১
“রাত বারোটা। খিল-আঁটা ঘরের মধ্যে অন্য কোনও আলো নেই। শুধু একটা জিরো-পাওয়ারের নীল বালল্ব জ্বলছে, আর সেই বালবের দিকে চোখ রেখে একেবারে চুপ করে আমি বসে আছি। এমন সময়ে সে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। চেহারাটা তো আমার মনের মধ্যে একেবারে গেঁথে আছে, তাই কোনও ভুলভাল হল না, হওয়ার কথাও নয়, দেখবামাত্র চিনতে পারলুম যে, এ সেই লোক। আবলুশ কাঠের মতো মিশমিশে কালো শরীর, যেমন রোগা তেমনি ঢ্যাঙা, গায়ে একটা সাদা আলখাল্লা আর মাথায় সেই চকরা-বকরা টুপি। আর চোখ! দেখলে মনে হয় যেন চোখ নয়, চোখের কোটরের মধ্যে কেউ জ্বলন্ত দু’টুকরো কয়লা বসিয়ে রেখেছে। মামাবাবু, অমন চেহারা একবার দেখলে আর ভোলা যায় না, সারা জীবন মনে থাকে। আমিও দেখবামাত্র বুঝতে পারলুম যে, এ আর কেউ নয়, মোম্বাসার সেই…”
কথাটা শেষ হল না। গল্পের সূচনাতেই সদানন্দবাবু সেই যে তাঁর দোদুল্যমান পা দুটিকে সোফার উপরে টেনে নিয়ে জোড়াসন হয়ে বসেছিলেন, তারপরে আর নীচে পা নামাননি। সেই অবস্থাতেই মাথাটাকে যতটা সম্ভব সামনে ঝুঁকিয়ে ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, “কালীচরণ?”
অমু বলল, “তা ছাড়া আর কে! সেই যে আফ্রিকায় আমার পিছু নিয়েছিল, এখনও আমাকে ছাড়েনি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু অমু, তুমিই তো বললে যে, ঘরে খিল আঁটা ছিল। তা হলে সে ঘরের মধ্যে ঢুকল কী করে?”
“সে তো আমিও বুঝতে পারছি না,” অমু বলল, “অথচ ঢুকে যে ছিল, তাও তো মিথ্যে নয়। আবার ঘর থেকে যখন বেরিয়ে গেল, তখনও যে সে দরজার খিল খোলেনি, তাও আমার স্পষ্ট মনে আছে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “বাবা রে! তারা ব্রহ্মময়ী মা গো। যা বলচ, তাতে তো গায়েরা লোম খাড়া হয়ে যায় হে।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “চোখের ভুল। ওই যাকে দৃষ্টিবিভ্রম বলে আর কী। জাস্ট গো টু অ্যান আই-স্পেশ্যালিস্ট অ্যান্ড গেট ইয়োর আইজ থরোলি এগজামিনড। ভাল কোনও স্পেশ্যালিস্টের সঙ্গে জানাশোনা আছে? না থাকে তো বলো, আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি।”
কৌশিক এতক্ষণ চুপ করে ছিল। বাবার কথা শুনে বলল, “কী যে বলো, বাবা! অমু যে একজন চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার, তার ওপরে একটা মাল্টিন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন কোম্পানির পুরো একটা ডিভিশনের কর্তা, সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন? ওর কাজ তো পুরো চোখেরই কাজ। গাদা-গাদা প্ল্যানের মাইনিউটেস্ট ডিটেল পর্যন্ত যাকে দেখে দিতে হচ্ছে, যে-সব প্ল্যানের যে-কোনও একটা ছোট্ট ভুলও নজর এড়িয়ে গেলে একটা ডিজাসটার হয়ে যাওয়াও কিছু বিচিত্র নয়, তার চোখের দোষ থাকলে চলে?”
অমু বলল, “কৌশিক ঠিক বলেছে মেসোমশাই। ডক্টর পট্টনায়কের নাম শুনেছেন নিশ্চয়?”
“তা কেন শুনব না?” অরুণ সান্যাল বললেন, “দিল্লির নামজাদা আই স্পেশ্যালিস্ট। কিন্তু তাঁর অ্যাপয়ন্টমেন্ট পাওয়া তো শুনেছি ভীষণ শক্ত, সারাক্ষণ নাকি ভিড় লেগে আছে।”
“তা লেগে আছে ঠিকই, কিন্তু আমার খুব-একটা অসুবিধে হয়নি। আমাদের কোম্পানি থেকে অ্যাপয়ন্টমেন্ট করে দেওয়া হয়েছিল। তো তিনি খুব যত্ন করে পরীক্ষা করে বললেন, নাথিং রং, কোথাও কিছু গণ্ডগোল নেই।”
মালতী ইতিমধ্যে আর-এক রাউন্ড চা পাঠিয়ে দিয়েছিল। পিরিচ থেকে পেয়ালা তুলে তাতে ছোট্ট একটা চুমুক দিলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর পেয়ালাটাকে নামিয়ে রেখে সেন্টার টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে অরুণ সান্যালের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এটা চোখের ব্যাপার নয়, অরুণ।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “ তা হলে?”
“মনের ব্যাপার। হ্যালুসিনেশন।”
সদানন্দবাবু বললেন, “সেটা আবার কী?”
“ধরুন,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কাউকে নিয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করছেন। এমন অনেক সময়ই করেন তো?”
“তা করি বই কী।”
“তখন মনের মধ্যে তার একটা ছবিও ফোটে নিশ্চয়?”
“তা তো ফোটেই।”
“হ্যালুসিনেশন হচ্ছে তারই একটা প্রোেজকশানের ব্যাপার।” ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “মনের ছবিটা বাইরে প্রোজেক্টেড হল, এই আর কী। কিন্তু আপনি সেটা বুঝলেন না; আপনি ভাবলেন, যার কথা চিন্তা করছিলেন, সত্যি বুঝি তাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। আসলে এটা কিন্তু চর্মচক্ষে দেখা নয়, পুরোপুরি মনশ্চক্ষে তাকে দেখছেন আপনি। ইটস আ ট্রিক ইয়োর মাইন্ড হ্যাজ প্লেড অন ইউ।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “দ্যাট’স ইট। বুঝলে হে অমু, দাদা ঠিকই বলেছেন। তা মোম্বাসার সেই কালীচরণকে নিয়ে ইদানীং খুব ভাবছিলে বুঝি?”
অমু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “মোটেই না। ভাবছিলুম ঠিকই, তবে কালীচরণকে নিয়ে নয়।” কৌশিক বলল, “তা হলে কী নিয়ে ভাবছিলি?”
“সে তো গোড়াতেই বলেছি।” অমু বলল, “আমাদের কোম্পানির কাজের যে এরিয়া, হালে তার একটা বড় রকমের এক্সটেনশান হচ্ছিল, আর তাই নিয়ে দেখা দিচ্ছিল এমন কয়েকটা সমস্যা, যা তক্ষুনি-তক্ষুনি সর্ট আউট না করলেই নয়। দায়িত্বটা আমার ঘাড়ে এসে পড়ে। কিন্তু সর্ট আউট করব কী, নিজেরই কয়েকটা পারিবারিক ঝঞ্ঝাটে আমি তখন এমন ব্যতিব্যস্ত যে, আপিসের কাজে মনই বসাতে পারছিলুম না। তা কৌশিক, আমাদের আপিসে যে একটা মেডিটেশান সেন্টার আছে, সেটা জানিস তো?”
প্রশ্নটা কৌশিককে করা হয়েছিল, কিন্তু উত্তরটা এল কৌশিকের বাবার কাছ থেকে। অরুণ সান্যাল হেসে বললেন, “তোমাদের আপিসে আছে কি না জানি না, তবে আজকালকার অনেক আপিসে ই আছে। কাজের টেবিলে বসার আগে কি কারখানার ফ্লোরে ঢোকার আগে যোগের কয়েকটা আসন করা, আর অন্তত মিনিট পাঁচ-সাত মেডিটেশান করা সেখানে একেবারে কম্পালসারি। ওতে নাকি কাজে মন বসাবার ব্যাপারে খুব সুবিধে হয়।”
সদানন্দবাবু বললেন, “যাব্বাবা, কাজে বসার আগে মেডিটেশান! মানে ধ্যান? ধ্যান তো সন্নিসিরা করে! ও মশাই, আপনি এ-সবে বিশ্বেস করেন নাকি?”
অরুণ স্যানাল বললেন, “ধুস, যত্ত সব ফ্যাড!”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “না হে অরুণ, সত্যিই নাকি ওতে কাজ হয়।”
অমু বলল, “সত্যিই হয়, মামাবাবু। তো যা বলছিলুম। ঘাড়ে একটা দায়িত্ব এসে পড়েছে, অথচ অনেক চেষ্টা করেও কাজে মন বসাতে পারছি না, ফলে আর উপায় না দেখে শেষপর্যন্ত আমি আমাদের মেডিটেশান-সেন্টারে চলে যাই। গিয়ে, সেখানে যিনি চার্জে আছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করে আমার সমস্যার কথা খুলে বলি।”
“তিনি তাতে কী বললেন?”
“বললেন যে, আপিস থেকে বাড়ি ফিরে আমাকে আরও গোটা দুই আসন করতে হবে। আর হ্যাঁ, আমার আসল সমস্যা তো কনসেনট্রেশনের, তো সেটা যাতে হয়, তার জন্যে আমাকে কোনও কিছু নিয়ে ডিপলি কিছু চিন্তা করার আগে অন্য তাবৎ চিন্তা থেকে মনকে একেবারে পুরোপুরি মুক্ত করে ফেলতে হবে।”
কৌশিক বলল, “তার মানে?”
“তার মানে মনটাকে একেবারে ফাঁকা, ব্ল্যাঙ্ক করে ফেলা চাই।” অমু বলল, “আমাদের মেডিটেশান সেন্টারের ট্রেনার প্রোফেসর যোগলেকর বললেন, ঘুমুতে যাবার আগে রোজ এই ধরুন হাফ অ্যান আওয়ার চেষ্টা করে দেখুন। হয়ে যাবে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “হল?”
“প্রথম দু’দিন হয়নি, হল থার্ড নাইটে। সুলেখা আর বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়ার পর আমার লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে, দরজায় খিল এঁটে রাত সাড়ে এগারোটায় মেডিটেশানে বসি, আর বারোটার মধ্যেই মন একদম ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যায়।”
এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে অমু বলল, “তার পরেই ঘটে এক তজ্জব কাণ্ড। আমাদের কাজকর্মের এরিয়ার এক্সটেনশান নিয়ে ওই যে কতগুলো অলমোস্ট ইনসারমাউন্টেবল সমস্যার কথা বলছিলুম, বললে বিশ্বাস করবেন না,মামাবাবু, তার সলিউশনগুলো একেবারে টকাটক আমার মাথায় এসে যেতে থাকে। ওয়ান আফটার অ্যানাদার। ওরই মধ্যে এমন জটিল একটা ক্যালকুলেশানের অঙ্ক ছিল, যার উত্তর কিছুতেই মেলানো যাচ্ছিল না। কিন্তু সেটাও মিলিয়ে ফেলি, ইন আ ফ্ল্যাশ!”
অমু চুপ করার পর মিনিট খানেক কেউ কোনও কথা বলল না। সবাই চুপচাপ বসে আছি। সেই নীরবতাকে ভাদুড়িমশাই-ই প্রথম ভাঙলেন। প্রশ্ন করলেন, “তার পরে আর মেডিটেশানে বসোনি?” হঠাৎই কেমন যেন নিষ্প্রভ ঠেকল অমুকে। নিচু গলায়, প্রায় আত্মগতভাবে বলল, “তার পরেও দিন তিন-চার বসেছিলুম, কিন্তু কী জানি কেন, তারপরে আর দরকারই হত না। বিনা মেডিটেশানে, বিনা চেষ্টায় মনটা মাঝে-মাঝে ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যেতে লাগল। দিনের মধ্যে যে-কোনও সময়ে, যে-কোনও জায়গায়। আর তখনই ঘটত একটা অদ্ভুত ব্যাপার।”
কী ব্যাপার, সেটা বলার আগে বোধহয় জানানো দরকার যে, অমু কে। অবশ্য ভাদুড়িমশাইয়ের হরেক কাহিনী যাঁরা পড়েছেন, অমু অর্থাৎ অমিতাভকে তাঁদের না-চেনার কথা নয়। অমিতাভ ঘোষ আমাদের কৌশিকের বাল্যবন্ধু। অরুণ সান্যালরা যখন যতীন বাগচি রোডে থাকতেন, কৌশিক আর অমিতাভ তখন একই ইশকুলে একই ক্লাসে পড়ত। অমিতাভ পরে শিবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেরোয়। চাকরির সূত্রে প্রথম দিকে তাকে আফ্রিকার কিনিয়ায় যেতে হয়েছিল। সেই সময়ে মোম্বাসা বন্দরে কালীচরণ নামে একটি রহস্যময় লোকের সঙ্গে তার দেখা হয়। লোকটিকে রহস্যময় বলছি এই কারণে যে, বিস্তর চেষ্টা করেও তার সম্পর্কে বলতে গেলে প্রায় কিছুই জানা যায়নি। এদিকে অমিতাভর ধারণা, কালীচরণ তার পিছু নিয়েছে আর আড়াল থেকে নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে তার গোটা জীবন। ‘আড়ালে আছে কালীচরণ’ বইটি যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয় এ-সব কথা জানেন। এখানে যা বলতে চাইছি, তা এই যে, সেই ঘটনার পরে তো বেশ কিছুকাল কেটে গেছে, তা অমিতাভর ইতিমধ্যে বিশ্বাস জন্মাতে শুরু হয়েছিল, কালীচরণ আর তাকে অনুসরণ করছে না। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে, সেটা ঠিক নয়, কালীচরণ তাকে ছাড়েনি। অমিতাভর জীবনে কীভাবে সে ফের দেখা দিয়েছে, তা তো গোড়াতেই বলেছি। এবারে আবার এই কাহিনীর খেই ধরা যাক।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এতক্ষণ যা বলেছ, সেটাই তো যথেষ্ট অদ্ভুত ব্যাপার। তারপরেও আবার কী অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল?”
অমুর সোফার পাশের সাইড-টেবিলে একটা কাচের জারে জল রাখা রয়েছে। জার থেকে গেলাশে জল ঢেলে নিয়ে পুরো এক গেলাশ জল ঢকঢক করে খেয়ে নিল অমু। তারপর পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখের ঘাম মুছে বলল, “যখন-তখন যেখানে-সেখানে আমার মন একদম ফাঁকা হয়ে যায়। সকালে, দুপুরে, বিকেলে, রাত্তিরে। বাড়িতে, আপিসে, বাজারে, রাস্তায়। আপিসে কনফারেন্স রুমে আমার কলিগদের সঙ্গে কথা বলছি, তখন। রাস্তায় গাড়ি চালাতে-চালাতে সিগন্যাল দেখে ব্রেক কষেছি, তখন। বাড়িতে ডাইনিং টেবিলে বসে আপনাদের বউমা’র সঙ্গে সাংসারিক কথাবার্তা সেরে নিচ্ছি, তখন। বাচ্চাটাকে তার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে নামিয়ে দিয়ে গাড়িতে ফিরে ফের স্টার্ট দিচ্ছি, তখন। একেবারে হঠাৎ-হঠাৎ মন একদম ব্ল্যাঙ্ক। কোথায় আছি, কী করছি, কিচ্ছু তখন আমার মনে নেই। উঃ, সে যে কী বিদঘুটে কাণ্ড, তা আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না।
সদানন্দবাবুর চোয়াল ঝুলে পড়েছিল। হাঁ বুজিয়ে ঢোক গিলে বললেন, “বলো কী হে, এ তো অতি বিচ্ছিরি ব্যাপার!”
“বিচ্ছিরি বলে বিচ্ছিরি।” অমু বলল, “কনফারেন্স রুমে কোনও কলিগকে কিছু বলতে-বলতে মাঝপথে চুপ করে যাই। সে তাজ্জব হয়ে বলে, তারপর? অথচ আমার মুখে কোনও কথা জোগায় না। বাড়িতে আপনাদের বউমা বলে, কী হল, অমন হাঁ করে কী দেখছ? অথচ আমি চুপ করে থাকি। রাস্তায় গ্রিন সিগন্যাল পাবার পরেও গাড়িতে স্টার্ট দেবার কথা ভুলে যাই, পিছনের গাড়িগুলো অধৈর্য হয়ে ক্রমাগত হর্ন বাজাতে থাকে, ট্রাফিক পুলিশ ছুটে এসে বলে, কেয়া হুয়া সাব, গাড়ি কেয়া স্টার্ট নেহি লেতি? তখন আমার চমক ভাঙে। অবস্থাটা একবার ভাবুন।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ তো একটা ঘোরের অবস্থা। এটা কতক্ষণ থাকত?”
“খুব বেশিক্ষণ নয়। সে ফর আ মিনিট আর টু।” অমু বলল, “তবে যখনই এটা হত, তখনই আমার কানের কাছে অদ্ভুত একটা শব্দ শুনতে পেতুম। ঘরের মধ্যে একটা গুবরে পোকা উড়ে বেড়ালে যে-রকম শব্দ হয়, সেই রকমের একটা বাজিং সাউন্ড। যেন কেউ আমাকে কিছু বলবার চেষ্টা করছে, কিন্তু শব্দগুলো ঠিকমতো ফর্মড হচ্ছে না।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “কোনও ই.এন.টি.-কে কনসাল্ট করেছ?”
“করেছি। কিন্তু তিনি বললেন, নাথিং রং ইন মাই হিয়ারিং ফ্যাকাল্টি।”
কৌশিক বলল, “এখনও এটা হয়?”
“আগের মতো ঘন-ঘন হয় না। আগে তো প্রায়ই হত, আর এখন এই ধর মাসে এক-আধ বার।”
“তা হলে হয়তো আস্তে-আস্তে এটা একেবারেই কেটে যাবে।”
“সুলেখার ধারণাও সেইরকমই। “ অমুর গলা হঠাৎই ভীষণ ক্লান্ত শোনাল। “কিন্তু আমি ভাবছি কালীচরণকে নিয়ে। সে আবার হঠাৎ আমার জীবন এসে ঢুকে পড়ল কেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওই একবারই তো তাকে দেখেছ। ও নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই। ওটা হ্যালুসিনেশন। হয়তো মনে-মনে তার কথা খুব ভাবছিলে, সেই ভাবনাটাই সেদিন তোমার চোখের সামনে প্রোজেক্টেড হয়েছে।”
অমু দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল, “না মামাবাবু, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি, সেদিন আমি মোটেই কালীচরণের কথা ভাবছিলুম না। ভাবছিলুম আমারই লেখা একটা ওয়ার্ক-রিপোর্ট নিয়ে। ডিরেক্টর্স’ বোর্ডের মিটিংয়ে পরদিনই যেটা আমার সাবমিট করার কথা। একা ঘরে বসে রিপোর্টটা সদ্য লিখে শেষ করেছি, তারপর শুধু একটা জিরো-পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে রেখে অন্য সব আলোর সুইচ অফ করে দিয়ে চুপচাপ ভাবছি যে, রিপোর্টের দু-একটা জায়গায় দু-একটা কথা পরদিন সকালে একটু পালটে দেব কি না, ঠিক এমন সময় কালীচরণ আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। কী বলব, তাকে দেখে…”
কথাটা শেষ হবার আগেই মালতী এসে ঘরে ঢুকে বলল, “আর নয়, ঢের গপ্পো হয়েছে, এবারে উঠে পড়ো দিকি। তোমাদের খেতে দিয়েছি।”
ঠিক এই সময়েই অমুর সেল-ফোন হঠাৎ বেজে উঠল। পকেট থেকে সেল-ফোন বার করে মিনিট খানেক কানে লাগিয়ে রেখে অমু যখন সেটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখল, তখন দেখলুম, তার মুখচোখ হঠাৎই যেন কেমন ফ্যাকাশে লাগছে।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কে ফোন করেছিল?”
অস্ফুট গলায় অমু বলল, “কালীচরণ। স্রেফ একটা খবর দিল। বলল যে, সদানন্দবাবুর পকেটে যে একটা পাঁচশো টাকার নোট রয়েছে, সেটা জাল।”
সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখলুম, ভদ্রলোকের চোয়াল আবার ঝুলে পড়েছে।