দ্বিতীয় খণ্ড – ছিন্ন হস্ত
“I am forfeited to eternal disgrace if you do not commiserate.”
Go to, them, raise-recover.
— Ben Jonson—”Poetaster”
প্রথম পরিচ্ছেদ
পরদিন প্রাতঃকালে রামকুমারবাবু বহির্ব্বাটীতে বসিয়া আপনমনে কত কি চিন্তা করিতেছেন। একবার ভাবিতেছেন হয়ত তাঁহার কন্যাকে তিনি পুনৰ্জ্জীবিত দেখিবেন; আবার বিমলা তাহাকে পিতৃ-সম্বোধনে তাঁহার কর্ণরন্ধ্রে অমৃত ঢালিবে; আবার তিনি বালিকার কুসুমসুকুমার তনু নিজ বক্ষে ধারণ করিয়া—‘মা’ বলিয়া ডাকিয়া শোকদগ্ধ দীর্ণবিদীর্ণ হৃদয় শীতল করিবেন। শুষ্ক—লুপ্ত সুখোস আবার তেমনি সুধাশাস্তিস্নিগ্ধস্নেহ-প্রবাহিনী হইয়া বহিবে—সেই স্নেহ-আহ্বান আবার তাঁহার হৃদয়ের কন্দরে কন্দরে প্রতিধ্বনি তুলিবে। কখন বা আবার ভাবিতেছেন—সঞ্জীববাবু তাহাকে মিথ্যা কথা বলিয়াছেন—মিথ্যা আশ্বাস দিয়াছেন।
বেলা যখন নয়টা তখন সঞ্জীববাবু রামকুমারবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। রামকুমারবাবু সযত্নে তাঁহাকে নিজপার্শ্বে—উপবেশন করাইলেন। বিশেষ ব্যগ্রতার সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন, “সঞ্জীববাবু, আমার প্রাণের ভিতর দারুণ উৎকণ্ঠা—আমায় ভেঙে বলুন—আমাকে আশ্বস্ত করুন- বলুন—কি করে আপনি জানলেন, আমার বিমল বেঁচে আছে?”
স। একদিন আপনি সব জানতে পারবেন—একদিন আমার সকল কার্য্য—সকল প্ৰমাণ প্রতিপন্ন হবে। আমি এমন অনেক প্রমাণ পেয়েছি—যাতে আমি বেশ বুঝতে পারছি—আপনার কন্যার মৃত্যু ঘটে নাই।
রা। বিমলা বেঁচে আছে আমি ত এ কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি ত কেবল ক্রমাগত তার মৃত্যুর প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি।
স। আপনার কন্যাকে কে স্থানান্তরিত করেছে। যে ব্যাক্তি এ কার্যে লিপ্ত আছে, সে এখন কেবল যাতে আমরা বিশ্বাস করি যে আপনার কন্যা খুন হয়েছে—সেই চেষ্টা করে নানাবিধ খুনের প্রমাণ দেখাচ্ছে। ও কিছুই নয়—কোন চতুরের চাতুরী মাত্র।
রা। কি দেখে আপনি বুঝলেন্—যে এ সকল প্রমাণ মিথ্যা চাতুরী মাত্র।
স। সকলই। যা যা আপনার বাটীতে এসে এ পর্যন্ত আমি দেখেছি সকলই মিথ্যা। তাতে আরও স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে—এ খুন নয়—এক ভীষণ ষড়যন্ত্র। আপনার গৃহের দেয়ালে যে রক্ত ছিটানো ছিল—তা দেখে বেশ বুঝা যায় যে, কোন লোক তাহা স্বহস্তে ছিটায়ে দিয়েছে। আরও দেখুন—যে ছুরিকাখানি শয্যার উপর পড়ে ছিল, তা বেশ সযত্নেই রাখা হয়েছিল; এমন ভাবে রাখা হয়েছিল—যাতে ঘরে প্রবেশ মাত্র দৃষ্টিপথে পতিত হয়। আর সে ছুরি দ্বারা কখনও হত্যা করা হয় নাই—তা ছুরিখানি দেখিলেই বুঝা যায়। ছুরিতে কেহ রক্ত মাখায়ে দিয়েছে—ছুরির অগ্রভাগে রক্ত ছিল না। ছুরি বিদ্ধ হইলে—অগ্রে অগ্রভাগ বিদ্ধ না হয়ে একেবারে মধ্যাংশ বিদ্ধ হতে পারে না।
রামকুমারবাবু বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে সকল শুনিতেছিলেন। কথা সমাপ্তে কহিলেন,– “সঞ্জীববাবু! ধন্য আপনাকে, এ সকল আপনি অনুসন্ধান করে দেখেছেন। আমরা ত কিছুই বুঝতে পারি নাই। আপনি যা বলছেন—এখন তা আমার বেশ মনে লাগছে; আপনি যে একজন উত্তম কৃতবিদ্য ও নিপুণ ব্যক্তি—তা আপনার কার্য্যের প্রারম্ভে বুঝতে পেরেছি। যাই হোক—সঞ্জীববাবু- যাতে আমি বিমলাকে পাই তা আপনাকে অনুগ্রহ করে করিতেই হইবে।”
স। অনুগ্রহ আর কি মহাশয়—আমাদের কার্য্যই এই। আমি এমনি রহস্যে পড়েছি যে—অন্য চিন্তা করবার জন্য মুহূৰ্ত্তাৰ্দ্ধ কাল সময় নাই। আমি এতদূর উৎকণ্ঠিত হয়েছি—যে এই মুহূর্তে যেন সকল ষড়যন্ত্র ভেদ করে ফেলি; কিন্তু—বড় শক্ত ব্যক্তির এ কাৰ্য্যকলাপ! সহজে সিদ্ধ হব না। আর এই ছিন্ন হস্ত—যাতে আপনি শঙ্কিত হয়েছিলেন—এ আপনার কন্যার জীবনের প্রকৃষ্ট প্রমাণ বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে সেই ছিন্নহস্ত বাহির করিলেন।
রা। আমি ত এ ছিন্নহস্তের কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।
স। এ হস্ত কখনই আপনার কন্যার নয়। আপনার কন্যার বয়স ত্রয়োদশ আর এই ছিন্ন হস্ত কোন বিংশতি কিম্বা ততোধিক বয়স্থার হবে। এ হস্ত কোন মৃত রমণীর। আপনার কন্যার অঙ্গুরী— সংযোজিত করা হ’য়েছে মাত্র।
রা। এ কার্য্যে হত্যাকারীদের কি অভিপ্রায় সিদ্ধ হবে?
স। এর ভিতর গূঢ় অভিপ্রায় আছে—আপনার কন্যার মৃত্যু প্রমাণে তাদের সে অভিপ্রায় সিদ্ধ হবে।
রা। মতামহদত্ত সমস্ত বিষয়ের উপর নাকি?
স। আজ্ঞে—হাঁ।
রা। যদি আমার কন্যা জীবিত থাকিল, তবে তাদের উদ্দেশ্য কি প্রকারে পূর্ণ হবে?
স। তারা এখন অগ্রে মৃত্যু প্রতিপন্ন করতে চায়—পরে সে কাজ সমাধা করবে—এখন পেরে উঠে নাই; তাদের এই সকল ধূর্ততায় আমি এ কথা সহজেই বুঝতে পারছি। এখন আমাদের যা কর্তব্য আমরা তাই করবো।
রা। আমাদের এখন কৰ্ত্তব্য কি?
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – “রমল।”
রা। যখন ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝবে—তাদের ষড়যন্ত্র নিস্ফল হয়েছে, তারা তখন আমার বিমলাকে কি আর জীবিত রাখবে?
স। (সহাস্যে) যতদিন আমরা বিমলাকে উদ্ধার করে না আনতে পারি—ততদিন তাদের সে কথা আমরা কি জানতে দিব? আর তারাই বা কি করে জানবে? এখন শঠের সঙ্গে আমাদের শঠতা করতে হবে—সহজে কিছু হবে না। তারা যেমন নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করবার জন্য ক্রমশঃ বিমলার মৃত্যুর প্রমাণ দেখাচ্ছে—আমরাও তেমনি যেন বিমলার শবদেহ সন্ধানে ফিরছি—বাহিরে এরূপ দেখাতে হবে। কিন্তু ভিতরের যে অনুসন্ধান—পরিশ্রম তা আপনার কন্যাকে মৃত্যুর পূর্ব্বে উদ্ধার করা।
রা। কিন্তু সঞ্জীববাবু—তারা যে বিমলাকে বেশী দিন জীবিত রাখবে না, তা আমি বেশ বুঝতে পারছি।
স। সে ভার আমার উপর। এখন মৃতদেহ কোথায় দুষ্টেরা প্রোথিত করেছে—সেটা আমাদের দেখতে হবে।
রা। (সবিস্ময়ে ও ভয়ে) সে কি সঞ্জীববাবু, এই বল্ছেন ‘জীবিত আছে’ আবার বল্ছেন প্রোথিত করেছে’। তবে–কি করে আমি আমার কন্যা বিমলাকে জীবিত পেতে পারি।
সঞ্জীববাবু মৃদু হাসিয়া কহিলেন, “আমি যে মৃতদেহের কথা বলছি তা আপনার বিমলার নয়; যার এই ছিন্নহস্ত, তার মৃতদেহ সন্ধান করে দেখতে হবে। এখন আমরা যেন বিমলার মৃতদেহ উদ্ধার করবার চেষ্টা করছি এমনটা দেখিয়ে সেই মৃতদেহ বার করতে হবে। ইতিমধ্যে আরও আপনার বিমলার উদ্ধারের সুযোগ দেখতে হবে। কিন্তু সহজে আপনার কন্যার উদ্ধার হবে না- অনেক আয়োজন করতে হবে। আমাকেও একবার পূর্ব্বে প্রত্যক্ষ দেখতে হবে যে এই ছিন্নহস্ত আপনার কন্যার কি না। মোট কথা তারা যেমন পাতায় পাতায় বেড়াতেছে, আমাদের তেমনি পাতার শিরায় শিরায় বেড়াতে হবে, নতুবা কাৰ্য্যসিদ্ধ হওয়া অসম্ভব।”
রামকুমারবাবু কহিলেন, “সঞ্জীববাবু আপনার অদ্ভুত ক্ষমতা, আপনার উদ্যমে যে আমার কন্যা উদ্ধার হবে, তার আর আশ্চর্য্য কি?
স। জগদীশ্বরের কৃপায় এবং আপনার আশীর্ব্বাদে আমি শীঘ্রই সফলকাম হব—শীঘ্রই আপনার কন্যা বিমলাকে আপনি প্রাপ্ত হবেন।
রা। আমিও আপনাকে যথোচিত পুরস্কার দিব।
স। বেশ ত, যদি আপনার কৃপালাভ করা আমার অদৃষ্টে থাকে, শীঘ্রই আমি কৃতকাৰ্য্য হব। আপাততঃ আপনি আমার কথা কাকেও বলবেন না।
রা। সঞ্জীববাবু—এ ভয়ানক ষড়যন্ত্রকারীরা কে?
স। সময়ে অবগত হবেন।
রা। অঙ্গে মৃতদেহ সন্ধানের আবশ্যক কি? অগ্রে বিমলাকে উদ্ধার করুন।
স। অগ্রে যদি মৃতদেহটী (যাহার হস্ত ছিন্ন করিয়া লওয়া হইয়াছে, তাহার) বার করা যায় তাহলে অনেক সুবিধা হয়। আপনি সেই মৃতদেহ, যা এত দিনে–বিকৃত হয়ে পড়েছে—আপনি তাহাই আপনার কন্যা বোধে গ্রহণ করবেন—চিনবেন—সৎকারও করবেন; তাহলে তাদের মনে দৃঢ় প্রতীতি জন্মাবে যে, তাদের অভিপ্রায় সিদ্ধপ্রায়; আমাদের উদ্দেশ্যও সফল হবে।
রা। মহাশয় কি কিছুই জানতে পারেন নাই।
স। কতকটা জানতে পেরেছি সে কিছুই নয়। “আমাকে বলুন।”
“এখন নয়—সময়ে জানাব।”
“সঞ্জীববাবু—গোয়েন্দারা প্রায় নানাপ্রকার ছদ্মবেশ ধারণ করে। আপনি যদি কখন ছদ্মবেশ ধরেন; আমি কি করে আপনাকে চিনতে পারবো?”
“আমি ছদ্মবেশে খুব অল্পই কাজ করি। বুদ্ধির অভাব হলেই—প্রায় সাজতে হয়; কিন্তু আমাকে তেমন জানবেন না—আমি এই অবস্থাতেই আপনার কার্য্য শেষ করতে পারবো। তবে যদি কখন ভিন্নমূর্তি ধরতে হয়, তবে আপনি আমার দিকে চক্ষু ফিরাবামাত্র আমার এক চক্ষু আমি মুদিত করবো, তাহলে সহজেই আমাকে চিনতে পারবেন। মনে থাকে যেন।”
“বেশ মনে থাকবে।”
“এখন আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার কন্যার উদ্ধারের ভার আমার উপর রইল।” এই বলিয়া সঞ্জীববাবু তথা হইতে বিদায় লইয়া উদ্যানে প্রবেশিলেন। যথায় হিরুলাল ও তাহার সঙ্গীদ্বয় মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে পূর্ব্বরাত্রে শুশ্রূষা করিতেছিল সেই স্থানে—সেই বৃক্ষতলে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন তথায় একখানি রক্তাক্ত রুমাল পড়িয়া রহিয়াছে। বুঝিলেন, আহত ব্যক্তির ক্ষতস্থানে এই রুমাল চাপিয়া ধরা হইয়াছিল।
তিনি রুমালখানি বেশ করিয়া খুলিয়া দেখিতে লাগিলেন। এককোণে কাহার নাম লিখা রাহিয়াছে। নামর পূর্ব্বাক্ষরটী রক্তকলঙ্কে একেবারেই লুপ্ত; বাকী অক্ষরত্রয় অস্পষ্ট দৃষ্ট হইতেছে “রমল।” মনে মনে বুঝিলেন, নামের পূর্ব্বাংশে “প ̄ি” রক্তে মিশাইয়া গিয়াছে। বলিলেন, “পরিমল! এইবার হতে তুমিই আমার সন্দেহস্থল হলে। দেখ, তোমার চাতুরীজাল আমি ছিন্ন করতে পারি কি না। তোমার সুন্দর, নির্দোষ অকলঙ্কিত মুখখানি আমার মন থেকে তোমার প্রতি আমার সন্দেহের যত কারণ সব দূর করেছিল, এখন আবার এই নামাঙ্কিত রুমাল তোমার উপর সেই সকল সন্দেহের কারণ পূর্ব্ব হতে দৃঢ়তর করে জাগায়ে তুলছে। আমার ভ্রম হয়েছিল; পুষ্পস্তূপে বিষপূর্ণ সর্পশিশু লুকায়িত থাকিতে পারে।”
তৃতীয় পরিচ্ছেদ – মল্লযুদ্ধ
দেবিদাস রামকুমারবাবুর রূঢ়-প্রত্যাখ্যান অবধি আর বেহালায় আসেন নাই। বুঝিতেও পারিলেন না, কেন রামকুমারবাবু তাঁহাকে সাক্ষাৎ করিতেও নিষেধ করিলেন। এখন কেবল সতত বিমলার চিন্তা তাহার হৃদয়ের সমস্ত স্থান জুড়িয়া বাস করিতেছে। বন্ধুদিগের সহিত আর সাক্ষাৎ করিতে গমন করেন না। তাঁহারা আসিলে তেমন যত্ন রাখেন না। তাঁহারা তাঁহার এ ভাব বৈলক্ষণ্যের কারণ জিজ্ঞাসিলে, কোন উত্তর করেন না—‘কিছু নয়’ বলিয়া কাটাইতেন। কিন্তু তাঁহারা দেখিত—তাঁহার সুন্দর মুখে কি একখান গভীর বিষাদের মেঘ চাপিয়া রহিয়াছে। পূর্ণিমার জ্যোৎস্না-মাখা-বক্ষে কোথা হইতে গুটি গুটি অমার আঁধার সঞ্চারিত হইয়া ক্রমশঃ গভীর হইতেছে। প্রস্ফুটিত শুভ্র-শ্বেত-প্রসূনের উপর তপ্তবায়ু বহিতেছে।
কেহ কেহ ভাবিত, বিমলার জন্য এ কেবল মিথ্যা দুঃখ–মিথ্যা বিষণ্ণতা—মিথ্যা শোক। যখন এই অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি হবে—তখন আপনারে আপনি সান্ত্বনা করিবে। গোপনে গোপনে অনেক লোকে রটাইত—দেবিদাসের মনে কোন দুঃখ নাই—শুধু ইচ্ছাকৃত প্রবঞ্চনা; নিজেই বিমলার হন্তারক। আমরা এই পরিচ্ছেদে পাঠক মহাশয়কে লইয়া একবার দেবিদাসের সহিত সাক্ষাৎ করিতে বাসনা করি।
.
এখন সন্ধ্যা। গোধুলির গগনব্যাপী কাঞ্চনঘটা অতিদূরে ক্রমে বিলীন হইতেছে। সম্মুখে রাক্ষসী যামিনী নিজ অন্তহীন অন্ধকারবদন ব্যাদান করিয়া সে কনককান্তিটুকু গ্রাসিতেছে। মৃদু সমীরণ বহিয়া আসিতেছিল; সে যামিনির হিংসাময়ী মূর্ত্তি দেখিয়া ক্ষণেক স্থির হইয়া দাঁড়াইল। কান্তিমতী সন্ধ্যা নিজ সৌন্দৰ্যক্ষয় দেখিয়া মলিন হইতে লাগিলেন। দীর্ঘ নিশ্বাস নিক্ষেপ করিলেন—কাঁদিলেন—ঝড় উঠিল, অল্প অল্প বারি নিপতিত হইতে আরম্ভ হইল। যামিনী কয়েকখানা মেঘ আনিয়া আঁধারের গাঢ়তা সৃজিলেন।
কালিঘাট হইতে দক্ষিণমুখে যে একটী রাস্তা চলিয়া গিয়াছে—সে রাস্তা ধরিয়া টালিগঞ্জে যাওয়া যায়। পূর্ব্বে (আমাদিগের ঘটনার সময়ে) ওই পথের দুই পার্শ্ব গভীর বনময় ছিল। এখনও অনেক বড় বড় গাছ দেখা যায়—মধ্যে মধ্যে দুই একখানি করিয়া অনেকগুলি পর্ণকুটীর নির্ম্মিত হইয়াছে। কলিকাতা সহরের দারিদ্র্য এক্ষণে সেইখানে জুটিতেছে—স্থিত হইতেছে।
এই পথে কেওড়াতলা নামে একটি শ্মশান আছে। শ্মশানের পশ্চিম-প্রান্ত ধরিয়া গঙ্গাদেবী বহিয়া যাইতেছেন। শ্মশানটী এখন বেশ সংস্কার করা হইয়াছে। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময়ে শুধু বৃক্ষাবলীতে বেষ্টিত ছিল। এক্ষণে ইষ্টক প্রাচীরে সীমাবদ্ধ। সেই শ্মশানের পশ্চিম পার্শ্ব ধরিয়া, অনিয়মাবদ্ধ বৃক্ষাবলীর মধ্য দিয়া অলক্ষ্যে দেবিদাস একা চলিয়া যাইতেছেন।
এমন সময় একজন তাঁহার স্কন্ধে হস্তার্পণ করিল। তিনি চমকাইয়া উঠিলেন। দেখিলেন, পশ্চাতে একজন বলিষ্ঠ ব্যক্তি। বলিলেন,–
“কে তুমি? কি চাও?”
“আমি গোয়েন্দা। মহাশয়কেই চাই।”
“এখানে আপনি কি জন্য এসেছেন?”
“মহাশয়ের সন্ধানে।
“কি চাও?”
“পূৰ্ব্বেই বলেছি—‘মহাশয়কে’।”
“হা অদৃষ্ট! আপনার কার্যগত ব্যক্তির নিকট আমাকে কোন আবশ্যক করে না।”
“আবশ্যক না থাকলে কি আসি—আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?”
“সে কথায় প্রয়োজন?
“প্রয়োজন পরে বলবো। এখন বা জিজ্ঞাসা করি বলুন দেখি।”
“আমি তোমার কথার কোন উত্তর করতে চাই না। করিব না।”
“না কর, তুমি আমার বন্দী।”
(বিস্ময়ে) বন্দী! কোন্ অপরাধে?
“বিমলার হত্যাপরাধে।”
“বিমলার হত্যাপরাধে!”
দেবিদাস ক্রোধিত হইলেন। ললাটি কুঞ্চিত ও চক্ষুদ্বয় বৃহদ্বিস্ফারিত করিয়া বজ্রগর্জ্জণে কহিলেন, “কে সাহস করে এ কথা বলে, যে আমি বিমলার হত্যাপরাধে অপরাধী?”
“আমি।”
সহসা পিস্তলের শব্দ হইল—একটা গুলি সঞ্জীববাবুর মাথার উপর দিয়া চলিয়া গেল।
সঞ্জীববাবু পূৰ্ব্বেই দেখিতে পাইয়াছিলেন, যে দেবিদাস তাঁহার বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে পিস্তল বাহির করিতেছেন। পূৰ্ব্ব সতর্কতায় আঘাত এড়াইবার জন্য তিনি ভূমিতলে বসিয়া পড়িয়াছিলেন। তাহার পর মুহূর্ত্তেই দেবিদাসকে জাপ্টাইয়া ধরিলেন। দেবিদাস নিজেকে মুক্ত করিবার জন্য প্রয়াস পাইলেন; বৃথা হইল। সঞ্জীববাবুকে ভূমিতলে নিক্ষেপ করিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন।
উভয়কে উভয়ে পরাস্ত করিতে চাহেন। সঞ্জীববাবু চাহেন তাঁহাকে কোন আঘাত না করিয়া নিরস্ত্র করিতে। দেবিদাস বাবু চাহেন, তাঁহার বিরোধীর প্রাণ হরণ করিতে।
উভয়ের শরীরে উপযুক্ত সামর্থ্য ছিল। কাহারও সহজে কোন সুবিধা ঘটিতেছে না। সঞ্জীববাবুর শরীরে এমন ক্ষমতা ছিল—যে কোন ব্যক্তি হউক—যত বড়ই শক্তিমান্ হউক, একা তাঁহাকে কেহ পরাস্ত করিতে পারিত না। দেবিদাস রূপবান যুবক—তাঁহার সুন্দর কোমল কান্তি- তাঁহার বলের চিহ্ন সম্পূর্ণই লুক্কায়িত রাখিয়াছে। কিন্তু তিনি এমন শক্তিমান্ যে সঞ্জীববাবু তাঁহার কিছুই করিতে পারিতেছেন না। এতক্ষণ যোঝাযুঝিতে পিস্তলটী অবধি কাড়িয়া লইতে পরিতেছেন না। পূর্ব্বে সঞ্জীববাবুও জানিতেন না যে দেবিদাস এমন বলিষ্ঠ।
পূর্ব্বে দেবিদাস নিজ বাটীতে চোবে পলওয়ান রাখিয়া কুস্তি শিক্ষা করিতেন। কিন্তু তিনি নিজের বুদ্ধিমত্তা ও শারীরিক পরিশ্রমে এতদূর শক্তি সঞ্চয় করেন যে শিক্ষক পলওয়ানদিগকে অনায়াসে পরাস্ত করিতেন। পরিশেষে বড় বড় পলওয়ানগণ তাঁহাকে পলওয়ান বলিয়া নিজেদের ও তাঁহার সম্মান রাখিত। আজ বৎসরাধিক কাল গত হইল—তিনি কুস্তি ছাড়িয়া দিয়াছেন; সাধারণে তিনি একজন উত্তম কুস্তিগীর বলিয়া পরিচিত।
পরিশেষে দেবিদাসবাবু তাঁহার পিস্তল, ফেলিয়া দিয়া কটিতট হইতে এক তীক্ষ্ণ ছুরিকা বাহির করিলেন। সঞ্জীববাবু ছুরিকা সমেত তাঁহার হাতখানা নিজের বগলে চাপিয়া ধরিলেন। দেখিলেন— এখন শীঘ্র তাহাকে নিরস্ত্র করিতে না পারিলে, নিজের জীবন সঙ্কটাপন্ন। তিনি দেবিদাসের হাত নিজের বগলের মধ্যে দিয়া দুই হাতে সম্মুখদিকে আকর্ষণ করিতে লাগিলেন। ক্রমে তাঁহাকে পদকৌশলে ভূতলে পতিত করিলেন। সঞ্জীববাবু দুই হস্তে ছুরিকা সমেত দেবিচরণের হস্ত ভূমিতলে চাপিয়া ধরিলেন। দত্তদ্বারা ছুরির বাঁট ধরিয়া আকর্ষণ করিতে লাগিলেন। ক্রমে ছুরিকা হস্তচ্যুত হইল। সেই নিমিষে দেবিদাসের বক্ষে চাপিয়া বসিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ – যুদ্ধাবসানে
“শোন দেবিদাস।” সঞ্জীববাবু বলিলেন।
“আগে আমার কথা শুনুন।” যুবক কহিলেন।
সঞ্জীববাবু কহিলেন, “বলুন।”
দে। মহাশয়, আমার সকলই আপনাকে দিব, যদি মহাশয় একটী মাত্র অনুগ্রহ করেন।
স। আমাকে কি করতে হবে বলুন।
দে। আমার ঐ ছুরি আমারই বুকে বসান।
স। (মৃদু হাসিয়া) আমার নিকট হতে এ অভিনব অনুগ্রহ নেবার কারণটা কি?
দে। পুলিষের লোকের নিকট এরূপ অপমান সহ্য করবার চেয়ে মৃত্যু শতগুণ শ্রেয়স্কর। না
পারেন, আমাকে দিন; আমি আপনার ছুরি আপনার হাতে নিজের বুকে বসাই।
স। না, দেবিবাবু, তা আপনাকে করতে হবে না, আমি আপনাকে বন্দী করি নাই। আপনার নিজের নির্দোষিতার উপর আপনার যত বিশ্বাস আছে, আমার তদপেক্ষা অধিক জানবেন। আরও আমি–আপনার নিদোষিতা প্রমাণ করবো। আপনি যাতে মিথ্যা অপরাধে অপরাধী না হন, তজ্জন্য বিশেষ চেষ্টা করবো।
দে। কে আমাকে অপরাধী করেছে।
স। উঠুন আগে, সকল কথা আপনাকে বলছি। আমাকে অবিশ্বাস করবেন না। গত মুহূর্ত্তের কথা আপনিও ভুলে যান—আমিও ভুলে যাই—যা হবার তা হয়েছে।
উভয়ে উঠিলেন। উভয়ের মুখপানে উভয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখিতে লাগিলেন। দেবিচরণ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও স্থিরচিত্ত; সঞ্জীববাবুকে দেখিয়া তাঁহার বেশ প্রতীতি হইল যে এ ব্যক্তি তাঁহার অপেক্ষা মানসিক ও শারীরিক উভয় শক্তিতেই শক্তিমান্।
দে। হাঁ—আমিও এমন বোধ করেছিলেম—যে আমাকেই এ হত্যাকাণ্ডের সন্দেহস্থল হতে হবে। স। আমিও তাই বলছি যে আপনি এ হত্যাকাণ্ডের একমাত্র সন্দেহ স্থল।
দে। মহাশয় কি বলতে পারেন, এ সন্দেহের কারণ কি?
স। কারণ ত পড়েই রয়েছে। আমি যেমন জানি—তাতে আপনার উপর সন্দেহ হবার বিশেষ কারণ রয়েছে। বিমলার মৃত্যুতে একমাত্র আপনারি লাভ।
দে। বিমলার মৃত্যুতে আমার লাভ?
স। আপনার পালক পিতা যে উইল করেছেন—সে উইল মতে বিমলার মৃত্যুতে আপনি ত সমস্ত বিষরৈশ্বর্য্যের একমাত্র অধিকারী।
দে। এই জন্য, কেমন?
স। আর কি?
কিয়ন্মুহূর্ত্তের জন্য দেবিদাস নিস্তব্ধ রহিলেন। চক্ষুদ্বয় মুদিত করিলেন। বুকের মধ্যে কি এক উৎকণ্ঠা, যন্ত্রণা অনুভব করিলেন। পরক্ষণে তুষ্ণীম্ভাব ত্যাগ করিয়া বলিলেন, “মহাশয়! আপনি যদি আমার কথা বিশ্বাস করেন, আমি ঈশ্বরের শপথ করে আপনাকে আমার কথা সমস্তই জানাতে পারি।”
সঞ্জীববাবু বক্তাপেক্ষা উত্তম শ্রোতা। সম্মতি দিলেন।
দেবিদাস উদ্বেগপূর্ণ বচনে বলিতে লাগিলেন,–”শুনুন, মহাশয়, আমাকে সহস্ৰ লোকে সন্দেহ করতে পারে—করছে—করবে। কিন্তু আপনার মন আমি আপনিই জানি। বিমলার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক, কি ঘনিষ্টতা, বিমলা আমাকে কত ভাল বাসতো—আমি তাকে কত ভাল বাতেম—তা কে বুঝবে? তার ভালবাসার জন্য আমি স্বর্গের আধিপত্য—এ কোন ছার বিষয়- আশয়—বিসর্জন দিতে পারি। তার একগাছি কেশের অপচয়ে প্রাণ দিতে আমি কুণ্ঠিত নই। আমি বেশ জানি, বিমলা যেমন আমাকে ভাল বাসতো তেমন ভালবাসা এ পৃথিবীতে আর নাই।
স। দেবিদাসবাবু, আপনি যে বলছেন—বিমলা আপনাকে নিজের প্রাণের চেয়ে ভালবাসতো; কিন্তু তার ভালবাসা মৌখিক হতে পারে—সে ভালবাসা যে আন্তরিক তা আপনার বিশ্বাস আছে? দে। বিশ্বাস আর কারে করি। এ জগতে বিশ্বাস নামে যা কিছু ছিল—তা অবিশ্বাস হয়ে তীক্ষ্ণ ছুরি নিয়ে ঘাতুকের ন্যায় ভ্রমণ করছে। আর আপনারে আপনি বিশ্বাস করতে পারি না। বিমলাকে আমি যতদূর বিশ্বাস করতেম—আমি নিজেকে তত দূর কখন করি নাই।
দেবিদাসের নয়নদ্বয় সজল হইল—বিষাদ, বিষণ্ণতা, শোক, অনুতাপ এককালে তাঁহার মুখমণ্ডলে স্বীয় স্বীয় চিহ্ন প্রকটিত করিল।
স। দেবীবাবু, কাতর হবেন না-আপনি কি এখন মনে করেন যে বিমলা মরে নাই—বেঁচে আছে?
দে। সে কথা আপনাকে কি বলবো—ইচ্ছা করি না।
স। দেবীবাবু—আপনি আমাকে আপনার বন্ধু বলে জানবেন; আমার উপর সকলই নির্ভর করুন। দেখবেন—শীঘ্রই আমি সে বন্ধুত্বের পরিচয় দিতে পারি কি না।
দে। মহাশয়ের উপর আমি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করেছি। মহাশয়ের নাম কি
স। সঞ্জীবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
দে। সঞ্জীববাবু, এর ভিতর গূঢ় মন্ত্রণা আছে। বিমলা যে বেঁচে আছে এ কথা আমি উত্তমরূপে জানি, এবং তার মৃত্যু হয়েছে বলে নানাবিধ যে সব প্রমাণ প্রয়োগ হচ্ছে—সে সকল কেবল আমাদিগকে অনুসন্ধান হতে নিবৃত্ত করবার জন্য।
স। তবে কি আপনি তার জন্য কোন সন্ধান করেছিলেন? কি করে জানিলেন বিমলা বেঁচে আছে?
দে। সেই রাত্রি আমি অলক্ষ্যে সেই কল্পিত হত্যাগৃহে প্রবেশ করেছিলেম। গৃহে প্রবেশ করে যা যা দেখেছি—তাতে আমি নিশ্চয় বলতে পারি যে এ গভীর ষড়যন্ত্র—হত্যা নয়।
সঞ্জীববাবু মৃদুহাসি হাসিলেন; আনন্দজ্যোতিঃ নয়নযুগে প্রকটিত হইল। কহিলেন, “কতকটা আপনি জেনেছেন বটে।”
“কতকটা কি—আমি যা যা বল্লেম—সকলই সত্য।”
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
স। যাই হোক—এখন কে দোষী তাহাই স্থির করতে হবে।
দে। কে দোষী? বিমলার পিতা?
স। না আপনি।
দে। আমি! কেন? (বিষ্ময়পূর্ণ দৃষ্টিতে সঞ্জীববাবুর মুখপানে চাহিলেন।) আমি কি প্রকারে দোষী হতে পারি?
স। আপনিই ত বিমলার অবর্তমানে সমস্ত বিষয়ের অধিকারী হবেন? কিন্তু আপনাকে আমি দোষী বিবেচনা করতে পারি না। দেবিবাবু, আপনার আর এমন কোন আত্মীয় আছে যে এ কাণ্ডে তার কোন লাভ আছে?
দে। বিমলা। আপাততঃ কেউ নয়।
স। নিশ্চয় জানেন। আপনার আর কোন আত্মীয় কুটুম্ব নাই, তিনি আপনার মৃত্যুতে উত্তরাধিকারী হতে পারেন?
দে। না—আমি নিশ্চয় জানি।
স। ভাল—সময়ে প্রকাশ পাবে।
দে। সময় কিছুই প্রকাশ করতে পারবে না।
সঞ্জীববাবু এককথা হইত কথান্তরে ধীরে ধীরে অলক্ষ্যে প্রবেশ করিতে বিশেষ নিপুণ। কহিলেন, “পরিমলকে জানেন?”
দেবিবাবু কহিলেন, “জানি।”
“পরিমল রামকুমারবাবুর কে হয়?”
“ভাগিনেয়ী।”
“আপনার কে হয়?”
“কেহই নয়।”
“দেবিবাবু আমি আপনাকে কতকগুলি কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই—বোধ হয় সে সকল কথা আপনার অসন্তোষজনক হতে পারে-আপনিও বিরক্ত হতে পারেন।”
“বলুন। আমি যা জানি উত্তর দিব।”
প্রশ্ন। কখন কোন দিন আপনি পরিমলকে প্রণয়চক্ষে দেখেছিলেন?
উত্তর। কখনও না।
প্র। সে কখনও দেখেছিল?
উ। একদিনও না।
প্র। কি করে জানলেন যে সে আপনাকে কখন প্রীতিচক্ষে দেখে নাই?
উ। প্রীতি থাকা দূরে থাকুক—সম্পূর্ণ বিপরীত। তাতে আমাতে স্বাভাবিক বিদ্বেষই ছিল; সে আমায় একদণ্ডের তরে দেখতে পারিত না—আমিও না।
প্র। তবে আপনার মৃত্যুতে তার কোন প্রকার লাভ নাই?
উ। আমার মৃত্যুতে আপনার যেমন লাভ–এর অধিক তার নয় জানিবেন।
“আচ্ছা আমার সঙ্গে আসুন।”
“কোথায়?”
“রামকুমারবাবুর বাটীতে।”
“সেখানে আমার প্রবেশ নিষেধ।”
“আমি আপনাকে গোপনে নিয়ে যাব।”
“প্রয়োজন?”
আমি আপনাকে একটা মৃতদেহ দেখাতে চাই?”
(সবিস্ময়ে) “মৃতদেহ!” (ব্যাকুলচিত্তে) বিমলার নাকি?
“দেখবে এস।”
.
নক্ষত্রালোক ধরিয়া উভয়ে রামকুমারবাবুর উদ্যানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। স। দেবিবাবু, ভয় পাবেন না ত।
দে। না।
পূর্ব্বোক্ত চাতালের খিলান মধ্যে হইতে পূর্ব্বোক্ত মৃতদেহ বাহির করিয়া, লণ্ঠানের তীক্ষ্ণরশ্মি সেই শবমুখে নিক্ষেপ করিয়া সঞ্জীববাবু কহিলেন, “দেখুন—চিনতে পারেন?”
দেবিদাসবাবু শঙ্কাভিভূত হইলেন—হৃদয়ের বল হারাইলেন—বিস্ফারিতনেত্রে রুদ্ধশ্বাসে দেখিতে লাগিলেন।
কিয়ৎকাল কোন উত্তর করিতে পারিলেন না।
স। শীঘ্র—বিলম্ব করবার সময় নাই।
দে। কার এ শব?
স। দেখে বলুন আপনি
দেবিদাস সেই মৃতদেহপার্শ্বে হেঁট হইয়া উত্তমরূপে দেখিতে লাগিলেন।
স। চিনতে পেরেছেন? কখনও এ ব্যক্তিকে কোথাও দেখেন নাই।
দে। কখনও দেখি নাই।
স। তবে আর কি হবে!
দে। কে এ ব্যক্তি আপনি জানেন?
স। জানি না। আমি বড় রহস্যেই পড়েছি।
দে। এ ব্যক্তি কি প্রকারে মৃত্যুমুখে পতিত হল?
স। সময়ান্তরে বলবো।
সহসা দেবিদাসের হস্ত ধরিয়া টানিয়া লইয়া কিঞ্চিৎ দূরে যাইলেন। লণ্ঠানের আলোক আবৃত করিলেন। নিজে তৃণদলের উপর শুইয়া পড়িয়া দেবিদাসকে তদ্রূপ করিতে কহিলেন, “কথা কয়ো না–কে আসছে?”
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – কাকা
উভয়ে সেস্থান হইতে কিছু দূরে যাইয়া একটা ঝোপের পার্শ্বে তৃণাস্তরণের উপর শয়ন করিয়া রহিলেন। সেই অল্প অল্প তমবিজড়িত বৃষ্টিকণার রাশির মধ্যে মৃতের সেই বিবর্ণীকৃত বিকৃতমুখ বিভীষিকা তুলিল।
দেবিদাস এ পর্যন্ত কোন শব্দ শ্রবণ করেন নাই—সহসা সঞ্জীববাবুকে এরূপভাবে লুক্কায়িত হইতে দেখিয়া বিস্মিত হইলেন। সঞ্জীববাবুর মুখের দিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন— তিনি অতি সতর্ক এবং তীক্ষ্ণদৃষ্টি—তাঁহার নিপুণতা, চতুরতা যেন তাহার নয়ন যুগলে প্রতিভাসিত হইতেছিল।
কয়েক মুহূর্ত্তের পর এক ব্যক্তি আসিয়া সেই শবের নিকট দাঁড়াইল। মৃতদেহ আপন বক্ষে টানিয়া লইয়া বলিল, “নরু! এই আশা করে এসেছিলি! তোর জন্যই আমার এই ভয়ঙ্কর কার্য্যে হস্তক্ষেপ করা। আজ আমার সকল উদ্যম নিষ্ফল হল—তুই আজ আমার সব নিষ্ফল করিলি।” কাঁদিল।
কিয়ৎপরেই নিতান্ত মর্ম্মাহতের ন্যায় প্রস্থান করিল।
সঞ্জীববাবু দেবিদাসবাবুকে কহিলেন, “আপনি এখন গৃহে যান। আমি সময় মত আপনার বাটীতে গিয়া দেখা করবো। আর সাবধান, যেন এ সকল কথা আপনার মুখ হতে অন্য ব্যক্তির কর্ণে প্রবেশ না করে।”
দেবিদাসবাবু সঞ্জীববাবুর হস্ত ধরিয়া কহিলেন, “মহাশয় সঞ্জীববাবু, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। যে লোকটী এই মাত্র এখান থেকে চলে গেল—আমার যেন পরিচিত বলে বোধ হচ্ছে। কিন্তু আমি কিছু স্থির করতে পাচ্ছি না—বোধ হচ্ছে যেন আমি পূর্ব্বে কোথায় দেখেছি।
“ভেবে দেখুন, আপনার মুখের গঠনের সঙ্গে ও ব্যাক্তির অনেক সাদৃশ্য আছে—আমি তা দেখেছি।”
“আপনিও জেনেছেন দেখছি—সেই জন্যই, আমি পরিচিত বোধ করছি। (কিয়ৎ পরে) হাঁ— আমার মনে হয়েছে—আমি ব্যক্তিকে জানি।”
“কে বলুন দেখি?”
“আমি বলবো না—মাপ করবেন।”
“দেবিবাবু, আপনার মন স্থির করুন—তা হলেই আমার সন্ধানের বোধ হয় কতকটা প্রকাশ হবে।”
“আমার কাকা।”
“আপনার কাকা? নাম কি?”
“নাম জানি না।”
“সেকি কথা—কাকার নাম জানেন না!”
“না—অনেক দিনের কথা, নাম ভুলে গেছি—এখন দেখে অস্পষ্ট চিনতে পারলেন মাত্ৰ আর আঠার বৎসরের অধিক হবে-আমাদিগকে ত্যাগ করে দেশান্তরিত হয়েন। শুনেছিলেম ঢাকায় থাকতেন। তারপর একবার মধ্যে আমার পিতার মৃত্যুর পর এনারও মৃত্যু সংবাদ পাই।
“আপনার কাকার আর কেউ আছে?”
“স্ত্রী। আর একটী পুত্র—আমার সমবয়স্ক।”
“তার নাম কি?”
“নরেন্দ্র।”
“তবে এই হত ব্যক্তি আপনার ভ্রাতা। আপনার কাকাকে নরু বলে ডাকতে শুনেছি, নরেন্দ্রর ওরফে—নরু—কেমন কি না? তবে বল্ছিলেন ও শব আমি চিনি না।”
“মিথ্যা বলি নাই। যখন আমাদের সাত আট বৎসর বয়স তখন, নরু আর আমি একসঙ্গে খেলা করতে; তারপরে আজ ষোল বৎসর আর দেখা নাই। বাল্য হইতে যৌবনে যেমন মুর্ত্তির পরিবর্ত্তন ঘটে, যৌবন হইতে প্রৌঢ়াবস্থায় কিম্বা বার্দ্ধক্যেও তেমন পরিবর্ত্তন ঘটে না। ইহা যে আপনি না জানেন—তাহা নহে।”
“অনেক সুবিধা হয়ে আছে—আর বড় বেশী পরিশ্রম করতে হবে না।
“কিসের সুবিধা। আপনি এখন কি মনে করিতেছেন?”
“এই ভয়ঙ্কর রহস্য—ভেদ করবার সুবিধা। কি মনে করিতেছি সে কথা এখন আপনাকে বলবার আবশ্যক দেখি না; কিন্তু আপনি নিশ্চয় জানবেন যে, আপনার বিমলা জীবিত আছে। যে কালে আপনি আপনার কাকাকে আমায় চিনিয়ে দিতে পেরেছেন—সে কালে—এ ষড়যন্ত্র সহজ হয়ে এসেছে। এখন বাড়ী যান—সময় বিশেষে—আমি আপনাকে কোন গভীর রহস্যের কথা বলবো।”
সপ্তম পরিচ্ছেদ – রহস্য ক্রমেই গভীর হইতেছে
দেবিদাসবাবু প্রস্থান করিলেন। যে ব্যক্তি শবের সন্নিকটস্থ হইয়া অনুতাপ করিয়াছিল—সে ব্যক্তি যেদিকে গিয়াছিল—সঞ্জীববাবু সেইদিকে চলিলেন।
তিনি কিয়দ্দূর গিয়া দেখিলেন সেই ব্যক্তি একটী বৃহদ্বক্ষান্তরালে আসিয়া সঙ্কেতধ্বনি করিতেছে। সঞ্জীববাবু অল্পদূরস্থ একটী বৃক্ষমূলপার্শ্বে বসিয়া পড়িলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে আবার সঙ্কেতধ্বনি হইল। সেইসঙ্গে একটী রমণীমূর্ত্তি সঙ্কেতকারীর সমীপস্থ হইল।
তখন টিপ্ টিপ্ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছিল। উভয়ের অনেকক্ষণ ধরিয়া কি পরামর্শ চলিল; সঞ্জীববাবু তাহা শুনিতে পাইলেন না। রমণীকে চিনিতে পারিলেন না, তাহার বদন শুভ্রাবগুণ্ঠনে আবৃত। পরামর্শ শেষ হইলে রমণী রামকুমারবাবুর বাটীর অভিমুখে চলিল। সঞ্জীববাবু রমণীর পশ্চাদনুধাবন করিতে অধিক আগ্রহশীল হইলেন। কিয়দ্দূর গিয়া দেখিলেন, রমণী পশ্চাদ্বার দিয়া রামকুমারবাবুর গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল—দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।
সঞ্জীববাবু স্থির হইয়া দাঁড়াইলেন। তাঁহার হৃদয়ে চিন্তার ঝটিকা বহিল। এমন সময় অকস্মাৎ কে পশ্চাৎ হইতে আসিয়া তাঁহার স্কন্ধে হস্তার্পণ করিল। হস্তস্থিত পিস্তল মস্তকলক্ষ্য করিয়া কর্কশস্বরে বলিল—”কোথা, হে, কোথায় যাও?”
সঞ্জীববাবু কোন উত্তর করিলেন না। দেখিলেন—সেই ব্যাক্তি আর কেহই নহে—সেই দেবিদাসের কাকা। সে ব্যক্তির যে হাতে পিস্তল ছিল সেই হাতখানা দুই হাতে ধরিয়া ঝুলিয়া পড়িলেন—সেই সঙ্গে দক্ষিণপদের দ্বারা তাহার পদদ্বয়ে সজোরে আঘাত করিলেন— সে ব্যক্তি পদাঘাতে পদভ্রষ্ট হইয়া পৃষ্ঠ প্রদর্শন করিয়া সাষ্টাঙ্গে ভূমিচুম্বন করিল। সঞ্জীববাবু তাহার পিঠে উঠিয়া বসিলেন—দুই একটী সজোরে মুষ্ট্যাঘাতও যে করিলেন না—তাহাও নহে। আপনার উত্তরীয় দ্বারা পতিত ব্যক্তির দুইহস্ত দুইপদ পৃষ্ঠোপরে আনিয়া একত্রে বাঁধিলেন। তাহাকে সেই স্থানে দৃঢ় বন্ধনে রাখিয়া রমণীর অনুসরণে চলিলেন।
পরিমল যে গৃহে শয়ন করিত সঞ্জীববাবু সেই গৃহাভিমুখে চলিলেন। দেখিলেন–কক্ষমধ্যে দীপ জ্বলিতেছে না—অন্ধকার। আবার সেই নল বহিয়া উঠিয়া গবাক্ষ দ্বার দিয়া কক্ষমধ্যে প্রবেশিলেন। লণ্ঠনের আবরণ উঠাইয়া দেখিলেন—পরিমল গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত। ঈষদুন্নতবক্ষ নিদ্রাদ্রুতশ্বাসে কাঁপিতেছে। পরিধেয় বসন মুষ্টিবদ্ধ করিয়া দেখিলেন—ভিজা নহে। স্বেদজলে দুই একস্থান সামান্য মাত্র ভিজা, আলো ধরিয়া পদতল দেখিলেন—শুষ্ক—পরিষ্কার। ভাবিলেন, “তবে কে সে রমণী? পরিমল কখনই নয়; রহস্য ক্রমেই গভীর হচ্ছে।
অষ্টম পরিচ্ছেদ – এ রমণী রহস্যময়ী
পরিমলের শয়ন কক্ষ হইতে সঞ্জীববাবু পুনরায় উদ্যানে প্রবেশ করিলেন। যে স্থানে তিনি দেবিদাসের কাকাকে আবদ্ধ রাখিয়া প্রস্থান করিয়াছিলেন—তথায় আসিয়া দেখিলেন, বন্দী পলাইয়া গিয়াছে। উত্তরীয়খানি শতখণ্ডে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। এমন সময়ে—দূর হইতে শিশ দেওয়ার শব্দ তাহার কর্ণে প্রবেশিল। কর্ণ স্থির করিলেন—বুঝিলেন যে গৃহে হত্যাকাণ্ড হইয়াছিল—সেই গৃহের দিক হইতে সে শব্দ আসিতেছে। উল্লাসিত মনে চলিতে লাগিলেন। আসিয়া যাহা দেখিলেন তাহাতে স্তম্ভিত হইলেন। তিনি কিঞ্চিদ্দূরস্থ একটী বৃক্ষতলে দাঁড়াইলেন।
যে গৃহে বিমলাকে হত্যা কিম্বা হরণ করা হয়, সেই গৃহের পশ্চিম পার্শ্বস্থ গবাক্ষ—যে গবাক্ষে আম্রশাখা প্রবেশ করিয়াছে এবং সেই আম্রবৃক্ষ বহিয়া যে গবাক্ষ পথ দিয়া সহজে তন্মধ্যে প্রবেশ করা যায়—উন্মুক্ত রহিয়াছে। সেই গবাক্ষদ্বারে প্রদীপ হস্তে একটী যুবতী দণ্ডায়মান। অপরহস্তে পিত্তলনিৰ্ম্মিত একটি ছোটচাবি রহিয়াছে—অর্দ্ধাবগুণ্ঠনে যুবতীর আননার্দ্ধ আবৃত। ওষ্ঠ হইতে চিবুক অবধি দীপালোকে দৃষ্ট হইতেছে সেইটুকুতেই যুবতীর অতুল সৌন্দর্য্যের-রূপের পরিচয় দিতেছে। কৃষ্ণকুঞ্চিতকেশদাম দুইপার্শ্বে গুচ্ছে গুচ্ছে লম্বিত হইয়া পড়িয়াছে—পূর্ণিমার শশী যেন কৃষ্ণমেঘ কর্তৃক বেষ্টিত হইয়াছে। মুখাকৃতি আবয়বিক গঠনপ্রণালী পরিমলের অনুরূপ। পরিধেয় বসন দুগ্ধশ্বেত—এলোথেলো, সুবিন্যস্ত নহে—নিদ্রাভঙ্গে শয্যা হইতে উঠিয়া আসিলে যেরূপ দেখায় সেইরূপ।
কিয়ৎপরে রমণী সেই পিত্তল নির্ম্মিত চাবির রন্ধ্রদেশ অধরস্পৃষ্ট করিয়া বাজাইল। সঞ্জীববাবু চিনিলেন যে শব্দ তিনি শিশ্ মনে করিয়াছিলেন এ সেই শব্দ—সঙ্কেতধ্বনি। ভাবিলেন, “এ রমণী রহস্যময়ী।”
সেই সঙ্কেতধ্বনিতে একব্যক্তি একবৃক্ষের ছায়ামধ্য হইতে বহির্গত হইয়া আম্রবৃক্ষ বহিয়া রমণীর নিকটস্থ হইল। পরে আর তথায় নাই।
রমণী আবার সঙ্কেতধ্বনি করিল। পূর্ব্বোক্ত স্থান হইতে আবার আর একব্যক্তি বহির্গত হইয়া সেইরূপে উপরতলে প্রবেশ করিল। এইরূপে চারি পাঁচজন বিকটাকার পুরুষ রমণীর সঙ্কেতধ্বনিতে গবাক্ষ দিয়া উপরে প্রবেশিল।
দীপ নিভিল—রমণী নাই। চতুর্দিক অন্ধকার—নিস্তব্ধ।
নবম পরিচ্ছেদ – অভিনব কৌশল
সঞ্জীববাবু দেখিলেন বাতায়ন পূর্ব্বের ন্যায় মুক্ত রহিয়াছে। আম্র বৃক্ষারোহণে তিনিও তাহার মধ্য দিয়া গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। তথায় কেহই নাই। পূর্ব্বপ্রবিষ্ট ব্যক্তিগণের পদধ্বনি শ্রুতিগোচর হইল। যেন তাহারা ক্রমাগত সোপানারোহণ করিয়া ত্রিতলে উঠিতেছে। তিনি তথা হইতে বহির্গত হইয়া বারান্দায় (চক্) পড়িলেন—কিয়দ্দূর অগ্রসর হইয়া ত্রিতলে উঠিবার সোপান দেখিতে পাইলেন।
সঞ্জীববাবু দেখিলেন, এই চারি পাঁচজন দস্যু শাণিত ছোরাহস্তে সেই সোপানারোহণ করিতেছে। তিনি তাহাদের অনুসরণ করিতে লাগিলেন। দস্যুগণ সোপান অতিক্রম করিয়া একে একে ছাদে উঠিতে লাগিল—এক–দুই—তিন। চতুর্থ, ব্যক্তি, যে পশ্চাতে ছিল সে যেমন উঠিতে যাইবে—সঞ্জীববাবু লাফাইয়া গিয়া এমন কঠিনরূপে তাহার গলা টিপিয়া ধরিলেন যে, সে আর কোন শব্দ করিতে পারিল না। অগ্রগামী ব্যক্তিগণ কিছু না জানিতে পারিয়া, রামকুমারবাবুর শয়ন গৃহাভিমুখে চলিয়া গেল।
যে কোন আকস্মিক বিপদ-বিপত্তি-ঘটনা ঘটুক না কেন, সঞ্জীববাবু সর্ব্ব সময়ে সে সকল দূর করিতে প্রস্তুত থাকিতেন। তাঁহার চারিজন শত্রুর একজন কমিল—তিনজন।
সঞ্জীববাবু এমন জোরে তাহার গলা টিপিয়া ধরিয়াছিলেন যে সে ব্যক্তি শীঘ্রই অবসন্ন হইয়া পড়িল। চক্ষুদ্বয় উপরে উঠিল। সঞ্জীববাবু দেখিলেন আর অধিকক্ষণ গলা টিপিয়া থাকিলে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইবে–ছাড়িয়া দিলেন। হতভাগ্য সেইখানে শুইয়া পড়িল—কাপড় শুখাইতে দিবার জন্য দেয়ালে একগাছি দড়ী ঝুলিতে ছিল। সেই দড়ী লইয়া সঞ্জীববাবু তাহার হস্তপদ কঠিনরূপে বন্ধন করিলেন। শেষে যাহাতে সে ব্যক্তি কোন কথা না কহিতে পারে, নিজ বস্ত্রের কতকটা ছিড়িয়া তাহার মুখরন্ধ্র পূর্ণ করিলেন।
সঞ্জীববাবুর কার্য্য শেষ হইতে না হইতে রামকুমারবাবুর শয়নকক্ষ হইতে সকাতর চিৎকার উঠিতে লাগিল। সঞ্জীববাবু শুনিলেন—কথাগুলি কেবল, “মলেম—বাঁচাও –রক্ষা কর।” বিদ্যুৎগতিতে সেই দিকে ছুটিলেন—কি সৰ্ব্বনাশ!
রামকুমারবাবুর শয়নকক্ষে দস্যুত্রয় উন্মুক্ত ছোরাহস্তে প্রবেশ করিয়াছে। গৃহ এত অন্ধকার কিছুই দেখিবার উপায় নাই—কেবল চুপি চুপি কথা, শ্বাস-প্রশ্বাস – হস্তপদাদিবিক্ষেপশব্দ— শ্রুতিগোচর হইতেছে মাত্র। রামকুমারবাবুর তখন আর কোন সাড়াশব্দ নাই।
সঞ্জীববাবু এ সময়ে কি করিবেন ভাবিয়া পাইলেন না। ব্যস্ত হইয়া কিছু করিতেও পারেন না, আবার শীঘ্র উপায় না করিলে রামকুমারবাবুর প্রাণ যায়। মনে করিলেন, গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া দস্যু দিগকে ছুরিকাহত করিয়া রামকুমারবাবুর প্রাণরক্ষা করেন; কিন্তু এই নিবীড় আঁধারের মধ্যে কে রামকুমারবাবু—কে দস্যু—কেমনে চিনিবেন? সঞ্জীববাবুর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব অসাধারণ। তিনি, দস্যুরা যে গৃহে আপনাদের কার্য্যসমাধা করিবার প্রয়াস পাইতেছে, সেই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া— বিকৃতস্বরে চুপি চুপি দস্যুদিগকে বলিলেন, “সর্ব্বনাশ হয়েছে—রক্ষা নাই।”
দস্যুদের মধ্যে আর একজন চুপি চুপি বলিল, “কে রে হিরু নাকি—এতক্ষণ কোথা ছিলি?”
“হ্যাঁরে, পালিয়ে আয়, এখনি গ্রেপ্তার হবি।” সঞ্জীববাবু চুপি চুপি বলিলেন। সে কথা সকলেই শুনিল—ঊর্দ্ধশ্বাসে যে, যে দিকে পাইল, পলাইল। সঞ্জীববাবুও পালাইবার ভাণ দেখাইয়া তাহাদিগের সঙ্গে কক্ষের বাহিরে আসিলেন। দ্বিতলে পরিমলের শয়নগৃহ হইতে কাহার পদশব্দ উঠিল। আলিসায় আসিয়া হেঁট হইয়া দেখিলেন—পরিমলের গৃহমধ্যে আলো জ্বলিতেছে। পরিমল দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া ত্রিতলের ছাদের দিকে চাহিয়া আছে। পরিমলের পরিধেয় বসনাদির সঙ্গে, আর যে অবগুণ্ঠনবতী রমণী বাতায়নে দস্যুদিগকে সঙ্কেত করিয়াছিল তাহার পরিধেয় বসনাদির কোন পার্থক্য নাই; সেইরূপই শুভ্র—পরিস্কৃত এলোমেলো—সুবিন্যস্ত নহে।
সঞ্জীবাবু নিশ্চয় বুঝিলেন, যে এই পরিমল সকল অনর্থের মূল। বিস্মিতও হইলেন—এই সামান্য বালিকার এত ষড়যন্ত্র। আবার ভাবিলেন দুই দুইবার আমাকে ফাঁকি দিয়াছে—এমন ফাঁকি দিয়াছে আমি একতিল সন্দেহ করিতে পারি নাই। ভাল, দেখা যাক্।
আলোক হস্তে পরিমল তখনি অদৃশ্য হইল। কিয়ৎপরেই দুই জন ভৃত্যসঙ্গ ত্রিতলে উপস্থিত। হাতে একটি প্রদীপ জ্বলিতেছিল। ব্যগ্রতার সহিত সঞ্জীববাবুকে বলিল, “কি হয়েছে—কি ঘটেছে বলুন?”
সঞ্জীববাবু কহিলেন—”আলো নিয়ে এই ঘরে গিয়ে দেখ কি হয়েছে; জান না কি?”
কথা সমাপ্ত হইতে না হইতে পরিমল গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল। দেখিল—রক্তাক্ত মাতুল গৃহতলে নিপতিত। পরিমল কাঁপিতে কাঁপিতে বসিয়া পড়িল। হস্তস্থিত দীপও সেই সঙ্গে কাঁপিয়া উঠিল। কাতর কণ্ঠে পরিমল চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “অ্যা–কি হল গো—মামাবাবুকে কে খুন করে গেছে যে—”
সঞ্জীববাবু কহিলেন, “আমি বোধ করি—তুমি যাদের অদ্য রাত্রে এই কতক্ষণ এ বাটীতে প্রবেশ করতে দিয়েছিলে—তাদেরই এ কৰ্ম্ম।”
“মামাবাবু নাই—আমাদের কি হবে গো।” সঞ্জীববাবুর কথায় কর্ণপাত না করিয়া পরিমল কাঁদিতে লাগিল।
সঞ্জীববাবু কহিলেন, “পরিমল, তোমার চাতুরী যে পূর্ণ হয়েছে তাত কিছু পরেই জানতে পারতে-তা ত কিছু পরেই জানতে পারতে— এত তাড়াতাড়ি—কাঁদবার ভাণে এসে দেখে যাবার প্রয়োজনটা কি?”
পরিমল তাঁহার কৃষ্ণোজ্জ্বলতার নয়ন সঞ্জীববাবুর তীক্ষ্ণ চক্ষুর উপর বিন্যস্ত করিয়া বলিল, “আপনি কি বলছেন? আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
সঞ্জীববাবু কহিলেন, “আমি কি বল্ছি কিছুক্ষণ পরেই জানতে পারবে।”
পরিমল সজলনয়নে বলিল, “মহাশয়! আমার মামাকে আগে বাঁচান—তারপর অন্য সময়ে আপনার ওসব কথা আমি শুনবো।” তাহার কাতরতা—অশ্রু—হা হুতাশ—ক্রন্দন দেখিয়া সঞ্জীববাবু ভাবিলেন, “এ বালিকা সাধারণ নহে।” কিন্তু যখন আবার সেই পরিমলের নির্ম্মল মুখখানি দেখিলেন—তখন তাহার সকল সন্দেহ দূর হইল। একটী কলঙ্করেখা—একটী পাপের চিহ্ন সে মুখখানিতে দেখিতে পাইলেন না। বরং দেখিলেন—সে আননমণ্ডলে পবিত্রতা বিকশিত। ভাবিলেন, তিনি একবার যাহাকে দেখিতেন—তাহার হৃদয়ের সমস্ত তত্ত্ব বুঝিয়া লইতেন—সে বিদ্যা আজ বালিকার সুন্দর মুখের কাছে পরাজয় মানিল।
সঞ্জীববাবু দেখিলেন, রামকুমারবাবু অচৈতন্য। তাহার বক্ষে ও হস্তের কব্জাতে (মনিবন্ধ) ছুরিকাঘাত করা হইয়াছে। বক্ষে অতি সামান্যই—আঘাত লাগিয়াছে কব্জা সম্পূর্ণরূপে বিদ্ধ হইয়াছে। বুঝিলেন, দস্যুরা বক্ষলক্ষ্য করিয়া ছুরিকাঘাত করিয়াছিল—বক্ষের উপর হস্ত থাকায় ছুরি বক্ষে বিদ্ধ হইতে পারে নাই—হস্তেভেদ করিয়া বক্ষ সংস্পর্শ করিয়াছে মাত্র। আঘাত সাংঘাতিক নহে।
সঞ্জীববাবু কহিলেন, “ভয় নাই পরিমল-তোমার মামাবাবু সংঘাতিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়েন নাই।” পরিমল একজন ভৃত্যকে ডাক্তার ডাকিতে ও অপরকে ভবানীপুর হইতে দেবিচরণকে সঙ্গে লইয়া আসিতে আজ্ঞা করিল।
সঞ্জীববাবু কহিলেন—”ডাক্তারই ডেকে আন—দেবিবাবুকে প্রয়োজন নাই।”
পরিমল সে কথা শুনিয়া একেবারে দাঁড়াইয়া উঠিল; ক্রোধে কাঁপিতে লাগিল। বৰ্দ্ধিতরোষা পরিমল সেই দুটী ডাগর নয়ন অধিকতর বিস্ফারিত করিয়া বলিল, “কে আপনি? আপনার কথা শুনিতে চাই না। আপনার—কথা কবার কোন অধিকার নাই—গোয়েন্দা আছ গোয়েন্দাই থাক- এতদূর কিছুই নহে।
দেবিদাসকে সঙ্গে লইয়া আসিবার জন্য যে ভৃত্যকে’ বলা হইয়াছিল সে বলিল, “তবে দেবিবাবুকে ডেকে আনি।”
সঞ্জীববাবু তাহার হাত ধরিয়া নিজের পিস্তল মুখের কাছে লইয়া বলিলেন, “যদি যাবি ত- তোকে খুন করে ফেলব।”
শঙ্কান্বিত ভৃত্য সেই তীব্রদৃষ্টি ও পিস্তল দেখিয়া বশ্যতা স্বীকার করিল।
দশম পরিচ্ছেদ – সঙ্গলাভে
ডাক্তারবাবু অর্দ্ধঘণ্টা মধ্যে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তখনও রামকুমার বাবুর চৈতন্য হয় নাই। ডাক্তারবাবু বিশেষ করিয়া রোগীকে দেখিলেন—হাতের যেখানটা কাটিয়া গিয়াছিল জলসিক্ত বস্ত্রখণ্ড বাঁধিয়া দিলেন। বলিলেন, “আঘাত গুরুতর বা সাংঘাতিক নহে। আর কোন ভয় নাই। মুখে জলের ছিটা দাও অল্পক্ষণ পরেই সংজ্ঞা হবে।”
ডাক্তারবাবু চলিয়া গেলেন। সঞ্জীববাবু পরিমলকে বলিলেন, “যতক্ষণ না চৈতন্য হয় ততক্ষণ মুখে জলের ছিটা দাও।”
পরিমল বলিল, “আপনি কোথা যাবেন?”
“আমি এখনি আছি। দেখ, খুব সাবধান—তোমার উপর তোমার মামাবাবুর জীবনের ভার রহিল।” বলিয়া চলিয়া গেলেন।
সঞ্জীববাবু দ্বিতলে অবতরণ করিবার সোপানে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন যে দস্যুকে (হিরু, যে ভাণে সঞ্জীববাবু দস্যুদলে মিশিয়াছিলেন) বন্ধনাবস্থায় রাখিয়া গিয়াছিলেন—সে নাই। বুঝিতে পারিলেন—তাহার সঙ্গীগণ পলাইবার কালে তাহাকেও লইয়া গিয়াছে।
উদ্যানের সকলস্থান তন্ন তন্ন করিয়া দেখিলেন, কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। যে গৃহে সংজ্ঞাশূন্য রামকুমারবাবু ও পরিমল ছিল, সেই গৃহদ্বারে পুনরায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাহির হইতে শুনিলাম রামকুমারবাবু ধীরে ধীরে কথা কহিতেছেন, পরিমল সে সকলের উত্তর করিতেছেন।
রা। পরিমল, তুমি এ ব্যাপারে তবে কিছুই জান না?
প। কিছু না, মামাবাবু, আমি কিছুই জানিনা। গোলমাল শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখনই এ প্রদীপটা নিয়ে উপরে ছুটে আসি। দেখি, এই ঘরের দরজায় সামনে পিস্তল হাতে আপনার গোয়েন্দাবাবু দাঁড়িয়ে আছেন!
“তিনি তোমাকে দেখিয়া কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলেন?”
“তিনি যা বলেছিলেন তাতে আমি বড়ই আশ্চর্য্য হলেম্।”
“তিনি তোমাকে এমন কি কথা বলেছিলেন?”
“আমি তার কথার ভাব ঠিক্ বুঝে উঠতে পারি নাই। তবে তিনি আমাকে দোষী ভেবে,
উপহাস করে ছিলেন—সন্দেহ করেছিলেন।”
“যাও, এখন তুমি তোমার ঘরে যাও, কাল এ বিষয়ের মীমাংসা করা যাবে।