২
আজ ৬ মার্চ, সোমবার ২০০৩ সাল। রাত দশটা বাজে। আপিস থেকে পাঁচটায় বেরিয়ে পাবলিশারের কাছে গিয়েছিলুম। সেখান থেকে সাতটায় বাড়ি ফিরে, একটা লেখার খানিকটা অংশ বাকি ছিল, সেটা শেষ করি। তারপর কয়েকটা চিঠির জবাব লিখতে বসে যাই। সে-সব মিটিয়ে খাওয়া চুকিয়ে ফের ড্রয়িং রুমে এসে বসেছি। ভাবছি গতকালের কথা।
ভাদুড়িমশাই এ-যাত্রায় মাত্র তিন দিনের জন্যে ব্যাঙ্গালোর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। শুক্র, শনি আর রবি, এই তিনটে দিন এখানে কাটিয়ে আজ রাত্তির সাতটা পঁয়তাল্লিশের ফ্লাইটে আবার ব্যাঙ্গালোরে ফিরে গেলেন। এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করে বললেন, দিন কয়েক পরে হয়তো আবার তাঁকে কলকাতায় আসতে হবে। কেন আসতে হবে, তা অবশ্য জানালেন না। মনে হচ্ছে, সি.বি. আই. অর্থাৎ চারু ভাদুড়ি ইনভেস্টিগেশানসের কলকাতা আপিসের কোনও কাজে।
অমুও আজ সকালের ফ্লাইটে দিল্লি চলে গেল। অমু কাজ করে তাদের কোম্পানির হেড-আপিসে। দিল্লির কনট সার্কাস থেকে বারাখাম্বা রোড ধরে বেঙ্গলি মার্কেটের দিকে বেশ খানিকটা এগোলে দেখা যাবে যে, সাপ্রু হাউসের কাছে মোটামুটি চওড়া একটা রাস্তা বাঁ দিকে বেরিয়ে গেছে। এই রাস্তার উপরেই অমুদের ম্যাক্রো কনস্ট্রাকশান ইন্টারন্যাশনালের হেড-আপিস। মস্ত লন আর বিশাল কম্পাউন্ড-ওয়ালা হাল-ফ্যাশানের তিনতলা বাড়ি। হঠাৎ দেখলে ধনী ব্যবসায়ীর বসতবাড়ি বলে ভ্রম হয়, আপিস-বাড়ি বলে বোঝা যায় না।
মাঝেমধ্যে আমাকে দিল্লি যেতে হয়। গেলে সাধারণত হেলি রোডের বঙ্গভবনে উঠি। সেখান থেকে অমুদের আপিস খুব কাছেই। হাতে সময় থাকায় গত জানুয়ারি মাসে একবার সেখানে গিয়ে অমুর সঙ্গে দেখাও করে এসেছিলুম। কোম্পানি থেকে ওর থাকার জন্যে যে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে, গ্রেটার কৈলাসের সেই ফ্ল্যাটে অবশ্য এখনও আমার যাওয়া হয়নি।
কালকের আড্ডার কথা যতই ভাবছি, ততই মনে পড়ছে অমুর কথা, আর ততই আমার ধাঁধা লেগে যাচ্ছে। এমন যে হয়, এমন যে হতে পারে, এ তো ভাবাই যায় না। কালীচরণকে একটা খিল-আঁটা ঘরের মধ্যে রাত বারোটায় দেখতে পাওয়ার ব্যাপারটাকে না হয় হ্যালুসিনেশন বলে মেনে নেওয়া গেল, আর ওই মেডিটেশানের সাহায্যে মননশক্তি বাড়িয়ে নেওয়ারও একটা ব্যাখ্যা হয়তো থাকাই সম্ভব, কিন্তু আমরা খেতে বসার ঠিক আগের মুহূর্তে অমুর সেল-ফোনে ওই যে একটা খবর এল, ওর কী ব্যাখ্যা? যে-ই খবর দিক, সে জানল কী করে যে, সদানন্দবাবুর পাঞ্জাবির পকেটে সত্যিই একটা পাঁচশো টাকার নোট রয়েছে, আর সেই নোটটা জাল?
কালীচরণ আবার এইভাবে অমুর জীবনে ফিরেই বা এল কেন? অমুর কথা যতটুকু যা জানি, তাতে অবশ্য এটা মানতে হবে যে, ছেলেটার কোনও অনিষ্ট সে আজ পর্যন্ত করেনি। বরং অমুই তার ক্ষতি করেছিল। মোম্বাসার একটা রেস্তোরাঁয় জনাকয় বন্ধুর সঙ্গে বসে অমু যখন কফি খাচ্ছিল, তখনই সে কালীচরণকে প্রথম দেখতে পায়। মিশকালো রোগা ঢ্যাঙা লোকটা তখন সেই রেস্তোরাঁর আর-এক দিকে বসে জানকয় শ্বেতাঙ্গ টেলি-ফিল্মওয়ালার হাত দেখে তাদের ভবিষ্যৎ বলে দিচ্ছিল। অমুর মনে হয়েছিল, লোকটা ঠগ, ফরচুন টেলিংয়ের ভাঁওতা মেরে বিদেশিদের ঠকাচ্ছে। নিচু গলায় কথাটা সে বলেওছিল। কিন্তু অনেক দূরে বসেও লোকটা সে-কথা শুনতে পেয়ে যায়। অমুদের টেবিলের সামনে এসে সে বলে, অমু তার ক্ষতি করছে বটে, কিন্তু তাই বলে অমুর কোনও ক্ষতি করার ইচ্ছে তার নেই। তবে হ্যাঁ,অমুকে সে আর মোম্বাসায় থাকতে দেবে না। আশ্চর্য ব্যাপার, তার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই অমুর আপিস তাকে মোম্বাসা থেকে ভারতে ফিরিয়ে নেয়।
না, সে অমুর কোনও ক্ষতি করেনি। অমু তো সত্যিই দেশে ফিরতে চাইছিল। কিন্তু একইসঙ্গে একটা অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে থাকে তার মনে। তার ধারণা হয়, এই লোকটা, কালীচরণ, যেন আড়ালে বসে রিমোট কন্ট্রোলে নিয়ন্ত্রণ করছে তার জীবন। পরে এমন আরও কয়েকটা ঘটনা ঘটে, যাতে তার এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়।
কিন্তু সে তো আজকের কথা নয়, বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। মাঝখানে চার-চারটে বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে অমু বিয়ে করেছে, একটি ছেলেও হয়েছে তার। সেই ছেলের বয়স এখন তিন বছর। ছেলের নাম শুনলুম অরুণাভ, ডাকনাম রুনু। গত জানুয়ারি মাসে যখন দিল্লিতে যাই, তখন গ্রেটার কৈলাসে যাওয়া হয়নি বলে রুনুকে আমার দেখাও হয়নি। তাকে নাকি এরই মধ্যে কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে। তিন বছরের একটা বাচ্চা কিনা ইস্কুলে যায়। এ তো আমরা ভাবতেও পারতুম না। পাঁচ বছর পূর্ণ হবার আগে তো হাতেখড়িই হত না আমাদের। তার আগেই ইস্কুল? বাবা রে, ভাগ্যিস, এ-কালে জন্মাইনি।
তো যা বলছিলুম। বউ-বাচ্চা নিয়ে অমিতাভ বেশ ভালই আছে। ভাল কোম্পানি, ভাল চাকরি, ভাল ফ্ল্যাট, তার উপর দিল্লি জায়গাটাও যা বুঝলুম তার ভালই লেগে গেছে। অমুর কথায় “দিল্লি আমাদের বেশ সুট করে গেছে, কিরণমামা।”
তার মানে এ-ছেলে আর কলকাতায় ফিরবে না, আস্তে-আস্তে বাংলার বাইরেই শিকড় গেড়ে বসে যাবে। তা বসুক, ওর দাদা সিদ্ধার্থ তো কানাডার মন্ট্রিয়লে চাকরি করতে গিয়ে সেইখানেই সংসার পেতেছে, অমুও সেইরকম মরিশাস কি মেক্সিকোতে পাড়ি জমাতেই পারত, তার বদলে দেশেই যে থেকে গেছে, এই রক্ষে। হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে, বাংলায় কথা বলার লোক ছিল না বলে মোম্বাসায় অমুর মন টেকেনি। কিন্তু দিল্লিতে সেই সমস্যা থাকার কথা নয়। ওর আপিসে কি আর দু’চার জন বাঙালি সহকর্মী নেই। তা ছাড়া, যে-এলাকায় ফ্ল্যাট পেয়েছে, সেই গ্রেটার কৈলাসে বাঙালি নেহাত কম থাকে না। তার উপরে আবার পাশেই চিত্তরঞ্জন পার্ক, সে তো বলতে গেলে বাঙালি -পাড়া। অমু অতএব সুখেই আছে।
এর মধ্যে একমাত্র অস্বস্তির কাঁটা ওই কালীচরণ। কী চায় সে? পঁচানব্বইয়ের অক্টোবরের পর থেকে তো আর তার দেখা মেলেনি। হঠাৎ সে আবার অমুর জীবনে এসে দেখা দিল কেন? সদানন্দবাবুর পকেটে যে একটা পাঁচশো টাকার জাল নোট রয়েছে, তা তো আমরা কেউই জানতুম না। সে কী করে জানল? আর যদি জানল, অমুকেই বা জানাতে গেল কেন? সে যে আশ্চর্য রকমের শক্তি ধরে, স্রেফ অমুকে এই কথাটা আবার নতুন করে টের পাইয়ে দেবার জন্যে? নাকি, অমুকে দিয়ে সে এমন কোনও কাজ করিয়ে নিতে চায়, এত শক্তিমান হওয়া সত্ত্বেও যা সে নিজে করে উঠতে পারছে না?
জাল-নোটের ব্যাপারটা বড্ড ভাবিয়ে তুলেছে। কাগজে তো এ নিয়ে ইতিমধ্যে খবর কিছু কম বেরোয়নি। তা থেকে বুঝতে পারি, জাল-নোটের জালটা মোটেই ছোট নয়, দেশের নানান জায়গায় এটা ছড়িয়ে পড়েছে। আজ যদি এখান থেকে জাল পাঁচশো টাকার নোটের খবর আসছে তো কাল আসছে ওখান থেকে। ফলে পাঁচশো টাকার নোট সম্পর্কেই জন্মে গেছে একটা ভয়। পারতপক্ষে কেউ পাঁচশো টাকার নোট নিতে চাইছে না। আমি নিজেই তো আজ ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলুম। পেট্রোল কিনে দাম মেটাতে গিয়ে একটা পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে দিয়েছি পাম্পের লোকটি বলল, “পাঁচশো টাকা ছাড়া নেই স্যার?” বললুম, “কেন, তুমি ভাঙিয়ে দিতে পারবে না?” তাতে সে একটু ইতস্তত করে বলল, “আজকের মতো পারব, কিন্তু কাল থেকে হয়তো নাও পারতে পারি, মালিকের নিষেধ আছে।”
জাল শুধু পাঁচশো টাকার নোটের কেন, পাঁচ দশ কুড়ি পঞ্চাশ আর একশো টাকার নোটেরও হয়, কিন্তু তা নিয়ে কখনও এত আতঙ্ক ছড়াতে দেখিনি। অঙ্ক বড় বলেই আতঙ্কও বেশি। আতঙ্ক কাটাবার জন্যে টিভিতে বারবার বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হচ্ছে, কোনটা খাঁটি আর কোনটা জাল, সেটা কীভাবে বুঝতে হবে। সদানন্দবাবু কি সেই বিজ্ঞাপন দেখেননি? যদি দেখে থাকেন তো কে তাঁকে এইভাবে একটা জাল নোট গছিয়ে দিয়ে যেতে পারল?
সদানন্দবাবুকে কালই এই প্রশ্নটা করেছিলুম। উত্তরে তিনি যা বললেন, সেও কিছু কম রহস্যজনক নয়। ঘটনাটা এই রকম :
পরশু অর্থাৎ গত শনিবার চৌঠা মার্চ তাঁকে একবার ধর্মতলার চাঁদনি মার্কেটে যেতে হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল বাথরুমের দরজার জন্য তিনটে পেতলের কব্জা, দেড় ডজন স্ক্রু, একটা স্ক্রু-ড্রাইভার, একটা মর্টিস লক, দুটো ছিটকিনি ও কিছু ছিট-কাপড় কিনবেন। মধ্য-কলকাতার যে গলিতে আমরা থাকি, সেই পীতাম্বর চৌধুরি লেনের পশ্চিম দিকে মহাত্মা গান্ধী রোড, আর পুব দিকের মুখটা মিশেছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রোডে। এই দুটো বড় রাস্তার যে-কোনও একটা থেকে বাসে উঠে খুব সহজেই সদানন্দবাবু ধর্মতলায় চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে তিনি চিত্তরঞ্জন অ্যাভেন্যুর মোড় পর্যন্ত চলে যান। তারপর ডাইনে বেঁকে দু’পা এগিয়ে মেট্রো স্টেশনে ঢুকে পাতাল রেলে ওঠেন। চাঁদনি স্টেশনে পৌঁছন দশটা নাগাদ। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ম্যাডান স্ট্রিট ধরে খানিকটা গিয়ে বাঁয়ে মোড় ফিরে ঢোকেন মার্কেটে। দরদাম করে কেনাকাটা সারতে সারতে বারোটা বেজে যায়। মার্কেট থেকে ফের চাঁদনি স্টেশনে ফিরতে-ফিরতে সওয়া বারোটা। টিকিট-কাউন্টারের সামনে কিউয়ে দাঁড়িয়ে পিছনের লোকটিকে বলতে শোনেন যে, উত্তর দিকে যাবার ট্রেন আসতে আর দেরি নেই, মিনিট খানেকের মধ্যেই এসে পড়বে। টিকিট কেটে সদানন্দবাবু তাই আর কোনও দিকে দৃকপাত করেননি, তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি বেয়ে প্ল্যাটফর্মে নামতে যান। আর তাতেই ঘটে বিপদ।
“সিঁড়ির শেষ ধাপ পর্যন্ত ঠিকই নেমেছিলুম। কিন্তু শেষরক্ষে হল না মশাই। কোঁচার খুটে পা জড়িয়ে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের উপরে একেবারে হাত-পা ছড়িয়ে আছাড় খেয়ে পড়লুম।”
অরুণ সান্যালদের বাড়িতে খাবার টেবিলে বসে কথা হচ্ছিল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “তারপর?”
“তারপর যা হয় আর কি। সবাই ছুটে এল। হাতের ব্যাগের জিনিসপত্তর আর পকেটের টাকাপয়সা তো ছত্রখান হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। তারাই সেগুলো ফের গোছগাছ করে তুলে দেয়।”
“ট্রেনও তক্ষুনি এসে পড়ে?”
সদানন্দবাবু বললেন, “কোতায়। গাড়ি এল আরও মিনিট দশেক বাদে।”
“অথচ কাউন্টারের কিউয়ে আপনার পিছনের লোকটি বলেছিল মিনিট খানেকের মধ্যেই এসে পড়বে, তা-ই না?
“বিলক্ষণ। তা নইলে আর অত তাড়াহুড়ো করতে যাব কেন। ঘোর ইরেসপনসিবল লোক, মশাই!…তবে হ্যাঁ, ইরেসপনসিবল হলেও নট এ ব্যাড ম্যান।”
“কী করে জানলেন?”
“বাঃ, জানব না? সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়েও আমার ঠিক পিছনেই ছিল তো, পড়ে যেতে ও-ই ছুটে এসে আমার হাত ধরে ফের দাঁড় করিয়ে দেয়। জিনিসপত্তর আর পয়সাকড়িও তো ও-ই কুড়িয়ে এনে তুলে দেয় আমার ব্যাগে আর পকেটে।”
“ফের যদি লোকটাকে কোথাও দেখেন তো চিনতে পারবেন?”
“তা কেন পারব না?” সদানন্দবাবু বললেন, “মাঝারি হাইট, শ্যামলা রং, চোখে চশমা, রোগাও নয়, মোটাও নয়, দোহারা চেহারা, আজকালকার ছেলেরা যেমন রাকে, সেই রকমের গোঁফ-দাড়ি, পরনে পায়জামা আর পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা, পায়ে চপ্পল… ও মশাই ঠিক চিনতে পারব।”
ভাদুড়িমশাইয়ের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। দইয়ের বার্টিটা টেনে নিয়ে বললেন, “আপনি বলছেন বটে চিনতে পারবেন, কিন্তু আমার ধারণা, মোটেই চিনতে পারবেন না।”
“কেন, কেন?”
“বলছি। হাইট আর গায়ের রং অবশ্য পালটাতে পারবে না। তবে এর পরে যেদিন ওকে দেখবেন, সেদিন ওর চোখে সম্ভবত চশমা থাকবে না, পায়জামা পাঞ্জাবি আর চপ্পলের বদলে পরনে থাকবে প্যান্ট শার্ট আর শ্য, আর হ্যাঁ, গোঁফদড়ি যদি নকল হয় তো কথাই নেই, আর যদি জেনুইন হয় তো কামিয়ে ফেলবে। তা হলে আর চিনবেন কী করে?”
সদানন্দবাবু ধাঁধায় পড়ে গেলেন। পাশ থেকে জলের গেলাশটা তুলে নিয়ে এক ঢোক জল খেয়ে বললেন, “তাই তো, কী করে চিনব?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কোনও ডিস্টিংগুইশিং মার্ক নেই?”
“সেটা আবার কী?”
“এমন কোনও চিহ্ন, যা মুছে ফেলা যায় না।”
একটুক্ষণ চিন্তা করে নিলেন সদানন্দবাবু। তারপর বললেন, “মনে পড়েছে। কপালে একটা কাটা দাগ।”
কাল দুপুরে খাওয়ার পর্ব শেষ হবার পরে আরও প্রায় ঘন্টাখানেক আমরা ও-বাড়িতে কাটাই। তারপর সদানন্দবাবুকে নিয়ে আমি চলে আসি। চলে আসার সময়ে চাঁদনি স্টেশনের লোকটা সম্পর্কে আরও দু-একটা কথা হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রসঙ্গে আসার আগে বরং সদানন্দবাবু সম্পর্কে কিছু জরুরি কথা জানিয়ে রাখি।
সদানন্দবাবু হাসিখুশি মানুষ। উপকারী প্রতিবেশী। তাঁর মুখে প্রায় সব সময়েই একটু হাসির ছোঁয়া লেগে থাকে। তিনি নিয়ম করে রোজ ভোরবেলায় হাঁটতে-হাঁটতে গোলদিঘিতে যান ও দিঘিটিকে ঘিরে গুনে-গুনে ন’টি পাক মেরে বাড়ি ফেরেন। ছেলেবেলায় কেউ তাঁকে বলেছিল যে, গোলদিঘিতে তিনটে পাক মারলে এক মাইল হাঁটা হয়। সদানন্দবাবুর বিশ্বাস, ভোরবেলায় রোজ তিন মাইল হাঁটাই হচ্ছে স্বাস্থ্যরক্ষার সেরা উপায়। ফলে তিনি ন’টি পাক মারেন। সদানন্দবাবুর সন্তানাদি হয়নি। বাড়ির লোক বলতে তিনি, তাঁর স্ত্রী কুসুমবালা ও পালিত কন্যা কমলি। জেঙ্কিস অ্যান্ড জেঙ্কিন্স কোম্পানির শিপিং ডিপার্টমেন্টের চাকরি থেকে যথাসময়ে রিটায়ার করেছেন। পেনশনের টাকা মাসে-মাসে তাঁর ব্যাঙ্ক-আকাউন্টে জমা পড়ে ও তাতেই তাঁর সংসার-খর্চা দিব্যি চলে যায়। উপরন্তু বাড়িটি নিজের, পৈতৃক সম্পত্তিও কম পাননি, ফলে তাঁকে বেশ সচ্ছল ও সুখী মানুষই বলা যায়।
ইদানীং অবশ্য সচ্ছল বললেও সুখী বলা যাচ্ছে না। গত কয়েক দিন ধরেই দেখছি যে, ভদ্রলোকের ভুরু প্রায় সব সময়েই একটু কুঁচকে থাকে। মুখের হাসি উধাও। মনে হচ্ছিল কোনও একটা ব্যাপার নিয়ে ভদ্রলোক একটু চিন্তায় পড়ে গেছেন। আমার স্ত্রী বাসন্তী মাঝে-মাঝেই ও-বাড়ি যায়। তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে, ব্যাপার নেহাত একটা নয়, তিনটে। প্রথম ব্যাপার, কুসুমবালার বাতব্যাধির প্রকোপ হালে হঠাৎ বেড়ে গেছে। দ্বিতীয় ব্যাপার, দিন তিনেক আগে জানালা দিয়ে হঠাৎ কুসুমবালার ঘরে একটা ঢিল এসে পড়ে। ঢিলের সঙ্গে সুতো দিয়ে বাঁধা একটা চিঠিও ছিল। চিঠিতে লেখা : ‘প্রানেস্বরি, তোমাকে না পেলে বিস খাইব। ইতি জগো।’ চিঠিখানি যার উদ্দেশে লেখা, সেই প্রাণেশ্বরী যে কে, কুসুমবালা তা বুঝতে পারেননি। ব্যাপারটা তিনি সদানন্দবাবুকে জানান। চিঠি পড়ে সদানন্দবাবু বলেন, ‘ইয়ে, তুমিই প্রাণেশ্বরী নও তো?’ কুসুমবালা তাতে খেপে গিয়ে তাঁর স্বামীকে প্রথম দফায় ‘ইতর’ ও ‘ছোটলোক’ বলেছেন, অতঃপর দ্বিতীয় দফায় স্বামীর সঙ্গে বাক্যালাপ একদম বন্ধ করে দিয়েছেন।
শুনে, বাসন্তীকে আমি বলি যে, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, ও চিঠি যে কুসুম-বউঠানকে লেখা হয়নি, তা না হয় বুঝলুম, কিন্তু যাকে লেখা হয়েছে সে কে?”
“তাও বুঝতে পারছ না?” বাসন্তী বলে, “কমলির ঘরের জানলা টিপ করে ঢিল ছুড়েছিল। কিন্তু হাতের টিপ খুব সুবিধের নয়, তাই ঢিলটা গিয়ে কুসুমদির ঘরে পড়েছে।”
“অ্যাঁ? কমলি? তার বয়েস তো মাত্র বারো কি তেরো।”
“বুঝতে পারছ না? এ-কালের ছেলে-মেয়ে, এঁচোড়ে পেকে গেছে।”
“আর ওই জগো? সেটা আবার কে?”
“পাড়ার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি বৈকুণ্ঠের অ্যাসিন্ট্যান্ট জগদীশ। তার বয়েসও ওই বারো-চোদ্দোর বেশি হবে না।” বাসন্তী হাসতে-হাসতে বলে, “বোঝো।”
তারপর, হাসি থামিয়ে, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, “দ্যাখো, এগুলো কোনও ব্যাপার নয়, ওই বয়েসে এমন এক-আধটা ঘটনা ঘটেই থাকে। কমলি বলছে, সে কিছু জানেই না, আর জগদীশকেও বৈকুণ্ঠ খুব ধমকে দিয়েছে। ব্যস, মামলা খতম। কুসুমদি অবশ্য বোসমশাইকে এখনও ক্ষমা করে দেননি, তবে আজ দুপুরেও তো ও-বাড়িতে একবার গেসলুম, মনে হল মেজাজ অনেকটাই পড়ে গেছে, রাত্তির নাগাদই হয়তো কথাবার্তা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু ও-সব তো কিছু না, আসল ব্যাপারটার খোঁজ রাখো?”
“সেটা আবার কী?”
“কুসুমদির ব্লাড শুগার তো খুব হাই। দু’বেলা ওষুধ খেতে হয়, তা ছাড়া ফি মাসে অন্তত একবার পিপি টেস্ট করান। তা পিপির জন্যে যে লোকটা ব্লাড টানতে আসে, তার ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ নাকি মোটেই নতুন নয়। গত হপ্তায় যখন ব্লাড টানতে এসেছিল, তখনই ধরা পড়ে যায়। মোড়ক খুলতে দেখা যায় যে, ছুঁচের ডগায় রক্ত লেগে আছে।”
“ওরে বাবা,” আঁতকে উঠে আমি বলি, “এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার। তার মানে, ওই সিরিঞ্জ দিয়ে একটু আগেই আর-কারও রক্ত টেনেছে কিংবা আর কাউকে ইঞ্জেকশন দিয়েছে। লোকটাকে চেপে ধরা হয়নি?”
“হয়েছিল। তাতে সে বলে যে, তার কোনও দোষ নেই। সে তো দোকান থেকে পয়সা দিয়ে সিরিঞ্জ কিনেছে। সিরিঞ্জ যদি মর্চে-পড়া হয়, কি তাতে যদি রক্ত লেগে থাকে তো তার কিছু করার নেই।”
“দোকানের ক্যাশমেমো দেখিয়েছিল?”
“বলেছিল, ক্যাশমেমো সঙ্গে করে আনেনি, পরদিন এসে দেখিয়ে যাবে। কিন্তু তারপরে তো পুরো এক হপ্তা কেটে গেল, লোকটা আর আসেনি।”
সদানন্দবাবুর ভুরু যে ইদানীং কেন কুঁচকে থাকছে, সেটা অতএব বোঝা গেল। তারপরে আবার জুটে গেছে একটা জাল-নোটের ঝামেলা। কাল যখন অরুণ সান্যালদের ফ্ল্যাট থেকে বিদায় নিই তখন আবার ওই নোটের প্রসঙ্গটা উঠেছিল। মেট্রো-স্টেশনের সেই লোকটির কপালে যে একটা কাটা দাগ আছে, এটা শুনে ভাদুড়িমশাই বলেছিলেন, “হ্যাঁ, ওটা একটা ডিস্টিংগুইশিং মার্ক। তা ওটা দেখলে তো লোকটাকে চিনতে পারবেন?”
“তা পারব বই কী।”
“চেনার পরে কী বলবেন তাকে?”
“কেন, লোকটা আমাকে প্ল্যাটফর্ম থেকে টেনে তুলল, প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে যাওয়া আমার জিনিসপত্তর আর টাকাকড়ি গুছিয়ে দিল, তা উপকারী লোককে যা বলতে হয়, তা-ই বলব। হাত দু’খানা আঁকড়ে ধরে বলব, থ্যাঙ্ক ইউ।”
“না, তা বলবেন না।”
“অ্যাঁ?”
“হ্যাঁ।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “লোকটা আপনার বন্ধু নয়, শত্রু। প্রথমত, ট্রেন আসার টাইম নিয়ে লোকটা আপনাকে একটা ভুল খবর খাইয়েছিল, যাতে আপনি সিঁড়ি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নামতে যান আর পিছন থেকে ছোট্ট একটা ধাক্কা মেরে আপনাকে ফেলে দেওয়া যায়। তারপর জিনিসপত্রগুলো আর টাকাকড়ি গুছিয়ে তুলে দেবার অছিলায় যাতে ওই জাল নোটখানা ঢুকিয়ে দেওয়া যায় আপনার পকেটে।”
সদানন্দবাবু মুখে কথা সরছিল না। খানিকক্ষণ একেবারে ফ্যালফ্যাল করে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি। তারপর বিভ্রান্ত গলায় বললেন, “কিন্তু তাতে তার লাভ কী?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সেটাই তো বুঝতে পারছি না। তবে হ্যাঁ, অনুমান করতে পারি যে, আপনাদের সম্পর্কটা শেষ হয়ে যায়নি, খুব শিগগিরই লোকটি আবার আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবে।”
শুনে সেই যে তিনি গুম মেরে গেলেন, বাড়ি পৌঁছনো পর্যন্ত গোটা রাস্তায় তিনি একবারও আর মুখ খুললেন না।