কামিনীর কণ্ঠহার – ৬

ঘর থেকে ফের বারান্দায় ফিরে আসতে এক মিনিটও লাগল না। বাঁ হাতে একটা সফট ড্রিঙ্কের বোতল, ডান হাতে লম্বাটে একটা কাচের গেলাশ। দাঁড়ানো অবস্থাতেই বোতল থেকে গেলাশ ভর্তি করে পানীয় ঢেলে নিল কামিনী, এক নিশ্বাসে আধ গেলাশ শেষ করল, তারপর বোতল আর গেলাশ টেবিলে নামিয়ে রেখে, ধপ করে তার চেয়ারে বসে পড়ে, ডান হাতের উলটো পিঠটা একবার ঠোঁটের উপর বুলিয়ে নিয়ে বলল, “যে লোকটা ফোন করেছিল, তার গলা আমি চিনি না। সে বলেছিল, নেকলেসটা যে-কাউকে দিয়ে পৌঁছে দিলেই হবে। তবে পৌঁছে দিতে হবে পরের দিনই। কাঁটায় কাঁটায় রাত আটটায়।”

“ক্যারিয়ার হিসেবে বিশেষ কারও নাম করেনি?” ভাদুড়িমশাই জিজ্ঞেস করলেন।

“না।” কামিনী বলল, “তবে এটা বলেছিল যে, যাকেই পাঠাই, সে যেন কোনও চালাকি করার চেষ্টা না করে। চালাকি করলে তার ফল ভাল হবে না।”

আমি বললুম, “পুলিশে খবর দেওয়া সম্পর্কে কিছু বলেনি?”

“বলেছিল বই কি। হুমকি দিয়েছিল, ওসব করলে পরিণাম খারাপ হবে।”

“ক্যারিয়ার হিসেবে কে ওটা নিয়ে গেল?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মানে কে ওটা নিয়ে যাবে, সেটা তো আর তোকে বলে দেওয়া হয়নি। লোক ঠিক করার ব্যাপারটা তো তোর হাতেই ছিল।”

“তা ছিল। হুকুম ছিল শুধু এই যে, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সে ওটা পৌঁছে দেবে।”

“কোথায় পৌঁছে দিতে হবে?”

“এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে, অন ইয়োর ওয়ে টু উত্তরকাশী, একটা হাফ-বিল্ট বাড়িতে। বাড়ি মানে জাস্ট একটা স্ট্রাকচার। শুরু করা হয়েছিল, শেষ হয়নি, আর শেষ যে কখনও হবে, তাও মনে হয় না।”

“কেন?”

“বিকজ অব দ্য লোকেশন।” কামিনী বলল, “বাড়িটা নিয়ম ভেঙে তৈরি হচ্ছিল।”

“নিয়মটা কী?”

“নিয়ম আর কিছুই নয়, পাছে এখানকার সিনিক বিউটি নষ্ট হয়, তাই পাহাড়ের গায়ে কোনও পার্মানেন্ট স্ট্রাকচার তোলা চলবে না। মালিক সেই নিয়ম ভেঙে পাহাড়ের গায়ে পাকা বাড়ি তুলছিল, একতলা-দোতলার ইটের কাজ শেষও করে ফেলেছিল, তারপরেই তার উপরে নোটিস জারি করে কাজ আটকে দেওয়া হয়। ফলে ইলেকট্রিক লাইন, জলের কানেকশন, স্যানিটেশন, প্লাম্বার ওয়ার্ক ইত্যাদি সব ফিনিশিংয়ের কাজ তো দূরের কথা, ইটের গায়ে প্লাস্টার পর্যন্ত পড়েনি। যদি উত্তরকাশীর দিকে যাও, তো রাস্তা থেকেই বাঁ দিকে তাকালে বাড়িটা দেখতে পাবে।”

“গয়নাটা সেখানে রেখে আসতে বলেছিল?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ইন দ্যাট আনফিনিশড অ্যাবানডন্ড স্ট্রাকচার?”

“হ্যাঁ, একদম নির্জন জায়গা তো। একে ফাঁকা একটা স্ট্রাকচার, তায় ধারেকাছে লোকজন নেই, কারও চোখে পড়বে না, এইসব ভেবেই বোধহয় ওখানে রেখে আসতে বলেছিল।”

শুনে ভাদুড়িমশাই একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “পরের দিন মানে ছাব্বিশে এপ্রিল। সেদিন রাত আটটায় ওখানে কাকে পাঠালি?”

“প্রথমে ভেবেছিলুম, ডোমেস্টিক স্টাফেরই কাউকে পাঠাব।” কামিনী বলল, “গয়নার ভেলভেটের কেসটাকে কাপড় নয়তো কাগজ দিয়ে ভাল করে মুড়ে দিয়ে একটা প্যাকেটের মতন করে তাকে বলব, এর মধ্যে একটা বই আছে, একজনকে দিতে হবে, রাত আটটার সময় এটা ওখানে রেখে আসতে হবে।…কিন্তু…”

“কিন্তু কী? পরে অন্যরকম মনে হল?”

“হ্যাঁ। পরে ভেবে দেখলুম, এ-বাড়ির যাকেই কাজটা করতে বলি না কেন, নিজেদের মধ্যে এই নিয়ে সে বলাবলি করবেই। ফলে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে, চাই কী বার্টির কানেও উঠে যেতে পারে। তার উপরে আবার এদের প্রত্যেকেরই যা ভূতের ভয়, সূর্য ডোবার পর ওখানে যেতে কেউ রাজি হবে কি না, সেও সন্দেহের ব্যাপার। তা ছাড়া, জায়গাটা একটু দূরেও বটে!”

“তা ভেবেচিন্তে কী ঠিক করলি?”

“ঠিক করলুম, লিজাকে বলব।”

সদানন্দবাবু বললেন, “মানে…ওই যে মেয়েটি হপ্তায় তিনদিন আপনাকে মাসাজ করতে আসে?”

“হ্যাঁ, শুধুই যে মাসাজ করে, তা নয়,” কামিনী বলল, “যোগ-ব্যায়ামের কয়েকটা আসনও করায়। তাতে বেশ উপকারও পাচ্ছি।”

আমি বললুম, “তা আপনি ঠিক করলেন যে, ক্যারিয়ারের কাজটা ওকে দিয়েই করাবেন?”

“হ্যাঁ, আমি ভেবে দেখলুম যে, ওকে বলাই ভাল। তার দুটো কারণ। প্রথম কারণ, ও একটু রেটিসেন্ট প্রকৃতির, দরকার ছাড়া এ-বাড়ির কারও সঙ্গে কথাবার্তা বিশেষ বলে না, ফলে ব্যাপারটা পাঁচকান হবার সম্ভাবনা কম।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “খুব গম্ভীর প্রকৃতির মেয়ে?”

কামিনী একটু হেসে বলল, “ঠিক তাও নয়। এমনিতে মিষ্টভাষী, সফ্ট স্পোকন, তবে তোমাদের তো বলেইছি যে, কিছুদিন আগে ওর স্বামী মারা গেছে…নাকি বলিনি?”

“হ্যাঁ, বলেছিস।”

“তো সেটাও ওর এই নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকার একটা কারণ হতে পারে। পারে না?”

“তা পারে বই কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু তুই তো দুটো কারণের কথা বলছিলি। লিজাকে

বললে কথাটা পাঁচকান হবে না, এটা প্রথম কারণ। তা দ্বিতীয় কারণটা কী?”

“দ্বিতীয় কারণটা হল, নেকলেসটা যেখানে রেখে আসার কথা, সেই জায়গাটা ওর বাড়ি থেকে বিশেষ দূরেও নয়।”

আমি বললুম, “তা লিজাকে কথাটা বললেন কখন?”

“তার পরদিন সকালে।” কামিনী বলল, “অর্থাৎ যে দিন রাত্তির আটটায় নেকলেসটা সেই আনফিনিশড বাড়িতে রেখে আসার কথা। টুয়েন্টি সিক্সথ এপ্রিল টু বি প্রিসাইজ

“হ্যাঁ, ভাদুড়িমশাই বললেন, “আজ থেকে ঠিক সাতদিন আগে।”

“অ্যান্ড দ্যাট ওয়জ আ ফ্রাইডে। তাতে আমার সুবিধেই হল। কেন না, শুক্রবার লিজার আসার দিন। কাঁটায়-কাঁটায় দশটায় আসে, এক ঘন্টা মাসাজ করে, আসন করায়, তারপর চলেও যায় ঠিক এগারোটায়।”

একটুক্ষণ চুপ করে রইল কামিনী। তারপর বলল, “সে-দিনও ঠিক দশটাতেই এল, বেসিনে নিজের হাত-মুখ সাবান দিয়ে ধুয়ে বডি অয়েল দিয়ে আমাকে মাসাজ করল মিনিট পঁয়তাল্লিশ, আমাকে দুটো আসন করতে বলল, কোথায় ভুল হচ্ছে সেটা দেখিয়ে দিল, তারপর যখন কাজ শেষ করে এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে যাচ্ছে তখন ওকে অনুরোধটা করলুম আমি।”

“ভেলভেটের বাক্সটা আগেই রেডি করে রেখেছিলি?”

“আগের রাত্তিরেই রেডি করে রেখেছিলুম। সেটা ওর হাতে দিয়ে বললুম, লিজা, উইল ইউ কাইন্ডলি ডু মি আ ফেভার?… ও তাতে একটু অবাক হয়ে বলল, কী করতে হবে? আমি বললুম, এই প্যাকেটে একটা বই আছে, এটা এক জায়গায় রাত আটটার সময় পৌঁছে দিতে হবে। কোথায় পৌঁছে দিতে হবে, তাও বললুম ওকে।”

“তুই রিকোয়েস্ট করতেই ও রাজি হয়ে গেল?”

“একেবারে সঙ্গে-সঙ্গেই যে রাজি হয়ে গেল, তা নয়। বলল, দিনের বেলায় হলে ওর কোনও অসুবিধে হত না। কিন্তু সোম বুধ আর শুক্রবারে তো হসপিটালে ওর নাইট ডিউটি থাকে, ওই তিনটে দিন তাই রাত্তিরের দিকে ও কোনো কাজ রাখে না, পাছে ডিউটিতে ওর লেট হয়ে যায়। বলে চলেই যাচ্ছিল, হঠাৎ দরজা পর্যন্ত গিয়ে একটু থেমে দাঁড়াল। তারপর পিছন ফিরে বলল, ঠিক আছে, দিয়ে দিন, আমি পৌঁছে দেব। আমি বললুম, কিন্তু তোমার তো হসপিটালে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। তাতে ও হেসে বলল, নাইট ডিউটি থাকলে বাড়ি থেকে তো আটটাতেই বেরিয়ে পড়তে হয়, আজ না হয় সাড়ে সাতটায় বার হব।”

“রাত আটটায় কেন একটা গড-ফরসে জায়গায় একটা বই পৌঁছে দিতে হবে, তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেনি?”

“না।” কামিনী বলল, “ওকে তো তা ধরো বছর দেড়েক ধরে দেখছি। এর মধ্যে যে কখনও ওকে কোনও অনুরোধ করিনি, তাও নয়। কিন্তু এই একটা ব্যাপার দেখেছি যে, অনুরোধ করলে ও হয় সেটা রাখে কিংবা সরাসরি বলে দেয়, সরি, অর্থাৎ অনুরোধটা রাখা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু কোনও ব্যাপারেই কখনও কোনও প্রশ্ন করে না।”

“প্যাকেটটা ও ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় রেখে এসেছিল?”

“হ্যাঁ। ফোনে আমাকে বলা হয়েছিল, বাড়িতে ঢুকে সামনেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি পাওয়া যাবে। নেকলেসের কেসটা রাখতে হবে তার প্রথম ধাপে। ও তা-ই রেখে আসে।”

“সেখানে কেউ ছিল না?”

“থাকলে লিজা তাকে দেখতে পায়নি। বাড়িটা তো অন্ধকার, তার মধ্যে দেখবেই বা কী করে?”

“কাউকে দেখতে পায়নি, এ-কথা লিজা তোকে কখন জানাল?”

“সোমবার আমাকে মাসাজ করতে এসে।” কামিনী বলল, “কিন্তু শুক্রবারই আমি একটা খুব মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলুম।”

শুনে, ভাদুড়িমশাইয়ের ভুরু একটু উপরে উঠে গিয়ে পরক্ষণেই আবার তার স্বাভাবিক জায়গায় ফিরে এল। বললেন, “বার্টি কিছু আঁচ করেছে?”

“ন্‌না, তা নয়।”

“মুশকিলটা তা হলে কীসের?”

কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল থেকে এবারে আর গেলাশে পানীয় ঢেলে নিল না কামিনী। বোতলটাকেই উঁচু করে তুলে ধরে বাদবাকি তরল পদার্থটুকু সরাসরি গলায় ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিল। তারপর বলল, “ওই শুক্রবার রাত্তিরেই আমাদের এই হাউসিং কমপ্লেক্সে একটা পার্টি ছিল।”

“কীসের পার্টি?”

“এখানে এক ভদ্রলোকের ছেলে বিলেতে একটা ভাল চাকরি পেয়েছে, সে বউ নিয়ে বিলেত চলে যাবে, সেই উপলক্ষে পার্টি। তা পার্টিতে আমি কী পোশাক পরে যাব, এমনিতে কখনও তা নিয়ে বার্টি কিছু বলে না। কিন্তু সেদিন রাত্তিরে হঠাৎ কী খেয়াল হল, আমি যখন পার্টিতে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, তখন বলে বসল যে, আমার হিরের নেকলেসটা যদি পরি, তো দিব্যি হয়।”

“তাতে তুই কী বললি?”

“বললুম, যেটা পরে আছি, এটা তো কিছু খারাপ নয়! এখন যদি সেই নেকলেসটা পরি তো তার সঙ্গে ম্যাচ করিয়ে আমার হাত আর কানের গয়নাও পালটাতে হবে। সে অনেক ঝামেলা, তাতে নাহক অনেক সময় নষ্ট হবে, পার্টিতে যেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”

ভাদুড়িমশাই মৃদু হেসে বললেন, “তার পরে কী হল, সে তো বুঝতেই পারছি। বার্টি জিদ ধরে বসে রইল যে, না, সেই নেকলেসটাই তোকে পরতে হবে, কেমন?”

কামিনী বলল, “ঠিক তা-ই। অন্য কখনও কিন্তু বার্টি এমন করে না। কিন্তু সেদিন যে কী হল…”

সদানন্দবাবু সম্ভবত একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেসলেন, কিংবা হয়তো এমনও হতে পারে যে, তারিখটা তিনি ঠিক খেয়াল করেননি। তাই বললেন, “তা আপনার হাজব্যান্ড যখন অত করে বলচেন, তখন না হয় একটু সময়ই নষ্ট হত, ওটা পরে নেওয়াই তো আপনার উচিত ছিল।”

আমি বললুম, “কোনটা পরে নেওয়া?”

“কেন, ওই হিরের নেকলেসটা।” সদানন্দবাবু বললেন, “ওটা পরে নিলেই তো হত।”

ভাদুড়িমশাই ধমক দেওয়ার গলায় বললেন, “কী করে পরবে? গত শুক্রবার রাতের কথা হচ্ছে, সেটা ভুলে যাবেন না। হিরের নেকলেসটা কি তখন মিনির কাছে ছিল?”

কামিনী বলল, “সেদিন সকালেই তো আমি সেটা লিজার হাতে তুলে দিয়েছি!”

“এঃ হে!” সদানন্দবাবু দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বললেন, “ভুলে গেসলুম।”

“তখন কী হল?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বার্টিকে তুই বললি, যে ওটা চুরি হয়ে গেছে?”

“প্রথমেই বলিনি।” কামিনী বলল, “আসল কথাটা তো বার্টিকে জানাতে পারছিলুম না। জানাতে ভয়ও করছিল খুব।”

“কীসের ভয়?”

“প্রথম ভয়, বার্টি হয়তো বিশ্বাস করে বসবে যে, সত্যি-সত্যি আমি আমার ওইরকমের কদর্য ছবি তুলিয়েছি। তার উপরে আবার বিশ্বাস না-করলেও কি ভয় নেই?”

বললুম, “বিশ্বাস না-করলে তো মিটেই গেল। তখন আবার ভয় কীসের?”

“বিশ্বাস না-করলে উল্টে আমাকে চার্জ করে বলবে যে, আমি কেন একটা ব্ল্যাকমেলারকে ভয় পেয়ে ঘুষ দিয়ে তার মুখ বন্ধ করার জন্যে নেকলেসটা তাকে পাঠিয়েছি। বার্টিকে আপনারা চেনেন না, ও এমনিতে ভাল মানুষ, কিন্তু রেগে গেলে ওর মাথায় খুন চেপে যায়। ওকে যদি বলতুম যে, ছবি পাঠিয়ে আর টেলিফোন করে যে-লোকটা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, নেকলেসটা তাকে কোথায় পৌঁছে দিতে হবে, তা হলে তক্ষুনি ও রিভলভার নিয়ে সেখান ছুটত। গিয়ে হয়তো সেখানে তাকে পেত না, কিংবা পেলেও একটা রক্তারক্তি কাণ্ড হত। হয় সেই লোকটা ওর হাতে খুন হত, কিংবা তার হাতে বার্টি। সে-সব ভেবেই ওকে সত্যি কথাটা বলতে পারিনি!”

“অগত্যা চুরির কথা বললি।ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু সেটাও তো প্রথমে বলিসনি বলছিস। কখন বললি তা হলে?”

“বলছি। প্রথমে কিছুক্ষণ আলমারির লকার খুলে খোঁজাখুঁজির ভান করলুম। তারপর বাটিকে বললুম, আমি তো পাচ্ছি না, তুমি একবার দ্যাখো না। তা বার্টিও খানিকক্ষণ খুঁজল। শুধু আমার আলমারির লকার নয়, সব ক’টা আলমারির সব ক’টা লকার। তারপর শাড়ির ভাঁজে, গদির তলায়। কিন্তু বার্টিও কিছু পেল না। কী বলব, ওটা পাওয়া যাবে না জেনেও যে ওকে দিয়ে এত পরিশ্রম করাচ্ছি, তার জন্যে আমার খারাপও লাগছিল খুব। শেষকালে এক সময় বললুম, দ্যাখো, গত মাসে ওই নেকলেসটা পরে একটা পার্টিতে গিয়েছিলুম, বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেসল। তখন ওটা বিছানাতেই রেখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, লকারে আর তুলে রাখা যায়নি। নিশ্চয় চুরি হয়ে গেছে।”

“তাতে বার্টি কী বলল?”

“প্রথম আমাকে একটু বকাবকি করল। তারপর বলল ইমিডিয়েটলি পুলিশে খবর দেওয়া দরকার কিন্তু, আঙ্কল, পুলিশে খবর দিতে বিবেকে বাধল আমার। আমি তো জানি, নেকলেসটা চুরি হয়নি। তা হলে পুলিশ ডেকে কী হবে। পুলিশ তো সন্দেহ করবে আমাদের বাড়ির কাজের লোকদেরই। অর্জুনকে, লছমিকে, যোগীশ্বরকে, হরিন্দরকে, দুখনকে। ওদের থানায় ধরে নিয়ে যাবে, পেটাবে। তা ছাড়া, লিজাকেও তো পুলিশ সন্দেহ করতে পারে। জেরা করতে পারে। বইয়ের প্যাকেট বলে তাকে যা দিয়েছি, সেটা সে খুলে দেখেছে কি না, তারই বা ঠিক কী। জেরায় জেরবার হয়ে সে যদি বলে দেয়, নেকলেসটা সেই প্যাকেটের মধ্যে ছিল, তা হলেই তো চিত্তির। বার্টিকে তাই বললুম, পুলিশকে জানিয়ে লাভ নেই, ওরা গুড ফর নাথিং, কোনও ক্রাইমেরই কিনারা করতে পারে না, বরং চারু আঙ্কলকে জানাই, তিনি নিশ্চয় ওটা উদ্ধার করে দিতে পারবেন।”

কামিনী থামতে ভাদুড়িমশাই বললেন, “বাস, তারপরেই ফোন করলি আমাকে!”

“করতে বাধ্য হলুম।” কামিনী বলল, “সব কথা তো শুনলে, এখন বলো, সেদিন তোমাকে ফোন না-করে কোনও উপায় ছিল আমার? যদি না তোমাকে ফোন করতুম, তো বার্টি নিশ্চয়ই থানায় ফোন করে পুলিশকে সব জানাত। তা হলে আর কেলেঙ্কারির কিছু বাকি থাকত না।”

ভাদুড়িমশাইকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল। বললেন, “সবই তো বুঝলুম, মিনি। কিন্তু আমিই বা এখন কী করব?”

কামিনী হেসে বলল, “কী আর করবে। যেন নেকলেসটাকে উদ্ধার না-করে ছাড়বে না, বার্টির সামনে এইরকম একটা ভাব দেখাবে, কয়েকটা দিন এখানে-ওখানে একটু ছুটোছুটি করবে, তারপর কলকাতায় ফিরে যাবে। বাই দ্যাট টাইম বার্টিও ধরে নেবে যে, তুমিও যখন কিছু করতে পারলে না, তখন পুলিশে খবর দিয়েও কোনও লাভ নেই।

“আর নেকলেসটা?”

“ওটা যাবার ছিল, গেছে! ওটা দিয়ে যে আমি আমার ইজ্জত বাঁচাতে পেরেছি, তা-ই যথেষ্ট। এ নিয়ে তুমি আর ভেবো না।”

কথা বলতে বলতেই হাতঘড়ির দিকে তাকাল কামিনী। বলল, “ওরে বাবা, একটা বাজতে চলল। একটু পরেই লাঞ্চের ডাক পড়বে। তোমরা স্নান করে নাও।”

“আর তুই?”

“আজ তো লিজা আসেনি, তাই মাসাজও হবে না। যোগব্যায়ামের গোটা কয়েক আসন তো করতে হবে, সে-সব নিজেই করে নেব। তারপর স্নানঘরে ঢুকব। খেতে বসব এই ধরো সওয়া একটা নাগাদ।…যাও, যাও, তোমরা আর দেরি কোরো না।”

বারান্দা থেকে কামিনী তার ঘরে চলে গেল। ভাদুড়িমশাইকে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিয়ে আমি আর সদানন্দবাবু আমাদের এলাকায় চলে এলুম। ঘরে ঢুকে সদানন্দবাবু বললেন, “আমি আর এখন চান করচি না, বরং মাতায় একটু জল ছিটিয়ে নেবখন, আপনি চান করে নিন।

চান করে বাইরে এসে দেখি, সদানন্দবাবু গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। বললুম, “কী ব্যাপার? কিছু ভাবছেন?”

সদানন্দবাবু বললেন, “ভাবচি যে, মেয়েটা বদ্ধ পাগল। নইলে হাসতে-হাসতে অমন কতা বলতে পারে?”

“কী বলল?”

“ওই যে বলল, ওটা যাবার ছিল গ্যাচে। অথচ যেটা গেল, তার দাম নাকি পাঁচ লাখ টাকা। ভাবা যায়?”

গম্ভীর গলায় বললুম, “যায়। বাজার চড়ুক, ও-মেয়ে শেয়ার বেচে ওর দ্বিগুণ টাকা তুলে নেবে।”