৩
কলকাতার তুলনায় সূর্যাস্ত এখানে অনেক দেরিতে হয়। তেমনি আবার সূর্যদেব এখানে ঘুম থেকে ওঠেনও অনেক দেরিতে। এখন বৈশাখ মাস, সাড়ে চারটেতেই কলকাতার আকাশে এখন প্রথম আলোর চরণধ্বনি শোনা যায়। আজ তেসরা মে, শুক্রবার। কাল রাত্তিরে একটু দেরি করে শুয়েছিলুম বটে, কিন্তু কী জানি কেন, ভোর পাঁচটাতেই আজ আমার ঘুম ভেঙে যায়। সেটা অবশ্য প্রথম দফার নিদ্রাভঙ্গ। ঘর অন্ধকার, আকাশে আলো ফোটেনি দেখে পাশ ফিরে ফের ঘুমিয়ে পড়ি। দ্বিতীয় দফার নিদ্রাভঙ্গ হতে হতে আটটা বাজে। সদানন্দবাবু হাঁকডাক শুরু করে না দিলে হয়তো আরও দেরি হত। চোখ খুলে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললুম, “ওরে বাবা, এ যে অনেক বেলা হয়ে গেছে। আপনি কখন উঠলেন?”
“সাতটায়। ভাদুড়িমশাই তারও আগে উঠেছেন। দুজনে মিলে মাইল তিনেক হেঁটে এলুম।”
“বাইরে গেসলেন নাকি?”
“না। কম্পাউন্ডের মধ্যেই দিব্যি রাস্তা রয়েছে, বাইরে যাবার দরকারই হল না।”
“চা খাওয়া হয়েছে?”
“অনেকক্ষণ।” বলতে বলতে ভাদুড়িমশাই ঘরে ঢুকলেন। “সাতটায় বেড টি দিয়েছিল। আপনারটা ওই টেবিলে ঢাকা দেওয়া রয়েছে, আপনি ঘুমোচ্ছেন দেখে সদানন্দবাবু আর আপনাকে জাগাননি।”
“ঠিক আছে, ওটা খেয়ে নিচ্ছি।” আমি বললুম, “নতুন করে আর চা দিতে বলার দরকার নেই।”
“ওটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, খাওয়া যাবে না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “বরং এক কাজ করা যাক। চটপট মুখহাত ধুয়ে নিন, তারপর চলুন, বাইরে থেকে সবাই মিলে আর-এক চক্কর ঘুরে আসি। বাইরে মানে কম্পাউন্ডের বাইরে। রাস্তার ধারে এক-আধটা চায়ের দোকান কি আর নেই? সেখানেই চা খেয়ে নেবেন।”
“একটু বাদেই তো ব্রেকফাস্ট দেবে।” আমি বললুম, “বেড-টি মিস করেছি, এবারে ব্রেকফাস্টও মিস করব নাকি?”
“ব্রেকফাস্ট দশটার আগে দেবে না, তার আগেই আমরা ফিরে আসব…চলুন, চলুন, আর সময় নষ্ট করবেন না।”
তা-ই হল। মুখহাত ধুয়ে, জামাকাপড় পালটে নিতে পাঁচ মিনিটও লাগল না। ভাদুড়িমশাই আর সদানন্দবাবুর সঙ্গে আমি দোতলা থেকে নীচে নেমে এলুম। কম্পাউন্ডের বাইরে রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকানও পাওয়া গেল। বিস্বাদ চা। তা-ই কোনও রকমে গলাধঃকরণ করে হাঁটতে হাঁটতে আমরা নদীর ধারে গিয়ে একটা পাথরের উপরে বসে পড়লুম। চমৎকার বাতাস বইছে। ঘুমের জড়তা নিমেষে কেটে গেল।
কম্পাউন্ড থেকে বেরোবার সময়েই লক্ষ করেছিলুম যে, সাস্ত্রি পালটে গেছে। নতুন লোকটিকে জানাতে হল যে, আমরা কে, কার গেস্ট, কত নম্বর বাংলোয় উঠেছি। ব্যাপার দেখে আমি আর সদানন্দবাবু যে একটু হকচকিয়ে গেছি, ভাদুড়িমশাই সেটা ঠিকই বুঝে গেসলেন। কম্পাউন্ডের বাইরে বেরিয়ে এসেই তিনি বলেন, এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। এখানকার সিকিওরিটির ব্যবস্থা খুবই কড়া। ডুণ্ডা ভ্যালি থেকে কোনও গাড়ি বেরোলে কিংবা বাইরে থেকে কোনও গাড়ি এখানে ঢুকলে সান্ত্রি তার নম্বর আর সময় লিখে রাখে। ভিতর থেকে কোনও অপরিচিত মানুষ বেরোলেও তাকে জেরা না করে ছাড়া হয় না।
নদীর ধারে বসে গল্প করতে-করতে কামিনী রাসেল সম্পর্কেও বেশ কিছু খবর জানা গেল। পাঠকদেরও সেটা সংক্ষেপে জানিয়ে রাখি।
কামিনী রাসেলদের পরিবারের সঙ্গে ভাদুড়িমশাইয়ের পরিচয় ও যোগাযোগ বাঙ্গালোরে। এঁদের তিনি প্রায় তিরিশ বছর ধরে চেনেন। কামিনীর বাবা গুজরাতি, মা বাঙালি। বাবা জানকীদাস পটেল ছিলেন আমেদাবাদের বিখ্যাত ব্যবসায়ী। ঠাকুর্দা অশ্বিনীভাই পটেল গীতাঞ্জলির ইংরেজি তর্জমা পড়ে রবীন্দ্রনাথের ভক্ত হন। শান্তিনিকেতনের খবর তিনি রাখতেন। ছেলের ইস্কুলের পাঠ সাঙ্গ হবার পরে তাকে তিনি শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেন। এ হল পঞ্চাশের দশকের গোড়ার কথা। জানকীদাসের বয়েস তখন বছর কুড়ি। শান্তিনিকেতনে পড়ার সময়ে তার পরিচয় হয় রঞ্জনার সঙ্গে। দুজনে একই ক্লাসে পড়তেন। পরিচয় থেকে প্রণয়। প্রণয় থেকে পরিণয়। অশ্বিনীভাই বেশিদিন বাঁচেননি। জানকীদাস ও রঞ্জনার বিয়ের বছর পাঁচেক বাদে তিনি মারা যান। যেহেতু বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান, তাই পারিবারিক ব্যাবসার পুরো ঝক্কি এসে পড়ে জানকীদাসের ঘাড়ে। এদিকে আমেদাবাদের জলবায়ু রঞ্জনার সহ্য হচ্ছিল না, তিনি মাঝে-মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। ডাক্তারের পরামর্শে জানকীদাসকে তাই আমেদাবাদ ছাড়তে হয়। অশ্বিনীভাইয়ের জুয়েলারির কারবার এক জ্ঞাতিভাইয়ের কাছে বিক্রি করে দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি বাঙ্গালোরে চলে আসেন। এ হল ১৯৭৫ সালের কথা। জানকীদাস আর রঞ্জনা, দুজনেরই বয়েস তখন চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। কামিনী তাঁদের একমাত্র সন্তান। তার বয়েস তখন বারো-তেরোর বেশি হবে না।
জিজ্ঞেস করলুম, “তার মানে তো কামিনীর বয়েস এখন চল্লিশ। তা-ই না?”
“তা তো হবেই।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কিন্তু ওর কথায় একটু পরে আসছি। তার আগে জানকীদাস সম্পর্কে আর দু-একটা কথা বলে নিই। ভদ্রলোকের ব্যাবসা-বুদ্ধি ছিল অসাধারণ। একটা নতুন জায়গায় এসে রাতারাতি ব্যাবসা জমানো নেহাত চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। বলতে গেলে প্রায় অসম্ভবই। জানকীদাস কিন্তু সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করলেন। ওঁর কারবারের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে পুরো একটা বছরও লাগল না।”
“কীসের কারবার?”
“কারবার সেই একই। জুয়েলারি। তবে শুধু সোনারুপোর নয়। সেই সঙ্গে দামি পাথরের হিরে-মুক্তো-চুনি-পান্নার। গয়না বানাবার ব্যাপারে বাঙালি কারিগরদের সুখ্যাতির কথা জানতেন তো, তাই কলকাতার বউবাজার পাড়া ছুঁড়ে, অনেক বেশি মাইনের টোপ দিয়ে, বেশ কয়েকজন নামী কারিগরকে বাঙ্গালোরে নিয়ে গেসলেন। তাদের দিয়ে এমন সব ডিজাইনের গয়না বানিয়ে শো-কেস সাজাতে লাগলেন, যা দেখে গোটা কর্ণাটকে একেবারে ধন্যি-ধন্যি পড়ে গেল। যেমন ডিজাইন, তেমনি পাথর সেটিংয়ের কাজ। কী বলব, জানকীদাসের দোকান থেকে কেনা হয়েছে, দেখতে-দেখতে এটাই যেন বাঙ্গালোর আর মাইসোরের অভিজাত মহিলা-মহলের একটা স্ট্যাটাস-সিম্বল হয়ে দাঁড়াল।”
একটুক্ষণের জন্যে চুপ করলেন, ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “শুধু জানকীদাসের ব্যাবসাবুদ্ধির তারিফ করলে অবিশ্যি ভুল হবে। ঝানু কারবারি তো তিনি ছিলেনই, কিন্তু সেই সঙ্গে যদি না আর-একজনের শিল্পরুচি যুক্ত হত, জানকীদাসের জুয়েলারি তা হলে অত তাড়াতাড়ি অতটা বিখ্যাত হয়ে উঠতে পারত না। আরও অনেক সময় লেগে যেত।”
“সেই আর-একজন কে?”
জানকীদাসের স্ত্রী রঞ্জনা। একে তো শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্রী তিনি, তার উপরে অলঙ্করণের ব্যাপারে তাঁর উদ্ভাবনী শক্তিও ছিল অসাধারণ। নিজের সম্পর্কে কখনও কিছু বলতে চাইতেন না, কিন্তু আমি জানকীদাসের কাছেই শুনেছি যে, প্রতিটি গয়নার নকশা রঞ্জনা নিজের হাতে এঁকে দেখিয়ে দিতেন। শুধু তা-ই নয়, কারিগরদের ডেকে বুঝিয়ে দিতেন কোন গয়নায় কোন পাথরের সেটিং হলে সবচেয়ে বেশি মানাবে।”
ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে পটেলদের পরিচয় আশি সালে। দোকান থেকে কিছু দামি গয়না চুরি হয়েছিল। থানায় জানালে সেটাই হত স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু জানকীদাস যেহেতু তাঁরই এক খানদানি কাস্টমারকে সন্দেহ করছিলেন, তাই লোক-জানাজানি হবার ভয়ে তিনি থানায় না-গিয়ে ভাদুড়িমশাইকে তদন্তের ভার দেন। ভাদুড়িমশাই বুঝতে পারেন, জানকীদাসের সন্দেহ অমূলক নয়। নামজাদা পরিবারের সেই খদ্দেরের উপরে অন্যভাবে চাপ খাটিয়ে তিনি গয়না উদ্ধার করে আনেন। রঞ্জনা দীর্ঘজীবী ছিলেন না। বিরাশি সালে, মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি মারা যান। স্ত্রীর এই অকালবিয়োগের বেদনা জানকীদাস সহ্য করতে পারেননি। তাঁর মৃত্যু হয় পঁচাশি সালে।
সদানন্দবাবু মনে-মনে হিসেব কষছিলেন বোধহয়। বললেন, “কামিনীর বয়েস তো তখন খুবই কম হবার কতা। মেরেকেটে বাইশ-তেইশ। ওই বয়েসেই বাপের ব্যাবসার ঝক্কি ওকে সামলাতে হল?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “সামলানো ওর পক্ষে শক্ত হত না। বুদ্ধিমতী মেয়ে, ইতিমধ্যে বি. এসসি.পাসও করে ফেলেছিল। তার উপরে বাপের কাছ থেকে পেয়েছিল গুজরাতি ব্যাবসাবুদ্ধি। বাই দ্য ওয়ে, ওর আঁকা ছবি তো আপনারা দেখেননি?”
বললুম, “আমরা যে-ঘরে আছি, তার দেওয়ালে একটা ল্যান্ডস্কেপ চোখে পড়েছে। ওটা কার আঁকা?”
“কামিনীর।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “অল্প বয়েসের আঁকা। মাইসোরের আর্ট-এগজিবিশনে ওটা গোল্ড মেডেল পেয়েছিল। পরে ওর আঁকার ধাঁচ পালটে যায়। নীচের লাইব্রেরি রুমে ওর খান তিন-চার অয়েল টাঙানো আছে। পরে দেখে নেবেন।”
“তার মানে মায়ের কাছ থেকেও যে কিছু পায়নি, তা নয়।”
“তা তো বটেই। কিন্তু যা বলছিলুম, বাপের ব্যাবসার ঝক্কি সামলানো ওর পক্ষে কিছুমাত্র শক্ত হত · না। যদি অবশ্য সেদিকে ওর মন থাকত। সেটাই যে নেই!”
“মন তা হলে কোন দিকে? শুধুই ছবি আঁকার দিকে?”
“তা হলেও তো হত।” ভাদুড়িমশাই বললেন,”সেক্ষেত্রে ভাবা যেত যে, ঠিক আছে, ছবি আঁকার উপরেই নির্ভর করছে ওর অস্তিত্ব। ও ছবি আঁকতেই জন্মেছে, তা-ই আঁকুক। এমন আর্টিস্ট, এমন স্কাল্টরের কথা তো সবাই জানে, যাকে ধ্রুব বলে বুঝেছে তার জন্যে সর্বস্ব ত্যাগ করতে যাদের আটকায়নি। ভাবতুম যে, কামিনীও সেই গোত্রের। কিন্তু মুশকিল কী জানেন, সেটাও এক্ষেত্রে আমি ভাবতে পারছি না।”
“কেন পারছেন না?”
“এইজন্যে পারছি না যে, ছবি আঁকা ও ছেড়ে দিয়েছে। আসলে ও খেয়ালি মানুষ। এক-এক সময় এক-একটা খেয়াল ওর মাথায় চাপে। যখন যেটা চাপে, তখন তা-ই নিয়েই ও মশগুল। যখন কলেজে পড়ত, তখন ছবি আঁকতে-আঁকতে ও ছেড়ে দেয়। তারপরে ধরে তবলা। ক্যান ইউ ইমাজিন, অব অল থিংস তবলা। যা কিনা মেয়েরা বাজায় না। সেটা ওকে জানাতে ও কী বলল জানেন? বলল, সেইজন্যেই বাজাব। তারপর তবলা ছেড়ে ধরল সরোদ। সেটাও যথারীতি ছাড়ল। ওই যে বললুম, সবই ওর খেয়াল। তার মধ্যে আবার মাঝে-মাঝেই যেটা চাগাড় দেয়, সেটাকে ঠিক খেয়ালও বলতে পারছি না। আসলে সেটা ঘোর বদখেয়াল!”
“তার মানে?”
ভাদুড়িমশাই তক্ষুনি-তক্ষুনি আমার প্রশ্নের কোনও জবাব দিলেন না। খানিকক্ষণ একেবারে নিঃশব্দ বসে রইলেন। তারপর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, “দেখুন, বয়েসে আমি ওর বাপের চেয়েও কিছু বড়। আমাকে ও আংকল বলে। যতই খেয়ালি হোক, আমি ওকে স্নেহও কিছু কম করি না। ওর বাবা আর মা, দুজনেই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। দুজনকেই আমি খুব কাছের থেকে দেখেছি। তাই বলতে পারি যে, অমন সজ্জন একালে খুব কমই চোখে পড়ে। আর সেইজন্যেই আমার মাঝে-মাঝে বড় ধাঁধা লেগে যায়। কিছুতেই বুঝতে পারি না যে, এমন উন্মাদ মেয়ে ওঁদের কী করে হল!”
“অ্যাঁ, উন্মাদ?” সদানন্দবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “তার মানে পাগল?”
“যে-মেয়ে দুমদাম প্রেমে পড়ে, আর প্রেমে পড়লেই যার কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়ে যায়, তাকে আপনি পাগল ছাড়া আর কী বলবেন? শুধু প্রেমে পড়া নয়, সেই সঙ্গে বিয়ে করার জন্যে খেপে যাওয়া!”
“অ্যাঁ?”
“হ্যাঁ। বার্টি রাসেল ওর ক’নম্বর স্বামী জানেন?”
সদানন্দবাবু ঢোক গিলে বললেন, “ক’ নম্বর?”
“চার নম্বর।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এর আগে ও আরও তিন-তিন বার বিয়ে করেছে।”
“বলেন কী?”
“ঠিকই বলছি। কামিনীর প্রথম বিয়ে হয়েছিল এক বাপে-তাড়ানো মায়ে-খেদানো বাউণ্ডুলে আর্টিস্টের সঙ্গে। ছোকরা কাঠকয়লা দিয়ে ছবি আঁকত, তারপর সেই ছবি পার্কের রেলিঙে টাঙিয়ে বিক্রি করত। কামিনীর তখনও বিয়ের বয়েস হয়নি, বয়েস ভাঁড়িয়ে বিয়ে করে বরকে সঙ্গে নিয়ে সরাসরি বাড়িতে এসে হাজির হয়। মুখে তিন দিনের না-কামানো দাড়ি, পরনে তাপ্পি-মারা জিনসের প্যান্টালুন আর ময়লা শার্ট—জামাতা-বাবাজীবনকে দেখে রঞ্জনা শয্যা নেন। তারপরে আর বেশিদিন তিনি বাঁচেননি। সে বিয়ে বছর খানেক টিকেছিল। কামিনী নিজেই একদিন তার নতুন প্রেমিককে ডেকে এনে আর্টিস্ট-বেচারাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দেয়।”
“নতুন প্রেমিকটি কী করত?”
“ফিল্মে ফাইটারের চাকরি করত। দেখতে নেহাত খারাপ ছিল না, কিন্তু বিদ্যে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত। এই দ্বিতীয় বিয়েটাও বেশি দিন টেকেনি।”
“আর থার্ড ম্যারেজ?”
“সেটা যে খুব খারাপ হয়েছিল, এমনিতে তা বলা যাচ্ছে না। সেও প্রেম করে বিয়ে। প্রেমিকটি অধ্যাপক, বাঙ্গালোরেরই একটা আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কমার্স কলেজে অ্যাকাউন্টেসি পড়াত। বয়েস অবশ্য একটু বেশি, এই ধরুন চল্লিশ-বিয়াল্লিশ তা ওই বয়েসে তো অনেকেই আজকাল বিয়ে করে।…কী মশাই, করে না?”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা করে বই কি!” সদানন্দবাবু বললেন, “তা এটাও টিকল না কেন?”
“কী করে টিকবে?” ভাদুড়িমশাই তেতো হাসলেন। “মাসখানেক যেতে না যেতেই ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল। জানা গেল যে, প্রেমিক পুরুষটি ব্যাচেলার নয়, তার বউ-বাচ্চা রয়েছে, বউ থাকত গ্রামের বাড়িতে, খবর পেয়ে সে শহরে এসে মামলা ঠুকে দিয়েছে। বিগ্যামির চার্জ। দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বাবাজীবনের জেল হয়ে যায়।”
সদানন্দবাবু বললেন, “উরেব্বাবা!”
আমি বললুম, “তারপরে এই ফোর্থ ম্যারেজ? উইথ বার্টি রাসেল? ‘ “হ্যাঁ।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এটা যে কদ্দিন টিকবে, কে জানে।”
“এতসব হুজ্জুতের মধ্যে কারবার দেখার সময় পায়?”
“কারবার কি ওর হাতে আছে যে দেখবে?”
“তার মানে?”
“মানে খুবই সহজ।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “রঞ্জনার মৃত্যুর পরেও বছর কয়েক বেঁচে ছিলেন জানকীদাস। কামিনীর প্রথম বিয়ের ধাক্কাটা তিনি সামলাতে পেরেছিলেন, কিন্তু ফিল্মি ফাইটারের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ের ধাক্কাটা আর পারলেন না। তা ছাড়া তিনি স্পষ্ট বুঝে গেসলেন যে, লেখাপড়ায় মেয়েটা চৌখস ঠিকই, সেই সঙ্গে মায়ের শিল্পরুচির সঙ্গে বাপের ক্ষুরধার বুদ্ধিও সে পেয়েছে বটে, কিন্তু এতসব গুণের কোনওটাই শেষ পর্যন্ত কাজে লাগবে না। তার কারণ, ওর মাথায় রয়েছে পাগলামির বীজ।”
আবার একটুক্ষণের জন্যে চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর বললেন, “এটা বোঝার পরে জানকীদাস আর সময় নষ্ট করেননি, জুয়েলারির ব্যাবসাটা তিনি বিক্রি করে দেন। বাড়িটা লিখে দিলেন মেয়ের নামে। রঞ্জনার যা কিছু গয়নাগাটি ছিল, সবই মেয়ের হাতে তুলে দিলেন। আর ব্যাবসা বিক্রি করে যা পাওয়া গিয়েছিল, তার থেকে কামিনীর নামে ব্যাঙ্কে একটা পঁচিশ লাখ টাকার ফিক্সড অ্যাকাউন্ট খুলে বাদবাকি টাকা দান করলেন রামকৃষ্ণ মিশনকে। …এ হল ১৯৮৫ সালের কথা। জানকীদাস সেই বছরই মারা যান।”
বললুম, “আপনার তো খুবই বন্ধু ছিলেন, মৃত্যুর আগে আপনাকে কিছু বলে যাননি?”
“একটাই কথা বলেছিলেন। মেয়েটা তো ঘোর উন্মাদ, বিপদে পড়লে ওকে যেন আমি দেখি।”
“বাপের মৃত্যুর পরে শোধরায়নি?”
“কোথায় আর শোধরাল। জানকীদাসের মৃত্যুর পরে দিন কয়েক একটু গুম মেরে ছিল। তারপর বছর দুয়েক বাদে বিয়ে করল ওই অধ্যাপককে। অ্যানাদার ডিজাস্টার! তা সে-বিয়েও তো বিগ্যামির চার্জে আদালতের রায়ে নাকচ হয়ে গেল!”
“তারপর?”
“তারপর পাঁচ বছর বাদে এই বিয়ে। এটা হল নাইন্টিটুতে। বার্টিরও আগে একটা বিয়ে হয়েছিল, টেকেনি। আর্মির ডাক্তার, বয়েস এখন বছর পঞ্চাশ, আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে এখানে আছে।”
“এ বিয়েও প্রেম করে হয়েছিল?”
“না। খবরের কাগজের ম্যাট্রিমনিয়াল কলামের বিজ্ঞাপন দেখে।”
“এটা টিকবে তো?”
ভাদুড়িমশাই হাসলেন। “দশটা বছর যখন টিকে গেছে, তখন বোধহয় চট করে আর ভাঙবে না…ওহো, একটা মজার কথাই বলা হয়নি। এমনিতে পাগলি হলে কী হয়, মেয়েটার ব্যাবসাবুদ্ধি প্রখর কিন্তু। বাপের কাছ থেকে কিছু গয়নাগাটি, একটা বাড়ি আর ওই পঁচিশ লাখ টাকা পেয়েছিল, সে তো জানেন। তা ওর ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, একবার ভাবুন দেখি। সেভারেল ক্রোরস!”
“বটে?”
“হ্যাঁ, স্রেফ শেয়ার কেনা-বেচা করে। ভাবা যায়?”
শুনলুম। শুনে বার কয়েক ঢোক গিললুম। তারপর বললুম, “আসল কথাটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। আপনি এখানে যে কাজে এসেছেন, মনে হচ্ছে সেটা কামিনীরই কাজ, ওই আপনাকে এখানে ডেকে এনেছে। তা কাজটা কী?”
“সেই একই কাজ।” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ওর বাপের দোকানের গয়নাগাটি উদ্ধার করে দিয়েছিলুম, এবারে ওর একটা দামি গয়না উদ্ধার করে দিতে হবে।”
সদানন্দবাবু বললেন, “আবার সেই বাংলা ক্রসওয়ার্ড। সেখানেও শব্দটা ছিল গয়নাগাটি।”
আমার মনে পড়ে গেল ইংরেজি ওআর্ড-জাম্বলের কথা। সেখানে শব্দটা ছিল মার্ডারার। কিন্তু সেটা আর বললুম না।