১১
১৫ মার্চ, বুধবার। সদানন্দবাবুকে যাঁরা চেনেন, তাঁদের খুব ভাল করেই জানা আছে যে, ভদ্রলোকের প্রাতঃভ্রমণে বড়-একটা ছেদ কখনও পড়ে না। সব ঋতুতে ও সর্বরকমের বাধাবিপত্তির মধ্যেও মর্নিং-ওয়াক তাঁর করাই চাই। সূর্যোদয়ের অনেক আগেই তিনি শয্যাত্যাগ করেন, তারপর চোখমুখ ধুয়ে ও এককাপ চা সেবন করে, হাতে একটা কুকুর-তাড়ানো খেটে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। কলকাতায় থাকলে গোলদিঘিতে গিয়ে গুনে-গুনে নটি পাক দেন, কেননা তাতে নাকি ঠিক তিন মাইল হাঁটা হয়। বাইরে গেলে ঘড়ি ধরে হাঁটেন ঠিক এক ঘণ্টা। ভদ্রলোকের ধারণা, তাতেও হাঁটা হয় ওই তিন মাইলই।
কিন্তু আমার হাতঘড়িতে এখন যদিও আটটা বাজে, সদানন্দবাবু আজ এখনও বিছানা থেকে ওঠেননি। তাঁর বাঁ চোখের ভুরুর আধ ইঞ্চি উপরে একটা আর ডান গালে হনুর খানিক নীচে আর একটা ব্যান্ড-এড লাগানো। তিনি যে তাঁর প্রাতঃকালীন চা এখনও খাননি, তা অবশ্য নয়, কিচেনে ফোন করে চা আনিয়ে নিয়ে, বিছানায় সেই চা সেবন করে, বিছানাতেই তিনি শুয়ে আছেন। কথাও বলছেন চিঁচিঁ করে। ভদ্রলোকের শরীর ও মন দুয়ের উপর দিয়েই কাল যা ধকল গেছে, তাতে মনে হয় আজ আর তিনি বিছানা ছেড়ে উঠবেন না।
শরীর ও মন যে আমারই খুব ভাল, তাও বলতে পারছি না। সদানন্দবাবুর মুখের উপরে দু’দুটো ব্যান্ড-এড, আর আমার ব্যান্ড-এড দুই হাঁটুতে। তাড়া খেয়ে দৌড়তে গিয়ে রাস্তার উপরে পড়ে গেসলুম, হাঁটু দুটো তার ফলে ছড়ে যায়, গেস্ট হাউসে ফিরে একটা লোশন দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে সেখানে ব্যান্ড-এড লাগিয়েছি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভোগাবে। হাঁটতে গেলে হাঁটুতে টান পড়ে, কষ্ট হয়। তবু তারই মধ্যে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে বাথরুমে গিয়ে মুখচোখ ধুয়েছি, দাড়ি কামিয়েছি, একটু আগে বারান্দা থেকে একটু ঘুরেও এলুম। সেই সময়ে ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরেও একবার উঁকি মারি। খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটছি দেখে তিনি বললেন, “এই অবস্থায় আর কষ্ট করে একতলার ডাইনিং হলে যাবার দরকার নেই, কিচেনে ফোন করে বলে দিন যে, ব্রেকফাস্ট যেন আপনাদের ঘরে দিয়ে যায়, আমাকেও তখন আপনাদের ঘরে ডেকে নেবেন।” কথা শুনে চলে আসছি, তখন ফের পিছন থেকে ডেকে বললেন, “রাস্তায় পড়ে গিয়ে কেটেছে, একটা অ্যান্টি-টিটেনাস ইঞ্জেকশন নিলে ভাল হয়। চলুন, কাছেই একটা ডাক্তারখানা রয়েছে, ব্রেকফাস্টের পর সেখানে গিয়ে ওটা নিয়ে নেবেন। … কিন্তু একটা কথা বলুন দিকি। আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে আপনারা ওভাবে দৌড়তে গেলেন কেন?”
কেন যে দৌড় লাগিয়েছিলুম, সে আমি খুব ভালই জানি। রাস্তার সমস্ত আলো যদি হঠাৎই একসঙ্গে নিভে যায়, আর দুমদাম এ-দিকে ও-দিকে বোমা ফাটে গোটাকয়েক, আর তারই মধ্যে কেউ বিকট গলায় চেঁচিয়ে ওঠে ‘মারো শালে কা’, তা হলে দৌড় না-লাগিয়ে উপায় থাকে? আবার বলি, দৌড় লাগাবার কারণটা আমি খুব ভালই জানি। শুধু জানি না যে, ভাদুড়িমশাই বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও কাল রাত্তিরে আমি আর সদানন্দবাবু তাঁর সঙ্গ নিয়েছিলুম কেন। ভাদুড়িমশাই আর সুরিন্দরকে নিয়ে দিল্লি পুলিশের দুই অফিসার অমৃক সিং আর শেখর চৌহান যে ওখলার সেই ধাবায় গিয়ে হানা দেবেন, পরশু বিকেলে তা জানা সত্ত্বেও কাল দুপুর পর্যন্ত ভাদুড়িমশাই আমাদের ঘুণাক্ষরেও জানাননি যে, ব্যাপারটা কাল রাত্তিরেই ঘটবে। সেটা জানলুম কাল ডাইনিং হলে দুপুরের খাওয়া শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবার পর। তাও যে তিনি নিজের থেকে জানালেন, তা নয়, ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় বেয়ারাটি এসে জিজ্ঞেস করে যে, রাতে আমরা কী খাব। তাতে ভাদুড়িমশাই বলেন, রোজ রাত্তিরে যা খাচ্ছি, তা-ই খাব, তবে তিনটের বদলে মিল হবে দুটো। শুনে আমি বলি, “দুটো কেন? আপনার কি কোথাওঁ নেমন্তন্ন আছে নাকি?” ভাদুড়িমশাই সঙ্গে-সঙ্গে কোনও উত্তর দিলেন না। বললেন, “চলুন, উপরে যাওয়া যাক।”
শুনে আমার সন্দেহ হয় যে, একটা কোনও ব্যাপার তিনি গোপন করে যাচ্ছেন। সন্দেহ অবশ্য পরশু রাত্তির থেকেই হচ্ছিল। প্রথমত, অমৃক সিং সেই যে কনফারেন্স-রুম থেকে তাঁকে নিয়ে গোপনে কী সব কথা বলতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, তারপর থেকেই দেখছিলুম যে, ভাদুড়িমশাই যেন আমাদের একটু এড়িয়ে-এড়িয়ে চলছেন। অমৃক সিং তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে, গেস্ট হাউস ছেড়ে চলে যাবার পরেও তিনি দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যেই বসে রইলেন। রাত দশটা নাগাদ তাঁর ঘরের দরজায় টোকা মেরে আমি জিজ্ঞেস করেছিলুম, খাবার জন্যে সবাই এবারে নীচে নামব কি না। তাতে তিনি দরজা না-খুলে ভিতর থেকেই বলেন যে, আমরা যেন খেয়ে নিই, তাঁর খাবার তিনি ঘরেই আনিয়ে নেবেন। রাত বারোটা নাগাদ সদানন্দবাবু একবার ঘর থকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গিয়ে তাঁর দরজার পাল্লায় কান রেখেছিলেন। ফিরে এসে বললেন, “ঘুমোননি। মনে হল যেন কারও সঙ্গে কথা বলচেন। অথচ ঘরে : তো উনি একা!” আমি বললুম, “তা হলে নিশ্চয় টেলিফোনে কথা বলছেন। কিছু বুঝতে পারা গেল?” তাতে সদানন্দবাবু হতাশ ভঙ্গিতে ঠোঁট উলটে দু’দিকে মাথা নাড়লেন মাত্র। মানে, কিছুই বোঝা যায়নি।
এ-সব পরশু রাত্তিরের ব্যাপার। কাল সকালেও সেই একই অবস্থা। অমৃক সিংয়ের সঙ্গে তাঁর কী নিয়ে কথা হল, জানার জন্য ছটফট করছি। অথচ তিনি মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। কাল অত রাত্তিরেই বা কার সঙ্গে কথা বলছিলেন? না, তাও জানার কোনও উপায় নেই। ভাদুড়িমশাই একেবারে স্পিকটি নট। যা-ই জিজ্ঞেস করি, তিনি এড়িয়ে যান। অথচ, তাঁর মুখ দেখেই বোঝা যায় যে, কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত। মাঝে-মাঝেই চোখ দুটো ভীষণ সরু হয়ে যায়, একদৃষ্টিতে তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কিন্তু কিছুই বলেন না। এমনকি, জাল সিরিঞ্জ নিয়েও না, জাল-নোট নিয়েও না। তারই মধ্যে কখনও-কখনও নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন, দরজার পাল্লায় কান রেখে বুঝতে পারি, আবার তিনি ফোন তুলে কারও সঙ্গে কথা বলছেন।
কাল দুপুরের খাওয়ার পর আর পারলুম না। পরশু থেকেই জানার চেষ্টা করে যাচ্ছি যে, কী হয়েছে, হঠাৎ তিনি এমন নিশ্চুপ হয়ে গেছেন কেন। কিন্তু তা-ই নিয়ে কোনও চাপাচাপি এ-পর্যন্ত করিনি। কিন্তু এবারে উপরে উঠে এসেই চেপে ধরলুম ভাদুড়িমশাইকে। বললুম, “রাত্তিরে এখানে খাবেন না কেন? বলুন কী হয়েছে। না-বললে ছাড়ছি না।”
সত্যিই যে ছাড়ব না, ভাদুড়িমশাই সেটা বুঝতে পেরে হাসলেন। বললেন, “রাত্তিরে এখানে খাব না, তার কারণ, সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে আমি এই গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে যাব।”
“কখন ফিরবেন?”
“ঠিক নেই।”
“কোথায় যাবেন?
“সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে এখানে একটা গাড়ি আসবে। সেই গাড়িটা নিয়ে আমি সুরিন্দরের বাড়িতে যাব। তাকে তুলে আর-এক জায়গায় যেতে হবে।”
“কোথায়?”
“তাও জানতে চান?” ভাদুড়িমশাই সামান্য হাসলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে। এতই যখন জানার ইচ্ছে, তখন সবই বলছি। কিন্তু একটা অনুরোধ আছে।”
বললুম, “অনুরোধটা পরে শুনব। আগে বলুন, সুরিন্দরকে নিয়ে আপনি কোথায় যাবেন। “ওখলায়।”.
শুনে চমকে উঠে বললুম, “তার মানে?”
“মানে তো খুবই সোজা। অমৃক সিং একটা গ্রিন সিগন্যালের জন্যে অপেক্ষা করছিল। সেটা এসে গেছে। তাই আর দেরি করা ঠিক হবে না, আজ রাত্তিরেই রেইড হবে। …বাই দ্য ওয়ে, রেইড সিমালটেনিয়াসলি দু’জায়গায় হচ্ছে।”
আমি সেই একই প্রশ্নের পুনরুক্তি করলুম। “তার মানে?”
“মানে অমৃক সিং হানা দিচ্ছে ওখলার ধাবায়। তার টিমের সঙ্গে আমি আর সুরিন্দরও থাকছি। আর সেই একই সময়ে…একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় একই সময়ে…”
ভাদুড়িমশাই কথাটা শেষ না করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমার বুকের মধ্যে একটা শব্দ হচ্ছিল। উত্তেজনা চেপে রেখে বললুম, “একেবারে একই সময়ে কী হবে?”
“একেবারে একই সময়ে কলকাতায় শোভন চৌধুরি তার টিম নিয়ে খিদিরপুর ডক-এলাকায় একটা বাড়িতে হানা দেবে।” ভাদুড়িমশাই একটু থেমে যোগ করলেন, “জাল-নোটের পান্ডাদের এই ডেরার হদিশটা ন্যাটা কালুর কাছ থেকে পাওয়া গেছে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “বলেন কী!”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিকই বলছি। শোভনের সঙ্গে কাল রাত্তিরে তো বটেই, আজ সকালেও ফোনে কথা হয়েছে আমার। ন্যাটা কালু যা-কিছু জানে, সব বলেছে। কে তাকে রিক্রুট করে কার কাছে নিয়ে গিয়েছিল, কে তাকে জাল-নোট দিয়ে যেত, সব। ডক এরিয়ার ওই বাড়িতেই আটকে রাখা হয়েছিল তাকে। ওখান থেকেই হাত-পা বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে, একটা গাড়িতে করে তাকে বাইপাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার পরের কথা আপনার জানেন।”
“মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল, তা জানি।” আমি বললুম, “মারা যায়নি, তাও আপনার কাছে শুনেছি। তবে জাল-নোটের পান্ডাদের ডেরার হদিশ যে তার কাছে পাওয়া গেছে, তা জানতুম না। পুলিশ যে আজই সেখানে হানা দেবে, তাও এই প্রথম শুনলুম।”
“এটাও শুনলেন যে, রেইড হবে একই সময়ে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখানে ওখলায় আর কলকাতায় খিদিরপুরে। এখন একটা অনুরোধ আছে।”
“বলুন।”
“ওখলায় রেইডের সময় আমি আর সুরিন্দর এদের সঙ্গে থাকব। সেটা যেমন আমি চাইছি, তেমন অমৃক সিংও চাইছে। এখন আমার অনুরোধ এই যে, দয়া করে আপনারা আমার সঙ্গে যেতে চাইবেন না।”
অনুরোধটা যে এইরকমই হবে, তা আমি আঁচ করতে পেরেছিলুম। সে-ক্ষেত্রে সদানন্দবাবুর প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা জানা না-থাকলেও আমি কী বলব, তা জানতুম আমি। বললুম, “তা কী করে হয়? না মশাই, আই ওন্ট চিকেন আউট।” বলেই সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বললুম, “আপনি?”
আমি যে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে যেতে চাই, সদানন্দবাবু তা বুঝতে পারেননি বলে আমার মনে হয় না, তবু তিনি যা করতে চান, সম্ভবত সেটা জানাবার আগে ব্যাপারটা একেবারে পরিষ্কারভাবে বুঝে নেবার জন্যে যে প্রশ্নটা ভদ্রলোক করলেন, অত উত্তেজনার মধ্যেও তাতে আমার হাসি পেয়ে গেল। সদানন্দবাবু বললেন, “ওই যে ‘চিকেন আউট’ বলে একটা কতা বললেন, ওটার মানে কী?” উত্তরটা আমার বদলে ভাদুড়িমশাই-ই দিলেন। বললেন, “ওর মানে ভয় পেয়ে পালানো।” ব্যস, বারুদে এই অগ্নিসংযোগটুকুরই দরকার ছিল। একেবারে সঙ্গে-সঙ্গে বদলে গেল সদানন্দবাবুর চেহারা। আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “ভেবেছেন কী, অ্যাঁ? আপনি পালাবেন না, আর আমি ভয় পেয়ে পালাব? কভি নেহি। আমিও যাব। তাতে যা হয় হোক।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “হতে কিন্তু অনেক-কিছুই পারে।”
তাতে আমি বললুম, “জানি।” আর সদানন্দবাবু বললেন, “হলে হবে। কিন্তু আমি যাবই।”
তারপরেও ভাদুড়িমশাই আমাদের বোঝাবার চেষ্টা করলেন অনেকক্ষণ ধরে। শেষে যখন দেখলেন যে, তাঁর সঙ্গ ছাড়তে আমরা রাজি নই, তখন হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, না-গিয়ে যখন ছাড়বেনই না, তখন আমি অমৃককে বলে আপনাদের জন্যে পারমিশান আনিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু একটা কথা, অপারেশন যতক্ষণ চলবে, ততক্ষণে একেবারে চুপ করে আপনারা গাড়ির মধ্যে বসে থাকবেন, ভুল করেও যেন গাড়ির থেকে নামবেন না। কথাটা মনে থাকবে তো?”
বললুম, “থাকবে, নিশ্চয় থাকবে।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে তৈরি থাকবেন। গাড়ি আসবে সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে। আপনারা বরং সাতটার মিনিট পাঁচেক আগেই আমার ঘরে চলে আসুন।”
গতকাল এর পরবর্তী পর্যায়ে যা-যা ঘটেছিল, তার পুরো বর্ণনা দেওয়া আমার কিংবা সদানন্দবাবুর পক্ষে সম্ভব নয়। তার কারণ পুরো ব্যাপারটা আমাদের চোখের সামনে ঘটেনি। আমি আর সদানন্দবাবু যেটুকু দেখেছি, তার কথাতে একটু পরে আসব। তার আগে বলে রাখি, ভাদুড়িমশাই ওই যে আমাদের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিয়েছিলেন যে, ওখলায় যতক্ষণ অপারেশন চলবে, ততক্ষণ আমরা গাড়ির মধ্যেই বসে থাকব, কিছুতেই গাড়ি থেকে নামব না, সেই কথাটা আমরা শেষ পর্যন্ত রাখতে পারিনি। অ্যাকশন শুরু হবার খানিক বাদে হঠাৎ বোমা পড়তে আরম্ভ করে। নার্ভাস হয়ে গিয়ে আমরা গাড়ি থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে দৌড় লাগাই। তার ফল হয়েছে এই যে, আমরা কেউই মারাত্মকভাবে জখম হইনি ঠিকই, তবে বোমার দুটো ছোটো স্প্লিনটার লেগে সদানন্দবাবুর মুখের দু’জায়গায় সামান্য কেটে গেছে, বেলা হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আর্লি রাইজার সদানন্দবাবু আজ এখনও শয্যাত্যাগ করেননি আর আমাকে একটু খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দু’জনের দুর্দশার কথা তো এই পরিচ্ছেদের গোড়াতেই বলেছি, এবারে কাল রাত্তিরে যেটুকু যা দেখেছি, সেই কথায় আসা যাক।
***
গাড়ি একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় সাতটাতেই এল। নীচের পার্কিং স্পেসে গাড়ি রেখে রিসেপশন থেকে অনুমতি নিয়ে, ড্রাইভারটি উপরে উঠে এসেছিল, ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে ঢুকে বলল, ঘোষ-সাহাব তাকে পাঠিয়েছেন।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “পুলিশ-পারমিট করিয়ে এনেছ তো? ওটা না-থাকলে কিন্তু যেখানে যাচ্ছি, সেখানে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতে দেবে না।”
“হ্যাঁ সাব,” ড্রাইভারটি হেসে বলল, “পারমিট নিয়ে এসেছি।”
“তা হলে নীচে গিয়ে একটু বোসো।” পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে ড্রাইভারের হাতে দু’খানা দশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাছেই একটা খাবারের দোকান আছে, পারলে কিছু খেয়ে নাও, আমরা সাড়ে সাতটায় রওনা হব।”
ড্রাইভারটি একটা সেলাম ঠুকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে আমি বললুম, “ওর নামটা জেনে রাখা হল না।”
“ওর নাম মোহন সিং।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কোটের বুকপকেটের বর্ডারে নাম-লেখা একটা স্ট্রিপ আঁটা রয়েছে, আপনি দেখেননি।”
রাত্তিরে যে পেটে কিছু নাও পড়তে পারে, তা জানাই ছিল। বিকেল ছ’টায় যখন চা দেয়, কিচেন থেকে তখনই তাই আরও কিছু খাবার আনিয়ে নিই। নীচে নামি ঠিক সাড়ে সাতটায়। সুরিন্দরের বাড়ি প্যাটেল-নগরে। যাব তো শেষ পর্যন্ত ওখলায়। তা হলে প্যাটেল-নগর হয়ে সেখানে যাচ্ছি কেন? এটা তো ঘুর-পথ হল। ভাল হত যদি সুরিন্দরকেই সফদরজঙ্গে চলে আসতে বলতেন ভাদুড়িমশাই। কিন্তু তা তিনি বলেননি। কেন বলেননি, তা জানি না। হয়তো তিনি আশঙ্কা করছেন যে, আমাদের গতিবিধির উপরে নজর রাখা হচ্ছে। যারা নজর রাখছে, এটা কি তাদের ধোঁকা দেবার জন্যে? কিছু জানি না। জানার কোনও উপায়ও নেই। গাড়িতে ওঠার আগে ভাদুড়িমশাই এটাও আমাদের দিয়ে কবুল করিয়ে নিয়েছেন যে, পথে আমরা কোনও প্রশ্ন করব না।
প্যাটেল-নগরে পৌঁছতে-পৌঁছতে সাড়ে আটটা বাজল। শুনেছিলুম, সুরিন্দর এখানে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলায় পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে। একটা ফ্ল্যাটে তার সংসার, অন্যটায় তার আপিস। চারু ভাদুড়ি ইনভেস্টিগেশানসের দিল্লি ব্রাঞ্চের কাজকর্ম চলে সেখান থেকেই। সুরিন্দরই তার চার্জে রয়েছে। কিন্তু মোহন যে-বাড়িটার সামনে তার গাড়ি থামাল, সেটা আদৌ কোনও ফ্ল্যাট-বাড়ি নয়। স্রেফ একতলা একটা বিশাল দোকান-ঘর। দোকানের সামনে লোহার শাটার ফেলা, তবে সাইনবোর্ড থেকে বোঝা যায় যে, এখানে মোটরগাড়ির স্পেয়ার পার্টস বিক্রি করা হয়। দোকান-ঘরের পাশে একটা সরু অন্ধকার প্যাসেজ। আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে গাড়ি থেকে নেমে ভাদুড়িমশাই সেই প্যাসেজের মধ্যে ঢুকে গেলেন। মিনিট পাঁচেক বাদে দেখলুম, সুরিন্দরকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে আসছেন। দু’জনের হাতে দুটো ঝোলা। ভাদুড়িমশাই বসে ছিলেন ড্রাইভারের বাঁ পাশের সিটে। সামনের দরজা দিয়ে তিনি সেখানেই ফের উঠে পড়লেন। সুরিন্দর উঠলেন পিছনের দরজা দিয়ে। পিছনের সিটে আমাদের পাশে বসে ঝোলা থেকে দুটো প্যাকেট বার করে আমাদের দুজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “জাস্ট সাম স্ন্যাকস। ভুখ লাগলে খেয়ে নিবেন।”
ঝোলার মধ্যে আর কী আছে, তা আমরা জিজ্ঞেস করলুম না। এ-সব কথা যত কম জিজ্ঞেস করা যায়, ততই ভাল। গাড়ি আবার ছুটল। আমি আর সদানন্দবাবু একেবারে নিঃশব্দে বসে রইলুম।
ওখলায় যখন পৌঁছলুম, আমার রেডিয়াম-লাগানো হাতঘড়িতে তখন দশটা বেজে গেছে। যাঁর নির্দেশে গাড়ি থামাতে হল, প্লেন ড্রেসে থাকায় তাঁর পরিচয় জানার উপায় নেই, তবে কথা বলার ধরন দেখে আন্দাজ করলুম যে, খুব উঁচু দরের না-হলেও ইনি পুলিশের একজন ছোটখাটো অফিসারই হবেন। পেন্সিলটর্চ ফেলে গাড়ির ভিতরটা একবার দেখে নিয়ে মোহন সিংকে তিনি নির্দেশ দিলেন যে, আর না-এগিয়ে গাড়িটা যেন এখানেই সে রাস্তার ধারে পার্ক করে রাখে। তারপর ভাদুড়িমশাইকে বললেন, “আপনি আর সুরিন্দর বেদী নেমে আসুন, আপনাদের আমি মিস্টার সিংয়ের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। অন্যেরা জানলার কাচ তুলে দিয়ে গাড়ির মধ্যেই বসে থাকুন, অপারেশন শেষ হলে আমরা জানাব, তার আগে ওঁরা যেন গাড়ি থেকে না নামেন। আন্ডার নো সার্কামস্টান্সেস।”
ভাদুড়িমশাই যেন তৈরি হয়েই ছিলেন, সুরিন্দরকে নিয়ে তিনি গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। লক্ষ করলুম, তাঁরা দুজনেই নামলেন একেবারে খালি হাতে, তাঁদের ঝোলা দুটি গাড়িতেই পড়ে রইল। তবে, নামার আগে সুরিন্দর তার ঝোলা থেকে যে-বস্তুটি বার করে কোমরের বেল্টে গুঁজে নিয়েছে, সেটা আমি চিনি। একটা রিভলভার। ধরেই নেওয়া যায় যে, ভাদুড়িমশাইও নিতান্ত নিরস্ত্র অবস্থায় গাড়ি থেকে নামেননি। একটু বাদেই ওঁরা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন
হাতঘড়ির দিকে তাকালুম। রাত এখন দশটা কুড়ি। এই সময়েও পুরনো দিল্লির রাস্তাঘাটে প্রচুর লোক চলাচল করে, যেমন বড়রাস্তায় তেমনি ছোটখাটো গলিতেও খোলা থাকে বেশ-কিছু খাবারের দোকান, টাঙ্গা আর অটো চলে, বিস্তর ফেরিওয়ালা চিৎকার করে নজর কাড়ে পথচলতি মানুষের। কিন্তু নিউদিল্লির ব্যাপার আলাদা। সেখানকার চওড়া-চওড়া সব রাস্তা এর অনেক আগেই ফাঁকা হয়ে যায়। হুশহাশ করে দিশি-বিদেশি গাড়ি তখনও চলতে থাকে ঠিকই, কিন্তু রাস্তাঘাটে মানুষজন বড়-একটা চোখে পড়ে না। আর এ তো ওখলা। শহরের কেন্দ্রবিন্দু থেকে এ জায়গা অনেক দূরে। এককালে তো এখানে জনবসতি ছিল না বললেই চলে, কিন্তু লোকসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মহানগরের সীমানাও দেখতে-দেখতে ছড়িয়ে পড়েছে অনেকখানি, বাড়ি-ঘরের সংখ্যা এ-দিকেও সেইসঙ্গে বাড়ছে বই কি। তবু, তুলনায় এ-দিকটা এখনও মোটামুটি ফাঁকা। তার উপরে, রাত ক্রমেই বাড়ছে। এত রাতে এখানে রাস্তায় লোকজন থাকার কথাই নয়। প্রাইভেট গাড়িও চোখে বিশেষ পড়ছে না। শুধু কিছু ট্রাক মাঝে-মাঝে এক প্রান্ত থেকে ছুটে এসে আবার অন্য প্রান্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। তার পরেই আবার সব স্তব্ধ হয়ে যায়।
রাত সাড়ে দশটায়, একেবারে হঠাৎই, যেন সেই স্তব্ধতার বুকে ছুরি চালিয়ে দিয়ে, তীব্র একটা হুইল বেজে ওঠে। সেইসঙ্গে ভেসে আসে কিছু ভারী বুটের শব্দ। দূরে একটা চেঁচামেচির শব্দও শুনতে পাই। পরক্ষণে সেটা থেকে যায়। মোহন বলে, “অ্যাকশন শুরু হো গিয়া হোগা।” আমরা কোনও কথা বলি না। নিশ্বাস বন্ধ করে আমি আমার হাতঘড়ির মিনিটের কাঁটার দিকে তাকিয়ে থাকি।
মিনিটের কাঁটা পিছলে পিছলে ঘুরে যাচ্ছে। এক মিনিট, দু’মিনিট, তিন মিনিট, চার মিনিট, পাঁচ মিনিট।
ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় হঠাৎ রাত্রির নৈঃশব্দ্য আবার ভেঙে যায়। পরপর কয়েকটা শব্দ শুনে বুঝতে পারি, বোমা পড়ছে। তারপরেই শুরু হয়ে যায় বোমার বৃষ্টি। যারা বোমা ছুড়ছে, ক্রমেই যে তারা এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে, পায়ের শব্দ আর কোলাহল থেকে তাও টের পাই। মোহনের গলা শুনে বুঝতে পারি, সে ভয় পেয়েছে। কাঁপা-কাঁপা গলায় সে বলে, “আগর আপ চাহে তো ইয়াঁহা বইঠ শকতে হ্যায়, পর হাম অব চলে যায়েঙ্গে।” বলে সে আর এক মুহূর্তও দেরি করে না, গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় নেমে ছুটতে থাকে।
ভাদুড়িমশাই বলে দিয়েছিলেন, তার উপরে এখানকার পুলিশ-অফিসারটিও স্পষ্ট করে বলেছেন যে, কোনও অবস্থাতেই যেন আমরা গাড়ি থেকে না নামি। কিন্তু সে-কথা তখন আর মনে থাকে না। মোহনকে পালাতে দেখে আমরাও গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। আর ঠিক তখনই নিভে যায় রাস্তার সমস্ত আলো। অন্ধকারের মধ্যে দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে আমরা ছুটতে থাকি। ছুটতে-ছুটতেই হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যাই আমি। হাঁটুতে প্রচণ্ড লাগে। মনে হয়, আমি আর উঠে দাঁড়াতে পারব না। কাছেই বোমা ফাটে একটা। সদানন্দবাবু ‘মাগো’ বলে চেঁচিয়ে উঠেই আমার পাশে বসে পড়েন। আমার মনে হয়, আজই আমাদের শেষ দিন।
ঠিক সেই মুহূর্তেই অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটে। পিছন থেকে ছুটতে ছুটতে একটা লোক আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে, তারপর, যেন দুটো ন্যাকড়ার পুতুল কুড়িয়ে নিচ্ছে, এইভাবে রাস্তা থেকে আমাদের দুজনকে দু’কাঁধে তুলে নিয়ে ফের ছুট লাগায়। ছুটতে ছুটতেই ঢুকে পড়ে বড় রাস্তার পাশের একটা অন্ধকার গলিতে। সেখানে আরও খানিকটা এগিয়ে একটা মাঠকোঠার মতো দোতলা বাড়ির একতলার দরজায় ধাক্কা মারতেই দরজা খুলে যায়। মনে হয়, বাড়িতে কেউ নেই। লোকটাও সম্ভবত তা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সে আর দেরি করে না। দরজা খুলে যেতেই আমাদের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়। তারপরে আর অপেক্ষা না-করে, যে-রকম ছুটতে-ছুটতে এসেছিল, সেইভাবেই আবার ছুটতে-ছুটতে ফিরে যায় বড় রাস্তার দিকে।
আমাদের বোধবুদ্ধি একেবারে তালগোল পাকিয়ে গেসল। পরপর যা সব কাণ্ড ঘটল, তাতে সেটা কিছু অস্বাভাবিকও নয়। কোনও কিছুই মাথায় ঢুকছিল না আমাদের। কে এই লোকটা? দিল্লি-পুলিশেরই কোনও কনস্টেবল কি হাবিলদার? নাকি শত্রুপক্ষের কোনও লোক? কিছুই বোঝার উপায় নেই। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছিলুম যে, লোকটা অসম্ভব শক্তিশালী। তা নইলে সে রাস্তা থেকে একইসঙ্গে দু’দুটো লোককে এইভাবে কাঁধে তুলে এ-রকম ছুটতে ছুটতে এখানে নিয়ে এল কী করে?
এখানে আমাদের ঢুকিয়েই বা দিল কোথায়? আলো নেই। হাঁটুতে প্রচণ্ড ব্যথা। তবু কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে হাত বুলোতে লাগলুম, যদি একটা সুইচ খুঁজে পাওয়া যায়। পাওয়া গেল না। জানলা থাকলে দেওয়ালে হাত বুলিয়ে সেটা বোঝা যেত। না, তাও নেই। তবে এখন শুক্লপক্ষ। তিথিটা নবমী। সম্ভবত সেই কারণেই ঘরের মধ্যে খুব সামান্য একটু আলো এসে পড়েছে। কোন পথে সেটা আসছে, উপরে তাকিয়ে সেটা বোঝা গেল। একটা ঘুলঘুলি। অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে আসার পরে বোঝা গেল যে, এটা একটা অন্ধ কুঠুরির মতো জায়গা। এই কুঠুরিতে একটা দরজা ছাড়া বড়-বড় দুটো বাক্স আছে, আর আছে একদিকে স্ট্যাক করে রাখা ট্যাবলয়েড সাইজের, মানে ছোট মাপের খবরের কাগজের সাইজের, কিছু কাগজ। তা ছাড়া আর কিছুই এখানে নেই। দরজায় খিল এঁটে দিলুম। এখন দেখা যাক কী হয়।
সদানন্দবাবু জ্ঞান হারাননি। তবে বেদম ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। খুবই স্বাভাবিক। কুঠুরির এক কোণে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে তিনি ঝিম মেরে বসে আছেন। সেখান থেকেই নিস্তেজ গলায় বললেন, “আমি বোধহয় আর বাঁচব না, কিরণবাবু। আপনারা আমার উইডোকে একটু দেকবেন।”
আমি বললুম, “ও কী কথা, অপারেশন যদি সাকসেসফুল হয়, তা হলে ওরা আমাদের খুঁজতে বেরোবে ঠিকই, আর খুঁজতে খুঁজতে এখানে নিশ্চয় এসেও যাবে। …কিন্তু আপনার কি খুবই লেগেছে?”
“মুখে লেগেচে। মুখ রক্তে ভেসে গেচে! মুখে হাত বুলিয়ে জিভে আঙুল ঠেকিয়েছিলুম। নোনা ঠেকল। তার মানে রক্ত। হাতটা চটচট করচে। …একটা রুমাল দিতে পারেন?”
“আপনার রুমাল কী হল?”
“গাড়িতে ফেলে এসিচি, নয়তো পথে কোথাও পড়ে গেচে। কী করি বলুন তো?”
আমি সাধারণত দুটো রুমাল নিয়ে বেরোই। কিন্তু সে-দুটোই তো এখন আমার দুই হাঁটুতে বাঁধা। তাতেও রক্ত লেগে আছে, তা দিয়ে অন্যের মুখ মোছার কথা ভাবাই যায় না। একটু ভেবে বললুম, “দাঁড়ান, এক কাজ করা যাক।” বলে স্ট্যাক করা কাগজ থেকে একটা শিট টেনে নিয়ে সেটা আধাআধি ছিঁড়ে একটা অংশ দিয়ে সদানন্দবাবুর মুখ মুছিয়ে বাকি অংশটা তাঁর হাতে দিয়ে বললুম, “এটা ভাঁজ করে আপনার পকেটে রেখে দিন, আপাতত এই দিয়েই কাজ চালাতে হবে।”
একটা ব্যাপার লক্ষ করছিলুম। আমরা এই কুঠুরিতে ঢোকার পরেও বোমা ফাটার যে শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল, বেশ কিছুক্ষণ ধরেই সেটা শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু এমন সাহসও হচ্ছিল না যে, দরজা খুলে বাইরে বেরোই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, সাড়ে এগারোটা বাজে। তার মানে প্রায় ঘণ্টাখানেক এই কুঠুরির মধ্যেই আমরা বসে আছি। কে জানে আর কতক্ষণ আমাদের এইভাবে বসে থাকতে হবে।
দরজায় ধাক্কা পড়ল রাত বারোটায়। সেইসঙ্গে উদ্বিগ্ন প্রশ্ন : ‘কিরণবাবু, সদানন্দবাবু, আপনারা কোথায়?’ এ-গলা আমার চেনা। ভাদুড়িমশাই। দরজা খুলে আমরা বাইরে বেরিয়ে এলুম। বাইরে তাঁরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছেন। ভাদুড়িমশাই, অমৃক সিং আর সুরিন্দর বেদী। টর্চ ফেলে সদানন্দবাবুকে দেখে ভাদুড়িমশাই শিউরে উঠে বললেন, “এ কী, আপনার মুখের এই অবস্থা কী করে হল?”
শুনে, দু’পা এগিয়ে সদানন্দবাবু যে-ভাবে ভাদুড়িমশাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, সেটা দেখে, এত হেনস্থার মধ্যেও আমার ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছবির সেই অবিস্মরণীয় দৃশ্যটির কথা মনে পড়ে গেল, সেই যেখানে মগনলাল মেঘরাজের চ্যালার রোমহর্ষক ছোরার খেলার শেষে লালমোহনবাবু সটান ফেলুদার কোলে মূর্ছা গেসলেন।