৮
ভাদুড়িমশাই বিদায় নেবার পর কিচেনে ফোন করে আমাদের ঘরে এক পট কফি পাঠিয়ে দিতে বলি। মিনিট দশেকের মধ্যে কফি এসে যায়। সদানন্দবাবুর উপদেশ অনুযায়ী অনেক বছর ধরেই আমি দুধচিনি না-মিশিয়ে চা খাচ্ছি। নাকি ওতে অ্যাসিডিটি হয় না। তবে কফিটা ওইভাবে খেতে পারি না, বড্ড তেতো লাগে। সদানন্দবাবু আগে কফি খেতেন না, আজকাল খাচ্ছেন। কফিতে অবশ্য তাঁরও দুধচিনি চাই। দুটো পেয়ালায় কফি ঢেলে, দুধচিনি মিশিয়ে, একটা পেয়ালা ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললুম, “কেমন বুঝছেন?”
কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বেজার মুখে ভদ্রলোক বললেন, “এর আর বোজাবুজির কী আচে। যে গাড্ডায় পড়িচি, ভালয় ভালয় উদ্ধার পেলে হয়।”
বললুম, “ভয় পাবেন না।”
“ভয় কি সাধে পাচ্চি।” কফিতে আর-একটা চুমুক দিয়ে, যেন কফি নয়, চিরতা-ভেজানো জল খেয়েছেন, এই রকমের মুখ করে সদানন্দবাবু বললেন, “ও যে আমাদের পদ্মই, এ আমি হলপ করে বলতে পারি। এখন এই খুনের ব্যাপার নিয়ে পুলিশ না আমাকে টানাটানি করে। কে জানে, পুলিশ হয়তো এতক্ষণে আমাদের বাড়িতে এসেও গেচে। আমার ওয়াইফকে জিজ্ঞেস করে জেনেও গেচে যে, আমি দিল্লিতে চলে এসেছি। এখন এই কলকাতা ছেড়ে চলে আসাটাকে তারা কীভাবে নেবে? আমি পালিয়ে এসিচি, এমন ভাববে না তো?”
আমিও যে ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছি, ভদ্রলোককে তা আর বললুম না। বললে, উনি আরও ঘাবড়ে যাবেন। তাই যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললুম, “তা নিশ্চয় ভাববে না। লোকে তো কাজেকর্মেও বাইরে যায়। যাবার দরকার হয় বলেই যায়। আর তা ছাড়া, সুরিন্দর তো আপনার ব্যাপারে শোভনের সঙ্গে কথা বলেছেই। ভাদুড়িমশাইও বললেন যে, আজ দুপুরে লালবাজারে ফোন করে শোভন চৌধুরির সঙ্গে কথা বলবেন। সেইসঙ্গে অমুর কথাটাও ভাবুন। সমস্যা যেমন আপনার, তেমনি অমুরও। দু’দুবার তার উপরে হামলা হয়েছে, ফোনে তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কই, সে তো আপনার মতো ঘাবড়ে যায়নি।”
নেতিয়ে-পড়া ভিতু মানুষও দেখেছি অনেক সময় হঠাৎ-হঠাৎ তেতে ওঠে। অমুর কথায় সদানন্দবাবুও হঠাৎ দুম করে তেতে উঠলেন। বললেন, “ঠিক, ঠিক, অমু ইজ এ কারেজাস ইয়ং ম্যান! আমাকেও ওই রকমের কারেজাস হতে হবে। আমি তো কোনও দোষ করিনি। তা হলে ভয় পাব কেন?”
“তা হলে চলুন, বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসা যাক। সবে তো এগারোটা বাজে। চমৎকার ওয়েদার, পাড়াটাও ভাল, একটু ঘুরে এলে দিব্যি লাগবে। লাঞ্চ একটায়, তার মানে আমাদের হাতে এখনও দু’ঘণ্টা সময়। চলুন, বেরিয়ে পড়া যাক।”
ভেবেছিলুম, ভদ্রলোকের মন-মেজাজের এই যে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে, তাতে বাইরে যাবার প্রস্তাবটা তিনি লুফে নেবেন। কোথায়! সদানন্দবাবু হঠাৎ আবার সেই আগের মতোই নেতিয়ে পড়ে বললেন, “না মশাই, বাইরে গিয়ে কাজ নেই।”
“কেন?”
“সকালে তো একবার বেরিয়েছিলুম। তখন একটা ব্যাপার দেখিচি, সেটা আমার খুব ভাল ঠেকেনি।”
“কী দেখেছিলেন?”
“কাছেই একটা পান-সিগারেটের দোকান আচে, চোখে পড়েচে?”
“পড়েছে। তাতে কী হল?”
“তা হলে শুনুন। ভোরবেলায় যখন মর্নিং ওয়াক করতে বেরোই, দুটো লোক তখন ওই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। একটা লোক ফর্সা আর বেঁটে, অন্যজন আবলুশ কাঁঠের মতো কালো আর ঢ্যাঙা। তো আমি তাদের পাশ দিয়ে খানিকটা পথ হেঁটে গিয়ে তো একটা পার্কে গিয়ে ঢুকলুম। ঢুকে চক্করও দিলুম গোটা দশেক। তাতে ঘণ্টা খানেক লাগল। তা আমার মনে হল, ঘণ্টা খানেক যখন হেঁটেচি, তখন নিশ্চয় মাইল তিনেক হাঁটা হয়ে গেচে, তা হলে আর হেঁটে কাজ নেই, ওভার-এক্সারসাইজ হয়ে যাবে। এই ভেবে আমি পার্ক থেকে বেরিয়ে আবার এখেনে ফিরে আসি। তো ফিরে আসার সময় কী দেকলুম জানেন?
“আপনি না-বললে কী করে জানব? কী দেখলেন?”
“দেকলুম যে, সেই লোক দুটো তখনও ওই পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আচে, আর নিজেদের মধ্যে কথা বলতে-বলতে মাঝে-মাঝে আমাদের এই বাড়িটার দিকে তাকাচ্চে।”
আশ্চর্য ব্যাপার! দুটো লোক একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে, এ তো খুবই স্বাভাবিক। এতে বিচলিত হবার কী আছে!
কথাটা সদানন্দবাবুকে জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, “বাঃ, আপনি তো অদ্ভুত লোক! আরে মশাই, দাঁড়িয়ে থাক না, কিন্তু এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন, আর মাঝে-মাঝে ত্যাড়চা চোখে এই বাড়িটার দিকে তাকাবেই বা কেন? সন্দেহজনক ব্যাপার নয়?”
‘ত্যাড়চা চোখে’ কথাটা আগে বলেননি, এটা এবারে যোগ করলেন। সন্দেহ নেই যে, এর পরে যখন আবার এই ঘটনার কথাটা উঠবে, সদানন্দবাবু তখন আরও দু’চারটে নতুন-নতুন কথা যোগ করবেন। আপাতত এইটে বুঝলুম যে, সদানন্দবাবুর বাইরে বেরুবার ইচ্ছে নেই। অগত্যা কী আর করা, পায়জামা তো পরাই ছিল, তার উপরে একটা পাঞ্জাবি চাপিয়ে আমি একাই বেরিয়ে পড়লুম।
গেস্ট হাউসের গেট পেরিয়ে রাস্তায় পড়ে ডাইনে তাকিয়ে দেখি, তাজ্জব কাণ্ড, পানের দোকানের সামনে সত্যি দুটো লোক তখনও দাঁড়িয়ে আছে। একজন মোটামুটি ফর্সা আর বেঁটে, অন্যজন মিশমিশে কালো আর ঢ্যাঙা। ঠিক যেমনটি সদানন্দবাবু বলেছিলেন। দুজনেরই পরনে খাটো ময়লা পায়জামা আর হাফশার্ট। তফাত এই যে, ফর্সা লোকটির হাফশার্টের রং নীল আর কালো লোকটি সাদায়-লালে চেক-কাটা একটা শার্ট পরে আছে। দুজনের পায়েই টায়ার-কাটা রবারের মোটা চপ্পল। ঠেট হিন্দিতে নিচু গলায় দুজনে গল্প করছিল আর হাসছিল।
আমার সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল। পানের দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট আর একটা ম্যাচবাক্স কিনলুম। তারপর দোকানিটিকে জিজ্ঞেস করলুম যে, এখানে ধারেকাছে কোনও অটো-স্টান্ড আছে কি না। দোকানি লোকটি হাসিখুশি। দোকান থেকে সামনে একটু মুখ বাড়িয়ে বাঁ দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওই দিকে খানিকটা এগোলেই একটা ইস্কুল-বাড়ি দেখবেন, তার পাশের গলিতেই অটো দাঁড়ায়।”
আমি একটু হেসে ‘বহোত সুকরিয়া ভাইসাব’ বলে বাঁ দিকে এগিয়ে গেলুম। যেতে-যেতে খানিক বাদে একবার ফিরে তাকাতে চোখে পড়ল যে, দোকানের সামনে সেই লোক দুটো তখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
ইস্কুলের পাশের সরু গলিটা সত্যিই একটা অটো-স্ট্যান্ড। গোটা পাঁচ-সাত অটো সেখানে লাইন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাইনের একেবারে সামনের চালকটিকে হাত তুলে ইঙ্গিত করতেই সে তার গাড়ি নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। কলকাতা হলে প্রথমেই সম্ভবত জিজ্ঞেস করত যে, আমি কোথায় যাব। গন্তব্যস্থলটা তার পছন্দ হলে যেত, নয়তো যেত না। এ কোনও প্রশ্ন করল না, আমি সিটে উঠে বসবার পর পিছন ফিরে আমার দিকে একবার তাকাল মাত্র। চাউনির অর্থটা পরিষ্কার, সওয়ারি কোন দিকে যেতে চান, সেটা জানালে সে ঠিক করে নিতে পারে যে, কোন রাস্তা ধরবে। আসলে আমি যে বিশেষ কোথাও যেতে চাইছিলুম, তা নয়। গেস্ট হাউসে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না বলে বেরিয়ে পড়েছি, ভাবছি যে, ঘণ্টা দেড়েক এ-দিকে ও-দিকে ঘুরে আবার গেস্ট হাউসে ফিরে যাব। অটো-চালককে খোলাখুলি সে-কথা জানালুমও। বললুম, “দ্যাখো ভাই, দিল্লিতে আমি নতুন আসছি না, তবে এ-দিকটায় এর আগে কখনও থাকিনি। তো এক কাম করো, দেড়-দো ঘন্টেকে লিয়ে তুম মুঝে থোড়া ইস ইলাকেকো সয়ের করাও, উসকে বাদ ফির ইয়াহাঁ হি হামকো ছোড় দেনা।”
আমার হিন্দি শুনে সবাই হাসে। কিন্তু এ-লোকটিকে তো হাজার রকমের সওয়ারি সামলাতে হয়, তাদের কারও-কারও মুখে নিশ্চয়ই এর চেয়েও নড়বড়ে হিন্দি শুনে থাকবে, তাই হাসল না। গম্ভীর মুখে ‘ঠিক হ্যায় সাব’ বলে অটোতে স্টার্ট দিতেই সেটা প্রচুর ধোঁয়া ও শব্দ উদ্গিরণ করে আর সেইসঙ্গে কয়েকটা ঝাঁকুনি মেরে চলতে শুরু করল। এমন মোক্ষম ঝাঁকুনি যে, অটোর ছাউনির লোহার একটা রড একেবারে তৎক্ষণাৎ আঁকড়ে না-ধরলে হয়তো আসন থেকে রাস্তার উপরে ছিটকে পড়তুম।
খানিক এগোতেই একটা পার্ক। সদানন্দবাবু কি এই পার্কেই আজ সকালে মর্নিং ওয়াক করে গেছেন? কী জানি, সেটা হয়তো অন্য পার্কও হতে পারে। পার্কের তো এখানে কিছু কমতি নেই। মিনিট তিনেকের মধ্যেই সফদরজং এনক্লেভের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে আমরা বড়রাস্তায় গিয়ে পড়লুম, আর তখনই, রাস্তার মোড়ে চোখে পড়ল একটা বিশাল হোর্ডিং। কাল সকালে এয়ারপোর্ট এলাকায় যে হোর্ডিংটা আমরা দেখেছিলুম, এটা তার হিন্দি সংস্করণ। ছবিটা আলাদা। মায়ের কোলে ছোট্ট একটা বাচ্চা, আর সেই বাচ্চাকে ইঞ্জেকশান দেওয়া হচ্ছে। ছবির উপরে নাগরী লিপিতে বড়-বড় হরফে লেখা : ইয়ে সুঁই নয়া হ্যায় কেয়া? ছবির তলায় হিন্দি ভাষায় আরও কিছু লেখা। সিগন্যাল পেয়ে আমাদের অটো তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল বলে লেখাটা আর পুরো পড়তে পারলুম না। লেখার তলায় আর-একটু বড় হরফে বিজ্ঞাপনদাতার নামটা দেওয়া হয়েছে বলে সেটা অবশ্য পড়ে নেওয়া গেল। ম্যাক্রো কনস্ট্রাকশান ইন্টারন্যাশনাল।
কাল যখন এয়ারপোর্ট থেকে সফদরজং এলাকায় এসে ঢুকি, এই হোর্ডিংটা তখন এখানে ছিল না। থাকলে নিশ্চয় চোখে পড়ত। তা হলে এটা কখন লাগানো হল? সম্ভবত কাল রাত্তিরে। রাত্তিরে রাস্তাঘাটে ভিড়ভাট্টা কম থাকে। অ্যাড-এজেন্সির লোকেরা হয়তো সেই জন্যেই এটা সেই সময়ে এসে লাগিয়েছে।
অটো চলছে, আর আমি দেখে যাচ্ছি দু’দিকের চোখ-ধাঁধানো ঘরবাড়ি আর দোকানপাট। দিল্লিতে যখনই আসি, একটা ব্যাপার লক্ষ না-করে পারি না। যেমন চওড়া এখানকার রাস্তাঘাট, তেমনি ঝকঝকে-তকতকে সব দোকান। ঘরবাড়ির আর্কিটেকচারও নতুন ধাঁচের। আর গাড়ি! সবই প্রায় হাল-ফ্যাশনের। দেখে বোঝা যায়, এখানে যারা এ-সব পাড়ায় থাকে, পয়সা তাদের অঢেল, দু’হাতে যতই খর্চা করুক, তাদের ভাঁড়ারে কখনও টান পড়ে না। তাই বলে কি এই শহরে গরিব-গুর্বো নেই? আছে বই কি। বিস্তর আছে। নুন আনতে তাদের পান্তা ফুরোয়। তবে এ-সব মহল্লায় তারা থাকবে কী করে? তাদের এলাকা আলাদা। সে-সব এলাকা যে দেখিনি, তা তো নয়। তাও অনেক দেখেছি। এমন সব এলাকা, যেখানে দিনের বেলাতেও রোদ্দুরের প্রবেশ নিষেধ। যেখানে ঢুকলে দম আটকে আসার উপক্রম হয়।
কিন্তু আমি তো এখন চলেছি বসন্তবিহারের রাস্তা দিয়ে। দু’দিকে চোখ বুলোতে বুলোতে চলেছি। আর যতই দেখছি, ততই তাক লেগে যাচ্ছে। কে বলবে যে, এটা গরিব, উন্নয়নশীল দেশ! এ তো উন্নতির একেবারে পরাকাষ্ঠা! দেশের কোটি-কোটি মানুষের জীবনে এই উন্নতির ছোঁয়া লাগেনি ঠিকই, এটাও ঠিক যে, স্বাধীনতা লাভের পরে বাহান্ন-তিপ্পান্নটা বছর কেটে গেলে কী হয়, জনসাধারণের একটা মস্ত অংশ আজও দারিদ্র-রেখার নীচেই পড়ে আছে, আবার একইসঙ্গে বেশ কিছু লোকের পকেট যে রাতারাতি দারুণ রকমের ভারী হয়েছে, তাও তো চোখের সামনেই দেখছি।
এইসব ভাবতে-ভাবতেই একবার মনে হল যে, আর এগোনো বোধহয় ঠিক হবে না। গেস্ট হাউসে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। হাতঘড়িতে বারোটা বাজে। তা হলে আর দেরি না-করে ফেরাই ভাল। অটোওয়ালাকে বললুম, “আব ওয়াপস চলো, ভাইসাব।”
ফিরতি-পথে কিছুক্ষণের জন্য একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলুম। চমক ভাঙল অটোওয়ালার কথায়। “দেখিয়ে সাব ক্যা হো রহা হ্যায়।”
যা দেখলুম, সেটা চমকে যাওয়ার মতোই ব্যাপার বটে। বড়রাস্তা থেকে সফদরজং এনক্লেভে ঢোকার মুখে যেখানে অমুদের সেই হোর্ডিং লাগানো হয়েছে তার সামনেই রাস্তার ধারে হাতে ঝোলা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বারো-চোদ্দো বছরের গুটি পাঁচ-সাত ছেলে। যে যার ঝোলা থেকে একটার-পর-একটা ঢ্যালা বার করছে তারা, আর সমানে সেই হোর্ডিংয়ের দিকে ছুড়ে যাচ্ছে। অটো থেকে লাফিয়ে নেমে আমি বাধা দিতে যাচ্ছিলুম। কিন্তু নামা হল না। অটোওয়ালা ছেলেটি আমার হাত চেপে ধরে চাপা গলায় বলল, “কুছ মাত কহিয়ে সাব, মুশকিল হোগা।” বলে সে আর দেরি করল না। অটোর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, ফের তাতে স্টার্ট দিয়ে সে একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল। তারই মধ্যে পিছন ফিরে দেখলুম, চকোলেট রঙের একটা মারুতি ভ্যান একেবারে হঠাৎই সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। ভ্যানের দরজা খুলে যেতেই ছেলেগুলো তার মধ্যে হুড়মুড় করে উঠে পড়ল। ভ্যানটা তার পরে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াল না। যে-দিক থেকে এসে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, সেই দিকেই ফের ছুটে বেরিয়ে গেল। হোর্ডিংটা ঝুলতে লাগল একটা ছেঁড়া পতাকার মতো। গোটা ব্যাপারটা ঘটে যেতে দু’মিনিটও লাগল না।
গেস্ট হাউসে ফিরে দেখি, ভাদুড়িমশাই আমাদের ঘরে বসে সদানন্দবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন। ঢিল ছুড়ে অমুদের হোর্ডিংটার দফা রফা করে দেবার ব্যাপারটা তাঁকে বললুম। সব শুনে তিনি বললেন, “অটোওয়ালা যে আপনাকে আটকেছিল, ছেলেগুলোকে বাধা দিতে দেয়নি, সেটা সে ভালই করেছে। ওদের বাধা দিলে কী হত জানেন? হোর্ডিংয়ের দিকে ঢিল না ছুড়ে আপনার মাথা তাক করে ছুড়ত। …না না, ওরা বাচ্চা-ছেলে হতে পারে, কিন্তু ওদের পিছনে পাকা মাথা রয়েছে। ওই যারা ভ্যানে করে ওদের ওখানে পাঠিয়েছিল, তারপর আবার ভ্যানে করে জায়গামতো ফিরিয়েও নিয়ে গেছে, তারা। রাত্তিরে আবার আর-এক দল ছেলেকে তারা আর-এক জায়গায় পাঠাবে। আরে মশাই, এই অ্যাড-ক্যাম্পেনে কাদের স্বার্থে ঘা পড়েছে, সেটা বোঝেন না? এ-সব কাজ তারাই করাচ্ছে।”
খিদে পেয়ে গিয়েছিল। বললুম, “একটা তো বাজে। খেতে যাবেন না?”
“যাব।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু কলকাতার কাগজ এসে গেছে, একবার চোখ বুলিয়ে নিন। তিনের পাতায় একটা খবরে দাগ দিয়ে রেখেছি, সেটা পড়তে ভুলবেন না।”
কথাটা যে-ভাবে বললেন, তাতে তিনের পাতাটাই আগে খুলতে হল। দাগ দেওয়া খবরটি এই রকম :
স্টাফ-রিপোর্টার, ১২ মার্চ—আজ রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ পার্ক সার্কাস কানেক্টর ও বালিগঞ্জ কানেক্টরের মধ্যবর্তী একটি জায়গায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বাইপাসের ধারে একটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে। বছর ত্রিশ-চল্লিশের একটি পুরুষের মৃতদেহ। পুলিশের ধারণা, লোকটিকে খুন করে চলতি কোনও গাড়ি থেকে ওখানে নিক্ষেপ করা হয়। লোকটির কপালে পুরনো একটি ক্ষতচিহ্ন রয়েছে।
খবরের শেষ লাইনটা পড়ে আমি চমকে উঠে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকালুম। তিনি মৃদু হেসে বললেন, “চলুন, খেতে যাওয়া যাক।”