জাল-ভেজাল – ৬

এখন রাত এগারোটা। গেস্ট হাউস থেকে আজ সন্ধে সাতটা পর্যন্ত কোথাও বেরোইনি। সাতটায় যাই গ্রেটার কৈলাসে অমুর ফ্ল্যাটে। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থাটা সেখানেই ছিল। দুপুর আর বিকেলের বৈঠকে যে-সব কথা হল আর তা থেকে যা জানা গেল, তার উল্লেখ আগেই করেছি। পদ্মকে কারা খুন করেছে, তা বোঝা শক্ত নয়। সদানন্দবাবুর বাড়িতে জাল-নোট নিয়ে যে-সব কথা হয়েছিল, পদ্মর পক্ষে তা শোনাই স্বাভাবিক। এটাও স্বভাবিক যে, সেদিন তার বস্তিবাড়িতে ফিরে পাঁচজনকে সে-সব কথা সে জানিয়েছে। তখন, কপালে কাটা-দাগওয়ালা একটা লোকই যে তার মনিব সদানন্দবাবুর পকেটে একটা জাল-নোট ঢুকিয়ে দিয়েছিল, এই শোনা-কথাটাও সে সবাইকে বলেছিল নিশ্চয়। ফলে, তার কথা থেকে যার আইডেন্টিটি ফাঁস হবার আশঙ্কা,পদ্মকে সে-ই যে খুন করেছে, এই সম্ভাবনাকে কিছুতেই উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি আমাদের সদানন্দবাবু, যিনি সব কথাই একটু দেরিতে বোঝেন, তাঁরও সেটা অনুমান করতে একটুও অসুবিধে হয়নি। তিনিও বললেন, “এ আর দেকতে হচ্চে না, এ নির্ঘাত সেই কপাল-কাটা লোকটার কাজ।”

শুনে আমি বলেছিলুম, “সদানন্দবাবু ভুল বলেননি।”

তাতে সদানন্দবাবু বলেন, “ভুল বলব কেন, এ তো বোঝাই যাচ্চে যে, পুলিশের হাতে ধরা পড়লে যাতে তাকে শনাক্ত করতে না পারে, তারই জন্যে পদ্মকে সে সরিয়ে দিল।”

কথাটা যে ভাদুড়িমশাইয়ের ভাবনায় বিশেষ দাগ কেটেছে, তাঁর মুখ দেখে তা কিন্তু মনে হল না। সদানন্দবাবুর কথা শুনে চিন্তিত মুখে তিনি বললেন, “আপনার তা-ই মনে হয়?”

সদানন্দবাবুর হয়ে উত্তরটা আমিই দিলুম। বললুম, “হওয়াই তো স্বাভাবিক। কাটা-কপালের কথাটা যখন পদ্মর মুখ থেকে বেরিয়েছে, তখন আসামিকে শনাক্ত করতে পুলিশ তো পদ্মকে ডাকবে। অবিশ্যি আসামিকে পুলিশ যদি ধরতে পারে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু পদ্ম তো আসামিকে দেখেইনি। সে একটা শোনা-কথা বলেছে মাত্র, তাও সত্যিই যদি সে পাঁচজনকে তা বলে থাকে। যা-ই হোক, আমি ধরেই নিচ্ছি যে, লোকটার শরীরের ওই ডিস্টিংগুইশিং মার্কটার কথা সত্যিই সে পাঁচজনকে বলেছিল, আর সেই রাত্তিরেই লোকটার কানে সে-কথা পৌঁছেও গিয়েছিল। কিন্তু সে-ক্ষেত্রেও সে পদ্মকে তার প্রথম টার্গেট করবে কেন?”

অমু বলেছিল, “কেন করবে না, মামাবাবু?”

“সে তো বললুমই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “পদ্মর বেঁচে থাকাটা তার পক্ষে বিপজ্জনক ঠিকই, কিন্তু তার চাইতে ঢের বেশি বিপজ্জনক এমন লোকের বেঁচে থাকা, যে কিনা পদ্মর মতো শোনা-কথা বলবে না, অর্থাৎ যে কিনা তাকে সত্যি-সত্যি চাক্ষুষ করেছে।”

কথাটার তাৎপর্য বুঝতে এবারও সদানন্দবাবুর বিন্দুমাত্র দেরি হল না। ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে শুকনো মুখে তিনি বললেন, “আপনি কি আ-আ-আমাকে মিন করচেন নাকি?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যে-লোকটা আপনার পকেটে ওই পাঁচশো টাকার জাল নোটটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল, পদ্ম কি তাকে দেখেছে?”

“না।”

“কিন্তু আপনি দেখেছেন।”

“হ্যাঁ, তা দেখিচি বই কী।”

“বিপদ অতএব আপনারই বেশি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “পুলিশ যদি সত্যিই লোকটাকে ধরতে পারে, তা হলে তাকে শনাক্ত করার একটা প্রশ্ন তো উঠবেই। তখন কিন্তু আপনার ডাক পড়বে। লোকটার প্রথম টার্গেট অতএব পদ্মর নয়, আপনারই হওয়া উচিত ছিল।”

সদানন্দবাবু বললেন, “কিন্তু পুলিশ আমাকে ডাকবে কেন? আমি তো এ-ব্যাপারে পুলিশকে কিচু জানাইনি। তা হলে লোকটাকে যে আমি চাক্ষুষ করিচি, পুলিশ তা জানবে কী করে?”

“পুলিশকে আমরা যতটা বোকা ভাবি…আই মিন এদেশি আর বিদেশি গোয়েন্দাকাহিনিতে তাদের যতটা বোকা বলে দেখানো হয়, সত্যিই কিন্তু তারা ততটা বোকা নয়, সদানন্দবাবু।” ভাদুড়িমশাই সামান্য হেসে বললেন, “তারা ঠিকই জানতে পারবে।”

গেস্ট হাউসে বসে এ-ব্যাপারে তখন আর কোনও কথা হয়নি। এর পরেই আমরা অমুর প্রসঙ্গে চলে যাই। সাতটা নাগাদ গেস্ট হাউস থেকে চলে যাই অমুর বাড়িতে। সেখানে রাতের খাওয়া শেষ করে যখন আবার গেস্ট হাউসে ফিরব, তখন কপালে-কাটা-দাগওয়ালা লোকটার কথা আর-একবার উঠেছিল। সে-প্রসঙ্গে পরে আবার আসব। তার আগে অন্য কিছু কথা সেরে নিই।

গ্রেটার কৈলাস চমৎকার পাড়া। আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু বিকাশ এখানকার ফেজ টুতে থাকে। দিল্লিতে এলুম, অথচ বিকাশের সঙ্গে দেখা হল না, এমন বড় একটা কখনও ঘটে না, বার দুয়েক তো ওরই বাড়িতে উঠেছি। আবার এমনও হয়েছে যে, উঠেছি হয়তো অন্য জায়গায়, হেলি রোডের বঙ্গভবনে কি লোদি এস্টেটের ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে কি রাজিন্দরনগরে, কিন্তু বিকাশ সে-কথা জানামাত্রই ছুটে এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেছে ওর বাড়িতে। এবারে অবশ্য আমার দিল্লি আসার কথা এখনও পর্যন্ত ও জানতে পারেনি। তবে জানবে ঠিকই, আর জানবার পরে যে ছুটে আসবে তাও ঠিক।

চিত্তরঞ্জন পার্কও এখান থেকে খুব কাছেই। বলতে গেলে সেটা বাঙালি-পাড়াই। সেখানে একটা টিলার উপরে পাশাপাশি যে তিনটি মন্দির রয়েছে, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। মন্দিরের সামনেকার লন আর বাগানও দেখার মতো। বাগান ঘিরে বেঞ্চি পাতা। বিকেলের দিকে প্রবীণ বাঙালিদের দিব্যি একটা আড্ডা জমে যায়। অনেকেই রিটায়ার্ড সরকারি কর্মচারী। বেশ খানিকটা সময় এখানে বসে গল্পগুজব করে তাঁরা যে-যাঁর বাড়ি ফিরে যান। সদানন্দবাবুকে একদিন ওখানে নিয়ে যেতে হবে। তবে ভদ্রলোকের এখন যে-রকম মনের অবস্থা, খুব-একটা উৎসাহিত হবেন বলে মনে হয় না। তার উপরে আবার পুলিশ যে দোষীকে শনাক্ত করার জন্য তাঁকেই ডাকতে পারে, এই কথাটা শুনে অবধি ভদ্রলোক বড্ডই সিঁটিয়ে আছেন। আমাকে বলেওছেন যে, কলকাতা শহরে লক্ষ-লক্ষ লোক থাকতে কেন যে ‘হারামজাদাটা’ তাঁরই পকেটে জাল-নোট গুঁজে দিল, “কোনও মানে হয় মশাই?”

তো যা বলছিলুম। গ্রেটার কৈলাস যেমন ছিমছাম পরিচ্ছন্ন পাড়া, অমুর ফ্ল্যাটটিও তেমনি প্রশস্ত ও পরিপাটি। আসলে একটা চারতলা বাড়ির গোটা তিনতলা জুড়ে এই ফ্ল্যাট। বোঝাই যাচ্ছে যে, ম্যাক্রো কনস্ট্রাকশান ইন্টারন্যাশনাল থেকে এই তিনতলাটা ভাড়া নিয়ে তাদের ডিভিশনাল ম্যানেজারের জন্য সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। অমু যে এখানে এরই মধ্যে বেশ গুছিয়ে বসেছে, তাও বোঝা যায়। হঠাৎই আবার মনে হল যে, বিদেশে যাক আর না-ই যাক, এ-ছেলে আর কলকাতায় ফিরছে না।

না-ফেরার আরও একটা কারণ সম্ভবত এই যে, অমুর বউ সুলেখা বাঙালি বটে, তবে প্রবাসী বাঙালি পরিবারের মেয়ে, পিত্রালয় জয়পুরে, শুনলুম ইস্কুল জীবন সেখানে কাটিয়ে পরে বাপের বদলির চাকরির সুবাদে দিল্লি চলে আসে। সুলেখার কলেজ-জীবন অতএব দিল্লিতেই কেটেছে। বিয়ের পরে কলকাতায় এক-আধবার গিয়েছে বটে, তবে স্বাভাবিক কারণেই দিল্লি তার কাছে যতটা নিজের জায়গা, কলকাতা তার সিকির সিকিও নয়। ছেলে রুনুও দেখলুম বাংলা বিশেষ বলে না। তিন বছরের বাচ্চা। বাংলায় কিছু জিজ্ঞেস করলে বোঝে ঠিকই, কিন্তু উত্তর দেয় ইংরেজিতে। সেই ইংরেজির মধ্যে মাঝে-মাঝে হিন্দিও ঢুকে যায়। ঠেট হিন্দি। কিন্ডারগার্টেনে যতক্ষণ থাকে, সেই কয়েক ঘন্টা ছাড়া বেশির ভাগ সময় বেয়ারা বাবুর্চিদের কথাই শোনে তো, তা হলে আর বাংলা শিখবে কোত্থেকে। নাঃ আমিতাভর আর কলকাতায় ফেরার কোনও সম্ভাবনাই নেই।

সম্ভবত ভাদুড়িমশাই আগে থাকতেই আপত্তি জানিয়ে রেখেছিলেন, অমিতাভ তাই বড় মাপের আয়োজন করেনি। সাদাসিধে বাঙালি খাওয়া। ডাল, ভাজা, একটা তরকারি আর মাছ। সবশেষে দই-মিষ্টি। খাওয়ার পর্ব শেষ হবার পর বারান্দায় বসে কথা হচ্ছিল। এ-ফ্ল্যাটের দু’দিকে দুটি ঘেরা বারান্দা। একটা সামনের রাস্তার দিকে। অন্যটা পিছনে। সেখান থেকে নীচের লন ও বাগান দেখা যায়। বাগানে আলো জ্বলছিল। গোটা দুয়েক আলো নাকি সারা রাতই জ্বলে, দিনের আলো ফুটলে নিবিয়ে দেওয়া হয়।

কথা শুরু হয়েছিল দেশের অবস্থা নিয়ে। রাজনীতি, অর্থনীতি, শেয়ার বাজার ૭ গ্লোবালাইজেশনের চক্করে ঘুরপাক খেয়ে শেষপর্যন্ত সেটা কারগিল-প্রসঙ্গে এসে কেন্দ্রীভূত হয়। অমু বলে, “কারগিলে ওরা আমাদের অসতর্কতার সুযোগ নিয়েছিল, তবে সুবিধে করতে পারেনি, পাল্টা-মার খেয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ওরা চুপ করে বসে নেই। আমাদের একটা এয়ারবাস কীভাবে হাইজ্যাকড হল, তা তো দেখলেনই, সেইসঙ্গে কাশ্মীরের অবস্থাটাও দেখুন, মামাবাবু সরাসরি… আই মিন সামনা-সামনি এঁটে উঠতে পারেনি বলে চোরাগোপ্তা হামলা সমানে চালিয়েই যাচ্ছে। এমন একটা দিনও কি যায়, কাগজে যেদিন কাশ্মীরে কোনও নতুন হামলার খবর থাকে না?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “শুধু কাশ্মীর কেন, আমাদের দেশের আরও নানান জায়াগায় যে ওরা চক্রান্তের জালটাকে বেশ বড় করেই ছড়িয়েছে, তাতে আমার সন্দেহ নেই। দেশটাকে ডিস্ট্যাবিলাইজ করে দিতে চাইছে তো, এই যে জাল-নোটের কথা হচ্ছিল, এও তো সেই চক্রান্তেরই একটা অংশ। তার উপরে আবার জুটেছে এই জাল-সিরিঞ্জের বিপদ।…বাই দ্য ওয়ে, এ-ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দেবার জন্য যে অ্যাড-ক্যাম্পেন তোমরা চালাচ্ছ,সেটা কি শুধু দিল্লির কথা ভেবেই করছ নাকি?”

“না না, শুধু দিল্লির কথা ভেবে এটা করা হচ্ছে না।” অমু বলল, “ক্যাম্পেনের এটা ফার্স্ট ফেজ। মোট ছ’টা বড় শহরে এটা চলবে। দিল্লি কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দরাবাদ আর বাঙ্গালোর।”

আমি বললুম, “কিন্তু ক্যাম্পেনের ভাষা কি এই একই থাকবে নাকি?”

“না, কিরণমামা। ইংরেজি অবশ্য থাকবেই। তবে হিন্দির বদলে অন্য-সব শহরে আসবে সেখানকার আঞ্চলিক ভাষা। কলকাতায় বাংলা, মুম্বইয়ে মরাঠি, চেন্নাইয়ে তামিল, হায়দরাবাদে তেলুগু আর বাঙ্গালোরে কন্নড়। যেমন কাগজের বিজ্ঞাপনে, তেমনি হোর্ডিংয়ে।”

সুলেখা এতক্ষণ ভিতরেই ছিল। সে ভিতর থেকে বারান্দায় এসে একটা চেয়ার টেনে বসতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে এলে?”

“হ্যাঁ।” সুলেখা হেসে বলল, “ঘুমের আগে একটা গল্প বলতে হয়, নইলে ঘুমোতে চায় না।” আমি বললুম, “কাল থেকে তো আবার ওর ইস্কুল!”

কথাটার জবাব না-দিয়ে অমুর দিকে তাকাল সুলেখা। যেভাবে ভুরু কুঁচকে তাকাল, তাতেই বুঝলুম, ইস্কুলের ব্যাপারে কিছু-একটা অস্বস্তির কারণ ঘটেছে।

অমু বলল, “ভাবছি রুনুকে এখন কয়েকটা দিন ইস্কুল পাঠাব না।”

“কেন? শরীর খারাপ?”

“না।” আমতা-আমতা করে অমু বলল, “ঠিক তা নয়।”

“তা হলে?” আমি বললুম, “আমরা অবিশ্যি তিন বছর বয়েসের একটা দুধের বাচ্চাকে এইভাবে ইস্কুলে পাঠাবার কথা ভাবতেও পারতুম না, কিন্তু তোমরা এ-কালের বাপ-মা, তোমাদের চিন্তা-ভাবনা যে অন্যরকম, তা আমরা খুব ভালই জানি। কিন্তু সে-কথা থাক, বাচ্চার শরীর যখন খারাপ নয়, জ্বরজারি হয়নি, তখন তাকে ইস্কুলে পাঠাচ্ছ না কেন?”

অমু কোনও উত্তর দিল না, চুপ করে বসে রইল। মনে হল, সে খুব অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে। হঠাৎই সরু হয়ে এল ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ। একটুক্ষণ একেবারে একদৃষ্টিতে তিনি অমিতাভর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নিচু কিন্তু স্পষ্ট গলায় বললেন, “কেউ ভয় দেখিয়ে চিঠি লিখেছে? শাসিয়েছে যে, ওকে ইস্কুল থেকে তুলে নিয়ে যাবে?”

“হ্যাঁ।” অমু বলল, “তবে চিঠি নয়, ফোন। আজ বিকেলেই বাড়িতে ফোন করে হুমকি দিয়েছে।”

“আজই বিকেলে? কিন্তু তোমার তো তখন বাড়িতে থাকার কথা নয়, তুমি তখন সফদরজঙ্গের গেস্ট হাউসে ছিলে। আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলে।”

“ঠিকই বলেছেন, মামাবাবু। আমি তখন বাড়িতে ছিলুম না। ফোনটা সুলেখা ধরেছিল।” সুলেখার দিকে তাকালেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “যে ফোন করেছিল, সে পুরুষ না মেয়ে?”

“পুরুষ।” সুলেখা বলল, “প্রথমেই কয়েকটা গালাগাল দিল। বিচ্ছিরি গালাগাল। এমন বিচ্ছিরি যে, সে আমি মুখে আনতে পারব না। তারপর হেসে বলল, মুন্না তো বহোত্ পেয়ারা হ্যায় না, স্কুলসে উসকো উঠা লেঙ্গে।”

সদানন্দবাবু বললেন, “এই কথাটা হেসে বলল?”

“হ্যাঁ, কিন্তু সে এমন হাসি যে, শুনলে বুক শুকিয়ে যায়।”

অমু বলল, “আমার ধারণা, এ সেই একই লোক, মামাবাবু। দফতরে ফোন করে আমাকে বলেছিল যে, হোর্ডিংগুলো তিন দিনের মধ্যে সরিয়ে ফেলতে হবে। এর কথা আপনাকে বলেছি।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার মনে আছে। ভয় পেয়ো না, অমু। তবে হ্যাঁ, ছেলেকে তুলে নেবে বলে যখন হুমকি দিয়েছে, তখন রুনুকে এখন দিন-কয়েক ইস্কুলে না-পাঠানোই ভাল।… আর ইয়ে… একটা কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি, কাল সকালে কি বাইরের কোনও লোক এ-বাড়িতে এসেছিল?”

“সকালে মানে কখন?”

“এই ধরো ন’টা-দশটা নাগাদ।”

“নট দ্যাট আই নো অব।” অমু একটু ভেবে নিয়ে বলল, “সকাল সাড়ে আটটায় আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেসলাম। ফিরতে ফিরতে বারোটা বেজে যায়। মাঝখানে সাড়ে তিন ঘন্টা সময়। জানি না তার মধ্যে কেউ এসেছিল কি না। তবে সুলেখা তো বাড়িতেই ছিল, ও হয়তো বলতে পারবে।”

টুকিটাকি কয়েকটা কাজ সারতে সুলেখা এর মধ্যে বারান্দা থেকে উঠে ভিতরে চলে গিয়েছিল। অমু ডাকতে ফের বারান্দায় ফিরে এল। ভাদুড়িমশাইয়ের প্রশ্ন শুনে বলল, “তেমন কেউ না। তবে হ্যাঁ, টেলিফোন-এক্সচেঞ্জ থেকে একজন মেকানিক এসেছিলেন বটে। আমাদের রিসিভারটা কোনও গণ্ডগোল করছে কি না জিজ্ঞেস করতে আমি বলি যে, বড় কোনও গণ্ডগোল নয়, এই মাঝেমধ্যে কড়কড় করে একটা জারিং সাউন্ড হয়। শুনে তিনি রিসিভারটা পালটে দিয়ে যান।”

অমু বলল, “বলো কী, আমি তো টেলিফোন-এক্সচেঞ্জে কোনও কমপ্লেন করিনি। স্রেফ নিজে থেকে লোক পাঠিয়ে ওরা রিসিভার পালটে দিয়ে গেল? বাব্বা, দেশটার হল কী! এ তো ভাবাই যায় না।”

ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরিয়েছিলেন। সেটা শেষ করলেন। তারপর বললেন, “এবারে উঠতে হবে। যাবার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করি। তুমি কী ঠিক করলে? জাল-সিরিঞ্জ নিয়ে তোমাদের ক্যাম্পেনটা আশা করি থামিয়ে দেবে না?”

“মোটেই না।” অমু বলল, “শুরু যখন একবার করেছি, তখন এর শেষ দেখে ছাড়ব। তা আমাকে যতই ভয় দেখাক।”

ভাদুড়িমশাই স্পষ্টতই খুশি হলেন। বললেন, “ভেরি গুড।…শোনো অমু, নিজেকে নিয়ে তোমার ভয় নেই, সে আমি জানি। বাকি রইল তোমার বউ আর ছেলে। কিন্তু ওদের নিয়েও ভয় কোরো না। আমি তো আছি। এ-ব্যাপারে যা করবার, আমি ঠিকই করব। ইন ফ্যাক্ট, আমার কাজ এর মধ্যে শুরুও হয়ে গেছে।”

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর অনেকটা আত্মগতভাবে বললেন, “এদিকে জাল-সিরিঞ্জ, ওদিকে জাল-নোট। কী জানি কেন আমার মনে হচ্ছে যে, দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র একটা আছেই।…পদ্ম মারা গেছে, এবারে কার পালা? কপালে-কাটা-দাগওয়ালা সেই লোকটার? কিন্তু পদ্মর আগে তো তারই মরার কথা ছিল।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “আর নয়, চলুন এবারে গেস্ট হাউসে ফেরা যাক।”