদের মিনিস্ট্রি অভ কালচারের সেক্রেটারি-সাহেব আসছেন। ডেলিগেশনের সঙ্গে তিনিও থাকবেন।”

“সে তো মস্ত খবর।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মিনিস্ট্রি অভ কালচারের সেক্রেটারি এসে নিজের চোখেই মিউজিয়ামটা দেখে যান, তাতে সেন্টার থেকেও ভাল-রকমের একটা গ্র্যান্ট হয়তো পাওয়া যেতে পারে। ওঁদের রিসিভ করার ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা সব ঠিক আছে তো?”

“তা আছে। তা ছাড়া নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মিউজিয়ামের ঘরগুলো একেবারে ঝকঝকে-তকতকে করিয়ে রেখেছি। খাতাপত্তরও সব একেবারে আপ-টু-ডেট করে রাখা হল। বাবুরা আশা করছি খুশিই হবেন। নাউ লেট আস ওয়েট অ্যান্ড সি।… আমি আর রাধিকা তো এখুনি ফের ওখানে চলে যাব। দেখি যদি কোথাও কিছু ফিনিশিং টাচ দেবার থাকে।”

রাধিকা বলল, “আমরা বেরিয়ে যাচ্ছি বলে আপনাদের তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই, আপনারা ধীরেসুস্থে খান।”

কিন্তু যাঁদের বাড়িতে আছি, তাঁরা বেরিয়ে যাবেন আর অতিথিরা বসে-বসে খেতে থাকবে, এটা ভাল দেখায় না বলে আমরাও চটপট খাওয়া চুকিয়ে উঠে পড়লুম। তারপর রঘুনন্দন আর রাধিকা যখন ফের গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন, তখন ভাদুড়িমশাই বললেন, “ছুটির দিনে সেই আপনাদের মিউজিয়াম তো খোলা রাখতেই হল, তা একটু বেশি সময় পর্যন্ত কি খোলা রাখা যায়?”

“কেন, আপনারা ওখানে যাবেন?” রঘুনন্দন বলল, “যদি যান তো খোলা রাখতে পারি। কখন যাবেন?”

“এই ধরুন আটটা নাগাদ।”

“ঠিক আছে, চলে আসুন। …আমাদের ভিজিটররা বিদায় নেবার পরে আমাকে অবশ্য আর-একবার নার্সিং হোমে যেতে হবে। তবে বাই দ্যাট টাইম নার্সিং হোম থেকে আমিও ওখানে পৌঁছে যেতে পারব।”

গাড়িতে উঠে রঘুনন্দনরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

আমরা দোতলায় উঠে এলুম। নিজের ঘরে ঢোকার আগে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনারা একটু বিশ্রাম করে নিন। এখন তো পৌনে দুটো বাজে, তিনটে নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়ব।”

সদানন্দবাবু বললেন, “মন্দির তো শুনিচি খুব কাছে নয়, এদিকে ওরা দুজনে তো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল, আমরা তা হলে কীসে করে যাব?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ও নিয়ে ভাববেন না, অটো আছে, ট্যাকসি আছে, বাড়ির গাড়িতেই যে যেতে হবে, তার কোনও মানে নেই।”

কথাটা বলে ঘরে ঢুকে ভাদুড়িমশাই দরজা বন্ধ করে দিলেন। বারান্দা থেকে আমরাও আমাদের ঘরে ঢুকে পড়লুম।

খানিক বাদেই দরজায় টোকা পড়ল। ভাদুড়িমশাই তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন, কিন্তু আমরা আমাদের দরজা খোলাই রেখেছি। বিছানা থেকেই তাই বললুম, “কাম ইন।”

পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল জনার্দন। হাতে জলভর্তি কাচের জাগ। ঘরের এককোণে ছোট্ট একটা টেবিল রয়েছে। জাগটা তার উপরে নামিয়ে রাখল। কিন্তু তারপরেও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মুখ দেখে মনে হল, কিছু বলতে চায়, কি লাটা উচিত হবে কি না, সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।

বললুম, “কিছু বলবে?”

“হাঁ, মালিক।” খুবই সংকুচিত গলায় জনার্দন বলল, “পরশু-রোজ আপনারা ইখানে এলেন, লেকিন আখুনো তো মন্দিলে গেলেন না।”

“কোন মন্দির?”

“বিন্ধ্যশ্বরী মাইজির মন্দিল। বিশোয়াস নাই?”

ভেবেছিলুম, সদানন্দবাবু বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু না, তিনি ঘুমোননি। জনার্দনের প্রশ্ন শুনে বিছানার উপরে উঠে বসে বললেন, “তা কেন থাকবে না? আলবাত বিশোয়াস আচে। মন্দিরমে তো অবশ্যই জায়েগা, প্রয়াগমে আস্নান ভি করেগা।”

“দুটা তো একদিনে হোবে না,” জনার্দন বলল, “আগে একদিন মন্দিলে যান, মাইজিকে পূজা দিন, বাদে এক রোজ ইলাহাবাদে গিয়ে আস্নান করবেন। সেটাই ভাল হোবে।”

“আরে, মন্দিরে তো আজই যাব।” সদানন্দবাবু বললেন, “এখন দুটো বাজে, তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়ব ভাবছি।”

“ঠিক আছে, ঘুরে আসুন। রাস্তাটা ভি বহোত বড়িয়া।… তা হলে কি তিনটার সময়ে চা দেব?”

“না না,” আমি বললুম, “তখন আর চা দিতে হবে না। চা আমরা পথেই কোথাও খেয়ে নেব অখন।”

“রাতকো ইখানেই ডিনার করবেন তো?”

“তা তো করবই।” সদানন্দবাবু বললেন, “নটার মধ্যেই যকন ফিরে আসচি, রাতের খাওয়া তখন আর এখানে খাব না কেন? তবে হ্যাঁ, আজ রাত্তিরেও মাচের ঝোল থাকচে তো?”

জনার্দনের মুখে এতক্ষণে সেই চতুর হাসিটা ফুটল আবার। বলল, “জরুর থাকবে।”

“তা হলে এক কাজ কোরো। রাত্তিরে আমার জন্যেও ভাতের ব্যবস্থা রেখো। মাচের ঝোল থাকচে, তখন আর রুটি খাব না।”

হাসিমুখেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জনার্দন। সদানন্দবাবু বললেন, “এ ভেরি লয়্যাল অ্যান্ড হার্ডওয়ার্কিং ম্যান।

আরও খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা বিছানা থেকে উঠে পড়লুম। চোখেমুখে জল ছিটোলুম, পোশাক পাল্টালুম, তারপর যখন ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা দিলুম, তখন ঠিক তিনটেই বাজে। ভাদুড়িমশাই তৈরি হয়েই ছিলেন। একতলায় নেমে ডাইনিং হলে জনার্দনকে পাওয়া গেল। তাকে বললুম যে, আমরা বেরোচ্ছি, তবে ন’টার মধ্যেই ফিরে আসব।

বড়রাস্তায় পৌঁছে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিলুম আমরা। এখানে ট্যাক্সি বলে আলাদা কিছু নেই; প্রাইভেট গাড়িই ট্যাক্সি খাটে। গাড়িতে ওঠার আগে ড্রাইভারকে বলে নিলুম যে, মন্দিরে আমরা বেশিক্ষণ থাকব না, আধঘণ্টার মতো সেখানে থেকে আবার তারই গাড়িতে মির্জাপুরে ফিরে আসব।

মির্জাপুর থেকে যাঁরা বিন্ধ্যেশ্বরী মন্দিরে গেছেন, তাঁরা জানেন যে, শহরের চৌহদ্দি ছাড়াবার একটু পরেই শুরু হয়ে যায় পাহাড়িয়া পথ। এই পাহাড়িয়া পথটুকু ভারী সুন্দর। সদানন্দবাবু বললেন, “ভাগ্যিস আপনাদের সঙ্গে এসেচিলুম, নইলে তো এ-সব দেকাই হত না।”

আমি বললুম, “রাস্তাটা যে সুন্দর, সে-কথা জানার্দনও বলছিল বটে

ভাদুড়িমশাই বললেন, “জনার্দন? আমরা যে আজ মন্দির দেখতে আসব, তা সে জানত নাকি?”

“তা জানত না। তবে আজই সে বলছিল যে, মন্দিরটা আমাদের দেখে আসা উচিত।”

“আমরা যে মন্দির দেখতেই বেরিয়েছি, তা সে জানে?”

“জানে বই কী।”

“কখন ফিরব, তাও জানে?”

বললুম, “তা জানে। আমিই ডাইনিং হলে গিয়ে তাকে জানিয়ে এসেছি যে, ন’টা নাগাদ ফিরব।” সদানন্দবাবু বললেন, “নীচে নামবার আগেই তো এই নিয়ে কথা হচ্চিল। তখন আমিও তাকে বলিচি যে, ন’টা নাগাদ ফিরে এসে মাচের ঝোল দিয়ে ভাত খাব। মাচ যখন রয়েচে, তখন আর রুটি খাচ্চি না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “অর্থাৎ সে জানে যে, তিনটে থেকে ন’টা, এই ছ’ঘণ্টা আমরা বাড়িতে থাকব না, কেমন?” তারপর আমাদের জবাবের জন্য অপেক্ষা না-করে বললেন, “ওদিকে রঘুনন্দন আর রাধিকাও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে, ফিরতে তাদেরও দেরি হবে। বাড়ি একদম ফাঁকা।”

সদানন্দবাবু বললেন, “ফাঁকা বলচেন কেন? জনার্দনই তো রয়েচে। তা ছাড়া রাঁধুনি বামুন আর বাবুর্চিটিও তো রয়েচে দেখলুম।”

ভাদুড়িমশাই এর পরে আর বেশি কিছু বললেন না, চুপ করে গেলেন। একটু বাদে এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার বলল, “মন্দিরের একেবারে সামনে তো গাড়ি নিয়ে যেতে দেবে না, আমি এখানেই গাড়ি রাখছি, আপনারা গিয়ে ঘুরে আসুন।”

কেন যে মন্দিরের একেবারে সামনে গাড়ি রাখার নিয়ম নেই, খানিক এগিয়েই তা বোঝা গেল। দূর থেকেই চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল, এবারে কাছে গিয়ে দেখলুম, বেজায় ভিড় ভিড় নাকি কোনও দিনই কিছু কম হয় না, তার উপরে আবার আজ রবিবার বলে পুণ্যার্থীদের লম্বা লাইন পড়ে গেছে। ইতিমধ্যে জনাকয়েক পাণ্ডা এসে আমাদের ঘিরে ধরেছিল। তাদের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিয়ে, সদানন্দবাবুকে তার হাতে সঁপে দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “যান বোসমশাই, পুজো দিয়ে আসুন, তবে দেরি করবেন না, আমার একটু তাড়া আছে, যত তাড়াতাড়ি পারেন বেরিয়ে আসবেন।”

সদানন্দবাবু বললেন, “সে কী, আপনারা ভেতরে যাবেন না?”

“আর-একদিন যাব। আজ শরীরটা বিশেষ ভাল নেই। আপনি ঘুরে আসুন, কিরণবাবু আর আমি এখানেই আপনার জন্যে অপেক্ষা করব।”

পাণ্ডার সঙ্গে সদানন্দবাবু ভিতরে ঢুকে গেলেন।

ভাদুড়িমশাইকে একটু চিন্তিত মনে হচ্ছিল। বললুম, “কী ভাবছেন বলুন তো?”

“ভাবছি যে, বাড়িতে আমরা কখন ফিরব, জনার্দনকে সেটা জানিয়ে দিয়ে বোধহয় ভাল করেননি।”

“এ-কথা কেন বলছেন?”

“সেটা আপনার আন্দাজ করা উচিত।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “জনার্দন যখন জেনে গেছে যে, রাত ন’টার আগে ফিরছি না, আর রঘুনন্দনদেরও আজ যখন ফিরতে দেরি হবে, তখন এই সময়ের মধ্যে সে হয়তো বাইরের কাউকে বাড়িতে আসতে বলতে পারে।”

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “অবশ্য আমারও এটা একটা আন্দাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে কিনা আন্দাজটা ঠিক কি না, তাও তো জানা দরকার। ভাবছি, সদানন্দবাবু মন্দির থেকে বেরোলেই আমরা বাড়ি ফিরব।”

বাড়ি ফিরলুম ছ’টার মধ্যেই। বাগান পেরিয়ে বারান্দায় উঠতেই চোখে পড়ল যে, ড্রয়িংরুম থেকে ট্রাউজার আর শার্ট পরা একজন লোককে নিয়ে জনার্দন বেরিয়ে আসছে। লোকটির বয়েস বেশি নয়। এ-বাড়িতে একে আগে কখনও দেখিনি। লোকটি একবার চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। জনার্দন তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ফিরে আসার পর ভাদুড়িমশাই বললেন, “ইনি কে জনার্দন?”

জনার্দন বলল, “আমার দেশের লোক, গাঁয়ের খবর দিতে এসেছিল। …তো আপনাদের মন্দিল দেখা হয়ে গেল?”

সদানন্দবাবু বললেন, “মন্দির দেখিচি, পুজোও দিলুম। এবারে একদিন প্রয়াগে গিয়ে একটা ডুব দিয়ে আসতে হবে।”

“চা দিব?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “চা? হ্যাঁ, দিলে তো ভালই হয়। সাতটা নাগাদ আবার তো বেরোতে হবে।”

কথা বলতে-বলতে আমরা দোতলায় উঠে এসেছিলুম। সদানন্দবাবু ঘরে ঢুকে গেলেন। ভাদুড়িমশাই বললেন, “দেখলেন তো? আন্দাজটা ঠিকই করেছিলুম।”

চা খেতে-খেতে ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব হল। তারপর সাতটা নাগাদ ফের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লুম আমরা। আজ রবিবার। তাই বলে সব দোকানই যে বন্ধ নয়, সে তো সকালবেলায় এসটিডি করতে গিয়েই বোঝা গিয়েছিল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “গোটা কয়েক বই কিনতে হবে, কিন্তু যে হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে এসেছি, তাতে আর কিছু ধরছে না, একটা ব্যাগ কিনতে পারলে ভাল হত। দামি ব্যাগ নয়, চটের হলেও চলবে।”

সেটা কেনা হল। সেইসঙ্গে কিছু হিন্দি আর ইংরিজি ম্যাগাজিন। ভাদুড়িমশাই সেগুলিকে তাঁর চটের থলের মধ্যে ঢুকিয়ে নিলেন। তারপর আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বললেন, “পৌনে আটটা বাজে। চলুন, এবারে একটা অটো-রিকশা ধরা যাক। আটটার মধ্যে মিউজিয়ামে পৌঁছতে হবে। রঘুনন্দন তো নার্সিং হোম থেকে আটটার মধ্যেই ওখানে চলে আসবে বলেছিল।”

রঘুনন্দন আর রাধিকা সত্যিই অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে। নন্দন মিউজিয়ামের গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল তারা। রাধিকা বলল, “আমরা এখানে মিনিট দশেক আগেই পৌঁছে গেছি। চলুন, ভিতরে ঢুকে কথা হবে।”

মিউজিয়ামের যে-ঘরে গিয়ে সবাই বসলুম, বোঝাই যায় যে, সেটি এখানকার কনফারেন্স-রুম। মস্ত একটা লম্বাটে টেবিলের দু’দিকে খান পনেরো-কুড়ি চেয়ার। টেবিলটিকে ধবধবে একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। গোটা কয়েক ফুলদানিতে ফুলও রয়েছে কয়েক গুচ্ছ। বিকেলে যাঁরা এসেছিলেন, সেই মান্য অতিথিদের জন্যেই যে এই ফুল-সজ্জা, সেটা আন্দাজ করতে কোনও অসুবিধে নেই। রঘুনন্দন বলল, “ভালয় ভালয় সব মিটে গেছে।”

ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “মিশ্রজি কেমন আছেন?”

রঘুনন্দন বলল, “সেটাই সবচেয়ে ভাল খবর। আজই বিকেলে ওঁকে আইসিইউ থেকে ক্যাবিনে নিয়ে আসা হয়েছে। ডঃ আমেদ বললেন, ইচ্ছে করলে আমরা ওঁকে বাড়িতেও নিয়ে যেতে পারি, তবে সেটা কাল সকালে নিলেই ভাল হয়। রাতটা বরং ক্যাবিনেই থাকুন।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ডঃ চতুর্বেদী কী বললেন? তাঁরও সেই মত?”

“তিনি বলছেন, দাদু ইজ কমপ্লিটলি আউট অভ ডেঞ্জার নাউ। হাত আর পা, দুটোই চমৎকার নাড়তে পারছেন। কথা অবশ্য এখনও ঠিকমতো বলতে পারছেন না। তবে যেমন ডঃ আমেদ তেমনি ডঃ চতুর্বেদীও বলছেন, সেটাও এর মধ্যে পেরে যাওয়া উচিত ছিল। দেখি, কাল সকালেই তো ওঁকে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছি, এর মধ্যে হয়তো কথারও আর-একটু উন্নতি হবে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “লেট আস হোপ সো। এ ছাড়া আর কীই বা বলতে পারি?”

রাধিকা বলল, “বাই দ্য ওয়ে, যে ফরেন ডেলিগেশন এসেছিল, তার মেম্বাররা তো মিউজিয়াম দেখে দারুণ খুশি। ডেলিগেশনের লিডার তো আমাদের ভিজিটর্স বুকে লিখেই দিয়েছেন যে, প্রাইভেট উদ্যোগে যে এমন একটা মিউজিয়াম এ-দেশে গড়ে তোলা হয়েছে, এ তাঁরা ভাবতেও পারেননি।”

“আর মিনিস্ট্রি অভ কালচারের সেক্রেটারি? তিনি কী বললেন?”

রঘুনন্দন বলল, “তিনিও উচ্ছ্বসিত। বললেন, আপাতত লাখ পাঁচেক টাকা তিনি স্যাংশন করে দেবেন।”

সদানন্দবাবু বললেন, “যাচ্চলে, মিউজিয়ামটা তো আমরা দেখিইনি, একটু ঘুরে দেখলে হয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটু বাদেই তো আমরা বাড়ি ফিরব, তার মধ্যে আপনারা কিছুই দেখে উঠতে পারবেন না, কাল বরং হাতে সময় নিয়ে আসুন, তখন খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সব দেখবেন।”

রাধিকা বলল, “আর তা ছাড়া গাইডকে তো আজকের মতো ছুটি দিয়ে দিয়েছি। সে থাকলে আপনাদের সব বুঝিয়ে বলতে পারত।”

ভাদুড়িমশাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আমার অবশ্য গাইডের দরকার হচ্ছে না, পাঁচ বছর আগে যখন এসেছিলুম, তখন মিশ্রজি নিজেই আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখিয়েছিলেন। তাই আমিই বরং ওয়েস্ট বেঙ্গল থেকে পাওয়া স্টোন এজের সেই কুড়ুলটা আর-একবার দেখে আসি। সেটা আছে তো?”

“অবশ্যই আছে।” রঘুনন্দন বলল, “সেটা দেখতেই তো জিওলজির অধ্যাপক আর ছাত্ররা হিল্লি-দিল্লি থেকে এখানে ছুটে আসে।”

“তা হলে আপনারা বসে গল্প করুন, স্রেফ সেইটে দেখেই আমি চলে আসব, মিনিট পাঁচ-সাতের বেশি লাগবে না।”

তা পাঁচ-সাত মিনিট না হোক, মিনিট দশেকের মধ্যেই ঘুরে এলেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “ওপর-ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলুম। এগজিবিটের সংখ্যা মনে হল বিস্তর বেড়ে গেছে।”

রঘুনন্দন বলল, “তা বেড়েছে। তবে সবই যে হাজার-হাজার বছরের পুরনো, তা কিন্তু ভাববেন না। দু’ পাঁচ শো বছর আগেকার পাথুরে ইউটেনসিলও প্রচুর এসেছে, ফ্রম অল ওভার ইন্ডিয়া।”

সদানন্দবাবু বললেন, “কাল এসে সব দেকব।”

ভাদুড়িমশাই তাঁর হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওরে বাবা, সাড়ে আটটা বাজে। এবারে তা হলে বাড়ি ফেরা যাক। ন’টা নাগাদ একটা ফোন আসার কথা আছে।”

নাইট-গার্ডদের ডেকে মিউজিয়াম বন্ধ করতে বলল রঘুনন্দন। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “সব বন্ধ না-করে তো বেরোতে পারছি না। আপনাদের যখন তাড়া রয়েছে, তখন গাড়িটা নিয়ে আপনারা বরং বাড়ি চলে যান, খানিক বাদে আমরা একটা অটো নিয়ে নিচ্ছি।”

বাড়ির মধ্যে যে ফোন বাজছে, গেটের সামনে পৌঁছেই সেটা শুনতে পেয়েছিলুম। সঙ্গে-সঙ্গেই আমার হাতে তাঁর চটের থলিটা ধরিয়ে দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভাড়া মিটিয়ে এটা নিয়ে উপরে চলে যান, আমি ফোনটা ধরেই উপরে উঠছি।” বলে, লম্বা-লম্বা পা ফেলে, সামনের জমিটুকু পেরিয়ে বারান্দায় উঠে তিনি ড্রয়িং রুমের দিকে চলে গেলেন।

উপরে এলেন মিনিট পাঁচেক বাদে। এসে বললেন, “যোগীশ্বরের কাণ্ড দেখুন, বলেছিল ন’টা নাগাদ ফোন করবে, অথচ ন’টা বাজতে এখনও পাঁচ মিনিট বাকি। জনার্দনের কাছে শুনলুম, সাড়ে আটটাতেও একবার ফোন করেছিল।”

বললুম, “কী বললেন?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কী আর বলবে, যা ভেবেছিলুম তা-ই বলল। এ তো আমি জানতুমই।”

“কী জানতেন?”

“জানতুম যে, আঙুলের কোনও ছাপই ওরা পাবে না। পায়ওনি।”

“তার মানে কি এই যে, হাতে রবারের দস্তানা পরে চোর ও-ঘরে ঢুকেছিল?

“তা তো পরতেই পারে। কিন্তু চোর এসেছিল এই খবর পেয়ে মিশ্রজি যখন লাইব্রেরি-ঘরে ঢোকেন, তখন তিনি তো আর রবারের দস্তানা পরে ঢোকেননি। তাঁর আঙুলের ছাপই বা তা হলে পাওয়া গেল না কেন?”

বললুম, “তাও তো বটে! কেন পাওয়া গেল না?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেটা বোঝা তো খুব শক্ত নয়, কিরণবাবু। কলকাতা থেকে আমরা এখানে এসে পৌঁছবার আগেই কেউ নিশ্চয় লাইব্রেরি-ঘরে ঢুকে একটা শুকনো কাপড় দিয়ে তাবৎ ফিংগার-প্রিন্ট মুছে সাফ করে দিয়েছে।”

গাড়ি ঢোকার শব্দ পেয়ে বুঝলুম, রঘুনন্দনরা ফিরেছে। ডিনারের ঘণ্টাও একেবারে সঙ্গে-সঙ্গেই বেজে উঠল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “থাক, এখন আর ও-সব কথা নয়।”

রঘুনন্দন আর রাধিকা উপরে উঠে এল। রঘুনন্দন বলল, “হাতমুখ ধুয়ে পোশাক পালটেই আমরা নীচে নামছি। খেতে বসে কথা হবে।”

কথা শেষ করে রঘুনন্দন তার ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল। কিন্তু দু’পা গিয়েই পিছন ফিরে বলল, “ও হ্যাঁ, একটা কথা আপনাদের জানানো হয়নি। মিউজিয়াম থেকে আপনারা চলে আসার পরে ডঃ চতুর্বেদীকে ফোন করেছিলুম।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেন? মিশ্রজির সম্পর্কে লেটেস্ট খবর জানার জন্যে?”

“হ্যাঁ। তো তিনি বললেন যে, কাল সকালেই দাদুকে আমরা বাড়িতে নিয়ে আসতে পারি। তা-ই নিয়ে আসব।”

মুখে-চোখে জল ছিটিয়ে পোশাক পালটে মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যেই নীচে নেমে আমরা ডাইনিং হলে গিয়ে ঢুকলুম। সকলেরই আজ বেশ ধকল গেছে। সম্ভবত সেইজন্যেই খেতে-খেতে আজ আর বিশেষ কথা হল না। তবে এই কথাটা জানা গেল যে, কথা বলতে না-পারলেও মিশ্রজির হাত-পায়ের সাড় প্রায় পুরোপুরিই ফিরে এসেছে। ক্যাবিনে ট্রান্সফার করার পরে নার্স তাঁর হাতে একটা পেনসিল ধরিয়ে দিয়েছিল। সেই পেনসিল দিয়ে মিশ্রজি একটুকরো কাগজে নাকি কাঁপা-কাঁপা হাতে এটাও লিখতে পেরেছেন যে, তিনি এখন বাড়ি ফিরতে চান। শুনে, ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ তো দারুণ খবর।”

ডিনার চুকে যাবার পরে উপরে এসে সদানন্দবাবু বললেন যে, তাঁর বড্ড ঘুম পেয়েছে। “আমি তো আর দাঁড়াতে পারচি না, মশাই।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশ তো, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।”

সদানন্দবাবু ঘরে ঢুকে যাবার পরে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনারও ঘুম পেয়েছে নাকি?”

বললুম, “না। এত তাড়াতাড়ি কি ঘুমোনো যায়?”

“বেশ, তা হলে আমার ঘরে আসুন।

দুজনে গিয়ে ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে ঢুকলুম। দুটো-চারটে মামুলি কথার পরে ভাদুড়িমশাই বললেন, “শুনুন, আপাতত আপনি ও-ঘরেই ফিরে যাবেন বটে, কিন্তু খানিক বাদে…এই ধরুন রাত একটা নাগাদ আপনাকে ফের আমার ঘরে ফিরে আসতে হবে।”

“কেন?”

“অত কথা এখন বলতে পারব না,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “শুধু একটা ব্যাপার খেয়াল রাখবেন, সদানন্দবাবু যেন কিছু টের না পান। দরজাটা একেবারে নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিয়ে আসবেন।”