কামিনীর কণ্ঠহার – ৫

গয়নাটা যদি চুরি না-ও হয়ে থাকে, তবু মূল ব্যাপারটা যে একটা দামি গয়না নিয়েই, সেটা আঁচ করতে আমাদের কোনও অসুবিধে হয়নি। একইসঙ্গে আশা করছিলুম সেটা নিয়ে যে সমস্যাই দেখা দিয়ে থাকুক, এবারে তা জানা যাবে। কামিনী কিন্তু তক্ষুনি তক্ষুনি গয়নার প্রসঙ্গে ঢুকল না। বলল, “তোমাকে কবে ফোন করেছিলুম?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ছাব্বিশে এপ্রিল। দ্যাট ওয়জ আ ফ্রাইডে।”

“তোমরা কাল এসেছ। কাল ছিল দোসরা মে।” অনুচ্চ গলায় আঙুলের কর গুনতে গুনতে কামিনী বলল, “সাতাশ…আঠাশ…ঊনত্রিশ…

তিরিশ…এক…দুই। তার মানে আমার ফোন পাবার ছ’দিন বাদে এলে। জানি না এর মধ্যে কিছু হয়ে গেল কি না।”

“কী হবে?”

এটার কোনও জবাব দিল না কামিনী। বলল, “আজও তো শুক্রবার। ঠিক আছে, আজ তার আসার দিন হলেও সে আসবে না।”

“কার আসার দিন?”

“লিজার।”

“সে কে?”

“লিজা ওয়েভার্লি। নার্স কাম ম্যাসিওর। উত্তরকাশীর ডিসট্রিকট হসপিটালে কাজ করে। সোম বুধ, আর শুক্রবার তার নাইট-ডিউটি থাকে। তাই ওই তিনদিন দুপুরে এসে আমাকে মাসাজ করিয়ে যায়। তবে আজ শুক্রবার হলেও সে আসবে না। কী একটা কাজে আটকে গেছে। বার্টিও বাড়িতে নেই। সো উই ক্যান টক ফ্রিলি।”

ভাদুড়িমশাইয়ের ভুরু কুঁচকে গেল। বললেন, “যখন কাজের লোকেদের কথা জিজ্ঞেস করেছিলুম, তখন কই তার কথা তো আমাকে বলিসনি?”

“লিজা কি এ-বাড়ির ডোমেস্টিক স্টাফের মধ্যে পড়ে যে, তার কথা বলব? আর তা ছাড়া, ওর কথা বলতে হলে তো আর-একজনের কথাও বলতে হয়।”

“সেই আর-একজনই বা কে?”

“দুখন।”

“সে কী করে?”

“বার্টির অ্যাসিস্ট্যান্ট। ডাক্তারবাবুর ব্যাগ বয়, সঙ্গে-সঙ্গে ঘোরে। পাস করা কম্পাউন্ডার নয়, তবে বার্টি ওকে ওষুধপত্তরের ব্যাপারটা খানিক-খানিক শিখিয়ে নিয়েছে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “লিজা থাকে কোথায়?”

“এখান থেকে উত্তরকাশীর পথে যদি যাও তো মাইল তিনেক গেলেই বাঁ দিকে পড়বে নতুন একটা সরকারি হাউসিং কমপ্লেক্স। বাইরের ফলকে সেটা লেখাই আছে। কমপ্লেক্সে ঢুকে বাঁ দিকের বাড়িটার দোতলায় থাকে।”

“বিবাহিত?”

“হ্যাঁ, তবে বছর দুয়েক আগে স্বামী মারা গেছেন।”

“বয়েস কত?”

“বছর তিরিশ-বত্রিশ।”

“বাড়িতে আর কে থাকে?”

“লিজার মা আর ছেলে। বাচ্চা ছেলে, বয়েস বছর তিনেক।”

ভাদুড়িমশাই মিনিট খানেক চুপ করে রইলেন, তারপর বললেন, “দুখন?”

“দুখন কী?”

“লিজার কথা তো শুনলুম, দুখন থাকে কোথায়?”

“সে থাকে এ-বাড়ির অন্য সব কাজের লোক যেখানে থাকে, সেইখানেই।”

“তার মানে পাহাড়ি বস্তিতে?”

“হ্যাঁ। তবে ওদের তুলনায় অনেক কাছে। আমাদের বাড়ির পিছনেই তো পাহাড়। খানিকটা উঠে গেলেই ওর বাড়ি।”

“ঠিক আছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এবারে কাজের কথায় আয়। গয়নাটার কী হল? যা বুঝতে পারছি, ওটা চুরি হয়নি।”

“না, চুরি হয়নি।”

“অথচ বার্টিকে ভুল বোঝাবার জন্যে তোকে চুরির কথা বলতে হয়েছিল, কেমন?”

“হ্যাঁ।”

“ভুল বোঝাবার দরকার হল কেন? ওটা কাউকে দান করেছিস?…মানে এমন কাউকে, বার্টি যাকে পছন্দ করে না?”

সেলফোন বেজে উঠল। হাউসকোটের পকেট থেকে যন্ত্রটা বার করে কানে লাগিয়ে কামিনী বলল, “হ্যালো…সে কী, লাঞ্চে আসতে পারছ না? তা হলে কখন ফিরবে?…বিকেলের আগে নয়?… দেখো বাপু, বাইরে যা-তা খেয়ে একটা অসুখ বাধিয়ে বোসো না।…হ্যাঁ হ্যাঁ, ওঁরা ভাল আছেন, আঙ্কলের সঙ্গে কথা বলবে?…ঠিক আছে, একটু তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা কোরো। বাই!”

যন্ত্রটা ফের পকেটে পুরে, ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে কামিনী বলল, “বোঝো ব্যাপার। কাল বিকেলের আগে বেরিয়ে গেছে, আজ বিকেলের আগে ফিরবে না। কোনও মানে হয়?”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “এমন তো হতেই পারে। ডাক্তার মানুষ, রুগিকে ফেলে আসতে পারছে না। নাথিং আনইউজুয়াল।”

“ডাক্তার বিয়ে করে ভুল করেছি!”

“কী যে বলিস। বার্টিকে তো বাঙ্গালোরে দেখেছি…অ্যান এক্সেলেন্ট ইয়াংম্যান!”

“এখন আর খুব ইয়াং নেই!” কামিনী হেসে বলল, “গত মাসে পঞ্চাশ পেরল। টাক পড়ে গেছে! দেখলে চিনতে পারবে না!”

“বিকেলে তো আসছে, তখনই বোঝা যাবে, চিনতে পারি কি না। কিন্তু সে কথা থাক, গয়নাটার কথা শুনি। ওটা দান করেছিস কাউকে?…আচ্ছা, সে-কথাও পরে শুনব। আগে বল, ওটার দাম কত।”

“দাম কত, তা জানি না।” কামিনী শুকনো গলায় বলল, “তবে গয়নাটা তুমি হয়তো দেখে থাকবে।”

“কোন গয়নাটার কথা বলছিস?”

“মা যেটা এমনিতে না পরলেও বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান-টনুষ্ঠান হলে পরতেন। একটা নেকলেস।”

“তোর মায়ের নেকলেস তো কম ছিল না, তার মধ্যে কোনটা?”

‘যেটা আসলে ঠাকুমা’র নেকলেস, মা’কে দিয়েছিলেন।”

শুনে ভাদুড়িমশাই যেভাবে মুখ দিয়ে বাতাস টানলেন, তার শব্দ স্পষ্ট শোনা গেল। তাঁর চোখও দেখলুম হঠাৎ ভীষণ সরু হয়ে এসেছে। খানিকক্ষণ তিনি কোনও কথাই বলতে পারলেন না। মনে হল তাঁর বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। খানিক বাদে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, “তোর ঠাকুমা যেটা তোর মা’কে দিয়েছিলেন? ঠিক বলছিস?”

“হ্যাঁ।”

“তার মানে সেই হিরের লেকলেসটা?”

“হ্যাঁ, লকেটে তিনটে হিরে সেট করা। মাঝখানেরটা বেশ বড়।”

ভাদুড়িমশাই আবার কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কামিনীর দিকে। তারপর বললেন, “ওটার দাম জানিস মিনি?”

“কী করে জানব?” নির্বিকার গলায় কামিনী বলল, “আমি শেয়ার কেনাবেচার ব্যাবসা করি, কোন শেয়ারের এখন কী দাম জিজ্ঞেস করো, আমি বলে দেব। গয়নাগাটির দাম আমি জানি না।”

“আমি জানি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোর বাবা বলেছিলেন, শুধু ওই হিরে তিনটের দামই আড়াই লাখ। তা সে তো আজকের কথা নয়। এখনকার বাজারে কোন না লাখ পাঁচেক হবে। তা সেই পাঁচ লাখ টাকার নেকলেস তুই কী করেছিস? যদি না সেটা চুরি হয়ে থাকে তো দান করেছিস কাউকে?”

“না।”

“হারিয়ে ফেলেছিস?”

“না।”

“কারও কাছে বন্ধক রেখে টাকা ধার নিয়েছিস?”

“ধার নিতে যাব কেন?” কামিনী হেসে বলল, “আমার কি টাকার অভাব?”

“তা হলে?”

সেই একই রকমের নির্বিকার গলায় কামিনী বলল, “শোনো আঙ্কল, নেকলেসটা যদি চুরিই হত, তা হলে আর তোমাকে এইভাবে তলব করে এখানে টেনে আনতুম না।

“পুলিশে খবর দিতি?”

“অফ কোর্স।”

“কিন্তু বার্টি তো চুরির কথাই জানে, সে কেন পুলিশে খবর দেয়নি?”

“আমিই দিতে দিইনি। বলেছি যে, পুলিশ তো অপদার্থ, ওয়ার্থলেস। কিছুই করতে পারবে না,

মাঝখান থেকে লোক-জানাজানি হবে। তার চেয়ে বরং আঙ্কলকে ডেকে পাঠাই, তিনি ঠিকই গয়নাটা উদ্ধার করে দিতে পারবেন।”

“বার্টি সে-কথা বিশ্বাস করল?”

“প্রথমে করতে চাইছিল না। পরে যখন বললুম যে, এর আগেও…আই মিন আমার বাবার আমলে…আমাদের গয়নার দোকানের একটা চুরির কিনারা করতে তোমাকেই ডাকা হয়েছিল, আর তুমিই গয়না উদ্ধার করে দিয়েছিলে, তখন আর কী করবে, মাথা চুলকে বলল, বেশ, তা হলে আঙ্কলকেই ডাকো। তো এই হচ্ছে ব্যাপার!”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এই হচ্ছে ব্যাপারের মানে? কী যে ব্যাপার, কিছুই তো বুঝলুম না। শুধু এইটুকু বোঝা গেল যে, এটা চুরির ব্যাপার নয়।”

“চুরির ব্যাপার নয়, হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপার নয়, কাউকে দান করার কি কোথাও বন্ধক রাখার ব্যাপারও নয়।”

“এসব যদি না-ই হবে, তা হলে ব্যাপারটা আসলে কী?” ঝাঁঝালো গলায় ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুই কি আমাকে পাগল করে ছাড়বি? গয়নাটা কি উবে গেল? যা হয়েছে, খুলে বল, নয়তো আমি কিছুই করতে পারব না। আর হ্যাঁ, কিছু যদি না-ই করতে পারি, তো বেকার এখানে বসে থাকব কেন? কোনও মানে হয়? ট্যাক্সিটা তো ছাড়িনি, আজই বিকেলে আমরা দেরাদুনে ফিরে যাব।”

কামিনী যে ঘোর অস্বস্তিতে পড়েছে, সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যায়। একবার ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাল, একবার আমাদের দিকে। কিন্তু কিছুই বলল না।

মনে হল, ভাদুড়িমশাই যদিও ওকে অভয় দিয়ে বলেছেন যে, আমাদের সামনে সমস্ত কথাই স্বচ্ছন্দে বলা যায়, তবু ওর অস্বস্তি কাটছে না। এটা মনে হওয়া মাত্র আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে বললুম, “আমি আর সদানন্দবাবু বরং একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।”

ভাদুড়িমশাই ফের সেই ঝাঁঝালো গলায় নির্দেশ দিলেন, “না, আপনারা বসুন। ও যদি কিছু বলতে চায়, তো আপনাদের সামনেই বলবে।” তারপরেই কামিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “জীবনে তো কাউকে ভক্তিশ্রদ্ধা করতে শিখিসনি। না তোর বাপকে, না তোর মাকে, না আমাকে। কী করেই বা করবি, ওটা তোর কুষ্ঠিতেই লেখা নেই যে! তা না-ই থাক, তোর আঙ্কলকে তুই বিশ্বাসটা অন্তত করতি। সম্ভবত এখনও করিস। তো সেই আমিই তোকে যখন আশ্বাস দিয়েছি যে, এদের সামনে যা-কিছু বলবি, তার একটা কথাও আর-কেউ জানবে না, তখন তোর অস্বস্তি কীসের?”

মুখ নিচু করে বসে ছিল কামিনী। এবারে মুখ তুলে বলল, “কীসের অস্বস্তি, কাকে নিয়ে অস্বস্তি, বুঝতে পারছ না? অস্বস্তি আমার দাম্পত্য জীবন নিয়ে। অস্বস্তি বার্টিকে নিয়ে। বার্টি যদি আসল ব্যাপারটা জানতে পারে…”

কামিনীকে তার কথা শেষ করতে দিলেন না ভাদুড়িমশাই, মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “তা হলে তোর জীবনে ফের অশান্তি দেখা দেবে, এই তো? ঠিক আছে, বাৰ্টি কিছু জানবে না।… নাউ লেট আস হ্যাভ দ্য হোল স্টোরি। হোয়াট হ্যাপেনড টু দ্যাট নেকলেস?”

“ওটা একজনকে দিয়েছি।” চোখ নামিয়ে কামিনী বলল, “মানে…ঠিক যে দিয়েছি, তা নয়, দিতে বাধ্য হয়েছি।”

“কাকে?”

“তা জানি না।”

“তার মানে? একজনকে দিতে বাধ্য হয়েছিস, অথচ কাকে দিলি, সে কে, তুই জানিস না! কোনও মানে হয়?”

“সত্যিই জানি না!”

“তুই কিছু লুকোচ্ছিস মিনি।” ভাদুড়িমশাই প্রায় ধমক দেবার গলায় বললেন, “অ্যান্ড ইউ এক্সপেক্ট মি টু হেল্প ইউ আউট। আমার ধারণা, তুই মিথ্যে বলছিস। নেকলেসটা যাকে দিয়েছিস, তাকে চিনিস তুই, কিন্তু তা তুই স্বীকার করছিস না। ইউ আর আ ড্যাম লায়ার!”

“না আঙ্কল, আমি মিথ্যুক নই।” কাতর গলায় কামিনী বলল, “সত্যিই আমি চিনি না তাকে।”

“তা হলে ওই অত দামি নেকলেসটা তাকে দিলি কেন?”

“আমি যে ভীষণ ভয় পেয়েছিলুম।”

“কীসের ভয়?”

“বার্টি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে, এই ভয়।”

“আই সি!” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভয় পেয়েছিলি, তা তো বুঝলুম। কিন্তু তার কারণটা ঠিক বুঝতে পারছি না। বার্টি তোকে ছেড়ে চলে যাবে, এমন ভয় পাবার কী কারণ ঘটল?”

চেয়ারে এতক্ষণে টান হয়ে বসল কামিনী। বুঝতে পারছিলুম, সে ভীষণ রকমের একটা অস্বস্তিতে ভুগছে। হয় সেইজন্যে সব কথা খোলাখুলি বলতে পারছে না, নয় তো বলতে চাইছে না। মনে হল, সেই অস্বস্তির ভাবটা বোধহয় কেটে গেছে। সরাসরি সে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাল। বলল, “সব কথা না-শুনে তুমি ছাড়বে না। কেমন?”

“সব কথা না-শুনলে তোকে সাহায্য করব কী করে?”

“ঠিক আছে।” কামিনী বলল, “যা-যা ঘটেছে, পরপর সবই তোমাকে বলছি। শুধু একটা অনুরোধ, দয়া করে শিউরে উঠো না কিংবা শক্ড হোয়ো না।”

“আমরা শিউরে উঠব না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “শকড হব না। কী জানিস, যে কাজ করি, তাতে শিউরে উঠতে কি শক্ড হতে আমি তো ভুলেই গেছি, আমার এই দুই বন্ধুরও বোধ হয় সেই একই অবস্থা। তবে হ্যাঁ, যে নোংরামি আর নীচতা মাঝে-মাঝে চোখে পড়ে, তাতে একটু কষ্ট এখনও পাই ঠিকই। যা-ই হোক, তুই বলে যা, আমরা শুনছি।”

কামিনী বলল, “তোমাকে তো ছাব্বিশে এপ্রিল ফোন করেছিলুম, তা-ই না?”

“হ্যাঁ। রাত আটটায়। আমার ডায়েরিতে লেখা আছে।”

“তুমি তখুনি চলে এলে না কেন?”

“ওরে বোকা, তক্ষুনি-তক্ষুনি কি আসা যায়? কলকাতার একটা কাজে এসেছিলুম। সেটা গুছিয়ে তুলতেই তো দু’তিন দিন লেগে গেল। তিরিশ তারিখে সকালের ফ্লাইটে দিল্লি আসি। সে রাতটা দিল্লিতে ছিলুম, পরের রাতে হৃষীকেশে। ব্যাস, কাল দোসরা মে তারিখেই তোর কাছে এসে হাজির দিয়েছি।…নে, এখন তোর কথা বল।”

“ছাব্বিশ এপ্রিলের দু’দিন আগে ডাকে আমার নামে একটা প্যাকেট আসে।” কামিনী বলল, লেটার বক্স খুলে প্যাকেটটা পাই। তাতে বিচ্ছিরি কয়েকটা ফোটোগ্রাফ ছিল।”

“কার ফোটোগ্রাফ?”

গলায় একটুও জড়তা নেই, কামিনী বলল, “আমার। হরর অব হরর্স, সবই উলঙ্গ অবস্থার ছবি!” শুনে, ভাদুড়িমশাইয়ের কোনও ভাবান্তর হল না। নির্বিকার গলায় বললেন, “অমন ছবি কখনও কাউকে দিয়ে তুলিয়েছিলি?”

কামিনী ফুঁসে উঠে বলল, “এমন কথা তুমি ভাবলে কী করে?”

কথাটার জবাব না দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুলিয়েছিলি?”

“কক্ষনো না।”

“ঠিক আছে, ছবিগুলো নিয়ে আয়, আমি দেখব।” কথাটা বলেই ভাদুড়িমশাই যোগ করলেন, “না না, ছবিগুলো নয়, যে-কোনও একটা আনলেই চলবে।”

বারান্দা থেকে বেরিয়ে গিয়ে মিনিট দুয়েকের মধ্যেই কামিনী আবার ফিরে এল। হাতে একটা প্যাকেট। তার থেকে একটা ফোটোগ্রাফ বার করে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এখন বলো, এমন ছবি আমি তোলাতে পারি, আনলেস আই গো কমপ্লিটলি ম্যাড?”

ছবিটা ভাদুড়িমশাই দেখলেন মাত্র এক মুহূর্তের জন্য। তারপরেই সেটা কামিনীর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “ছবির সঙ্গে আর-কিছু ছিল না?”

“একটা চিঠি ছিল।” হাউসকোটের পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে সেটাও ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কামিনী বলল, “পড়ে দ্যাখো।”

ভাদুড়িমশাই পড়লেন। তারপর চিঠিখানাকে আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আপনারাও পড়ুন।”

ইংরেজিতে টাইপ করা অজস্র ভুলে ভরা চিঠি। বাংলা করলে এইরকম দাঁড়ায়

“এমন ছবি আমাদের কাছে আরও এক সেট আছে। তাতে যে শুধু তুমিই আছ তা নয়, তোমার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে একটি ছেলেকেও। সেও তোমারই মতো উলঙ্গ। উপযুক্ত দাম পেলে নেগেটিভসহ সমস্ত ছবি তোমাকে ফেরত দেব। দাম না পেলে ছবিগুলি পাঠাব তোমার স্বামীকে।

চিঠি পড়ে ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে তুলে দিলুম। ভাদুড়িমশাই সেটা কামিনীকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, “দাম কীভাবে ঠিক হল?”

“পরের দিনই মানে পঁচিশ এপ্রিল দুপুরে একটা টেলিফোন পাই। হেঁড়ে গলায় একটা লোক বলে, ‘তোমার কাছে তিনটে হিরে বসানো একটা নেকলেস আছে, সেটা দিলে ছবি ফেরত পাবে।’ সেইদিনই রাত্রে ফের ফোন আসে। সেই একই গলা। নেকলেসটা কীভাবে কোথায় পৌঁছে দিতে হবে, সে তা জানিয়ে দেয়।”

“কীভাবে পৌঁছে দিলি?”

“দাঁড়াও, বড্ড তেষ্টা পেয়ে গেছে। জল খেয়ে এসে সব বলছি।”

বারান্দা থেকে কামিনী আবার ঘরে ঢুকে গেল।