৫
মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে যার লাশ পাওয়া গেছে, সে যদি সত্যিই পদ্ম হয়, তা হলে বুঝতে হবে সমস্যা আরও জটিল হয়ে দাঁড়াল। ভাদুড়িমশাইয়ের ধারণা, এই খুনের সঙ্গে জাল-নোটের একটা সম্পর্ক থাকাই সম্ভব। গেস্ট হাউসের কিচেন থেকে ইতিমধ্যে আমাদের জন্য চা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চা খেয়ে একটা সিগারেট ধরালেন ভাদুড়িমশাই। চুপচাপ কিছুক্ষণ সিগারেট টানলেন। তারপর সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওষুধের দোকান থেকে ফিরে এসে যখন পদ্ম বলল যে, নোটটা ওরা নেয়নি, জাল বলে ফিরিয়ে দিয়েছে, তখন আপনার রিঅ্যাকশনটা কী হল? খুব অবাক হয়ে গেলেন নিশ্চয়?”
“তা তো হলুমই।” সদানন্দবাবু বললেন, “ব্যাঙ্ক থেকে পাওয়া নোট… মানে তখন পর্যন্ত তো আমি আসল ব্যাপার জানি না, তাই তাজ্জব হয়ে গেসলুম।”
“মিসেস বসু তখন ছিলেন সেখানে?”
“ছিলেন মানে?” সদানন্দবাবু একেবারে চুপসে গিয়ে বললেন, “অফ কোর্স ছিলেন। পদ্মর কথা শুনে খেপে গিয়ে আমাকে এই মারেন তো সেই মারেন। যত বলি যে, ওটা ব্যাঙ্কের থেকে পাওয়া নোট, জাল হবে কী করে, তিনি সে-কথায় কানই দেন না! খালি বলেন, ‘ছিছি, জাল নোট দিয়ে জিনিস কিনতে পাঠিয়েচ। পাড়ার মধ্যে মান-সম্মান বলে আর কিচু রইল না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আজ কোতায়-কোতায় গেসলে, সব খুলে বলো, নইলে তোমাকে ছাড়চি না!’ তো কী আর করি, সব তাঁকে খুলে বললুম। চাঁদনিতে ওই আছাড় খাওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য চেপে যেতে চেয়েছিলুম, কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করলেন যে, ধুতিটা ছিঁড়ল কী করে, তখন সেটাও চেপে রাখা গেল না।”
“সব শুনে কী বললেন তিনি?”
“যা বললেন, সেটা তো আপনার কথার সঙ্গে মিলে যাচ্চে, মশাই। বললেন যে, ইস্টিশানে আমার পয়সাকড়ি কুড়িয়ে দেবার সময়েই জাল-নোটটা আমার পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েচে।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তা যদি বলে থাকেন তো বুঝতে হবে যে, ভদ্রমহিলার বুদ্ধি আপনার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু তাঁর কথা থাক, আপাতত আমি পদ্মর কথা ভাবছি।”
অমু এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল, একটাও কথা বলেনি। এবারে বলল, “কী ভাবছেন, মামাবাবু?”
ভাদুড়িমশাই তক্ষুনি অমুর কথার উত্তর না-দিয়ে সদানন্দবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার স্ত্রীর সঙ্গে যখন আপনার কথা হয়, ঘরে তখন আর কে ছিল?”
“আর-কেউ ছিল না।”
“পদ্মও ছিল না?”
“না।”
শুনে একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “জাল-নোট দিয়ে পদ্মকে ওষুধ কিনতে পাঠিয়েছিলেন বলে আপনার স্ত্রী তো আপনাকে খুব বকাঝকা করছিলেন তখন, তা-ই না?”
“হ্যাঁ।”
“তার মানে বেশ উঁচু গলাতেই কথা বলছিলেন তিনি, কেমন?”
“সে তো আমার ওয়াইফ সব সময়েই বলেন।” সদানন্দবাবু বললেন, ‘বকাঝকা করলেও বলেন, না-করলেও বলেন। অবিশ্যি আমিও যে খুব নিচু গলায় কথা বলছিলুম তা নয়।”
“তবে তো সোনায় সোহাগা। পদ্ম সেক্ষেত্রে ঘরে থাক আর না-ই থাক, আপনাদের ডায়ালগ সে বিলক্ষণ শুনতে পেয়ে থাকবে।” একটু চিন্তিত গলায় ভাদুড়িমশাই বললেন, “স্টেশনে আপনি আছাড় খাওয়ার পর ওই জাল-নোট আপনার পকেটে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আপনার স্ত্রীর এই অনুমানের কথাও পদ্মর সেক্ষেত্রে শুনে থাকাই সম্ভব। আর হ্যাঁ… পদ্ম যেখানে থাকে… কোথায় যেন থাকে বলছিলেন?”
“ট্যাংরার একটা বস্তিবাড়িতে।”
“হ্যাঁ, ট্যাংরার একটা বস্তিবাড়িতে। তো রাত্তিরে সেখানে ফিরে গিয়ে পদ্ম কি এই গল্পটা খুব রসিয়ে সবাইকে বলেনি?”
“গপ্পো কেন হবে?” সদানন্দবাবু বললেন, “এ তো সত্যি ঘটনা!”
“অফ কোর্স সত্যি ঘটনা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর সেইজন্যেই তো গল্প হিসেবে এমন মজাদার…আই মিন বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলার মতন গল্প।… আচ্ছা সদানন্দবাবু, আপনার স্ত্রীর কাছে এই সত্যি ঘটনার কথা যখন বলছিলেন, তখন আপনার সেই পরোপকারী বন্ধুটির… মানে ওই যিনি আপনার জিনিসপত্র আর টাকাপয়সা ফের গুছিয়ে তুলে দিলেন, সেই ভদ্রলোকের চেহারার একটা ডেসক্রিপশান দেননি?”
“তা দিয়েছিলুম বই কি
“ডিস্টিংগুইশিং মার্ক… মানে কপালের সেই কাটা দাগটার কথাও বলেছিলেন নিশ্চয়?”
“বলেছিলুম।”
‘পদ্ম যদি সেটাও শুনে থাকে আর বস্তিতে ফিরে গিয়ে রসিয়ে রসিয়ে গল্প করার সময় সেটাও বলে থাকে, তো তার ফলটা কী দাঁড়ায়?”
অমু বলল, “যাদের মারফতে জাল-নোট ছড়ানো হচ্ছে, তাদের অন্তত একজনকে আইডেন্টিফাই করার কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়।”
আমি বললুম, “হয়তো সেইজন্যেই পদ্মকে সরিয়ে দেওয়া হল, কপালে কাটা-দাগওয়ালা একটা লোক কীভাবে আর-একজনের পকেটে একটা জাল-নোট ঢুকিয়ে দিয়েছে, এই গল্পটা যাতে না আর ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সত্যিই যদি পদ্ম এই গল্পটা সেদিন তার বস্তিতে ফিরে সবাইকে বলে থাকে… অ্যান্ড আই থিংক সত্যিই সে বলেছিল… তা হলে তো বুঝতে হবে না-জেনে সে নিজেই নিজের ডেথ-ওয়ারেন্টে সই করে দিয়েছিল সেদিন।”
“ওরে বাবা,” সদানন্দবাবু বললেন, “এ তো ভয়ংকর ব্যাপার। কাণ্ডটা যে অ্যাদ্দুর গড়াবে, তা তো আমি ভাবতেও পারিনি!”
“এদিকে অমুর কথা তো এখনও আপনাদের বলিনি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেও কিছু কম ভয়ংকর নয়। তা নইলে আর মুম্বই থেকে পড়িমরি এখানে ছুটে আসব কেন।”
সদানন্দবাবু বললেন, “কী হয়েচে অমুর? ওকেও কেউ জাল-নোট গছিয়েচে?”
উত্তরটা অমুই দিল। বলল, “জাল-নোট নয়। জাল সিরিঞ্জ।”
আমি বললুম, “ডিসপোজেবল সিরিঞ্জের কথা বলছ তো?”
“হ্যাঁ, কিরণমামা।’
“একবার ইউজ করেই ওগুলো ভেঙে ফেলার কথা।” আমি বললুম, “কিন্তু অনেকেই ভাঙে না, আর তার ফল কী হয়, সে তো সবাই জানি। হাসপাতাল আর নার্সিং হোমের জঞ্জাল ঘেঁটে অনেকে ওগুলো কুড়িয়ে নিয়ে যায়। তারপর নতুন মোড়কে ওই ইউক্ড সিরিঞ্জগুলো আবার বাজারে ঢুকে পড়ে।”
“ঠিক বলেছেন। তার ফল কী হচ্ছে, তা তো জানেনই।”
“জানব না কেন, এর ফলে মারাত্মক সব রোগ যে কীভাবে ছড়াচ্ছে, সে তো আমরা সবাই জানি। কাগজে এ নিয়ে লেখালিখিও তো কিছু কম হয় না, আর শুধু কাগজ বলেই বা কথা কী, ইউজ-করা সিরিঞ্জগুলো হাসপাতালের বাইরে কীভাবে ডাঁই করে ফেলে রাখা হয়, টিভিতেও তো তা কতবার দেখানো হয়েছে। কিন্তু কই, লোকের চৈতন্য হচ্ছে কোথায়!”
“হচ্ছে না, কিন্তু হওয়া দরকার।” অমু বলল, “যাতে হয়, তার জন্যে আমাদের কম্প্যানি থেকে…. আই মিন আমাদের কম্প্যানির যে পাবলিক রিলেশানস ডিপার্টমেন্ট রয়েছে, তার থেকে হালে একটা ড্রাইভ দেওয়া হয়েছিল। এতে যে আমাদের কোনও স্বার্থ ছিল না, তা বলব না।”
“কীসের স্বার্থ?” আমি বললুম, “তোমরা কি ডিসপোজেবল সিরিঞ্জও বানাও নাকি?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আরে কিরণবাবু, এটা ওরা মাল বিক্রির জন্যে করে না, এটা করে কম্প্যানির ইমেজ বাড়াবার জন্যে। পাবলিক ইন্টারেস্টে কলকাতাতেও তো কত কম্প্যানি বাগান বানিয়ে দিচ্ছে, কি একটা বাগান অ্যাডপ্ট করে মালি রেখে সেটা মেনটেন করার দায়িত্ব নিচ্ছে। এও তেমনি। এর সঙ্গে বিক্রিবাটার কোনও সম্পর্ক নেই। এ-সব কাজের…মানে ওই যাকে আপনারা জনহিতকর কাজ বলেন আর কি, এর একটাই উদ্দেশ্য, ইমেজ বাড়ানো।”
অমু বলল, “অ্যাবসলুটলি রাইট। তো আমাদের ডিরেক্টর্স বোর্ড যখন ঠিক করল যে, আমাদের ম্যাক্রো কনস্ট্রাকশান ইন্টারন্যাশনালকেও ওই রকমের কোনও কাজের ভার নিতে হবে, তখন কাজটা কী হবে, তা ঠিক করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। তো আমি বলি, ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ নিয়ে এই যে একটা সর্বনেশে চোরাই ব্যাবসা গজিয়ে উঠেছে, এর বিপদ সম্পর্কে পাবলিককে আমরা সচেতন করে তুলতে পারি। বোর্ডও একেবারে সঙ্গে-সঙ্গেই তাতে রাজি হয়ে যায়। আমাকে বলে, গো অ্যাহেড।”
সদানন্দবাবু ভুক্তভোগী মানুষ। একদিকে যখন জাল-নোটের ফাঁদে পড়ে ছটফট করছিলেন, তখন একইসঙ্গে তাঁকে জাল ডিসপোজেবল সিরিঞ্জের হ্যাপাও সমানে সামলাতে হয়েছে। তিনি তাই অমুর কথাগুলি এতক্ষণ খুবই মন দিয়ে শুনছিলেন। অমু একটু থামতেই তিনি সামনে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তারপর?”
“তারপর আর কী।” অমু বলল, “বোর্ড আমার প্রোপোজালটা অ্যাপ্রুভ করার পরে আমি আর দেরি করিনি, একেবারে সঙ্গে-সঙ্গেই কাজে লেগে যাই। আমাদের পাবলিক রিলেশানস ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে একটা বৈঠক সেরে নিয়েই ডেকে পাঠাই একটা অ্যাড-এজেন্সির ম্যানেজারকে! তাঁকে বলি যে, ডিজপোজেবল সিরিঞ্জ নিয়ে যে ডিজনেস্ট কারবার চলছে, পাবলিককে সে সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে কাগজের জন্যে কয়েকটা বিজ্ঞাপন তো তৈরি করে দিতে হবেই, সেইসঙ্গে শহরের বড় বড় ক্রসিংয়ে লাগাতে হবে প্রমাণ সাইজের হোর্ডিং।”
একটুক্ষণ চুপ করে রইল অমু। তারপর বলল, “এ হল মাস দেড়েক আগের ঘটনা। অ্যাড-এজেন্সি আমাদের কাজটা চটপট করে দেয়। কাগজে গোটাকয় বিজ্ঞাপন এরই মধ্যে বেরিয়েও গেছে, সেইসঙ্গে হিন্দি আর ইংরেজিতে লাগানোও হয়েছে গোটাকয়েক বড়-বড় হোর্ডিং। আজ যখন এয়ারপোর্ট টার্মিন্যাল থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন একটা হোর্ডিং হয়তো আপনাদের চোখেও পড়ে থাকবে।”
আমি বললুম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখেছি। একজন লোককে ইঞ্জেকশান দেওয়া হচ্ছে, এই ছবির উপরে বড়-বড় হরফে লেখা: বিওয়্যার অভ দ্য নিডল। চমৎকার হোর্ডিং।”
কাজের প্রশংসা করলুম, অথচ অমু যে তাতে বিশেষ উৎফুল্ল হয়েছে, এমন মনে হল না। ফের একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আপনি তো বললেন চমৎকার, কিন্তু আমাদের এই অ্যাড-ক্যাম্পেন নিয়েই বিপদ ঘটেছে, কিরণমামা। কিছু লোক এটা একদম পছন্দ করছে না।”
কিছুই বুঝতে পারলুম না। ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললুম, “অমুরা যা করছে, সে তো বেশ ভাল কাজ। মানুষের এতে উপকার হবে। যেখানে জীবন-মরণের প্রশ্ন সেখানে ইউ কান্ট অ্যাফোর্ড টু বি কেয়ারলেস। এই সব হোর্ডিং দেখে সাধারণ মানুষ সাবধান হতে শিখবে।”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তা তো বটেই।”
“তা হলে এটা পছন্দ না হবার কী আছে? কারা পছন্দ করছে না? বিপদের কথাই বা উঠছে কেন?”
“সেটা আমার মুখে শুনে কী হবে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অমুই বলুক।”
অমু তিক্ত হাসল, বলল, “আমাদের অন্তত আট-দশটা হোর্ডিং এরই মধ্যে ঢিল মেরে ছিঁড়ে দিয়েছে।”
“কই,” সদানন্দবাবু বললেন, “এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যেটা দেকলুম, সেটার তো কোনও খেতি হয়েচে বলে মনে হল না।”
“ওটা প্রোটেক্টেড এরিয়া, সারাক্ষণ পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা রয়েছে, আর্মড গার্ড চব্বিশ ঘন্টা টহল দিচ্ছে, ওখানে কে ঢিল-পাটকেল ছুড়তে যাবে, অ্যারেস্ট হবার ভয় নেই? বজ্জাতি হচ্ছে যে-সব জায়গা কম্পারেটিভলি সেফ, সেখানে। রাত্তিরবেলায় এসে হোর্ডিংয়ের দফা রফা করে দিচ্ছে। শুধু যে ছিঁড়ে দিচ্ছে, তা নয়, ছবি আর লেখার উপরে বুলিয়ে দিচ্ছে কালির পোঁচড়া।”
“এ-কাজ কারা করছে?”
“তা তো জানি না, তবে অনুমান ঠিকই করতে পারি।” অমু বলল, “আমাদের এই ক্যাম্পেনে যাদের ক্ষতি হবার আশঙ্কা, কাজটা যে তারাই করছে, চোখ-কান বুজেই তা বলে দেওয়া যায়।”
“অর্থাৎ যা একবার ব্যবহার করা হয়ে গেছে, কিন্তু নষ্ট করে ফেলা হয়নি, হাসপাতাল আর নার্সিংহোমগুলোর বাইরে ফেলে দেওয়া সেই রাশি-রাশি ডিসপোজেবল সিরিঞ্জকে আবার সেলোফেনের মোড়কে মুড়ে যারা বাজারে ফের নতুন বলে চালায়, তারা। ঠিক বলেছি?”
“ষোলো-আনার উপরে আঠারো আনা ঠিক বলেছেন, কিরণমামা।” অমু বলল, “আর এদের এই সর্বনেশে ব্যাবসাটা কীসের সুযোগে চলছে জানেন? চলছে স্রেফ আমাদের অসাবধানতার সুযোগে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “রোজ এ-দেশে ওই রকমের কত সিরিঞ্জ ইউজ করা হয় ভাবুন তো।” বললুম, “কয়েক লাখ তো বটেই।”
“তার মধ্যে একটা মস্ত অংশই আবার বাজারে ফিরে আসে। ফিরে আসা সম্ভব হয়, তার কারণ ওই অমু যা বলল, আমরা অত্যন্ত অসাবধান।”
“আমরা অসাবধান, হেলথ সেন্টারগুলো অসাবধান, হাসপাতাল অসাবধান, নার্সিং হোম অসাবধান।” অমু বলল, “আমরা ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করি, কিন্তু ব্যবহার করার পর বড় একটা সেগুলো ভেঙে ফেলি না। আমরা ভাঙি না, হেলথ সেন্টারগুলো ভাঙে না, হাসপাতাল ভাঙে না, নার্সিং হোম ভাঙে না। রোগীর বিছানার ধারে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে সেটাকে ফেলে দিয়েই আমাদের দায়িত্ব ফুরোয়। আমরা খবরও রাখি না যে, রোগীর ঘর থেকে সেগুলো রাস্তার ভ্যাটে চালান হয়। সেখান থেকে সেগুলো কুড়িয়ে নেয় ওই যাদের আমরা কাগজকুড়ুনি বলি, তারা। তাদের কাছ থেকে ওই ব্যবসায়ীরা সেগুলো জলের দরে কিনে নেয়। তারপর নতুন মোড়কে সেই ইউজড সিরিঞ্জগুলো আবার বাজারে এসে ঢোকে। ভিশাস সার্কল মানে বিষবৃত্ত বা পাপচক্র বলে একটা কথা আছে না? এই হচ্ছে সেই ভিশাস সার্কল।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমরা সাবধান হলেই কিন্তু এই সার্কলটা ভেঙে যাবে।”
অমু বলল, “কিরণমামা, আমরা ঠিক সেই কাজটাই করছি। লোকজনকে সাবধান করে দিচ্ছি। বিজ্ঞাপন দিয়ে, হোর্ডিং লাগিয়ে সবাইকে বলছি, যে-ছুঁচ আপনার শরীরে ঢুকছে, নামে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জের ছুঁচ হলেও আপনার আগে সেটা হয়তো কোনও হেপাটাইটিস-বি রোগীর শরীরে ঢোকানো হয়েছিল, কিংবা এমনকি কোনও এইডস-রোগীর শরীরে। বলছি, একবার ইউজ করার পরেই ওই ছুঁচটা ভেঙে ফেলুন। নইলে, ওটা যে ফের আপনারই কোনও প্রিয়জনের শরীরে ঢুকে মারাত্মক কোনও রোগ ছড়াবে না, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। প্রতিটি হাসপাতাল আর নার্সিং হোমের বাইরে এই হোর্ডিং লাগিয়েছি আমরা। যেমন রোগী, তেমনি ডাক্তার আর নার্সদেরও সতর্ক করে দিচ্ছি। ফলে, যারা ইউ সিরিঞ্জের কারবারি, তারা তো খেপে যাবেই। তারা লোক লাগিয়ে আমাদের হোর্ডিংগুলো তো ছিঁড়বেই। আমাদের বিজ্ঞাপন ছাপছে বলে তারা ফোন করে কাগজগুলোকে তো ভয় দেখাবেই।… আর হ্যাঁ, তারা জেনে গেছে যে, এই ক্যাম্পেনের মূলে আছি আমি। আর তাই আমার উপরে তারা হামলা তো করবেই।”
শিউরে উঠে বললুম, “তোমার উপরে হামলা হয়েছে?”
“একবার নয়, দু’বার।” অমু বলল, প্রথম বার… সে অ্যাবাউট আ উইক অর টেন ডেজ এগো…আপিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে পাথর ছুড়ে আমার গাড়ির কাচ ভেঙে দেয়। আর দ্বিতীয় হামলাটা গত মঙ্গলবার হয়েছে। এয়ারপোর্টে এক বন্ধুকে সি অফ করে রিজ-এর পথ ধরে রাজিন্দর নগরের দিকে যাচ্ছিলুম। রাত তখন এই ধরুন আটটা। একেবারে হঠাৎই বাঁ দিকের একটা গলি থেকে একটা ট্রাক আমার গাড়ির উপরে এসে পড়ে। গাড়িটা তুবড়ে গেলেও ভাগ্যবলে আমি বেঁচে যাই। ট্রাকটার নম্বর টুকে রেখেছিলুম। পথ-চলতি একটা অটো রিকশা নিয়ে কাছাকাছি একটা থানায় গিয়ে রিপোর্ট লেখাই। থানা থেকে পরদিন আমাকে জানানো হয়, ওই নম্বরের কোনও ট্রাক নেই। বাস, তাতেই যা বুঝবার তা বুঝে যাই আমি। সেইদিনই ফোন করি মামাবাবুকে। বলি, ইমিডিয়েটলি তিনি যেন দিল্লিতে চলে আসেন।”