।। ১৫।।
সেদিন সন্ধেবেলা ফোনটা নিয়ে সোফায় বসে ঘাঁটছিলো কমলিকা। হঠাৎই বেশ উস্কোখুস্কো হয়ে বাড়ি ফিরল ঈশা। বাড়িতে ঢুকেই রাগে ফেটে পড়লো। মনীন্দ্র বসে টিভির খবরে চোখ রেখেছিলো। ঈশা ঢুকেই চিৎকার করে বললো, পাপা দিস ইস চিটিং, দিস ইস ড্যাম চিটিং, অর্কপ্রভ আমার সাথে চিট করলো। তুমি জানো আমার আজ অ্যাসাইনমেন্টে সাইন করার কথা ছিল, সেই অবস্থায় ও ইউটিউবে না ফেসবুকে কোন এক কমলিকা দাশগুপ্তের কবিতা শুনছে, দিয়ে বললো, ওই কমলিকা দাশগুপ্তের গলাটাই নাকি পারফেক্ট হবে ওর মুভির ক্যারেক্টারের জন্য। তাই কোনো এক অচেনা কমলিকা দাশগুপ্তের নম্বর জোগাড়ের জন্য পাগল হয়ে গিয়ে আমার সাথে অ্যাসাইনমেন্ট ক্যানসেল করলো।
আই অ্যাম ফিলিং ইনসাল্টেট পাপা।
ঈশার চোখে হতাশা আর জীবনে প্রথম হেরে যাওয়ার ব্যর্থতা দেখলো কমলিকা।
মনীন্দ্রর মুখে আতঙ্ক। ফিসফিস করে বললো, কি নাম বললি?
ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল, পাপা তুমি এখনও নাম নিয়ে পড়ে আছো? এদিকে আমি বন্ধু, বান্ধব পরিচিত সকলকে বলে দিয়েছিলাম, এমনকি আমার চ্যানেলে পর্যন্ত অ্যানাউন্স করে দিয়েছি, যে অর্কর নেক্সট মুভি ‘বিজয়িনী’তে বেশ কয়েকটা কবিতা শুনতে পাবেন আমার গলায়! বুঝতে পারছ আমার ভিউয়ার্সদের কাছে আমি কতটা ছোট হয়ে যাবো।
আমি আর ভাবতে পারছি না পাপা।
মনীন্দ্র আবারও বললো, কার নাম বললি?
ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল, কমলিকা দাসগুপ্ত, ওনার কবিতা এই তিনদিনে ভাইরাল হয়ে গেছে ফেসবুকে। আমাকেও তিনজন সেন্ড করেছে।
মনীন্দ্র আতঙ্কিত গলায় বলল, একবার শোনাবি?
ঈশা পাপার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো এমন ভাবে বলছো, যেন তুমি মহিলাকে চেন!
নিজের মোবাইলটা অন করে কবিতাটা চালিয়ে দিলো ঈশা।
কেঁপে উঠলো মনীন্দ্র।
কবি প্রবীর রায়চৌধুরীর—পরজন্ম
কমলিকা দাসগুপ্তের কণ্ঠে
যখন তুমি দাঁড়িয়ে আছো ছাদের আলসেতে,
আমি নির্নিমেষ তাকিয়ে ভাবি একটা পরজন্ম চাই, দুচোখ ভরে তোমায় দেখবো বলে।
তোমার কড়ি আঙুলটা ধরবার স্পর্ধার জন্য একটা পরজন্ম চাই আমার।
তোমায় ডাকনামে ডাকবো বলেই চাই পরজন্ম।
তোমার খোলা চুলের গন্ধ নিতেও চাই ওই জন্মে।
তোমার গোলাপি ঠোঁটের দিকে সাহস ভরে তাকাতে চাই পরজন্মে।
না, না, এ জন্মে তুমি দূরের নীহারিকা। রূপকথার রাজকন্যা।
তোমায় ছুঁয়ে দেখবো, সাহস কোথায়!
পরজন্মে আমিও আসবো পক্ষীরাজে চড়ে,
এই ভাঙা সাইকেল ফেলে দেব আস্তাকুঁড়ে।
তোমার চিবুক ধরে বলবো, চলো তোমায় নিয়ে যাবো সাত সমুদ্র পাড়ে।
তোমার ইচ্ছেপূরণের চাবিকাঠিটা তোমার হাতে দিয়ে বলবো,
ভালোবাসি, বিশ্বাস করো গতজন্ম থেকে
অপেক্ষা করছি শুধু তোমার জন্য।
একটা পরজন্ম চাই আমার।
দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো মনীন্দ্র।
ঈশা তিতবিরক্ত গলায় বলল, তোমার আবার কি হলো পাপা? এক্সের কথা মনে পড়লো নাকি! মাকে তো বাধ্য হয়ে লগ্নাভ্রষ্টা হওয়া থেকে বাঁচাতে বিয়ে করেছিলে তুমি, তাই কি পুরোনো ব্যর্থ প্রেমের কথা মনে পড়লো তোমার?
আশ্চর্য মানুষ বটে। কবিতা শুনে কাঁদছো!
মনীন্দ্র ভাঙা গলায় ফিসফিস করে, এই কবিতাটাই প্রবীর রায়চৌধুরীর বই থেকে টুকে আমি কমলিকাকে পাঠিয়েছিলাম।
ঈশা সব ভুলে বোকার মত তাকিয়ে আছে পাপার দিকে।
ঈশা বললো, তুমি কি চেন নাকি মহিলাকে?
আরে এনার জন্য আমার সব বানচাল হয়ে গেছে গো, এর নম্বর জোগাড় করতে পারলে আমি জাস্ট রিকোয়েস্ট করবো, উনি যেন অর্কর সাথে কাজটা না করেন। তাহলে অর্ক বাধ্য হয়ে আমাকেই ডাকবে, ওর হাতে আর অপশন নেই।
কমলিকা ধীর পায়ে ফোনটা নিয়ে নিজের ঘরে গেল।
প্রবুদ্ধ, প্লিজ আমায় এটা করতে বলো না। অর্কপ্রভ না কে যেন ঈশার অ্যাসাইনমেন্ট বাতিল করে দিয়েছে, ঈশা ভীষণ আপসেট হয়ে পড়েছে। মা হয়ে এভাবে মেয়ের সাথে কম্পিটিশন করতে পারছি না আমি। তুমি যা বলেছো আমি শুনেছি প্রবুদ্ধ। ইউটিউবে চ্যানেল খোলা, ফেসবুকে পেজ খোলা, রেকর্ডিং করা, সেগুলো তুমি যেভাবে পোস্ট করেছো আমি কিছুতেই তোমায় বাধা দিইনি। কিন্তু তাই বলে মা হয়ে শেষ পর্যন্ত ঈশার সাথে প্রতিগযোগিতায় নামবো? নিজের বিবেককে কি উত্তর দেব প্রবুদ্ধ!
ওর কথা শেষ হবার আগেই ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকলো ঈশা।
কমলিকার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঈশা বললো, তুমিই কমলিকা দাসগুপ্ত? তুমি কার্ডিওলজিস্ট কমলেশ দাসগুপ্তর মেয়ে? তুমি ইংলিশে মাস্টার্স?
এগুলো কি সঠিক?
এখুনি আমার এক বন্ধু তোমার একটা ছবি পাঠিয়েছে আর ডিটেল দিয়েছে। তুমি তো চ্যানেলে নিজের ছবি দাও নি। কি হলো, চুপ করে আছো কেন, এগুলো কি সত্যি?
কমলিকা কিছু বলার আগেই মনীন্দ্র বললো, হ্যাঁ এগুলো সত্যি।
ঈশা অবাক চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, মানে? তুমি যে সেই ছোট থেকে বলেছো, তোর মা খুব গরিব বাড়ির মেয়ে, তুমি নাকি তাকে বিয়ে করে উদ্ধার করেছ, মা নাকি চূড়ান্ত অশিক্ষত। ভুল কবিতা শেখাবে আমাদের….এগুলো তাহলে কি পাপা?
মনীন্দ্র অর্থহীন ভাবে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল ওগুলো মিথ্যে ছিল।
ঈশা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়ে বলল, মিথ্যে বলেছিলে? কেন, মায়ের নামে এত মিথ্যে বলে তোমার কি লাভ হয়েছিল?
কমলিকা স্থির কম্পনহীন গলায় বলল, জিতে গিয়েছিল তোমার পাপা।
নিজের মানসিক বিকারকে চরিতার্থ করতে মিথ্যের পর মিথ্যে সাজিয়েছিলো তোমার বাবা।
কমলিকার ফোনে একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন ঢুকছে। রিসিভ করতেই ভরাট গলায় কেউ একজন বললো, আমি অর্কপ্রভ ব্যানার্জী বলছি। ফেসবুকে আপনার বেশ কয়েকটি কবিতা শুনে আমি আপনার সাথে কাজ করতে আগ্রহী।
কমলিকা ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললো, সরি। আমি যতদূর জানি, আপনার সাথে মিস ঈশা সেনের একটা মৌখিক কন্ট্যাক্ট হয়েছিল এই মুভিটার ব্যাপারে, তাহলে আপনি কেন আমায় অ্যাপ্রোচ করছেন?
এক্সট্রিমলি সরি, আমি কাজটা করতে পারবো না।
কমলিকা ফোনটা কেটে দিলো।
রান্নাঘরে যাওয়ার সময় শুনতে পেল ঈশা ফোনে অর্ককে বলছে, সরি অর্ক, আমি তোমার কোনো মুভিতেই আর কাজ করতে পারবো না।
তারপরেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ঈশা, বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে মেয়েটা।
ছোটবেলায় বায়না করে কিছু না পেলেই এভাবে কাঁদত ঈশা। কমলিকা পায়ে পায়ে ওর ঘরে ঢুকে ঈশার পিঠে হাত দিয়ে বললো, কাঁদছিস কেন? অর্কর অফার ফিরিয়ে দিলি কেন?
ঈশা কমলিকাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বললো, মা প্রবুদ্ধ আমার ফোন রিসিভ করছে না, মেসেজের রিপ্লাই পর্যন্ত দিচ্ছে না, প্রবুদ্ধ আর আমায় ভালোবাসে না মা। আমি ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও পেলাম না ওর কাছে।
কমলিকা শান্ত গলায় বলল, একদিন প্রবুদ্ধ তোকে বারংবার ফোন করে গেছে, তুই রিসিভ করিস নি।
ওর মেসেজের উত্তর অবধি দিস নি। মিথ্যে বলেছিস ওকে, তারপরেও ও তোকে ফোন করে গেছে। ঈশা ধরে নে এবারে তোর পরীক্ষা। ও যতটা এফোর্ট দিয়েছিল তোদের সম্পর্কটাতে তুই ততটা দিসনি। এখন তুই এফোর্ট দে ঈশা, যতক্ষণ না প্রবুদ্ধর অভিমানের বরফ গলে ততক্ষণ পর্যন্ত তুই চেষ্টা করে যা।
ঈশা বললো, মা প্রবুদ্ধ তো তোমাকে খুব ভালোবাসে তাই না? ওই তো তোমার রেকর্ডিং, চ্যানেল এসব করে দিয়েছে, তুমি একবার ওকে বলবে আমার হয়ে?
কমলিকা ঘাড় নেড়ে বললো, বেশ বলে দেখবো।
রাতে প্রবুদ্ধ ফোনে বললো, আন্টি, ঈশা আজ আমায় পঞ্চাশবার ফোন করেছে, ‘মেয়েটা নিজের ভুল বুঝতে পেরে মেসেজ করেছে, আমি আর পারছি না আন্টি। এবারে আমি ওর কল রিসিভ করছি।
ঈশা কষ্ট পাচ্ছে আন্টি।
কমলিকা বললো, পাঁচশোটা কল করলে তারপর রিসিভ করবে প্রবুদ্ধ, এটা আমার নির্দেশ। আরেকটু এফোর্ট তুমি ডিসার্ভ করো।
প্রবুদ্ধ ভাঙা গলায় বলল, কিন্তু ঈশা যে কষ্ট পাচ্ছে।
কমলিকা কঠিন গলায় বলল, তুমি আরও বেশি কষ্ট পেয়েছিল প্রবুদ্ধ, ভুলে যাচ্ছ কেন। ঈশাকে আরেকটু কষ্ট পেতে দাও। আগুনে পুড়লে তবেই তো খাঁটি সোনাটাকে তুমি পাবে প্রবুদ্ধ।
দেবজিত আর ঈশার সাথে ব্রেকফার্স্ট টেবিলে বসে দেবজিতের বিয়ের মেনু ঠিক করছিল কমলিকা। ঈশা আজ নিজের চ্যানেলে মাকে লাইভে আনবে বলে পাগলামি শুরু করেছে। ওর সব ভিউয়ারের সামনে নাকি ও বলতে চায়, আজকের ঈশা সেন হবার পিছনে সমস্ত ক্রেডিট ওর মায়ের।
মনীন্দ্র দূর থেকে দেখেছিলো ওদের।
ছেলে, মেয়ে দুজনেই চূড়ান্ত অপমান করেছে বাবাকে। এত মিথ্যে কথা ওরাও সহ্য করতে পারে নি।
দেবজিত তো বলেই বসলো, ভাগ্যিস মায়ের ব্লাডটাও আমাদের শরীরে ছিল, নাহলে তো মিথ্যেবাদীর শিরোপা পেয়ে যেতাম, সঙ্গে প্রবঞ্চকের মুকুটটাও।
মনীন্দ্র এই সংসারেই আছে কিন্তু এক কোণে, যেখানে এতদিন কমলিকার স্থান ছিল, মনীন্দ্র আজ সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, একা, নিঃসঙ্গ ভাবে।
মনে মনে ভাবছিলো, কমলিকাকে হারাতে গিয়ে নিজের সব হারিয়ে ফেললো ও। এমন কি সম্মানটুকুও। দূর থেকেই শুনতে পেল কমলিকা বলছে,
একটা পরজন্ম চাই আমার।
নতুন করে মানুষকে বিশ্বাস করার শক্তি চাই।
ভালোবাসা শব্দের সঠিক অর্থ জানার জন্য
পরজন্ম চাই।
মুখোশ ছাড়া প্রেমিকের দৃষ্টিতে নিজেকে দেখার জন্য আরেকটা পরজন্ম চাই আমার।
ইচ্ছাপূরণের ঘুড়িটাকে ধরার জন্য পরজন্ম চাই।
এ জন্মের সব ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার জন্য
একটা পরজন্ম চাই আমার।
সমাপ্ত