১২
তা এ-সব কাল রাতের খবর। এখন আবার আজকের কথায় ফিরব। কিন্তু তার আগে বলা দরকার, কালকে রেইডের ফলাফল কী দাঁড়াল।
হানা একইসঙ্গে দুটো ঘাঁটিতে দেওয়া হয়েছিল। দিল্লির ওখলায় আর কলকাতায় খিদিরপুরে। কলকাতায় মোট আটজন গ্রেফতার হয়েছে। তাদের মধ্যে দু’জন বিদেশি। এ-দেশে আসার ও থাকার কোনও বৈধ কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি। ঘাঁটিতে জাল ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ পাওয়া গিয়েছে কয়েক হাজার। সেইসঙ্গে জাল-নোটের বান্ডিলও কয়েক লক্ষ টাকার হবে। ন্যাটা কালু সুস্থ হয়ে উঠেছে। সে রাজসাক্ষী হবে। এ-খবর ভাদুড়িমশাইয়ের কাছেই পাওয়া গেল। আজ তিনি কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।
এখানকার খবর কাল রাতে ওখলা থেকে ফিরতি পথেই পেয়েছি। ধাবা ও তার দুই ধারের পার্কিং লট ও টেলিফোন বুথ থেকে গুরমিত সিং সোঁধি-সহ মোট পনেরোজন গ্রেফতার হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন বিদেশি। গোটা এলাকাটা পুলিশ কর্ডন করে রেখেছিল। তাই বোমা ফাটিয়ে যারা পালাবার চেষ্টা করেছিল, পুলিশের জালে তারা আটকে যায়। দুষ্কৃতীদের মধ্যে সাতজন জখম, পুলিশ-পার্টির পাঁচজন।
অ্যাকশন শেষ হবার পর ভাদুড়িমশাই আমাদের গাড়ির কাছে ফিরে এসেছিলেন। এসে দেখেন, গাড়িতে কেউ নেই। ফলে, তিনি আমাদের খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন
খুঁজে পাওয়া যায়নি একমাত্র আমাদের ড্রাইভার মোহন সিংকে। গাড়ি লক না-করে, এমনকি চাবিটা পর্যন্ত গাড়িতেই ফেলে রেখে সে পালায়। সেই গাড়িতে করেই কাল রাত্তিরে আমরা ওখলা থেকে সফদরগঞ্জে ফিরে আসি।
ফেরার পথে একটা কাণ্ড হয়। সদানন্দবাবুকে বাঁ পাশে বসিয়ে ভাদুড়িমশাই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। খানিকটা পথ এগিয়ে তিনি বলেন, “সবই তো হল, কিন্তু কেসটাকে দাঁড় করানো খুব শক্ত হবে।”
পিছনের সিট থেকে আমি বললুম, “কেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিছুই তো পাওয়া গেল না! ভেবেছিলুম, গাদা-গাদা জাল-সিরিঞ্জ পাওয়া যাবে! কিচ্ছু পাওয়া যায়নি! ব্যাটা সব সরিয়ে ফেলেছে! নিশ্চয় খবর পেয়ে গেসল!”
“তা হলে?”
“তা হলে আর কী! এখন এভিডেন্স বলতে স্রেফ গুরমিতের ওই ট্রাক! কিন্তু ওটার উপরে ভরসা করে আর কদ্দুর যাওয়া সম্ভব? পুলিশ বলবে, গুরমিত ওই ট্রাক চালিয়ে অমিতাভ ঘোষকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। জবাবে ওদের উকিল বলবে, মার্ডার কেন করতে চাইবে, মোটিভ কী, ওটা জাস্ট একটা অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া আর কিছুই নয়।”
“মোটিভ প্রমাণ করা যাবে না?”
“যেত, যদি গুরমিতের ওই ডেরা থেকে পুলিশ কিছু জাল-সিরিঞ্জ উদ্ধার করতে পারত। সরকারি উকিল সে-ক্ষেত্রে বলতে পারত যে, গুরমিত জাল-সিরিঞ্জের কারবার করে, অমিতাভ ঘোষের অ্যাড-ক্যাম্পেনে সেই কারবার ধাক্কা খেয়েছে, অ্যান্ড দ্যাটস হোয়াই হি ওয়ান্টেড টু গেট হিম মার্ডারড। কিন্তু কিছুই তো…আরে, আরে, ওটা আপনি কী দিয়ে আপনার মুখ মুছছেন?”
গাড়ি চালাতে-চালাতেই কথা বলছিলেন ভাদুড়িমশাই। সেই অবস্থাতেই স্পিড কমিয়ে, ব্রেক কষে বললেন, “ওটা কী, সদানন্দবাবু?”
সদানন্দবাবু তাঁর পকেট থেকে সেই কাগজখানার বাকি অর্ধাংশ বার করে মুখ মুছতে শুরু করেছিলেন। হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, “আজ্ঞে, এটা একটা কাগজ। রুমাল হারিয়ে ফেলেছি বলে এইটে দিয়ে মুখের রক্ত মুছতে হচ্চে।”
কাগজখানা প্রায় ছিনিয়ে নিলেন ভাদুড়িমশাই। গাড়ির বাতি জ্বালিয়ে সেটা দেখে বললেন, “এই কাগজ আপনি পেলেন কোথায়?”
আমি বললুম, “ওটা আমিই ওঁকে দিয়েছিলুম। যে-কুঠুরির মধ্যে আমাদের দুজনকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে এমন বিস্তর কাগজ স্ট্যাক করা রয়েছে। তারই একটা শিট তুলে তার আধখানা ছিঁড়ে আমি ওঁর রক্ত মুছিয়ে দিই, বাকি আধখানা উনি পকেটে রেখে দেন। কেন, তাতে কী হল?” ‘কী হল, কুঠুরির মধ্যে আলো না থাকায় সেটা আপনারা কেউই বুঝতে পারেননি। নিন, গাড়ির আলো তো জ্বেলে দিয়েছি, এবারে ভাল করে দেখুন।”
কাগজখানা ভাদুড়িমশাইয়ের হাত থেকে নিয়ে যা দেখলুম, তাতে আমার বিষম খাবার উপক্রম। দুপিঠ-ছাপানো কাগজখানা আসলে পরপর সাজানো নোটের সারি। সবই পাঁচশো টাকার নোট।
ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাতে তিনি বললেন, “জাল নোট। এখানে আছে এক-এক সারিতে পাঁচখানা করে পাঁচ সারিতে পঁচিশখানা। কিন্তু এটা তো পুরো শিট নয়, তার অর্ধেক। পুরো শিটে তা হলে পঞ্চাশখানার মতো নোট থাকবে। এ-রকম শিট ওখানে কত আছে?
“প্রচুর।” আমি বললুম, “কিন্তু নোটগুলো তো আলাদা নয়। একই শিটে একসঙ্গে ছাপানো।”
“তাতে পাচার করার সুবিধে। পরে খুব ধারালো ব্লেডের কাটিং মেশিনে ফেলে এগুলো আলাদা করে নিলেই হল। …থ্যাঙ্ক গড়, ভাগ্যিস আমার কথা না শুনে আপনারা গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলেন, আর ভাগ্যিস ঢুকেছিলেন ওই কুঠুরির মধ্যে। নইলে তো এই জাল-নোটের ব্যাপারটা ধরাই পড়ত না। এভিডেন্স হিসেবে এটা কাজে লাগবে।”
বলেই গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেন ভাদুড়িমশাই। আবার ছুট লাগালেন ওখলার সেই ঘাঁটির দিকে। আমার বুকের মধ্যে ফের ঢিবঢিব করে শব্দ হতে শুরু করেছিল। ভাবছিলুম, আমরা গিয়ে পৌঁছোনোর আগেই কেউ স্ট্যাক-করা সেই কাগজগুলোকে সরিয়ে ফেলবে না তো?
না, শেখর চৌহান খুবই হুঁশিয়ার অফিসার, গোটা এলাকাটা জুড়ে তিনি একেবারে নিশ্ছিদ্র পাহারার ব্যবস্থা রেখেছিলেন। যাতে একটি মাছিও সেখান থেকে না গলতে পারে। ফলে, শুধু স্ট্যাক-করা সেই কাগজের শিটগুলো কেন, যে-দুটো বাক্স সেখানে দেখেছিলুম, বিশাল আকারের সেই বাক্স দুটোকেও সেখানে যথাস্থানেই পাওয়া গেল। আর সেই বাক্সের মধ্যেই পাওয়া গেল পুরনো, ব্যবহৃত হাজার কয়েক ডিসপোজেল সিরিঞ্জ।
* * *
তো এখন আবার আজ সকালের কথায় ফেরা যাক। গেস্ট হাউসে আমাদের ঘরে বসেই ব্রেকফাস্ট খেয়েছি। ডাক্তারবাবু আমাকে আর সদানন্দবাবুকে অ্যান্টিটিটেনাস ইঞ্জেকশনও দিয়ে গেছেন। তার খানিক বাদে আমরা সবাই কনফারেন্স রুমে এসে বসেছি। আমি এসেছি খোঁড়াতে-খোঁড়াতে, আর সদানন্দবাবু এসেছেন তাঁর ফোলা মুখ নিয়ে।
কনফারেন্স রুমে শুধু আমরা কেন, অমৃক সিং আর সুরিন্দরও হাজির। গতকাল রাতের ঘটনা নিয়ে দু’চার কথার পর অমৃক বললেন, “এখন তা হলে আর ভাবনা কী। জাল-সিরিঞ্জও যখন পাওয়া গেছে, গুরমিতের মোটিভ প্রমাণ করা তখন শক্ত হবে না। ওটাও গুরমিতেরই বাড়ি। এ তো একেবারে ওয়াটার-টাইট কেস।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সবই হল, কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না।”
সুরিন্দর বলল, “কোন বেপারটা?”
“কিরণবাবু আর সদানন্দবাবুকে রাস্তা থেকে তুলে ওই মাঠকোঠার কুঠুরিতে পৌঁছে দিল কে। সে ওখানে এলই বা কোত্থেকে?”
“তা জানি না।” আমি বললুম, “তবে একটা কথা বলতে পারি। লোকটা ভীষণ শক্তিমান। এমন ভাবে আমাদের দু’জনকে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুট লাগাল, যেন দুটো তুলোর বালিশ নিয়ে দৌড়চ্ছে।”
“লোকটা কোনও কথা বলেনি?”
“না, একটাও না। তবে শুক্লপক্ষের নবমীর রাত তো। রাস্তার আলো নিভে গেলেও তাই আকাশে অল্প-স্বল্প আলো ছিল। তাতে যেটুকু যা ঠাহর করলুম, সেটা বলতে পারি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশ তো, তা-ই বলুন।”
বললুম, “লোকটা অসম্ভব কালো আর অসম্ভব ঢ্যাঙা। আপনারা কেউ অমন কাউকে চেনেন?”
শুনে, ভাদুড়িমশাই, সুরিন্দর আর অমৃক সিং যে-রকম বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে পরস্পরের দিকে তাকালেন, তাতেই বোঝা গেল যে, তাঁরা অন্তত অমন কাউকে চেনেন না। শুধু অমু হঠাৎ দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে টেবিলের উপরে মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইল।
সদানন্দবাবু অস্ফুট গলায় বললেন, “তারা ব্রহ্মময়ী মা গো, অবোধ সন্তানকে বাঁচিয়ে রেখো মা!”
***
রচনাকাল : ১৪০৭