১২
আজ ৭ এপ্রিল, রবিবার। কাল রাত্তিরে খাওয়া শেষ হতে-হতে প্রায় দশটা বেজে যায়। খাবার টেবিলে খুব-একটা কথাবার্তা হয়নি। যোগীশ্বর সহায় যে কেন আসছেন, রাধিকার সেটা জানা ছিল না। রঘুনন্দন তাকে বুঝিয়ে বলে যে, মিশ্রজির লাইব্রেরি-ঘরে তো চোর ঢুকেছিল, সেখানে চোরের আঙুলের ছাপ থেকে যাওয়া কিছু অসম্ভব নয়। সত্যিই আছে কি না সেটা পরীক্ষা করে দেখবার জন্যেই পুলিশ সুপারকে আসতে বলা হয়েছে। তিনি একজন এক্সপার্টকে সঙ্গে নিয়ে আসবেন। শুনে, রাধিকা বলে, কীভাবে আঙুলের ছাপ তোলা হয়, সেটা দেখবার জন্যে কাল সে নার্সিং হোমে না-গিয়ে বাড়িতেই থাকতে চায়। তাতে রঘুনন্দন বলে যে, সেটা ঠিক হবে না, দাদুকেই তার দেখতে যাওয়া উচিত। ভাদুড়িমশাইও বলেন যে, সেটাই ঠিক হবে। “আর যদি পুলিশ সুপারকে চা-টা দিয়ে আপ্যায়ন কে করবে এইটে ভেবে আপনি বাড়িতে থাকতে চান, তো বলি, তারও কোনও দরকার হচ্ছে না, যোগীশ্বর আমার চেনা লোক, তার দেখভাল আমিই করতে পারব। আর তা ছাড়া জনার্দন, লছমন এরা তো সব রইলই, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে মিশ্রজিকে দেখে আসুন।”
পুলিশ সুপারের প্রসঙ্গ শেষ হবার পরে চুপচাপ সবাই খেয়ে যাচ্ছিলেন, তার মধ্যে সদানন্দবাবু একবার বলে বসেন যে, রাত্তিরে তিনি সাধারণত রুটিই খান, তবে কিনা এ-বেলায় যে এত চমৎকার মাছের আইটেম হবে, এটা জানলে তিনি আজ রুটি না খেয়ে ভাতই খেতেন। “আরে মশাই, রুটির সঙ্গে মাছ খেয়ে ঠিক জুত হয় না, তার জন্যে ভাত চাই।”
কাল রাত্তিরে ডিনার-টেবিলে এ ছাড়া আর কোনও কথা হয়নি। ভাদুড়িমশাই ওই যা প্রথম দিকে এক-আধটা কথা বলেছিলেন। তারপরেই তিনি চুপ করে যান। তাঁর মুখ দেখে আমার মনে হচ্ছিল যে, তিনি একটু চিন্তিত।
কী নিয়ে চিন্তিত, সেটা বুঝতে না-পারায় আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ভেবেছিলুম, খাওয়া শেষ হবার পরে তো দোতলায় যাচ্ছি, আর দোতলায় গিয়েই নিশ্চয় ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ব না, ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমাদের ঘরেই হোক আর ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরেই হোক খানিকক্ষণ গল্পগুজব হবেই, তখন এই নিয়ে জিজ্ঞেস করা যাবে। ভাদুড়িমশাই কিন্তু দোতলায় উঠে না-এলেন আমাদের ঘরে, না তাঁর ঘরে আমাদের যেতে বললেন। আমি মুখ খুলবার আগেই বললেন, “রাত না-জেগে এবারে শুয়ে পড়ুন দেখি।” তারপর একটু থেমে তাঁর নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন।
ভাদুড়িমশাইয়ের চিন্তা যে ঠিক কী নিয়ে, সেটা অতএব জানা গেল না। তবে এটা বোঝা গেল যে, আপাতত তিনি কথা বলার মুডে নেই, সম্ভবত আমাদের একটু এড়িয়েও চলতে চাইছেন। ঘরে ঢুকে সদানন্দবাবু বললেন, “দূর মশাই, কবে যে বিন্ধ্যেশ্বরীর মন্দিরে যাব আর প্রয়াগে অ্যাট অল চান করা হবে কি না, কিছুই তো বোজবার জো নেই! এমনকী, এখানকার মিউজিয়ামে গিয়ে সেই কুড়ুলটা অব্দি দেকলুম না! এ তো দেখচি মোস্ট আনইন্টারেস্টিং জার্নি হয়ে গেল! শুধুই তো খাচ্চি আর ঘুমুচ্চি! কোনও মানে হয়?”
বলে আর কথা বাড়ালেন না, পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন।
আমিও নিশ্চয় তার একটু বাদেই ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। এটা এইজন্যে বলতে পারছি যে, সদানন্দবাবুর মৃদুমন্দ নাসিক-গর্জন যে কাল রাতে খুব বেশিক্ষণ আমাকে শুনতে হয়নি, এটা মনে আছে।
আজ সকালে ঘুম ভেঙেছে যথারীতি সেই ঘণ্টার শব্দ শুনেই। তার মিনিট খানেকের মধ্যেই জনার্দন যথারীতি চা দিয়ে যায়। ঘুম ভাঙবার পরে আজও পাশের বিছানায় সদানন্দবাবুকে দেখতে পাইনি। তাতে বুঝতে পারি যে, আজও যথারীতি তিনি মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়ে পড়েছেন।
মুখেচোখে জল ছিটিয়ে চা খেয়ে, দাড়ি কামিয়ে, স্নান সেরে ফের বিছানায় টান হই। থ্রিলারটার বেশ কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে ফেলি। তারপর পোশাক পালটে যখন নীচে নামি, ঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। ভাদুড়িমশাই আর সদানন্দবাবু সেই গার্ডেন-বেঞ্চিতে বসেই কথা বলছিলেন। আমাকে দেখে সদানন্দবাবু বললেন, “কী, ঘুম ভাঙল?” বললুম যে, ঘুম সেই ছ’টাতেই ভেঙেছে, “এরা ঘণ্টা বাজিয়ে ঘুম ভাঙায়, তারপরে তো আর শুয়ে থাকা চলে না।…আপনাদের চা খাওয়া হয়েছে?” শুনে, সদানন্দবাবু একগাল হেসে বললেন, “পাঁচটায় বেরিয়ে পড়েছিলুম, ছ’টায় ফিরে এসে চা খেয়েচি। দাড়ি কামানো, চান, কোনওটাই বাকি নেই।”
সাড়ে আটটার ঘণ্টাও বাজল ঠিক সময়েই। তার মিনিট খানেকের মধ্যেই রঘুনন্দন ও রাধিকা দোতলা থেকে নীচে নামল। আমরা বাগানে বসে গল্প করছি দেখে রাধিকা বলল, “আপনারা বসে আছেন যে? ব্রেকফাস্ট করবেন না?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনারা তো নার্সিং হোমে যাবেন, তা হলে খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন।”
“আর আপনারা?”
“আমাদের তো কোনও তাড়া নেই। ফিংগারপ্রিন্ট তোলার লোকটিকে সঙ্গে নিয়ে যোগীশ্বর আশা করি ন’টা নাগাদ এসে যাবে। সে এসে কাজে লাগুক, তখন খেয়ে নিলেই হবে।”
“এক কাজ করলে হয়,” রাধিকার পিছন থেকে রঘুনন্দন বলল, “ওঁদেরও আপনাদের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করে নিতে বলুন।”
“ঠিক আছে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বলব অখন। কিন্তু ওরা কি আর না-খেয়ে বাড়ি থেকে বেরুবে?…ও হ্যাঁ, লাইব্রেরি-ঘরের চাবিটা তো চাই। ওটা দিয়ে যান।”
“ওটা জনার্দনের কাছে আছে, ওর কাছ থেকে চেয়ে নেবেন।”
ব্রেকফাস্ট করে গাড়িতে উঠে রঘুনন্দন আর রাধিকা যখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, ন’টা বাজতে তখন আর মিনিট পাঁচেক বাকি।
যোগীশ্বর সহায় তাঁর ফিংগারপ্রিন্ট-এক্সপার্টকে নিয়ে সওয়া ন’টার মধ্যেই এসে গেলেন। গাড়ি এসে বাড়ির হাতায় ঢুকতেই বেঞ্চি থেকে উঠে গাড়ির কাছে গিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আরে এসো এসো, যোগী। তা এই লজঝর অ্যাম্বাসাডরে করে এসেছ কেন? তোমাদের লাল-বাতি লাগানো জিপ কোথায়? তা ছাড়া, হাতে ব্যাটন নেই, পরনে উর্দি নেই, ব্যাপার কী হে?”
“চালাকি করবেন না, ভাদুড়ি-আঙ্কল!” যোগীশ্বর সহায় হেসে বললেন, “আপনি খুব ভালই জানেন যে, একটা বেআইনি কাজ করতে হলে যে-ভাবে আসা উচিত, আমি ঠিক সেইভাবেই এসেছি। আর তাই নো জিপ নো ইউনিফর্ম। চুপচাপ কাজটা সেরে চলে যাব। মির্জাপুর পুলিশ যদি টের পায় যে, আমি তাদের এলাকায় এসে নাক গলিয়েছি তো মুশকিল হবে।”
সঙ্গের ভদ্রলোকটি মিটিমিটি হাসছিলেন। তাঁর দিকে আঙুল তুলে যোগীশ্বর বললেন, “ইনি রমেশ ভার্মা। আঙুলের ছাপের ব্যাপারে যা-কিছু করা দরকার, ইনিই করবেন। তা লাইব্রেরি-ঘরে চোর ঢুকেছিল বলছিলেন না? ঘরটা দেখিয়ে দিন।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তার আগে তোমরা আমাদের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করে নেবে না? আমরা তো তোমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম।”
“যাচ্চলে,” যোগীশ্বর বললেন, “আমরা দুজনেই তো নাস্তা করে বেরিয়েছি। বাট থ্যাঙ্ক ইউ অল দ্য সেম।”
“ঠিক আছে,” জনার্দনের কাছ থেকে চাবি নিয়ে লাইব্রেরি-ঘর খুলে দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে তোমরা কাজে লেগে যাও। সেই ফাঁকে চটপট আমরা ব্রেকফাস্ট করে নিই।”
যোগীশ্বর হেসে বললেন, “কাজ যা করার সেটা রমেশই করবে, আমার কিছু করার নেই। আমি ওকে জাস্ট এখানে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।”
“বেশ তো, তা হলে মিঃ ভার্মা যা করার করুন, ততক্ষণ বরং তুমি আমাদের একটু সঙ্গ দাও।” সঙ্গে করে ডাইনিং হলে নিয়ে এলুম বটে, কিন্তু স্রেফ এক পেয়ালা চা ছাড়া যোগীশ্বর সহায় সত্যিই কিছু খেলেন না। আমরাও তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট শেষ করলুম। তারপর সবাই এসে ড্রয়িং রুমে বসা গেল।
যোগীশ্বর সহায়ের বয়স মনে হল চল্লিশের বেশি হবে না। এক-আধ বছর কমও হতে পারে। হাসিখুশি মানুষ, চোখ দুটি ঝকঝকে, যখন হাসেন তখন হাসিটা শুধুই ঠোটের মধ্যেই আটকে থাকে না, চোখেও ছড়িয়ে যায়। দোহারা চেহারা, চলাফেরায় একটা ছটফটে ভাব রয়েছে।
পারস্পরিক কুশল-বিনিময় আর দু-চারটে মামুলি কথাবার্তার পরে ভাদুড়িমশাই বললেন, “যোগী, গত বছর যে তুমি একবার এ-বাড়িতে এসেছিলে, সে তো তুমি নিজেই কাল আমাকে জানিয়েছ। এখন তা-ই নিয়ে কি তোমাকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”
“অবশ্যই পারেন,” যোগীশ্বর বললেন, “কিন্তু কোনও গোলমেলে প্রশ্ন করা চলবে না।”
“যদি জিজ্ঞেস করি যে, এ-বাড়িতে তোমাকে আসতে হয়েছিল কেন, তা হলে কি সেটাও তোমার কাছে খুব গোলমেলে প্রশ্ন বলে মনে হবে?”
“তা হবে না ঠিকই,” যোগীশ্বর বললেন, “কিন্তু যদি বলি যে, আমাদের…আই মিন আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের অ্যানুয়াল সোশ্যাল গ্যাদারিংয়ে প্রধান অতিথি হবার জন্যে ওঁকে রিকোয়েস্ট করতে এসেছিলাম, তা হলে কি আপনি সে-কথা বিশ্বাস করবেন?”
“না, তা করব না।”
“কেন করবেন না?’
“করব না, তার কারণ, তুমি যে কেন এসেছিলে, তা আমি জানি।
যোগীশ্বর সহায়ের চোখেমুখে যে হাসিটা এতক্ষণ খেলা করছিল, একেবারে হঠাৎই সেটা মিলিয়ে গেল। ভুরু কুঁচকে বললেন, “কার কাছে জানলেন? মিশ্রজির কাছে?”
“তিনি কী করে জানাবেন? আমি এখানে এসে পৌঁছবার আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, কাউকে কিছু জানাবার মতো অবস্থাই তখন তাঁর ছিল না। এখনও নেই। সেরিব্রাল স্ট্রোক হয়েছে, নার্সিংহোমে আছেন, হি হ্যাজ লস্ট হিজ স্পিচ।”
“সেটা জানি, কাগজে খবরটা বেরিয়েছে।” যোগীশ্বর একটু চিন্তিত গলায় বললেন, “আমি এখানে কেন এসেছিলুম, সেটা তা হলে আপনাকে কে জানাল?”
“কে জানাল, দ্যাট’স নট ইম্পর্ট্যান্ট, কী জেনেছি সেটা শোনো।”
“বলুন।”
“ত্রিলোক সিং বলে একজন লোককে তোমরা অ্যারেস্ট করেছিলে। তার কাছে কিছু কাগজপত্তর ছিল, তার মধ্যে মিশ্রজির নামের উল্লেখ দেখে তোমাদের মনে হয় যে, তিনি হয়তো লোকটিকে চিনতে পারেন। কিন্তু মিশ্রজি তোমাকে জানান যে, ওই নামের কোনও লোককে তিনি চেনেন না। ঠিক বলছি?”
যোগীশ্বর সহায় তক্ষুনি কোনও উত্তর দিলেন না। একটুক্ষণ বাদে বললেন, “আপনার কথার জবাব দেবার আগে বরং আমিই একটা প্রশ্ন করি, কেমন?”
“গো অ্যাহেড।”
“মিশ্রজির সঙ্গে যখন আমার কথা হয়, এই বাড়িরই এক ভদ্রমহিলা তখন এখানে উপস্থিত ছিলেন। সম্ভবত এ-বাড়ির বউ। এ-সব কথা কি আপনি তাঁর কাছে শুনেছেন?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তোমার প্রশ্নের উত্তরে আমি হ্যাঁ-ও বলব না, না-ও বলব না। তবে যার কাছেই শুনে থাকি না কেন, শুধু ওইটুকুই যে শুনেছি, তা নয়।”
“আর কী শুনেছেন?”
“শুনেছি যে, ত্রিলোক সিংয়ের কাছে শুধু কিছু কাগজপত্তরই ছিল না, তার হাতে খুব দামি একটা আংটিও ছিল। আংটিতে মেকারের ছাপ দেখে তোমরা এলাহাবাদের এক গয়নার দোকানে হানা দিয়েছিলে। দোকানের এক বুড়ো কর্মচারী তোমাদের জানান যে, ওটা অর্ডারি মাল, বছর বিশেক আগে এক ভদ্রলোক ওটা তাদের দোকানে অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন। অর্ডার দেবার এগজ্যাক্ট বছরটাও তুমি জানতে পেরেছিল, তা নইলে নিশ্চয় আংটিটা দেখিয়ে মিশ্রজিকে তুমি জিজ্ঞেস করতে না যে, ১৯৭৫ সালে ওই দোকানে এই আংটির ফরমাশ তিনি দিয়েছিলেন কি না।… কী যোগী, আমি কি ভুল বলছি?”
এতক্ষণে আবার সেই হাসিটা ফিরে এল যোগীশ্বর সহায়ের চোখেমুখে। বললেন, “ভাদুড়ি-আঙ্কল, এই সহজ কথাটা আপনি বুঝতে চাইছেন না যে, যা আপনি জানতে চান, একজন পুলিশ-অফিসার হিসেবে তা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
শুনে, যেন ভারী অবাক হয়ে গেছেন, চোখেমুখে এইরকমের একটা ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলে ভাদুডিমশাই বললেন, “যাচ্চলে, তুমি কি একজন পুলিশ-অফিসার হিসেবে আজ এখানে এসেছ নাকি? ও-সব কেতা ছাড়ো তো! ইউ হ্যাভ কাম টু ইয়োর ভাদুড়ি-আঙ্কল টু হেলপ হিম আউট।”
“কিন্তু তার যে একটা অসুবিধে রয়েছে।”
“বুঝেছি,” আমাদের দিকে হাত তুলে ভাদুড়িমশাই বললেন, “এঁদের সামনে মুখ খুলতে চাইছ না। কিন্তু এঁরা দুজনেই আমার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আমাকে যা বলবে তা এঁদের সামনেই স্বচ্ছন্দে বলতে পারো। কাকপক্ষীও কিছু জানতে পারবে না।”
যোগীশ্বর সহায় তবু ইতস্তত করছেন দেখে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোমার অবশ্য আরও-একটা অসুবিধে থাকতে পারে। মিশ্রজিকে সম্ভবত তুমি কথা দিয়েছ যে, তাঁর যাতে কোনও ব্যাপারে কোনও অস্বস্তির কারণ না ঘটে, সেটা তুমি দেখবে।”
“তাও আপনি জেনে গেছেন?”
“জেনেছি বই কী। কিন্তু যোগী, একটা কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ। মিশ্রজিকে আমিও কিছু কম শ্রদ্ধা করি না। তিনি তো আমারই ক্লায়েন্ট, সুতরাং কোনওভাবেই তাঁর সম্মান যাতে ক্ষুণ্ণ না হয়, আমিও সেটা দেখব।”
“আংটির ব্যাপারে তিনি কী বলেছিলেন, তা আপনি জানেন?”
“জানি। বলেছিলেন যে, অমন কোনও আংটির অর্ডার তিনি কখনও দেননি।”
মৃদু হেসে যোগীশ্বর সহায় বললেন, “সেটা তিনি সত্যিকথা বলেননি।”
“তাও যে আমি বুঝতে পারিনি, তা নয়।”
“কী করে বুঝলেন?”
“এ তো খুবই সহজ কথা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোমাকে আমি চিনি। অর্ডারটা যে বছর-কুড়ি আগে দেওয়া হয়েছিল, দোকানের এক বুড়ো কর্মচারীর মুখে শুধু এইটুকু জেনেই হাত গুটিয়ে বসে থাকার পাত্র তুমি নও। নিশ্চয় সেই সময়কার কয়েক বছরের অর্ডারের খাতা সিজ করে তুমি তন্ন-তন্ন করে সব দেখেছিলে। দেখে জেনে গিয়েছিলে যে, ওটা ১৯৭৫ সালের অর্ডার। শুধু তা-ই নয়, অর্ডার-বুকে তারিখ আর যিনি অর্ডার দিচ্ছেন, তাঁর সইটাও ছিল নিশ্চয়।”
“ছিল। আমার ব্যাগ থেকে অর্ডার-বুকটা বার করে তাঁকে দেখাতেও যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই কী হল জানেন?”
“জানি না, কিন্তু আন্দাজ করে নিতে পারি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোমাদের কথাবার্তার সময় যে ভদ্রমহিলাটি সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তুমি তোমার ব্যাগ থেকে অর্ডার-বুক বার করতেই মিশ্রজি তোমার জন্যে চা নিয়ে আসবার অছিলায় ঘর থেকে তাঁকে সরিয়ে দিলেন আর তোমার কাছে কবুল করলেন যে, প্রথমে যদিও অস্বীকার করেছিলেন, ওই আংটির অর্ডার তিনিই দিয়েছিলেন বটে।”
“স্বীকার না-করে তাঁর উপায় ছিল না।” যোগীশ্বর সহায় বললেন, “অর্ডার-বুকটা বার করতেই মিশ্রজি বুঝে গিয়েছিলেন যে, প্রমাণ হাতে না-নিয়ে আমি তাঁর কাছে যাইনি।…ভাদুড়ি-আঙ্কল, একজন মানী লোক যখন খুব লজ্জায় পড়ে যান, তখন তাঁর মুখের চেহারা যে নিমেষে কীরকম পালটে যায়, সেটা সেই আমি প্রথম দেখলুম।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন যোগীশ্বর। তারপর বললেন, “লজ্জা তো শুধু মিথ্যে কথার জন্যে নয়, মিথ্যেকথা বলে ধরা পড়ে যাওয়ার জন্যেও। লজ্জা তো শুধু আমার কাছে নয়, তাঁর নিজের কাছেও। কী বলব, মাথা নিচু করে তিনি বসে ছিলেন, লজ্জায় কোনও কথাই বলতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে বললেন যে, কথাটা যেন কেউ না জানতে পারে। আর হ্যাঁ, আমিও যেন ব্যাপারটা আর পার্স না করি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “পার্স করলে তাঁর অসুবিধে কীসের, সেটা জানতে চেয়েছিলে?”
যোগীশ্বর সহায় হেসে বললেন, “তা-ই কখনও জিজ্ঞেস করতে পারি? করা যায়? ভাদুড়ি-আঙ্কল, আমাদের সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন বলুন তো? পুলিশে কাজ করি বলে কি আমরা ইট-পাথরের মতো ইনসেনসিটিভ হয়ে গেছি? আমি তো বুঝেই গেলুম যে, এটা পার্স করলে হয়তো এমন অনেক কথা বেরিয়ে পড়বে, যাতে ওঁর মান-সম্মান বাঁচবে না। আর তা ছাড়া, ওপর-ওপর দেখতে গেলে ওটা তো একটা পেটি কেস ছাড়া আর কিছুই নয়, সো আই ড্রপড দ্য হোল ম্যাটার। তবে হ্যাঁ, চা-বিস্কিট খেয়ে অফিসে ফেরার আগে মিশ্রজিকে বলে এসেছিলুম যে, তিনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তাঁর অস্বস্তি হয় এমন কোনও-কিছু আমরা করব না।”
“আংটিটার কী হল?”
“যে-ভদ্রমহিলাকে মিশ্রজি ঘর থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি ফিরে আসার আগেই মিশ্ৰজি বলেন যে, যার কাছে পেয়েছি, আংটিটা যেন তাকেই আমি ফিরিয়ে দিই। তা-ই দিয়েছি।”
“পুলিশ-হেডকোয়ার্টার্সে ফিরে গিয়ে ত্রিলোক সিংকে আর কোনও জেরা করোনি?”
“কী জেরা করব?”
“প্রোফেসর মিশ্রের আংটি কী করে তার হাতে এল, তাও জিজ্ঞেস করোনি?”
“না, ওই যে বললুম, আই ড্রপড দ্য হোল ম্যাটার। স্রেফ ত্রিলোক সিংয়ের হাতে আংটিটা তুলে দিয়ে বললুম, ইমিডিয়েটলি সে যেন ইলাহাবাদ ছেড়ে চলে যায়, ফের যদি তাকে এই শহরে দেখি তো তার ছাল ছাড়িয়ে নেব। বাস, তারপর গত এক বছরে তাকে আমি ইলাহাবাদে দেখিনি। লোকটা যে কে, তাও আমি জানি না।”
“তার ফিংগারপ্রিন্ট তুলে রেখেছ?”
“নতুন করে আর তোলার দরকার হয়নি। লোকটা দাগি চোর, এর আগেও বার দুই-তিন ধরা পড়েছিল, আমাদের রেকর্ড-বইয়ে তার ফিংগারপ্রিন্ট তোলাই আছে।”
কথা শেষ করে ভাদুড়িমশাইকে যোগীশ্বর সহায় বললেন, “শুধু একটা অনুরোধ, ভাদুড়ি-আঙ্কল, এখানে আমি যা-কিছু বলেছি, সবই অফ দ্য রেকর্ড, কেউ জানতে না পারে।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কেউ জানবে না। এখন চলো, তোমাদের এক্সপার্টের কাজ কদ্দুর এগোল, দেখে আসা যাক।”
ড্রয়িং রুম থেকে বেরোতেই রমেশ ভার্মার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনিও তখন লাইব্রেরি-ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। যোগীশ্বর সহায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে, স্যার।”
“কোনও জায়গা বাদ দাওনি তো?”
“সব জায়গায় তো ছাপ পড়ে না স্যার, যেখানে যেখানে পড়তে পারে…মানে কাচ কিংবা গ্লসি সারফেসের জিনিসপত্র, তার কোনওটাই ছাড়িনি।”
“ঠিক আছে,” যোগীশ্বর বললেন, “তা হলে তোমার সরঞ্জামগুলো গুছিয়ে নাও।…আর হ্যাঁ, এই বাবদে খর্চা-টর্চা যা হল, তার বিল কিন্তু ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ো না, ওটা আমি দিয়ে দেব।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুমি কেন দেবে। কত পড়ল, আমাকে জানিয়ো, টাকাটা আমিই তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসব।… আর হ্যাঁ, ফিল্মে কী পাওয়া গেল না-গেল, সেটা কখন জানতে পারছি?”
“আজ তো রবিবার, ছুটির দিন,” যোগীশ্বর সহায় বললেন, “আমাদের পুলিশ-ডিপার্টমেন্টের ফোটো-ল্যাব আজ বন্ধ থাকবে। তবে আমার চেনা-জানা প্রাইভেট ল্যাবও তো বিস্তর রয়েছে, তারই কোনও-একটা থেকে ডেভেলাপ করিয়ে নেওয়া যাবে। রাত্তির এই ধরুন ন’টা নাগাদ আপনি বাড়িতে থাকবেন তো? তখনই আপনাকে ফোন করে জানিয়ে দেব।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ যোগী, আমি বাড়িতেই থাকব।”
কথা বলতে-বলতে আমরা বাইরে বেরিয়ে এসেছিলুম। যোগীশ্বর সহায় আর রমেশ ভার্মা তাঁদের গাড়িতে উঠে পড়লেন। ভিতরে এসে লাইব্রেরি-ঘরে ফের তালা লাগিয়ে চাবিটা জনার্দনের হাতে তুলে দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমাদের কাজ হয়ে গেছে।”