১০
অমু ঠিক ছ’টাতেই চলে এসেছিল। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে, সে বেশ উদ্বিগ্ন। সুরিন্দর এল ছ’টা বাজার একটু পরে। তাঁর সঙ্গে যিনি এলেন, তাঁকে চিনলুম না। মুখ দেখে মনে হল, সুরিন্দরের ইনি সমবয়সি, তার মানে এঁর বয়েস সম্ভবত বছর পঁয়ত্রিশের মধ্যেই হবে। সেই সঙ্গে মাথায় পাগড়ি, পাকানো গোঁফ, ফেট্টিতে জড়ানো চাপদাড়ি আর হাতের বালা দেখে বোঝা গেল যে, ইনি শিখ। তবে এর আগে এঁকে কখনও দেখিনি।
ভাদুড়িমশাই অবশ্য এঁকে দেখবামাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে, ভদ্রলোকের হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে-দিতে বললেন, “আরে, অমৃক! এসো, এসো!”
নাম শুনে বুঝলুম, ইনি অমৃক সিং। দিল্লি পুলিশের এই তরুণ অফিসারটির কথা ভাদুড়িমশাইয়ের কাছে এর আগেও আমরা শুনছি। এখন আমাদের সঙ্গে এঁর পরিচয় করিয়ে দেবার সময় তিনি এটাও জানালেন যে, কলকাতার শোভন চৌধুরি আর দিল্লির অমৃক সিং আসলে একই বছরের আই.পি.এস. ব্যাচমেট হিসেবে পরস্পরের এঁরা বন্ধুস্থানীয়, তা ছাড়া যে যাঁর ক্যাডারে কাজে যোগ দেবার আগে মুসৌরির লালবাহাদুর ইনস্টিট্যুটে একই সঙ্গে ট্রেনিং পেয়েছিলেন। দু’জনের বন্ধুত্ব সেই তখন থেকে
কথাবার্তা আর এগোবার আগে অমু বলল, “এখানে তো চেয়ার মাত্র তিনটে, বসতে অসুবিধে হবে; চলুন, আমাদের কনফারেন্স-রুমে যাওয়া যাক।”
কনফারেন্স-রুম গেস্ট হাউসের এই তলারই এক প্রান্তে। ভাদুড়িমশাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আমরা সেখানে চলে এলুম। ঘরটা খুব বড় না-হলেও, একটা গোল টেবিল ঘিরে খান আষ্টেক গদি-আঁটা চেয়ার ছাড়াও দেওয়াল ঘেঁষে লম্বালম্বি সোফার ব্যবস্থা রয়েছে দেখলুম। চেয়ারগুলোতে মুখোমুখি বসে পড়া গেল। সবাই ঠিকমতো বসেছে দেখে নিয়ে অমু বলল, “কিচেনে আমি চা-কফি কথা বলে রেখেছি। সাড়ে ছ’টায় ওরা চা-কফি দিয়ে যাবে। আপনারা কথা বলুন, আমার তো আর নতুন করে কিছু বলার নেই, আমি বরং যাই।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে কী, তোমার তো থাকা দরকার, কোথায় যাবার কথা ভাবছ?”
“বাড়ি যাব। আজ আবার ফোন করে ওই যে হুমকি দিল, তার পর থেকেই সুলেখা বড্ড অস্থির হয়ে আছে।”
অমৃক সিং বললেন, “ঘোষ-সাহাব, আপনি ঘাবড়াচ্ছেন কেনো?”
“ঘাবড়ে যাব না?” অমু বলল, “যতক্ষণ বাইরে থাকি, ভয়ে ভয়ে থাকি। ভয় আমার নিজের জন্যে নয়, ফর মাই ওয়াইফ অ্যান্ড দ্যাট ইনোসেন্ট চাইল্ড।”
“তাদের কুছু হোবে না।” অমৃক সিং বললেন, “ফোনের কথা আমি জানি। আপনার ফ্ল্যাটে অ্যাডিকুয়েট সিকিওরিটির বন্দবস্ত করে তব না আমি আসছি ইখানে? প্লিজ ডোন্ট গেট নার্ভাস।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুমি একটু থেকে যাও, অমু। যা বুঝতে পারছি, অমৃক যখন এসেই গেছে, তখন একটা প্ল্যান অব অ্যাকশন ছকে নেওয়া ভাল। তবে কিনা, জাল-সিরিঞ্জের যারা কারবারি, আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে যখন তোমাকেই তারা বেছে নিয়েছে, তখন পাল্টা-ব্যবস্থা হিসেবে যা-ই আমরা ঠিক করি না কেন, সেটা তোমাকে জানানো দরকার। আর হ্যাঁ, তাতে তোমার সম্মতিও থাকা দরকার।”
অমৃক সিং বললেন, “আমরা যা করব বলে ভাবছি, আপনারা পারমিশান দিলে সেটা আমি বলব।”
“নিশ্চয়ই বলবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তার আগে সুরিন্দরের কথাটা শুনি। সুরিন্দর, অমুর বাড়িতে ফোন করে যে-লোকটা ভয় দেখাচ্ছে, সে কোথা থেকে ফোন করছে, সেটা তো তুমি ট্রেস করতে পেরেছ, তা-ই না?”
সুরিন্দর কথা বলতে গিয়েও বলল না, কেননা মস্ত দুটো ট্রের উপরে চা আর কফির সরঞ্জাম নিয়ে দুটি বেয়ারা ঠিক সেই মুহূর্তেই কনফারেন্স রুমে এসে ঢুকল। টেবিলের উপরে পট, পেয়ালা, ও পিরিচ সাজিয়ে তারা সম্ভবত জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল যে, আমাদের মধ্যে কে চা খাবেন আর কে কফি। কিন্তু তারা মুখ খুলবার আগেই অমু বলল, “তোমরা যেতে পারো, চা আর কফি আমরা নিজেরাই ঢেলে নেব। এখন আর তোমাদের কোনও দরকার নেই।”
বেয়ারা দুটি আর দাঁড়াল না, মৃদু গলায় ‘জি সাব’ বলে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল।
সুরিন্দরের দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “নাও, কী বলছিলে বলো। কলটা কোত্থেকে করেছে?”
“যে-নাম্বার থেকে করেছে, সেটা কোনও প্রাইভেট লাইনের নয়।” সুরিন্দর বলল, “সেটা একটা পাবলিক বুথের নাম্বার। অ্যান্ড দ্য বুথ ইজ ইন দ্য সেম এরিয়া।”
“কোন এরিয়া?”
“ওখলা।”
শুনে হঠাৎই পালটে গেল ভাদুড়িমশাইয়ের মুখচোখের চেহারা। সেইসঙ্গে কণ্ঠস্বরও। আমি দেখলুম, এতক্ষণ যিনি স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা বলছিলেন, তাঁর ভিতর থেকে যেন অন্য-একটা মানুষ বেরিয়ে এসেছে। সরু চোখে সুরিন্দরের দিকে তাকিয়ে, চাপা কিন্তু ভীষণ রকমের কঠিন গলায় তিনি বললেন, “বুথটার নাম্বার যখন জেনেছ, তখন সেটা ওখলার কোন রাস্তার কত নম্বর বাড়িতে, সেটা জানাও তো শক্ত নয়। …কী সুরিন্দর, জেনে নিয়েছ?”
“ইয়েস, বস।”
“ওটা নিশ্চয় ধাবাটার খুব কাছেই?”
“আপনি কোন ধাবার কথা বলছেন, মামাবাবু?” অমিতাভ বলল, “যার পাশের পার্কিং লটে সেই ট্রাকটা রয়েছে? মানে সেদিন বুদ্ধ জয়ন্তী পার্কের কাছে রিজের রাস্তায় যে-ট্রাকটা আমার টাটা সুমোকে ধাক্কা মেরেছিল?”
ভাদুড়িমশাই সুরিন্দরের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলেন। সেদিক থেকে মুখ না-ফিরিয়ে অমুর প্রশ্নের জবাবে বললেন, “হ্যাঁ।” তারপর সুরিন্দরকে বললেন, “কী, টেলিফোন-বুথটা সেই ধাবার খুব কাছেই তো?”
সুরিন্দর বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আপনি সেটা কী করে জানলেন?”
কথাটার উত্তর না দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “কত কাছে?”
“একদম কাছে। ইন ফ্যাকট, ধাবাটার এক সাইডে তো ওই পার্কিং লট, আর অন্য সাইডে এই বুথ।”
সুরিন্দর বেদীর ডাইনে বসে আছেন অমৃক সিং। এবারে তাঁর দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোমার প্ল্যানটা কী অমৃক?”
অমৃক সিং মৃদু হেসে বললেন, “প্ল্যান কুছু ঠিক করি নাই। সেইটা আপনার অ্যাডভাইস নিয়ে তারপর ঠিক করব। আমার চিফও সেইটাই চান। দ্যাটস হোয়াই আই হ্যাভ কাম টু ইউ।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক আছে। কিন্তু তুমি তো এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছ। কী মনে হয় তোমার?”
“হ্যাঁ, আমি ধেয়ান দিয়েছি।” অমৃক বললেন, “তো আমি ভাবলাম যে, দুটা কাজ তো করাই যায়। ট্রাক-ড্রাইভারকে আমি ওয়াচে রেখেছি, সে ইখানেই আছে। অওর, ট্রাকটা জলন্ধরে রেজিস্টার্ড হলেও ট্রাকের যে ওনার, সে দিল্লির লোক। তা অ্যাকসিডেন্ট করল, কিন্তু পুলিশকে সেটা জানাল না, তার উপরে আবার ফলস নাম্বার-প্লেট লাগিয়েছিল, সির্ফ এইজন্যেই আমি ওদের দুজনকে অ্যারেস্ট করতে পারি। কিন্তু করছি না।”
“কেন করছ না?”
“ফর টু রিজনস। রিজন নাম্বার ওয়ান, জাল ডিসপোজেবল সিরিঞ্জের এগেনস্টে দিল্লিতে যে অ্যাড-ক্যাম্পেন চলছে, সেটাকে যারা রুখে দিতে চায়, সারকামস্ট্যানসিয়াল এভিডেন্স থেকে বুঝতে পারছি যে, গুরমিত সোঁধি ইজ ওয়ান অব দেম।”
“হু ইজ দিস গুরমিত? আর হ্যাঁ, তার এগেনস্টে এভিডেন্সটাই বা কী?”
হাসিটাকে ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখে অমৃক বললেন, “গুরমিতই ওই ট্রাকের ওনার।”
আর ব্যাখ্যার দরকার ছিল না। ভাদুড়িমশাই বললেন, “বুঝেছি। তারই ট্রাক যে অমুর টাটা সুমোকে ধাক্কা মেরেছিল, এটাই তোমরা ব্যবহার করবে এভিডেন্স হিসেবে, কেমন?”
“সেটা ডিফিকাল্ট হোবে না, মিস্টার ভাদুড়ি।” অমৃক বললেন, “অ্যাড-ক্যাম্পেনটা একটা মালটি-ন্যাশনাল কম্প্যানির নামে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ক্যাম্পেনের পিছনে যে আছে ঘোষ সাহাবের ব্রেন, সেটা সবাই জানে। কেসটা আদালতে উঠলে সেটাই আমরা বলব। উই শ্যাল অলসো সে দ্যাট কুছু লোকের ইললিগ্যাল বিজনেস এই ক্যাম্পেনের জন্যে সাফার করছে, অ্যান্ড দ্যাট ইজ হোয়াই দে ট্রায়েড টু কিল মিস্টার ঘোষ অন দ্যাট নাইট বাই স্টেজিং আ ফেক অ্যাকসিডেন্ট।”
“কিন্তু সোঁধির বিজনেস যে এই ক্যাম্পেনের ফলে সাফার করছে, সেটা প্রুভ করবে কী করে? প্রুভ করতে হলে তোমাকে দেখাতে হবে যে, সে ইউজড সিরিঞ্জকেই ফের নতুন মোড়কে মুড়ে বাজারে ছাড়ছে। সেটা দেখাতে পারবে তো?”
“পারব, মিস্টার ভাদুড়ি।” অমৃক হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, “কিন্তু কী করে পারব, সেটা এখন জানতে চাইবেন না, প্লিজ।” একটু থেমে আবার বললেন, “গুরমিতকে আমরা আজই অ্যারেস্ট করতে পারি। কিন্তু করছি না। আর দু-একটা এভিডেন্সের জন্যে ওয়েট করছি। সেটা পেয়ে গেলেই ওর ডেরায় গিয়ে হানা দেব।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওয়েট করার সেটা তো একটা কারণ। অন্য কারণও আছে নাকি?”
“অন্য কারণটা তো আপনি।” অমৃক সিংয়ের গাম্ভীর্যের মুখোশ খসে পড়ল। হেসে বললেন, “মিস্টার ভাদুড়ি, কলকাতা থেকে শোভন আমাকে ফোন করেছিল। সে বলল, আপনি বিশোয়াস করেন যে, জাল সিরিঞ্জ আর জাল কারেন্সি নোট, এ দুটার মধ্যে একটা লিঙ্ক আছে।”
“শুধু এ-দুটো কেন, লিঙ্ক আছে আরও অনেক-কিছুর মধ্যেই।”
“যেমন?”
“তাও বলে দিতে হবে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এই যে এখানে-ওখানে এত বোমা ফাটানো হচ্ছে, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি, রেলের লাইন উপড়ে ফেলা হচ্ছে, এখানে-ওখানে পাওয়া যাচ্ছে এত-এত আর.ডি. এক্স., এই যে এত নিরীহ লোক মেরে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে, কী ভাবো তোমরা, এর মধ্যে কোনও যোগসম্পর্ক নেই? আছে। ঠিক যেমন আছে এই জাল-সিরিঞ্জ আর জাল-নোটের মধ্যে। এর কোনওটাই বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়, সবই ইন্টারলিঙ্কড। আবার কোনওটা ঘটাচ্ছে এ-দেশেরই এমন-কিছু লোক, টাকার লোভে যারা নিজের মাকেও বেচে দিতে পারে। আর এই সবকিছুর উদ্দেশ্য তো একটাই।”
“সেটা কী?”
“মানুষ মেরে, আতঙ্ক ছড়িয়ে, সন্দেহের আগুনে বাতাস লাগিয়ে দেশটাকে ডিস্টেবিলাইজ করে দেওয়া। …অমৃক, জাল-টাকা ছড়ানো আর জাল-সিরিঞ্জ দিয়ে অসুখ ছড়ানো, তুমি ভাবছ এ- দুটো আলাদা-আলাদা ক্রাইম। কিন্তু, কাজ আলাদা হলেও এদের উদ্দেশ্য সেই একই ডিস্টেবিলাইজেশন।”
“শোভনও তা-ই বলছিল।” অমৃক সিং বললেন, “আপনার সঙ্গে কথা বলে তারও এই একই বিশোয়াস হয়েছে। আর সেইজন্যেই সে চায় যে, দিল্লি আর কলকাতা, দুটো জায়গায় একইসঙ্গে অচানক রেইড করা দরকার। যাতে এক জায়গায় রেইড হলে অন্য জায়গায় লোক সেটার খবর পেয়ে সরে পড়তে না পারে। তা, শোভন ইজ রেডি উইথ হিজ টিম। আর এখোন আপনাকে বলতে পারি, রেডি আছি আমরাও।”
“রেইড কবে হবে?”
“কবে হবে, কখন হবে, শোভনের সঙ্গে কথা বলে সেটা আমি ঠিক করে নিয়েছি। তবে সেটা আমি সির্ফ আপনাকে বলব।” অমৃক সিং চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বললেন, “চোলেন মিস্টার ভাদুড়ি, আপনার ঘরে যাই। তবে যাবার আগে ঘোষ সাহাবকে অ্যাসিওর করে যাচ্ছি, ইট উইল বি আ স্মুদ অপারেশন, তাঁর ঘাবড়াবার কুছু নাই।”
ভাদুড়িমশাইকে সঙ্গে নিয়ে কনফারেন্স-রুম থেকে অমৃক সিং বেরিয়ে গেলেন।