কামিনীর কণ্ঠহার – ৯

আজ চৌঠা মে, শনিবার। কাল রাতে মন চঞ্চল ছিল, তাই ঘুম আসতে দেরি হয়। আজ অবশ্য সকাল-সকালই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছি। চোখমুখ ধুয়ে চা খেয়ে, ডুণ্ডা ভ্যালির এই কম্পাউন্ডের মধ্যেই এক চক্কর ঘুরেও এলুম। বার্টি আজ সাড়ে সাতটার মধ্যেই ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছে, দুখনকে সঙ্গে করে আটটা নাগাদ সে তার গাড়ি নিয়ে বেরিয়েও গেল। কাছেই একটা পাহাড়ি বস্তিতে গিয়ে রোগী দেখবে, বারোটা সাড়ে বারোটার আগে ফিরবে না।

উপরে উঠে ভাদুড়িমশাইয়ের ঘরে গিয়ে তাঁকে পেলুম না। বাইরের বারান্দায় গিয়ে দেখলুম, সেখানে বসে তিনি কামিনীর সঙ্গে কথা বলছেন। পাশে বসে আছেন সদানন্দবাবু। আমাকে দেখে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আসুন কিরণবাবু। আপনার খোঁজ করেছিলুম, শুনলুম আপনি বাইরে বেরিয়েছেন। মিনিট পাঁচেক আগে আবার ফোন করেছিল সে।”

বললুম, “সে মানে কে? সেই লোকটা, যে কাল রাতে ফোন করেছিল?”

কামিনী বলল, “হ্যাঁ। ফোন করে হুমকি দিয়ে মনে করিয়ে দিল যে, মুক্তোর মালাটা তার আজই চাই। কাউকে দিয়ে যেন সেটা পাঠাবার ব্যবস্থা করি। যাকেই পাঠাই, সে যেন ঠিক সেখানেই মালাটা রেখে আসে।”

“কখন রেখে আসবে, তাও বলল নাকি?”

“হ্যাঁ, আগের বারের মতো রাত ঠিক আটটায়।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “মুক্তোর মালার কেসটা সেই আগের মতোই প্যাক করে রেখেছিস তো?”

“কাল রাত্তিরেই উপরে উঠে প্যাক করে রেখেছি। বার্টি অঘোরে ঘুমুচ্ছিল, কিচ্ছু টের পায়নি।”

“পাঠাবি কাকে দিয়ে?”

“আগের বারে তো লিজাকে দিয়ে পাঠিয়েছিলুম।”

“এবারেও তা হলে তাকে দিয়েই পাঠা।…নাকি তাতে কোনও অসুবিধে আছে?”

“নেই বলি কী করে?” কামিনী একটু ইতস্তত করে বলল, “সে-বারে তো এককথায় রাজি হয়নি, প্রথমটায় সরাসরি ‘না’-ই বলে দিয়েছিল।”

“সে তো ওর নাইট-ডিউটির জন্যে।”

“হ্যাঁ, বলেছিল যে, প্যাকেটটা যেখানে পৌঁছে দিতে হবে, সেই জায়গাটা ওর বাড়ির থেকে তেমন কিছু দূরে নয় ঠিকই, তবে কিনা রাত আটটায় যদি সেখানে যেতে হয় তো হাসপাতালে পৌঁছতে ওর দেরি হয়ে যাবে।”

“কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছিল ঠিকই।”

“তা হয়েছিল,” কামিনী বলল, “কিন্তু এবারেও যে রাজি হবে, তা কী করে বলি?”

“আহা, একবার অনুরোধ করেই দ্যাখ না,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোরই কাছে শুনেছি যে, নম্র স্বভাবের সফ্ট-স্পোকন মেয়ে, তাই অসুবিধে একটু আছে ঠিকই, তবু জাস্ট টু প্লিজ ইউ, রাজি হয়তো হয়েও যেতে পারে। অ্যাট লিস্ট দেয়ার’স নো হার্ম ইন আস্কিং। তা-ই না?”

“আর যদি রাজি না হয়?” কামিনী বলল, “তখন কী করব? বাড়ির কাজের লোকেদের তো আর অনুরোধ করা যায় না, পাঁচকান হবে। তা-ছাড়া, ওরা কেউ রাজি হবে বলে মনেও হয় না। যা ওদের ভূতের ভয়!”

“ঠিক আছে,” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “লিজা যদি রাজি না হয় তো সদানন্দবাবুই কাজটা করে দেবেন। কী সদানন্দবাবু, আপনি রাজি তো?”

সদানন্দবাবুর যে ভিতরে-ভিতরে এত সাহস, সেটা জানতুম না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, “অফ কোর্স। কুছ পরোয়া নেই ম্যাডাম, আমি যাব।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে তো গোল মিটেই গেল। তবে হ্যাঁ, লিজাকে একবার অনুরোধ করেই দ্যাখ না। তার তো কালই আসার কথা ছিল। কিন্তু আসেনি। তবে আজ আসবে। তা-ই তো?”

“হ্যাঁ।”

“কখন আসবে?”

“ঠিক দশটায়।” কামিনী বলল, “নিজের স্কুটারে আসে, একদিনও দেরি করে না।”

ভাদুড়িমশাই তাঁর হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, “ওরেব্বাস, এখন তো সাড়ে ন’টা। তা হলে ব্রেকফাস্ট করবি কখন? চল চল, নীচে যাই, লিজা আসার আগে ব্রেকফাস্টটা করে নে!”

“যেদিন মাসাজ থাকে, সেদিন আর আমি ব্রেকফাস্ট করি না।” কামিনী বলল, “সকালে এক গ্লাস দুধ খেয়ে নিয়েছি, ওতেই হবে।”

“ঠিক আছে,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুই যখন ব্রেকফাস্ট করবি না, তখন আমাদেরও কিছু তাড়া নেই। লিজা এলে তখন আমরা নীচে নামব। ইতিমধ্যে একটা কথা মনে করিয়ে দিই। লিজা তো এক ঘন্টা এখানে থাকে, দশটায় এসে এগারোটায় চলে যায়। তা-ই না?”

“হ্যাঁ।”

“তা আজ যখন ফিরে যাবে, তখন ওকে রিকোয়েস্টটা করতে ভুলিস না কিন্তু।”

“তা করব। তবে রাজি হবে কি না, সন্দেহ আছে।”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “রাজি না-হলেও তো সমস্যা হচ্ছে না। ইন দ্যাট কেস আমাদের সদানন্দবাবু তো আছেনই। তোর ওই প্যাকেটটা তিনিই যথাসময়ে যথাস্থানে পৌঁছে দেবেন।”

শব্দ শুনে বুঝেছিলুম, একটা মোটর-বাইক এই হাউসিং কমপ্লেক্সের ভিতরে এসে ঢুকেছে। সেকেন্ড কয়েক বাদেই একতলায় সদর-দরজার বেল বেজে উঠল। তারও একটু পরে দোতলার কাজের লোকটি এসে জানাল, মেমসাব এসে গেছেন। কামিনী বলল, “মেমসাবকে উপরে নিয়ে আয়।”

ভাদুড়িমশাই উঠে পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “চলুন, আপনাদের ঘরে গিয়ে বসা যাক। ওটা একটু দূরে। ওখানে কথা বললে এখান থেকে শোনা যাবে না।”

লিজা ওয়েভার্লি দোতলায় ওঠার আগেই আমরা আমাদের ঘরে চলে এলুম। অর্জুন আমাদের ঘরের সামনের ছাতে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের দেখে বলল, “খোকি তো আজ নাস্তা খাবে না, আপনারা কি নীচে গিয়ে নাস্তা খাবেন, নাকি উপরে পাঠিয়ে দেব?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “নীচেই যাব, তবে এখন নয়। আধঘন্টা বাদে যাব।”

অর্জুন নীচে চলে গেল।

ঘরে ঢুকে ভাদুড়িমশাই জানলা-দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর পাঞ্জাবির পকেট থেকে তাঁর সেলফোন বার করে বললেন, “আপনারা গল্প করুন, এখন আমি পরপর কয়েকটা ফোন করব।”

দুতরফা কথা শোনার তো উপায় নেই, একমাত্র ভাদুড়িমশাইয়ের কথাই আমরা শুনতে পাচ্ছি। সেই একতরফা কথা এই রকম:

“আমি চারু ভাদুড়ি কথা বলছি। সব ঠিক আছে তো?…ভেরি গুড। রিপোর্টটা কখন পাওয়া যাবে?…ঠিক আছে, তা হলেই হবে। পরের কাজটাই সবচেয়ে জরুরি। ছ’টা নাগাদ বাচ্চাটাকে তুলে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নিজের কাছে নয়, এস. পি.-র সঙ্গে আলাপ-পরিচয় আছে?…নেই? তা হলে তোমাদের মধ্যে যে তাঁকে চেনে, মিনিট দশেকের মধ্যে তাকে আমার মোবাইল নাম্বারে ফোন করতে বলো। দিস ইজ ভেরি ভেরি আর্জেন্ট। ওভার।”

ফোনটা অফ করেই ফের চালু করলেন ভাদুড়িমশাই। ডায়াল করে যার সঙ্গে কথা বললেন, তার দিকের কথা শুনতে পাবার প্রশ্নই নেই। একতরফা কথা যা শুনলুম, তা এই:

“হ্যালো, আমি ফাইভ জিরো ডাবল এইট কথা বলছি…অত ‘স্যার স্যার’ কোরো না, যা জিজ্ঞেস করছি, তার জবাব দাও। উত্তরকাশীর এস.পি.-র সঙ্গে আলাপ পরিচয় আছে?…নেই? তা হলে তোমাদের মধ্যে যে তাঁকে চেনে, মিনিট দশেকের মধ্যে তাকে আমার মোবাইল নাম্বারে ফোন করতে বলো। দিস ইজ ভেরি ভেরি আর্জেন্ট। ওভার।”

ফোনটা আবার অফ করে দিলেন ভাদুড়িমশাই। আমি আমার হাতঘড়ির দিকে চোখ রেখেছিলুম। দেখলুম সেটা বেজে উঠল ঠিক সাত মিনিট বাদে। যন্ত্রটা তুলে ভাদুড়িমশাই বললেন :

“ইয়েস, দিস ইজ ফাইভ জিরো ডাবল এইট…তুমি ওঁকে চেনো তা হলে?…ভেরি গুড। ওঁকে ফোন করে আমার পরিচয় দাও, তারপর বলো যে, বিকেল সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে আমার চিঠি নিয়ে একজন লোক আজ ওঁর কাছে যাবে, উনি যেন দু’জন কনস্টেবলকে তার সঙ্গে দিয়ে দেন।…না, উর্দি-পরা কনস্টেবল নয়, প্লেন-ড্রেস পোলিসম্যান। তবে হ্যাঁ, সঙ্গে যেন আইডেন্টিটি কার্ড থাকে।…যদি রাজি না হন? ঠিক আছে, তা হলে ভয় দেখাবে, বলবে যে, আমি সেক্ষেত্রে ওঁর ওপরওয়ালার সঙ্গে যোগাযোগ করব, তবে হ্যাঁ, একই সঙ্গে এটাও বোলো যে, সেরকম না হওয়াটাই বাঞ্জনীয়।…কী বলছ, তার দরকার হবে না? ভাল। তা হলে আর দেরি কোরো না, সাড়ে দশটা বাজে, এখুনি ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলে নাও, তারপর আমাকে জানাও যে, কী হল। ওভার।”

সেলফোন অফ করে পকেটে পুরলেন ভাদুড়িমশাই। দরজায় টোকা মারার শব্দ হল। খুলে দেখি এ-বাড়ির একতলার কাজের লোক যোগীশ্বর দাঁড়িয়ে আছে। বলল, “নাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। আপনারা কি নীচে যাবেন? যদি বলেন তো উপরেও দিয়ে যেতে পারি।”

ভাদুড়িমশাইকে বললুম। “উপরে দিয়ে যেতে বলব?”

“দরকার কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আধঘন্টার মধ্যে কেউ ফোন করবে বলে মনে হয় না। চলুন, নীচেই যাওয়া যাক।”

নীচে নেমে ডাইনিং রুমে ঢুকলুম। অর্জুন একটা লম্বা সেলাম ঠুকে বলল, “একটা মুশকিল হয়ে গেছে। দুকানে ডবল রুটি পাইনি।”

সদানন্দবাবু বললেন, “সেটা আবার কী?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ব্রেড। পাউরুটি।” তারপর অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাতে মুশকিলটা কী হল?”

“টোস্ট হল না।” অর্জুন বলল, “তাই আজ পুরি করেছি।”

বললুম, “বেশ করেছ। রোজ-রোজ পাউরুটি চিবোতে কি ভাল লাগে? যে ক’টা দিন আছি, সকালে আমাদের জন্যে পুরিই কোরো।”

পুরির সঙ্গে আলুভাজা আর কুমড়োর ছোকা ছিল। আর ছিল রাজেশের পাঠানো কালাকাঁদ। চটপট ব্রেকফাস্ট করে আমরা উপরে উঠে এলুম। তার মিনিট খানেক বাদেই ভাদুড়িমশাইয়ের মোবাইল জানান দিল যে, মেসেজ আছে।

আবার সেই একতরফা কথা। ভাদুড়িমশাই যা বললেন, সেটা এই :

“ফাইভ জিরো ডাবল এইট।…হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি, বলে যাও।…আমাকে উনি চিনতে পেরেছেন? ভাল।…আমার লোক গিয়ে দেখা করলেই তার সঙ্গে যাবার জন্য সাদা পোশাকের দু’জন কনস্টেবল দিয়ে দেবেন?…ভেরি গুড। তুমি আপাতত অফিসেই থাকো, মানে আবার হয়তো তোমার সঙ্গে কথা বলার দরকার হতে পারে। ওভার।”

ফোনটা আবার পকেটে ঢোকালেন ভাদুড়িমশাই। হাতঘড়ি দেখে মৃদু হেসে বললেন, “সো ফার সো গুড। কিন্তু সওয়া এগারোটা বাজে, মিনি তার ঘর থেকে বেরোচ্ছে না কেন? দরজাটা খুলে রাখুন তো।”

সদানন্দবাবু বললেন, “লিজা চলে না গেলে বেরোবেন কী করে?”

আমি বললুম, “কিন্তু তার তো এতক্ষণে চলে যাবার কথা।”

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই কানে এল স্কুটার স্টার্ট করার শব্দ। সদানন্দবাবু বললেন, “ওই গেল বোধহয়। মিসেস রাসেলের রিকোয়েস্টে রাজি হল কি না, কে জানে!”

আমি বললুম, “রাজি না-হলে তো আপনিই আছেন। প্যাকেটটা ক্যারি করে আপনিই যথাস্থানে পৌঁছে দেবেন।

“তা তো দেবই। রাত আটটাতেই দেব। কতা যখন একবার দিইচি, তখন সেটা রাকতেই হবে। তাতে মরি তো মরব। শুধু একটা কতা। যদি মরি তো আমার উইডোকে দয়া করে দেকবেন।”

সদানন্দবাবুর গলাটা কি শেষের দিকে একটু কেঁপে গেল? সম্ভবত এতক্ষণে ভদ্রলোক বুঝেছেন যে, দায়িত্বটা কঠিন, ঘাড় পেতে সেটা নেওয়াটা খুব সুবুদ্ধির কাজ হয়নি।

ভাদুড়িমশাই কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি মুখ খোলার আগেই কামিনী এসে ঘরে ঢুকল। বলল, “তোমরা ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছ তো?”

“তা করেছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু ও-সব কথা ছেড়ে এখন কাজের কথায় আয়। লিজাকে রিকোয়েস্ট করেছিলি?”

“করেছি।” কামিনী বলল, “ও রাজিও হয়েছে। কিন্তু প্যাকেটটা নিয়ে গেল না।”

“তার মানে? নিল না কেন?”

“প্রথমে তো প্যাকেটটা পৌঁছে দিতে রাজিই হচ্ছিল না। নাকি আজ দু’বেলাতেই ওকে দু’দুটো জায়গায় নেমন্তন্নে যেতে হবে, তাই আটটার সময় অন্য কোথাও যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। শেষে অনেক সাধ্যসাধনা করতে বলল, ঠিক আছে, রাত্তিরের নেমন্তন্নটায় নাহয় যাবে না, কিন্তু এ-বেলার নেমন্তন্নটা না রেখে উপায় নেই। ওর এক বন্ধুর মেয়ের জন্মদিন, লাঞ্চের নেমন্তন্ন, অথচ উপহার হিসেবে ও শুধু একটা পুতুল নিয়ে যাচ্ছে, এখন এই বইয়ের প্যাকেটটাও যদি সঙ্গে নিয়ে যায়, তা হলে এটাকেও ওরা হয়তো একটা উপহার বলে ভাববে, অথচ এটা তো ও দিতে পারবে না, সে ভারী বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। প্যাকেটটা তাই এখনই নিতে রাজি হল না।”

“তা হলে কখন নেবে?”

“সাতটার আগে নয়।” কামিনী বলল, “সাড়ে-সাতটাও হতে পারে। এখান থেকে যদি পশ্চিম দিকে যাও তা হলে ধরাসু বলে একটা জায়গা পড়বে, জানো তো?”

“তা জানি।”

“অত দূর না-হলেও ওরই কাছাকাছি ঠিক এই রকমেরই একটা বসতি গড়ে উঠেছে। জায়গাটার নাম ডুলুং ভ্যালি। সেখানেই নাকি ওর বন্ধুর বাড়ি। দুপুরে খাওয়ার নেমন্তন্ন, তাই এখান থেকে সরাসরি ও এখন সেখানেই যাবে। রাত্তিরের নেমন্তন্নটা তো স্কিপ করছে, তাই বিকেল অব্দি থাকবে ডুলুং ভ্যালিতেই। তারপর বাড়িতে ফেরার পথে সাতটা নাগাদ আমাদের বাড়ি থেকে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে আটটার সময় যেখানে এটা পৌঁছে দেবার কথা সেখানে পৌঁছে দিয়ে হসপিটালে চলে যাবে নাইট ডিউটি দিতে।”

“বাব্বা, এরা পারেও বটে!” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তা তুই এখন কী করবি?”

কামিনী বলল, “বারোটা বাজতে চলল, বার্টি একটু বাদেই ফিরবে, আমি স্নান করে নিচ্ছি, তোমরাও স্নান সেরে নাও, তারপর বার্টি এলে সবাই মিলে এক সঙ্গে খেতে বসব।”

ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল কামিনী। দরজা পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “একটা কথা বলা হয়নি। বার্টি এর মধ্যে ফোন করেছিল। বলল যে, খেয়ে একটু বিশ্রাম করে ফের বেরোতে হবে ওকে।…কী জানো আঙ্কল, কাল তো সারাদিন বেরোবে না, তাই কাল যেসব রুগিকে দেখার কথা ছিল আজই তাদের যতজনকে পারে দেখে আসবে।”

শুনে লিজার ব্যাপারে একটু আগেই যা বলেছিলেন, বার্টির ব্যাপারেও সেই একই মন্তব্য করলেন ভাদুড়িমশাই। “বাব্বা, এরা পারেও বটে!”

সদানন্দবাবু বললেন, “যা শুনলুম, তাতে তো মনে হচ্চে লিজাই সাতটা নাগাদ এখেনে এসে প্যাকেটটা নিয়ে যাবে। তা হলে আর আমাকে ওটা নিয়ে যেতে হচ্চে না, কেমন?”

আমি বললুম, “তাতে তো আপনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন মশাই। যা ভয় পেয়েছিলেন।”

“মোটেই ভয় পাইনি।” সদানন্দবাবু ফুঁসে উঠে বললেন, “আমি তো যাবার জন্যে তৈরিই ছিলুম।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “থাক থাক, আর বীরত্ব ফলাতে হবে না। আপনি খুব ভালই জানেন যে, আমিই আপনাকে যেতে দিতুম না। দরকার হলে আমি নিজেই যেতুম। আর তা ছাড়া, কেউই ওই প্যাকেট নিয়ে ওখানে যাবে কি না, তাতেও আমার সন্দেহ আছে।”

এই শেষের কথাটা কেন বললেন, তা আর ব্যাখ্যা করলেন না ভাদুড়িমশাই। পকেট থেকে সেলফোন বার করে ডায়াল করতে বসলেন। যাঁকে ডাকলেন, তার উত্তর পাওয়ার পর একতরফা তাকে যা বললেন, তা এই :

“আমি চারু ভাদুড়ি কথা বলছি। বাচ্চার মা এখন বাইরে। সম্ভবত সাড়ে-সাতটা আটটা পর্যন্ত বাইরেই থাকবে। বাচ্চাকে তুলে আনার কাজটা তার ফলে সহজ হয়ে গেল। এস.পি.-র সঙ্গে দেখা করলে তিনি দুজন প্লেন-ড্রেসের পুলিশ সঙ্গে দেবেন। বাচ্চাকে তুলে এনে নিজের কাছে রাখা উচিত হবে না, এস. পি.-র আপিসে জমা দিতে হবে। ক্লিয়ার?…গুড। তা যে রিপোর্টের কথা বলেছিলুম, সেটা কখন পাওয়া যাবে?…অ্যা, পাওয়া গেছে?…তা-ই? আমি ঠিক এই সন্দেহই করেছিলুম। ওভার।”

সেলফোন পকেটে পুরে ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ কী, আপনারা বসে আছেন কেন? স্নান করে নিন। আমি আমার ঘরে চললুম।”

আর কোনও কথা না বলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

বার্টি বলেছিল বারোটা সাড়ে বারোটায় ফিরবে, ফিরল একটারও খানিক পরে। কাঁচুমাচু মুখে বলল, “সরি আঙ্কল, এত রোগী দেখতে হবে ভাবিনি, একটু দেরি হয়ে গেল।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে আর কী করা যাবে, এখন পোশাক পালটে নীচে নেমে খাওয়ার পাট চুকিয়ে একটু বিশ্রাম করে নাও। বিকেলে তো ফের রুগি দেখতে যাবে শুনলুম।”

লাঞ্চের ঘন্টা দেড়টায়। খাওয়ার পাট চুকতে-চুকতে আড়াইটে। তারপরে আর গল্পগুজব বিশেষ হল না। আমরা উপরে চলে এলুম। ভাদুড়িমশাই আর আমাদের ঘরে এলেন না, নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। তাঁকে একটু অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। খাওয়ার টেবিলে খুব একটা কথা বলেননি, উপরে এসেও আমাদের কিছু বললেন না। মনে হল, নিজের ঘরে গিয়ে এখন বোধহয় আরও গোটাকয়েক ফোন করবেন।

আমাদের ঘরে ঢুকে সদানন্দবাবু আর দেরি করলেন না, বিছানায় টান হয়ে শুয়ে পড়লেন। ঘুমিয়েও পড়লেন প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই। তার দুটো কারণ। এক, গুরুভোজন। দুই, প্যাকেটটা রাত আটটার সময়ে যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি। আমার ঘুম এল না। কলকাতা থেকে একটা থ্রিলার সঙ্গে করে এনেছিলুম, সেটা পড়তে শুরু করেছি, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল।

দরজা খুলে দেখি, ভাদুড়িমশাই। বললেন, “আমি একটা জরুরি কলের জন্যে অপেক্ষা করছি, নীচে নামা সম্ভব নয়। আপনি একতলায় গিয়ে ইন্দরলালকে বলে আসুন, সে যেন বিকেলে কোথাও না যায়, আর ট্যাক্সিটাও যেন তৈরি থাকে। সন্ধে নাগাদ আমরা বেরোব।”

কথা শেষ করে তিনি আর দাঁড়ালেন না, নিজের ঘরে চলে গেলেন। আমি নীচে নেমে ইন্দরলালকে যা বলার বলে আবার দোতলায় উঠে এলুম। থ্রিলারটা আবার পড়তে শুরু করেছিলুম, কিন্তু মন বসল না। বিছানায় শুয়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলুম। যে বাচ্চাটিকে তার বাড়ি থেকে তোলার কথা শুনেছি, সে কে? তাকে আদৌ তোলা হবে কেন? রিপোর্টই বা কীসের? কিছুই ঠাহর হচ্ছে না। শুধু এইটুকু আন্দাজ করতে পারছি যে, কামিনীর ব্যাপারটা এখন ক্রমেই আরও ঘোরালো হয়ে উঠছে।

বার্টির বাড়িটা চমৎকার, কিন্তু গাড়িটা লজঝড়। স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করার সময় বিকট শব্দ করে। শব্দটা আমি চিনে রেখেছি। কানে আসতে ঘড়ির দিকে তাকালুম। সাড়ে চারটে। বার্টি তার গাড়ি নিয়ে পাহাড়ি বস্তিতে চলে গেল। রোগী দেখার কাজ শেষ করে, তাদের ওষুধপত্তর দিয়ে কখন বাড়ি ফিরবে কে জানে।

একটু বাদেই ঘরে ঢুকলেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “একজনকে ফোন করা দরকার। ও ঘর থেকে করতে পারছি না। ঘর সাফাই হচ্ছে, বিছানা-বালিশের চাদর-ওয়াড় পালটানো হচ্ছে। তার মধ্যে ফোন করা যায়?”

হেসে বললুম, “বেশ তো, তা হলে এখান থেকেই করুন।”

পকেট থেকে সেলফোন বার করলেন ভাদুড়িমশাই। ডায়াল করলেন। তারপর প্রায় মিনিট খানেক চুপ করে থেকে বললেন :

“আমি ভাদুড়ি বলছি। ফোন ধরতে এত দেরি হয় কেন?…এস.পি.-র সঙ্গে দেখা হল?… দুজন লোক দিয়েছে?…ভাল। দুজনই সঙ্গে যাক, তবে ফেরার সময় দুজনের একজনকে ওখানে রেখে আসতে হবে।…হ্যাঁ, আমার দরকার হতে পারে। আর কিছু জানার আছে?…নেই? তা হলে আর দেরি না করে কাজে বেরিয়ে পড়া ভাল। ওভার।”

ফোন পকেটে পুরে বললেন, “পাঁচটা বাজে। সদানন্দবাবু ঘুমোচ্ছেন দেখছি। ঘুমোতে দিন। তবে হ্যাঁ, ছ’টার সময় তুলে দেবেন। সাড়ে ছ’টার মধ্যে আপনাদের রেডি হয়ে নেওয়া চাই। যদি অবশ্য আমার সঙ্গে যেতে চান।”

বললুম, “রেডি হয়ে থাকব অবশ্যই। আপনার সঙ্গে যাবও। কিন্তু আপনি যাবেনটা কোথায়?”

“সঙ্গে যখন যাচ্ছেন, তখন যথাসময়ে সেটা জানতে পারবেন।”

“রওনা হবেন ওই সাড়ে ছ’টাতেই?”

“সেটাই নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না।” ভাদুড়িমশাই রহস্যময় হেসে বললেন, “আপাতত শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে, সম্ভবত সাড়ে ছ’টার আগে নয়, ওদিকে সাড়ে সাতটার পরে নয়।…ও হ্যাঁ, ইন্দরলালকে গাড়ি তৈরি রাখতে বলেছেন তো?”

“তখনই বলে এসেছি। গাড়ি তৈরি থাকবে।”

“তা হলে এখন যাই। ঘরে বসে চুপচাপ একটা প্ল্যান ছকে নিতে হবে। আশা করি, আমার ঘর গোছাবার কাজ এতক্ষণে শেষ হয়েছে।”

ভাদুড়িমশাই আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি আবার আমার অর্ধসমাপ্ত থ্রিলারের পাতা ওলটাতে শুরু করলুম। কিন্তু এবারেও তাতে মন বসল না। বুঝতে পারছিলুম, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। কিন্তু সেটা যে কী, তা বুঝে উঠতে পারছিলুম না। তার ফলে একটু অস্থির-অস্থির বোধ করছিলুম। ভাবছিলুম যে, ভাদুড়িমশাই যাবেন কোথায়? সেই শেষ না-হওয়া বাড়িটাতে, যার একতলার সিঁড়ির প্রথম ধাপে প্যাকেটটা রেখে আসার কথা? যে-লোকটা ফোন করে ভয় দেখাচ্ছে, হুকুম দিচ্ছে, প্যাকেটটা নেবার জন্যে সে কি সেখানে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে অপেক্ষা করে থাকবে? ভাদুড়িমশাই যদি সেখানেই যান, একটা সংঘর্ষ তা হলে হবেই। বই পড়ব কী, এইসব ভাবনাই আমাকে অস্থির করে দিচ্ছিল।

ছ’টা বাজতেই সদানন্দবাবুকে তুলে দিলুম। সাড়ে ছ’টার মধ্যে আমরা রেডি। তার মিনিট কয়েক আগে ভাদুড়িমশাই তাঁর ঘর থেকে আমাদের ঘরে চলে এসেছিলেন। বললেন, “ভয় পাবেন না, ভয়ের কিছু নেই। কাজ শেষ হতে ঘন্টা খানেকের বেশি লাগবে না।

সদানন্দবাবু বললেন, “ভয় করলেই ভয়।”