কামিনীর কণ্ঠহার – ৮

জেলার নাম উত্তরকাশী, শহরের নামও তা-ই। ফিরতি পথে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে ট্যাক্সি যখন একটু ফাঁকা জায়গায় পড়ল, হাতঘড়িতে তখন পৌনে সাতটা। কিন্তু সূর্যাস্ত তো কলকাতার তুলনায় এখানে অনেক দেরিতে হয়, আকাশ থেকে আলো তাই তখনও মুছে যায়নি।

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আসার পথে বাঁ দিকে চোখ রাখতে বলেছিলুম, এবারে ডান দিকে চোখ রাখুন।”

সদানন্দবাবু বললেন, “তার মানে এই ফিরতি পথেও নদীর দিকে চোক রাকা চলবে না? সেই পাহাড় দেকতে-দেকতেই যাব?”

“শুধু পাহাড় দেখবেন কেন? বাড়িঘর, লোকজন, দোকানপাট—সব দেখবেন।”

“সে তো আসার পথেই দেকিচি!”

“ইন্টারেস্টিং কিছু চোখে পড়েনি?”

“রাস্তার ধারে একটা ঝাঁকড়া-চুলো লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেকিচি, সঙ্গে একটা বাঁদর। বাঁদরটা তার কাঁধে বসে কলা খাচ্ছিল।”

“মানুষ কি শুধু কুকুর-বেড়াল আর গোরু-ছাগল পোষে?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “বাঁদরও পোষে। ওটা ওর পোষা বাঁদর।…তো উল্লেখ করার মতো আর-কিছু আপনি দেখেননি?”

“কই, না তো।” সদানন্দবাবু বললেন, “তবে হ্যাঁ, একটা মিষ্টির দোকানের সাইনবোর্ডে হিন্দি লেকার নীচে বাংলায় লেকা রয়েচে দেকলুম বিশ্বনাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। দোকানটার মালিক বোধ করি বাঙালি। তা এটা কি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার নয়?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “খুবই ইন্টারেস্টিং।…তা কিরণবাবু, এবারে আপনার কথা শুনি। আপনার চোখে কিছু পড়ল?”

“না।” আমি বললুম, “বাঁদর-কাঁধে লোকটাকে আমিও দেখেছি বটে, তবে সাইনবোর্ডে বাংলা হরফটা আমার চোখে পড়েনি। দুটো বাড়ি অবশ্য দেখেছি।”

“কোন দুটো বাড়ি?”

“যার কথা আজই কামিনীর মুখে শুনেছি আমরা। প্রথমটা অবশ্য আলাদা একটা বাড়ি নয়, অনেকগুলো ফ্ল্যাটবাড়ি নিয়ে একটা হাউসিং এস্টেট। এটা মোটামুটি ডুণ্ডা ভ্যালি আর উত্তরকাশীর মাঝামাঝি জায়গায়। লিজা বোধহয় ওখানেই থাকে।”

“দ্বিতীয় বাড়িটার কথা বলুন।”

“সেটা আবার ওই হাউসিং এস্টেট আর উত্তরকাশীর মাঝামাঝি জায়গায়। মোটামুটি দুটো জায়গা থেকেই ইকুইডিসট্যান্ট।”

“এটা কী রকমের বাড়ি?”

“স্রেফ ইটের গাঁথনির একটা দোতলা স্ট্রাকচার। আনফিনিশড। এমনকি ইটের ওপরে পলস্তারাও পড়েনি। তা এই রকমের একটা বাড়ির কথাও তো আজই আমরা শুনেছি। তা-ই না?”

“থ্যাঙ্কস।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি ধরেই নিয়েছিলুম যে, যে-দুটি বাড়ির কথা আপনারা আজই শুনেছেন, আর সে দুটো যে এই রাস্তার উপরেই, তাও যখন আপনারা জানেন, তখন অন্তত তাদের লোকেশনের দিকে আপনাদের খেয়াল থাকবে। কিন্তু এখন দেখছি, কিরণবাবুর খেয়াল থাকলেও সদানন্দবাবুর ছিল না।… সদানন্দবাবু, তার শাস্তি কী জানেন?”

সদানন্দবাবু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। আমতা-আমতা করে বললেন, “না না, আমারও খেয়াল ছিল। বাড়ি দুটো আমিও দেকিচি, সে-কতা বলতুমও, তবে কিনা…ওই মানে…”

“শাস্তি হচ্ছে, আজ না হোক কাল রাত্তিরে ওই আনফিনিশড বাড়িটাতে আপনাকে একবার একা যেতে হবে।”

সদানন্দবাবু ডুকরে উঠে বললেন, “একদম একা?”

“একদম একা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অস্ত্র বলতে আপনার ওই খেটে লাঠিটা অবশ্য থাকবে, ওটা দিয়ে আপনি যে-ই সেখানে থাকুক, তার নাকে এক ঘা বসিয়ে দেবেন।”

আমি বললুম, “অবশ্য অন্ধকারে তাকে আপনি দেখতে পাবেন কি না, সেটা ঘোর সন্দেহের ব্যাপার। লাঠির সঙ্গে তাই একটা টর্চও সঙ্গে থাকা ভাল।”

আমরা যে তাঁকে নিয়ে মজা করছি, সে-ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না সদানন্দবাবু। বললেন, “যাঃ, যতসব বেয়াড়া ঠাট্টা! কোনও মানে হয়?”

কথা বলতে-বলতে আমরা সেই পরিত্যক্ত বাড়িটার কাছে এসে পড়েছিলুম। চলন্ত ট্যাক্সি থেকে সেদিকে আঙুল তুলে ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাড়িটা ভাল করে দেখে রাখুন সদানন্দবাবু। এখনও দিনের আলো একেবারে মিলিয়ে যায়নি, রাত্তিরে কিন্তু ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। ভয় করবে না তো?”

এতক্ষণ যিনি মিনমিন করে কথা বলছিলেন, একেবারে হঠাৎই পালটে গেল তাঁর গলা। বুকে টোকা মেরে বললেন, “ভয় করবে? আমার? দেন ইউ ডোন্ট নো সদানন্দ বোস। হা হা হা হা!”

আমার মনে হল, সদানন্দবাবু যদি পাগল না-ও হয়ে থাকেন, তো হতে আর খুব দেরি নেই। কিন্তু ভাদুড়িমশাই দেখলুম দারুণ খুশি। বললেন, “শাবাশ। ব্রেভো। এই-তো চাই।”

বাদবাকি রাস্তাটা গল্পগুজব করে কাটল। হাউসিং এস্টেটের কাছেই একটা পেট্রোল পাম্প, সেখান থেকে ট্যাঙ্ক ভর্তি করে তেল নিয়ে নিল ইন্দরলাল। ডুণ্ডা ভ্যালিতে পৌঁছে কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমরা ভিতরে ঢুকলুম না। ভাদুড়িমশাই-ই ঢুকতে দিলেন না। ইন্দরলালকে বললেন, “গেট ছাড়িয়ে গাড়িটা একেবারে পাঁচিলের শেষ অব্দি নিয়ে চলো, তারপর পাঁচিল যেখানে উত্তরে ঘুরেছে, সেখানে ডাইনে মোড় নিয়ে রাস্তা থেকে একটু নামিয়ে তোমার গাড়িকে পাঁচিলের গা ঘেঁষে দাঁড় করাও।”

তা-ই করল ইন্দরলাল। গাড়িটা এখন পাঁচিলের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। উঁচু পাঁচিল, তবু যাতে কেউ টপকাতে না পারে, তার জন্যে সেই পাঁচিলের উপরেও আদ্যন্ত টেনে নেওয়া হয়েছে ফুট-দেড়েক উঁচু কাঁটাতারের বেড়া। সেটা চওড়াও অন্তত ফুটখানেক। তার উপরে একটা কাক মরে পড়ে আছে। তার পাশে তার থেকে ঝুলছে এক ফালি ব্রাউন রঙের মোটা ছিট-কাপড়

বনেটে পা রেখে গাড়ির ছাতের উপরে উঠে পড়লেন ভাদুড়িমশাই। কাঁটাতারের বেড়াটা এখন তাঁর হাতের নাগালে। হাত বাড়ালেই সেটা তিনি ধরতে পারেন। হাতটা একবার বাড়িয়েছিলেনও। কিন্তু পরমুহূর্তেই হাতটা টেনে নিয়ে গাড়ির ছাত থেকে তিনি মাটিতে নেমে পড়লেন।

বললুম, “কী ব্যাপার, গেট দিয়েই তো ভিতরে ঢোকা যায়, তা হলে আর পাঁচিল ডিঙোবার দরকার কী?”

ভাদুড়িমশাই আমার কথার কোনও জবাব না দিয়ে সদানন্দবাবুর দিকে তাকালেন। বললেন, “আপনার লাঠিখানা সঙ্গে আছে?”

“মাথায় লোহার বল লাগানো লাঠিটা?” সদানন্দবাবু বললেন, “ওটা সব সময়েই আমার সঙ্গে থাকে।”

“ওটা দিন।”

লাঠিখানা নিয়ে ফের গাড়ির ছাতে উঠলেন ভাদুড়িমশাই। লাঠির যে দিকে রাবারের ফেরুল লাগানো থাকে, সেই দিকটা দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া থেকে ছিট কাপড়ের টুকরোটা খসিয়ে আনলেন। তারপর গাড়িতে ঢুকে সদানন্দবাবুকে তার লাঠিখানা ফেরত দিয়ে ইন্দরলালকে বললেন, “এবারে গাড়ি ঘুরিয়ে গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকো।”

বললুম, “লাঠির দরকার হল কেন? ছিট-কাপড়ের টুকরোটা আপনার কী কাজে লাগবে জানি না, তবে ওটা তো হাত বাড়িয়েই নিয়ে আসা যেত।”

“তা যেত।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর তার ফলে আমি মারাও যেতে পারতুম।”

“তার মানে?”

“মানে তো খুবই সোজা। লোহার কাঁটাতারের মধ্যে দিয়ে সম্ভবত ইলেকট্রিক কারেন্ট চালানো আছে। নইলে কাকটা ওখানে ওইভাবে মরে পড়ে থাকত না।”

গেট দিয়ে গাড়ি ভিতরে ঢুকল। পথ আটকানো কাঠের ডাণ্ডাটা তুলে নেওয়া হল। সেন্ট্রি-বক্সের লোকটি যে তার খাতা বার করেছে, তাও দেখলুম। ওর কাজ গাড়ির নম্বর আর ভিতরে ঢোকার সময় লিখে রাখা। সেটা লিখে রাখছে।

প্রায় সাড়ে আটটা। কাজের লোকেরা বিকেল-বিকেল যে যার বাড়ি চলে যায়। আজও চলে গিয়েছে। সদরের কলিং বেল বাজাতে তাই কামিনী এসে দরজা খুলে দিল। খানিকটা অনুযোগের গলায় বলল, “এত দেরি হল যে? রাজেশ ছাড়তে চাইছিল না বুঝি?”

“শুধু কি আর রাজেশের সঙ্গে দেখা করতে গেসলুম, আরও কাজ ছিল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “সে-সব সারতে সারতে দেরি হয়ে গেল। তা বার্টি ফিরেছে তো?”

“তোমরা বেরিয়ে যাবার খানিক বাদই ফিরেছে।” কামিনী বলল, “ঘন্টাখানেক ঘুমিয়েও নিয়েছে।…তা তোমরা দাঁড়িয়ে রইলে কেন, ভিতরে এসো। বার্টি তোমাদের জন্যে ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছে।”

সবাই মিলে একতলার ড্রয়িংরুমে ঢোকা গেল। ঘরের এককোণে একটা আর্ম-চেয়ার। সেখানে ল্যাম্প স্ট্যান্ডের তলায় বসে যিনি একটা বই পড়ছিলেন, তিনিই যে ডঃ হারবার্ট রাসেল, সেটা বুঝে নিলুম। ভদ্রলোক আমাদের ঘরে ঢোকার শব্দ পেয়ে বই থেকে চোখ তুলেই আরাম-কেদারা থেকে উঠে পড়েছিলেন, এবারে এগিয়ে এসে ভাদুড়িমশাইয়ের দু’হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে-দিতে বললেন, “ওয়েলকাম, ওয়েলকাম, ওয়েলকাম। তা কাণ্ড দ্যাখো, আঙ্কল, আমরাই তোমাকে এখানে ডেকে আনলুম, অথচ তোমরা যখন এলে, তখন আমিই বাড়িতে ছিলুম না। হোআট আ শেম!”

পরক্ষণেই আমার ও সদানন্দবাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, “আমি বাৰ্টি, আর আপনাদের পরিচয় আমি মিনির কাছে পেয়েছি, সো য়ু ডোন্ট হ্যাভ টু ইন্ট্রোডিউস ইয়োরসেলভস।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোমার রুগিদের খবর কী?”

“গ্রামে একটা উৎসব ছিল,” বার্টি বলল, “আর জানেনই তো, খাওয়া-দাওয়া ছাড়া কোনও উৎসবই হয় না, তো তারই থেকে ফুড পয়জনিং। যা-ই হোক, সময়মতো খবর পেয়েছিলুম তাই রক্ষে, একজন বাদে বাকি সবাই এ-যাত্রা বেঁচে গেছে।”

“তোমার খুব ধকল গেল!”

“ও কিছু না,” বার্টি হেসে বলল, “বাড়িতে ফিরে ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নিয়েছি, বাস, ধকল তাতেই কেটে গেছে।…তা আপনাদের জন্যে একটু কফির ব্যবস্থা করি?”

কামিনী প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, “এখন কফি? পাগলামি কোরো না, ন’টা বাজতে চলল, খাবারগুলো গরম করে এখুনি তোমাদের ডিনারের ব্যবস্থা করছি।”

ঘর থেকে কামিনী বেরিয়ে গেল।

ডিনারের ডাক পড়ল মিনিট দশেক পরেই।

ডাইনিং রুমে ঢুকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাইরে থেকে ঘুরে এসেছি। উপরে গিয়ে জামাকাপড় পালটে এলে হত না?”

কামিনী বলল, “খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, আঙ্কল। এখানেই বেসিনে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে যাও।”

তা-ই বসতে হল। খেতে বসে ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওরে মিনি, যেমন লাঞ্চ তেমন ডিনারের আগেও তুই তো সেই টনিকটা খাস। সেটা খাবি না?”

“সেটা তো তোমার কাছে। বেরোবার আগে তো আর সেটা আমাকে দিয়ে যাওনি। নিজে খাওয়ার পরে বোধহয় তোমার ঘরেই রেখে দিয়েছ।”

“তা-ই হবে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বুড়ো হয়েছি তো, অনেক দরকারি কথাও আজকাল দেখছি ভুলে যাই। যাক গে, স্বাদটা যখন ভাল লাগছিল না, তখন আর ওটা খাবার দরকার নেই, তোর জন্যে একটা নতুন বোতল নিয়ে এসেছি। এই দ্যাখ!”

বিগ শপারটা হাতে ঝুলিয়েই ডাইনিং রুমে ঢুকেছিলেন ভাদুড়িমশাই, এবারে তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বোতলটা বার করে টেবিলের উপরে রাখলেন।

কামিনী বলল, “আরে এটা তো একই টনিক—এনার্জি প্লাস।”

“রাইট। কিন্তু টনিকটা এক হলেও স্বাদটা আলাদা। এনার্জি প্লাস আসলে অনেক স্বাদের হয়। এটা অরেঞ্জ ফ্লেভার্ড। খেয়ে দ্যাখ, খারাপ লাগবে না।”

বার্টিকে দিয়ে বোতলের মুখ খুলিয়ে একটা কাপে দু’চামচ ঢেলে তক্ষুনি খেয়ে নিল কামিনী। তারপর ঠোটে জিভ বুলিয়ে বলল, “চমৎকার! থ্যাঙ্ক ইউ অ্যাঙ্কল। তা এটা কিনলে কোথায়?”

“কেন, উত্তরকাশীতে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “দাঁড়া, উত্তরকাশী থেকে তোর জন্যে আর একটা জিনিসও এনেছি।”

বলে, ফের সেই ঝোলার মধ্যে হাত ঢোকালেন। এবারে বার হল সোনালি র‍্যাপিং পেপারে জরির ফিতে দিয়ে মোড়া একটা প্যাকেট।

কামিনী বলল, “কী আছে ওর মধ্যে?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “উত্তরকাশীর বিখ্যাত মিঠাইওয়ালা গয়াপ্রসাদের কালাকাঁদ। রাজেশ তোর জন্যে পাঠিয়েছে। তার ছেলেবেলায় মিনিদিদির কথা সে ভোলেনি।”

বার্টি বলল, “আপনারা যে রাজেশের কাছে গিয়েছিলেন, সে-কথা মিনির কাছে শুনেছি। তা ওকে একদিন আসতে বললেই তো হয়।…আপনার কাছে ওর ফোন নাম্বার আছে আঙ্কল?”

“কেন, ওর সঙ্গে কথা বলবে?”

“আমি কথা না-বলে বরং মিনি বলুক।” বার্টি বলল, “মিনি, তুমিই ওকে ফোন করে বলে দাও যে, পরশু রবিবার সকালেই যদি ও চলে আসে তো আমরা ভারী খুশি হব। সারাটা দিন আমাদের সঙ্গে কাটাক, তারপরে বিকেলে আবার উত্তরকাশীতে ফিরে যাবে।”

কামিনী বলল, “আসতে যে বলব, তুমি সেদিন বাড়িতে থাকতে পারবে তো? তুমি হোস্ট, সেটা ভুলে যেয়ো না। কাউকে আসতে বলে তারপর নিজেই যদি বাড়িতে না থাকো, তো সে ভারী বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে,” বাৰ্টি বলল, “আমি সেদিন বাড়িতেই থাকব। আরে বাবা, ডাক্তাররাও তো মানুষ, তাদেরও তো এক-আধদিন বাড়িতে থাকার দরকার হতে পারে, তাদেরও তো অসুখ-বিসুখ হয়, নাকি হয় না?”

কামিনী বলেছিল, বার্টির বয়েস এখন পঞ্চাশ। চেহারা দেখে কিন্তু আর-একটু কম বলে মনে হয়। টাক পড়েছে, এটাও বাজে কথা। তবে হ্যাঁ, মাথার সামনের দিকের চুল খানিকটা পাতলা হয়ে এসেছে বটে। টুথব্রাশ গোঁফ। থুতনিতে গোটিটা, ওই যাকে ছাগল-দাড়ি বলে আর কি, চোখে পড়ার মতো। ড্রয়িং রুমে ঢুকে চোখে চশমা দেখেছিলুম, আমরা ঘরে ঢুকতেই বার্টি সেটা খুলে রাখে। তার মানে প্লাস পাওয়ারের চশমা, বই পড়ার সময় কি কাগজপত্রে চোখ বুলোবার সময় ওটার দরকার হয়, অন্য সময়ে হয় না। যেমন এখন ওর চোখে চশমা নেই। চোখের মণির রং আশ্চর্য নীল। মুখে সব সময়েই একটু হাসি লেগে আছে। কথাবার্তা শুনে মনে হয়, মানুষটি খোলামেলা ধরনের। এটাও মনে হল যে, তিন-তিনবার ভুল করার পরে কামিনী অন্তত এইবার কোনও ভুল করেনি, সত্যিকারের নির্ভরযোগ্য একজন মানুষকে সে তার জীবনসঙ্গী হিসেবে খুঁজে পেয়েছে।

খাওয়ার পর্ব শেষ হয়ে গিয়েছিলে সাড়ে ন’টার মধ্যেই। কিন্তু গল্প যেন আর শেষ হতে চাইছিল না। বাঙ্গালোরের গল্প। কামিনীর বাবা আর মায়ের গল্প। কামিনীর ছেলেবেলার গল্প। তার ছবি আঁকা আর সরোদ শেখার গল্প। রাজেশদের পরিবার আর কামিনীদের পরিবারের মধুর সম্পর্কের গল্প। গল্পে হঠাৎ ছেদ পড়ল ভাদুড়িমশাইয়ের কথায়। “ওরে বাবা, এ যে সাড়ে দশটা বাজে। ওহে বাৰ্টি, পরশু রোববার সকালে তো রাজেশ এখানে আসবে, তুমিও সারাদিন তাই বাড়িতেই থাকছ, তা-ই না?”

বার্টি হেসে বলল, “সে তো থাকতেই হবে।”

“আর কাল?”

“কাল সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট করেই রোগী দেখতে যাব। এখানকারই একটা পাহাড়ি বস্তিতে। ফিরতে-ফিরতে বারোটা-একটা। ইটস আ ক্রাউডেড ডে।”

“তা হলে আর একটিও কথা না বলে শুয়ে পড়ো গিয়ে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বিকেলে ঘন্টা খানেক ঘুমিয়েছ বটে, কিন্তু গতকাল থেকে যা খাটাখাটনি গেছে, তার ধকল তাতে কাটেনি। এখন আর গল্প না করে উঠে পড়ো। য়ু নিড রেস্ট।”

বার্টিকে সত্যিই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। সে আর কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ল।

ফোনটা বাজল তার মিনিট দশেক বাদে। আমরা তখনও ডাইনিং রুমে বসে গল্প করছি। কামিনী বলল, “তোমরা বোসো আঙ্কল, বার্টি সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে, আমিই ড্রয়িং রুমে গিয়ে লাইনটা নিয়ে নিচ্ছি।” কথাটা বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ফিরে এল মিনিট পাঁচেক বাদেই। ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিশ্চয় কোনও রুগির ফোন? বাৰ্টিকে এখন আবার ঘুম থেকে উঠে বেরুতে হবে নাকি?”

কামিনী কোনও উত্তর দিল না। একটা পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে বসে রইল। দেখে মনে হল, তার মুখ থেকে সমস্ত রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে।

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কী রে, কী হল? কথা বলছিস না কেন? কার ফোন?”

এতক্ষণে যেন হুঁশ ফিরল কামিনীর। শুকনো ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “সেই লোকটার।”

“কোন লোকটার? যার কথায় ভয় পেয়ে তুই নেকলেসটা দিয়ে দিয়েছিস?”

“হ্যাঁ। কিন্তু এখন আবার আমার যে একটা মুক্তোর মালা আছে, সেটা চাইছে। বলছে যে, কাল রাত্তিরেই কাউকে দিয়ে পাঠাতে হবে। সেই একই জায়গায়!”

ভাদুড়িমশাই মৃদু হাসলেন। বললেন, “এতে এত অবাক হচ্ছিস কেন?”

“হব না? ও তো এর পরে আরও চাইবে।”

“চাইতেই পারে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যারা ব্ল্যাকমেল করে, শিকারকে তারা সহজে ছাড়ে না। এ-লোকটাও তোকে সহজে ছাড়বে না, মিনি। ক্রমাগত ভয় দেখিয়ে তোর সর্বস্ব লুঠ করবে!”

“তা হলে কী করব আমি এখন? ওর কথামতো কাজ না করলে তো ছবিগুলো বার্টির কাছে পাঠিয়ে দেবে। তা হলে যে কী কাণ্ড হবে, তা তো ভাবতেই আমার হাত-পা হিম হয়ে যাচ্ছে। বার্টিকে সব খুলে বলব?”

ভাদুড়িমশাই আবার মৃদু হাসলেন। বললেন, “বলা উচিত ছিল প্রথম যখন ওই কদর্য ফোটোগুলো আর ওই চিঠিটা পেয়েছিলি, তখনই। তা যখন বলিসনি, তখন এবারেও বলিস না।”

“এবারে তা হলে কী করব?”

প্রথমবারে যা করেছিলি, এবারেও তা-ই করবি। মুক্তোর মালাটা পাঠিয়ে দিবি।”

“ওগুলো কালচার্ড পার্ল নয়, আঙ্কল!” কামিনী ডুকরে উঠে বলল, “খাঁটি মুক্তো!”

“তা হোক।” ভাদুড়িমশাই তাঁর মুখের হাসিটা ধরে রেখে নির্বিকার গলায় বললেন, “চেয়েছে যখন, তখন পাঠিয়েই দে!”