৭
ভাদুড়িমশাই তাঁর ঘর থেকে আমাদের ঘরে চলে এসেছিলেন। বসে-বসে গল্প হচ্ছিল। তার মধ্যে ফোটোগ্রাফগুলোর কথা একবারও ওঠেনি। কথা হচ্ছিল নেকলেসটা নিয়ে। ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওর মধ্যে যেটা বড়, তার একটা ইতিহাস আছে। মূলে ওটা কার ছিল, বলা শক্ত, তবে কামিনীর ঠাকুর্দার হাতে আসার আগে ওটা ছিল বরোদার এক বনেদি ব্যবসায়ীর হাতে। সে নাকি সুরাটের এক পোর্তুগিজ বণিকের কাছ থেকে ওটা কিনেছিল। কিন্তু কেনার পর মাত্র এক বছরের মধ্যেই তার স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানটি মারা যায়। তাতে তার ধারণা হয় যে, হিরেটা অপয়া, ওটা কেনার ফলেই তার স্ত্রীপুত্র মারা গেছে, এবারে ব্যাবসাও লাটে উঠবে। বাস, তারপরে সে আর দেরি করেনি, কামিনীর ঠাকুর্দা অশ্বিনীভাই পটেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে ওটা বেচে দেয়।”
সদানন্দবাবু বললেন, “হিরের যে পয়া-অপয়া আচে, এটা কিন্তু মিচে কতা নয়। আমার এক পিসশাশুড়ির কাচে শুনিচি, তাঁর দাদাশ্বশুরের ছেলেবেলায় একবার এমন ন্যাবা রোগ হয়েছিল যে, গোটা শরীর একেবারে হলদে হয়ে যেত, বাঁচার কোনও আশাই ছিল না। ডাক্তার-বদ্যি ফেল মেরে যাবার পরে ডাক পড়ল জ্যোতিষীর। তিনি এসে রুগির কুষ্টি দেখে বললেন, তোমরা করেচ কী, এর তো দেকচি হীরকারোগ্য যোগ রয়েচে, বাঁচাতে হলে এক্ষুনি একে হিরের আংটি পরাও।”
হেসে বললুম, “হিরের আংটি পরাতেই অমনি জন্ডিস সেরে গেল?”
“হাসবেন না, হাসবেন না,” সদানন্দবাবু বললেন, “এর ভেতরে হাসির কিছু নই ‘ হিরের সত্যি পয়া-অপয়া আচে। কারও ভাল হয়, কারও মন্দ। কী রকমের মন্দ, সেটা যদি শুনতে। তো আমাদের জেঙ্কিনস অ্যান্ড জেঙ্কিনস কোম্পানির শামুকখোলা টি-গার্ডেনের ম্যানেজারের গপ্পোটা বলি…”
গপ্পোটা শুরু হবার আগেই ঘন্টা পড়ল।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “লাঞ্চের ঘন্টা। গপ্পোটা পরে শুনব, চলুন, খেতে যাওয়া যাক।”
হাতঘড়িতে দেড়টা বাজে। সবাই মিলে একতলার ডাইনিং রুমে গিয়ে হাজির হওয়া গেল। অর্জুন টেবিলে প্লেট সাজিয়ে ফেলেছে। ভাদুড়িমশাই বললেন, “মিনি কোথায়? তাকে দেখছি না যে?”
প্রশ্নটা অর্জুনকে করেছিলেন। কিন্তু তার আর কোনও উত্তর দেবার দরকার হল না, হাতে একটা বোতল নিয়ে কামিনী এসে ঘরে ঢুকল। বলল, “তোমরা এসে গেছ দেখছি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঘন্টা বাজাবার ব্যাপারটা তোদের বাঙ্গালোরের বাড়িতে ছিল। সেটা এখানেও চালু আছে দেখে ভাল লাগল। কাল রাত্তিরে অবশ্য ডিনারের ঘন্টা শুনিনি।
কামিনী হেসে বলল, “ওটা অর্জুনের ব্যাপার। ও তো বিকেল-বিকেলই চলে যায়। রাত্তিরে তাই ঘন্টাও বাজেনি, তোমরাও শোনোনি।”
“তা-ই বল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তোর হাতে ওটা কীসের বোতল?”
“টনিকের। এনার্জি-প্লাস। এনার্জি বাড়ায়। কিছুদিন থেকে রোজ দু’বেলা দুচামচ করে খাচ্ছি। দুপুরে আর রাতে খাওয়ার আগে।”
“কাল রাত্তিরে তো খেতে দেখিনি।”
“ডাইনিং রুমে নিয়ে আসিনি, তাই দ্যাখোনি। দোতলাতেই টনিকটা খেয়ে নিয়ে তারপর নীচে খাওয়ার ঘরে এসেছিলুম।”
“ওটা খেলে সত্যি এনার্জি বাড়ে?”
“না-বাড়লে আর খাচ্ছি কেন?” কামিনী একটা কাপে দু’চামচ ওষুধ ঢালল, তারপর ওষুধটা খেয়ে, মুখ-বিকৃতি করে বলল, “স্বাদটা অবশ্য অতি বিচ্ছিরি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হোক, উপকার যখন পাচ্ছিস, তখন খেয়ে যা।… তা যে-কাজে এসেছি, আমারও একটু এনার্জি দরকার, তাই তোর সঙ্গে রোজ আমিও একটু খেলে পারি… মানে ওই যে ক’টা দিন এখানে আছি আর কি।”
“খাবে?” কামিনী তার ওষুধের বোতলটাকে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে খুশি গলায় বলল, “দাঁড়াও, অর্জুনকে তা হলে আর-একটা কাপ দিতে বলি। স্বাদটা কিন্তু সত্যি খুব বিচ্ছিরি!”
“থাক, তা হলে আর এখন খেয়ে খিদেটা নষ্ট করব না!” ভাদুড়িমশাই বললেন, “আগে লাঞ্চ খাই, পরে উপরে গিয়ে ওষুধ খাব।”
“ওটা কিন্তু খাওয়ার আগেই খেতে হয়।”
“কে বলেছে? বাৰ্টি?”
“বার্টির এত সময় কোথায় যে, বউয়ের স্বাস্থ্য আর ওষুধ নিয়ে ভাববে। সে তো তার দু’টাকা ভিজিটের রুগিদের নিয়েই ব্যস্ত!”
“বাঃ, বার্টি তোর শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবে না?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “বাজে কথা বলিস না মিনি। সে যদি না-ই ভাববে তো ওষুধটা প্রেসক্রাইব করল কে?”
কামিনী বলল, “লিজা। তবে হ্যাঁ, লিজা এটা এনে দেবার পরে বার্টিকে না-জানিয়ে খেতে শুরু করিনি। তা বোতলটা দেখে সে বলল, লিজা ঠিক ওষুধই এনেছে। এটা খুবই নাম-করা কোম্পানির টনিক, খেলে উপকার পাবই।”
খেতে-খেতে কথা হচ্ছিল। অর্জুনের রান্নার হাত ভাল। পদ বেশি করেনি। ভাতের সঙ্গে ডাল, বেগুনভাজা, আলু-পোস্ত আর চিকেন কারি। শেষ পাতে জমাট টক-দই। সেও বাড়িতেই পাতা।
খাওয়া শেষ করে ভাদুড়িমশাই বললেন, “বার্টি তো বিকেলের আগে ফিরছে না। ততক্ষণ তুই কী করবি মিনি?”
“ঘরে গিয়ে একটা-কোনও বই পড়ব।” কামিনী বলল, “বই পড়তে-পড়তে যদি ঘুম এসে যায় তো ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নেব। তোমরাও একটু ঘুমিয়ে নিলে পারো, আঙ্কল।”
“কিরণবাবু আর বোসমশাই কী করবেন, আমার জানা নেই, তবে আমি ঘুমোব না।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আমি রাতে ঘুমোই, দিনে জাগি। আর তা ছাড়া, আমাকে একটু বেরোতেও হবে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “কোতায়?”
কথাটার জবাব না-দিয়ে কামিনীর দিকে তাকিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ রে মিনি, রাজেশের কথা তোর মনে আছে?”
“কোন রাজেশ?”
“রাজেশ কুলকার্নি। বাঙ্গালোরে তোদের পাশের বাড়িতে একটি খ্রিস্টান পরিবার থাকত। মনে আছে?”
“মানে সেই বাড়ির সেই ছোট্ট ছেলেটা। যে তখন ইস্কুলে পড়ত, তারপর রোজ বিকেলে দোকানে যাবার আগে বাবা যাকে ডেকে পাঠিয়ে ঘন্টাখানেক অঙ্ক শেখাতেন? তাকে কেন মনে থাকবে না?”
“যাক, মনে আছে তা হলে। তো সে আর এখন সেই ছোট্ট ছেলেটি নেই। তার বয়েস এখন বছর তিরিশেক।”
“কী করে সে এখন?”
“এম. এসসি. পাশ করে কর্ণাটকের একটা গ্রামের ইস্কুলে মাস্টারিতে ঢুকেছিল। বছর তিনেক আগে ইস্কুলের চাকরি ছেড়ে কলেজে ঢোকে। এখন উত্তরকাশীর একটা কলেজে পড়ায়। কলেজটা শুনেছি ক্রিশচান মিশনারিদের। মনে হয় ভালই আছে।”
“বলো কী। তুমি এত সব খবর রাখো কী করে?”
“যে-ভাবে রাখতে হয়।… কী জানিস মিনি, আমি কাউকেই ভুলে যাই না। যেমন তোর খবর রাখি, তেমন রাজেশের খবরও রাখি। তা ভাবছি যে, রাজেশ যখন এত কাছে রয়েছে, তখন দুপুরটা বেকার বসে না-থেকে তার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।”
“এখানে ওর বাড়ি?”
“বাড়ি ভাড়া করার দরকার হয়নি। হস্টেল-সুপারিন্টেন্ডেন্ট, হস্টেলের মধ্যেই দু’কামরার কোয়ার্টার্স। বিয়ে করেনি। বাবা তো ওর ছেলেবেলাতেই মারা গেছেন, তোর বাবার সাহায্য না-পেলে ওর লেখাপড়াই হত না। যা-ই হোক, এখন মা’কে নিয়ে এখানে থাকে।”
“তাই-ই?” কামিনী বলল, “রাজেশ জানে যে, আমরা ওদের এত কাছে থাকি?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “আগে জানত না। এখন জানে। আসলে, ওর সঙ্গে তো চিঠিপত্রে আমার যোগাযোগ ছিলই, ওর ফোন নাম্বারও আমি জানতুম, তা কলকাতা থেকে রওনা হবার আগের দিন ওকে ফোন করে আমার আসার কথা জানাই। এটাও বলি যে, এখানে এসে ওর সঙ্গে দেখা করব।”
“এখানে তুমি আমার কাছে উঠবে, তা ওকে বলেছ?”
“তা বলিনি, তবে আজ তো ওর সঙ্গে দেখাই হচ্ছে, তখন বলব।”
“তখন বোলো যে, মা’কে নিয়ে ও যেন অতি অবশ্য একদিন এখানে আসে। এলে আমরা দারুণ খুশি হব।… উঃ, সেই রাজেশ। ও আমাকে মিনিদিদি বলত আর আমি ওর মাকে বলতুম সাদামাসি। সেই রাজেশ এত কাছে থাকে! এ তো ভাবাই যায় না! ওকে কিন্তু শিগগিরই একদিন আসতে বোলো, আঙ্কল!”
“বলব রে, বলব!”
কামিনীকে আশ্বস্ত করে আমাদের দিকে তাকালেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “কী ব্যাপার, আমি বেরুব শুনেও আপনারা চুপ করে আছেন যে? বেরুবার ইচ্ছে নেই? দুপুরে পড়ে-পড়ে ঘুমুবেন?”
বললুম, “কী যে বলেন! সেই কত বছর আগে উত্তরকাশীতে আসা হয়েছিল, আবার যখন শহরটাকে দেখার সুযোগ পাচ্ছি, তখন ছাড়া যায়?”
সদানন্দবাবু বললেন, “আমি তো যাবই। বাবা বিশ্বনাথের কাশী অবিশ্যি আমার দেকা হয়নি, তবে এই কাশীকে দেকার সুযোগ যখন পেইচি, তখন ছাড়চি না।”
খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। কাজের লোকটি টেবিল পরিষ্কার করার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমরা উঠে পড়লুম। ভাদুড়িমশাই এনার্জিবর্ধক ওষুধের বোতলটা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে কামিনীকে বললেন, “এটা আমি আমার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি। দু’চামচ খেয়ে তারপর বোতলটা তোর ঘরে দিয়ে আসব।”
কথাটা শেষ করে ভাদুড়িমশাই আর দাঁড়ালেন না। আমাদের নিয়ে দোতলায় চলে এলেন। নিজের ঘরে ঢোকার আগে বললেন, “সওয়া দুটো বাজে। দিবানিদ্রা মহাপাপ, তাই ঘুমোবার চেষ্টা করবেন না। ইন্দরলালকে বলা আছে, সে গাড়ি তৈরি রেখেছে। আমরা আড়াইটে নাগাদ বেরিয়ে পড়ব। পনরো মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নীচে নামুন।”
বৈশাখ মাসের অর্ধেকটা কাবার হয়ে গেছে। কলকাতায় এখন নিশ্চয় দারুণ গরম। এখানে কিন্তু গরমের নামগন্ধ নেই। বেশি না-হলেও বাতাসে হালকা-মতন শীতের আমেজ, বিকেল হলে সেটা আরও বেড়ে যায়। সদানন্দবাবুকে বললুম, “আর কিছু না হোক, অন্তত একটা মাফলার রাখা ভাল।”
সদানন্দবাবু বললেন, “আমি মশাই একজোড়া মোজাও আমার পকেটে নিয়ে নিচ্চি। ফিরতি পথে পরে নেবখন। নয়তো চোরা ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। বিদেশে এসে অসুখ বাধিয়ে বসাটা কোনও কাজের কতা নয়।”
ঠিক আড়াইটেতেই নীচে নেমে, গাড়ি তৈরিই ছিল, আমরা বেরিয়ে পড়লুম। বেরোবার সময় দুটো ব্যাপার চোখে পড়ে। এক, পথ আটকানো কাঠের ডাণ্ডাটা নামানো ছিল, আমাদের ট্যাক্সিটাকে বেরোতে দেবার জন্যে সেটা উপরে উঠে যায়। দুই, সেন্ট্রি-বক্সের লোকটি একটা খাতা খুলে কিছু লিখে নিল। সম্ভবত আমাদের গাড়ির নম্বর ও হাউসিং কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে যাবার সময়।
সদানন্দবাবু আমার পাঁজরে একটা খোঁচা মেরে চাপা গলায় বললেন, “দেকলেন ব্যাপারটা?” উত্তরটা আর আমাকে দিতে হল না, যতই আস্তে বলে থাকুন, প্রশ্নটা আমাদের ড্রাইভার ইন্দরলালের কানে ঠিকই পৌঁছে গেছে। ঘাড় না-ঘুরিয়েই সে সামনের সিট থেকে বলল, “মায় ভি দেখা বাবুজি। সিকিওরিটি বহোত কড়া হ্যায়।”
ভাদুড়িমশাইও বসে আছেন সামনের সিটে, ইন্দরলালের বাঁ পাশে। সদানন্দবাবুর কথাটা তিনিও শুনেছেন ঠিকই। বললেন, “যাক, আপনারা চোখ-কান খোলা রেখেছেন তা হলে?”
“সে তো আমি চব্বিশ ঘন্টাই খোলা রাকি!” সদানন্দবাবু বললেন, “সব দেকি, সব শুনি। তা নইলে আর আপনার কাজে হেল্প করব কী করে?”
“আপাতত আপনাদের ডান দিকের চোখ বন্ধ রাখলেও ক্ষতি নেই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “নদীর শোভা না দেখলেও চলবে। বাঁ দিকের সবকিছু কিন্তু দেখা চাই। পাহাড়, ঘরবাড়ি, লোকজন, মন্দির, দোকানপাট—সব। যদি ইন্টারেস্টিং কিছু চোখে পড়ে, উত্তরকাশীতে পৌঁছে আমাকে জানাতে ভুলবেন না। এখন শুধু দেখতে থাকুন।”
উত্তরকাশীতে পৌঁছতে-পৌঁছতে সাড়ে তিনটে বাজল। পথ-চলতি লোকজনদের কাছ থেকে রাস্তার হদিশ জেনে নিয়ে রাজেশ কুলকার্নির কলেজে পৌঁছতে পৌনে চারটে। দিব্যি কলেজ। এল-শেপের তিনতলা বাড়ি, পাথুরে গাঁথনির শক্তপোক্ত স্ট্রাকচার, বিশাল কম্পাউন্ড, তার মধ্যে যেমন ফুটবল খেলার মাঠ, তেমন একটা টেনিস-কোর্টও চোখে পড়ল। একদিকে একটা গির্জা। মিশনারিদের সব কলেজেই যেমন থাকে। কলেজ-কম্পাউন্ডে ঢুকে রাজেশের খোঁজ করতে একটি ছাত্র বলল, “আর কে’র আজ লাস্ট ক্লাস ছিল আড়াইটেয়। এখন ওঁকে টিচার্স রুমেও পাবেন না। হয় লাইব্রেরিতে পাবেন, নয়তো হস্টেলে ওঁর কোয়ার্টার্সে।”
লাইব্রেরিতে পাওয়া গেল না। হস্টেলটা যে খেলার মাঠের ধারে, সেটা আমরা কলেজে ঢুকেই দেখে রেখেছি। সেখানে গিয়ে দরোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সুপারিন্টেন্ডেন্টের কোয়ার্টার্স তিনতলায়, “কুলকার্নিসাব একটু আগে কলেজ থেকে ফিরেছেন, তাঁকে তাঁর বাড়িতেই পাওয়া যাবে।”
তিনতলায় উঠে কলিং বেল টিপতে দরজা খুলে যে যুবকটি বেরিয়ে এল, তার মুখচোখ দেখেই বোঝা যায় যে, সে ভীষণ অবাক হয়ে গেছে। এগিয়ে এসে ভাদুড়িমশাইয়ের হাঁটু ছুঁয়ে বলল, “আঙ্কল, আপনি? আসুন আসুন, ভিতরে আসুন।” তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে, “এঁদের তো চিনলুম না!”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “এঁরাও তোর আঙ্কল, রাজেশ। ইনি চ্যাটার্জি-আঙ্কল আর উনি বোস-আঙ্কল। দু’জনেই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।”
সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের হাঁটু ছুঁয়ে হাত জোড় করে রাজেশ বলল, “দাঁড়িয়ে থাকবেন না, দয়া করে ভিতরে আসুন।”
দরজা পেরোলেই ড্রয়িং রুম। ঘরটা বড় নয়, তবে আসবাবপত্রও অল্প। একদিকে একটি সেন্টার-টেবিল ঘিরে বেতের একটা টানা সোফা আর খান কয়েক বেতের চেয়ার,অন্যদিকে একটা কাচের বুক-কেসে কিছু বই। আসববাবপত্র কম বলে ধুলোময়লাও কম। একদিকে মস্ত জানালা। জানালায় পর্দা নেই। মাঝে-মাঝে হাওয়া আসছে। তাতে ঠাণ্ডার আমেজ।
ঘরে ঢুকে জমিয়ে বসা গেল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “হ্যাঁ রে রাজেশ, তোর মা’কে যে দেখছি না? তিনি কোথায়?”
“মা দেরাদুনে তাঁর এক বোনের বাড়িতে গেছেন। আপন বোন নন, একটু দূর সম্পর্কের আত্মীয়। পরশু ফিরবেন।… দাঁড়ান, আপনাদের জন্যে চা করে আনি।”
“তোকেই চা করতে হবে?”
“সে তো মা থাকলেও আমি নিজেই চা করি!” রাজেশ হেসে বলল, “আপনারা গল্প করুন, আমি এক্ষুনি চা নিয়ে আসছি।”
রাজেশ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরে ভাদুড়িমশাই বললেন, “হস্টেলের ছাত্ররা থাকে একতলায় আর দোতলায়। তিনতলার পুরোটাই দেখছি রাজেশের দখলে। ঘর মাত্র দুটো বটে, কিন্তু ছাতটা বিরাট। দিব্যি হাত-পা ছড়িয়ে আছে।”
বললুম, “জায়গাটাও শুনেছি স্বাস্থ্যকর।”
সদানন্দবাবু বললেন, “ঠিকই শুনেচেন। আমি তো অলরেডি সেটা ফিল করতে শুরু করিচি।”
বিরাট একটা ট্রে’র উপরে চায়ের সরঞ্জাম আর আলাদা একটা প্লেটে কিছু বিস্কুট নিয়ে রাজেশ এসে ঘরে ঢুকল। বলল, “দুধ-চিনি মেশাইনি, আপনারা মিশিয়ে নিন।”
আমরা যে-যার পেয়ালায় যে যার মতন করে চা নিলুম। আমি আর সদানন্দবাবু স্রেফ লিকার, ভাদুড়িমশাই আর রাজেশ দুধ আর চিনি মিশিয়ে। নিজের পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “চমৎকার চা।…তা হ্যাঁ রে রাজেশ, তোর ছেলেবেলা তো বাঙ্গালোরে কেটেছে, সেখানকার কথা মনে পড়ে?”
রাজেশ বলল, “খুব মনে পড়ে। বিশেষ করে মনে পড়ে পটেল আঙ্কলদের কথা। ওঁরা কেমন আছেন?”
“রঞ্জনা বেঁচে নেই, জানকীদাসও মারা গেছে।…তা হ্যাঁ রে, তোর মিনিদিদির কথা মনে পড়ে না?”
“খুব মনে পড়ে। আমাকে ভারী ভালবাসত। তা মিনিদিদির খবর কী?”
“যদি বলি তোর মিনিদিদি এখন তোর খুব কাছেই থাকে, তা হলে বিশ্বাস করবি?”
“সত্যি? কোথায় থাকে সে?”
“ডুণ্ডা ভ্যালিতে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ডঃ হারবার্ট রাসেলের নাম শুনেছিস?”
“ওরেব্বাবা,” রাজেশ বলল, “তাঁকে কে না জানে। তিনি তো মস্ত লোক। আ ভেরি ওয়াইডলি রেসপেক্টেড ফিজিশিয়ান। গরিবের বন্ধু। অত নামজাদা ডাক্তার মাত্র দু’টাকা ভিজিটে রুগি দেখেন, অনেককে নাকি ওষুধও দেন বিনি পয়সায়।”
“সেই মানুষটাই তোর মিনিদিদির স্বামী।”
“বলেন কী। তা মিনিদিদি যখন এত কাছে থাকে, তখন তো তার বাড়িতে একদিন যাওয়া উচিত। আমাকে চিনতে পারবে তো?”
“কী যে বলিস, তোর নাম বলতেই তোকে চিনতে পেরেছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোর ফোন নাম্বার মিনিকে দিয়েছি। শিগগিরই তোকে ফোন করে ও বাড়িতে যেতে বলবে।”
কথা বলতে-বলতেই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ভাদুড়িমশাই। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা বসে-বসে গল্প করুন। রাজেশকে নিয়ে আমি বরং ওর কলেজটা একটু দেখে আসি।”
বুঝতে পেরেছিলুম যে, যে-কোনও কারণেই হোক, ভাদুড়িমশাই এখন রাজেশের সঙ্গে কিছুক্ষণ একা থাকতে চান। ইঙ্গিতটা ধরতে না পারায় সদানন্দবাবুও ‘চলুন আমিও যাব’ বলে উঠে পড়েছিলেন, আমি তাঁর পাঞ্জাবির খুট ধরে ফের বসিয়ে দিলুম।
রাজেশকে নিয়ে ভাদুড়িমশাই বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন ছ’টা নাগাদ। ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে দেখলুম ওই যাকে ‘বিগ শপার’ বলে সেই রকমের একটা বড়সড় ব্যাগ। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বললেন, “গোটাকয় জিনিস আর কিছু ওষুধপত্তর কেনার ছিল, এখান থেকেই কিনে নিয়ে এলুম।”
ফিরতি পথে রওনা হতে-হতে সাড়ে ছ’টা।