কামিনীর কণ্ঠহার – ৪

নদীর ধার থেকে বাংলোয় ফিরতে-ফিরতে প্রায় দশটাই বেজে যায়। ভাদুড়িমশাইয়ের পিছনে পিছনে একতলার ডাইনিং রুমে ঢুকে দেখি, কামিনী আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। জিজ্ঞেস করল, “কোথায় গিয়েছিলে?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ভোরবেলায় উঠে সদানন্দবাবুকে নিয়ে হাঁটতে গিয়েছিলুম। কিরণবাবু তো তোরই মতো ঘুমকাতুরে। আটটায় ফিরে এসে ওঁর ঘুম ভাঙাই। তারপর ওঁকে নিয়ে নদীর ধারে গেসলুম। চমৎকার জায়গা, বাতাসটাও ইনভিগরেটিং, উঠতে ইচ্ছে করছিল না। …তা বাৰ্টিকে দেখছি না যে? সে কোথায়?”

“ফেরেনি।” কামিনী বলল, “একটু আগে ফোন করেছিল। বলল, একটা কেস একটু গোলমেলে, তাকে ফেলে রেখে ফিরতে পারছে না। তবে লাঞ্চের আগে ফিরবে।”

“ব্রেকফাস্ট কোথায় করবে? আর তা ছাড়া বেরিয়ে গেছে তো কাল বিকেল হওয়ার আগেই। তা হলে রাত্তিরের খাওয়াটাই বা কোথায় খেল?”

“সঙ্গে কিছু স্যান্ডুইচ দিয়ে দিয়েছিলুম। সেই সঙ্গে এক ফ্লাস্ক কফি। ডিনার যদি করে থাকে, তো তা-ই দিয়েই করেছে।”

“আর ব্রেকফাস্ট?”

কামিনী হেসে বলল, “আজ আর সেটা ওর কপালে নেই। তবে ও নিয়ে তোমরা ভেবো না তো। ডাক্তারদের অমন হয়েই থাকে।”

কাজের লোকটি প্লেটভর্তি টোস্ট নিয়ে ঘরে ঢুকল। তারপর দুটো-দুটো করে টোস্ট আমাদের প্লেটে নামিয়ে দিয়ে বলল, “ডিম কীরকম হবে?”

ভাদুড়িমশাই কামিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুই কীরকম খাস?”

“বাবা তো ভেজিটেরিয়ান ছিলেন,” কামিনী বলল, “বাড়িতে তাই মাছ-মাংস আর ডিম কখনও ঢুকতই না। ওসব জিনিস মা’ও ছেড়ে দিয়েছিলেন, আমিও বাঙ্গালোরে থাকতে খাইনি। তবে এখন খাই।”

“তুই যে-রকম পছন্দ করিস, আমাদের জন্যেও তা-ই বলে দে। আমাদের সব রকমই পছন্দ।”

“ঠিক আছে।” কাজের লোকটির দিকে তাকিয়ে কামিনী বলল, “প্লেন অমলেট। তবে হ্যাঁ, পেঁয়াজ দিয়ো না, আর কুচোনো কাঁচালঙ্কা একটু বেশি করে দিয়ো।”

ডাইনিং রুমের পাশেই কিচেন। মালকিনের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে কাজের লোকটি কিচেনে চলে গেল। ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোর গয়নাটার কথা কাল শোনাই হল না। আজ শুনব।…মানে গয়নাটা যে চুরি হয়েছে…”

“ওটা তো চুরি হয়নি।….চুরির কথা আবার কখন বললুম?”

“তা হলে?” ভাদুড়িমশাইকে একটু বিভ্রান্ত দেখাল। “তা হলে তুই কী বলেছিলি?”

“এখুনি বলব? ইন ডিটেলস?”

“না থাক।” এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “চা খেয়ে উপরে যাই। তখন শুনব।” অমলেট এসে গিয়েছিল। টোস্ট অমলেট আর চা খেয়ে আমরা উপরে উঠে এলুম। উপরে সামনের দিকে বিশাল বারান্দা। মুল বাড়ির কাঠামো থেকে সেটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। একটি কাজের লোক এসে সেখানে একটা গোল টেবিল ঘিরে ছোট ছোট চারটে ক্যানভাসের চেয়ার রেখে গেল। আমরা তাতে আরাম করে বসার পরে ভাদুড়িমশাই একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “তোর বাড়িতে কাজের লোক মোট ক’জন রে?”

কামিনী বলল, “পাঁচজন। একজন কুক, তাকে তোমরা একতলায় দেখেছ। বাকি চারজন অন্য সব কাজ করে।”

“অন্য সব কাজ মানে কী কাজ?”

“একটি মেয়ে আছে, যে বাসন-কোসন ধোয় আর জামাকাপড় কাচে। বাদবাকি তিনজন পুরুষ। তাদের মধ্যে একজন যেমন দোতলা ঝাঁটপাট দেয়, মেঝে মোছে, ডাস্টিং করে সব সাফসুতরো রাখে, আর একজনও তেমনি সেই একই কাজ করে একতলায়”

“এখনও একজনের কথা বলিসনি। সে কী করে?”

“বাগানের কাজ করে। তা ছাড়া গাড়ি ধোয়।”

“এরা কি রাত্তিরেও এখানে…মানে এই বাড়িতে থাকে?”

“না।” কামিনী বলল, “রাত্তিরে ওরা কেউই এখানে থাকে না। সকালে আসে, যে যার নিজের কাজ করে, তারপর বিকেল হবার আগেই বাড়ি চলে যায়।”

“বাড়ি কোথায়?”

“পাহাড়ের বস্তিতে।…যাচ্চলে, তুমি তো গয়নার কথা কিছু শুনছ না।”

“শুনব, অত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন?” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “এক্ষুনি গয়নার কথায় আসছি। তার আগে আর দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করে নিই।”

“বেশ, করো।”

“ওরা যে পাহাড়ের বস্তিতে থাকে, তা তো শুনলুম। তা সবাই কি একই বস্তিতে থাকে?”

“না, আলাদা-আলাদা বস্তিতে।”

“সেগুলির ডিসট্যান্স এখান থেকে কতটা?”

“সবই দু’তিন মাইলের মধ্যে।” কামিনী বলল, “তবে বোঝোই তো, পাহাড়ি জায়গা, সূর্য ডুবলেই গোটা এলাকা অন্ধকার। তা ছাড়া পাহাড়ে এখন বুনো জন্তু-জানোয়ার অনেক কমে গেছে ঠিকই, তবে একেবারেই যে নেই, তা নয়। সাপ আর বিছের ভয়ও আছে। ওরা তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায়।”

“চাইতেই পারে,” সদানন্দবাবু বললেন, “জন্তু-জানোয়ার আচে, সাপখোপ আচে, তা হলে আর চাইবে না কেন?…আচ্ছা, একটা কতা বলুন তো, ভূতপেত্নির ভয় নেই তো?”

কামিনী হেসে বলল, “তাও আছে বই কী।…মানে ওদের কথা বলছি, ভীষণ ভূতের ভয়। বিশেষ করে ওই যে মেয়েটার কথা বললুম, লছমি…বাসন মাজা আর কাপড়চোপড় ধোয়ার কাজ করে…তার যে কী ভীষণ ভূতের ভয়, সে আর কী বলব।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওরা তো বিকেল না হতেই বাড়ি চলে যায়। বার্টিও কি আর নিত্যি তিরিশ দিন বাড়িতে থাকে? ডাক্তার মানুষ, রাত্তিরের দিকে কল এলে তাকেও নিশ্চয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে হয়, রাত্তিরে আর বাড়ি ফিরতে পারে না, এই যেমন কাল রাত্তিরে ফেরেনি। তখন তোর ভয় করে না?”

“কীসের ভয়?” কামিনী এবারে হো-হো করে হেসে উঠল। “ভূতের? ধুত, আমি কি ভূতে বিশ্বাস করি নাকি?”

“ভূত না-ই থাক, চোর-ডাকাত তো আছে। নাকি তাও নেই?”

“তা থাকবে না কেন। তবে ডুণ্ডা ভ্যালির এই হাউসিং কমপ্লেক্সে চোর-ডাকাতের ভয়ও নেই, আঙ্কল। এখানকার পাহারা ভীষণ কড়া।”

“সেটা আমরা এরই মধ্যে বুঝেছি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবু এত বড় একটা বাড়িতে একা থাকতে একটু অস্বস্তি হওয়াই তো স্বাভাবিক। কাজের মেয়েটাকে তো মাঝেমধ্যে থাকতে বলতে পারিস।”

“ওর নিজের সংসার আছে না? আর তা ছাড়া লছমি থাকলেই বা লাভ কী? বরং অর্জুন….আই মিন আমাদের কুক…ওই যে লোকটি তোমাদের ব্রেকফাস্ট সার্ভ করল…সে থাকলে লাভ হত। তা হলে আর রাত্তিরের খাবারটা নিত্যি-নিত্যি আমাকে গরম করে নিতে হত না।”

“অর্জুনকে তো তোদের বাঙ্গালোরের বাড়িতেও দেখেছি।”

“দেখতেই পারো, ও বাবার আমলের লোক। বাঙ্গালোরে তো তুমি মাঝে-মাঝেই আমাদের বাড়িতে আসতে। মুখটা মনে রেখেছ দেখছি।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমি সব কিছুই মনে রাখি। কিন্তু সে-কথা হচ্ছে না। অর্জুন তা হলে বাঙ্গালোরের লোক নয়?”

“না, বাঙ্গালোরে গিয়েছিল কাজের ধান্দায়। আসলে ও গাড়োয়ালি, বার্টির সঙ্গে আমার বিয়ে হবার পর খুশি হয়েই আমার সঙ্গে এখানে চলে এসেছে।”

“কিন্তু তোরা তো প্রথম একটা বছর উত্তরকাশীতে ছিলি। অথচ অর্জুনের বাড়ি এখানকার পাহাড়ি বস্তিতে। তখন তা হলে রোজ-রোজ বাড়িতে ফিরতে পারত না।”

“না।” কামিনী বলল, “তখন সপ্তাহে একদিন…রবিবার বাড়ি আসত, আবার সোমবার সকালে বাস ধরে চলে যেত উত্তরকাশী। পরে ওই আমাদের খবর দেয় যে, ডুণ্ডা ভ্যালির কলোনিতে জমি পাওয়া যাচ্ছে। শুনে আমরা এখানকার কলোনির কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জমি কিনে বাড়ি বানাই। বার্টি আর্মির ডাক্তার ছিল, তাই জমি পেতে অসুবিধে হয়নি।”

“তাতে যেমন তোদের, তেমন অর্জুনেরও লাভ হল, কী বলিস?”

“তা তো হলই। ও এখন রোজই বাড়ি ফিরতে পারে।”

“এরা সবাই…মানে তোদের এই বাড়িতে যারা কাজ করে…সবাই বিশ্বাসযোগ্য লোক?”

“অবিশ্বাস করার মতন তো কখনও কিছু দেখিনি।”

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। একটা সিগারেট ধরালেন। দেশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠিটাকে শূন্যে বার দুই সজোরে নেড়ে নেভালেন। তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, “যদি কিছু মনে না করিস, তো একটা প্রশ্ন করব।”

কামিনী হেসে বলল, “বেশ তো, করো।”

“বার্টির রোজগারপত্তর কেমন?”

“ভালই।” কামিনী বলল, “আর্মি থেকে আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পেনশনটা

নেহাত খারাপ পায় না। তা ছাড়া ডাক্তারি তো আর ছেড়ে দেয়নি।”

“তাতেও কিছু আসে, কেমন?”

“যতটা আসতে পারত, তার সিকির সিকিও আসে না।”

“কেন?”

“ওর রুগি দেখার ফি কত জানো?”

“কত?”

‘পার ভিজিট দু’টাকা। বলে, এখানকার লোকজন বড় গরিব, এর বেশি দেবে কোত্থেকে?”

“তা হলে ওই দু’টাকাই বা নেয় কেন?”

“ওর তরফে তারও একটা জবাব আছে।” কামিনী হাসল। “ও বলে যে, একেবারে ফ্রিতে রুগি দেখলে ডাক্তার সম্পর্কে রুগির আস্থা জন্মায় না।”

“ঠিকই বলে।”

“তা ছাড়া, রোজগারের কথা উঠছেই বা কেন?” কামিনী বলল, “বার্টির টাকা আর আমার টাকা কি আলাদা? ও যা-ই পেনশন পাক, শেয়ার কেনা-বেচার ব্যাবসায় আমি কি কম রোজগার করি নাকি?”

ভাদুড়িমশাইয়ের চোখে কৌতুক ঝিলিক দিল। বললেন, “কত রোজগার করিস?”

“তার কি কিছু ঠিক আছে নাকি? সবই তো বাজার ওঠা-পড়ার ব্যাপার। পড়তির বাজারে যা কিনি, সেটা ধরে রেখে দেখতে থাকি, বাজার উঠছে কি না। খানিকটা ওঠার পরে বেচে দিই। গত মাসে পাঁচ লাখ লাভ হয়েছিল। এ মাসে কিনেছি, কিন্তু বাজার ভাল নয়, তাই এখুনি বিক্রি করছি না, আরও কিছু দিন দেখব।”

“ব্যাবসা শুরু করার সময় তো বেশ-কিছু টাকা প্রথমে ইনভেস্ট করতে হয়েছিল। কত টাকার শেয়ার কিনেছিলি?”

“পঁচিশ লাখ টাকার।

“সে-টাকা পেলি কোথায়?

“বা রে!” কামিনী হেসে বলল, “বাবা আমার নামে ব্যাঙ্কে টাকা রেখে দিয়েছিল না? সে-টাকা পুরো তুলে নিয়ে শেয়ারে খাটিয়ে দিই।”

“যাক, তা হলে বাঙ্গালোরের বাড়িটা বেচিসনি?”

“আরে না না, বাড়ি বিক্রি করিনি, ভাড়াটেও বসাইনি।”

“আর তোর মায়ের যে গয়নাগাটি তুই পেয়েছিস, সেগুলির কী হল?”

“তারও একটাও বেচিনি।” কথাটা বলেই তীব্র চোখে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকাল কামিনী। বলল, “কী ব্যাপার বলো তো? টাকা বাড়ি গয়না—খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে এত সব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? রাত্তিরে ঘুম ঠিকমতো হয়েছিল?”

“তা হয়েছিল। সকাল-সকাল ঘুমিয়েছি, উঠেও পড়েছি ভোর না হতেই। তারপরে তো দু’দফা ঘুরেও এলুম।…তা যে-কথা হচ্ছিল…”

ভাদুড়িমশাইকে কথাটা শেষ করতে দিল না কামিনী। মাঝপথে বাধা দিয়ে বলল, “দাঁড়াও দাঁড়াও, তুমি যে ঘনঘন চা খাও, তা ভুলেই গেসলুম। আর-এক রাউন্ড চা দিতে বলি?”

“তা বল।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “শীতের জায়গা, চা ছাড়া চলে?”

কামিনী আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনাদের জন্যে কী বলব। চা না কফি?”

সদানন্দবাবু বললেন, “চা। তবে শুধু লিকার। আমি আর কিরণবাবু দুধ-চিনি মিশিয়ে চা খাই না। আর হ্যাঁ, লিকারটা খুব হাল্কা হলে ভাল হয়।”

“তা-ই হবে।” কামিনী বলল, “আপনারা বসুন, আমি চায়ের কথা বলে আসছি।”

ফিরে এল মিনিট পাঁচেক বাদে। এসে তার চেয়ারে বসে পড়ে, আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “খালি চারু-আঙ্কলের সঙ্গে কথা বলছি, আপনাদের সঙ্গে তো কথাই হচ্ছে না। এর আগে আপনারা এদিকে কখনও এসেছেন?”

বললুম, “আমি এসেছি, তবে সদানন্দবাবু আসেননি।”

সদানন্দবাবু বললেন, “আমি একবার এয়াদের সঙ্গে মুসুরি এসেছিলুম, তখন ডেরাডুন হরিদ্বার আর হৃষীকেশটাও দেখা হয়ে গেসল। তবে কিনা আমার দৌড় ওই পর্যন্ত, হৃষীকেশ ছাড়িয়ে ইদিকে কখনও আসা হয়নি।”

আমরা দেরাদুন বলি, সদানন্দবাবু বলেন ডেরাডুন। আমরা দেড় টাকা বললেও সদানন্দবাবু বলেন ডেড় টাকা। এটা বোধহয় নর্থ ক্যালকাটার উচ্চারণ।

কামিনী আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি এদিকে এসেছিলেন কেন? জাস্ট বেড়াতে?”

বললুম, “ঠিক তা-ই। আসলে যমুনোত্রী গেসলুম। ফিরতি পথে মনে হল, এসেই যখন পড়েছি, তখন গঙ্গোত্রীও দেখে যাই। নয়তো আবার কবে আসা হবে কে জানে। তো গঙ্গোত্রী গেসলুম এই পথেই। অনেকদিন আগের কথা, তখন এই ডুণ্ডা ভ্যালিতে এত ঘরবাড়ি দেখিনি।”

“তখন এত ঘরবাড়ি ছিলই না, তা হলে আর দেখবেন কোত্থেকে!”

চা এসে গেল। যে লোকটি আমাদের সামনের গোল টেবিলে চায়ের ট্রে নামিয়ে রাখল, একটু আগে একতলায় ডাইনিং রুমে তাকে আমরা দেখেছি। এ-বাড়ির কুক, অর্জুন। লোকটির বয়েস মনে হল বছর ষাটেক। তবে একমাথা পাকা চুল ছাড়া শরীরে কোথাও বয়েসের ছাপ তত স্পষ্ট হয়ে ফোটেনি। চামড়া কুঁচকোয়নি, হাঁটাচলার ভঙ্গিটিও সতেজ।

কামিনী বলল, “এদের চিনতে পেরেছ অর্জুন?”

“ভাদুড়িসাবকে চিনেছি।” অর্জুন মৃদু হেসে বলল, “বাঙ্গালোরে বড়বাবুর কাছে আসতেন। তবে এঁদের চিনলাম না।”

“এঁরা আঙ্কলের বন্ধু, বেড়াতে এসেছেন, দিন কয়েক থাকবেন।…তা তুমি কেন চা নিয়ে এলে, যোগীশ্বরকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই তো হত।”

“ওর ঘর ঝাঁট দেওয়া আর মোছার কাজ তো শেষ হয়ে গেছে। বসে ছিল, তাই বাটনা বাটতে লাগিয়ে দিয়ে চা’টা নিজেই নিয়ে এলাম। এঁরা লাঞ্চে কী খাবেন?”

“তোমরা যা খাও, তা-ই খাব।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশি কিছু করতে যেয়ো না।”

“আপনারা বাংগালি, আপনাদের মাছ চাই।” অর্জুন বলল, “আজ কিন্তু মাছ পাইনি। মিট আছে। কী আইটেম করব?”

কামিনী বলল, “ডাল, ভাত, সবজি আর মিট কারি।…ও হ্যাঁ, খানকয় চাপাটিও কোরো। ডাক্তারবাবু তো ভাত খান না, তাঁর চাপাটি চাই।”

অর্জুন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কামিনী টি পট থেকে পেয়ালায়-পেয়ালায় চা ঢালতে ঢালতে বলল, “লাঞ্চ একটা থেকে দুটোর মধ্যে। তারপর একটু বিশ্রাম করে নিয়ো, আঙ্কল। বিকেলে কোথাও বেড়াতে যাবে?”

ভাদুড়িমশাই চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে কামিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “কথা ঘোরাসনে মিনি। যতবার আমি গয়নাগাটির কথা তুলছি, ততবারই তুই অন্য কথায় চলে যাচ্ছিল। কী ভাবিস তুই বল তো? আমার মেমারি একদম লোপ পেয়ে গেছে?”

“এ-কথা কেন বলছ?”

“এইজন্যে বলছি যে, আমার স্পষ্ট মনে আছে, কলকাতায় ফোন করে তুই আমাকে জানিয়েছিলি যে, তোর একটা দামি গয়না চুরি হয়েছে। অথচ আজ বললি, ‘ওটা তো চুরি হয়নি!’ কী ব্যাপার বল তো? চুরি যদি না-ই হবে তো ফোনে আমাকে চুরির কথা বলেছিলি কেন?”

তক্ষুনি-তক্ষুনি প্রশ্নটার কোনও জবাব দিল না কামিনী। মুখ নিচু করে চায়ের পেয়ালায় চামচ নাড়তে লাগল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ভাদুড়িমশাই ফের সেই একই প্রশ্ন করলেন। “কেন বলেছিলি?” মুখ না তুলেই স্খলিত গলায় কামিনী বলল, “বলতে হয়েছিল।”

“তার মানে?”

এতক্ষণে মুখ তুলল কামিনী। বলল, “না-বলে উপায় ছিল না।”

“তারই বা কী মানে?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “একটা জিনিস চুরি হয়নি। অথচ সেটা চুরি হয়েছে না বলে তোর উপায় ছিল না, এর কোনও মানে হয়?”

“হয়।” অস্ফুট গলায় কামিনী বলল, “তোমাকে যখন ফোন করি, বার্টি তখন আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল যে। তাই গয়নার ব্যাপারে তাকে যা বলেছিলুম, তোমাকেও তা-ই বলতে হল।”

“ওকেই বা তোর মিথ্যে কথা বলতে হয়েছিল কেন?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “না না, অস্বস্তির কিছু নেই। আমাকে যা বলা যায়, তা এঁদের দু’জনের সামনেও স্বচ্ছন্দে বলতে পারিস। সব কথা খুলে বল, কিচ্ছু লুকোস না।”