৪
আজ ১২ মার্চ, রবিবার। রাত এখন আটটা। আজই সকালের ফ্লাইটে সদানন্দবাবুকে নিয়ে কলকাতা থেকে আমি দিল্লিতে এসেছি। উঠেছি ম্যাক্রো কনস্ট্রাকশন ইন্টারন্যাশনালের সফদরজঙ্গের এই গেস্ট হাউসে। ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে অমিতাভই এখানে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। এয়ারপোর্ট থেকে এখানে আমাদের নিয়ে আসার ব্যবস্থাও সে-ই করেছে। ভাদুড়িমশাই এখানে এসেছেন গতকাল। তিনিও এই গেস্ট হাউসেই আছেন। যেমন থাকা, তেমন খাওয়ার ব্যবস্থাও এখানেই। এক টুকরো লন ও ছোট্ট একফালি বাগান-সহ ছিমছাম গেস্ট হাউস। থাকার ব্যবস্থা পরিপাটি। ও বেলা এখানেই খেয়েছি। তাতে মনে হল, খাওয়ার ব্যবস্থাও খারাপ হবে না। কুকটি গোয়ানিজ।
কেন যে হঠাৎ দিল্লি আসতে হল, এবারে সেই কথাটা বলি। কথা ছিল, ব্যাঙ্গালোর থেকে ভাদুড়িমশাই খুব শিগগিরই আবার আসবেন। কিন্তু, কুরিয়ার সার্ভিসে ফের যে তাঁকে পাঁচশো টাকার দশখানা জাল-নোট পাঠানো হয়েছে, সদানন্দবাবুর কাছে এই খবর পাবার পর আমার মনে হয়, আর দেরি করা ঠিক হবে না, ব্যাপারটা যেরকম দ্রুত গড়াচ্ছে, তাতে একটা বিপদ ঘটে যাওয়া কিছু বিচিত্র নয়, তাই ভাদুড়িমশাইকে এক্ষুনি সব জানানো দরকার। বুধবার রাত্তিরেই তাই ব্যাঙ্গালোরে ফোন করি। ফোনে ভাদুড়িমশাইকে সব জানাবার পর তিনি বলেন, দু’চার দিনের মধ্যে ফের তাঁর কলকাতায় আসার কথা ছিল ঠিকই, কিন্তু আপাতত সেটা সম্ভব হচ্ছে না, একটা ফোর্জারি কেসে সাক্ষ্য দেবার জন্যে পরদিনই তাঁকে মুম্বই যেতে হচ্ছে। ‘আদালতের সমন মশাই, না গিয়ে উপায় নেই।’ বলেছিলুম,
জিজ্ঞেস বেশ তো, তা হলে মুম্বই থেকে কলকাতায় আসুন। কিন্তু তাও নাকি সম্ভব নয়। কেন নয়, করে জানা গেল, মুম্বই থেকে তাঁকে দিল্লি যেতে হবে। ‘অমিতাভ ডেকে পাঠিয়েছে। ফোন করেছিল, ডিটেলস বলল না, তবে মনে হল, ছেলেটা বিপদে পড়েছে। তো এক কাজ করুন মশাই, আপনারাই দিন কয়েকের জন্য দিল্লি চলে আসুন।’
এমনভাবে কথাটা বললেন, যেন দিল্লি যাওয়া কতই সোজা। নিজে সারাক্ষণ হিল্লি-দিল্লি করে বেড়াচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু আমরা তো তাঁর মতো মুক্তপুরুষ নই, সংসারী জীব, হাজার ঝামেলায় জড়িয়ে রয়েছি, হুট বললেই কি আমরা নোঙর তুলে ভেসে পড়তে পারি?
আশ্চর্য ব্যাপার, ভাদুড়িমশাইয়ের কথাটা সদানন্দবাবুকে বলতে তিনি দেখলুম তৎক্ষণাৎ রাজি। টেলিফোনে হুমকি আর ফের অতগুলো জাল নোট পাবার পরে বোধহয় কলকাতায় থাকতেই ভদ্রলোক ভয় পাচ্ছিলেন। তবে মুখে সে-কথা স্বীকার করলেন না। বললেন, “ভাদুড়িমশাই তো খারাপ কতা বলেননি। দরকার যখন আমার, তখন যেতে হবে বই কী। আর তা ছাড়া মার্চ মাসের দিল্লি তো শুনিচি চমৎকার জায়গা মশাই। ঠাণ্ডাও কেটে গেচে, আবার গরমও পড়েনি… চলুন, চলুন, দিন কয়েকের জন্যে ঘুরেই আসা যাক।”
ভাদুড়িমশাই পরদিন অর্থাৎ বেস্পতিবার রাত্তিরে মুম্বই থেকে ফোন করেছিলেন। তখনই তাঁকে জানিয়ে দিই যে, আমরা দিল্লি যাচ্ছি। রোববার সকালের ফ্লাইটে যাব, তবে কোথায় থাকব তা এখনও ঠিক করিনি। তাতে তিনি বলেন যে, থাকার জায়গা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে না, অমুকে ফোন করে তিনি জানিয়ে দেবেন যে, সে-ই যেন সব ব্যবস্থা করে রাখে। রোব্বার তো ছুটির দিন, তাই এয়ারপোর্টে আমাদের জন্যে গাড়ি নিয়ে যেতেও অমুর কোনও অসুবিধে হবে না।
ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের টিকিট পেতেও কোনও অসুবিধে হয়নি। ফ্লাইটও লেট ছিল না। আজ সকালে রাইট টাইমেই আমরা দিল্লি পৌঁছেছি।
কলকাতা ছাড়ার ব্যাপারে সদানন্দবাবুর একটা ছোট্ট অসুবিধে দেখা দিয়েছিল। পদ্ম নামের যে মেয়েটি তাঁদের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করত, সদানন্দবাবু প্রায়ই বলতেন যে, গত জন্মে অনেক পুণ্য করেছিলেন বলেই এ-জন্মে অমন কাজের মেয়ে পেয়েছেন। বাসন্তীকেও বলতে শুনেছি, অমন কাজের মেয়ে নাকি ভাগ্যে মেলে। তা সেই পদ্ম গত বেস্পতিবার থেকে আর কাজে আসেনি। এদিকে অন্য কোনও কাজের লোক না পাওয়ার ফলে সদানন্দবাবু বুঝতে পারছিলেন না যে, অসুস্থ স্ত্রীকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে কীভাবে তিনি দিল্লি যাবেন। শেষ পর্যন্ত বাসন্তী আশ্বাস দেয় যে, আমাদের বাড়ির কাজের মেয়েটিই আপাতত দু’বাড়ির কাজের সামাল দেবে।
গেস্ট হাউসের দোতলার দুটো ঘর আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একটায় ভাদুড়িমশাই আছেন। অন্যটায় থাকব আমি আর সদানন্দবাবু। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের দুজনকে এখানে ছেড়ে দিয়ে অমু তার গ্রেটার কৈলাসের ফ্ল্যাটে চলে যায়। যাবার আগে আমাদের বলে যায় যে, একটার মধ্যে আমরা যেন লাঞ্চ খেয়ে নিই, সে তার বাড়িতে দুপুরের খাওয়া চুকিয়ে মোটামুটি দুটোর মধ্যে আবার এখানে চলে আসবে। তা-ই এসেছিল। তখন অমু ও ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে আমাদের একটা ছোট্ট বৈঠকও হয়েছিল। অমুর আবার নতুন কী সমস্যা হল, তখনও তা আমরা জানি না। অমুকে তা-ই নিয়ে প্রশ্ন করতে সে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকায়। ভাদুড়িমশাই বলেন, “ওর কথা পরে হবে, আগে সদানন্দবাবুর কথাটা শুনি।” সদানন্দবাবু নিজে কিছু না-বলে আমার দিকে তাকান। তখন, গত রোব্বারে অরুণ সান্যালের কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে আমাদের সেই বৈঠকের পর থেকে যা-যা ঘটেছে, তার সবই আমি ভাদুড়িমশাইকে জানাই। পদ্মদাসীর কথাটাও বাদ দিই না। সেটা বলি ভাদুড়িমশাইকে এই কথাটা বোঝাতে যে, সদানন্দবাবুকে সত্যি খুব অসুবিধের মধ্যে কলকাতা ছেড়ে দিল্লি আসতে হয়েছে।
ভাদুড়িমশাইকে কিন্তু টেলিফোনে হুমকি দিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসে ফের জাল নোট আসার ব্যাপারটা নিয়ে ততটা ভাবিত হতে দেখলুম না, যতটা ভাবিত মনে হল পদ্মদাসীকে নিয়ে। ‘লাশ ফেলে’ দেবার হুমকির কথাটা আমি ফের তুলতে গিয়েছিলুম, কিন্তু ভাদুড়িমশাই তাঁর হাতের ইঙ্গিতে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “দাঁড়ান মশাই, আগে এই কাজের মেয়েটির ব্যাপারটা একটু বুঝে নিই। ও কি এর মধ্যে আর কাজে ফেরেনি?”
“না।” সদানন্দবাবু বললেন, “ও আমাদের বাড়িতে শেষ বারের মতো কাজে এসেছিল গত বুধবার। কাজ সেরে সন্ধের সময় বাড়ি ফিরে যায়। বেস্পতিবার সকাল থেকে অ্যাবসেন্ট। বেস্পতি, শুক্কুর, শনি, পরপর তিন দিন আসেনি। রোব্বার, মানে আজকের কতা বলতে পারব না। তার কারণ, সকালের ফ্লাইট ধরব বলে আজ একেবারে ভোরবেলায় আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়িচি।”
ভাদুড়িমশাই তার পকেট থেকে সেল-ফোনটা বার করলেন। সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিরণবাবুর বাড়িতে ফোন করে আপনাদের পৌঁছ-সংবাদটা দিয়ে দিচ্ছি। সেইসঙ্গে আপনাদের কাজের মেয়েটি আজ এসেছে কি না, তাও জেনে নেওয়া যাবে।”
ফোনের একতরফা কথাবার্তা যা শোনা গেল, তা এইরকম।
“… কে, বাসন্তী?… আমি ভাদুড়িদা।… হ্যাঁ, ওঁরা ঠিক সময়েই পৌঁছে গেছেন, প্লেন লেট করেনি। এখন একটা খবর দাও তো, সদানন্দবাবুদের বাড়িতে যে-মেয়েটি কাজ করে, সে কি আজও আসেনি?…ঠিক আছে। ওঁদের জন্যে ভেবো না, ওঁরা ভালই আছেন, কাজ মিটলেই ফিরে যাবেন। তোমরা ভাল থেকো।”
কথা শেষ করে সেল-ফোনটা আবার পকেটে পুরলেন ভাদুড়িমশাই। তারপরে ফের সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাদের কাজের মেয়েটির নাম যেন কী?… ও হ্যাঁ, পদ্ম। ইয়ে, পদ্ম আজও কাজে আসেনি।”
এই পর্যন্ত বলে একটুক্ষণের জন্য চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। একটা সিগারেট ধরালেন। নিঃশব্দে সেটা টানলেন কিছুক্ষণ। তারপর আধ-খাওয়া সিগারেটটাকে অ্যাশট্রেতে পিষে দিয়ে বললেন, “আপনাকে একটা প্রশ্ন করি সদানন্দবাবু। চাঁদনি স্টেশনে আপনার পকেটে যে পাঁচশো টাকার নোটটা গুঁজে দেওয়া হয়েছিল, সেটা যে জাল নোট, তা আপনি প্রথম কখন জানলেন?”
“প্রথম তো আপনার কাছেই জানলুম।” সদানন্দবাবু বললেন, “ওই মানে গত রোব্বার অরুণবাবুদের বাড়িতে অমুর কাছে সেই ফোনটা আসার পরে যখন নোটটা আপনাকে দেখতে দিলুম আর আপনি সেটা দেখে বললেন যে, জাল, সেই তখন।”
“ঠিক আছে। কিন্তু এটা তো মানবেন যে, বড়-রকমের কোনও কেনাকাটার দরকার না-থাকলে সব সময়ে… আই মিন নর্মালি আমরা পকেটে পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে ঘুরে বেড়াই না। … কী, ভুল বললুম?”
“না, না, ভুল বলবেন কেন,” সদানন্দবাবু বললেন, “আপনি ঠিক কথাই বলেচেন। তবে কিনা সত্যি সেদিন পকেটে পাঁচশো টাকার নোট নিয়েই আমি বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলুম।”
“সেদিন মানে কবে?”
“অরুণবাবুদের বাড়িতে যেদিন যাই, তার আগের দিন। সেদিন তো শনিবার ছিল, তা-ই না?”
“হ্যাঁ, শনিবার। চৌঠা মার্চ।”
“গোটা কয়েক জিনিস কেনার দরকার ছিল বলে সেদিন আমি চাঁদনি মার্কেটে যাই। তার আগের দিন ব্যাঙ্কে গিয়ে আমার পেনশনের টাকা তুলি। ব্যাঙ্ক থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা বান্ডিল দিয়েছিল, সেইসঙ্গে খানকয় পাঁচশো টাকার নোট। চাঁদনিতে যাবার সময় খুচরো কিছু টাকাপয়সার সঙ্গে খানকয় পঞ্চাশ টাকার নোট আর একটা পাঁচশো টাকার নোটও আমি পকেটে ঢুকিয়ে নিয়েছিলুম। ভেবেছিলুম, জিনিসপত্তরের দাম মেটাবার সময় ওই বড় নোটখানা ভাঙিয়ে নেব।”
এই পর্যন্ত শুনে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা তো হল, কিন্তু সদানন্দবাবু, আপনি শেয়ালদা-পাড়ায় থাকেন, সেখান থেকে চাঁদনি মার্কেটের ডিসট্যান্স তো তেমন কিছু নয়, বাসে-ট্রামে কি ট্র্যাক্সিতে গেলে চটপট পৌঁছে যেতে পারতেন। তা হলে অতটা পথ উজিয়ে মহাত্মা গান্ধী রোড স্টেশনে গিয়ে আপনার পাতাল-রেলে উঠবার দরকার হল কেন?
“পকেটে টাকা রয়েচে বলে ভিড়ভাট্টার সময়ে আমি বাসে-ট্রামে উঠিনি। আর ট্যাক্সিতে আমি পারতপক্ষে উঠি না, ভাড়ার হিসেব নিয়ে বড্ড গণ্ডগোল হয়। ড্রাইভার যে হিসেব দেয়, সেটা আমার মাথায় ঢোকে না। তাই ট্যাক্সি আমি সব সময়ে অ্যাভয়েড করি।”
“সো ফার সো গুড।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “মাইলখানেক হেঁটে গিয়ে মেট্রো ধরার কারণটা বোঝা গেল। এখন বলুন, চাঁদনিতে জিনিসপত্র কিনে আপনার পাঁচশো টাকার নোটখানা ভাঙাতে পেরেছিলেন?”
“না মশাই, পারিনি।” সদানন্দবাবু বললেন, “জিনিসপত্তর কিনেছিলুম মোট সাড়ে তিনশো টাকার শুধু এক ছিট-কাপড় ছাড়া বাদবাকি সবকিছু একই দোকান থেকে কিনেছিলুম। কিন্তু পাঁচশো টাকার নোটখানা এগিয়ে দিতে দোকানি লোকটি বেজার হয়ে বলে, সবে দোকান খুলেছে, ক্যাশবাক্স ফাঁকা, ব্যালান্স ফেরত দেবার উপায় নেই। অগত্যা কী আর করি, পকেট থেকে সাতখানা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে তার পাওনা মেটাই।”
“আর ওই পাঁচশো টাকার নোটখানা আপনার পকেটেই থেকে যায়।”
“হ্যাঁ, থেকে যায়।”
ভাদুড়িমশাই আবার হাসলেন। বললেন, “পেনশনের টাকা তুলতে গিয়ে ওটা আপনি ব্যাঙ্ক থেকে পেয়েছিলেন। সুতরাং ধরেই নিতে পারেন যে, ওটা জেনুইন নোট। তা হলে তো একখানা নয়, দুখানা পাঁচশো টাকার নোট নিয়ে আপনার বাড়ি ফেরার কথা।”
“তার মানে?”
“তার মানে তো অতি সহজ। জেনুইন একখানা পাঁচশো টাকার নোট আপনার পকেটেই ছিল। প্লাস ফিরতি পথে চাঁদনি স্টেশনে আছাড় খাওয়ার ফলে আপনার জিনিসপত্র আর টাকাপয়সা যখন প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে যায়, তখন সেগুলো গুছিয়ে তুলে দেবার সময় পাঁচশো টাকার আর-একখানা নোট—জাল নোট–ঢুকিয়ে দেওয়া হয় আপনার পকেটে। কী, দুখানা নোট হল না?”
“তা হল। কিন্তু বাড়ি ফিরে পাঞ্জাবি খুলে তার পকেট থেকে টাকাকড়ি বার করতে গিয়ে তো দেখলুম যে… দেখলুম যে…”
“দুখানা নয়, পাঁচশো টাকার মাত্তর একখানা নোটই আপনার পকেটে রয়েছে, কেমন?” সদানন্দবাবু মুখ দেখে মনে হল, তিনি একটা জটিল ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছেন। বললেন, “ঠিক তা-ই। এটা কী করে হল?”
“খুব সহজেই হল।” মুখের হাসিটা ধরে রেখে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি ভাবছেন পাঁচশো টাকার একখানা নোট নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, আবার ফিরেও এসেছেন একখানা নোট নিয়ে, তা হলে এর মধ্যে গণ্ডগোলটা কোথায়। গণ্ডগোলটা এইখানে যে, যে-নোট নিয়ে বেরিয়েছিলেন, সে-নোট নিয়ে ফেরেননি।”
“অ্যাঁ?”
“হ্যাঁ। আপনার সেই চাঁদনি স্টেশনের বন্ধুটি যা করেছে, সে অতি পাকা হাতের কাজ, মশাই। সে একই সঙ্গে দু’দুটি কাজ করেছে। যেমন সে আপনার পকেটে একটি জাল নোট ঢুকিয়েছে, তেমনি আবার প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে যাওয়া পয়সাকড়ির ভিতর থেকে চোখের পলকে সরিয়েছে আপনার পাঁচশো টাকার জেনুইন নোটখানা।”
“আর আমি কিনা সেই জাল নোটখানাকেই আমার আসল নোট ভেবে পকেটে করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম। আরে ছিছি, আপনি বলে না-দিলে তো ওটাকে জাল বলে চিনতেই পারতুম না।”
এতক্ষণ তো হাসতে-হাসতে কথা বলছিলেন ভাদুড়িমশাই। এবারে, একেবারে হঠাৎই, হাসিটা তাঁর মুখ থেকে মিলিয়ে গেল। সরু চোখে সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি বলে দেবার আগে পর্যন্ত আপনি জানতেন না যে, ওটা জাল? সদানন্দবাবু, প্লিজ ডোন্ট সাপ্রেস দ্য ট্রুথ। সত্যি কথাটা বলে ফেলুন। আপনার কোনও ধারণাই নেই যে, কারা আপনাকে নিয়ে খেলছে। মিথ্যে বললে বিপদ আরও বেড়েই যাবে, কেউ আপনাকে বাঁচাতে পারবে না!”
ভাদুড়িমশাইয়ের চাউনিতে কী ছিল জানি না, কিন্তু সদানন্দবাবু যেন নিমেষে কুঁকড়ে গেলেন। আমতা-আমতা করে বললেন, “আপনি বলে দেবার আগে, শনিবার বিকেলেই জানতে পেরেছিলুম।”
“কী করে জানলেন? কোথাও চালাতে গিয়েছিলেন?”
“আজ্ঞে আমি যাইনি।”
“তা হলে?”
“আমার ওয়াইফের গোটাকয় ওষুধ কেনবার ছিল। প্রেসক্রিপশান আর ওই পাঁচশো টাকার নোটটা দিয়ে শনিবার বিকেলে পদ্মকে আমাদের পাড়ার ওষুধের দোকানে পাঠাই। সত্যি বলছি, ওটা যে জাল-নোট, তা আমি তখনও পর্যন্ত জানতুম না। জানলুম পদ্ম ফিরে আসার পর। ফিরে এসে ও বলল, এ-নোট জাল, দোকানি ফিরিয়ে দিয়েছে।”
গেস্ট হাউসে ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে বসে কথা হচ্ছিল। ঘরের এক দিকে দেওয়াল ঘেঁষে একটা রাইটিং টেবিল। চেয়ার থেকে উঠে ভাদুড়িমশাই তার টানা খুলে একটা কাগজ বার করে আনলেন। তারপর কাগজখানা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “কলকাতার কাগজ এখানে দেরি করে আসে জানেন তো? একটু আগে এই বাংলা কাগজখানা দিয়ে গেছে। তিনের পাতায় একটা খবর দাগ দিয়ে রেখেছি। পড়ে দেখুন।”
পাঁচ-সাত লাইনের ছোট্ট খবরটা এইরকম :
“স্টাফ রিপোর্টার, ১১ মার্চ—সায়েন্স সিটির কাছে, মেট্রোপলিটান বাইপাসের ধারে আজ রাত্রে একটি যুবতীর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়। যুবতীর বয়স আনুমানিক ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ, রং ময়লা, বাঁ হাতের কবজিতে উলকিতে প্রজাপতি আঁকা। গলায় দাগ দেখে পুলিশের সন্দেহ, রাত্রেই গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করে তাকে রাস্তার ধারে ফেলে রাখা হয়েছে।”
খবরটা পড়ে শোনাতে সদানন্দবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “বাঁ হাতের কবজিতে প্রজাপতি আঁকা! সর্বনাশ, ও তো নির্ঘাত পদ্ম। ট্যাংরার ওদিক থেকেই তো আসত। কে মারল তাকে!
প্রশ্ন নয়, নেহাতই স্বগতোক্তি। সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই তবু বললেন, “আপনার কী মনে হয়? মেয়েটার সম্পর্কে কিছু জানেন?”
“খুব অল্পই জানি।” সদানন্দবাবু বললেন, “যেটুকু জানি, তাও আবার আমার ওয়াইফের কাছে শোনা।”
“কী শুনেছেন?”
“শুনিচি যে মেয়েটা আসলে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ক্যানিংয়ের ওদিককার এক গাঁয়ের চাষিবউ। ছেলেপুলে নেই, স্বামী নেয় না, পেটের জ্বালায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। ট্যাংরার একটা বস্তিতে থাকত। থাকার জায়গাটা নাকি এক রাজমিস্তিরি জুটিয়ে দিয়েছিল। তা ওখান থেকেই রোজ কাজ করতে আসত।”
আমি বললুম, “কে ওকে মারতে পারে?”
“সেটাই তো প্রশ্ন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “জাল পাতলেই যারা ধরা দেয়, তাদের মারা তো মোটেই শক্ত নয়।”
“কীসের জাল?”
“লোভের জাল। নতুন করে সংসার পাতার লোভ, গয়নাগাটির লোভ, শরীরের খিদে মেটাবার লোভ, টাকার লোভ। তবে আমি ভাবছি অন্য কথা। জালটা যারা পেতেছে, এই একটা খুন করেই তারা থেমে থাকবে কি না।”