।। ১।।
এখনও রান্না কমপ্লিট করতে পারোনি মা? সারাদিনে ওই একটাই তো কাজ করো তুমি, সেটাও পারছো না? তাহলে পাপাকে বলো একটা রাঁধুনি রেখে দিতে, সে অ্যাটলিস্ট টাইমলি খাবারটা দিতে পারবে।
এই তো রে ঈশা হয়ে গেছে। তুই গরম গরম ভেজ ডাল ভালোবাসিস বলেই তো…
মায়ের কথার মাঝেই ব্যঙ্গাত্মক ভাবে হেসে উঠলো দেবজিত। তুইও যেমন, মায়ের টাইম সেন্স কি করে থাকবে একটু বলবি? দিনরাত বাড়ির মধ্যে থাকে। দুটো অকাজ আগে পরে করলেই কি বুঝতে পারবে তার লাভক্ষতি! অফিসে যদি দশ মিনিট লেটে যাই তাহলে লালকালির দাগটা পড়বে সেটার অর্থ পাপা জানলেও মা তো বুঝবেই না রে পাগলী।
বোনের দিকে তাকিয়েই নিজের ফাইল গোছাতে গোছাতে কথাগুলো বললো দেবজিত। সে এখন সদ্য চাকরি পেয়েছে রেলে। এই বাজারে সরকারি চাকরি পাওয়ার পুরো ক্রেডিট গোজ টু মি বলে মাঝে মাঝেই গলা ফাটাচ্ছে সে। দেবজিত বলে, আমার কোনো গড ফাদার নেই, তাই নিজের যোগ্যতায় নিজেরটুকু ছিনিয়ে নিয়েছি।
ঈশা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, দাদাভাই তোর তো অফিস, আর আমার কথাটা একবার ভেবে দেখ, কবিতার রেকর্ডিং আছে। সব ইন্সট্রুমেন্ট রেডি করে স্টুডিও ভাড়া করে ভদ্রলোক বসে থাকবেন, দেরি হলেই পরের স্লট শুরু হয়ে যাবে, ভাবতে পারছিস? তুই হয়তো পারছিস, কিন্তু মা তো কোনোদিনই পারলো না বল। এখন আমি কি ডাল খেতে ভালোবাসি সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল।
এগুলোকে আমি ভালোবাসা বলি না বুঝলি দাদাভাই! আমি বলি অশিক্ষা, জাস্ট আনকালচার্ড।
ভাতের থালাটা সামনে ধরে দিতে দিতে কমলিকা নরম গলায় বললেন, একটু দেরি হয়ে গেল।
দেবজিত আবার বললো, এটা তো রোজকার চিত্র মা।
একটা কথা বলতো, বাবার আর আমার মাইনেতে এখন তো একজন রাঁধুনি রাখাই যায়, তাও কেন তুমি গোঁয়ার্তুমি করে সব কিছু নিজের হাতে করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছ, কে জানে!
দেবজিতের সামনে খাবারটা ধরে দিতে দিতেই রান্নাঘরের সাজানো তাকগুলোর দিকে আড়চোখে তাকালো কমলিকা। না, এখনো কোনো ছায়ার আধিপত্য নেই রান্নাঘরের চৌকাঠে। কাঠের ডাইনিং টেবিলের চারটে চেয়ারের দিকে তাকালো ও। ঈশা, দেবজিত, মনীন্দ্র তিনজনে তিনটে চেয়ারে বসে আছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত আরেকটা চেয়ারে বসতেন মনীন্দ্রর মা, পুষ্পবালা দেবী।
বছর দুয়েক হলো এ সংসারের মায়া ত্যাগ করে তিনি স্বর্গালোকে যাত্রা করেছেন। তারপর থেকে ওই চেয়ারটা ফাঁকাই পড়ে আছে। কমলিকার চেয়ারে বসে একসাথে সবার সাথে খাবার অভ্যাসটা আর তৈরি হয়নি।
ঈশা হবার আগে অবশ্য শ্বশুরমশাই বসতেন এখন ঈশা যে চেয়ারটায় বসে আছে সেটাতে। তখনও কমলিকা সবাইকার খাওয়া হলে শেষে ওই হাঁড়ি কুড়ি নিয়ে বসে কোনোমতে খাওয়া শেষ করতো।
কাজের মাসি এসেই চেঁচাবে, তাই নিজের খাওয়ার থেকেও সব বাসনগুলো টিউবওয়েলের নীচে ভিজিয়ে রাখাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওর কাছে। তখন এ বাড়িতে সিঙ্ক ছিল না। উঠোনের একপাশে ছিল একটা টিউবওয়েল। ওখানেই বাসন মাজতো ঠিকে ঝি। যেদিন সে কামাই করতো সেদিন বাধ্য হয়ে কমলিকা নিজেই মেজে নিত। বেশ কিছু অভ্যেস তাই ওর এ বাড়িতে তৈরিই হয়নি।
রিনা, এই রিনা, আমার খাবারটা দিয়ে দাও প্লিজ।
মনীন্দ্র খবরের কাগজ হাতে খাবার টেবিলে বসলো।
ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল, আজ তো তোর রেকর্ডিং আছে, তাই না?
কমলিকা ভাত বাড়তে বাড়তে ভাবছিলো, মনীন্দ্র ছেলে মেয়ের বিষয়ে খুঁটি নাটি সব জানতে পারে, অন্ধকারে থাকে শুধু কমলিকা। ওকে ইদানিং ছেলে মেয়েরা আর কিছুই বলে না। যেটুকু ওদের নিজের আলোচনা থেকে কানে আসে আরকি।
কি হলো গো রিনা, তাড়াতাড়ি কর!
রিনা, না কমলিকার ডাক নাম রিনা নয়। বাবা ওকে আদর করে কমল বলে ডাকতো, মা ডাকতো কলি।
রিনা নামটা এ বাড়ির দেওয়া।
বিয়ের প্রথম দিন এ বাড়িতে ঢোকার পরই শাশুড়ি হাসি মুখে সকলকে বলেছিলেন, বৌমার নাম পরিবর্তন করলাম, আমার ভাসুরের মেয়ের নামও কমলিকা, একই বাড়িতে দুটো কমলিকার কি দরকার বাপু, তাই বৌমার নামটা পরিবর্তন করে রিনা রাখলাম। শুনে নাও, সবাই আজ থেকে ওকে রিনা বলে ডাকবে।
এই কমলিকা, তুইও বৌদিকে রিনা বৌদি বলবি বুঝলি!
কমলিকা নামের ননদটি একমুখ হেসে বলেছিল, সেই ভালো, আমার বাবা কত শখ করে আমার এই নাম রেখেছিলো, আমি কখনো আমার নাম চেঞ্জ করবো না বাবা, তার থেকে বরং বৌদিরটাই পরিবর্তন হোক।
কমলিকা দাসগুপ্তর নাম পরিবর্তন করে হয়ে গেল রিনা সেন। তেইশ বছরের পরিচিত বাড়ি, চিরপরিচিত মানুষগুলোকে সদ্য ছেড়ে আসার কষ্টের সাথে আরেকটা কষ্ট যোগ হলো। রীতিমত আইডেনটিটি ক্রাইসিস।
তখনও কলেজের বন্ধুদের ডাক শুনতে পাচ্ছে কানে—কমলিকা চল ক্যান্টিনে।
প্রফেসর ঢুকেই বললেন, কমলিকা দাসগুপ্ত প্লিজ কাম হেয়ার।
আস্তে আস্তে শ্রবণেন্দ্রিয় অভ্যস্ত হচ্ছিল রিনা নামটার সাথে। ভুলছিলো কমলিকাকে। প্রথম প্রথম এ বাড়ির সবাই যখন রিনা বলে ডাকত, কমলিকার মনে হতো ওকে নয়, অন্য কাউকে ডাকছে।
দুবার তিনবার ডাকার পরে আচমকা নিজের নতুন নাম মনে পড়ে গিয়ে সাড়া দিয়ে উঠতো।
হারিয়ে গেছে কমলিকা। কাগজে কলমে শুধু নয়, নিজের মন থেকেও যেন মুছে দিয়েছে ওর নিজের নামটাকেই। এতবছরের পরিচিতি ভুলে নতুন নামে অভ্যস্ত হতে হলো ওকে।
মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, বিয়ে তো মনীন্দ্রও করলো, ওর তো সারনেম বদলালো না, পরিবর্তন হলো না তো ওর নামের। কমলিকার এক দূরসম্পর্কের মেসোমশাইয়ের নাম মনীন্দ্র, তার কারণে তো কমলিকার বাড়িতে পাল্টে গেল না মনীন্দ্রর নাম। বিয়ে কি শুধু কমলিকারই হলো!
হাতে শাঁখা, পলা, নোয়া, সিঁথিতে সিঁদুর, নামের পরিবর্তন সব কিছু শুধুই ওর হলো! মেনে নিয়েছিল কমলিকা, ভালোবেসেছিল যে মনীন্দ্রকে। আপন করে পেতে চেয়েছিল ওকে। ওর মনে একাধিপত্য বিস্তার করার জন্য নিজের সবটুকু পরিবর্তন করতেও পিছপা হয় নি কমলিকা।
।। ২।।
আজকেও তুমি লেট করে ফেললে ঈশা! নাও তাড়াতাড়ি করো। প্রবুদ্ধ গাড়িতে স্টার্ট দিয়েই বললো, এবারে তো আমাদের বিষয়টা বাড়িতে জানিয়ে দিতে পারো, এই তোমার বাড়ি থেকে তিনহাত দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাপিত্যেস করে বসে থাকতে হয় না তাহলে। তোমার মায়ের হাতের ডেলিসিয়াস খাবার দাবার সেনবাড়ির উডবি জামাইয়ের পাতেও একটু আধটু পড়ে আর কি!
সিটবেল্টটা লাগাতে লাগাতে ঈশা আদুরে ভঙ্গিমায় বললো, আর কটা দিন ডিয়ার, আমার এম বি এ কমপ্লিট হলেই বলবো, আসলে পাপা আমায় একটু বেশিই প্রশ্রয় দিয়েছে জীবনে। এখন যদি শোনে আমি তাঁর স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে প্রেম করে বসে আছি তাহলে হয়তো একটু অফেন্ডেড হবে, তাই একটু টাইম নিচ্ছি, বাড়িতে বিয়ের কথা উঠলেই টুপ করে বলে দেব।
প্রবুদ্ধ সামনের বাসটার উদ্দেশ্যে জোরে হর্ন দিয়ে বললো, আর তোমার মা? তাকেও তো বলতে পারো।
ঈশার ঠোঁটে ব্যঙ্গাত্মক হাসি ফুটলো!
মা আবার কি বলবে? পাপার মতটাই আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট, মা কবেই কি বুঝলো, আজকেই মায়ের রান্নার দেরি হলো বলেই আমারও দেরি হলো জানো?
প্রবুদ্ধ হেসে বললো, এটা তো রোজকার ঘটনা ঈশা।
ঈশা বিরক্তিতে মুখটা বেঁকিয়ে বললো, কি বলবো বলো, এই ভদ্রমহিলা বোধহয় কিছুতেই চান না, আমি প্রতিষ্ঠিত হই। তুমি জাস্ট ভাবতে পারবে না প্রবুদ্ধ, গত পরশু আমি ঘরের মধ্যে মোবাইলে আজকের কবিতাগুলো রেকর্ড করছিলাম, বারবার শুনলে ভুলগুলো ঠিক হয়ে জিনিসটা নিখুঁত হয় তাই, মা চা দিতে ঘরে এসে বলে কিনা, ঈশা, পৃথিবী, ধরিত্রী এই কথাগুলো যখন উচ্চারণ করবি তখন দৃঢ় অথচ সম্মানের সাথে উচ্চারণ কর। মা ছোটবেলায় আমায় কবিতা শিখিয়েছিল। তারপর অবশ্য পাপার জন্যই আমি প্রফেশনাল টিচারের কাছেই শিখেছি। তবুও মা সেই ছোটবেলার মত এখনও আমায় শেখাতে আসে! হাসবে না কাঁদবে তুমি বলো!
আমার নিজস্ব ইউটিউবের চ্যানেলে কত ভিউয়ার মা জানে না, লোকজন জাস্ট পাগল আমার কবিতা আবৃত্তি শোনার জন্য, সেখানে ওই রিনা সেনের কাছ থেকে আমায় শিখতে হবে কেমন করে কবিতা বলবো, কেমন করে শব্দ উচ্চারণ করবো! ক্যান ইউ ইমাজিন প্রবুদ্ধ!
নেহাত মা বলেই আমি অপমান করিনি, জাস্ট ইগনোর করলাম। প্রবুদ্ধ বললো, কুল ডাউন বেবি, আজ তোমার রেকর্ডিং আছে। মনটাকে শান্ত করো প্লিজ। আর এটা কিন্তু তোমার আগের মত শুধু ইউটিউবের জন্য রেকর্ডিং নয়, এই প্রথম কোনো নামি পরিচালকের মুভিতে তোমার গলা ব্যবহার করবে ওরা।
ঈশা আদুরে গলায় বলল, মিস্টার অর্কপ্রভ ব্যানার্জীকে তো আমি চিনতামই না, তুমিই পরিচয় করিয়ে দিলে, ইনফ্যাক্ট এই ইউটিউবে নিজের রিসাইটেশন চ্যানেল খোলার প্ল্যানটাও তো তোমার ছিল, নাহলে হয়তো পাড়ার স্টেজেই প্রশংসা কুড়িয়ে বেড়াতে হতো।
প্রবুদ্ধ বললো, কিন্তু ঈশা ওই পাড়ার স্টেজে তোমার কবিতা শুনেই কিন্তু আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। সেটা ভুলে গেলে চলবে না কিন্তু।
ঈশা মুচকি হেসে বললো, আমি পিছনের দিকে তাকাতে মোটেই ভালোবাসি না প্রবুদ্ধ, তুমি তো জানো।
আমি সামনে পা বাড়িয়ে সিঁড়ির উঁচু ধাপে উঠতে চাই।
এই, বললে না তো অর্কপ্রভর সাথে তোমার আলাপ কি করে!
প্রবুদ্ধ রাস্তার দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে বললো, আমার অফিসে এসেছিলেন ভদ্রলোক, বেশ মিশুকে মানুষ, আমার থেকে বয়েসে হয়তো বছর দুয়েকের বড়ই হবেন, একটা সেট সাজাতে চান, তাই ইনটিরিয়ার ডেকোরেশনের জন্যই এসেছিলেন, তখনই কথায় কথায় বললেন, নতুন মুখ, নতুন সেট, নতুন গলা ব্যবহার করতে চান, ছবির গানগুলো গাওয়াচ্ছেন নাকি কোনো এক অপরিচিত অথচ ট্যালেন্টেড গায়ককে দিয়ে, তখন এটাও বললেন, গোটা তিনেক কবিতা আছে আমার মুভিতে, মেয়েটি একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বালাবে আর নেভাবে… কি ধরনের আলো দেওয়া উচিত বলুন তো আপনি?
তখন আমি বললাম, কবিতার জন্য নতুন গলা যদি না পেয়ে থাকেন তাহলে একজনের গলা শুনতে পারেন, দিয়ে মোবাইল থেকে তোমার বলা গোটা দুয়েক কবিতা শোনাতেই ভদ্রলোক বললেন, ব্রিলিয়ান্ট, তারপরেই তো অডিশনে ডাকলো তোমায়। আর আজ একেবারে রেকর্ডিং।
ঈশা হালকা করে হাতটা ধরলো প্রবুদ্ধর, নরম গলায় বলল, তুমি ছিলে বলেই এসব সম্ভব হচ্ছে।
প্রবুদ্ধ স্টুডিওর সামনে গাড়িটা পার্ক করিয়ে বললো, লাভ ইউ ঈশা, তুমি আরও এগিয়ে যাবে, বেস্ট অফ লাক, তোমার হয়ে গেলে আমায় কল করো, আমি যদি নাও আসতে পারি তাহলে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দেব, তোমায় বাড়িতে ড্রপ করে দেবে, আপাতত আমি অফিসে যাচ্ছি।
ঈশা কাঁচুমাচু মুখ করে বললো, নার্ভাস লাগছে যে! প্রবুদ্ধ মুচকি হেসে বললো, লক্ষ্যের দোরগোড়ায় পৌঁছালে এমন একটু আধটু হয়, তাড়াতাড়ি যাও, অলরেডি তুমি লেট আছো টেন মিনিটস।
কুর্তির ওপরে স্কার্ফটা ঠিক করে নিয়ে স্টুডিওর দিকে হাঁটা দিলো ঈশা।
এর আগে যা কিছু রেকর্ড করেছে সবেতেই প্রবুদ্ধ ছিল, তাছাড়া ওগুলো সবই ঈশার নিজের চ্যানেলের জন্য, এই প্রথম ওর কণ্ঠ, ওর আবৃত্তি ব্যবহার করা হবে মুভির নায়িকার গলায়, একদিকে প্রাপ্তি অন্যদিকে টেনশনের একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে ভাসছিল ঈশা, মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রবুদ্ধর সাথে প্রথম আলাপের মুহূর্তগুলো।
।। ৩।।
অফিসে ঢুকতেই বিকাশদা বললো, আরে দেবজিত তোমায় তো একটা কথা বলাই হয়নি ডিয়ার, সামনের সপ্তাহে আমাদের ডিপার্টমেন্টের মুখার্জীদার রিটায়ারমেন্ট উপলক্ষ্যে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রাখা হয়েছে, এমনি কিছুই নয়, আমরা সবাই যে যেরকম পারি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করব, ওই হেঁড়ে গলায় গান থেকে শুরু করে কবিতা, গল্প পাঠ যা ইচ্ছে। তো তোমরা এবারে একেবারে ফ্রেস ক্যান্ডিডেট, তাই তোমাদের মত ইয়ংদের তো পার্টিসিপেট করতেই হবে। আমাদের চিফ যেহেতু বাঙালি তাই ওনার এসবে বেশ ইন্টারেস্ট আছে, এর আগেও বড় সাহেবের জন্মদিনে আমরা একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান করেছিলাম।
দেবজিত নিজের ব্যাপারে বরাবরই পারফেকশনিস্ট, অফিস ঢোকার সময় পালিশ জুতোয় সামান্য ধুলোর দাগ লেগে থাকলেও ওর মনটা খুঁতখুঁত করে, মাথার চুল থেকে জুতোর লেস পর্যন্ত নিখুঁত চাই ওর, সাজগোজ নয়, এটাকে ও পারফেকশন বলে। যখন দেবজিত বেশ ছোট, ওই ক্লাস সিক্সে পড়ে যখন রাত এগারোটা মানে ওর কাছে মধ্যরাত, তখন একদিন ঘুম চোখে দেখেছিলো মা ওর স্কুলের ড্রেসটা আয়রন করছে। গরম ইস্ত্রি দিয়ে প্রেস করছে ওর ড্রেসের কলারটা। পরেরদিন মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি অত রাতে আমার স্কুলড্রেস আয়রন কেন করছিলে?
মা হেসে বলেছিল, পোশাক-আশাক পুরোনো হোক, কিন্তু পরিষ্কার ঝকঝকে পরবি, তাহলে দেখবি আত্মবিশ্বাস জন্মাবে, সবার সামনে দাঁড়িয়ে যদি নিজের পোশাকের প্রতি চোখ পড়ে মনে হয়, এমা, কি অগোছালো! তাহলে কথা বলার সময় গলার স্বর কেঁপে যাবে! কনফিডেন্স লেভেল যাবে নেমে। তাই নিজেকে সবসময় স্মার্টলি প্রেজেন্ট করবি। ওই ছোট্ট মাথায় কথাগুলো ঢুকে গিয়েছিল দেবজিতের।
বুঝেছিলো কোঁচকানো অপরিস্কার জামায় আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়। বাবা অবশ্য বলতো, সবেতেই তোর মায়ের বেশি বেশি, ছোট ছেলে তার স্কুলড্রেসও নাকি আয়রন করতে হবে। আমরা তো কোনোদিন এসব করে স্কুলে যাইনি। কিন্তু মায়ের আর সব শাসন দেবজিতের খারাপ লাগলেও এটা বেশ ভালো লাগত। বিনা কোঁচের বকের পালকের মত সাদা স্কুলড্রেসটা পরার পরেই ওর মনে হতো, ভালো করে পড়া বলতে হবে, স্যারেরা যেন পড়া করিসনির দলে ওকে না ফেলতে পারেন। সেই থেকেই নিজের সব ব্যাপারে দেবজিত বড্ড নিখুঁত।
এমনকি ওর ঘরটাকেও ও সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পছন্দ করে। ঈশার ঘরে ঢুকলেই বোঝা যায়, এলোমেলো অগোছালো একটা ব্যাচেলর মেয়ের ঘর। কিন্তু দেবজিতের বিছানার চাদর নিভাঁজ, টেবিলের বইপত্র গোছানো, ঘরের কোনো ফার্নিচারের ওপরে জমে নেই রোজকার আলগা ধুলোটুকুও।
বড্ড গোছানো দেবজিত। তাই বিকাশদার এই ঘরোয়া অনুষ্ঠানের মাত্র পঞ্চাশ জন দর্শকের সামনে হলেও দেবজিতের কাছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। হেঁড়ে গলায় বেতালা গান ও গাইতে পারবে না। এই কদিন নিজেকে তৈরি করতে হবে। আর নাহলে দর্শকাসন অলংকৃত করবে বরং। কিন্তু নিজেকে নিখুঁত ভাবে তৈরি না করে কিছুতেই মাইক ধরবে না ও। ছোটবেলায় মায়ের কাছেই ওরা দুই ভাইবোন কবিতা আবৃত্তি শিখত। দেবজিতের তখন ক্লাস নাইন, দুই ভাই বোনই একটা প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছিল। ঈশা হয়েছিল ফার্স্ট আর দেবজিত থার্ড। সেদিনই দেবজিতের মনে হয়েছিল, মা বোধহয় ঈশাকে একটু বেশিই যত্ন করে শিখিয়ে দিয়েছে। নাহলে ওর থেকে দুবছরের ছোট ঈশা কি করে ফার্স্ট প্রাইজটা ছিনিয়ে নিলো।
তখন থেকে ঈশা কবিতা বলতে গেলেও দেবজিত যায়নি। মা বারবার জিজ্ঞেস করায় একটাই উত্তর দিয়েছিল, আমি তোমার কাছে কবিতা শিখতে চাইনা, তুমি ঈশাকে বেশি যত্ন নিয়ে শেখাও, দুনম্বরি মানুষের কাছে আমি চাইনা শিখতে। স্তম্ভিত মা, ধীর পায়ে পিছু হটেছিল ওর ঘর থেকে। তারপর থেকে ঈশার বলা কবিতা শুনলেও নিজে আর কখনো করেনি। তবে ওটা ওর ভালোলাগার একটা জিনিস।
মনে মনে স্থির করলো দেবজিত, এই অনুষ্ঠানে ও একটা কবিতাই বলবে। কারোর সাহায্য ছাড়াই বলবে।
একা একাই নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে চেয়েছে ও। সেখানে রিনাদেবীর হস্তক্ষেপ ওর মোটেও পছন্দ নয়। তবুও কিছু ব্যাপারে নিতেই হয়েছে সাহায্য। আজও হয়। যেমন অফিসে আসার আগে মায়ের রান্না খাবার খেয়ে আসতে হয়, ওর জামা প্যান্ট ওয়াসিং মেশিনে মা-ই কেচে দেয়। নিঃস্পৃহভাবে রিনাদেবী করে সংসারের সব কাজ। আর তার থেকেও বেশি বিরক্ত হয়ে সেসব উপকার গ্রহণ করে দেবজিত।
মনের মধ্যে হালকাভাবে একটা প্রশ্নের আভাস ভেসে এলো। নিঃস্পৃহ ভাবে? নাকি একটু বেশিই যত্ন করে! কবে থেকে যে মায়ের সাথে দেবজিতের সম্পর্কটা এমন বরফ শীতল হয়ে গেল কে জানে!
ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরে স্কুলের সব গল্প মাকে না বললে যেন ওর শান্তি হতো না। মা ওকে ভাত মেখে খাইয়ে দিত আর দেবজিত বকবক করে বলে যেত স্কুলের গল্প। দাদু, ঠাকুমা, বাবা, বোন কেউ না শুনতে চাইলেও মা সবটা শুনত চোখ বড় বড় করে, মাঝে মাঝে কৌতূহলের বশে প্রশ্নও করতো, তারপর?
ক্লাস টিচার ওই দুষ্টু ছেলেটাকে কতটা বকলো বল জিত?
দেবজিতও ততোধিক উৎসাহের সাথে বলতো ওর বীরপুরুষ হওয়ার কাহিনী। একমাত্র মায়ের কাছেই পেত সবরকম প্রশ্রয়। আবার দুষ্টুমি করলে বকুনি জুটতো কপালে। কবে যে ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরি হলো মায়ের সাথে, কবে যে মাকে মনে মনে রিনাদেবী বলে ডাকতে শুরু করলো কে জানে। স্মৃতির খাতায় অকারণেই মুখ ডুবিয়ে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলো দেবজিত।
বেশ কিছু এলোমেলো ঘটনা প্রবাহ এসে উপস্থিত হলো ওর দৃষ্টিপথে। ছোটবেলায় দেবজিত চাইতো মাকে জড়িয়ে ধরে রাতে ঘুমাতে। মাও তাই চাইতো। সন্ধ্যে থেকেই দুজনের চোখের ইশারায় রাতের গল্পের বুনন তৈরি হতো। ওদের একটা অলিখিত চুক্তি ছিল। যেটা বাড়ির আর কেউ জানতো না। এমনকি পাশে শুয়ে বাবাও বুঝতে পারতো না। ওদের ওই চুক্তিতে বলা ছিল, একদিন মা গল্প বলবে একদিন জিত।
মায়ের তো গল্পের অনেক স্টক। কিন্তু জিতও হারতে চায় না। তাই স্কুলের পড়ার পরে গল্পের বই নিয়ে বসে যেত। মায়ের চোখের আড়ালে দাদুর ঘরে তাড়াতাড়ি পড়ে নিত ঈশপের কোনো গল্প অথবা আরব্য রজনী। রাতে সেটাই মায়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বলতো দেবজিত।
মা অবাক হয়ে শুনত আর বলতো আস্তে বলবি, বাবা সারাদিন খেটে খুটে আসে তো, ঘুম যেন না ভেঙে যায়।
বাবার নাকি নিশ্চিত ঘুমের দরকার। দেবজিতের ছোট্ট মনে প্রশ্ন জাগত, কেন? মা তো সারাদিন বাড়িতে এত কাজ করে তাহলে ঠাকুমা কেন বলে, তোর বাবাকে সেই কোন সকালে উঠে বেরোতে হয়। সারাদিন কত পরিশ্রম করতে হয়। বাবা তাই নটার মধ্যেই খেয়ে নিয়ে বিছানায় চলে যেত। দেবজিত আর ঈশাও বাবা ঘরে ঢুকলেই শান্ত হয়ে যেত। মা তারও ঘন্টা দুয়েক পরে ঘুমাতে পেতো।
সব ঘরে জলের বোতল দিয়ে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে, ঈশা, দেবজিতের স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে, ড্রেস রেডি করে, দাদুর ওষুধ দিয়ে তবে মা এসে শুতো। ঈশা বরাবরই দাদু ঠাকুমার ঘরে ঘুমাতে যেত কিন্তু দেবজিত ঘুমঘুম চোখে অপেক্ষা করতো মায়ের জন্য।
মা ক্লান্ত হয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিত। তখনই দেবজিত বলতো, মা গল্প বলো!
মা ওকে জড়িয়ে ধরে বাবার ঘুম না ভাঙিয়ে অত্যন্ত সচেতন ভাবে বলতো রাজা রানী আর রাজকুমারীর গল্প। বেশির ভাগ দিন গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে যেত দেবজিত। আবার সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙে দেখতো, বাবা অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। আর মা রান্নাঘরে ছুটো ছুটি করছে। বাবার ভাত, দুপুরের টিফিন সব করতো। দেবজিত ভাবত মা কি রাতে ঘুমায় না?
দেবজিত ঘুমিয়ে গেলেই কি মা ওর পাশ থেকে উঠে চলে যায় রান্নাঘরে! প্রশ্নগুলো ছোট্ট মাথায় যখন নড়াচড়া করতো তখন ঠাকুমা বলতো, দাদুভাই তুমিও এবার থেকে ঈশার মত আমার কাছে শুয়ে পড়বে। আমাদের ঘরে কত বড় খাট বলতো!
দেবজিত ঘাড় নেড়ে বলতো, কিছুতেই না। পিটপিট করে তাকাত মায়ের দিকে। মা হালকা গলায় বলতো, থাক না মা, আপনার ছেলের ঘুমের ব্যাঘাত তো আমি বা জিত কেউই ঘটাইনি, তাহলে থাক না!
ঠাকুমা বেশ কঠিন স্বরে বলতো, মনি আমায় বলেছে ওর অসুবিধা হয়। মা আর কিছু বলেনি ঠাকুমার মুখের ওপর। দেবজিতের রাতে ঘুমের জায়গা আলাদা হয়েছিল। মা নির্লিপ্ত ভাবে মেনেও নিয়েছিল ঠাকুমার কথাগুলো। মনে মনে একরাশ ঘৃণা জন্মেছিল দেবজিতের যখন স্কুলের বন্ধু রণদেব বলেছিল, আরে বোকা, তোর বাবা মা একসাথে প্রেম করবে বলেই না তোকে সরিয়ে দিল! দেবজিত মৃদু গলায় প্রতিবাদ করে বলেছিল, কিন্তু বাবা তো ঘুমিয়ে পড়ে। মা একাই জেগে থাকে। রণদেব হেসে বলেছিল, তুই হলি বুদ্ধু। ক্লাস সিক্সের দেবজিতের মনে অনেকটা কষ্ট জমেছিল। ঠাকুমার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো, আচ্ছা ঠাকুমা, বাবা, মা দুজনেই কি চায় আমি ঐ ঘরে আর না ঘুমাই?
ঠাকুমা জিতের গায়ে ঢাকাটা টেনে দিয়ে বলেছিল, হ্যাঁ রে পাগল দুজনেই চায়। মুখোশ পরা মাকে সেদিন থেকেই মনে মনে রিনাদেবী বলে ডাকতে শুরু করেছিল জিত।
আড়ালে জিতকে মা বলেছিল, দাঁড়া না দুদিন পরেই ঠাম্মার কাছ থেকে আমি তোকে আমার ঘরে নিয়ে আসবো, আবার শুরু হবে আমাদের গল্পের ঝুলি, জিতও আশায় দিন গুনছিলো, অথচ বাবার সাথে মাও নাকি ঠাম্মাকে বলেছে, জিত ওঘরে থাকলে মায়েরও অসুবিধা হয়, মুহূর্তে বড় হয়ে গিয়েছিল জিত, স্কুলের রণদেবের যুক্তিগুলো আর ঠাম্মার বলা আপাত নিরীহ কথাগুলো নিজের মত করে সাজিয়ে চিনতে পেরেছিল মায়ের আসল মুখোশটা, মা ডাকটাতেই কাঠিন্য এসেছিল।
আচমকা একদিন জিত বলে বসেছিলো, মা আর আমাদের গল্পের ঝুলি খোলার দরকার নেই, তুমি বরং বাবার সাথেই গল্প করো, আমি বোন আর ঠাম্মার সাথেই থাকবো। মায়ের চোখে কি অসহায় একটা নীল কষ্ট দেখেছিলো সেদিন! আক্রোশে সেই কষ্টটুকুকে প্রবল উত্তেজনায় উপভোগ করেছিল জিত।
এমন অনেক টুকরো টুকরো ঘটনার সমাহারই মাকে রিনাদেবী বা ভদ্রমহিলা বলতে বাধ্য করেছিল জিতকে। মাও আর জোর করে মুঠো শক্ত করে ধরে রাখতে চায়নি জিতকে। নিঃস্পৃহ ভাবে ছেড়ে দিয়েছিল সন্তানের প্রতি মায়ের স্বাভাবিক অধিকারটুকুও।
ঠাম্মার মারাত্মক প্রভাবেই বড় হচ্ছিল দেবজিত আর ঈশা। শুধু ওই ভদ্রমহিলা রুটিন মিলিয়ে ওদের স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে দিত, গরম ভাত বেড়ে দিত। কার কি পছন্দের তরকারি না বলতেও সেটা পাতে পড়তো এসে। মাঝে মাঝে হালছাড়া গলায় জিজ্ঞেস করতো, তোদের তো সামনেই এক্সাম, সন্ধেবেলা টিভির সামনে কেন বসেছিস!
ঈশা আর দেবজিতকে কষ্ট করে কিছু উত্তর দিতে হতো না। ঠাম্মা, দাদু কিংবা বাবা বিরক্ত হয়ে বলতো, একটু টিভি দেখলে কেউ জাহান্নামে যায় না। তোমায় চিন্তা করতে হবে না। মাও চিন্তা বাদ দিয়ে লেগে যেত সংসারের কাজে। দেবজিতের খুব ইচ্ছে হতো মা বকেঝকে আগের মত জোর করে ওকে পড়তে বসাক কিন্তু মা নির্লিপ্ত পায়ে গ্যাসে চায়ের জল বসাত। দূরে সরে যাচ্ছিল ওর চেনা মা টা।
মায়ের গায়ের মা মা গন্ধটা কেমন যেন অপরিচিত হয়ে যাচ্ছিল ওর কাছে। উৎকট হয়ে ধরা পড়ছিল রিনাদেবীর নিঃস্পৃহতা। দেবজিতও নিজের জগতে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। পড়াশোনা, স্কুলের হোমওয়ার্ক, খেলার মাঠ, নতুন পাওয়া বন্ধুত্বের স্বাদে রিনাদেবীর নাক গলানো একেবারেই না পসন্দ হয়ে উঠেছিল ওর। বরং টিফিন বক্সের বেশি যত্নই যেন অসহ্য হয়ে উঠছিল ক্রমে। দু হাত আর একটা ছোট্ট মন দিয়ে যতটা পারছিল দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল ওই মহিলাকে।
রিতেশদা টেবিলে ফাইলটা নামিয়ে দিয়ে বললেন, কি ব্যাপার দেবজিত, কি এত ভাবছো ভায়া?
স্মৃতির সারণী বেয়ে অনেকটা পথ পিছনে চলে গিয়েছিল দেবজিত। রিতেশদার ডাকে ফিরে এলো বর্তমানে। ধুর, কি সব ভাবছে। দেবজিত আবার কবে থেকে ওই ব্যক্তিত্বহীন মহিলাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলো! ভীষণ ভাবে সাকসেসফুল ও নিজের জীবনে, তাই আত্মবিশ্বাসে কোনোদিন ফাটল ধরতে দেবে না ও। ফাইলটা টেনে নিয়ে কাজে মন দিলো দেবজিত।
।। ৪।।
যত দিন যাচ্ছে রিনার সাথে বাস করাটা যেন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। বরফের মত শীতল মুখে অনুভূতিশূন্য চোখে ঘরের কাজ করে চলেছে। এর থেকে যদি দুটো ঝগড়া করতো, যদি দুটো গালমন্দ করতো তবুও বোধহয় মনে হত একটা মানুষের সাথে বাস করছে মনীন্দ্র। বিয়ের পর পর তো প্রায়ই নিজের মতামত প্রতিষ্ঠিত করার জন্য উঠেপড়ে লাগতো রিনা। ঈশা, দেবজিত হওয়ার পরেও প্রায়ই ঝামেলা লাগতো মনীন্দ্রর সাথে। কখনো ছেলেমেয়েদের কেন্দ্র করে, কখনো সংসারের খুঁটিনাটি। ইদানিং তো মনে হয় একটা রোবটের সাথে ঘর শেয়ার করছে ও। না রোবটেরও বোধহয় যান্ত্রিক আওয়াজ হয় একটা, কিন্তু রিনার ঠোঁট দুটো যেন কেউ ফেবিকল দিয়ে এঁটে দিয়েছে।
মাঝে মাঝে ওকে দেখে অবাক লাগে মনীন্দ্রর। এই সেই কলেজের কমলিকা দাসগুপ্ত, যাকে দেখে মনীন্দ্রর মনে হয়েছিল এক ঝলক উষ্ণ বাতাস। কনকনে শীতে ভীষণ আরামদায়ক। কিন্তু তীব্র গরমে পুড়িয়ে দেবে নির্ঘাত।
বিজয়বিহারী কলেজের গায়েই মনীন্দ্রর অফিস। মনীন্দ্র তখন সদ্য জয়েন করেছে চাকরিতে। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি, মাইনে বেশি দিলেও সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত খাটিয়ে নিত। বাড়ি থেকে ভোর ভোর উঠে নাকে মুখে গুঁজেই ছুটতে হত। বাবার ব্যবসায় ভরাডুবি হবার পরেই তড়িঘড়ি চাকরিতে ঢুকেছিলো মনীন্দ্র।
তাই হয়তো সেন পরিবার সামলে নিয়েছিল ব্যবসায় ভরাডুবি হবার ঝড় ঝাপটাটা। মনীন্দ্রর মাইনের টাকাতেই বিয়ে দিয়েছিল বোনের। অল্প বয়েস থেকেই সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে দায়িত্ব ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে জীবনটা শুরু করেছিল মনীন্দ্র। সেখানে কমলিকা যেন এক ঝলক টাটকা বেলফুলের সুবাস।
সত্যি বলতে কি মনীন্দ্র হিংসা করতো কমলিকার মত জীবনযাত্রা করা মেয়েদের। পৃথিবীর কোনো জটিলতা যার জীবনে প্রবেশ করেনি। হালকা পালকের মত অকারণেই উড়ছে, কারণবিহীন কারণে হেসে উঠছে উচ্ছল ঝর্ণার মত। একদল রঙিন প্রজাপতিকে রোজ দেখতো মনীন্দ্র অফিসের চেয়ারে বসে। তারমধ্যে সব থেকে আকর্ষণীয়া ছিল কমলিকা। দীঘল চোখে মায়াবী স্বপ্ন আঁকা, কাজলের টানে উড়ো মেঘের উদাসীনতা। হালকা রঙের চুড়িদার, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। দুই ভ্রুর মাঝে ছোট্ট একটা কালো টিপ। ওই মেয়েকে নজর লাগা থেকে আটকাতে টিপের প্রচেষ্টা জারি থাকতো সব সময়।
কমলিকার দিকে তাকালেই টিপটাতে চোখ আটকে যেত। ভেজা ঠোঁটে হালকা পিঙ্ক লিপস্টিক। অল্প সাজেই বড্ড নিখুঁত। ভগবান একচোখমী করেই গড়েছিলো কমলিকাকে, আরেকটু কম সুন্দর হলেও চলতো। অফিসের হাজার কাজের ফাঁকেও ওর কলেজ আসার সময়টুকু নানা আছিলায় জানালার ধারে দাঁড়াতো মনীন্দ্র। ওই এক পলক দেখার সুখটুকুই ছিল ওর একঘেয়ে জীবনের এক মুঠো বাতাস।
নিঃশ্বাস নেবার জন্য নয় এক্সট্রা অক্সিজেনের জন্যই প্রয়োজন ছিল মুহূর্ত চাউনির। যদিও কমলিকা কখনো দোতলার অফিসের জানালার দিকে তাকিয়েও দেখতো না। জানতই না কেউ তার আসা যাওয়ার সময় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে প্রতিটা পল। যেদিন কোনো কারণে কলেজ ছুটি থাকতো বা কলেজে আসতো না কমলিকা সেদিন হালকা মনখারাপ ছেয়ে রাখতো মনীন্দ্রর মনটাকে। আবার যখনই কমলিকাকে দেখতো মনীন্দ্র, তখনই ওর হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যেত। অসহ্য অবুঝ রাগে শিরা উপাশিরার রক্তরা হত দ্রুতগামী। কি সুন্দর মিষ্টি একটা জীবন। বসন্ত বাতাসে ভেসে বেড়ানো রূপকথার পরী যেন। মনীন্দ্রর মনে হত কমলিকার ঘাড় ধরে ওর রোজকার রুটিনটা দেখাতে, বোঝাতে চাইতো জীবন কার নাম। দায়িত্ব শব্দের মানে কি। এক ঝলক হাসি, একটুকরো অহংকারী দৃষ্টি আর রঙিন পোশাকের সমারোহ মানেই জীবন নয়। না পাওয়া শব্দটা বোধহয় কমলিকার নিজস্ব ডিকশনারিতে ছিলই না। নামটা অবশ্য তখন মনীন্দ্র জানতো না। শুধু হরিণ চোখের মেয়েটাকে দেখতো রাস্তায়, কলেজ যাওয়ার পথে। সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলবে ভাবে নি কোনোদিন। ভালোলাগার সাথে মারাত্মক আক্রোশ ছিল কমলিকাদের বন্ধু গ্রুপটার প্রতি। দেখেই বোঝা যেত সবাই বেশ অবস্থাপন্ন বাড়ির আদুরে ছেলেমেয়ে। এদের অন্তত দিনের শেষে মাসকাবারের হিসেব নিয়ে বসতে হয়না। বাবার অসহায় চাউনির দিকে তাকিয়ে বলতে হয়না, সামলে নেব।
ব্যবসায় ভরাডুবি হবার পর থেকেই বাবা একটু খিটখিটে আর অবুঝ হয়ে গিয়েছিল। সকলকেই চিটার মনে করতো। গোটা সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে স্বপ্নবিহীন দুটো চোখে হিসেব কষে কষে এগোচ্ছিল মনীন্দ্র।
তাই কমলিকাদের অকারণ হাসির শব্দ শুনলেই মনে হত, সারাজীবনের জন্য মুছে দিতে হবে ওদের হাসি।
যদিও জানতো ওই মেয়ের সামনে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কোনো দিনই মনীন্দ্র জোগাড় করতে পারবে না। দূর থেকে দেখা ছাড়া বিশেষ কিছু পাবার আশাও করেনি কোনোদিন। তবে মাঝে মাঝে ভিখিরীরও কোটি টাকার লটারি লাগে। ভাগ্যের চাকা আচমকা হিসেব না কষেই ঘুরে যায় বেনিয়মের ঘরে। তেমনই কোনো আয়োজন ছাড়াই কমলিকার সাথে পরিচয় হয়েছিল মনীন্দ্রর। এতটাই আকস্মিকভাবে ঘটেছিল পরিচয় মুহূর্তটা যে মনীন্দ্র সময় পায়নি নিজেকে গোছানোর। ওদের অফিসের বিশাখাদি সাংস্কৃতিকমনস্ক একজন মানুষ। তার উদ্যোগেই অফিসের জনা পাঁচেক বিজয়বিহারী কলেজের সোশ্যাল ফাংশনে উপস্থিত হয়েছিল। সেখানেই কাছ থেকে দেখেছিলো কমলিকা দাসগুপ্তকে।
একটা নীলচে শাড়িতে গোটা আকাশকে শরীরে জড়িয়ে কালপুরুষকে নিজের শাসনে রেখে মাটিতে পা ফেলে হাঁটছিল মেয়েটা।
চোখের তারায় সপ্তর্ষিমণ্ডলের রহস্যময়তা। ঠোঁটের হাসিতে নীহারিকার দাম্ভিকতা। ওরা পাঁচজন সামনের সারিতে বসেছিলো। বিশাখাদির সাথে পরিচয় ছিল কলেজের কোনো এক ইউনিয়ন লিডারের। তার দাক্ষিণ্যেই সামনের সারিতে বসতে পেরেছিল ওরা।
ঘোষক একটি হলদে পাঞ্জাবি পরা ছেলে। বছর একুশের ছেলেটা নিজেকে আইনস্টাইনের ভায়রাভাই মনে করেছিল মাইক হাতে। মনীন্দ্রর রাগে মুঠো শক্ত হচ্ছিল। কমলিকা ছেলেটার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে কিছু বলছিলো। ছেলেটিও সমর্থনে ঘাড় নেড়ে সায় দিচ্ছিল। এই সব বড়লোকের ছেলেমেয়েগুলো মনে করে গোটা দুনিয়াটা এদের ইশারায় নাচবে। ফাঁকা মঞ্চে ছেলেটার পদসঞ্চলনা বলে দিচ্ছিল, ছেলেটা ভীষণ অহংকারী। জীবনে কোনোদিন না শব্দটা শোনেনি। বেশ কিছুক্ষণ মাইক টেস্ট করার পর অনুষ্ঠান শুরু হলো।
বেশিরভাগই ইচড়ে পক্ক ছেলেমেয়ে। গিটার বাজিয়ে বেসুরো গান গাইছিল মাথা ঝাঁকিয়ে। শ্রোতাদের কেমন লাগছে সেটুকু জানার প্রয়োজনও নেই, নিজেরাই নিজেদের গানের সম্পর্কে বড্ড বেশি গুনগান করছিল। অসহ্য রকম বিরক্তিতে ভরে গিয়েছিল মনীন্দ্রর মনটা। ধুর, সন্ধেটা নষ্ট হলো বিশাখাদির পাল্লায় পড়ে।
মনটা যখন তিক্ততায় ভরে গিয়েছিল তখনই অ্যানাউন্স হয়েছিল, এবারে আপনাদের সামনে কবিতাবৃত্তি করবে কমলিকা দাসগুপ্ত।
ধীর পায়ে মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছিল মেয়েটা। যাকে অফিসের জানালা থেকে একবার দেখার জন্য আকুল হয়ে তাকিয়ে থাকে মনীন্দ্র। মনে হয় যেন দলছুট রূপকথার রাজকন্যা হাঁটছে রাজপথে।
এতদিনে মেয়েটার নাম জানলো মনীন্দ্র। কমলিকা দাসগুপ্ত।
স্টেজে উঠেই একটু ঝুঁকে নমস্কারের ভঙ্গিমা করে শুরু করলো কবিতা বলা।
মনীন্দ্র গানের ভক্ত, একঘেয়ে কবিতা পাঠ ওর নাপসন্দ। কিন্তু কমলিকা যখন বলছিলো,
আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণী,
তন্বী-নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম,
আমি ধন্যি!
চিত- চুম্বন-চোর-কম্পন
আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে
দেখা অনুখণ,
আমি চপল মেয়ের ভালবাসা, তা’র কাঁকন
চুড়ির কনকন
আমি চির-শিশু,
চির-কিশোর
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচলি..
নিচোর..!
তখন মনীন্দ্রর রোমকূপে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। সাধারণত বিদ্রোহী কবিতাটা ছেলেদের কণ্ঠেই শুনেছে মনীন্দ্র। তাই ধারণাই ছিল না, মেয়েদের নরম গলায় এই কবিতার প্রতিটি অক্ষর শ্রোতাদের স্পর্শ করতে পারবে। গোটা হলে পিন ড্রপ সাইলেন্স। কমলিকার দুচোখে জল। গলায় কাঁপন, দৃপ্ত কণ্ঠে বলে চলেছে—
মহা- বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল,
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি আমি সেই দিন হব শান্ত!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু,
ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা
খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব-ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু,
ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদ্রোহী বীর—
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
বেশ কয়েকটা কবিতা পর পর বলার পরে কমলিকা মঞ্চ ছাড়ল। মন্ত্রমুগ্ধের মত নিজের চেয়ার ছেড়ে গ্রীনরুমের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল মনীন্দ্র।
নিজের অবস্থানের কথা না ভেবেই উপস্থিত হয়েছিল কমলিকার সামনে। আচমকা আবেগতাড়িত হয়ে বলেছিল, ধন্য আপনার কবিতাবৃত্তি। কয়েকটা আবেগহীন শুষ্ক শব্দকে নিজের অনুভূতি দিয়ে বাঁচিয়ে তুললেন আপনি! এখনও ঘোর কাটেনি আমার।
কমলিকা লজ্জিত গলায় বলেছিল, আপনার ভালো লেগেছে? শুনে খুশি হলাম, সকলে বলে কবিতা নাকি আমার রক্তে, আমার মামা, মা সবাই ভালো কবিতা বলে, তাই এই একটা জিনিসই আমি পারি বিনাপরিশ্রমে।
মনীন্দ্র বলেছিল, জানিনা কি করে বোঝাবো আমার ভালোলাগা, তবে শুধু এটুকুই বলবো, জীবনে কখনো কোনো পরিস্থিতিতে কবিতার সাথে আড়ি করবেন না, তাহলে হয়তো থমকে যাবে আপনার জীবনের ছন্দ।
কমলিকা চোখ নিচু করে লাজুক গলায় বলেছিল, আরেকটু অপেক্ষা করুন, আমার একটা শ্রুতি নাটক আছে মিনিট কুড়ি পরে।
মনীন্দ্র তখনও আপ্লুত গলায় বলেছিল, তার আগে কথা দিন, আপনার যেখানেই প্রোগ্রাম থাকবে একবার অন্তত এই অধমকে খবর দেবেন, আপনাদের কলেজ ক্যাম্পাসের গায়েই এই অর্বাচীনের অফিস।
নাম মনীন্দ্র সেন, ছাপোষা কেরানী, কিন্তু স্বপ্ন দেখে আকাশ ছোঁয়ার। না না, আপনার মত রূপকথার রাজকন্যাদের সে দূর থেকেই দেখতে ভালোবাসে, তাই বদ উদ্দেশ্য আছে ভাববেন না যেন।
কমলিকা একটু অস্বস্তিতে পড়েই বলেছিল, পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো। মনীন্দ্র ফিরে এসে বসেছিলো নিজের চেয়ারে, বিশাখাদি বলছিলো, সত্যিই মেয়েটা জাস্ট ফাটিয়ে দিলো, এতক্ষণে বিরক্তিকর অনুষ্ঠানটাকে অন্য মাত্রা দিয়ে দিল, না এলে খুব মিস করতাম বুঝলে মনীন্দ্র।
মনীন্দ্র তখন নিজের রাজ্য থেকে অনেক দূরে, হালকা পালকের সাথে পাল্লা দিয়ে ভাসছিল।
ততক্ষণে শুরু হয়েছিল কমলিকা দাসগুপ্ত পরিচালিত এবং অভিনীত শ্রুতি নাটক। ফিমেল চরিত্র একা কমলিকা। আর তিনজন পুরুষ চরিত্রে ছিল দুজন লেকচারার আর একজন স্টুডেন্ট।
মনীন্দ্র কমলিকার স্বামীর চরিত্রে বসে থাকা সুপুরুষ প্রফেসরকে দেখছিলো। যেন দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনের দুজন মানুষ তাদের চাওয়া পাওয়া ভাগ করে নিচ্ছে পুরোনো বন্ধুদের সাথে। সাবলীল কমলিকা, গলায় এতটুকু জড়তা নেই। প্রফেসরও অদ্ভুত দক্ষতায় পাল্লা দিচ্ছিলেন কমলিকার সাথে।
নাটকের শেষের দিকে মনীন্দ্রর অকারণ ক্রোধটা বেশ জমিয়ে বসেছিলো। পাশাপাশি অনেকের ফিসফিস কথা কানে আসছিল মনীন্দ্রর। কি দারুণ মানিয়েছে দুজনকে।
মনীন্দ্র বুঝতে পারছিল একটু আগের ও ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছিল। খুব ইচ্ছে করছিল স্টেজে উঠে গিয়ে সকলের সামনে দিয়ে কমলিকাকে টেনে হিজড়ে নামিয়ে আনে বাস্তবের মাটিতে। মঞ্চের ওই স্বামী স্ত্রীর আদর আদর অভিমানী নাটকের সমাপ্তি ঘটুক মুহূর্তে।
মাথা চাড়া দিচ্ছিল ওর অদ্ভুত রোগটা। বাধ্য হয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে নাটকের শেষ পথেই ও উঠে পালিয়ে এসেছিল। খোলা হাওয়ায় বেশ কিছুক্ষণ পায়চারি করেছিল। রগের পাশের দপদপে যন্ত্রণাটা কমে এসেছিল যখন, তখনই আবার শুনতে পেয়েছিলো কমলিকার উচ্ছাস হাসির আওয়াজ। কয়েকটা বন্ধু আর সেই প্রফেসরের সাথে কলেজের গেট দিয়ে বেরোনোর সময় বলছিলো, পরের বার আরেকটু সিরিয়াস নাটক করবো স্যার। প্রফেসর আলগা হাসির ছলে বলছিলেন, তোমরা করো, আমি কেন প্রতিবার!
মনীন্দ্র শুকনো মাটিতে নিজের জুতোটা ঠুকেছিলো অসহায় রাগে। কমলিকার মত মেয়েদের দূর থেকে দেখা যায়, সামনে গিয়ে কবিতার প্রশংসা করা যায়, মনে মনে কল্পনার জাল বোনা যায় কিন্তু এদের ধরা যায়না ওর মত কেরানীর জীবন দিয়ে। তবুও সেদিন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, ভেঙে দেবে কমলিকার স্বপ্নগুলো। শুধু বুঝতে পারেনি কিভাবে ওই রূপকথার রাজকন্যার কাছাকাছি হবে!