১৩
বাড়ি থেকে বেরোবার সময় রঘুনন্দন বলে গেছে যে, তারা নার্সিং হোম থেকে মিউজিয়ামে যাবে। যেহেতু একটা বিদেশি ডেলিগেশনের সদস্যদের নিয়ে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আজ তিনটে নাগাদ সেখানে আসবেন, তাই ছুটির দিন হলেও মিউজিয়াম আজ খোলা রাখতে হয়েছে, রাধিকা আর রঘুনন্দন এ-বেলাতেই সেখানে গিয়ে সবকিছু সাফসুতরো করে রাখতে চায়। দুপুরবেলায় তারা বাড়িতে খেতে আসবে ঠিকই, কিন্তু বারোটার আগে আসতে পারবে বলে মনে হয় না।
এদিকে ঘড়িতে এখন এগারোটা বাজে। ফিংগারপ্রিন্ট তোলার কাজ শেষ করে যোগীশ্বর সহায় তাঁর সঙ্গীকে নিয়ে এইমাত্র এলাহাবাদ রওনা হয়ে গেলেন। তার মানে ঘণ্টাখানেক এখন একেবারে নিশ্চিন্ত অবসর। ভাবছিলুম যে, দোতলায় উঠে এবারে একটু বিশ্রাম নেওয়া যাবে।
কিন্তু সেটা আর হল না। যোগীশ্বরকে সবে বিদায় জানিয়ে একতলার বারান্দায় ফিরে এসে সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি, পিছন থেকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কোথায় যাচ্ছেন?”
বললুম, “কেন, দোতলায়।”
সদানন্দবাবু বললেন, “দুপুরের খাওয়া তো সেই একটায়। ততক্ষণ নিজেদের ঘরে গিয়ে…”
“একটু গড়িয়ে নিলে মন্দ হত না, কেমন?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এতই যদি গড়াবার ইচ্ছে তো আমার সঙ্গে এলেন কেন, কলকাতায় থাকলেই তো পারতেন।”
কথাটার মধ্যে যে বেশ-একটু ঝাঁজ রয়েছে, সেটা বুঝে গিয়ে একটু থতমত খেয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “কেন, কোথাও যেতে হবে নাকি?”
“তা যেতে হবে, তবে দূরে নয়, কাছেই।” আমাদের নিয়ে বাড়ির গেট পেরিয়ে রাস্তায় পড়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা এসটিডি করা দরকার।”
বললুম, “কোথায়?”
“নৈনিতালে।”
সেটা তো বাড়ির ফোন থেকেই করা যেত।”
“তা করা যেত, কিন্তু করা উচিত হত না।”
“কেন?”
“যাঁকে ফোন করছি, তাঁর পেশা আর পদবিটাই শুধু জানি, নাম জানি না। তাই পদবি দেখে আর তার সঙ্গে পেশা মিলিয়ে পরপর কয়েকটা ফোন করতে হবে, তার মধ্যে যেটা মিলে যায়। অন্যের ফোন থেকে এতগুলো কল করা কি উচিত হত?”
“তার মানে কোনও দোকান থেকে ফোন করবেন, কেমন? কিন্তু আজ তো রবিবার, তেমন কোনও দোকান কি খোলা পাওয়া যাবে?”
সদানন্দবাবু বললেন, “ওই তো এসটিডি-আইএসডির প্ল্যাকার্ড ঝোলানো একটা দোকান খোলা রয়েচে।”
কথা বলতে-বলতে আমরা বড়রাস্তায় পৌঁছে গিয়েছিলুম। সেখানে মোড়ের মাথায় সত্যিই দোকানটা খেলা পাওয়া গেল। ফোটো তোলার স্টুডিয়ো, তবে দেশে-বিদেশে ফোনও এখান থেকে করা যায়। দোকানে ঢুকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমরা নৈনিতালে আমাদের এক বন্ধুকে একটা ফোন করব। তবে যাঁকে ফোন করব, তাঁর নম্বর জানি না। নৈনিতালের ফোন গাইড পেলে অবশ্য নম্বরটা খুঁজে নিতে পারি।”
দোকানের মালিক নেহাতই ছেলেমানুষ। বয়েস মনে হল বিশ-পঁচিশের বেশি হবে না। ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে হেসে বলল, “নৈনিতালের ফোন-গাইড তো আমার কাছে নেই। তবে আপনাদের ফোন করাটা যদি খুব জরুরি হয় তো একটা কাজ করতে পারি।”
“কী করবেন?”
“নৈনিতালে আমার দাদা থাকে, তার কাছে একটা লোক্যাল ফোন-গাইড নিশ্চয় থাকবে। তাকে ফোন করে যদি আপনাদের বন্ধুর নাম বলি তো তাঁর নম্বরটা সে নিশ্চয় গাইড দেখে বলে দিতে পারবে।’
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাঃ, তা হলে তো ভালই হয়। আপনি আপনার দাদাকে ফোন করুন।” ছেলেটির বয়েস যতই কম হোক, ব্যাবসাবুদ্ধি টনটনে। বলল, “এর চার্জটাও কিন্তু আপনাদেরই দিতে হবে। মানে আমি তো আমার দরকারে ফোন করছি না, আপনাদের দরকারেই করছি।”
“তা তো বটেই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “দরকার যখন আমাদের, তখন এটার চার্জও আমরাই দিয়ে দেব।…নিন, আপনি ফোন করুন তো, আমাদের বন্ধুর নাম ডঃ ত্রিপাঠী।”
ডায়াল ঘুরিয়ে লাইন পেতে দেরি হল না। রিসিভারে মুখ রেখে ছেলেটি বলল :
“কে, ভাবি? আমি মির্জাপুর থেকে মন্নু ফোন করছি। বড়ভাইয়া বাড়িতে নেই?…না না, আম্মি ভাল আছে, জ্বর সেরে গেছে, তাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।… হ্যাঁ হ্যাঁ, আম্মিকে নিয়ে সামনের মাসের গোড়াতেই তোমাদের ওখানে যাব।…এখন একটা কাজ করো তো, তোমাদের ফোন-গাইড দেখে নৈনিতালের এক ভদ্রলোকের ফোন-নাম্বারটা আমাকে জানিয়ে দাও।…ভদ্রলোকের নাম ডাক্তার ত্রিপাঠী।…হ্যাঁ, ত্রিপাঠী।…নাও, একটু তাড়াতাড়ি করো, খুব জরুরি দরকার।”
মিনিট দুয়েক চুপ করে রইল মন্নু। তারপর বলল :
“কী বললে?…গাইডে দুজন ডাক্তার ত্রিপাঠীর নাম পাচ্ছ?…..ঠিক আছে, দুজনের নম্বরই আমাকে দাও।…দাঁড়াও, আমি লিখে নিচ্ছি।…ঠিক আছে, সামনের মাসের গোড়াতেই যাব।” সামনের বোর্ডের উপরে চার্জের অঙ্কটা টকাটক বদলে যাচ্ছিল। ক্রেডলের উপরে রিসিভার নামিয়ে মন্নু সেটার সুইচ অফ করে বলল, “এটা এখুনি দেবার দরকার নেই। আপনাদের কলটা করে নিয়ে একসঙ্গে দেবেন। এই নিন আপনাদের ফোন নম্বর।”
মন্নু যে স্লিপটা ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিল, তাতে দু-দুটো ফোন-নম্বর লেখা। একটা ডঃ সুরেশ্বর ত্রিপাঠীর, অন্যটা ডঃ শিউমঙ্গল ত্রিপাঠীর। ভাদুড়িমশাই রিসিভার হাতে নিয়ে প্রথমে ডঃ সুরেশ্বর ত্রিপাঠীর নম্বর ডায়াল করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে পেয়েও গেলেন লাইন। কিন্তু না, ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বুঝে গেলুম যে, এঁকে তিনি চাননি। রিসিভার নামিয়ে রাখতে বোর্ডে ফুটে ওঠা অঙ্ক দেখে মন্নু বলল, “ফিফটিসেভেন প্লাস ইলেভেন। টোটাল সিক্সটিএইট রুপিজ।”
পরের নম্বর ডঃ শিউমঙ্গল ত্রিপাঠীর। এবারে অবশ্য চটপট শেষ না হয়ে অনেকক্ষণ ধরে কথা চলল। তাতেই মনে হয়, এঁকেই ভাদুড়িমশাই চাইছিলেন। আমরা অবশ্য নেহাতই একতরফা কথা শুনতে পাচ্ছিলুম। যা শুনলুম, তার সংক্ষিপ্তসার এইরকম :
“আমাকে আপনি চিনবেন না, আমি মির্জাপুরের প্রোফেসর শ্যামনন্দন মিশ্রের বাড়ি থেকে কথা বলছি।… কী বললেন, তাঁকে লাইন দেব?… কিন্তু তিনি তো এখন এখানে নেই, অসুস্থ হয়ে নার্সিং হোমে রয়েছেন।… হ্যাঁ, তাঁর নাতির কথা জানতে চান।… রাইট, ওই নামই তো বললেন।… অ্যা, ইউ কুড়ন’ট কেয়ার লেস?… কোথায় আছে, তাও জানেন না?…আই সি… তো ঠিক আছে, এটাই তাঁকে জানিয়ে দেব। নমস্তে।”
ভাদুড়িমশাই রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। তাঁর মুখে দেখলুম অদ্ভুত এক টুকরো হাসি ফুটে উঠেছে। মন্নু বলল, “সিক্সটিএইট প্লাস সেভেন্টিটু। টোটাল ওয়ান হানড্রেড ফর্টি রুপিজ।”
ব্যাগ থেকে দেড়শো টাকা বার করে দিলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর ব্যালান্স দশ টাকা ফেরত নিয়ে বললেন : “চলুন, বাড়ি ফেরা যাক।”
রাস্তায় নেমে সদানন্দবাবু একবার পিছন দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, “অতি খলিফা ছেলে!”
বললুম, “কার কথা বলছেন?”
“কেন, মন্নুর।” সদানন্দবাবু বললেন, “নৈনিতালে ও-ব্যাটার নিজেরই ফোন করার দরকার ছিল, অথচ পুরো খর্চাটা চাপিয়ে দিল আমাদের ঘাড়ে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা দিক, শিউমঙ্গল ত্রিপাঠীর ফোন-নাম্বারটা যে আনিয়ে দিয়েছে, এই যথেষ্ট। নইলে তো মশাই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে যোগাযোগই করা যেত না।”
“কিন্তু এই ডঃ ত্রিপাঠী লোকটি কে?”
“আপনাদের নিয়ে এই হয়েছে মুশকিল।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সবই আপনাদের বলেছি, অথচ কিছুই আপনাদের মনে নেই!… যাক গে, আজ বিকেলে বিন্ধ্যেশ্বরীর মন্দিরে যাবেন নাকি?”
শেষ কথাটা সদানন্দবাবুর উদ্দেশে বলা। বিন্ধ্যেশ্বরীর মন্দিরে যাওয়া আর প্রয়াগে গিয়ে একটা ডুব দেওয়ার জন্যে তিনি যে বড়ই উতলা হয়ে পড়েছেন, কাল রাত্তিরেই ভাদুড়িমশাইকে আমি তা জানিয়ে রেখেছিলুম। কিন্তু সদানন্দবাবুর যা বৈশিষ্ট্য, যখনই তিনি বুঝতে পারেন যে, তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হতে চলেছে, ঠিক তখনই তাঁর কর্তব্যবুদ্ধি হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ভাদুড়িমশাইয়ের কথা শুনে তিনি একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠলেন। “আরে না না, এখুনি ও-সব মন্দির-টন্দির কেন! কাজটাই হচ্চে আসল কতা। হাতের কাজ আগে শেষ করুন, তারপর ও-সব হবে। মন্দির তো আর পালিয়ে যাচ্চে না।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাজ তো প্রায় শেষ। একটা ধাঁধা ছিল অবিশ্যি, তবে নৈনিতালে ফোন করে যা শুনলুম, তাতে সেটাও মিটে গেছে।”
“তা-ই?”
“হ্যাঁ। নিন, বারোটা বাজতে চলল, রঘুনন্দন হয়তো এখুনি এসে পড়বে।”