পাহাড়ি বিছে – ১

হাতের কাগজখানা ভাঁজ করে সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে কৌশিক বলল, “যত সব আজগুবি ব্যাপার! দুটো লোকের চেহারা কি একেবারে একইরকম হতে পারে? হওয়া সম্ভব? আই মিন নাক মুখ চোখ ঠোট ভুরু হাইট…এরিথিং একেবারে একই ছাঁচে ঢালা…ইস্তক গায়ের রং পর্যন্ত…এটা হয়?”

প্রশ্নটা ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে করেছিল, কিন্তু উত্তরটা এল সুরিন্দর বেদীর কাছ থেকে। ইনি সি. বি. আই. অর্থাৎ চারুচন্দ্র ভাদুড়ি ইনভেস্টিগেশানসের দিল্লি ব্রাঞ্চের চার্জে আছেন, আমাদের পরিচিত লোক, এবারে একটা তদন্তের কাজে কলকাতায় এসেছিলেন, সেটা মিটে যাওয়ায় হোটেল থেকে চেক আউট করে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, দুপুরের খাওয়া এখানেই সেরে নিয়ে দমদম থেকে বিকেলের ফ্লাইট ধরে দিল্লি ফিরবেন।

সুরিন্দর বেদী বললেন, “হোবে না কেন, জড়ুয়া ভাই হলে তো সেটা হতেই পারে।”

সদানন্দবাবু বললেন, “কারেক্ট। সুরিন্দর ঠিক কতাই বলেচে। ‘রাম অওর শ্যাম’ দেকেচ?”

কৌশিক বলল, “সেটা আবার কী?”

“তার মানে দ্যাকোনি। একটা হিন্দি বই। তাতে রাম আর শ্যাম হচ্চে জড়ুয়া মানে যমজ ভাই। একদম একরকম দেখতে। দিলীপকুমার নেবেছিল ডবল রোলে। সে-ই রাম, আবার সে-ই শ্যাম। উঃ, সে কী বই রে বাবা! যেমন মারদাঙ্গা, তেমনি সাসপেন্স, আবার তেমনি হাসির হুল্লোড়। একদিকে যেমন দু’ ভাইয়ে মিলে বেধড়ক ঠেঙিয়ে ভিলেন-ব্যাটাচ্ছেলেকে একেবারে আধমরা করে ছাড়লে, অন্য দিকে তেমনি আবার তাদের বউ দুটো তো চিনতেই পারে না যে, কে কার হাজব্যান্ড! হাসতে হাসতে পেটে একেবারে খিল ধরে যাবার জোগাড়!”

“হাঁ, হাঁ, হামিও সেইটা দেখেছি,” সুরিন্দার বেদী বললেন, “দ্যাট ওয়াজ আ ভেরি গুড ফিল্ম!”

“যাচ্চলে!” কৌশিক বলল, “এ তো আচ্ছা বখেড়া হল দেখছি! এর মধ্যে আবার ফিল্মের কথা আসছে কেন? আমি তো রিয়েল লাইফের কথা বলছিলুম। রিয়েল লাইফে এ-রকম হয়? …না না, ও-সব যমজ-ভাইটাইয়ের ব্যাপার নয়, দুটো একেবারে আলাদা লোক, এমনকী একজনের সঙ্গে আর-একজনের কোনও আত্মীয়তার সম্পর্কও নেই। তাও এ-রকম হতে পারে?”

প্রশ্নটা এবারেও কৌশিক তার মামাবাবুর দিকে তাকিয়েই করেছিল। কিন্তু এবারেও ভাদুড়িমশাই উত্তর দেবার সুযোগ পেলেন না। তিনি মুখ খুলবার আগেই অরুণ সান্যাল বললেন, “হবে না কেন, তাও হয়।”

“রিয়েল লাইফে?”

“হ্যাঁ রে, রিয়েল লাইফেও হয়। ফিল্ড মার্শাল মন্টগোমারির নাম শুনেছিস?”

“তা কেন শুনব না?” কৌশিক বলল, “মস্ত বড় ব্রিটিশ জেনারেল। সেকেন্ড ওয়ার্লড ওয়ারে নর্থ আফ্রিকা থেকে জার্মানদের হটিয়ে ছেড়েছিলেন। ডেজার্ট ওয়ারে রোমেলকে যে তাঁর কাছে ওইরকম নাস্তানাবুদ হতে হবে, তা নাকি কেউ ভাবতেই পারেনি।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “যাক, চিনেছিস তাহলে। তো সেই সময়ে ওয়ার-ফ্রন্টের ছবি-টবি কাগজে বেরুত তো, তাতে মন্টগোমারির ছবিও আমরা দেখেছি। কিন্তু সে নাকি অন্য লোক।”

“তার মানে?”

“মানে আর-একটা লোক। যাকে দেখতে ঠিক মন্টি মানে মন্টগোমারির মতো। তো সেই অন্য লোকটা যখন ওয়ার-করেসপন্ডেন্টদের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সোলজারদের স্যালুট নিচ্ছে, কি কোনও অফিসারের সঙ্গে কথা বলছে, কি ধর হাসপাতালে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোনও জখম সেপাইয়ের বেডের পাশে, আসল মন্টি তখন হয়তো তার ধারেকাছেও নেই, লন্ডনের কোনও আন্ডারগ্রাউন্ড শেল্টারে বসে তিনি হয়তো তখন নর্থ আফ্রিকার ম্যাপ খুলে চার্চিলকে বোঝাচ্ছেন তাঁর স্ট্র্যাটেজি।”

“ইয়েস, ইয়েস,” সুরিন্দর বেদী বললেন, “আই রিমেমবার। ওয়ার খতম হয়ে যাবার বাদে এই দুস্রা আদমি একঠো কিতাবও লিখেছিল : আই ওয়াজ মন্টি’জ ডাল। কিতাবে তার একঠো তবিরও ছিল।”

“রাইট।” অরুণ সান্যাল বললেন, “আমিও পড়েছি। তবে একটা নয়, অনেকগুলি ছবি ছিল সেই বইয়ে। সবই ওয়ার-ফ্রন্টে তোলা। তোবড়ানো গাল, মাথায় ফেল্টের বেরে টুপি, বগলে ব্যাটন। একেবারে হুবহু ফিল্ড মার্শাল মন্টগোমারি।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না হে অরুণ, যাকে হুবহু মিল বলে, মন্টির সঙ্গে তা কিন্তু এই লোকটার ছিল না। হাইট এক, দু’জনেই রোগাপট্‌কা মানুষ, তোবড়ানো গাল ছাড়া চোখমুখের আদলেও মিল ছিল কিছুটা। তবে বাদবাকিটা মেক-আপ ম্যানের কারসাজি।”

কৌশিক বলল, “মেক-আপ ম্যানের কথা ছেড়ে দাও, মামাবাবু। যমজ ভাইয়ের কথাও বাদ দিচ্ছি। কিন্তু তা ছাড়া কি ওই যাকে হুবহু মিল বলে, দু’জন লোকের মধ্যে সেটা থাকতেই পারে না?”

সদানন্দবাবু বললেন, “প্রভাত মুকুজ্যের নাম শুনেচ?”

“কোন্ প্রভাত মুখুজ্যে?” কৌশিক বলল, “ওই যিনি রবীন্দ্রনাথের বায়োগ্রাফি লিখেছেন, তিনি?”

“না হে, ইনি গপ্পো লিকতেন। অতি মজাদার জমজমাট সব গপ্পো। পড়ে সবাই ধন্যি ধন্যি করত। তা ছাড়া নবেলও খানকয় লিকেছিলেন। তার একটার মধ্যে ওই রকমের মিলের কতা ছিল।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “আপনি কি ‘রত্নদীপ’-এর কথা বলছেন? ওটা নিয়েও তো ফিল্ম হয়েছিল একটা।”

“যাচ্চলে,” কৌশিক বলল, “আবার তোমরা সেই ফিল্মের লাইনে ঢুকে পড়লে? আমি ফিল্মের কথাও বলছি না, গপ্পো কি নাটক-নভেলের কথাও বলছি না। আমি বলছি রিয়েল লাইফের কথা। তাতে অমন হয়?”

“হয় বলে তো শুনিনি।” অরুণ সান্যাল বললেন, “কিন্তু তুই হঠাৎ এটা নিয়ে এত ভাবছিস কেন?”

“সাধে কি আর ভাবছি। আজকের কাগজে এই রকমের একটা মিলের কথা বেরিয়েছে। একেবারে টায়ে-টায়ে মিল। আমার অবিশ্যি বিশ্বাস হয় না, তবু পড়ে শোনাচ্ছি, তোমাদের হয়তো বিশ্বাস হলেও হতে পারে।”

সেন্টার টেবিল থেকে ভাঁজ-করা কাগজখানা ফের তুলে নিয়ে, তার ভিতরকার একটা পৃষ্ঠা খুলে কৌশিক অতঃপর যে খবরটা পড়ে শোনাল, আগড়ম-বাগড়ম বাদ দিলে সেটা এই রকম : তিনসুকিয়ায় গিয়ে একটা লোক গত কয়েকদিন ধরে বলে বেড়াচ্ছিল যে, সে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক সুশীল বন্দ্যোপাধ্যায়। নিরিবিলিতে বসে চা-বাগানের উপরে একটা উপন্যাস লিখবে বলে সে তিনসুকিয়া এসেছিল, কিন্তু আসবার পথে রেলগাড়িতে একদল গুণ্ডা তার সর্বস্ব কেড়ে নেয়। এখন সে যে কলকাতায় ফিরবে তার রেলভাড়াটা পর্যন্ত নেই। সুশীল বাঁড়ুজ্যে বিখ্যাত লোক, কাগজে মাঝেমধ্যে তাঁর ছবিও বেরোয়, এ লোকটির সঙ্গে সে-সব ছবির হুবহু মিল দেখে কেউ কোনও সন্দেহ করেনি, স্থানীয় বাঙালি সমাজ তাকে দিন কয়েক খুব খাতিরযত্ন করে। এমনকি চাঁদা করে হাজারখানেক টাকাও তুলে দেয়। কিন্তু তিনসুকিয়া থেকে ডিব্রুগড়ে গিয়েই লোকটি পড়ে যায় মুশকিলে। সুশীল বাঁড়ুজ্যের এক মেয়ের বিয়ে যে ডিব্রুগড়ে হয়েছে, লোকটি তা জানত না। সেই মেয়েই পুলিশে জানিয়ে দেয় যে, এ তার বাবা নয়। তবে হ্যাঁ, মাত্র একটা ব্যাপার ছাড়া তার বাবার চেহারার সঙ্গে এর আশ্চর্য মিল রয়েছে বটে। সেই একটা ব্যাপার আর কিছুই নয়, সুশীল বাঁড়ুজ্যের বাঁ গালে একটা জঙুল আছে, এর তা নেই। লোকটি এখন হাজতে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওটাই তো মস্ত অমিল। তা হলে আর টায়ে-টায়ে মিল হল কোত্থেকে? না না, ওটা হয় না।”

সুরিন্দর বেদীর বয়স বেশি নয়। সম্ভবত কৌশিকেরই সমবয়সি। কৌশিকের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “আই থিঙ্ক ইয়োর আংল ইজ রাইট। দো আদমিকা এক হি স? নেহি ভাই, ইয়ে বাত কুছ্ না-মুমকিন সা লগ্ রহা হ্যায়। ইট’স জাস্ট নট পসিবল।”

সদানন্দবাবু যে ভিতরে-ভিতরে একটু উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন, সে তার মুখচোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু উত্তেজনাটা যে এইভাবে প্রকাশ পাবে, সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। একেবারে হঠাৎই নিজের বাঁ হাতের তালুতে ডান হাতে একটা ঘুসি মেরে তিনি বললেন, “পসিবল নয়? আপনি বললেই হল? আলবাত পসিবল! টায়ে-টায়ে মিল হয় না? একশো বার হয়। আরে মশাই, এই টায়ে-টায়ে মিলের জন্যে গত বছর আমি কী বিপদে পড়েছিলুম, জানেন?”

সুরিন্দর যে সদানন্দবাবুর আকস্মিক রূপান্তরে একটু ভড়কে গিয়েছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। আমতা-আমতা করে বললেন, “হ্যাভ আই সেড এনিথিং ইমপ্রপার? অগর এইসা কুছ বোলা তো তার জন্যে আমি মাফি মাংছি।”

কৌশিক হেসে বলল, “আরে সুরিন্দর, বোস-জেঠুর সঙ্গে তোমার তো ভাল করে পরিচয় হয়নি, সেটা হলে বুঝতে পারবে যে, উনি ওইভাবেই কথা বলেন, ওতে কিছু মনে কোরো না।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “তা তো হল, কিন্তু এদিকে যে আসল কথাটাই চাপা পড়ে যাচ্ছে। কী বিপদ হয়েছিল বোসদা?”

“বিপদ বলে বিপদ!” সদানন্দবাবু বললেন, “বালিগঞ্জের ফুটপাথে একগাদা হুমদো জোয়ান মিলে দিন-দুপুরে আমার গায়ের চামড়াখানা খুলে নেবার জোগাড় করেছিল। উঃ, খুব বাঁচা বেঁচে গেচি মশাই।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কই, এটার কথা তো কখনও আমাদের বলেননি।”

“কী করে বলব? সে এমন লজ্জাজনক কাণ্ড যে, নিজের বাপের কাচেও বলা যায় না। অ্যাদ্দিন তাই চেপে ছিলুম, কাউকে কিচু বলিনি।”

কৌশিক বলল, “কিন্তু আজ তো বলবেন। তা নইলে কিন্তু ছাড়ছি না।”

সদানন্দবাবু বললেন, “আজ তো বলতেই হবে। বিশেষ করে আরও এইজন্যে বলব যে, তা নইলে একটা ভুল ধারণাই সকলের থেকে যাবে। তোমরা ভাবছ যে, রিয়েল লাইফে একজনের সঙ্গে আর-একজনের অমন হুবহু মিল হয় না। আসলে কিন্তু হয়।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে তো আপনি আগেই বলেছেন। এখন গল্পটা বলে ফেলুন দিকি।” আজ একতিরিশে মার্চ, রবিবার। হঠাৎ একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় দিন কয়েক আগে ভাদুড়িমশাই কলকাতায় এসেছেন। কাজ শেষ করে তিনি আবার বাঙ্গালোরে ফিরে যাবেন। ইতিমধ্যে আজ ছুটির দিন বলে আমরা কৌশিকদের কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে চলে এসেছি। সকালবেলার আড্ডাটা মোটামুটি ভালই জমে গেছে।

দ্বিতীয় রাউন্ডের চা এসে গিয়েছিল। নিজের পেয়ালায় আলতো একটা চুমুক দিয়ে সদানন্দবাবু বললেন, “চত্তির-সেল কাকে বলে জানেন তো?”

রান্নাঘরের কাজ মিটিয়ে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে মালতী ইতিমধ্যে ড্রয়িং রুমে ঢুকে পড়েছিল। একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে সে বলল, “ওমা, তা কেন জানব না। যদ্দিন বালিগঞ্জ পাড়ায় ছিলুম, বেশির ভাগ জামাকাপড় তো ওই সেল থেকেই কিনেছি।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “শুধু জামাকাপড় কেন, গেরস্তালির সব জিনিসই এই সময়ে সেলে খুব শস্তায় মেলে। তা ছাড়া বালিগঞ্জ বলেও কথা নেই, শেয়ালদা বলো, মানিকতলা বলো, হাতিবাগান বলো, শ্যামবাজার বলো, চোত মাস পড়লেই অমনি গোটা কলকাতা জুড়ে সেলের ধুম পড়ে যায়।”

“বাজে বোকো না।” মালতী বলল, “গোটা কলকাতা জুড়ে সেল হলে তো এই কাঁকুড়গাছিতেও হত। হয়? উঃ, চোত মাসের অর্ধেকই তো কাবার হয়ে গেল, অথচ কাণ্ড দ্যাখো, ফুটপাথের দোকান থেকে শস্তায় দু’ চারটে শাড়ি কিনব, এখানে তা হবার জো নেই।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কার জন্যে কিনবি রে, তোর কি শাড়ির কিছু অভাব?”

“শুধু আমার জন্যে কিনব কেন?” মালতী রেগে গিয়ে বলল, “কাজের মেয়েটার জন্যেও তো কিনতে হবে। তা ছাড়া শুধু শাড়ি বলেই বা কথা কী, বেডকভার, পর্দার কাপড়, তোয়ালে, কাপডিশ—কত কিছুই তো কেনা দরকার। উঃ, যতীন বাগচি রোডের ফ্ল্যাটটা ছেড়ে আসাই ভুল হয়েছে, ওখানে থাকলে এই সময়ে কত শস্তায় এ-সব কেনা যেত!”

কৌশিক বলল, “শস্তায় তো দেবেই। এই চোত মাসেই ওদের স্টক ক্লিয়ারেন্স হয় যে!”

সদানন্দবাবু একটুক্ষণের জন্যে চুপ করে গিয়েছিলেন। এইবারে ফুঁসে উঠে বললেন, “স্টক ক্লিয়ারেন্স না হাতি! আসলে এটা হচ্ছে খদ্দেরদের বোকা বানিয়ে যত রাজ্যের রদ্দি মাল গছিয়ে দেবার টাইম!”

অরুণ সান্যাল বললেন, “তা-ই?”

“হ্যাঁ, তা-ই! আরে মশাই, আপনাদের বালিগঞ্জ পাড়ার চোত-সেলের তো খুব সুখ্যাত শুনি, নাকি ওখানে জলের দরে এই সময়ে জামাকাপড় বিক্রি হয়, কিন্তু সস্তায় মাল কিনতে গিয়ে গত বছরে ওখেনে মিসেস বোসের…মানে আমার ওয়াইফের কী অবস্থা হয়েছিল জানেন?”

“কী হয়েছিল?”

“যা হবার তা-ই হয়েছিল। কী কিনেছিলেন শুনুন। নিজের জন্যে তিনখানা ধনেখালির শাড়ি, কমলির জন্যে দুটো শালোয়ার কামিজ উইথ রেশমি দোপাট্টা আর আমার জন্যে দুটো ফতুয়া। তা ছাড়া, বাড়িতে দুটো কাজের মেয়ে রয়েচে তো, তাদের জন্যে দুটো ছাপাশাড়ি আর ব্লাউজ। তা কোনও ফিক্সড প্রাইসের রেসপেক্টেবল দোকানে কি এত সব জিনিস হাজার টাকার কমে পাওয়া যেত?”

মালতী বলল, “হাজার টাকায় হত না বোসদা। অন্তত দেড় হাজার।”

সদানন্দবাবু বললেন, “অথচ আমার ওয়াইফ তো আর কোনও রেসপেক্টেবল দোকান থেকে এ-সব কেনেননি। তিনি কিনেছিলেন চত্তির-সেলে, বালিগঞ্জের ফুটপাথ থেকে। দাম পড়েছিল মাত্র সাতশো পঁচিশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা। তো তিনি ভাবলেন, দারুণ বাণিজ্য করে ফেলেচেন!

“ভাবতেই পারেন!” মালতী বলল, “এ তো হাফ প্রাইসের চাইতেও কম!”

“দাঁড়ান, দাঁড়ান, আগেই কমেন্ট করবেন না। সবটা আগ শুনুন। তো একটা ট্যাক্সি ধরে জামাকাপড়ের সেই গন্ধমাদন পাহাড়টিকে তার মধ্যে চাপিয়ে বাড়িতে ফিরে কী দেকলুম জানেন?”

“কী দেখলেন?”

“দেকলুম যে, ধনেখালি শাড়ি তিনটের মধ্যে দুটোই হচ্চে ন’হাতি। তা দিয়ে গামছার কাজ চলতে পারে, কিন্তু লজ্জা-নিবারণ হয় না। শুধু তা-ই নয়, শালোয়ার-কামিজ দুটোর একটা খাটো, একটা ফাটা। আর আমার জন্যে যে একজোড়া ফতুয়া কিনেছিলেন, তার কোনওটারই ঝুল কোমরের নীচে নামচে না। কাজের মেয়ে দুটোর জন্যে ছাপাশাড়ি আর ব্লাউজ কিনেছিলেন। পরের দিনই তারা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এ কী জিনিস দিয়েচ মাগো, এ তো জলে ধুতেই ছাপ-টাপ মুচে গিয়ে সাদা হয়ে গেল!”

অরুণ সান্যাল বললেন, “অ্যাঁ, বলেন কী!”

সদানন্দবাবু বললেন, “ঠিকই বলচি। জিনিসগুলো অবিশ্যি ফেলা যায়নি। শাড়ি কেটে রাজ্যের বালিশের ওয়াড় বানানো হল, আর বাদবাকি জিনিস দিয়ে আমাদের ঘর-মোছা ন্যাতার কাজ চলচে।”

আমি বললুম “যাচ্চলে! এ তো দেখছি শস্তার তিন অবস্থা!”

“ঠিক বলেচেন,” সদানন্দবাবু বললেন, “তবে সেটা কোনও কতা নয়। এমনকি, বালিগঞ্জের ফুটপাথগুলোয় তো এই সময় যাচ্ছেতাই ভিড় হয়, তো সেই ভিড়ের মধ্যে আমার ওয়াইফের ব্যাগে ব্লেড চালিয়ে যে আড়াইশো টাকা কেউ মেরে দিয়েছিল, সেটার কতাও আমি ধরচি না। কতায় আচে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু! শস্তায় জিনিস কেনার লোভে পড়ে গিন্নির কতায় নেচে উঠেছিলুম, তাই দণ্ড দিতে হল। অমনটা তো হতেই পারে।…না না, সে-সব নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। আমার আসল দুঃখটা হল অন্য জায়গায়। স্রেফ গদাইয়ের জন্যে আমার বড় হেনস্তা হয়েছিল, মশাই।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু যদি বুঝিয়ে বলেন তো বড্ড ভাল হয়।”

“এতে বোজাবার কী আচে?”

“আরে মশাই, বলছিলেন তো চত্তির-সেলের কতা। তার মধ্যে হঠাৎ জাম্প কাট করে গদাইয়ের কথায় চলে গেলেন কেন?”

“যেতে হল। বিকজ ইট হ্যাপেন্ড অন দি সেম ডে, অ্যান্ড হ্যাপেন্ড অন দি সেম ফুটপাথ অফ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। ভাবতে পারেন যে, আমার চামড়া খুলে নেবার জন্যে গদাই সেদিন একগাদা ছেলে-ছোকরাকে কন্টিনিউয়াসলি ইনসাইট করে যাচ্ছিল? তাও আবার আমার ওয়াইফ যেখেনে কেনাকাটা করছিলেন, তার থেকে মাত্তর হাত পঁচিশেক দূরে? ক্যান ইউ ইমাজিন?”

চুপচাপ সব শুনে গেলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “গদাইটি কে?”

“ওহো, সেটাই তো বলা হয়নি,” সদানন্দবাবু দাঁতে জিভ ঠেকিয়ে চুক-চুক শব্দে আক্ষেপ জানিয়ে বললেন, “গদাই হচ্চে আমার ওয়াইফের পিসতুতো ভাই বলরাম দত্তের ছোট ছেলে। ভাল নাম গদাধর দত্ত, ডাকনাম গদাই। বয়েস আর কত হবে, এই ধরুন পঁচিশ-ছাব্বিশ। অতি ভাল ছেলে, বি. কম. পাশ করে রেলের চাকরি নিয়ে জামালপুরে চলে যায়। এখন সেইখেনেই আচে। তবে মাঝেমদ্যে যে কলকাতায় আসে না, তা নয়। গত বছরের মাঘমাসেই তো বিয়ে করতে এসেছিল। তিন দিনের বেশি ছুটি পায়নি বলে, বিয়েটা সেরেই বউকে নিয়ে জামালপুরে ফিরে যেতে হয়।…তো সেই গদাই, আমার পিসতুতো শালা চোরবাগানের বলরাম দত্তের ছোট ছেলে, ন্যাংটো বয়েস থেকেই যে কিনা তার পিসেমশাই আর বড়পিসির…আই মিন আমার আর আমার ওয়াইফের…দারুণ ন্যাওটা, উঃ, সেই গদাই যে আমার সঙ্গে এমন ব্যাভার করবে, এ তো মশাই আমি ভাবতেও পারিনি!”

“কী ব্যবহার করেছে, কেন করেছে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি মশাই বড্ড ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলেন! কী হয়েছিল, একটু স্পষ্ট করে বলুন তো।”

সুরিন্দর বেদী বললেন, “হাঁ হাঁ, সাফ্ সাফ্ সব বাতা দিজিয়ে।”

“বলচি।” বলে পুরো এক মিনিট ঝিম মেরে বসে রইলেন সদানন্দবাবু। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমার ওয়াইফ একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দামদস্তুর করছিলেন। তাঁর পছন্দ-করা একটা ছাপাশাড়ির দাম যে একশো পঁয়তাল্লিশ টাকা, দোকানির মুখে এই কথা শুনে তিনি বললেন, এর দাম পঁয়তিরিশ টাকার এক পয়সাও বেশি হওয়া উচিত নয়। তাতে দোকানির মুকচোক এমন কুইকলি পালটে গেল যে, যা বুজবার তা তক্ষুনি আমি বুজে গেলুম।”

অরুণ সান্যাল বললেন, “কী বুঝলেন?”

“বুজলুম যে, আর এক সেকেন্ডও এখেনে দাঁড়িয়ে থাকাটা আমার পক্ষে মোটেই নিরাপদ হবে না। যেন এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে আসিনি, এইরকম একটা ভাব দেখিয়ে তক্ষুনি আমি দূরে সরে যাই, গিয়ে অন্যদের কেনাকাটা দেকতে থাকি। আর তখনই দেখা হয়ে যায় গদাইয়ের সঙ্গে।”

“সেও চত্তির-সেলে কেনাকাটা করতে এসেছিল?”

সদানন্দবাবু বললেন, “সেও কেনাকাটা করতে এয়েছিল। একটা অল্পবয়িসি মেয়েও ছিল তার সঙ্গে। তা বিয়ের দিনে আর বউভাতের দিনে তো কাজের বাড়ির ভিড়ভাট্টার মদ্যে ভাল করে দেকা হয়নি, তবে শাঁখাসিঁদুর দেকে বুজলুম যে, এ নিশ্চয় গদাইয়ের বউই হবে। এগিয়ে গিয়ে নতুন বউয়ের থুতনিতে হাত রেকে বললুম, ‘কী গো মা-মণি, জামালপুর থেকে এরই মদ্যে ফিরে এলে যে? বাপের বাড়ির জন্যে মন কেমন করছিল বুঝি?’ তাতে কী হল ভাবতে পারেন?”

“কী হল?”

“গদাই হতচ্ছাড়া নাপিয়ে এসে আমার পাঞ্জাবির বুকপকেটের কাচে খামচে ধরে বলল, ‘অ্যাই রাস্কেল, তুই আমার বউয়ের গায়ে হাত দিলি কেন? জুতিয়ে মুক ভেঙে দোব!’ শুনে তো আমি হতভম্ব। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, ‘তুমি গদাই নও?’ তাতে সে বলল, ‘সো হোয়াট? তুই শালা আমাকে তুমি বলবার কে?’ যত বলি, ‘ও গদাই, তুমি আমাকে চিনতে পারচ না? আমি তোমার শ্যালদার বড় পিসে মশাই,’ তত সে নাপ মারে আর বলে, ‘চোপরও শালা!” শুদু কি তা-ই? ব্যাপার দেকে কিছু ছেলেমেয়েরা ইতিমধ্যে ভিড় জমিয়ে ফেলেছিল। গদাই আর সেই মেয়েটা, দু’ জনে মিলে তাদের ক্রমাগত ইনসাইট করতে থাকে আর বলতে থাকে যে, পুলিশ ডেকে কিছু হবে না, সবাই মিলে এই বুড়ো ভামটার ছাল ছাড়িয়ে নিতে হবে।”

এক মুহূর্তের জন্যে চুপ করে রইলেন সদানন্দবাবু। তারপর বললেন, “উঃ, ব্যাপারটা একবার ভেবে দেকুন দিকি! সম্পর্কে যার বাপ আমার শালা হয়, সে-ই কিনা আমাকে শালা বলচে, রাস্কেল বলচে, বুড়ো ভাম বলচে, জুতিয়ে মুখ ভেঙে দেবে বলচে, আমার চামড়া খুলে নেবার কথা বলচে! এ কি ভাবা যায়? আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলুম, মশাই। কী করে যে সেই নরপাষণ্ডের হাত থেকে সেদিন ছাড়া পেয়েছিলুম, সে শুদু আমিই জানি।”