তৃতীয় খণ্ড – খুনী কে? (মেঘ সঞ্চার)

তৃতীয় খণ্ড – খুনী কে? (মেঘ সঞ্চার)

প্রথম পরিচ্ছেদ – পরামর্শ

সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকাণ্ড অপেক্ষা তাঁহার মৃতদেহ অপহরণ ব্যাপারটা সর্ব্বসাধারণের নিকটে আরও বিপুল বিস্ময়জনক বলিয়া প্রতীত হইল। এবং সংবাদ-পত্র সমূহের মধ্যে একটা তুমূল আন্দোলন পড়িয়া গেল। প্রতিবেশিগণও স্থানে স্থানে দল বাঁধিয়া সাগ্রহে তৎসম্বন্ধে আলোচনা করিতে লাগিল, এবং তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই অপহৃত মৃতদেহ পুনরুদ্ধারের অনন্তবিধ উপায় স্থির করিয়া, এক-একটা দৃঢ়তর মত প্রকাশ করিতে লাগিল; কিন্তু কেহই নিজে সে কাজে অগ্রসর হইতে সাহস করিল না।

দত্ত সাহেবের মনে কিছুমাত্র শান্তি নাই। কাহারও সহিত ভাল করিয়া কথা কহেন না। বিশেষতঃ সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে বন্ধুবান্ধবদিগের মধ্যে কেহ কোন কথা তুলিলে তিনি বলিতেন, “এ সকল কথায় আপনাদিগের কোন প্রয়োজন নাই, যা’ নিজে ভাল বলিয়া বুঝিব তাহাই করিব। সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ বা হত্যাকারীকে যদি সন্ধান করিয়া বাহির করিবার হয়, তাহা আমার দ্বারাই হইবে।” বলা বাহুল্য, দত্ত সাহেবের এরূপ ব্যবহারে কেহ বড় সন্তুষ্ট হইতেন না। যাঁহার যা’ কিছু উপদেশ প্রয়োগ করিবার ছিল, তাহা অমরেন্দ্রনাথের উপর প্রয়োগ করিয়া পরম নিশ্চিন্তমনে স্বস্থানে প্রস্থান করিতে লাগিলেন। কেহ বলিলেন, “দত্ত সাহেবের মস্তিষ্ক একেবারে বিগড়াইয়া গিয়াছে—চিকিৎসা আবশ্যক।” কেহ সেই কথার সমর্থন করিয়া বলিলেন, “নিশ্চয়ই, নতুবা তিনি অবশ্যই এ কাজে একজন সুদক্ষ ডিটেটিভ নিযুক্ত করিতেন।” কিন্তু, এদিকে দত্ত সাহেব যে, নিজেকে নিজের ডিটেকটিভ স্থির করিয়াছেন, তাহা কেহ বুঝিলেন না।

দত্ত সাহেব প্রথমে সেই নিদ্রালু কনেষ্টবলকে এবং নিজের ভৃত্যবর্গকে প্রশ্ন-পরীক্ষা করিলেন। তাহার পর নিজে একবার থানায় গিয়া ইনস্পেক্টর গঙ্গারামের সহিত দেখা করিলেন। গঙ্গারাম তাঁহাকে সসম্ভ্রম আহ্বান করিয়া বসিতে বলিলেন।

বসিয়া দত্ত সাহেব বলিলেন, “গঙ্গারামবাবু, চেষ্টা করিয়া কোন সূত্র বাহির করিতে পারিলেন কি?”

গঙ্গা। না, কিছুই না; যতক্ষণ না রহিমবক্সের জ্ঞান হইতেছে, ততক্ষণ কোন সুবিধাজনক সূত্র পাওয়া যাইবে বলিয়া আমার বোধ হয় না। রহিমবক্স এখন কেমন আছে?

দত্ত। এখন তাহার খুব জ্বর। জ্বরে সে এখনো কেবলই প্রলাপ বকিতেছে।

গঙ্গা। সেই প্রলাপের মধ্যে আপনি এমন কোন কথা শুনেন নাই, যাহাতে একটা যা-তা সূত্র অবলম্বন করিয়া আপাততঃ আমরা কাজটা আরম্ভ করিতে পারি?

দ। কিছুই না।

গ। তাইত—কোন দিকেই সুবিধা হইতেছে না। কথায় কথায় একবার আমি বেন্টউডকে রহিমবক্সের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। তাঁহার মতে রহিমবক্স কোন গুরুতর আঘাতে এরূপ অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছে।

দ। আমারও তাহাই মনে হয়। হয় ত রহিমবক্স ঘুমাইয়া পড়িয়া ছিল। যখন মৃতদেহ অপহরণকারীরা জানালা দিয়া ঘরের ভিতরে আসে, তখন তাহার ঘুম ভাঙ্গিয়া যায়। রহিমবক্স একা —বয়সও হইয়াছে, চেষ্টা করিয়া তাহাদের কিছুই করিতে পারে নাই। একাকী পাইয়া রহিমবক্সকে তাহারাই গুরুতর আঘাত করিয়া থাকিবে।

গ। আমার তা’ বোধ হয় না। ইহার ভিতরে অনেকগুলি কথা আছে। আপনি একটা বড় ভুল করিয়াছেন।

দ। আমার ভুল হইয়া থাকে—আপনি তাহার সংশোধন করুন, সে জন্য আমি কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হইব না। বলুন, আপনি এ সম্বন্ধে এখন কি বলিতে চাহেন?

গ। আমি যাহা জিজ্ঞাসা করি, আপনি তাহার উত্তর দিতে থাকুন, তাহা হইলে আপনি নিজের ভ্রম সহজেই বুঝিতে পারিবেন; আমাকে আলাহিদা কিছু বুঝাইয়া বলিতে হইবে না। যে রাত্রে মৃতদেহ চুরি যায়, সে রাত্রে কি আপনি লাইব্রেরী ঘরে ছিলেন?

দ। হাঁ, যখন রাত বারটা, তখন আমি যেখানকার যেরূপ বন্দোবস্ত, সমুদয় ঠিক করিয়া লাইব্রেরী ঘরে যাই। চেয়ারে বসিয়া টেবিলের উপর মাথা রাখিয়া নিজের দুরদৃষ্টের কথা চিন্তা করিতে থাকি। তাহার পর কখন ঘুমাইয়া পড়িলাম, জানিতে পারি নাই। যখন জাগিয়া উঠলাম— তখন রাত তিনটা

গ। বেশ, তাহা হইলে রাত বারটা হইতে তিনটার মধ্যে সুরেন্দ্রনাথের শব অপহৃত হইয়াছে। আপনার মুখেই শুনিয়াছি, আপনার ঘুম খুব সজাগ।

গঙ্গারামের কথা শুনিয়া, সে রাত্রের রুদ্ধদ্বারে সেলিনার মৃদু করঘাতের কথা দত্ত সাহেবের মনে পড়িয়া গেল। তিনি বলিলেন, “হাঁ আমি একটু শব্দেই জাগিয়া উঠি।”

গঙ্গারাম বলিলেন, “রহিমবক্স যদি চীৎকার করিয়া উঠিত, তাহা হইলে সে শব্দে নিশ্চয়ই আপনি তখন জাগিয়া উঠিতেন।”

দ। নিশ্চয়ই; লাইব্রেরী ঘর সেখান হইতে বেশী দূরে নয়। তা’ ছাড়া লাইব্রেরী ঘরের কবাট খোলা ছিল। কিন্তু, রহিমবক্সকে চীৎকার করিতে শুনি নাই।

গ। তাহা হইলে আপনি বলিতেছেন যে, রহিমবক্স চীৎকার করে নাই। যখন অপহরণকারীরা জানালা দিয়া ঘরের ভিতরে আসে, তখন একটা লোকের ঘুম ভাঙিবার মত শব্দ অবশ্যই হইয়া থাকিবে। রহিমবক্স জাগিয়া যখন অপহরণকারীদিগকে দেখিতে পাইল, তখন সে যে অন্যান্যের সাহায্যপ্রার্থী হইয়া, চীৎকার না করিয়া বর্ণপরিচয়ের গোপাল বড় সুবোধ বালকের মত চুপ করিয়াছিল, কেমন করিয়া আমি এমন অনুমান করিব?

দ। হয় ত তাহার ঘুম ভাঙে নাই। আর যদি বা তখন রহিমবক্সের ঘুম ভাঙিয়া থাকে, তাহাতেই বা হইয়াছে কি?

গ। তাহাতেই আমার মনে একটা সন্দেহ হইয়াছে। আমার বিশ্বাস, তাহারা কোন উগ্ৰ ঔষধে রহিমকে অজ্ঞান করিয়া থাকিবে।

দ। কিন্তু, তাহার মাথায় পিঠে যে সব আঘাতের চিহ্ন রহিয়াছে, সে সম্বন্ধে আপনি কি বলেন?

গ। মৃতদেহ অপহরণকারীরা যখন রহিমবক্সকে ঔষধের সাহায্যে অচেতন করে, তখন পড়িয়া গিয়াও রহিমের মাথায় পিঠে তেমন আঘাতের চিহ্ন হইতে পারে না কি?

দ। [চিন্তিতভাবে] না—এ সব কথা কোন কাজের নয়। শবাপহরণকারীরা রহিমকে প্রহারে অচেতন করুক বা ঔষধেই অচেতন করুক, সে কথা পরে হইবে। তাহারা বাগানের দিক্কার সেই জানালা দিয়াই যে সে ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল, সে সম্বন্ধে আপনার এখন আর কোন সন্দেহ আছে কি?

গ। খুব আছে। আপনি ইহার মধ্যেই ভুলিয়া গিয়াছেন দেখছি; সেই জানালাটা যে ভিতর দিক্‌ হইতে খোলা হইয়াছিল, সে প্রমাণ ত আপনি সেইদিনই আমার নিকট পাইয়াছেন।

দ। তবে কি কেহ ঘরের ভিতরে লুকাইয়া ছিল?

গ। না—তাহাও নহে। ইহার ভিতরে কিছু রহস্য আছে।

দ। রহস্য আর মাথামুণ্ড। তবে কি আপনি বলিতে চাহেন যে, আমাদের রহিমবক্স ভিতর হইতে সেই শবাপহরণকারীদিগকে জানালা খুলিয়া দিয়াছিল?

গ। হাঁ, সেই কথাই আমি বলিতে চাই। নিশ্চয় তাহাদের সঙ্গে আপনার রহিমবক্সের কোন যোগাযোগ ছিল। রহিমবক্সই জানালা খুলিয়া তাহাদিগকে ঘরের ভিতরে আসিতে দিয়াছিল। তাহারা নিজের কাজ গুছাইয়া শেষে রহিমবক্সের এরূপ দুর্দ্দশা করিয়া চলিয়া গিয়াছে।

দ। এ কথা কোন কাজেরই নয়। রহিমবক্স আমার খুব বিশ্বাসী; বিশেষতঃ সুরেন্দ্রনাথকে সে বড় ভালবাসিত। আর তাই যদি না হয়—আপনার অনুমানই যদি সত্য হয়, তাহা হইলে মৃতদেহ অপহরণকারীরা তাহাদিগের সাহায্যকারী রহিমের উপরে এরূপ অন্যায় ব্যবহার করিবে কেন?

গ। সে কথা আমি ঠিক বলিতে পারি না। হয়ত প্রথমে তাহারা রহিমকে কিছু টাকার প্রলোভন দেখাইয়াছিল; তাহার পর যখন দেখিল, কাজ শেষ হইয়াছে, তখন রহিমকে টাকা দিবার পরিবর্তে এইরূপ একটা সদুপায় অবলম্বন করিয়া থাকিবে।

দ। তাহাও কি কখন হয়? যখন রহিমবক্সের জ্ঞান হইবে, তখন যে সকল কথাই প্ৰকাশ পাইবে, এ অনুমান কি তাহাদের হয় নাই?

গ। আপনার কথা আমি স্বীকার করি। কিন্তু ইতিমধ্যে তাহারা নিজে নিরাপদ হইতে পারিবে—এমন একটা সম্ভাবনার জন্য এ কাজ করিয়াছে। এইরূপ অবস্থায় রহিমের কতদিন কাটিবে—কে জানে?

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – তর্ক-বিতর্ক

দত্ত সাহেব কহিলেন, “রহিমের উপর আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে। আপনি যতই বলুন না কেন, আমি কিছুতেই তাহার উপরে আজ এমন একটা গুরুতর সন্দেহ করিতে পারি না। সে যাহা হোক, রহিমকে যে একটা উগ্র ঔষধের সাহায্যে অচেতন করা হইয়াছে, কেমন করিয়া আপনি এমন অনুমান করিতেছেন, বুঝিতে পারিলাম না।

গ। যখন আপনি রহিমবক্সের নিকটে আমাকে লইয়া যান, তখন সেই ঘরের মধ্যে কেমন একটা গন্ধ পাইতেছিলাম।

দ। (সাগ্রহে) কিসের গন্ধ? কি রকম?

গ। তা’ আমি ঠিক বলিতে পারি না—গন্ধটা অতি তীব্র—কেমন যেন বিষাক্ত বলিয়া বোধ হয়; সে গন্ধটা অতি সহজে সৰ্ব্বাগ্রে যেন মস্তিষ্ক ভেদ করিয়া উঠিতে থাকে।

দ। ডাক্তার বেন্টউড কি সে গন্ধ পাইয়াছিলেন? আপনাকে সে সম্বন্ধে কোন কথা বলিয়াছেন?

গ। গন্ধটা তিনি পাইয়াছিলেন বটে, কিন্তু জিজ্ঞাসা করায় তিনি গন্ধের কথা ঠিক করিয়া কিছুই বলিতে পারেন নাই। তাঁহার ধারণা, মস্তকে দারুণ আঘাত লাগায় রহিমবক্স অজ্ঞান হইয়া পড়িয়াছে। আমি বলিতেছি, সে কথা ঠিক নয়; কোন প্রকার তীব্র ঔষধের ঘ্রাণে রহিম সংজ্ঞাশূন্য।

দ। আচ্ছা, পরে সকলই জানিতে পারা যাইবে। ভাল, সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ কখন কিরূপে অপহৃত হইয়াছে, সে সম্বন্ধে আপনি কিছু অনুমান করিয়া বলিতে পারেন? কোন্ পথ দিয়াই বা মৃতদেহটা এমন নির্বিঘ্নে লইয়া গেল?

গ। আপনার বাগানের মধ্য দিয়া বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছে।

দ। বাগানের মধ্য দিয়া যে, মৃতদেহ লইয়া গিয়াছে, তাহা আমিও জানি। বাগান পার হইয়া মৃতদেহ অপহরণকারীরা যে গলিপথে ঢুকিয়াছিল, তাহাও আমি জানি। কিন্তু, সে গলি ছাড়াইয়া তাহারা কোন্ পথে গিয়াছে, তাহার ত কোন ঠিক হইতেছে না।

গ। তাহারা পূর্ব্ব হইতেই একখানা গাড়ী ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল। বড় রাস্তায় পড়িয়া সেই গাড়ীতে মৃতদেহ চালান করিয়াছে।

দ। কেমন করিয়া আপনি এমন অনুমান করিতেছেন?

গ। কারণ আছে। সেদিন রাত্রে বেশ এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছিল—বোধ হয়, আপনার স্মরণ আছে। সেই বৃষ্টির জলে রাস্তায় যেরূপ কাদা হইয়াছিল, তাহাতে আমি গাড়ীর চাকার দাগ বেশ স্পষ্ট দেখিতে পাইয়াছি।

দ। আপনি তাহা অনুসরণ করিয়া দেখিয়াছিলেন?

গ। চেষ্টার ত্রুটী করি নাই, কিন্তু সে অনুসরণে কোন ফল হয় নাই। চৌরাস্তায় যাইয়া দেখিলাম, সেখানে সে দাগ অন্যান্য গাড়ীর চাকার দাগের সঙ্গে মিশাইয়া গিয়াছে। এমন অসম্ভব কেস্ আমার হাতে আর কখনও পড়ে নাই—সকলই যেন একটা ভৌতিক-রহস্য বলিয়া বোধ হইতেছে। বাস্তবিকই, ব্যাপার দেখিয়া আমাকে যেন হতভম্ব হইয়া পড়িতে হইয়াছে। কে জানে, লাস চুরি করিয়া কাহার কি লাভ হইবে?

দ। যাহারা সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে, আমার বিবেচনায় তাহারাই সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহও চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে।

গ। কেমন করিয়া তাহা হইবে। তাহারা মনে করিলে, যে রাত্রে সুরেন্দ্রনাথকে খুন করে, সেই রাত্রেই ত লাস্ গোপন করিয়া ফেলিতে পারিত। সাধ করিয়া নিজেদের জীবনকে বিপদাপন্ন করিতে তাহাদের এ দুঃসাহসিকতার পুনরভিনয়ের কোন আবশ্যকতা ছিল না।

দ। হত্যাকারীরা আগে সে কথা ভাবে নাই, বোধ হয়। মৃতদেহ গোপন করার কল্পনাটা পরে তাহাদের মাথায় উঠিয়া থাকিবে।

গ। এ রকম একটা ভয়ানক হত্যাকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করিতে হইলে পরে কি করিবে—কি না করিবে, সে কথা লোকে আগেই ভাবিয়া ঠিক করিয়া রাখে। যা’ই হোক, ইতিমধ্যে যদি আমি হত্যাকারীদের কোন সন্ধান-সুলভ করিতে পারি, তখনই আপনাকে জানাইব। কিন্তু যতক্ষণ না রহিম প্রকৃতিস্থ হইতেছে, ততক্ষণ সন্ধান-সুলভের আর কোন সুবিধা হইবে বলিয়া আমার ত বোধ হয় না।

“রহিম! রহিম আমার খুব বিশ্বাসী, সে কখনই এ বিশ্বাসঘাতকতা করিবে না, তাহাকে আমি খুব জানি।” এই বলিয়া দত্ত সাহেব আসন ত্যাগ করিয়া উঠিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গারামও উঠিলেন, এবং দত্ত সাহেবের সহিত থানার বাহিরে আসিলেন। থানার সম্মুখে দত্ত সাহেবের গাড়ী দাঁড়াইয়া ছিল। দত্ত সাহেব গঙ্গারামের নিকট হইতে বিদায় লইয়া নিজের গাড়ীতে উঠিয়া বসিলেন। গাড়ী বাড়ীর দিকে চলিল।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – সমস্যা

গাড়ীতে বসিয়া দত্ত সাহেব গঙ্গারামের কথাগুলি মনে মনে তোলাপাড় করিতে লাগিলেন। প্রথমে তিনি গঙ্গারামকে যতটা নির্ব্বোধ মনে করিয়া তাঁহার প্রতি হতশ্রদ্ধ হইয়াছিলেন, এখন গঙ্গারামের সহিত কথোপকথনে সে ভাবটা একেবারে তাঁহার মন হইতে তিরোহিত হইয়া গেল। এখন তাঁহার মনে হইতে লাগিল, গঙ্গারাম যে কথাগুলি বলিলেন, সেগুলি নিতান্ত বাজে কথা নহে—কাজের। চেষ্টা করিলে ঐ কথাগুলির উপর নির্ভর করিয়া কাজের দিকে আপাততঃ অনেকটা অগ্রসর হইতে পারা যায়।

রহিমের উপরে দত্ত সাহেবের অনন্ত বিশ্বাস; তিনি রহিমকে কিছুতেই দোষী বলিয়া সন্দেহ করিতে পারিলেন না। রহিম তাঁহাদিগের সংসারে আবাল্যবার্দ্ধক্য প্রতিপালিত হইয়া আজ সহসা সে এমন একটা ভীষণতর বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করিবে, এ কথা দত্ত সাহেব মনে ক্ষণমাত্র স্থান দিতে পারিলেন না। তবে হঠাৎ কেহ যে তাহাকে কোন তীব্র ঔষধের দ্বারা মৃতকল্প করিয়া নিজের কার্য্যোদ্ধার করিয়া লইয়াছে, ইহাই সম্ভব। কিন্তু জানালা ভিতর হইতে বন্ধ ছিল, এবং ভিতর হইতে খোলা হইয়াছে; তবে কি কোন লোক ঘরের ভিতরে লুকাইয়াছিল—কে জানে?

এইখানে দত্ত সাহেবের মনে একটা বড় গোলমাল বাঁধিয়া গেল। তিনি আপন মনে বলিতে লাগিলেন, “তাহাই বা কিরূপে হইবে? রাত বারটার সময়ে আমি নিজে চারিদিক্ ভাল করিয়া দেখিয়াছি। রহিমও সন্ধ্যা হইতে সেই ঘরে পাহারায় নিযুক্ত ছিল, বাহিরে একটা কনেষ্টবল পাহারা দিতেছিল, কেমন করিয়া অন্য কেহ আমাদের বাড়ীতে অন্যের অলক্ষ্যে প্রবেশ করিতে পারে? বিশেষতঃ আমার লাইব্রেরী ঘরের কবাট খোলা ছিল, সেই লাইব্রেরী ঘরের পাশের ঘরেই সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ ছিল; কাহাকেও সে ঘরে যাইতে হইলে লাইব্রেরী ঘরের সম্মুখ দিয়া যাইতে হইবে। যদিও আমি পরে নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছিলাম—সে নিদ্রা যতই কেন গভীর হউক না, একটু শব্দেই আমি জাগিয়া উঠিতাম। সেলিনার সেই মৃদু করাঘাতের শব্দেই যেকালে আমি জাগিয়া উঠিয়াছিলাম, তখন আমার ঘরের সম্মুখ দিয়া কেহ চলিয়া গেলে তাহার পায়ের শব্দেও আমার ঘুম ভাঙিয়া যাইত। অপর কেহ যে, অন্যের অজ্ঞাতে আমার বাড়ীতে প্রবেশ করিতে পারিয়াছিল, ইহা কেমন করিয়া সম্ভবপর হইতে পারে? অথচ, যে ঘরে শব ছিল, সে ঘরের জানালা ঘরের ভিতর হইতে খোলা হইয়াছে। কি আশ্চর্য্য ব্যাপার! সকলই যেন একটা আরব্য উপন্যাসের ভৌতিক কাণ্ড বলিয়া বোধ হইতেছে। যা-ই হোক, যতক্ষণ না রহিমের জ্ঞান হইতেছে, ততক্ষণ এ রহস্য এমনই গভীর হইয়াই থাকিবে।

যখন দত্ত সাহেব এই রহস্যোদ্ভেদের জন্য একমাত্র রহিমের প্রতীক্ষা করিতেছেন, তখন রহিমের অবস্থা নিতান্ত শোচনীয়। জ্বরে তাহার সর্ব্বাঙ্গ পুড়িয়া যাইতেছে, চক্ষুঃ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, এবং ঘন ঘন নিঃশ্বাস বহিতেছে। সে কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখিতে পারিতেছে না— বিছানায় পড়িয়া ছট্‌ফট্ করিতেছে; এক একবার উদাসদৃষ্টিতে গৃহের চারিদিকে চাহিয়া দন্তে দন্ত নিষ্পীড়ন করিয়া বিকট শব্দ করিতেছে—আর প্রলাপ-চীৎকারে মুহুর্মুহুঃ সমগ্র অট্টালিকা প্রকম্পিত ও প্রতিধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে। তাহার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়।

গফুরের মা নাম্নী দত্ত সাহেবের কোন পরিচারিকা দিন-রাত রহিমের সেবা করিতেছে। রহিমের উপর তাহার একটু টান ছিল। সে অনেকটা পরিমাণে রহিমের দুঃখে দুঃখী,—সুখে সুখী, সুতরাং সেবা শুশ্রূষার কোন ত্রুটী হইতেছে না। যদিও গফুরের মার বয়স গিয়াছে, যদিও তাহার দেহখানি অদৃষ্টপূর্ব্ব স্থূল—এবং সেই দেহের বর্ণ তাহার কৃষ্ণচক্ষুঃ এবং কৃষ্ণকেশের ন্যায় নিবিড় তথাপি রহিমের চোখে সে সমুদয় বড়ই মধুর বলিয়া বোধ হইত। এবং তাহার তীব্রকণ্ঠ অন্যের নিকটে শ্রুতিকটু হইলেও রহিমের কর্ণে তাহা অমৃতবর্ষণ করিত—সে বর্ষণে নিষ্ঠীবন নামক একটা বস্তুও সকল সময়ে মিশ্রিত দেখিতে পাওয়া যাইত। হায়! আজ যদি হতভাগ্য রহিম একেবারে অজ্ঞান হইয়া না পড়িত, তাহা হইলে গফুরের মাকে তাহার রুগ্নশয্যায় বসিয়া, এরূপভাবে সেবা-শুশ্রূষা করিতে দেখিলে এবং সেই স্নেহহস্তের কিশলয়স্পর্শে সে কতই না সুখানুভব করিত!

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – নূতন সূত্র–রুমাল

দত্ত সাহেব বাটীতে আসিয়াই দ্রুতপদে রহিমের ঘরে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দত্ত সাহেবকে আসিতে দেখিয়া গফুরের মা তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইল। দত্ত সাহেব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রহিম এখন কেমন আছে?”

গফুরের মা বলিল, “সেই রকমই। এই কতক্ষণ ডাক্তার সাহেব এসেছিলেন, তিনি বলেন, রহিমের বকুনি না থামলে দাওয়াই দিয়ে কোন ফয়দা হবে না।”

দত্ত সাহেব আপন মনে বলিলেন, “যতক্ষণ না রহিমের মৃত্যু হয়, ততক্ষণ ডাক্তার বেন্টউডের দাওয়াইয়ে যে কোন ফয়দা হবে না, তা’ আমি বেশ জানি। এইরূপ অবস্থায় এখন রহিম মারা গেলে, সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারীদের সন্ধান করিবার আর কোন উপায়ই থাকিবে না—এ হত্যারহস্য চিরকাল এমনই প্রচ্ছন্ন থাকিয়া যাইবে।”

রুগ্ন রহিমের হস্তপদাদির বিক্ষেপে বিছানার চাদরখানা স্থানে স্থানে গুটাইয়া গিয়াছিল, দত্ত সাহেব তাহা টানিয়া ঠিক করিয়া দিতে লাগিলেন। সেই সময়ে কেমন একটা অননুভূতপূর্ব্ব গন্ধ তাঁহার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করিতে লাগিল। কিন্তু সেই গন্ধটা কোথা হইতে আসিতেছে, ঠিক করিতে পারিলেন না। তিনি বিশেষ মনোযোগের সহিত ঘরের চারিদিক্ দেখিতে লাগিলেন। চারিদিক্‌ চাহিয়া, কোথায় কিছু দেখিতে না পাইয়া, যখন তিনি রহিমের মস্তকের কাছে মুখ লইয়া গেলেন, তখন সেই গন্ধটা পূৰ্ব্বাপেক্ষা আরও যেন একটু উগ্র বলিয়া বোধ হইল। রহিমের মস্তকের ক্ষতস্থান ব্যাণ্ডেজ করা ছিল, বোধ হইল, তথা হইতেই সেই গন্ধটা বাহির হইতেছে। তখন তিনি ব্যাণ্ডেজের বস্ত্রখণ্ড বিশেষ মনোযোগের সহিত দেখিতে লাগিলেন। দেখিলেন, ব্যাণ্ডেজের বস্ত্র খণ্ডের ভিতর হইতে একখানি রেশমী রুমালের একটি কোণের খানিকটা দেখা যাইতেছে। দেখিয়া তিনি শিহরিয়া উঠিলেন। গফুরের মাকে সেই রুমালের কোণ দেখাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ রুমাল এখানে কোথা হইতে আসিল?”

গফুরের মা বলিল, “তা” আমি জানি না, এ ঘরে যখন রহিমকে আনা হয়, তখন থেকেই ঐ রুমাল ব্যাণ্ডেজের সঙ্গে রহিয়াছে। ডাক্তার সাহেব ব’লে গেছেন, এখন যেন ও ব্যাণ্ডেজে হাত দেওয়া না হয়—তা’ হ’লে রহিমকে নিয়ে বড় মুস্কিলে পড়তে হবে।

দত্ত সাহেব সে কথা কানে না করিয়া ধীরে ধীরে রহিমের মস্তকের ব্যাণ্ডেজ খুলিতে লাগিলেন। মনে করিলেন, সেই রুমালখালি কাহার জানিতে পারিলে, আপাততঃ এই অনুদ্ঘাটীত হত্যা-রহস্যের মর্ম্মভেদ করিবার একটা সূত্রও পাওয়া যাইতে পারে।

দত্ত সাহেবের কার্য্যকলাপ দেখিয়া গফুরের মার মুখ ভয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া গেল। তাহার মনিব যে কার্য্য করিতেছেন, তাহা একান্ত অন্যায় বুঝিয়াও সে সাহস করিয়া কোন কথা মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিল না। সে কেবল ভীতিবিহ্বল দৃষ্টিতে দত্ত সাহেবের হাতের দিকে চাহিয়া রহিল। ক্ষণকাল মধ্যে দত্ত সাহেব ব্যাণ্ডেজ খুলিয়া সেই রেশমী রুমালখানা বাহির করিয়া লইলেন। সেই রুমালখানির স্থানে স্থানে শুষ্ক রক্তের দাগ এবং কোণে লাল সূতায় সেলিনার মা’র নাম লিখিত রহিয়াছে, দেখিয়া দত্ত সাহেবের বুকের মধ্যে উত্তপ্ত রক্ত ফুটিতে লাগিল।

“মার্‌শন!” দত্ত সাহেব অতিমাত্র বিস্ময়ের সহিত বলিতে লাগিলেন, “এ যে সেলিনার মা’র নাম। সে রাত্রে তাহার এ রুমালখানা কে এখানে লইয়া আসিল? রুমালে এ কিসের গন্ধ?” গন্ধটা তাঁহার পরিচিত বলিয়া মনে হইতে লাগিল। সামান্যমাত্র চেষ্টায় অল্পক্ষণ মধ্যে তিনি বুঝিতে পারিলেন, ইহা তাঁহারই সেই অপহৃত বিষ-গুপ্তি মধ্যস্থ বিষের গন্ধ। তখন তাঁহার দেহস্থ সমুদয় রক্ত যুগপৎ শীতল হইয়া গেল, এবং তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের ন্যায় সেইখানে বসিয়া পড়িলেন।

বিস্ময়বিমুগ্ধ দত্ত সাহেবের মনের ভিতরে অত্যন্ত গোলমাল বাঁধিয়া গেল—একবার মনে হইল, তবে কি মিসেস্ মার্র্শন আমার সেই বিষগুপ্তি অপহরণ করিয়াছেন? এই রুমালে, বিষ-গুপ্তির বিষ লাগাইয়া তিনিই কি স্বহস্থে রহিমকে হতজ্ঞান করিয়াছেন? এ সকল ভয়ানক অভিনয়ে তবে কি তিনিই একমাত্র অভিনেত্রী? এইরূপ অনেক প্রশ্ন তাঁহার মনে উঠিতে লাগিল, কিন্তু কোনটারই মীমাংসা হইল না।

ডাক্তার বেন্টউডের উপরেও দত্ত সাহেবের সন্দেহ হইতে লাগিল। বেন্টউড এই বিষাক্ত রুমাল দিয়া রহিমের মস্তকের ক্ষতস্থান ব্যাণ্ডেজ করিয়াছেন, এবং সেই রুমাল যাহাতে তাহাকে না জানাইয়া খোলা না হয়, সেজন্য গফুরের মাকে বিশেষ সাবধানে থাকিতে বলিয়া গিয়াছেন। এ সকলের অর্থ কি? ডাক্তার বেন্টউড কি তবে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আছেন? তিনি এই রুমাল কোথায় পাইলেন? হয়ত তিনি মিসেস্ মারশনের কাছে এই রুমাল পাইয়াছেন, নতুবা, ইহা মার্শনের কাজ, তিনি মৃতদেহ অপহরণ করিতে আসিয়া এই রুমাল ফেলিয়া গিয়াছেন। ডাক্তার বেন্টউড ব্যাণ্ডেজ করিবার সময়ে, মুচ্ছিত রহিমের পার্শ্বেই হয়ত এই রুমালখানা পড়িয়া থাকিতে দেখিয়াছিলেন। ভ্রম ক্রমে? ভ্রমক্রমেই বা কিরূপে হইবে? এই রুমাল যাহাতে খোলা না হয়, সেজন্য গফুরের মাকে তিনি সতর্ক করিয়া গিয়াছেন; নিশ্চয় তিনি জানিয়া এ কাজ করিয়াছেন। ডাক্তার বেন্টউড ইহার মূলে আছেন—তিনি বড় সহজ লোক নহেন। এখন বুঝিতে পারিতেছি, বেন্টউডের সহায়তায় সেলিনার মা এই সকল ভয়ানক কাজ করিতেছেন, তিনিই বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছেন, এবং সেই বিষ-গুপ্তির দ্বারা সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছেন; তাহার পর বেন্টউডের সহায়তায় সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছেন। আমি বিশ্বস্তসূত্রে অবগত আছি, সেলিনার সহিত সুরেন্দ্রনাথের বিবাহ হয়—এ ইচ্ছা তাঁর আদৌ ছিল না; কিন্তু যখন তিনি বুঝিতে পারিলেন, তাঁহার একমাত্র কন্যা সেলিনা সুরেন্দ্রনাথ ছাড়া আর কাহাকেও বিবাহ করিবে না, তখন তিনি নিজের অভীষ্টসিদ্ধির জন্য নিজেই সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিয়াছেন।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – বিষাক্ত রমাল

দত্ত সাহেবের মাথার ঠিক নাই; যতবার তিনি চিন্তার পর চিন্তা করিয়া নিঃসন্দেহ হইতে চেষ্টা করিতেছেন, ততই তিনি সন্দেহাকুল হইয়া উঠিতেছেন। তাঁহার মনের যখন এইরূপ শোচনীয় অবস্থা, তখন তিনি এ বিষয়ে অমরেন্দ্রের সহিত একটা পরামর্শ করা যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করিয়া জনৈক ভৃত্যের দ্বারা তাঁহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। অমরেন্দ্রনাথ আসিলে একমাত্র মিসেস্ মার্শনের উপরেই যে, তাঁহার সন্দেহ হইতেছে, সে কথা তাঁহাকে বেশ বুঝাইয়া বলিতে লাগিলেন।

শুনিয়া অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা ঠিক নয়। সেলিনার মাতা যে এমন একটা হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত আছেন, এ কথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস্য বলিয়া বোধ করি না। একজন স্ত্রীলোক দ্বারা এ সকল ভয়ানক কাণ্ড কখনই এমন সহজে সুচারুরূপে সম্পন্ন হইতেই পারে না।”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “কিন্তু অমর, সেলিনার মাতার এ রুমালখানা এখানে কি প্রকারে আসিল?”

অমরেন্দ্র বলিলেন, “সেই রাত্রে সেলিনা এখানে আসিয়াছিল; সম্ভব সেলিনাই রুমালখানা এখানে ফেলিয়া গিয়াছে।”

একটু চিন্তা করিয়া দত্ত সাহেব কহিনলে, “হ’তে পারে, কিন্তু এ রুমালে আমাদের বিষ-গুপ্তির বিষের গন্ধ কোথা হইতে আসিল?”

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনার মুখেই একদিন শুনিয়াছি, ছোটনাগপুরের লোকেরা ঐ বিষ-গুপ্তির বিষ তৈয়ারি করিতে জানে; জুলেখা সেই দেশের মেয়ে, জুলেখা সেই বিষ তৈয়ারি করিয়া থাকিবে। এ গন্ধ যে আমাদের বিষ-গুপ্তিরই বিষের গন্ধ, তাহার তেমন কোন সন্তোষজনক প্রমাণ কোথায়?”

দত্ত সাহেব বলিলেন, “তাহাই যেন হইল, জুলেখাই এই বিষ তৈয়ারি করিয়াছে, কিন্তু রুমালে মাখাইবার কারণ কি?”

অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এ কথার আমি কি উত্তর দিব? জুলেখাকে জিজ্ঞাসা করিলে, সে ইহার কারণ বলিতে পারে।”

“তাহাই আমাকে করিতে হইবে।” বলিয়া দত্ত সাহেব চেয়ার ঠেলিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। দাঁড়াইয়া দৃঢ়স্বরে অমরেন্দ্রনাথকে বলিলেন, “অমর আরও আমাকে দেখিতে হইবে, কোন্ প্ৰয়োজন সে এই বিষ তৈয়ারি করিয়াছে। আমি এখন বেশ বুঝিতে পারিতেছি, জুলেখাই এই সকল কাণ্ডকারখানার মধ্যে আছে—আর কেহ নহে। জুলেখাই আমার বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছে, বিষ-গুপ্তির বিষ তৈয়ারি করিয়াছে—সেই বিষে সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে; তাহার পর পিশাচী তাহার মৃতদেহ অপহরণ করিয়াছে। এই সকল পৈশাচিক কাণ্ড—সেই পিশাচীকে সম্ভবে।”

অবক্ষেপককণ্ঠে অমরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এইমাত্র সেলিনার মা’র উপরে দোষারোপ করিতেছিলেন, এখন আবার আপনি মনে করিতেছেন যে—”  

বাধা দিয়া দত্ত সাহেব বলিলেন, “চুপ কর অমর, আমি কি মনে করিতেছি, না করিতেছি, সে কথায় কাহারও কোন প্রয়োজন নাই। জুলেখা কিম্বা সেলিনার মাতা–কে তা’ ঠিক বলিতে পারি না, এই দুজনের মধ্যে অবশ্যই একজন এই ভয়ঙ্কর হত্যাভিনয়ের অভিনেত্রী। আমি এখনই সেলিনাদের বাড়ীতে যাইব। দেখি, নিজে যাইয়া কিছু করিতে পারি কি না।”

স্বর হতাশাসংক্ষুব্ধ।

অমরেন্দ্র বলিলেন, “সেখানে গিয়া এখন আপনি কি করিবেন? তাঁহাদিগের দোষ সপ্রমাণ করিতে পারেন, এখনও তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। সহসা এ সব কথা তাঁহাদিগের নিকটে উত্থাপন করিয়া কি হইবে?”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “না, আমি সেজন্য যাইতেছি না। প্রথমে আমি একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে চাই, সেলিনার নিকটে কোন সন্ধান পাওয়া যায় কিনা। সে সুরেন্দ্রনাথকে একান্ত ভালবাসিত, সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারীর সন্ধানে তাহার নিকটে দুই-একটা সন্ধানও পাওয়া যাইতে পারে।”

অমরেন্দ্র বলিলেন, “সেলিনার নিকটে আপনি কোন সন্ধান পাইবেন না। আপনি কি মনে করেন, সে তাহার মাতা কিম্বা জুলেখার বিপক্ষে কোন কথা আপনার নিকটে প্রকাশ করিবে?”

“স্ত্রীলোকের প্রতিহিংসার নিকটে তাহার পরমাত্মীয়ও নিস্তার পায় না। যেমন করিয়া হউক, একদিন আমি এ গভীর রহস্যের মর্ম্মভেদ করিবই।” এই বলিয়া দত্ত সাহেব ঘরের বাহির হইয়া গেলেন।

অমরেন্দ্রনাথ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বাটীর ভিতরে চলিয়া গেলেন।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – সূত্ৰান্বেষণ

দত্ত সাহেব সেলিনার সহিত দেখা করিতে চলিলেন। ভাবিয়া ভাবিয়া মনের অস্থিরতায় তাঁহার মস্তিষ্ক সাতিশয় চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, এবং মনের দৃঢ়তা আদৌ ছিল না। অনেক দূর আসিয়া আবার কি মনে করিয়া নিজের বাটীর দিকে ফিরিতে আরম্ভ করিলেন। বাটীতে আসিয়া পুনরপি অমরেন্দ্রকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। অমরেন্দ্র আসিলে তাঁহাকে বলিলেন, “অমর, তোমাকে আরও দুই-একটা কথা আমার জিজ্ঞাসা করিবার আছে। যখন তুমি সেলিনাকে তাহাদের বাড়ীতে রাখিতে যাও, তখন তাহাদের বাড়ীর অবস্থা কিরূপ ছিল? সকলে নিদ্রিত ছিল—না কেহ জাগিয়াছিল? যখন তুমি সেলিনাকে রাখিয়া ফিরিয়া আসিলে, তখন ডাক্তার বেন্টউড, গঙ্গারামবাবু আসিয়া পড়িয়াছিলেন বলিয়া এ সকল কথা জিজ্ঞাসা করিবার সুবিধা হয় নাই, তাহার পর আর মনে ছিল না। সে রাত্রে সেলিনাকে রাখিতে যাইয়া প্রথমে কাহার সহিত তোমার দেখা হইল?”

অমর। সেলিনার মা’র সঙ্গে?

দত্ত। তিনি কি জাগিয়া ছিলেন?

অমর। হাঁ, তখন তিনি জাগিয়া ছিলেন। সহসা রাত্রে সেলিনাকে বাটীমধ্যে দেখিতে না পাইয়া, তিনি তখন অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিলেন। তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্নভাবে বারান্দায় পরিক্রমণ করিতেছিলেন।

দত্ত। বটে। তখন কি তিনি রাত্রিবাসে ছিলেন?

অমর। না—রাত্রিবাসে ছিলেন না। যতদূর মনে পড়ে, তাতে বোধ হয়, তখন তিনি বেড়াইতে বাহির হইবার বেশে ছিলেন।

দত্ত। আর জুলেখা?

অমর। জুলেখা তখন সেখানে ছিল না, কই—তাহাকে তখন দেখিতে পাই নাই। সেলিনার মাতার নিকটে সেলিনাকে রাখিয়া আমি চলিয়া আসিলাম। সেলিনার অবস্থা তখন বড় ভয়ানক— সেলিনার মা তাড়াতাড়ি সেলিনাকে লইয়া গিয়া তাহার ঘরে শুয়াইয়া দিল। সে সময়ে আমি সেলিনার মাকে জুলেখার সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার কোন সুবিধাও পাই নাই।

দত্ত সাহেব আপন মনে বলিলেন, “সেলিনার মাতার তখন বেড়াইতে বাহির হইবার বেশ! অথচ জুলেখাও তখন সেখানে ছিল না! ইহার ভিতরে অবশ্যই একটা গুরুতর রহস্য আছে।” তাহার পর অমরেন্দ্রের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত করিয়া বলিলেন, “অমর, সমস্তই ঠিক হইয়াছে, তোমার নিকটে আমার আর কিছু জানিবার নাই।”

এই বলিয়া দত্ত সাহেব পুনরায় বাহির হইয়া গেলেন এবং সেলিনাদের বাড়ীর দিকে চলিলেন।

পথে অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া দত্ত সাহেব অমরেন্দ্রনাথের সহিত অনেকটা পরিমাণে একমত হইতে পারিলেন যে, সেলিনার নিকট হইতে বিশেষ কিছু সন্ধান পাইবার কোন সম্ভাবনা নাই। সেদিন রাত্রে সেলিনার যে উদ্ভ্রান্তভাব দেখা গিয়াছিল, তাহাতে সে সেই রাত্রের কোন কথাই বলিতে পারিবে না। সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যুতে সে উন্মাদিনীর ন্যায় হইয়াছিল; তাতে আমাদের এখানে আসিবার পূর্ব্বে যদি সেলিনা নিজের বাড়ীতে সন্দেহজনক কোন কিছু দেখিয়া থাকে, এখন সে সকল স্মরণ করা তাহার পক্ষে একান্ত দুঃসাধ্য হইবে। তাহার পর এখন সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ অপহরণে তাহার বিকৃত মস্তিষ্ক আরও বিকৃত হইয়া গিয়াছে।

সপ্তম পরিচ্ছেদ – আর এক ভাব

সন্দেহমন্দপদে দত্ত সাহেব সেলিনাদের বাটীতে প্রবেশ করিলেন। অগ্রেই সেলিনার সহিত তাঁহার দেখা হইল। তিনি যে অভিপ্রায়ে আসিয়াছেন, তাহাতে সেলিনার মাতা কিম্বা জুলেখার সহিত সাক্ষাৎ হইবার পূর্ব্বে সেলিনার সহিত প্রথমে দেখা হয়, ইহাই তাহার বাঞ্ছনীয়। নতুবা তাঁহার অভীষ্টসিদ্ধির পক্ষে অনেক বিঘ্ন ঘটিবার সম্ভাবনা ছিল।

দত্ত সাহেব গেট পার হইয়া দেখিলেন, শ্যামতৃণাচ্ছন্ন বহিরঙ্গনে সেলিনা একাকী অবনতমুখে ধীরপদে পরিক্রমণ করিতেছে। তাহার মুখভাব বিষণ্ণ, তাহার আয়তনেত্রের কোমলোজ্জ্বল দৃষ্টিতেও একটা বিষণ্ণতার ম্লান ছায়া পড়িয়াছে; এবং সে বিষণ্ণতায় তাহার মুখভাব আরও গম্ভীর দেখাইতেছে। দেখিয়া দত্তসাহেব অতিশয় বিস্মিত হইলেন। তিনি সে রাত্রে সেলিনার যেরূপ ব্যাকুলতা, যেরূপ উদ্বেগ, এবং তাহার প্রত্যেক অঙ্গভঙ্গীতে যেরূপ একটা বালিকাসুলভ চাঞ্চল্য দেখিয়াছিলেন, আজ তাহার কিছুই দেখিলেন না।

প্রথমে সেলিনা, দত্ত সাহেবকে দেখিতে পায় নাই। যখন তিনি সেলিনার একেবারে সম্মুখবর্তী হইয়া দাঁড়াইলেন, তখন সেলিনা তাঁহাকে দেখিয়া প্রথমে একটু চমকিত হইয়া উঠিল। তাহার পর ব্যাগ্রকণ্ঠে কহিল, “এই যে আপনি আসিয়াছেন—ভালই হইয়াছে, আমি এইমাত্র মনে করিতেছিলাম, এখনি আপনার সঙ্গে দেখা করিতে আপনার বাড়ীতে যাইব।”

“আমার সঙ্গে দেখা করিতে! কেন সেলিনা?”

“হাঁ, আপনার সঙ্গে দেখা করিতে।” সেলিনা দৃঢ়স্বরে কহিল, “সে দিনকার সেই ভয়ানক রাত্রের অনেক কথা এখনও আমি শুনি নাই।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “সে সকল কথা স্মরণ করিয়া কেন নিজেকে ব্যথিত করিবে? এখন ও সকল চিন্তা যত শীঘ্র মন হইতে দূর করিতে পার—ততই ভাল।”

সেলিনার আয়তচক্ষুঃ আয়ততর হইয়া জ্বলিয়া উঠিল। সেলিনা বলিতে লাগিল, “নিজের ভালর চেষ্টা পরে করিব, এখনও আমি আমার নিজের কর্ত্তব্য শেষ করিতে পারি নাই—হত্যাকারী এখনও ধরা পড়ে নাই। তাহার সন্ধানের জন্য আমি প্রাণপণ করিব, এবং আপনাকে সাধ্যমত সাহায্য করিতে ত্রুটি করিব না। আপনি আমার মুখে এ সকল কথা শুনিয়া কি মনে করিতেছেন, জানি না। হয়ত আমাকে অল্পবয়স্কা মনে করিয়া আপনি আমার কোন কথাই মনে স্থান দিতেছেন না—সেদিন রাত্রে আমার উন্মত্তভাব দেখিয়াছিলেন; আজ আবার আমার মুখে এই সকল কথা শুনিয়া আমাকে আপনি উন্মাদিনী ভাবিতেছেন, নিশ্চয়। আপনি যা-ই মনে করুন না কেন, আমি নিশ্চয় জানি, আমার এ বালিকাবুদ্ধিতেও হত্যাকারীর সন্ধানে আমি আপনার অনেকটা সাহায্য করিতে পারিব।”

সেলিনার কণ্ঠ আগ্রহপূর্ণ, স্থির, ধীর এবং মর্মস্পর্শী, এবং তাহার মুখভাবও আজ বড় গম্ভীর। সেদিনকার সেই উদ্বেগচঞ্চলা সেলিনার আজ এইরূপ অভাবনীর পরিবর্তনে দত্ত সাহেব বিস্মিত হইয়া তাহার মুখের দিকে অনিমেষনেত্রে চাহিয়া রহিলেন।

সেলিমা জিজ্ঞাসা করিল, “ইহার মধ্যে আপনি হত্যাকারীদের সন্ধানের কিছু করিতে পারিয়াছেন কি? আমাকে বলুন—আমাকে কোন কথা গোপন করিবেন না।”

দত্তসাহেবও মনে মনে বুঝিলেন যে, এরূপ স্থলে সেলিনার সাহায্য ব্যতীত তিনি একাকী নিজে বিশেষ কিছু সুবিধা করিয়া উঠিতে পারিবেন না। তখন তিনি তাঁহার সহিত গঙ্গারামের যে সকল কথাবাৰ্ত্তা হইয়াছিল, তাহা সেলিনাকে বলিলেন। তাহার পর সেই রুমালের কথা বলিলেন। যতক্ষণ দত্ত সাহেব বলিতে লাগিলেন, ততক্ষণ সেলিনা একটি কথারও প্রতিবাদ করিল না—তাহার বিশালনেত্রের সরল দৃষ্টিতে দত্ত সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া নীরবে শুনিয়া যাইতে লাগিল। দত্ত সাহেবের বলা শেষ হইলে, সেলিনা একটু ইতস্ততঃ করিল, তৎক্ষণাৎ ক্ষুণ্ণভাবে কহিল, “আপনার কথায় বুঝাইতেছে যে, আপনি আমার মা আর জুলেখাকে এই সকল হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত আছে বলিয়া সন্দেহ করিতেছেন।

সেলিনার এইরূপ স্পষ্টবাক্যে দত্ত সাহেব বড় অপ্রতিভ হইলেন; কিছু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, “না তা’ আমি ঠিক মনে করি নাই। তবে এরূপ স্থলে রহিমের মাথার ব্যাণ্ডেজের ভিতরে তোমার মার রুমালখানা দেখিয়া আমার বড় আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে।”

সে। ইহাতে আশ্চর্য্যের কিছুই না। ডাক্তার বেন্টউড সেই রুমাল দিয়া ব্যাণ্ডেজ করিয়াছেন।

দত্ত। তা’ আমি জানি; কিন্তু ডাক্তার বেন্টউড কি তখন সেই রুমাল সঙ্গে করিয়া অসিয়াছিলেন?

সে। তিনি কেন রুমাল সঙ্গে করিয়া আসিবেন? তিনি রুমালখানা সেইখানে পড়িয়া থাকিতে দেখিবেন।

দত্ত। তাহাই যেন হইল; তাহা হইলে তোমার মা–

সে। [বাধা দিয়া] মা এ রুমালের কথা কিছুই জানেন না। আমিই রুমালখানা সেখানে ফেলিয়া আসিয়াছিলাম। ইহাতে আশ্চর্য্যের কিছুই নাই, সেদিন আমি ভ্রমক্রমে মার রুমালখানা আপনাদের বাটীতে লইয়া গিয়াছিলাম; তখন আমার মনের কিছুমাত্র ঠিক ছিল না, কখন্ রুমালখানা হাত হইতে পড়িয়া গিয়াছে, জানিতে পারি নাই। তাহার পর কখন হয়ত ব্যাণ্ডেজ করিবার সময়ে ডাক্তার বেন্টউড রুমালখানি কুড়াইয়া লইয়া ব্যাণ্ডেজ করিয়া থাকিবেন। ইহাতে আমি গোলযোগের কিছুই দেখি না।

দত্ত। গোলযোগের কিছু না থাকিলেও, একটা বিষয়ে কিছু গোলযোগ আছে; সেই রুমালে আমাদের বিষ-গুপ্তির বিষের গন্ধ কোথা হইতে আসিল, বলিতে পার কি?

সে। আমি আপনাদের বিষ-গুপ্তি কখন দেখি নাই, সে সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানি না। আপনি রুমালের যে গন্ধের কথা বলিতেছেন, তাহা আমি জানি। উহা একটা ঔষধের গন্ধ। সেদিন রাত্রে আমি পীড়িত হই; আমার সেদিনকার অবস্থা আপনি নিজেও দেখিয়াছেন। আমাকে পীড়িত দেখিয়া, জুলেখা তাহাদের দেশের কি একটা ঔষধ তৈয়ারি করিয়া, মার রুমালে লাগাইয়া আমার কপালে বাঁধিয়া দেয়। ঔষধটা কিছু উপকারী; আপনি রুমালে সেই ঔষধের গন্ধ পাইয়া থাকিবেন। আমি সেদিন রাত্রে যখন আপনাদের বাড়ীতে পলাইয়া যাই, আমার বেশ মনে পড়িতেছে, আমি রুমালখানা কপাল হইতে খুলিয়া হাতে করিয়া লইয়া যাই।

দত্ত। সকলই বুঝিলাম, কিন্তু এই দুই গন্ধের সাদৃশ্য বড় বিস্ময়জনক। এইজন্যই স্বতই কেমন একটা সন্দেহ হইতেছে।

“হইবারই কথা; কিন্তু এ সন্দেহ বেশিক্ষণ থাকিবে না। জুলেখাকে জিজ্ঞাসা করিলে আপনি সকলই জানিতে পারিবেন। আসুন, আমার সঙ্গে একবার বাড়ীর ভিতরে চলুন।” এই বলিয়া সেলিনা গমনোদ্যত ভাবে উঠিয়া দাঁড়াইল।

সেলিনা অগ্রে অগ্রে চলিল, এবং দত্ত সাহেব তাহার অনুসরণ করিলেন।

অষ্টম পরিচ্ছেদ – রুমাল-রহস্য

যাইতে যাইতে দত্ত সাহেব বলিলেন, “সেলিনা, আমার ত বিশ্বাস হয় না, জুলেখা তোমার মত এমন অকপটভাবে কোন কথা আমার কাছে প্রকাশ করিবে। ভাল কথা, আচ্ছা সেলিনা, সেদিন শেষ রাত্রে তুমি কিরূপে এখান হইতে গোপনে পলাইয়া আমাদিগের বাড়ীতে গিয়াছিলে? কেহ কি, সে সময়ে তোমায় কোন সহায়তা করিয়াছিল?”

সেলিনা কহিল, “কেহ না। বোধ হয়, আপনি আমাদের জুলেখাকে উদ্দেশ করিয়া এ কথা বলিতেছেন। সেদিন আমার মনের কিছুই ঠিক ছিল না। মনে হয়; আমি নিজের শয়নগৃহ হইতেই একাকী চুপি চুপি উঠিয়া যাই।”

দত্ত সাহেব সন্দিগ্ধচিত্তে কহিলেন, “সেদিন তুমি পীড়িত, তাহাতে তোমার শুশ্রূষার জন্য তখন কি তোমার ঘরে আর কেহ ছিল না?”

সেলিনা কহিল, “মা আমার ঘরে ছিলেন; আমি যখন উঠিয়া যাই, তখন তিনি ঘুমাইতেছিলেন—জানিতে পারেন নাই। আমার মা যে, আপনাদের বাড়ীতে গিয়া সে রাত্রে রুমাল ফেলিয়া আসিয়াছেন বলিয়া আপনার সন্দেহ হইতেছিল, ইহাতেই বুঝিয়া দেখুন, আপনার সন্দেহ কতদূর অমূলক।”

দত্ত সাহেব অপ্রতিভ হইলেন। কহিলেন, “না, তাঁহার উপরে আমার কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু তোমার মা’র রুমালে বিষ-গুপ্তির বিষের গন্ধ কোথা হইতে আসিল?”

সেলিনা কহিল, “জুলেখার সহিত দেখা করিলে আপনি সহজে সকলই বুঝিতে পারিবেন। জুলেখা আমারই জন্য একটা ঔষধ তৈয়ারি করিয়া সেই রুমালে লাগাইয়াছিল; হয়ত আপনি সেই ঔষধের গন্ধকে আপনার বিষ-গুপ্তির বিষের গন্ধ মনে করিতেছেন।”

এখন সেলিনার সঙ্গে দত্ত সাহেব দ্বিতলের বারান্দায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন; তখন জুলেখা বারান্দার অপরপার্শ্বের ফুলগাছগুলির টবে জল ঢালিতেছিল। জুলেখাকে দেখিয়া দত্ত সাহেব সেইখানে দাঁড়াইলেন, এবং সেলিনাকে দাঁড়াইতে বলিয়া বলিলেন, “আর একটা কথা আছে, বেন্টউড যে সেই রুমাল কুড়াইয়া লইয়া ব্যাণ্ডেজ করিয়াছিলেন, তাহা তুমি কিরূপে জানিতে পারিলে?”

সেলিনা কহিল,”একদিন ডাক্তার বেণ্টউডকে আমার মা’র কাছে এ কথা বলিতে শুনিয়াছি।” দত্ত সাহেব কহিলেন, “বটে, কিন্তু তিনি এ রুমাল সেখানে কিরূপে পাইলেন, সে সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেন নাই?”

সেলিনা কহিল, “না, সে কথা আমি ঠিক বলিতে পারিলাম না। কই, তাঁহাকে সে সম্বন্ধে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে আমি শুনি নাই।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “কথাটা যেন কেমন শুনাইতেছে; রুমালখানা কোথা হইতে আসিল, কে আনিল, এ সম্বন্ধে তিনি কোন কথাই তখন জিজ্ঞাসা করিলেন না; কি আশ্চর্য! বিশেষতঃ তুমি যে সে রাত্রে আমাদের বাড়ীতে গিয়াছিলে, তিনি তাহার বিন্দুবিসর্গ অবগত নহেন।”

সেলিনার মুখমণ্ডল আরক্ত হইয়া উঠিল। মৃদুকণ্ঠে বলিল, “সে রাত্রে আমি যে আপনাদের বাড়ীতে গিয়াছিলাম, তাহা তিনি জানেন। আমার মা ডাক্তার বেন্টউডকে আমার পীড়ার কথা যখন বুঝাইয়া বলেন, তখন তিনি সে রাত্রের সকল কথাই তাঁহার নিকটে প্রকাশ করেন। তাহাতে বোধ করি, আমি যে আপনাদের বাড়ীতে রুমাল ফেলিয়া আসিয়াছিলাম, তাহা ডাক্তার বেন্টউড অনুভবেই বুঝিতে পারিয়াছিলেন।”

এই বলিয়া সেলিনা জুলেখার দিকে দ্রুতপদে চলিয়া গেল; সেলিনার কথার ভাবে এবং এক-একবার ইতস্ততঃ করায় দত্ত সাহেব মনে মনে বুঝিতে পারিলেন, সেলিনা তাঁহার নিকটে কিছু গোপন করিবার চেষ্টা করিতেছে। যাহাই হউক, সেলিনার দিকে সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে চাহিতে চাহিতে ধীরপদে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। দত্ত সাহেব মনে করিয়াছিলেন, সেলিনা তাহার প্রণয়-পাত্র সুরেন্দ্রনাথের হত্যার প্রতিশোধ লইতে হত্যাকারীর সন্ধানে তাহার আর কোন সাহায্য করুক বা না করুক, সেলিনা অকপটভাবে তাঁহার নিকটে সকল কথা প্রকাশ করিবে। কিন্তু, সেলিনার এখনকার কথার ভাবে দত্ত সাহেব সহজেই বুঝিতে পারিলেন, সেলিনা যাহা জানে, তাহার মধ্যে অনেক কথা আজ তাঁহার নিকটে ঢাকিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছে। ইহাতে বোধ হয়—জুলেখার উচ্চকণ্ঠে সহসা দত্ত সাহেবের চিন্তাস্রোতে বাধা পড়িল। তখন তিনি জুলেখার সম্মুখীন হইয়াছেন।

জুলেখা তাহার তীক্ষ্ণদৃষ্টি দত্ত সাহেবের মুখের উপরে স্থাপন করিয়া বলিল, “হুজুর, সেলিনার মুখে শুন্‌লেম, আপনি আমাদের দেশের কাউরূপীর কথা শুনতে চান। কিন্তু এ দেশের আর সকলেই আমাদের কাঁউরূপীকে হেসে উড়িয়ে দেয়।”

দত্ত সাহেব আশাতিরিক্ত গম্ভীরভাবে কহিলেন, “না, আমি তোমাদের কাঁউরূপীর কোন কথা শুনতে চাই না। তুমি যে ঔষধ তৈয়ারী করিয়া তোমার মনিবদের রুমালে লাগাইয়াছিলে, আমি কেবল সেই ঔষধের কথা জানিতে চাই।”

সেলিনা তাড়াতাড়ি কহিল, “তোর মনে নাই, জুলেখা, আমার ব্যারামের সময়ে এই যে কি একটা ঔষধ তুই মা’র একখানা রুমালে মাখিয়ে আমার কপালে বেঁধে দিয়েছিলি?”

জুলেখা চোখ দুটা কপালে তুলিয়া আকাশ হইতে পড়িল। বলিল, “সে বড় চমৎকার দাওয়াই, গন্ধে কোন শয়তান কাছে আসতে পারে না, আমাদের দেশের আমীরা এই দাওয়াইকে বড় খেয়াল করে।”

দত্ত। কোথায় তোমাদের দেশ? ছোটনাগপুর?

জুলেখা। ঠিক বলেছেন। সে দাওয়াইয়ের গন্ধ বড় তেজাল। এমন কি বেশী হ’লে মানুষ মারা পড়ে।

দত্ত। গন্ধে মানুষ মারা পড়ে?

জুলেখা। গন্ধে কোন্ শয়তান, বদ্ বাতাস কাছে আসতে পারে না। যদি সূচে করে ঐ দাওয়াই একটু গায়ে ফুটিয়ে দেওয়া যায়—যত বড় জোয়ান্ আদ্‌মী হোক্ না কেন, একদম্ মারা পড়বে।

দত্ত। তোমাদের দেশের চালেনা-দেশমে কি সেই দাওয়াই থাকে?

অত্যন্ত বিস্ময়ের ভান করিয়া জুলেখা বলিল, “ঠিক বলেছেন। আপনি চালেনা-দেশমের কথা কি ক’রে জানলেন?

দত্ত। আমার একটা ‘চালেনা-দেশম’ ছিল।

সন্দেহের উচ্চহাস্য করিয়া জুলেখা বলিল, “সে এ দেশে কোথা পাবেন? আমাদের দেশের বড় বড় মান্‌কীর কাছে এক-একটা থাকে।”

দত্ত। হাঁ, আমি তোমাদের দেশের একজন মান্কীর কাছ থেকে এনেছিলেম। আপাততঃ, সেটা চুরি গেছে।

নবম পরিচ্ছেদ – জুলেখার কৌশল

সেলিনা জুলেখাকে কহিল, “সেই বিষ-গুপ্তি চুরির কথা ইহার মধ্যেই ভুলিয়া গেছিস, জুলেখা? তুই চুরি করিয়াছিস্ বলিয়া তোর উপরে কত সন্দেহ হয়েছিল।”

জুলেখা বলিল, “হাঁ হুজুর, এখন আমার ঠিক মনে পড়েছে। আমার উপরেই সকলের সন্দেহ হয়েছিল যে, আমি সেই চালেনা-দেশম চুরি করিয়া আনিয়াছি, তাতে নূতন বিষ দিয়ে ছোট সাহেবকে খুন করেছি।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “তুমি খুন কর আর নাই কর, সেই চালেনা-দেশমের বিষের সাহায্যেই ছোট সাহেবের মৃতদেহ কেহ চুরি করিয়াছে।”

অধীরভাবে জুলেখা কহিল, “তা’ হবে, তা’ হবে—আমি তার কিছু জানি না। হুজুরের চালেনা-দেশমের ভিতরে কি বিষ ছিল?”

দত্ত। বিষ ছিল, শুখাইয়া গিয়াছিল।

জুলে। তাতে ক্ষতি কি, একটু জল দিলেই বিষ আবার তেমনি তেজাল হইয়া ওঠে। হুজুর, আমার কোন দোষ নাই, আমি চালেনা দেশম দেখিনি। তবে রুমালে যে দাওয়াই আছে, তা’ আমি সেলিনার জন্য তৈয়ারী করেছি।

বাক্যশেষে জুলেখা দত্ত সাহেবের উত্তর প্রতীক্ষায় যোড়হস্তে তাঁহার মুখের দিকে বিনীতভাবে চাহিয়া রহিল। দত্ত সাহেব আর কিছুই বলিলেন না।

দত্ত সাহেবকে নীরব থাকিতে দেখিয়া সেলিনা কহিল, “এখন ত আপনি জুলেখার মুখে সকলই শুনিলেন; বোধ করি, আপনার মনে এখন আর কোন সন্দেহ নাই।”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “না, আপাততঃ আমার মনে আর কোন সন্দেহ নাই।”

সেলিনা কহিল, “জুলেখার মুখে যা’ শুনিলেন, তাতে হত্যাকারীর সন্ধান হইতে পারে, এমন কোন সূত্র দেখিতে পাইলেন কি?”

দত্ত সাহেব নিতান্ত চিন্তিতভাবে ক্ষণেক সেলিনার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। তারপর শুষ্ককণ্ঠে কহিলেন, “হাঁ, জুলেখার কথায় একটা নূতন সূত্র পাইয়াছি; ইহা আমি আগে ভাবি নাই। এখন আমি চলিলাম।” এই বলিয়া দত্ত সাহেব গমনোদ্যত হইলেন।

সেলিনা সাগ্রহকণ্ঠে কহিল, “আবার কখন আপনার সঙ্গে দেখা হইবে?”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “এই নূতন সূত্রের শেষ সীমা পর্যন্ত দেখিয়া তাহার পর সাক্ষাৎ করিব।”

পরক্ষণে দত্ত সাহেব দ্রুতপদে সোপানাবতরণ করিয়া নীচে নামিয়া গেলেন।

.

দত্ত সাহেবের প্রস্থানের অনেকক্ষণ পরে সেলিনা মলিনমুখে জুলেখার মুখের দিকে চাহিল। সংক্ষুব্ধস্বরে কহিল, “দেখ দেখি জুলেখা, তোর জন্য আজ কত মিথ্যা কথা বলিতে হইল। তুই যে কথা বলিতে মানা করিয়া দিয়াছিস্, তার একটা কথাও মুখ দিয়া বাহির করি নাই।”

বিশেষ আগ্রহের সহিত জুলেখা কহিল, “বেশ হইয়াছে, কিসের এত ভয়? আমি বলি— বাধা দিয়া কম্পিত কণ্ঠে সেলিনা কহিল, “চুপ কর, আর তোকে কিছু বলিতে হইবে না। তুই অনেক পাপ করিয়াছিস, আর মিথ্যাকথার উপরে মিথ্যাকথা ব’লে পাপের বোঝা ভারি করিস কেন?” বলিতে বলিতে সেলিনা ছুটিয়া চলিয়া গেল। আজকাল জুলেখার সহিত একা থাকিতে সেলিনার বড় ভয় করে।

সেলিনা তথা হইতে অন্তর্হিত হইলে, অনেকক্ষণ জুলেখা নতমুখে সেইখানে একা বসিয়া ভাবিতে লাগিল। দত্ত সাহেব হত্যাকারীর অনুসন্ধানে যেরূপ বদ্ধপরিকর হইয়াছেন, এবং সেলিনার যেরূপ মনের চাঞ্চল্য, তাহাতে যদি তাহার মুখ হইতে ঘুণাক্ষরে কোন কথা প্রকাশ পায়, তাহা হইলে নিজের যে সর্ব্বনাশ ঘটিবার সম্ভাবনা, এখন জুলেখা তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছে। দারুণ দুর্ভাবনার সূত্রপাতে জুলেখার মন নিরতিশয় উদ্বেলিত হইতে লাগিল। জুলেখা অনেক চিন্তার পর ঠিক করিল, আজই একবার ডাক্তার বেন্টউডের সহিত দেখা করিয়া যাহা হয় একটা বন্দোবস্ত করিতে হইবে। তাঁহার কাছে টম্বরু আছে—ভয় কি? টম্বরু সব দিক্ রক্ষা করিবে।

টম্বরু একপ্রকার ক্ষুদ্র প্রস্তরখণ্ড; ইহা একান্ত দুষ্প্রাপ্য। ছোটনাগপুর অঞ্চলে খাড়িয়া জাতিরা এই প্রস্তরখণ্ডের অত্যন্ত সম্মান করিয়া থাকে।

যখন ডাক্তার বেন্টউডের সহিত সাক্ষাৎ করা স্থির-সিদ্ধান্ত হইল, তখন জুলেখা কাহাকেও কিছু না বলিয়া, বাটী হইতে বাহির হইয়া আলিপুরের দিকে চলিতে আরম্ভ করিল। জুলেখার উপরে সেলিনার মাতার কিছুমাত্র শাসন ছিল না। সে যখন মনে করিত, বাটীর বাহির হইয়া যাইত; যখন ইচ্ছা হইত, বাটীতে ফিরিয়া আসিত। কখনও যদি সেলিনার মাতা তাহার দীর্ঘ নিরুদ্দেশের কারণ জিজ্ঞাসা করিতেন, জুলেখা তৎক্ষণাৎ তদুত্তরে নিজেদের দেশের কাঁউরূপীর অসম্ভব কাহিনীর দ্বারা তাঁহার মনে এমন একটা ভীতির সঞ্চার করিয়া দিত যে, সে সম্বন্ধে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে তাঁহার সাহস হইত না। জুলেখাকে আলিপুরের পথে ছাড়িয়া, আসুন পাঠক, দত্ত সাহেব এখন কি করিতেছেন একবার দেখিতে হইবে।

দশম পরিচ্ছেদ – আমিনা সুন্দরী

নিজের বাটীতে ফিরিয়া দত্ত সাহেব, সেলিনা ও জুলেখার সহিত তাঁহার যে সকল কথাবার্তা হইয়াছে, তাহার পুনরালোচনের জন্য অমরেন্দ্রনাথের সন্ধান করিলেন। অমরেন্দ্র তখন বেড়াইতে বাহির হইয়াছেন, সুতরাং আপাততঃ তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল না। অনতিবিলম্বে একজন ভৃত্যের মুখে শুনিলেন, তাঁহার সহিত দেখা করিবার জন্য মিস্ আমিনা বাটীর ভিতরে অপেক্ষা করিতেছে। দত্ত সাহেব শুনিয়া প্রথমতঃ কিছু বিস্মিত হইলেন, তৎপরে দ্রুতপদে তাহার সহিত দেখা করিতে দ্বিতলে উঠিয়া গেলেন; এবং যে ঘরে আমিনা অপেক্ষা করিতেছে, তন্মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

দত্ত সাহেবকে সম্মুখীন দেখিয়া আমিনা তাঁহার সম্মান প্রদর্শনের জন্য চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। দত্ত সাহেব তাহাকে বসিতে বলিয়া টুপীটা পাশে রাখিয়া নিকটস্থ আর একখানা চেয়ারে নিজে বসিয়া পড়িলেন। বসিয়া বলিলেন, “মিস্ আমিনা, অনেক দিনের পর তুমি আমাদের এখানে আসিয়াছ; আমি একটা কাজে বাহির হইয়াছিলাম; আমার জন্য তোমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিতে হইয়াছে, বোধ করি।”

মিস্ আমিনা মৃদুস্বরে কহিল, “না, অর্দ্ধঘণ্টামাত্র বসিয়াছি। আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিতে হয় নাই। কোন একটা বিশেষ প্রয়োজনে আমি আপনার নিকটে আসিয়াছি, তাহাতে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যত কেনই বিলম্ব হউক না, আমি আপনার প্রতীক্ষায় এখানে বসিয়া থাকিতাম।”

এইখানে আমিনার একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রয়োজন। আমিনা বিখ্যাত ব্যারিষ্টার সৈয়দ আলি খাঁর একমাত্র কন্যা। বিলাত হইতে প্রতিগমন কালে আমীর আলি খাঁ, এক ইংরাজ-দুহিতাকে বিবাহ করিয়া সঙ্গে লইয়া আসেন। সেই ইংরাজ-দুহিতা আমিনার মাতা। এখন আমিনার মাতা পিতা কেহই জীবিত নাই; মাতা বহুদিন পূর্ব্বেই পরলোকগতা হইয়াছেন, দুই বৎসর অতীত হইল, তাহার স্নেহময় পিতাও তাহাকে চিরকালের জন্য ত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। এখন তাঁহার অতুলৈশ্বর্য্যের একমাত্র অধীশ্বরী, মাতৃপিতৃহীনা সুন্দরী আমিনা। দত্ত সাহেবের সহিত আমিনার পিতার যথেষ্ট সৌহাৰ্দ্দ ছিল; তিনি মৃত্যুকালে দত্ত সাহেবকে নিজের কন্যার রক্ষণাবেক্ষণের ভার দিয়া যান, এবং যাহাতে সুরেন্দ্রনাথের সহিত তাঁহার কন্যার বিবাহ হয়, সেজন্য দত্ত সাহেবকে অনুরোধও করেন।

আমিনা অষ্টাদশবর্ষীয়া সুন্দরী। নবীনযৌবনসমাগমে তাহার সুকুমার দেহে অপরূপ রূপলাবণ্য, নববর্ষার চন্দ্রালোকবিভাসিত, উচ্ছ্বাসোন্মুখ নদীর ন্যায় বিকসিত হইয়া উঠিয়াছে। সেই সুন্দর দেহের বর্ণ আরও কি সুন্দর! সে বর্ণ চম্পকে নাই, কষিত কাঞ্চনে নাই; সে বর্ণ বসন্তের স্নিগ্ধ প্রভাতে নবীন সূর্যোদয়ে নবকিশলয়দামে কেবলমাত্র প্রতিফলিত হয়। মুখখানি প্রফুল্ল, অপ্রশস্ত সুগঠিত ললাট, তদুপরে ভুজঙ্গশিশুশ্রেণীবৎ বায়ুচঞ্চল অলকশ্রেণীর অপূর্ব্ব শোভা। ভ্রমর-ভর-স্পন্দিত নীলকুসুমতার চক্ষু দুটি বড় চঞ্চল–হাস্যময়, প্রথম দৃষ্টিপাতে তাহা অতি সহজে এবং সর্ব্বাগ্রে দর্শকের হৃদয়স্পর্শ করে। শিশিরাক্ত সদ্যঃপ্রোদ্ভিন্ন রক্তশতদলের ন্যায় কোমল ওষ্ঠাধর সরস, তদন্তরে অতি পরিষ্কার দুই শ্রেণীর দত্ত কুন্দকলিকাসন্নিভ। মস্তকের পশ্চাদ্ভাগে তিমিরনির্ঝরবৎ অন্ধকারময়, দীর্ঘবিলম্বিত, কৃষ্ণকেশতরঙ্গমালায়, মেঘমালাযুক্ত চন্দ্রের ন্যায় সে সুচারু মুখমণ্ডল আরও একটা অনির্ব্বচনীয় সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিয়াছে। তেমনি সুগঠিত দেহ, সেই সুগঠিত দেহের তেমনি আবার ললিত-কোমল-ভঙ্গি। পরিপুষ্ট অথচ অস্থূল বাহুলতা সুগোল; তদগ্রভাবে চম্পককলিকাসদৃশ অঙ্গুলিগুলি লাবণ্যশিখার ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে। এত রূপ লইয়াও যে আমিনা সুরেন্দ্রনাথের হৃদয় অধিকার করিতে পারে নাই, পাঠক, তুমি সেজন্য বিস্মিত হইয়ো না। রূপে প্রেমের বিকাশ হয় না—প্রেমেই রূপের বিকাশ হয়। যেখানে তুমি আমি সৌন্দর্য্যের কিছুই দেখি না, সহসা প্রেম সেখানে যাহা কিছু সকলই মাধুর্য্যময় করিয়া তুলে। সেলিনা সুন্দরী হইলেও আমিনার অপেক্ষা নহে; তথাপি সে, আমিনা যাহা পারে নাই, তাহা অতি সহজে সম্পন্ন করিতে পারিয়াছে। যেখানে প্রেমের সাহায্য, সেখানে ঐরূপ জয়লাভ অতি সুলভ। যে দৃষ্টিতে প্রেমের একটা মোহ আবরণ পড়িয়াছে, সে দৃষ্টিতে আমি কুৎসিতকে যত সুন্দর দেখি, তুমি সেই সৌন্দর্য্য কোন সুন্দরে দেখিবে না। প্রেম প্রথমে দৃষ্টিতে জন্মগ্রহণ করিয়া তৎপরে হৃদয়ের মধ্যে প্রতিপালিত ও প্রতাপবান্ হইয়া উঠিতে থাকে। এমনও অনেক দেখা গিয়াছে, আমার কাছে যাহা অশেষ সৌন্দর্য্যময়, তাহাই আবার তোমার চক্ষে বিষ ঢালিয়া দেয়। কথাটা খুব সহজ, পাঠক, তোমার চক্ষে মিশরী-সুন্দরী সৌন্দর্য্যের রাণী ক্লিওপেট্রার অপেক্ষা তোমার প্রিয়তমা শতগুণে রূপলাবণ্যময়ী; হয়ত তুমি আমার উপন্যাস পড়িতে পড়িতে পাঠ বন্ধ রাখিয়া বারংবার তাহার মুখখানির দিকে অনিমেষলোচনে চাহিয়া থাক; আর যদি অভ্যাস থাকে, শটকার নলে সুগন্ধি তাম্রকূটধূমের সহিত তন্ময়চিত্তে চন্দ্রোপম মুখখানির সৌন্দর্য্যসুধা পান করিয়া করিয়া আশা আর মিটে না—কিন্তু, তোমার সেই লোচনানন্দবিধায়িনী প্রিয়তমার কেহ যদি সপত্নী থাকেন—[এমন যেন না হয়, ঈশ্বর না করেন—] সেই পত্নীর চক্ষে তাঁহার সেই অতুল রূপরাশি একটা অসহ্য বিভীষিকার ন্যায় প্রতীয়মান হয়। যে সৌন্দর্য্যে তোমার হৃদয় পরিপ্লুত হইতে থাকে— সেই একই সৌন্দর্য্য সপত্নীর হৃদয়ে বিষের দহন উপস্থিত করে। যাক্, আমিনার একটু পরিচয় দিতে অনেক কথা বলিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছি।

দত্ত সাহেব দেখিলেন, আমিনার পূর্ব্বভাবের কিছু বৈলক্ষণ্য ঘটিয়াছে; তাহার চক্ষু রক্তবর্ণ, দৃষ্টি উদাস, এবং তাহাতে যেন একটা বিষণ্ণতা ও একটা কিসের আগ্রহ স্পষ্টীকৃত হইয়া উঠিয়াছে। দত্ত সাহেব আমিনার দিকে চাহিয়া রহিলেন, কিছু বলিলেন না।

আমিনা সহসা বলিলেন, “আপনার সহিত আমার একটা বিশেষ কথা আছে—কথাটা বিশেষ প্রয়োজনীয়; সম্ভবতঃ আপনার অনুসন্ধান কার্য্যে তাহাতে অনেক সাহায্য হইতে পারে।”

দত্ত সাহেব সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মৃতদেহ অপহরণ সম্বন্ধে কি?”

আমি। না, হত্যা সম্বন্ধে।

দত্ত। হত্যা সম্বন্ধে! কি এমন কথা?

আমি। আছে—পরে বলিব। আগে বলুন দেখি, আপনি হত্যাকারীদের সন্ধানের কতদূর কি করিলেন?

হতাশভাবে মাথা নাড়িয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “না—কিছুই করিতে পারি নাই—এখনও আমি ঘোর অন্ধকারের ভিতরে রহিয়াছি। ইনস্পেক্টর গঙ্গারামেরও এই অবস্থা। এ সকল ঘটনা যেন একটা অভাবনীয় ভৌতিক-রহস্যের ন্যায় বোধ হইতেছে।”

আমি। এ ভৌতিক-রহস্য যতই কেন গভীর হউক না—শীঘ্র পরিষ্কার হইয়া যাইবে। এখন ব্যাপার কিরূপ দাঁড়াইয়াছে, আমাকে বলুন; আমি আপনাকে এ সম্বন্ধে অনেক সাহায্য করিতে পারিব।

দত্ত। এ সকল ব্যাপারের তুমি কিছু জান কি?

আমি। কিছু জানি—সেইজন্যই ত আমি আপনার এখানে আসিয়াছি। প্রথম হইতে যাহা কিছু ঘটিয়াছে, আগে আপনি আমাকে বলুন; আমি সব কথা এখনও শুনি নাই; যাহা শুনিয়াছি, তাহাও ভাল বুঝিতে পারি নাই। আমার মনের ভিতরে কেমন একটা গোলমাল বাঁধিয়া রহিয়ছে।

একাদশ পরিচ্ছেদ – পুনরুদ্ধার

একটু ইতস্ততঃ করিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “বলিতে বাধা নাই—কিন্তু হয়ত আমার কথায় তুমি কষ্ট পাইবে।”

আমিনা কহিল, “আপনি যে জন্য ইতস্ততঃ করিতেছেন, বুঝিতে পারিয়াছি—সুরেন্দ্রনাথ সেলিনাকে বিবাহ করিতে—”

বাধা দিয়া দত্ত সাহেব সাগ্রহে কহিলেন, “তুমি এ কথা কোথায় শুনিলে?”

আমিনা কহিল, “অমরেন্দ্রনাথের নিকট শুনিয়াছি।”

কথাটা শুনিয়া দত্ত সাহেব একটু চিন্তান্বিত হইলেন। তাহার পর কহিলেন, “ওঃ বুঝিয়াছি,

কেন যে অমরেন্দ্র ইতিমধ্যে তোমার নিকটে এ কথা প্রকাশ করিয়াছে।”

আমিনা সন্দিগ্ধভাবে কহিল, “কেন—আপনি এ কথা বলিতেছেন কেন?”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “সে কথার এখন প্রয়োজন নাই। পরে তোমায় বলিব। তুমি বিষ-গুপ্তির কথা কি বলিতেছিলে? সেই বিষ-গুপ্তির বিষেই পথিমধ্যে সুরেন্দ্রের মৃত্যু হইয়াছে।”

আমিনা কহিল, হাঁ, আমিও লোকের মুখে শুনিয়া যতদূর বুঝিতে পারিয়াছি তাহাতে সম্ভব বিষ-গুপ্তির বিষেই সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হইয়াছে। তাহার পর?”

দত্ত সাহেব কহিলে, “সুরেন্দ্রনাথের মৃতদেহ আমি বহির্ব্বাটীর একটা ঘরের ভিতরে রাখিয়াছিলাম। মৃতদেহের উপরে রাত্রে পাহারা দিতে রহিমকে নিযুক্ত করিয়া দিয়াছিলাম। রহিমবক্সকে কোন বিষাক্তগন্ধ ঔষধের সাহায্যে অজ্ঞান করিয়া, জানি না—কোন্ দস্যু সেই মৃতদেহ বাহির করিয়া লইয়া গিয়াছে!”

আমিনা কহিল, “মৃতদেহ অপহরণ সম্বন্ধে কাহার উপরে আপনার সন্দেহ হয়?”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “কাহারও উপরে নহে। সন্দেহ করিয়া কি করিব? কিন্তু আমার কাছে বেশিদিন গোপন থাকিবে না। না হয়, সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারীর সন্ধানে আমার বাকী জীবনটা কাটাইয়া দিব; সহজে ছাড়িব না। প্রথমে আমাকে দেখিতে হইবে, কে আমার বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছে। বিষ গুপ্তির চোরকে ধরিতে পারিলে, আমি তখন সকল দিক্‌ই সুবিধা করিয়া আনিতে পারিব। বিষ-গুপ্তি সকল অনর্থের মূল। এমন কি সেই বিষ-গুপ্তিরই বিষের বিষাক্ত গন্ধে রহিমকে অজ্ঞান করা হইয়াছে।”

আমিনা কহিল, “সেই বিষেই যে রহিমকে অজ্ঞান করা হইয়াছে, তাহা আপনি কিরূপে জানিলেন?”

দত্ত সাহেব দেখিলেন, সে কথা প্রকাশ করিতে গেলে অনেক কথা প্রকাশ হইয়া পড়িবে; তাহা হইলে সে রাত্রে সেলিনার আগমনের কথাও প্রকাশ হইয়া যায়, সুতরাং তিনি চাপিয়া গেলেন। বলিলেন, “সে কথা এখন আমি বলিতে পারিব না। কিন্তু আমি যেরূপেই জানি না কেন, আমি যাহা বলিলাম, তাহা নিশ্চিত।”

আমিনা কহিল, “তাহা হইলে আপনার সেই বিষ-গুপ্তি কি এই সকল দুর্ঘটনার মূল কারণ?”

দ। আমার ত তাহাই বিশ্বাস।

আমি। যদি এখন আপনার সেই বিষ-গুপ্তিটা দেখিতে পান, তাহা হইলে কি আপনি এই দুর্ভেদ্য রহস্য ভেদ করিতে পারিবেন?

দ। সে কথা আমি এখন ঠিক বলিতে পারি না। তবে কে আমার বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছে, জানিতে পারিলে, প্রকৃত ব্যাপার যাহা ঘটিয়াছে, বুঝিতে পারিব।

তখন আমিনা বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে এমন একটা কিছু বাহির করিয়া দত্ত সাহেবের সম্মুখে ধরিলেন যে, তিনি দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। বিস্ময়ের প্রথম মূহূৰ্ত্ত অতিবাহিত হইলে দত্ত সাহেব কহিলেন, “একি, এ যে আমারই সেই বিষ-গুপ্তি! এ বিষ-গুপ্তি তুমি কোথায় পাইলে?”

আমিনা কহিল, “হাঁ—ইহাই আপনার সেই বিষ-গুপ্তি। আমি ইহা সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারীর নিকটে পাইয়াছি।”

স্কন্ধাবর্তন করিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “সুরেন্দ্রনাথের হত্যাকারী! তুমি হত্যাকারীকে জান? কে সে–কে—সে? কোন স্ত্রীলোক?”

“না, স্ত্রীলোক নহে— পুরুষ। আপনার পরিচিত আশানুল্লা।”

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – প্রশ্ন-পরীক্ষা

দত্ত সাহেব অতিমাত্র বিস্মিত হইলেন। আশানুল্লার মানসিক ও শারীরিক উভয় শক্তিরই যেরূপ অভাব—তাহাতে তাহা দ্বারা এ সকল ভীষণ ব্যাপার সংঘটিত হওয়া কিছুতেই সম্ভবপর নহে। বিষ-গুপ্তি চুরি, সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা এবং তাহার মৃতদেহ অপহরণ—এ সকল ভীষণ ঘটনা এত সহজে সম্পন্ন করিতে অনেক বুদ্ধি, অনেক কৌশল, এবং অনেক সাহসের অবশ্যকতা। অশানুল্লার ন্যায় ভীরু নির্ব্বোধ লোকের কর্ম্ম নহে। দত্ত সাহেব আমিনার কথা বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। বলিলেন, “তোমার ভুল হইয়াছে। আশানুল্লার দ্বারা এ সকল কাজ কিছুতেই হইতে পারে না। সে যেরূপ অল্পবুদ্ধি, আর ভীরুস্বভাব, কিছুতেই তাহাকে দোষী বলিয়া আমার বোধ হয় না।”

শুষ্ককণ্ঠে আমিনা কহিল, “আপনি তাহা প্রমাণিত করিবেন; আমি ঠিক জানি না। আপনি বলিতেছিলেন, বিষ-গুপ্তির চোরকে ধরিতে পারিলে হত্যাকারীকে জানিতে পারিবেন, আমি সেই হিসাবেই আশানুল্লাকে দোষী বলিতেছি। আমি তাহারই কাছে আপনার এই বিষ-গুপ্তিটা পাইয়াছি।”

দত্ত। কিরূপে পাইলে?

আমিনা। সে আমার কাছে এই বিষ-গুপ্তিটা বিক্রয় করিতে আনিয়াছিল।

দত্ত। ইহাও তাহার নির্দোষিতার একটা প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সে নিজে দোষী হইলে কখনই বিক্রয়ের জন্য এই বিষ-গুপ্তি এত সত্বর বাহির করিত না।

আমি। পাছে সে ভয় পায়, এবং এখন হইতে সাবধান হয়, সেজন্য আমি কোন কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করি নাই। আপনি এখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিতে পারেন।

দত্ত। শীঘ্রই তাহাকে সন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে। তাহাকে কয়দিন দেখি নাই—সে এখন কোথায়?

আমি। আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি। আপনার বাড়ীর পাশে যেখানে আমার গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে, সে সেইখানে আমার কোচ-ম্যানের জিম্মায় আছে। আপনি আশানুল্লাকে এখানে ডাকিয়া আনিবার জন্য এখনি একজন বেহারা পাঠাইয়া দিতে পারেন।

দত্ত। বড় ভাল কাজই করিয়াছ—আমি তোমার দ্বারা বিশেষ উপকৃত হইলাম। আমি জানি তুমি নিজে বড় বুদ্ধিমতী।

আমি। কিছুই না—এরূপ স্থলে ইহা সকলেই করিয়া থাকে। ইহাতে বুদ্ধির কিছুই নাই। যখন তাহার নিকটে এই বিষ-গুপ্তি পাওয়া গেল, তখন তাহাকে আর চোখের অন্তরাল করা ঠিক হয় না মনে করিয়া, দাম দিতেছি বলিয়া তাহাকে একেবারে এখানে লইয়া আসিলাম। সে দোষী, কি নিৰ্দ্দোষ, সে সম্বন্ধে আমি কোন কথা ঠিক করিয়া বলিতে পারি না। সে নিজে যদিও নিৰ্দ্দোষ হয়, তাহা হইলেও আপনি তাহার মুখে এ হত্যা সম্বন্ধে অনেক কথা পাইতে পারেন। সে কোথায় আপনার এই বিষ-গুপ্তি পাইল, তাহা যদি তাহাকে কোন রকমে স্বীকার করাইতে পারেন, সেই সূত্রে আপনি বোধ হয়, হত্যাকারীর নামটাও জানিতে পারিবেন।

দত্ত সাহেব তখনই আশানুল্লাকে আনিয়া সেই স্থানে উপস্থিত করিবার জন্য জনৈক ভৃত্যকে আদেশ করিলেন।

দত্ত সাহেব কহিলেন, “আশানুল্লা কখনই দোষী নহে। কেন সে বিষগুপ্তি চুরি করিবে? আর সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়া বা তাহার মৃতদেহ অপহরণে আশানুল্লার কি লাভ? আর সে যদি নিজেই দোষী হইবে, তাহা হইলে সাধ করিয়া নিজের গলা ফাঁসীকাঠে বাড়াইয়া দিতে সে এত শীঘ্র কখনই এই বিষ-গুপ্তি বিক্রয়ের জন্য বাহির করিত না।”

অল্পক্ষণ পরে চারিদিকে সভয়ে চাহিতে চাহিতে চোরের মত আশানুল্লা ভৃত্যের সহিত সেই কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল।

ভৃত্য চলিয়া গেল।

ভূতপূর্ব্ব ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব, বিচারাসনে বসিয়া পূৰ্ব্বে যেমন আসামীদিগের মুখের প্রতি ক্ষণকালের জন্য মর্ম্মভেদী দৃষ্টিপাত করিতেন, তিনি এখনও তাহা ভুলিতে পারেন নাই। ঠিক সেইরূপ তীক্ষ্ণদৃষ্টিপাতে ক্ষণকাল আশানুল্লার দিকে চাহিয়া রহিলেন।

আমিনাও আশানুল্লাকে তখন কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না। ব্যাপার কিরূপ ঘটে, তাহাই জানিবার জন্য সে সকৌতূহল হৃদয়ে অবাঙ্মুখে একবার দত্ত সাহেবের এবং একবার আশানুল্লার মুখের দিকে চাহিতে লাগিল।

আশানুল্লার মুখের উপরে সেইরূপ তীক্ষ্ণদৃষ্টি স্থাপন করিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “তোর নাম কি?”

“আশানুল্লা।”

“আর কোন নাম নাই?”

“না, এই একটাই নাম।”

“কি করিস্ তুই?”

“ভিক্ষা করি।”

“আর ভিক্ষা না পাইলে?”

“চুরি।”

“আমি তা’ আগেই বুঝেছি। [বিষ-গুপ্তি দেখাইয়া] ইহা তুই চুরি করিয়াছিলি, কেমন?”

“চুরি করিনি—কুড়াইয়া পাইয়াছি।”

“বটে! কুড়াইয়া পাইয়াছিস্? কোথায়?”

“ও পাড়ায়?”

“কোন্ পাড়ায়?”

“মিস্ সেলিনাদের পাড়ায়।”

দত্ত সাহেব ধম্‌কাইয়া বলিলেন, “বেশী চালাকী করিলে মাথা ভাঙ্গিয়া দিব। ঠিক্ করিয়া সব কথা বল্। ঠিক কোনখানে তুই ইহা কুড়াইয়া পাইয়াছিস্?”

আশা। মিস্ সেলিনাদের বাড়ীর গেটের কাছে।

দত্ত। কতদিন হইল কুড়াইয়া পাইয়াছিস্?

আশা। খুনের পরদিন।

দত্ত। তখনই ইহা পুলিসের হাতে জমা দিস্ নাই কেন?

আশা। পুলিসকে দিতে যাইব কেন? তারা এটার জন্য আমাকে একটা পয়সাও দিত না—বরং আমাকে নিয়ে টানাটানি করত। আমি এটা মিস্ আমিনাকে দিতে—একেবারে আমাকে পাঁচ টাকা দেবেন বলিয়াছেন। [আমিনার প্রতি] কই, আমার পাঁচ টাকা এখন দেবেন?

আমিনা কহিল, “এখন না—তুই ইহা চুরি করিয়া আনিয়াছিস্, কি ডাকাতি করিয়া আনিয়াছিস্—কেমন করিয়া জানিব?”

আশানুল্লা কিছু বিরক্তভাবে বলিল, “আমি ত আপনাকে তখন থেকে বলিতেছি যে, মিস্ সেলিনাদের বাগানের গেটের কাছে কুড়াইয়া পাইয়াছি।”

দত্ত সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “গেটের কোথায়, ভিতরে না বাহিরে?”

আশানুল্লা বলিল, “ভিতরে। সেলিনারা কিছু খাবার দিবার জন্য আমাকে ডেকেছিল। যখন আমি খাবার নিয়ে তাদের বাড়ীর ভিতর হইতে বাহিরে আসি, তখন দেখি গেটের কাছে সেই ঘাসবনের ভিতরে [বিষ-গুপ্তির প্রতি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া] ইহা পড়িয়া রহিয়াছে। সূর্য্যের আলোকে ঝক্ ঝক্ করিয়া ঐ সব কাচগুলা জ্বলিতেছে। চারিদিকে একেবারে চাহিয়া দেখি, কেউ কোথায় নাই—অমনি চুপি চুপি কাপড় ঢাকা দিয়া এটা বাহির করিয়া নিয়া আসি, একেবারে বেমালুম চুরি।”

আশানুল্লা যেরূপ সরলভাবে প্রশ্নের উত্তর করিতে লাগিল, তাহাতে দত্ত সাহেব তাহাকে নিৰ্দ্দোষ বলিয়া বুঝিতে পারিলেন। দেখিলেন তাহার সত্য গোপন করিবার চেষ্টা আদৌ নাই—এবং তাহার কারণও কিছুমাত্র নাই। বিশেষতঃ সে গাঁজা গুলি খাইয়া নিজের বুদ্ধিবৃত্তি একেবারে নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে; তাহা ছাড়া অন্নাভাবে তাহার দুর্ব্বল শরীরের অবস্থা যেরূপ শোচনীয়, তাহাতে তাহার হাতে বিষ-গুপ্তি কেন, আরও যে কোন সাংঘাতিক অস্ত্র থাক্, সে যে সুরেন্দ্রনাথের ন্যায় একজন বলিষ্ঠ যুবককে আক্রমণ করিতে সাহস করিবে, ইহা কখনই সম্ভবপর হইতে পারে না। তখন দত্ত সাহেবের সম্পূর্ণ সন্দেহ জুলেখার উপরে নিহিত হইতে লাগিল। তিনি ভাবিতে লাগিলেন, বিষ-গুপ্তির বিষ একবারে শুখাইয়া গিয়াছিল, জুলেখা পুনরায় নূতন বিষ তৈয়ারি করিয়া বিষগুপ্তিতে ঢালিয়াছে। সে ছাড়া যখন এখানে আর কেহ এই বিষ তৈয়ারি করিতে জানে না, তখন এ সকল তাহারই কাজ

মনের যখন এইরূপ অবস্থা, তখন দত্ত সাহেব সেই বিষ-গুপ্তি ধীরে ধীরে উঠাইয়া লইলেন; এবং নির্দ্দিষ্ট স্থানে সামান্য চাপ দিয়া টিপিয়া ধরিতে বিষ-গুপ্তির অগ্রভাগ হইতে সর্পজিহ্বার ন্যায় সূক্ষ্ম, সূচীবৎ তীক্ষ্ণাগ্র বিষসিক্ত ক্ষুদ্র লৌহ-শলাকা বাহির হইল। দত্ত সাহেব একাগ্রদৃষ্টিতে দেখিতে লাগিলেন, অগ্রভাগে একবিন্দু উজ্জ্বল সবুজবর্ণের বিষ টল্ টল্ করিতেছে। দত্ত সাহেব বুঝিলেন, জুলেখা তাহার সর্ব্বনাশ করিবার জন্য এই নুতন বিষ তৈয়ারি করিয়াছে। দত্ত সাহেবের মুখ আরও অন্ধকার হইয়া গেল।

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – আরও সন্দেহ

দত্ত সাহেবকে এতক্ষণ নীরব থাকিতে দেখিয়া এবং তাঁহার মুখের অন্ধকার ক্রমশঃ নিবিড় হইতে নিবিড়তর হইতে দেখিয়া আমিনা চকিতে জিজ্ঞাসা করিল, “কি হইয়াছে—আপনি কি ভাবিতেছেন?”

দত্ত সাহেব গম্ভীরমুখে কহিলেন, “আমি জুলেখার কথা ভাবিতেছি, এখন বেশ বুঝিতে পারিয়াছি, নিজে সেই পিশাচীই এই সকল সর্ব্বনাশের মূল।”

চিন্তিতভাবে ধীরে ধীরে আমিনা কহিল, “জুলেখা! ওঃ অমরেন্দ্রনাথের মুখে আমি যে অনেকবার এ নাম শুনিয়াছি। সে ছোটনাগপুর দেশীয়া নয়?”

দত্ত সাহেব কহিলেন, “হাঁ, সে নাগপুরের নাগিনী। আমি তাহারই বিষে সুরেন্দ্রনাথকে হারাইয়াছি।”

সন্দিগ্ধভাবে আমিনা কহিল, “আপনি যাহা মনে করিতেছেন-”

বাধা দিয়া দত্ত সাহেব কহিলেন, “তা’ সৰ্ব্বতোভাবে সত্য, সেই পিশাচীই আমাদের সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে। যদিও তাহার বিরুদ্ধে এখনও তেমন কোন প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় নাই, যাহাতে তাহাকে আমি—” বলিতে বলিতে দত্ত সাহেব সহসা সাবধান হইলেন। এবং সে কথা চাপা দিয়া পরিবর্তিত স্বরে তৎক্ষণাৎ কহিলেন, “যাক্, এ সকল ভাবনা ইহার পর ভাবিলেও চলিবে। আপাততঃ আশানুল্লাকে আরও দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া দেখা যাক্।”

আমি। আপনি আর কি জিজ্ঞাসা করিবেন?

দত্ত। নূতন কিছু নহে। সেলিনাদের বাগান-বাড়ীর গেটের ধারে এই বিষ-গুপ্তি কুড়াইয়া পাইয়াছে বলিয়া, যখন সে নিজে স্বীকার করিতেছে, তখন তাহার নিকট হইতে হত্যাকারীর বিরুদ্ধে দুই-একটা প্রমাণ পাওয়া যাইতে পারে।

আমি। আপনি কি তাহার নিকটে তেমন কোন সুবিধাজনক প্রমাণ পাইবেন, বোধ করেন? দত্ত। এখন প্রমাণও পাইতে পারি যে, খুনের পর জুলেখাই এই বিষ-গুপ্তি সেখানে ফেলিয়া থাকিবে।

আমিনা কহিল, “জুলেখা যে এ হত্যা করিয়াছে, আপনার এ অনুমান কি সত্য?”

দত্ত সাহেব উত্তেজিত কণ্ঠে কহিলেন, “নিশ্চয়ই—এখন আইনসঙ্গত প্রমাণ চাই—আমি যে প্রমাণে তাহাকে—” সহসা তিনি থামিয়া গেলেন। তাহার পর ধীরে ধীরে বলিলেন, “এই বিষ-গুপ্তিতে নূতন বিষের সংযোগ আর সেই রুমালে এই বিষ মাখানো, এই দুইটি সূত্র ধরিয়া এখন আমাকে কাজ করিতে হইবে।”

আমিনা। আমি আপনার কথা ভাল বুঝিতে পারিলাম না।

দত্ত। [বাধা দিয়া] ইহার পর সকলই বুঝিতে পারিবে—এখন ইহার বেশি নয়। [আশানুল্লার প্রতি] সেলিনাদের বাড়ীর জুলেখাকে তুই চিনিস?

আশা। খুব চিনি, সে মাগী যেন শয়তান।

দত্ত। কিসে?

আশা। সে না করতে পারে—এমন কোন কাজই নাই। সে একদিন আমাকে নিয়ে এমন একটা কাণ্ড করলে যে, আমি অবাক্ হ’য়ে গেলেম। আমি সেই অবধি আর তার কাছে ভয়ে যাই না।

দত্ত। কি কাণ্ড করলে?

আশা। আমার চোখের দিকে চাইতে চাইতে কতকগুলা মন্তোর পড়তে লাগলো—আর সে কি চাহনি—বাপরে বাপ্, চোখ দুটা যেন দুটো মশাল! ভয়ে আমার প্রাণ উড়ে গেল।

দত্ত। তোকে ভূতে ধরেছিল, না তোর কোন অসুখ করেছিল?

আশা। ভূতেও ধরেনি—অসুখও করেনি, মাগীটা শুধু শুধু—কোথায় কিছু নাই, মন্তর প’ড়ে আমাকে ঝাড়িয়ে দিলে। সেদিন তাকে চালেনা দেশমের কথা বলতে যাই।

শুনিয়া দত্ত সাহেব চমকিত হইলেন। বিস্ময়কম্পিতকণ্ঠে কহিলেন, “চালেনা-দেশম! চালেনা- দেশমের তুই কি জানিস?”

আশানুল্লা সভয়ে বলিল, “কিছু না। আমাকে পথে দেখতে পেয়ে ডাক্তার সাহেব ঐ চালেনা-দেশমের খবর দিতে জুলেখার কাছে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।”

দত্ত। এ কতদিনের কথা?

আশা। খুনের আগে।

দত্ত। বুঝিয়াছি। [ক্ষণপরে] আশানুল্লা, তুই যদি আমাদের বাড়ীতে থাকিস্ ত বল। গুলি গাঁজার খরচ পাবি, তা’ ছাড়া রোজ খুব পেট ভ’রে খেতে পাবি। কি বলিস্?

আশা। কেন থাকব না, হুজুর? না খেতে পেয়ে ম’রে গেলেম! হুজুরের সঙ্গে ব’কে ব’কে এখন এত খিদে পেয়েছে যে, আর আমি একটুও দাঁড়াতে পারছি না।

দত্ত। তুই এখন বাড়ীর ভিতরে উঠানে গিয়া দাঁড়া। আমি বেহারা দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। তার পর তোর এখানে থাকবার একটা ভাল বন্দোবস্ত ক’রে দিব।

একটার স্থলে দশটা সেলাম করিয়া আশানুল্লা ঘরের বাহির হইয়া গেল।

দত্ত সাহেবের এই সকল কাৰ্য্যকলাপ দেখিয়া সাতিশয় বিস্ময়ের সহিত আমিনা জিজ্ঞাসা করিল, “এ সকল কি ব্যাপার? আমি ভাল বুঝিলাম না।”

শুষ্ককণ্ঠে দত্ত সাহেব কহিলেন, “ব্যাপার বড় সহজ নহে—বিষ-গুপ্তির অপর নাম চালেনা-দেশম। এই হত্যাকাণ্ডে ডাক্তার বেন্টউডও জড়িত আছে।”

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – হত্যাকারী কে?

আমিনা বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কহিল, “বেন্টউডের সহিত আপনার ত খুব বন্ধুত্ব!”

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কক্ষমধ্যে পরিক্রমণ করিতে করিতে দত্ত সাহেব মস্তকান্দোলনের সহিত বলিতে লাগিলেন, “হাঁ, পরমবন্ধু। আমি কালসর্প লইয়া বুকে পোষণ করিয়াছিলাম; এখন সে দংশন করিয়াছে। আমি শীঘ্রই বেন্টউডের সহিত দেখা করিব। এখন বুঝিতে পারিলাম, তাহার দ্বারাই এই সকল কাণ্ড হইতেছে।”

তীক্ষ্ণবুদ্ধি নিপুণ পাঠকগণ, বক্ষ্যমাণ ঘটনাসূত্রে প্রকৃত হত্যাকারী ধৃত হইবার পূর্ব্বে, এই সময় হইতে আপনারাও একবার প্রকৃত হত্যাকারীকে নির্দ্দেশ করিতে চেষ্টা করিয়া দেখিবেন। এই হত্যাসম্বন্ধে অনেকেরই উপরে সন্দেহ হয়; বেন্টউডের উপরে সন্দেহ ঘনীভূত হইয়াছে; বেন্টউডের দ্বারা এ হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হইতে পারে, তাহার যেমন একটা বিশেষ কারণ আছে। অমরেন্দ্রকে সন্দেহ করিলেও সেইরূপ একটা বিশেষ কারণ পাওয়া যায়—স্ত্রীলোকের রূপমোহে ভাই ভাই এর বুকে ছুরি বসাইতে কুণ্ঠিত হয় না। সুরেন্দ্রনাথের প্রতি জুলেখার যেরূপ ঘৃণা ও বিদ্বেষ এবং সেই সুরেন্দ্রনাথেরই সহিত সেলিনার বিবাহের কথা হইতেছিল, ইহাতে জুলেখার উপরেও সন্দেহ হইতে পারে। এইরূপ একটা কারণে সেলিনার মাতার উপরেও কিছু যে সন্দেহ না হয়, এমন নহে।

তাহার একান্ত অনিচ্ছা একমাত্র কন্যা সেলিনার সহিত সুরেন্দ্রনাথের বিবাহ হয়, তাঁহার অনিচ্ছাসত্ত্বেও কন্যা সুরেন্দ্রনাথের একান্ত পক্ষপাতিনী। তাহার পর বিষ-গুপ্তির সন্ধানকারিণী আমিনার উপরেও সন্দেহ হইবার বিশিষ্ট কারণ আছে; সে সুরেন্দ্রনাথের নিকটে উপেক্ষিতা হইয়াছে। ইহা অপেক্ষা স্ত্রীলোকের আর অধিক কি অপমান হইতে পারে? তাহার পর আশানুল্লা, তাহাকেও বড় বিশ্বাস নাই। কে জানে, সে যাহা দত্ত সাহেবের নিকটে বলিল, তাহা সত্য কি মিথ্যা। যাহা হউক, ইহা একটী দুরূহার্থ হত্যা-প্রহেলিকা। সুনিপুণ পাঠক, যথা সময়ে অর্থ প্রকাশ পাইবার পূর্ব্বে প্রকৃতার্থ নির্ণয় করিয়া নিজ পাঠ-নৈপুণ্যের প্রকৃষ্ট পরিচয় দিবেন।

আমিনা জিজ্ঞাসা করিল, “ডাক্তার বেন্টউডকেই কি আপনি আপাততঃ দোষী স্থির করিয়াছেন?”

দত্ত। তাহাকে দোষী স্থির করিবার অনেক কারণ আছে। একদিন বেন্টউড সুরেন্দ্রনাথের কর-রেখা গণিয়া বলিয়াছিল, যদি সে সেলিনাকে বিবাহ বা তাহার নিকটে বিবাহের প্রস্তাব করে, তাহার জীবনৃত-দশা ঘটিবে।

আমিনা। ইহার অর্থ কি—জীবন থাকিতে মৃত্যু?

দত্ত। আমরাও আগে তাহাই মনে করিয়াছিলাম। আমরা পূর্ব্বে এই কথায় পক্ষাঘাত বা মৃগীরোগ এইরূপ একটা মানে করিয়াছিলাম। এখন বুঝিতেছি, জীবন থাকিতে মৃত্যু—মানে, অকালে অপঘাতমৃত্যু—খুন—খুন। প্রকারান্তরে তখনই বেন্টউড সুরেন্দ্রনাথকে খুন করিবে বলিয়াছিল; আমরা তখন কথাটা ভাবিয়া দেখিতে চেষ্টা করি নাই। বেন্টউডের আন্তরিক ইচ্ছা সেলিনাকে বিবাহ করে; কিন্তু সেলিনা সুরেন্দ্রনাথের একান্ত অনুরাগিণী। সুরেন্দ্রনাথ যাহাতে পূৰ্ব্ব হইতে সাবধান হয়, সেইজন্য বেন্টউড করকোষ্ঠী গণনার ছলে তাহাকে সাবধান করিয়া দিয়াছিল। এমন কি ইহার পর বেন্টউড এই হত্যাকাণ্ড সহজে সমাধা করিবার অভিপ্রায়ে দুই-একবার এই বিষ-গুপ্তি আমার নিকট হইতে ক্রয় করিবার প্রস্তাবও করিয়াছিল।

আমিনা। [সাশ্চর্য্যে] কি সৰ্ব্বনাশ! তিনি এই বিষ-গুপ্তি আপনার নিকট হইতে কিনিতেও চাহিয়াছিলেন?

দত্ত। হাঁ, আমি একেবারে অস্বীকার করায় অনন্যোপায় হইয়া নারকী শেষে চুরি করিয়া লইতে কুণ্ঠিত হয় নাই।

আমিনা। তিনি যে চুরি করিয়াছেন, তাহার প্রমাণ কি?

দত্ত। প্রমাণ সহজেই হইবে। তুমি এইমাত্র আশানুল্লার মুখে শুনিলে সে ডাক্তার বেন্টউডের নিকট হইতে এই বিষ-গুপ্তির সংবাদ লইয়া জুলেখাকে বলে। কি কারণে কেহ জানে না, জুলেখার উপর ডাক্তার বেন্টউডের একটা খুব প্রবল প্রভুত্ব আছে, জুলেখাও তাহাকে অত্যন্ত ভয় করে। সে নিশ্চয়ই বেন্টউডের অভিপ্রায় অনুসারে এই বিষ-গুপ্তি চুরি করিয়াছে, ইহাতে নূতন-বিষ তৈয়ারি করিয়া ঢালিয়াছে। তাহার পর এই বিষ-গুপ্তি লইয়া বেন্টউড সুরেন্দ্রনাথকে হত্যা করিয়াছে। ইহাতে আর কোন সন্দেহ নাই। নিজে বেন্টউডই সুরেন্দ্রনাথের প্রকৃত হত্যাকারী।

আমিনা। আপনি অনুমানের উপর নির্ভর করিয়া তাহাকে হত্যাপরাধে ফেলিতেছেন। প্রমাণ চাই।

দ। প্রমাণ সংগ্রহ হইবে।

আ। সহজে হইবে না।

দ। সে কথা সত্য। কারণ, বেন্টউড সহজ লোক নহে। যখন আমি নিজে সুরেন্দ্রনাথের খুনীর অনুসন্ধান কার্য্যে হস্তক্ষেপ করি, তখনই বুঝিয়াছিলাম, সহজে কিছু হইবে না। যাহা হউক, বিশ্বাস আছে, অমরেন্দ্রনাথের সাহায্যে আমি অনেক সুবিধা করিতে পারিব।

যথেষ্ট উৎসাহয়িত্রীর ভাব দেখাইয়া আমিনা বলিল, “আমিও আপনার সাহায্য করিতে সাধ্যমত চেষ্টা করিব। যখন যে কোন সন্ধান পাইব, আপনাকে জানাইব। আপাততঃ আমি উঠিলাম। আশানুল্লার কি করিবেন?”

দ। সে এখন এইখানেই থাকিবে।

আ। দেখিবেন, যেন না পালাইয়া যায়।

দ। না, সে ভয় কিছুমাত্র নাই। পেট ভরিয়া খাইতে পাইলে সে নিজেই নড়িতে চাহিবে না। আমার খুব বিশ্বাস, সে হত্যাকাণ্ডে আদৌ লিপ্ত নাই। তাহা হইলে সে কখনই বিনাপত্তিতে এক কথায় আমার এখানে থাকিতে চাহিত না। তাহার নিকটে বেন্টউড ও জুলেখার ভিতরের অনেক কথা পরে পাওয়া যাইতে পারে। প্রথমে আমাকে আরও সন্ধান করিয়া দেখিতে হইবে, জুলেখা, বেন্টউডকে কেন এত ভয় করে।

আ। আশানুল্লা সে বিষয়ে কি জানে? সে কথা জুলেখা নিজে বলিতে পারে।

দ। বেন্টউডও বলিতে পারে। যাহা হউক, আগে কোন রকম প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া যদি বেন্টউডকে গ্রেপ্তার করিতে পারি, তখন বেন্টউডের নিকটেও এ কথা পাওয়া যাইবে, বোধ হয়।

তাহার পর নিজে যাইয়া দত্ত সাহেব আমিনাকে তাহার গাড়ীতে উঠাইয়া দিয়া আসিলেন।