জন ষ্টুয়ার্ট মিল

মিলের মৃত্যু হইয়াছে। আমরা কখন তাঁহাকে চক্ষে দেখি নাই; তিনিও কখন বঙ্গদর্শনের পরিচয় গ্রহণ করেন নাই। তথাপি আমাদিগের মনে হইতেছে যেন আমাদিগের কোন পরম আত্মীয়ের সহিত চিরবিচ্ছেদ হইয়াছে !

২৭ বৈশাখ তারিখের টেলিগ্রাম ২৮ তারিখে প্রকাশ হয় যে মিল সঙ্কটাপন্নরূপে পীড়িত। পরদিন প্রাতে মিলের কুশল জানিবার জন্য সাতিশয় আগ্রহচিত্তে সম্বাদপত্র খুলিলাম, দেখিলাম যে, চিকিৎসকেরা মিলের জীবনের আশা পরিত্যাগ করিয়াছেন। সেই দিবস অপরাহ্নে সম্বাদ আইসে যে মিল নাই!

ছয় হাজার মাইল দূরে থাকিয়া আমরা এই শোক পাইয়াছি, না জানি ইংলণ্ডবাসীরা কতই দুঃখ করিতেছেন! কিন্তু কেনই দুঃখ করি তাহা বলা যায় না! যে মহোদয় আপন বুদ্ধিবলে প্রায় সমস্ত মানব জাতিকে ঋণী করিয়াছেন, যিনি যাবজ্জীবন ঋণ প্রদানে নিযুক্ত ছিলেন এবং যিনি এতাদৃশ কীর্তি রাখিয়া গিয়াছেন যে, যে কেহ হউক যত্নসহকারে আবেদন করিলেই তাঁহার বদান্যতার ফলভোগী হইতে পারিবে, এরূপ মহাপুরুষ এত কাল পরে বিশ্রাম লাভ করিয়াছেন বলিয়া কেনই এত কাতর হই? তথাচ মৃত্যুশোক দূর হইবার নহে, “মিল নাই” এই কথা মনে করিলে চিত্ত স্বভাবতঃই ব্যথিত হয়।

মিল অতি সূক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন নৈয়ায়িক ছিলেন। তাঁহার কৃত ইংরাজি ন্যায়শাস্ত্র এবং অর্থব্যবহারশাস্ত্র তাঁহার প্রধান কীর্তি। ইহাতে তিনি যে কোন নূতন কথার উদ্ভাবন করিয়াছেন তাহা নহে কিন্তু এতৎসংক্রান্ত সমুদায় কথা এমন সুশৃঙ্খল করিয়া লিখিয়াছেন এবং প্রত্যেক বিষয় এত পরিষ্কার করিয়া বুঝাইয়াছেন যে, তাঁহার গ্রন্থ পাঠ না করিলে কাহারই উক্তশাস্ত্র অধ্যয়ন সম্পূর্ণ হইবেক না।

তিনি রাজ্যশাসনপ্রণালী বিষয়ে যে সমস্ত কথা বলিয়া গিয়াছেন, বোধ হয় যে, কিছুকাল পরে ইংলণ্ডে তাহা ফলধারণ করিবে। তাহার পরামর্শ ইংলণ্ডীয়দিগের প্রকৃতির উপযোগী বটে তথাপি অপর সাধারণে এখনও তাহার সম্পূর্ণ মর্মগ্রহণ করিয়া উঠিতে পারে নাই।

বিদ্যানুশীলন বিষয়ে তিনি যে পথ প্রদর্শন করিয়াছেন এখন সর্বত্র সকলেই সেই পথানুসারী হইতেছে। মিল বলিয়াছেন যে, যেমন চৌর্য প্রভৃতি অপরাধ নিবারণের উপায় রাজা কর্তৃক নির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক, তদ্রূপ তাবৎ লোককে লেখাপড়া শিক্ষা দেওয়াও রাজার কর্তব্য। তাঁহার ঐকান্তিক বাসনা ছিল যে উত্তম অধম, ধনী দরিদ্র, ভদ্র অভদ্র সকলেই বিদ্যাভ্যাস করিবে; সর্বত্র বিজ্ঞানশাস্ত্রের চর্চা বর্ধিত হইবে এবং ধর্মোপদেশ বিষয়ে রাজার হস্তক্ষেপ করা কর্তব্য নহে। কাজে না হউক মনে মনে প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীগণ প্রায় সকলেই এই সকল কথার যৌক্তিকতা স্বীকার করিয়াছেন।

মনোবিজ্ঞানশাস্ত্রে মিল অনেকের যথেচ্ছচারিতা দমন করিয়াছেন। এখন Absolutist বলিয়া কাহারও পরিচয় দিলে তাঁহার একপ্রকার নিন্দা করা হয়। এতাদৃশ সংস্কার বিস্তার করণ পক্ষে মিলের আয়াস যথেষ্ট ফললাভ করিয়াছে।

মিল শেষাবস্থায় সামাজিক ব্যবস্থা বিষয়ে দুটি নূতন কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলেন। প্রথমতঃ তাঁহার মতে স্ত্রীজাতি সর্বতোভাবে পুরুষের তুল্য, অতএব যাহাতে উভয় জাতির শ্রেষ্ঠ নিকৃষ্ট সম্বন্ধ দূরীকৃত হয় মিল তাহার জন্য অতিশয় চেষ্টিত ছিলেন। পরিণামে ইহার কি হয় বলা যায় না কিন্তু ইউরোপে ও আমেরিকার অবস্থার প্রতি মনোনিবেশ করিয়া দেখিলে বোধ হয় না যে, যে উদ্যম আরম্ভ হইয়াছে তাহা সহসা ভঙ্গ হইবেক। এই বিষয়ক চিন্তাকালে আমাদিগের মনে হয় যেন মিল আপন স্ত্রীবিয়োগের পর তাঁহার গাঢ় পত্নীভক্তি কার্যে পর্যবসিত করণার্থ ব্রত স্বরূপ এই চেষ্টাতে প্রবৃত্ত হয়েন।

এস্থলে এ কথা বলিলে তাঁহার মনের ভাব কতক প্রকাশ হইবেক যে, ফরাসিদেশে আডিনে নামক নগরের এক গির্জার সমাধিক্ষেত্রে মিলের স্ত্রী সমাধিস্থ হয়েন এবং ঐ সমাধি সর্বদা দেখিতে পাইবেন বলিয়া মিল তাহার নিকটবর্তী একটি বাটী ক্রয় করেন। সেই বাটীতে এরিসিপেলাস রোগে তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে।

দ্বিতীয়; মিলের কল্পনা এই যে পৃথিবীর ভূমিসম্পত্তির উপস্বত্ব ক্রমশঃই বর্ধিত হইতেছে; ইহার কিয়দংশ কেবল মাত্র সভ্যতার উন্নতিজনিত; তাহাতে কাহারও আয়াস বা অর্থব্যয় হয় না, কিন্তু কেবল কতিপয় ভূম্যধিকারীই তাহার ফলভোগী হয়েন। যদ্যপি উপস্বত্বের এই বর্ধিত অংশ রাজহস্তে সমর্পিত হয়, তবে ক্রমশঃ রাজকরের লাঘব হইয়া রাজ্যস্থ তাবৎ লোকেই ইহার কিছু কিছু অংশ পাইতে পারেন। অতএব ইহার সদুপায় করা কর্তব্য। মিল এই কার্যে অতি অল্পদিন হইল হস্তক্ষেপণ করিয়াছিলেন, তাঁহার মৃত্যুর পরে যে হঠাৎ আর কেহ ইহাতে প্রবৃত্ত হইবেন, বোধ করি তাহার সম্ভাবনা অল্প।

মিল প্রথমাবস্থায় অনেক বিষয়ে কোম্‌তের সহিত একমত ছিলেন কিন্তু পরিণামে নানা মতভেদ উপস্থিত হয়। আমরা মনে করি যে পরস্পরের বিবাদের স্থূল কথা এই যে,—

ব্যক্তিবিশেষ ও জনসমাজ এতদুভয় মধ্যে, মিলের মতে ব্যক্তির প্রাধান্য রক্ষা করিয়া সমাজের উন্নতিসাধন করিতে হইবেক নতুবা পৃথিবী ক্রমশঃ নিস্তেজ হইয়া যাইবেক।

আর কোম্‌ৎ বলেন যে, সহস্র চেষ্টা করিলেও মনুষ্যের স্বার্থানুরাগ পরহিতৈষিতা অপেক্ষা ক্ষুণ্ণ হইবেক না; ব্যক্তিবিশেষের প্রাধান্য রক্ষার্থ যত্ন প্রয়োগ হইলে, সে যত্নের দ্বারা সমাজের যে উন্নতি হইতে পারিত তাহার ব্যাঘাত হইবেক। অতএব স্বার্থানুরাগ কেবল দমন করিবার চেষ্টা করাই কর্তব্য।

মিল ও কোম্‌তের ন্যায় মহোপাধ্যায়গণ যে সকল বিষয়ের ঐক্যমত সংস্থাপন করিতে পারেন নাই, তাহার কোন পক্ষের মত সমর্থন করা সামান্য লোকের পক্ষে অবশ্যই অসাধ্য। সুতরাং মতদ্বয় মধ্যে কোন্‌টি শ্রেষ্ঠ এবং কোন্‌টি নিকৃষ্ট তদ্বিষয়ে আমরা কোন কথা বলিতে পারি না। কিন্তু এই পর্যন্ত বলিতে ইচ্ছা করি যে, মিল, কোম্‌ৎ দর্শন বিচার করিবার জন্য Auguste Comte and Positivism নামক যে পুস্তক রচনা করিয়াছেন, তাহাতে জনসমাজের কথঞ্চিৎ ক্ষতি হইয়াছে। কিন্তু তাহা মিলের অভিপ্রেত নহে বলিয়া তজ্জন্য মিলকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। অনেকে কোম্‌তের গ্রন্থ পাঠ করা দুরূহ বলিয়া মিলের গ্রন্থ হইতে তাঁহার মতের সার সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইহার পরিণাম কেবল এই মাত্র হয় যে, যেমন কিছুদিন পূর্বে খৃষ্টান মহাশয়েরা সকল কথা না বুঝিয়া কেবল হিন্দুধর্মের প্রতি ব্যঙ্গ করিতেই পটু হইতেন, মিলকৃত কোম্‌ৎভাষ্যের পাঠক মহাশয়েরাও তদ্রূপ কেবল ব্যঙ্গ করিবার ক্ষমতা লাভ করেন।

মিলের ধর্ম বিষয়ে আমরা কোন কথা বলিতে ইচ্ছা করি না, কারণ তিনি নিজে তাহা পরিষ্কাররূপে ব্যক্ত করেন নাই। ইহাতে তিনি নিন্দাভাজন হইয়াছেন কি না তদ্বিষয়ে দ্বিমত থাকিতে পারে। কিন্তু যদি তিনি স্বয়ং আপন প্রকৃত বিশ্বাস গোপন করিবার চেষ্টা করিয়া থাকেন, তবে অন্যের পক্ষে তাহার আন্দোলন করা বন্ধুর কার্য হইতে পারে না।

আমরা এতক্ষণ যে সকল বিষয়ের আলোচনা করিতেছিলাম, তাহাতে আমরা সমগ্র মানব জাতির সহিত ভ্রাতৃসম্পর্কে আবদ্ধ। কিন্তু ভারতবাসী বলিয়া মিলের সহিত আমাদের আরো কিছু সম্পর্ক আছে। যৎকালে ভারতবর্ষ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃত্বাধীন ছিল তখন মিল প্রথমতঃ ইষ্ট ইণ্ডিয়া হাউসের একজন কেরানি এবং পরিশেষে চিঠিপত্র-পরীক্ষকের কার্য করিতেন। কোর্ট অব্ ডাইরেকটর হইতে ভারতবর্ষে যে সকল আজ্ঞালিপি আসিত তাহা মিলের পরীক্ষা ভিন্ন প্রেরিত হইত না। কিম্বদন্তী আছে যে, ভারতবর্ষের বিদ্যাশিক্ষাবিষয়ক সন ১৮৫৪ সালের প্রসিদ্ধ লিপিরচনাকার্যে মিলের বিশিষ্ট সাহায্য ছিল। ফলতঃ উহাতে যেরূপ নিয়ম নির্দিষ্ট হইয়াছে তাহার সহিত মিলের Liberty নামক পুস্তকোক্ত মতের সম্পূর্ণ ঐক্য লক্ষিত হইবেক।

ভারতবর্ষের রাজকার্য মহারাণীর কর্মচারিগণের হস্তে অর্পিত হইবার সময় মিলকে ইণ্ডিয়া কৌন্সিলের মেম্বর হইতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু ঐ নূতন বন্দোবস্ত মিলের মতে অযৌক্তিক বলিয়া তিনি উক্ত পদ গ্রহণ করেন নাই। তৎকালে ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ হইতে, মহারাণীকে এই কার্য হইতে ক্ষান্ত করিবার জন্য এক আবেদন করা হয়। কথিত আছে যে, মিল তাহার রচনা করিয়াছিলেন। উক্ত আবেদনে লিখিত ছিল যে, ভারতবর্ষের ন্যায় রাজ্য পার্লিয়ামেণ্টের অধীন না হইয়া কোম্পানির অধীন থাকিলে ভারতবাসীদিগের মঙ্গল হইবেক, নতুবা তাহারা ইংলণ্ডের দলাদলির আক্রোশে পড়িয়া নিতান্ত উৎপীড়িত হইবেক। তৎকালে এই কথার প্রতি কেহই তাদৃশ মনোযোগ করেন নাই; কিন্তু এখন ইহাকে তুচ্ছ করিতে পারে এমন লোক কে আছে?

জীবনবৃত্তান্ত লিখিবার প্রথা অনুসারে মিলের বিষয়ে, নিম্নলিখিত তারিখগুলি সংগ্রহ করিয়া দেওয়া গেল।

মিলের জন্ম১৮০৬
তৎকৃত System of Logic নামক ন্যায়শাস্ত্র প্রকাশ১৮৪৩
Essay on Unsettled Questions of Political Economy  প্রকাশ১৮৪৪
মিল ইষ্ট ইণ্ডিয়া হৌসের Examiner of Indian Correspondence পদে নিযুক্ত১৮৫৬
মিল উক্ত কর্ম ত্যাগ করেন১৮৫৮
মিলকৃত Essays on Liberty প্রকাশ১৮৫৯
Dissertations and Discussions Political &c. প্রকাশ১৮৫৯
Thoughts on Parliamentary Reforms প্রকাশ১৮৫৯
Principles of Political Economy (অর্থব্যবহারশাস্ত্র) প্রকাশ১৮৬১
Considerations on Representative Government প্রকাশ১৮৬১
Utilitarianism প্রকাশ১৮৬২
Auguste Comte & Positivism প্রকাশ১৮৬৫
মিল পার্লিয়ামেণ্টের মেম্বর হয়েন১৮৬৫
Examination of Sir W. Hamilton’s Philosophy প্রকাশ১৮৬৫
তৎকৃত Inaugural Address delivered to the University of St. Andrew প্রকাশ১৮৬৭
England and Ireland প্রকাশ১৮৬৮
Subjection of Women প্রকাশ১৮৬৮
মিলের মৃত্যু১৮৭৩

—‘বঙ্গদর্শন’, শ্রাবণ ১২৮০, পৃ. ১৪৫-৪৮।