পাহাড়ি বিছে – ১১

১১

রঘুনন্দন আর রাধিকা একইসঙ্গে ফিরল। ফেরবার কথা ছিল ছ’টা নাগাদ। ফিরল কিন্তু সওয়া সাতটায়।

গাড়ির শব্দ পেয়েই দোতলা থেকে আমরা একতলায় নেমে এসেছিলুম। সবাই মিলে লাইব্রেরি রুমের পাশে এদের বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে বসা গেল। রাধিকা অবশ্য বসল না। বলল, “যাই, রাত্তিরের জন্যে রান্নাবান্নার কী ব্যবস্থা হচ্ছে একবার দেখে আসি।”

রঘুনন্দন বলল, “ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল। কিন্তু আপনাদের খবর কী? একে তো রাধা এখানে ছিল না, তার উপরে আমাকেও বারবার বেরোতে হচ্ছে, আপনাদের চা-টা পেতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নট ইন দ্য লিস্ট। আপনারা না থাকলে কী হয়, জনার্দন তো রয়েছে বারবার চা পেয়েছি, একটু আগে জলখাবারও দিয়ে গেল, অসুবিধে হবে কেন?…কিন্তু আপনার কী খবর? ডি. এম. কাল আসছেন?”

“সেই ডেলিগেশন নিয়েই আসবেন। ঘুরে-ঘুরে সব দেখবেনও। টেলিফোনে কথা বলেছিলুম। ঠাণ্ডা মেজাজের ভদ্রলোক বলেই তো মনে হল।”

“টাকাটা পাওয়া যাবে?”

“তা কী করে বলব,” রঘুনন্দন হাত উলটে হাসল। “সরকারের টাকা, ও-বস্তু হাতে না আসা পর্যন্ত কি কিছু বলা যায়? ডি. এম. অবশ্য টেলিফোনেই আশ্বাস দিলেন যে, তাঁর পক্ষে যতটা করা সম্ভব তিনি করবেন। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও গেয়ে রাখলেন যে, সরকারের খুব টানাটানি চলছে।”

“নার্সিং হোমে গিয়েছিলেন?”

“গিয়েছিলুম। ড. চতুর্বেদী আর ড. আমেদ, দুজনের সঙ্গেই কথা হল। ড. আমেদ তো বললেন, হিজ কন্ডিশন হ্যাজ বিন ইমপ্রুভিং স্টেডিলি। প্রেশার অলমোস্ট নর্মাল। কিন্তু দাদুকে উনি আরও দিন দুয়েক আইসিইউতে রাখবেন, তার আগে ক্যাবিনে পাঠাবেন না।”

“আইসিইউতে গিয়েছিলেন?”

“আমি যাইনি, রাধা গিয়েছিল। বলল যে, ওকে দেখেও হেসেছেন। কিছু বলারও চেষ্টা করেছিলেন। তবে জিভের আড়ষ্ট-ভাবটা তো রয়েছে, তাই কথা ঠিকমতো বোঝা যায়নি।”

“এখন কি সেখান থেকেই ফিরছেন?”

“না।” রঘুনন্দন বলল, “রাধার দু’-চারটে জিনিস কেনার ছিল। তাই একবার মার্কেটেও যেতে হয়েছিল। কেনাকাটা সেরে সেখান থেকেই ফিরছি।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সারাদিন ঘোরাঘুরি করেছেন, লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, একটু ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়ই?”

“তেমন কিছু না।” ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রঘুনন্দন বলল, “কেন, আপনার কোনও কথা ছিল?”

“তা ছিল। তবে সত্যি যদি ক্লান্ত বোধ করেন, তো উপরে গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে নিন। কথাটা পরে হলেও চলবে।”

“না না, আমি ঠিকই আছি। আপনি কী বলবেন বলুন।”

“বুধবার রাত্তিরে যে চুরির অ্যাটেম্‌৳ হয়েছিল, সেইটে নিয়ে ভাবছি। চোর তো এবারেও লাইব্রেরি-ঘরে ঢুকেছিল, তাই না?”

“হ্যাঁ। কিন্তু কিছু চুরি যায়নি।”

“তা না-ই যাক, কে এসে বারবার লাইব্রেরি-ঘরে ঢুকছে, সেটা তো জানা দরকার। তাই ভাবছিলুম যে, পুলিশকে এটা জানালে ভাল হত।”

“কিন্তু দাদু তো পুলিশে খবর দিতে চাননি।”

“চাননি, তার নানান রকম কারণ থাকতে পারে। একটা কারণ এই যে, পুলিশের কাজেকর্মে তাঁর বিশ্বাস নেই। সেটা যে আমারই খুব আছে, তাও নয়। তবে কিনা, একটা সাহায্য তো পুলিশের কাছে পাওয়া যেতেই পারে।”

“কী ধরনের সাহায্য?”

“বলছি। কিন্তু তার আগে আপনাকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করি। বুধবার রাত্তিরে যে এ-বাড়িতে চোর ঢুকেছিল, এটা প্রথম কে জানতে পারে?”

“জনার্দন। রাত্তিরে ও তো একতলায় থাকে। বেস্পতিবার ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে ও-ই প্ৰথম দেখতে পায় যে, লাইব্রেরি-ঘরের দরজা খোলা, তালাটা মেঝের উপর পড়ে রয়েছে। সঙ্গে-সঙ্গে ও দোতলায় উঠে এসে দাদুকে ব্যাপারটা জানায়। দাদুও তৎক্ষণাৎ নীচে নেমে যান।”

“আপনারা তখন কী করছিলেন?”

“আমরা মানে তো আমি আর রাধা। তা রাধা তো এখানে ছিলই না, দিন কয়েক আগেই সে লখনউয়ে চলে গিয়েছিল, আর আমার তখনও ঘুমই ভাঙেনি।” এক মুহূর্ত থেমে থেকে রঘুনন্দন বলল, “আসলে বেড-টি তো দেয় ছ’টার সময়, তার আগে কোনও দিনই আমার ঘুম ভাঙে না।”

“চোর এসেছিল, এই খবর তা হলে আপনি কখন পেলেন?”

“ওই ছ’টার সময়েই। ঘণ্টা বাজিয়ে বেড-টি নিয়ে এসে জনার্দন আমার ঘুম ভাঙায়। তারই কাছে শুনি যে, আগের রাত্তিরে চোর এসে ফের লাইব্রেরি-রুমে ঢুকেছিল।”

“জনার্দনের মুখে চোর আসার খবর পেয়ে আপনি কী করলেন? কিছু চুরি হয়েছে কি না, দেখবার জন্যে একতলায় নেমে লাইব্রেরি-রুমে গেলেন নিশ্চয়? নাকি তক্ষুনি যাননি?”

“না। নীচে নামতে যাচ্ছিলুম ঠিকই, কিন্তু তার আগেই…মানে আমার ঘর থেকে দোতলার বারান্দায় বেরোতেই দাদুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। তিনি বললেন, ভাল করে সব দেখে এসেছেন, কিন্তু না, লাইব্রেরি-ঘর থেকে এবারেও কিছু খোয়া যায়নি। লাইব্রেরি-ঘরে যে নতুন একটা তালা লাগিয়ে এসেছেন, তাও বললেন।”

“তাঁর সঙ্গে আপনার আর কোনও কথা হল?”

“হ্যাঁ,” রঘুনন্দন বলল, “আমি বলেছিলুম যে, এবারে অন্তত থানায় গিয়ে একটা ডায়েরি লিখিয়ে আসা দরকার। কিন্তু পুলিশকে কিছু জানাবার ব্যাপারে আগেও যেমন তিনি রাজি হননি, তেমন এবারেও হলেন না। বললেন, ‘পুলিশের দ্বারা কিছু হবার নয়, চা খেয়ে নিয়ে মি. ভাদুড়িকে ফোন করো, আমার নাম করে তাঁকে আসতে বলে দাও, আর দেরি করা ঠিক হবে না।’ কিন্তু এ-সব কথা তো বেস্পতিবার সকালে যখন আপনাকে ফোন করি, তখনই আপনাকে জানিয়েছিলুম।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি কেন পুলিশে খবর দেওয়ার পক্ষপাতী, একটু বাদেই তা বলছি। কিন্তু তার আগে আপনার কাছে আরও দু-একটা কথা জেনে নেওয়া দরকার।”

“বেশ তো, কী জানতে চান বলুন।”

“রোজ রাত্তিরেই কি লাইব্রেরি-ঘরে তালা দেওয়া থাকে?”

“হ্যাঁ, দাদু নিজেই লাইব্রেরিতে তালা লাগিয়ে তারপর দোতলায় ওঠেন।”

“সেদিনও নিজেই তালা লাগিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

“চোর তা হলে তালা ভেঙে লাইব্রেরিতে ঢুকেছিল, কেমন?”

“তা তো বটেই। তালা না-ভেঙে ঢুকবে কেমন করে? ভাঙা তালাটা মেঝের উপরে পড়ে ছিল। সেটা দেখেই তো জনার্দন দোতলায় এসে দাদুকে জানায়।”

“তা তো শুনেছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু আমার যেটা জানা দরকার, সেটা এই যে, তালাটা ভাঙা আর দরজা খোলা, এটা দেখে দোতলায় আসার আগে সে নিজে একবার লাইব্রেরি-ঘরে ঢুকেছিল কি না।”

“তা তো বলতে পারব না।…দাঁড়ান, জনার্দনকে ডেকে পাঠাচ্ছি।”

জনার্দন একতলার ডাইনিং হলে কাজ করছিল। খবর পাঠাতেই সে বৈঠকখানায় চলে এসে রঘুনন্দনকে বলল, “আমাকে ডাকছিলে?”

“আমি ডাকিনি,” রঘুনন্দন বলল, “মি. ভাদুড়ি তোমাকে কী জিজ্ঞেস করবেন।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আচ্ছা জনার্দন, লাইব্রেরি-ঘরে চোর ঢুকেছিল, গত বেস্পতিবার ঘুম থেকে উঠে এটা বুঝতে পেরেই কি তুমি দোতলায় গিয়ে মিশ্রজিকে খবর দিয়েছিল?”

“হ্যাঁ, মালিক।”

“তার আগে তুমি নিজে লাইব্রেরি-ঘরে ঢোকোনি?”

“নেহি, মালিক। বুড়াবাবুর অর্ডার আছে, তিনি না-ডাকলে কোই আদমি ওখানে ঢুকবে না।”

“ঝাঁটপাট দিতেও কখনও ঢোকো না?”

“সে তো রোজই ঢুকি। কিন্তু তিনি নিজে তখন ঘরে থাকেন।”

“কিন্তু তিনি নিজে তো রোজই দু’বার বাড়ি থেকে বেরিয়ে মিউজিয়ামে যেতেন। একবার নাস্তা খেয়ে, আর একবার দুপুরের খাওয়ার পরে। লাইব্রেরি তো তখন খোলা থাকত। সেই সময়ে কি কেউ ও-ঘরে ঢুকত না?”

“খোলা থাকত না, মালিক। বুড়াবাবু যখনই মকান থেকে বেরোতেন, লাইব্রেরিতে তালা লাগিয়ে যেতেন।”

“ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো, আর-কিছু জিজ্ঞেস করার নেই।”

জনার্দন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রঘুনন্দন বলল, “আর-কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন?”

“আপনাকেই আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেস্পতিবারও যে উনি ওঁর নিয়ম-মতো দু’-দু’বার মিউজিয়ামে গিয়েছিলেন, এটা আপনার কাছে কাল রাত্তিরেই শুনেছি। কথা হচ্ছে জনার্দনের মুখে সেদিন চোর ঢোকার খবর পেয়ে ভোরবেলায় ওই যে উনি একবার লাইব্রেরি-ঘরে গিয়েছিলেন, তার পরে আর ও-ঘরে তিনি কিংবা আর-কেউ গিয়েছিলেন কি না।”

“না। ঘরের অবস্থা দেখে নিয়ে ওই যে তিনি ঘরটায় ফের নতুন একটা তালা লাগিয়ে দোতলায় উঠে আসেন, তারপর আর সেদিন তিনি ও-ঘরে ঢোকেননি। আর তিনি নিজে ডেকে না-পাঠালে আর-কারও তো ও-ঘরে যাবার কথাই ওঠে না। পরশু…মানে বেস্পতিবার ভোরবেলা থেকেই ঘরটা তাই তালাবন্ধ হয়ে রয়েছে।”

“সেটা ভালই হয়েছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “পুলিশকে দিয়ে যে-কাজটা আমি করিয়ে নিতে চাইছি, এতে তার সুবিধেই হবে।”

রঘুনন্দন বলল, “পুলিশকে কিছু জানানোর ব্যাপারে দাদুর কিন্তু আপত্তি ছিল। ইন ফ্যাক্‌ট, সেইজন্যেই তিনি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। দাদুর ইচ্ছে, এ-ব্যাপারে যা-কিছু করার তা আপনি করবেন।”

“তা জানি,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কিন্তু কাজটা যখন আমি করব, তখন ডিসিশানটাও তো আমাকেই নিতে হবে। তাতে যদি আপনার আপত্তি থাকে তো বলুন, কালই আমি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি।”

“না না,” রঘুনন্দন একেবারে মিইয়ে গিয়ে বলল, “সে-কথা হচ্ছে না। কিন্তু পুলিশকে দিয়ে আপনি কী করাতে চাইছেন, সেটা বলবেন তো?”

“নাও বলতে পারি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে এতই যখন আপনার আগ্রহ, তখন শুনে রাখুন, ইটস আ ভেরি সিম্পল থিং। ঘরটায় কোনও আঙুলের ছাপ পাওয়া যায় কি না, সেটা পরীক্ষা করিয়ে নিতে চাই। তা পুলিশ ছাড়া এ-কাজ কাকে দিয়ে করাব? আমিই করতে পারতুম, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি আমাকে চলে আসতে হল যে, ছাপ তোলার সরঞ্জাম আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারিনি। পুলিশের সাহায্য তাই পাওয়াই চাই।”

“বুঝেছি। কিন্তু এখানকার পুলিশ ডিপার্টমেন্টেই কি আর ও-সব সরঞ্জাম থাকবে?”

“না-থাকাই সম্ভব। কিন্তু এলাহাবাদে থাকবে।” পকেট থেকে একটা নোটবই বার করে তার গোটাকয়েক পাতা উলটে ভাদুড়িমশাই বললেন, “এই নম্বরটায় একবার যোগীশ্বর সহায়কে ডাকুন।”

“উনি তো এখন যদ্দুর জানি এলাহাবাদের পুলিশ সুপার।”

“হ্যাঁ, এটা ওর অফিসের টেলিফোন-নম্বর। অফিসে যদি না-পাওয়া যায়, তো ওর বাড়ির নম্বর নিয়ে সেখানে ডাকতে হবে। আমার নাম করে বলবেন যে, আমি ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছি।”

পাশেই টেলিফোন। নম্বরটা আর-একবার জেনে নিয়ে রিসিভার তুলে রঘুনন্দন ডায়াল ঘোরাতে লাগল।

যোগীশ্বর সহায় তাঁর অফিসেই ছিলেন। যোগাযোগ করতে তাই এক মিনিটও লাগল না। রিসিভারটাকে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে রঘুনন্দন বলল, “কথা বলুন।”

অতঃপর যে একতরফা কথা আমাদের কানে এল, সেটা এইরকম :

“যোগী, আমি বাঙ্গালোরের চারু ভাদুড়ি, মির্জাপুর থেকে কথা বলছি, একটু সাহায্য চাই।… হ্যাঁ হ্যাঁ, ভালই আছি। এখন কাজের কথাটা শোনো। শুধু মনে রেখো যে, যা বলছি, স্ট্রিক্‌টলি কনফিডেনশিয়াল, কাউকে বলা চলবে না।… আরে না, বেআইনি কিছু নয়। তুমি কি প্রোফেসর শ্যামনন্দন মিশ্রকে চেনো?…বাঃ, তাঁর বাড়িতেও এর আগে এসেছ? তবে তো কথাই নেই। মিশ্রজি অবশ্য এখন অসুস্থ, নার্সিং হোমে আছেন, কিন্তু যে-কাজে আমি এখানে এসেছি, সেটা তাঁরই কাজ।… আরে হ্যাঁ, সেই কথাই তো বলছি। গত বুধবার রাতে তাঁর লাইব্রেরি-ঘরে চোর ঢুকেছিল। আমার ধারণা, সেখানে হয়তো চোরের ফিংগারপ্রিন্ট পাওয়া যেতে পারে। তা তুমি কি একজন ফিংগারপ্রিন্ট-এক্সপার্টকে নিয়ে কাল সকালে এখানে একবার আসতে পারবে?…কথাটা কেন বলছি, সে তো বুঝতেই পারছ। যদি দাগি ক্রিমিন্যাল হয়, তো তোমাদের ফাইলে তার আঙুলের ছাপ থাকবে হয়তো, আর তা যদি থাকে তো আমার খাটুনি বেঁচে যায়… কী বললে? এটা অন্য এলাকা, মির্জাপুরের ব্যাপার, তাই নাক গলাতে তোমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অসুবিধে আছে? আরে, মির্জাপুর-পুলিশকে তো কিছু জানানোই হয়নি, আর তোমাকেও আমি ফর্ম্যালি কোনও অনুরোধ করছি না, স্রেফ বন্ধু হিসেবে এসে আমার কাজটা করে দেবে, বাস।…চালাকি কোরো না যোগী, গত বছর তোমার জন্যে আমি কী করেছিলুম মনে নেই? তুমিই কি তখন আনঅফিসিয়ালি তোমার ভাদুড়ি-আঙ্কলের সাহায্য চাওনি?… আ, দ্যাট্স লাইক আ গুড বয়! কাল সকালেই… এই ধরো নটা নাগাদ তোমাদের এক্সপার্টকে নিয়ে তা হলে চলে এসো। থ্যাঙ্কস আ লট!”

ভাদুড়িমশাই ফোন নামিয়ে রাখলেন।

রঘুনন্দন বলল, “মনে পড়েছে।”

“কী?”

“গত বছর উনি…আই মিন যোগীশ্বর সহায় সত্যিই আমাদের বাড়িতে একবার এসেছিলেন। তবে আমি তখন বাড়িতে ছিলুম না, পরে রাধার কাছে শুনেছি।”

‘কেন এসেছিল জানেন?”

“কে-একজন লোকের সম্পর্কে দাদুর সঙ্গে কথা বলতে। লোকটা ক্রিমিন্যাল, তার কাছে নাকি এমন কিছু কাগজপত্তর পাওয়া যায়, যাতে দাদুর নামের উল্লেখ ছিল। ফলে ওঁদের ধারণা হয়েছিল, দাদু হয়তো তাকে চিনতে পারেন। কিন্তু না, দাদু ওঁকে জানিয়ে দেন যে, ওই নামের কাউকে তিনি চেনেন না।”

“লোকটার নাম কী?”

“তা তো মনে নেই।” রঘুনন্দন বলল, “তবে রাধার হয়তো মনে থাকতে পারে। দাঁড়ান, ওকে ডাকছি।”

ভিতরে গিয়ে রাধিকাকে ডেকে আনল রঘুনন্দন। ভাদুড়িমশাই কী জানতে চান, রঘুনন্দনের কাছেই রাধিকা তা শুনে থাকবে। তাই ঘরে ঢুকেই বলল, “ত্রিলোক সিং। তবে শুধু কাগজপত্তর দেখেই যে পুলিশ-সুপার আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, তা নয়।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “পুলিশ-সুপারের সঙ্গে যখন আপনার দাদাশ্বশুরের কথা হয়, তখন কি আপনি সেখানে ছিলেন?”

“প্রায় সারাক্ষণই ছিলুম,” রাধিকা বলল, “তাই জানি যে, ত্রিলোক সিংয়ের কাছে ও-সব কাগজপত্তর ছাড়াও এমন একটা জিনিস ছিল, যা দেখে পুলিশের সন্দেহ হয়।”

“সেটা কী?”

“একটা সোনার আংটি। ওটা নাকি ত্রিলোক সিংয়ের হাতে ছিল।”

“তা তো থাকতেই পারে, তাতে সন্দেহের কী আছে?”

“চুনি-বসানো আংটি, সোনার পরিমাণও কম নয়।” রাধিকা বলল, “এই বাজারে ও-আংটির দাম নেহাত কম হবে না। দাগি ক্রিমিন্যালের হাতে অমন একটা আংটি দেখে পুলিশের সন্দেহ হয় যে, ওটা চোরাই মাল। আংটির গায়ে মেকারের ছাপ ছিল। সেই ছাপ দেখে ইলাহাবাদের এক জুয়েলারের কাছে গিয়ে পুলিশ খোঁজ করে যে, তাঁর দোকান থেকে কে কবে ওটা কিনেছিলেন।”

ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ ক্রমেই সরু হয়ে উঠছিল। তিনি বললেন, “কে কিনেছিল, সেটা জানা যায়?”

রাধিকা বলল, “জুয়েলার নাকি কিছুই বলতে পারে না। শেষপর্যন্ত তার দোকানের এক বুড়ো কর্মচারী জানায় যে, ওটা রেডিমেড জিনিস নয়, অর্ডারি মাল, বছর কুড়ি আগে অর্ডার দিয়ে ওটা তৈরি করানো হয়েছিল। তবে কে অর্ডার দিয়েছিলেন, তা তার মনে নেই।”

“যোগীশ্বর সহায়… আই মিন এলাহাবাদের পুলিশ সুপার কি ওই আংটির ব্যাপারে আপনার দাদাশ্বশুরকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলেন?”

“তা করেছিলেন বই কী। তা নইলে তিনি আসবেন কেন?”

“কী জিজ্ঞেস করেছিলেন?”

“জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, ত্রিলোক সিং বলে একজন দাগি চোরের কাছে পুলিশ এমন কিছু কাগজপত্তর পেয়েছে, যাতে দাদুর নামের উল্লেখ রয়েছে। এ-বিষয়ে দাদু কিছু জানেন কি না। দাদু বলেন যে, না, তিনি কিছুই জানেন কি না। ত্রিলোক সিং বলে কোনও লোককে তিনি চেনেনও না। যোগীশ্বর সহায় তখন দাদুকে আংটিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন যে, ইলাহাবাদের জুয়েলার্স অ্যান্ড ডায়মন্ড মার্চেন্টস দয়ালরাম অ্যান্ড সনস-এ ১৯৭৫ সালে তিনি এই রকম একটা আংটির ফরমাশ দিয়েছিলেন কি না। তাতেও দাদু বলেন যে, না, অমন কোনও আংটির অর্ডার তিনি দেননি।”

“তারপরেই যোগীশ্বর সহায় চলে যান?”

“তারপরেই যে চলে যান, তা নয়।” রাধিকা বলল, “দাদুর সঙ্গে তাঁর আরও দু-একটা কথা হয়েছিল। তবে তখন আমি ছিলুম না। যোগীশ্বর সহায়ের জন্যে দাদু আমাকে চা নিয়ে আসতে বলেছিলেন। আমি কিচেনে গিয়ে চা আর বিস্কিট নিয়ে আসি। যোগীশ্বর সহায় চা খেতে-খেতে দাদুর সঙ্গে আরও দু’চার মিনিট কথা বলেন। তারপর চলে যান। গাড়িতে ওঠার আগে দাদুকে তিনি যা বলেছিলেন, তাতে মনে হয়েছিল যে, তিনি একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক।…মানে পুলিশের লোকেরা তো সাধারণত একটু রুড অ্যান্ড রাফ টাইপের হয়, ইনি মোটেই সেই রকমের নন।”

“কী বলেছিলেন যোগীশ্বর সহায়?”

“বলেছিলেন, ‘মিশ্রজি, আপনি একজন পণ্ডিত মানুষ, সবাই আপনাকে শ্রদ্ধা করে। আপনার যাতে কোনও ব্যাপারে কোনও অস্বস্তির কারণ না ঘটে, সেটা আমি দেখব।’ সত্যিকারের সজ্জন না-হলে কেউ এমন কথা বলে?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বলেলেন, “রাইট। যোগীশ্বর ইজ আ পার্ফেক্ট জেন্টলম্যান। এটা আপনি ঠিকই বলেছেন।”

সদানন্দবাবু অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেননি। এবারে বললেন, “থাকে, পুলিশের মদ্যেও ভদ্দরলোক থাকে।”

রঘুনন্দন বলল, “হোয়াট আ পিটি! যোগীশ্বর সহায় কাল সকাল ন’টা নাগাদ এখানে আসবেন, অথচ আমরা তখন বাড়িতে থাকছি না। রাধাকে নিয়ে তখন তো আমাকে নার্সিং হোমে যেতে হবে।”

ঢংঢং করে ঘণ্টা বাজল। রাত ন’টা। জনার্দন ঘরে ঢুকে বলল, “খেতে দেওয়া হয়েছে।”