৭
১৩ মার্চ, সোমবার। ডায়েরি লেখা শেষ করে শুয়ে পড়তে-পড়তে কাল রাত বারোটা বেজে গেসল। সঙ্গে-সঙ্গেই যে ঘুমিয়ে পড়তে পেরেছিলুম, তা নয়। মাথার মধ্যে হরেক রকমের চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকলে ঘুম আসতে দেরি হয়। তা অমিতাভর জীবনে এই যে একটা ঝামেলা এসে জুটেছে, পাথর ছুড়ে গাড়ির কাচ ভেঙে দেওয়া ছাড়াও রিজের নির্জন রাস্তায় চুরমার করা হয়েছে তার গাড়ি, তার উপরে আবার ফোনে হুমকি দেওয়া হয়েছে যে, ইস্কুল থেকে তার তিন বছরের ছেলেকে কিডন্যাপ করা হবে, বিছানায় টান হবার পরেও একদিকে যেমন সেটা নিয়ে ভাবছিলুম, অন্য দিকে তেমনি ভাবছিলুম পদ্মর কথা। পদ্মকে কে মারল? কপালে-কাটা-দাগওয়ালা সেই লোকটা? কিন্তু পদ্মর আগে যে তারই মরার কথা ছিল, ভাদুড়িমশাই-ই বা হঠাৎ এমন কথা বললেন কেন? ভাদুড়িমশাই আরও একটা কথা কাল বলেছেন। তাঁর একটা ধারণার কথা। সেটা কী? না জাল-সিরিঞ্জ আর জাল-নোটের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছেই।
চিন্তা হচ্ছিল সদানন্দবাবুকে নিয়েও। যে-বাড়িতে কাজের মেয়ে খুন হয়েছে, পুলিশ তার মালিককে নিয়ে টানাটানি করবে না, তাও কি হয় নাকি? লোকাল থানার পুলিশ এতক্ষণে নিশ্চয় সদানন্দবাবুর খোঁজ করতে এসে জেনে গেছে যে, তিনি কলকাতায় নেই, রবিবার সকালের ফ্লাইটে দিল্লি চলে গেছেন। তা কোনও একটা ঘটনা সম্পর্কে পুলিশ যাদের জিজ্ঞেসাবাদ করতে চায়, তাদের মধ্যে কেউ যদি হঠাৎ অকুস্থল, অর্থাৎ ঘটনাটা যেখানে ঘটেছে, সেই জায়গা থেকে সরে পড়ে, তা হলে সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে পুলিশের সন্দেহ তার উপরে পড়বেই। কে জানে ভাদুড়িমশাই এ-দিকটা ভেবে দেখেছেন কি না।
ঘুমের আর দোষ কী, মাথার মধ্যে এত সব ভাবনা জট পাকিয়ে গেলে ঘুম আসতে দেরি হওয়াই স্বাভাবিক। আমারও মনে হয় কাল ঘুম আসতে-আসতে একটা-দেড়টা বেজে গিয়েছিল। উঠেছি আটটা নাগাদ। উঠে দেখলুম ঘর ফাঁকা। বেয়ারাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, আমার ঘরের ‘বুঢ়া বাবু’ খানিক আগে গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে গেছেন। ‘বুড্ঢা বাবু’ সাড়ে আটটা নাগাদ ফিরে বললেন, মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছিলেন। কাছাকাছি একটা পার্কে গিয়ে গোটা দশেক পাক মেরেছেন। “তাতে মাইল তিনেক কভার করতে পেরিচি কি না, তা অবশ্য জানি না।” ভদ্রলোকের মুখ দেখে অবশ্য মনে হল না, খুব একটা চিন্তিত। পদ্মর ব্যাপারে পুলিশের সন্দেহের তির যে তাঁকে লক্ষ্য করতে পারে, তা আর তাঁকে বলিনি। কী দরকার ভদ্রলোককে ফের ভয় পাইয়ে দিয়ে!
ভাদুড়িমশাই আমাদের ঘরে এসে ঢুকলেন ন’টা নাগাদ। কিচেনে ফোন করে ঘরেই ব্রেকফাস্ট আনিয়ে নেওয়া গেল। প্রাতরাশ করতে-করতেই দুটো খবর দিলেন ভাদুড়িমশাই। এক নম্বর খবর, কলকাতায় ফোন করে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, আমরা ভাল আছি। আর দু’নম্বর খবর, একটু বাদেই সুরিন্দর বেদী আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবে।
পাঠকরা আশা করি সুরিন্দর বেদীকে ভুলে যাননি। ভাদুড়িমশাইয়ের মির্জাপুরকীর্তি নিয়ে ‘পাহাড়ি বিছে’ বলে যে কাহিনি আমি লিখেছিলুম, তার প্রথম পরিচ্ছেদেই সুরিন্দর বেদীর কথা ছিল। ছেলেটি চারু ভাদুড়ি ইনভেস্টিগেশানসের দিল্লি ব্রাঞ্চের চার্জে আছে। কাজেকর্মে দক্ষ লোক, ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলে, মুখে সর্বদাই লেগে থাকে অল্প-একটু হাসির ছোঁয়া। কৌশিক অবশ্য বলে যে, ওই হাসিটাই হচ্ছে মারাত্মক, ‘ও যে হাসতে-হাসতেই কখন কার সোলার প্লেক্সে রদ্দা মেরে বসবে, তার ঠিক নেই।’ বয়স বছর পঁয়ত্রিশ। আগে বাঙ্গালোরে ছিল। বছর পাঁচেক হল এখানকার কাজকর্মের সামাল দিচ্ছে।
সুরিন্দর এল কাঁটায়-কাঁটায় দশটায়। আমাকে আর সদানন্দবাবুকে নমস্কার করে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “অওর কুছু করবার আছে?…আই মিন এমোন কাজ, যেটা আখুনি করা দরকার।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেটা একটু বাদে বলছি। আগে বলো যা-যা করতে বলেছিলাম, সেগুলো সব ঠিকমতো হয়েছে কি না। অল আই ওয়ান্ট ইজ আ প্রোগ্রেস রিপোর্ট।”
“রিপোর্ট তো রেডি হো রহা হ্যায়, বস। ওটা দু’দিন বাদে দিব।” সুরিন্দর তার মুখের হাসিটা ধরে রেখে বলল, “বাট অল দ্য আনসার্স আর অন মাই ফিঙ্গার টিপস। আপনি কোয়েশ্চেন কোরেন, আমি আনসার বাতাচ্ছি।”
“ভাল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ট্রাকটার কোনও হদিশ করতে পারলে?”
“শিওর। ওটা পাঞ্জাবের ট্রাক। বুদ্ধ জয়ন্তী পার্কের কাছে রিজের রাস্তায় ঘোষসাহেবের গাড়িতে বাঁ দিক থেকে ধাক্কা লাগায়। ফর দ্য লাস্ট থ্রি ডেজ ওটা ওখলার ওদিকে একটা গারাজে আছে।”
“কিন্তু পুলিশ তো বলছে, অমিতাভ ঘোষ থানায় যে নাম্বারের কথা বলেছিল, সেই নাম্বারের কোনও ট্রাকের খোঁজ তারা পায়নি।”-
“কী করে পাবে, সেটা তো ফল্স নাম্বার-প্লেট। পুলিশও জানে যে, সেটা ফল্স। অ্যাকসিডেন্টের পরে সেটা পালটে ফির আসলি নাম্বার লাগিয়ে নিয়েছে।”
“তুমি তা হলে ট্রাকটাকে আইডেন্টিফাই করলে কী করে?”
“ভেরি সিম্পল, বস।” সুরিন্দর বলল, “অ্যাকসিডেন্টের খবরটা আপনি আমাকে লাস্ট মঙ্গলবার সাত তারিখে দিলেন। বললেন, ঘোষ-সাহাবের গাড়ি, টাটা সুমো। ইউ অলসো গেভ মি দ্য প্লেস অ্যান্ড টাইম। রাইট?”
“হ্যাঁ, আমি মুম্বই থেকে তোমাকে ফোন করি। তার একটু আগেই এখান থেকে অমু আমাকে ফোনে সব জানিয়েছিল।”
“ইয়েস, বস। তো আপনার ফোন পেয়ে আই ওয়েন্ট টু দ্য প্লেস অভ দ্য অ্যাকসিডেন্ট। ঘোষ-সাহাব তখন সেখানে ছিলেন না।”
অমিতাভ বলল, “কী করে থাকব। পথ-চলতি একটা অটো ধরে আমি থানায় চলে গেসলাম।”
“কিন্তু আপনার স্ম্যাশড গাড়িটা সেখানে ছিল।” সুরিন্দর বলল, “আমি গিয়ে দেখলাম, থানা থেকে একজন কনস্টেবলকে সেখানে পাহারায় রাখা হয়েছে। গাড়ির কাছে ট্রাকের চাকার দাগ ছিল। আমি চাকার দাগের ছবি তুলি। ভাঙা এক টুকরো কাচ ছিল। সেটাও কুড়িয়ে নিই।”
“আমার টাটা সুমোর কাচ?”
“ওহ্ নো। ড্রাইভারের ডাইনে দরজার বাইরে একটা সাইড-গ্ল্যাস থাকে তো, এটা সেই সাইড-গ্ল্যাসের একটা ভাঙা টুকরো। লেকিন আপনার গাড়িতে দেখলাম বাঁ-দিকের জানলা আর সামনের কাচটা স্ম্যাশড হয়ে গেলেও ড্রাইভারের সাইড-গ্ল্যাসটা ভাঙেনি। এটা সেই কিলার-ট্রাকের সাইড-গ্ল্যাসের একটা পিস।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তারপর?”
“তারপর আমি লোক লাগালাম। অল ওভার দ্য সিটি অ্যান্ড সাবার্ব আমার এজেন্টদের বলে দিলাম, এইসা এক ট্রাকের পতা মিলনা চাহিয়ে, যার ড্রাইভিং সিটের ডানদিকের সাইড-গ্ল্যাস ভেঙে গেছে, যার সব ক’টা টায়ারই একদম ব্র্যান্ড নিউ…অ্যান্ড ইয়েস, যার সামনের দিকের মাডগার্ডে এমন দাগ লেগে আছে, যাতে বোঝা যায় যে, ট্রাকের সামনের দিকটা ডিপ মেরুন কালারের কোনও গাড়িকে ধাক্কা মেরেছিল।”
“আরে,” অমিতাভ বলল, “আমার টাটা সুমোর তো ওই রং! ডিপ ড্যাজলিং মেরুন!”
“তো ডিপ ড্যাজলিং মেরুন কালারের গাড়িকে ধাক্কা মারলে, যে সেই ধাক্কাটা মারল, ঘষটানি লেগে তার গাড়ির গায়েও ওই রং একটু লেগে যাবে না?”
ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ কৌতুকে ঝিকমিক করছিল। বললেন, “আ ভেরি ক্লেভার পিস অব ডিডাকশন।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, বস।” সুরিন্দর বলল, “তো আমাদের এজেন্টদের যেমন এই কুগুলান আমি দিয়ে দিলাম, তেমনি জানালাম দিল্লি পুলিশের হেডকোয়ার্টার্সে আমার এক বন্ধুকে, যাতে সে থানাগুলানকে এটা ইমিডিয়েটলি বলে দেয়। অ্যান্ড ইয়েস, স্পেয়ার পার্টসের দুকান অওর গাড়ি-মারাম্মতির গারাজগুলোও জেনে যায় যে, উই আর অন দ্য লুক আউট ফর আ ট্রাক উইথ ব্র্যান্ড নিউ টায়ার্স, আর ব্রোকেন সাইড-গ্ল্যাস অ্যান্ড আ প্যাঁচ অব ডিপ ড্যাজলিং মেরুন অন ইটস ফ্রন্ট মাডগার্ডস।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ট্রাকের লোকেরাও নিশ্চয় আন্দাজ করেছিল যে, একটা অ্যালার্ট জারি হয়ে যাবে, ফলে পরদিনই কোনও স্পেয়ার পার্টসের দোকান থেকে সাইড-গ্ল্যাস পালটে নেওয়া কি কোনও গাড়ি রিপেয়ার করার গারাজে গিয়ে মাডগার্ডের ওই ছোপটা তুলিয়ে আবার নতুন করে রং করানোটা খুব নিরাপদ হবে না।”
“ইয়েস, বস।” সুরিন্দর বলল, “শেষ পর্যন্ত ওখলার একটা গারাজে ওটার খোঁজ মেলে। খোঁজটা যে দিয়েছে, সে বলল, মঙ্গলবার রাত থেকে ওটা ওই গারাজেই পড়ে আছে, ওখান থেকে আর বাহার হয়নি। …তো এটা কি দিল্লি পুলিশকে জানাব?”
“জানাতে তো হবেই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ট্রাফিকের অমৃক সিং আমার চেনা লোক। আমার নাম করে তাকে সব জানাও। তবে হ্যাঁ, তাকে বলো যে, এখুনি কাউকে অ্যারেস্ট করার দরকার নেই, শুধু লোকাল থানা যেন গারাজটার উপরে সারাক্ষণ নজর রাখে। জায়গাটা কেমন, সুরিন্দর? জাস্ট একটা গারাজ?”
“ঠিক গারাজও নয়। ধাবা-লাগোয়া একটা পার্কিং লটের মতো। অনেকেই ওখানে ট্রাক রাখে।”
“ভাল। তা হলে নজর রাখুক ধাবায় কারা আসে, কখন আসে। কাউকে শেডি ক্যারেকটার বলে মনে হয় কি না। তেমন কেউ আসে কি না, পুলিশের খাতায় যার নাম রয়েছে।”
“ঠিক আছে, এখান থেকে ফিরে গিয়েই আমি অমৃক সিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে সব বলব। এনিথিং এলস?”
ভাদুড়িমশাই একটু ভেবে নিলেন। তারপর বললেন, “কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলে?”
“কালই করেছিলাম। অগর কাল তো সানডে থা, ইসি লিয়ে শোভন চৌধুরিকে লালবাজারে পাওয়া যায়নি। বাড়িতে ফোন লাগাতে হল। আপনার নাম করে সদানন্দবাবুর কথা ওঁকে বললাম।” সুরিন্দর বেদীর মুখে হঠাৎ নিজের নামটা উচ্চারিত হওয়ায় সদানন্দবাবু উৎকর্ণ হয়েছিলেন। সেইসঙ্গে লক্ষ করলুম, ভদ্রলোকের কপালে গোটা কয়েক ভাঁজ পড়ে গেছে।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাতে শোভন কী বলল?”
“বললেন যে, যে-মেয়েটা খুন হয়েছে, উইদিন আ ডে অর টু তার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট মিলবে, তার আগে কুছু বলা যাচ্ছে না। এটাও বললেন যে, জাল-নোটের ব্যাপারে নতুন কুছু খবর নাই। অওর হাঁ, সদানন্দবাবু যাতে হ্যারাসড না হন, সেটা উনি দেখবেন। আজ কি ওঁকে অওর একবার ফোন লাগাব?”
“না, তোমাকে আর ফোন করতে হবে না, ভাবছি দুপুরের দিকে আমি নিজেই শোভনকে একবার ফোন করব। তুমি বরং এ-দিকটা সামলাও।”
“অওর কুছু আপনার জানবার নাই?”
“আর কী জানব?”
“কেন, ঘোষ-সাহাবের বাড়িতে ওই যে ফোনের রিসিভার পালটানো হল, সেইটা?’
হঠাৎই আবার সরু হয়ে গেল ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ। সেই সরু চোখে তিনি সুরিন্দরের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, তারপর হোহো করে হেসে উঠে বললেন, “ওটা তা হলে তুমিই পালটে দিয়ে এসেছ? আমার বোঝা উচিত ছিল।”
সুরিন্দরও হাসছিল। মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলেও চোখে সেটাকে আটকে রেখে বলল, “না বস, আমি নিজে পালটাইনি। আই গট দ্য জব ডান বাই আ টেলিফোন-মেকানিক। টেলিফোন-এক্সচেঞ্জে আমাদের লোক আছে, অ্যান্ড হি ইজ অন আওয়ার পে-রোল। রিসিভারে যে মেকানিক্যাল ডিভাইসটা লাগানো আছে, সেটা অবশ্য আমিই সাপ্লাই করেছিলাম।”
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা কথা ভাবছি, সুরিন্দর। অমিতাভর বাড়িতে তুমি যাকে পাঠিয়েছিলে, সে গিয়ে সুলেখাকে… আই মিন অমিতাভর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিল যে, ওদের রিসিভারটা কোনও গণ্ডগোল করছে কি না। তাতে সুলেখা বলে যে, মাঝেমধ্যে একটা জারিং সাউন্ড হয়। তো সুলেখা যদি তা না-বলত, তা হলে কী করে…আই মিন কোন অজুহাতে রিসিভারটা পালটে দিত তোমার লোক?”
সুরিন্দর বলল, “আমি একটা বেপারে শিওর ছিলাম, এখনও আছি।”
“সেটা কী?”
“আপনি যদি একটা র্যান্ডম সার্ভে করে এ-দেশের যে-কোনও শহরে যে-কোনও একশোটা লোককে পুছেন যে, তার ফোনের রিসিভার ঠিকঠাক কাজ করছে কি না, তো অ্যাট লিস্ট নাইন্টি পিপল বলবে যে, না ঠিকঠাক কাজ করছে না, একটা-না-একটা কমপ্লেন তারা করবেই। সো মাই ম্যান টুক আ চান্স।”
আমি বললুম, “তা তো হল, কিন্তু এতে কাজটা কী হবে?”
প্রশ্ন শুনে সুরিন্দর যে-ভাবে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাল, তাতে বুঝলুম, এ নিয়ে আর-কিছু ব্যাখ্যা করে বলা ঠিক হবে কি না, সে সেটা তার উপরওয়ালার কাছে জানতে চ।ইছে। ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “গো অ্যাহেড।”
সুরিন্দর এবারে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঘোষ-সাহাবের বাড়িতে যে নতুন রিসিভারটা বসানো হল, তার ভিতরে একটা ছোট্ট যন্তর লাগানো আছে। আ ভেরি স্মল ওয়ান। সর্ট অব আ ক্যাসেট। বাইরে থেকে যে-ই ওদের ফোন করুক, সঙ্গে-সঙ্গে ওটা অ্যাকটিভেটেড হবে অওর তার ভয়েস ওতে রেকর্ডেড হয়ে যাবে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি ধরে নিচ্ছি, যে-লোকটা ওদের ছেলেকে তুলে নেবে বলে ফোনে হুমকি দিয়েছিল, দু-এক দিনের মধ্যে সে আবারও ফোন করে হুমকি দেবে। যদি দেয়, তো সঙ্গে-সঙ্গে রেকর্ডড হয়ে যাবে তার ভয়েস। তা পুলিশের কাছে তো দাগি অপরাধীদের ভয়েস-স্যাম্পল থাকেই। ফলে আমরা মিলিয়ে দেখতে পারব যে, সেই সব স্যাম্পলের কোনওটার সঙ্গে এর গলার স্বর কি কথা বলার ঢং মিলে যায় কি না।”
“তা এতই যখন করা সম্ভব,” আমি বললুম, “তখন ইনকামিং কলের সোর্স…মানে লোকটা কোন নম্বর থেকে ফোন করছে সেটা ট্রেস করা যায় না?”
সুরিন্দর বলল, “কেনো যাবে না? এক্সচেঞ্জে যে-লোকটি আমাদের হয়ে কাজ করে, তাকে সেটা বলেছি। ঘোষ-সাহাবের টেলিফোন-নাম্বার সে জানে। ওখানে কে ফোন করছে আর কোন নাম্বার থেকে করছে, অফ কোর্স হি উইল কিপ অ্যান আই অন দ্যাট।”
“কিন্তু এটা… আই মিন এই ফোন-ট্যাপিং, এই ভয়েস-রেকর্ডিং, এটা কি মানুষের প্রাইভেসির উপরে হামলা নয়? সেদিক থেকে তো এটা ঘোর বে-আইনি ব্যাপার।”
সুরিন্দর এতক্ষণ নিঃশব্দে হাসছিল। এবারে শব্দ করে হাসল। তারপর হাসি থামিয়ে বলল, “অফ কোর্স বে-আইনি বেপার। কিন্তু চাটার্জি-সাব, একবার ভাবুন যে, বে-আইনি বেপারটা আমরা করছি কেনো। দেশের যেটা আইন, সেটাকে হেলপ করবার জন্যেই তো। সো হোয়াটস রং দেয়ার?”
এরপরে আর কী বলা যায়? আমি চুপ করে গেলুম।
সদানন্দবাবু অনেকক্ষণ কোনও কথা বলেননি। কিন্তু তাঁর মুখ দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল যে, কিছু একটা বলতে চান। তবে তা বলা উচিত হবে কি না, সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না।
ভাদুড়িমশাই তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিছু বলবেন?”
“হ্যাঁ, মানে ভাবছিলুম যে…ভাবছিলুম যে…”
“কী ভাবছিলেন?”
“ভাবছিলুম যে, কলকাতায় কি অমন কোনও যন্তর লাগাবার ব্যবস্থা নেই?” সদানন্দবাবু বললেন, “তা হলে তো কোত্থেকে কে আমাকে ভয় দেখাচ্চে, সেটাও জানা যেত।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আছে বই কি। কলকাতাতেও আছে। তবে এ নিয়ে আপনি এত ভাববেন না। ভয়ের কিছু নেই। আপনার ব্যাপারে কী-কী স্টেপ নিতে হবে, কলকাতায় ফোন করে কৌশিককে সেটা আমি বলে দেব। তা ছাড়া আজ দুপুরেই তো শোভনের সঙ্গে কথা বলেছি। না না, আপনি চিন্তা করবেন না।”
আমি বললুম, “তা হলে এখন আমরা কী করব?”
“দুপুর একটায় নীচের ডাইনিং হলে গিয়ে আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবেন। ততক্ষণ গল্প করুন। মার্চের চমৎকার ওয়েদার, ইচ্ছে হলে বাইরে থেকে একটু ঘুরেও আসতে পারেন। আমি এখন আমার ঘরে গিয়ে গোটাকয় চিঠি লিখে ফেলব।”
সুরিন্দরকে নিয়ে ভাদুড়িমশাই আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।