২
আজ দোসরা মে, বৃহস্পতিবার। হাতঘড়িতে দেখছি, রাত এখন এগোরোটা। আমি আর সদানন্দবাবু একই ঘরে আছি। সদানন্দবাবু ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমার ঘুম আসছে না। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে গত দু’দিনের কথা লিখে রাখছি, নইলে পরে হয়তো ভুলে যাব।
তিরিশে এপ্রিল মঙ্গলবার ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের সকালের ফ্লাইটে দিল্লি আসি। গ্রেটার কৈলাসের বিকাশ বিশ্বাস আমার অতি স্নেহের পাত্র, অনেক দিনের বন্ধুও বটে। কলকাতা থেকে রওনা হবার আগের দিন ফোনে তাকে আমাদের দিল্লি যাওয়ার কথা জানিয়ে রেখেছিলুম ঠিকই, তবে তাই বলে সে যে গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্ট চলে আসবে, তা ভাবিনি। বিকাশ ধরে বসল যে, তার বাড়িতেই উঠতে হবে। তা অবশ্য ওঠা হল না। চিত্তরঞ্জন পার্কের কালীবাড়ির লাগোয়া যে একটা চমৎকার গেস্ট হাউস হালে বানানো হয়েছে, ভাদুড়িমশাই আগে থাকতেই সেখানে দুটো ঘর বুক করে রেখেছিলেন, ফলে সেখানেই উঠতে হয়।
বিকাশই অবশ্য সেখানে পৌঁছে দেয় আমাদের।
যেমন কালীবাড়ি, তেমন বাগান, তেমন লন। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। বোশেখ মাস, কড়া রোদ্দুর, অথচ লনের ঘাস এতটুকু হলদে হয়ে যায়নি। বোঝা যায়, মেনটেন্যান্সে কোথাও এতটুকু ত্রুটি নেই। সদানন্দবাবু তো বলেই ফেললেন যে, পারলে তিনি তাঁর বাদবাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দিতেন। “এ তো স্বর্গরাজ্য মশাই!” এই কথাটা অবশ্য কাল বিকেলে হরিদ্বারে ও হৃষীকেশেও তিনি বলেছেন, আবার আজ দুপুরে নরেন্দ্রনগরে ও বিকেলবেলায় ডুণ্ডা ভ্যালিতে পৌঁছেও তিনি রিপিট করেছেন।
এখন আবার আগের কথায় ফিরে যাই। গ্রেটার কৈলাস থেকে চিত্তরঞ্জন পার্কের দূরত্ব নেহাতই সামান্য। সন্ধেবেলায় এসে বিকাশ আমাদের তাই তার গ্রেটার কৈলাসের বাড়িতে টেনে নিয়ে যায়, তারপর রাতের খাওয়া খাইয়ে সে-ই আবার আমাদের ফিরিয়ে দিয়ে যায় কালীবাড়ির গেস্ট হাউসে। ইতিমধ্যে হৃষীকেশে যাওয়ার ট্যাক্সির ব্যবস্থাও করে রাখা হয়েছিল। তিরিশে এপ্রিল রাতটা আমরা চিত্তরঞ্জন পার্কে কাটাই। পরদিন সকালে সেখানেই স্নান আর ব্রেকফাস্ট করি। তারপর গেস্ট হাউসের বিল মিটিয়ে কালীবাড়ির টিলা থেকে নীচের রাস্তায় নেমে দেখি, ট্যাক্সি এসে গেছে।
ট্যাক্সিওয়ালার নাম ইন্দরলাল। বয়েস বছর পঁচিশ-তিরিশের বেশি হবে না। হরিয়ানার হট্টাকাটা জোয়ান যুবক। সে-ই গাড়ির মালিক, চালকও সে-ই। ইন্দরলালের মেজাজটাও ভাল, নইলে কি আর গাড়ি চালাতে-চালাতে অমন গুনগুন করে গান গায়। এইখানে একটা কথা বলে রাখি। ইন্দরের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে যে, যতদিন না আমরা দিল্লি ফিরছি, ইন্দরও ততদিন আমাদের সঙ্গেই থাকবে। তা সাতুই মে’র আগে তো আমরা দিল্লি ফিরে কলকাতার প্লেন ধরছি না, সেই কটা দিন ইন্দর যদি আমাদের কাজে বহাল থাকে তো ভালই, কাছাকাছি কয়েকটা জায়গা থেকে একটু ঘুরে আসা যাবে
যা বলছিলুম। দিল্লিতে খুচরো কয়েকটা কাজ সেরে নিয়ে আমরা হৃষীকেশের পথে রওনা দিলুম। এই রাস্তায় আমি আগেও দু’বার এসেছি। একবার ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে, একবার একা। মোদীনগর, মুজফফরনগর, রুরকি ইত্যাদি সব জায়গা পার হয়ে হরিদ্বার পৌঁছতে-পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যায়। সেখানে দুপুরের খাওয়া সেরে নিই। খাওয়ার আগে সদানন্দবাবু বায়না ধরেছিলেন যে, হরকি পৈরিতে তিনি লোহার শেকল ধরে গঙ্গাস্নানটা সেরে নেবেন। ভাদুড়িমশাইয়ের আপত্তিতে সেটা সম্ভব হয়নি। ঘাটের ধারে একটা গলিতে ঢুকে বাসমতী চালের ভাত, অড়হর ডাল আর রাজমা’র একটা তরকারি দিয়ে নিরামিষ মধ্যাহ্নভোজ সমাধা হল। শেষপাতে যে টক দইটা দিয়েছিল, সেটাও খারাপ লাগল না।
রাতটা হৃষীকেশে কাটাই। কলকাতার বাইরে গেলে সাধারণত আমরা দুটো ঘর নিয়ে থাকি। একটা ছেড়ে দিই ভাদুড়িমশাইকে। অন্যটায় থাকি আমি আর সদানন্দবাবু। এবার অনেক চেষ্টা করেও হৃষীকেশের কোনও হোটেলে দুটো ঘর পাওয়া গেল না। যাত্রী-সংখ্যা হঠাৎ নাকি ভীষণ বেড়ে গেছে, সর্বত্র ভিড়। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে এখানকার পার্বতী নিগমের ট্যুরিস্ট লজে একটা থ্রি-বেডেড রুম নিতে হল। বাথরুম একটা বলে একটু অসুবিধে হল বটে, কিন্তু ঘরটা খোলামেলা, তার উপর কাচের জানলায় গিয়ে দাঁড়ালে পাহাড় চোখে পড়ে। সন্ধে নামার আগেই লজ থেকে বেরিয়ে,খানিক হেঁটে, লছমন ঝুলা পেরিয়ে গঙ্গার ওপার থেকে দিব্যি ঘুরেও আসা গেল। পুরি আর সবজি সহযোগে নৈশাহারও ওপারেই সমাধা করেছি। হাঁটাহাঁটি কম হয়নি। লজে ফিরে বিছানায় গা ঢেলে দেওয়া মাত্ৰ ঘুমে দু’চোখ জড়িয়ে এল।
আজ দোসরা মে একটু দেরিতে ঘুম ভেঙেছিল। ভাদুড়িমশাই অবশ্য সাত সকালে বিছানা থেকে উঠে পড়েছেন। দাড়ি কামিয়ে, স্নান সেরে এক চক্কর ঘুরেও এসেছেন এরই মধ্যে। লজে ফিরে তিনিই আমাদের ঘুম ভাঙান। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, আটটা বাজে। বেশ শীত। ভাদুড়িমশাইয়ের তো বরফ-ঠান্ডা জলেও স্নান করতে কোনও অসুবিধে হয় না। কিন্তু যেমন আমার, তেমন সদানন্দবাবুরও গরম জল চাই। সেটা জোগাড় করতে অবশ্য বেগ পেতে হয়নি। চৌকিদারকে ডেকে তার হাতে একটা পাঁচ টাকার কয়েন গুঁজে দিতেই এক বালতি গরম জলের ব্যবস্থা হয়ে যায়। চটপট স্নান আর প্রাতরাশ সেরে নিয়ে, লজ ছেড়ে আমরা ন’টা নাগাদ বেরিয়ে পড়ি।
হৃষীকেশের সামনে নদী, পিছনে পাহাড়। পাহাড়কে বেড় দিয়ে উঠে গেছে চকচকে কালো পিচের রাস্তা। সেই ঘোরানো রাস্তায় পাক খেতে-খেতে ইন্দরলালের গাড়ি একেবারে পাহাড়চূড়ায় গিয়ে পৌঁছল। নীচের দিকে তাকালে শুধুই পাহাড়, খাত, শীর্ণ দু-একটি ঝর্না আর গাছপালা ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না, তবু মনে হয় যেন হৃষীকেশের একেবারে মাথায় আমরা চড়ে বসেছি। জায়গাটা আসলে একটা ছোট্ট শহর। নাম নরেন্দ্রনগর। ছিমছাম পরিপাটি জায়গা। দেখতে অনেকটা দার্জিলিঙের ম্যালের মতো। শহরের মাঝমধ্যিখানে একটা মার্কেট প্লেসও চোখে পড়ল। ট্যাক্সি থামিয়ে ভাদুড়িমশাই এক কার্টন সিগারেট কিনলেন। পথের ধারে একটা দোকানে ঢুকে চা’ও খাওয়া হল। তারপর ফের উতরাই।
নীচে নেমে সমতলভূমি। মাঝে-মাঝে ছোট-ছোট জনবসতি। এবড়ো-খেবড়ো পাথরের বাড়ি, খাপরার চাল। একটার পরে একটা বসতি পার হয়ে যাচ্ছি। হিন্দোলা, আগরখাল, ফাকট, জাজলস, নাগনি, চামুয়া, টিহারি, গোদিসরাই, চলদিয়ানা, জাম, নাগুন–নামের ফলকগুলি চোখের সামনে ভেসে উঠেই ফের ছিটকে পিছনে চলে যাচ্ছে, কোনও কিছুই ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। না ঘরবাড়ি, না গেরস্থালি, না মানুষজন।
দেখতে দেখতে ধরাসু বলে একটা জায়গায় পৌঁছে গেলুম। পথ এখান থেকে তিন দিকে চলে গেছে। পিছনের রাস্তা ধরে নরেন্দ্রনগরে ফিরে যেতে পারি। বাঁ দিকের রাস্তা চলে গেছে যমুনোত্রীর দিকে, আর গঙ্গোত্রীর দিকে যেতে হলে ধরতে হবে ডান দিকের পথ। আমরা ডান দিকের পথ ধরি। গঙ্গোত্রী দূরের ব্যাপার। তার অনেক আগে পড়বে উত্তরকাশী শহর। আমরা অবশ্য উত্তরকাশীতেও যাব না। তার আগে পড়বে ডুণ্ডা ভ্যালি। আপাতত সেখানেই আমাদের যাত্রা শেষ হবে
একটা কথা বলতে ভুলেছি। ধরাসুতে আগেই বেশ কয়েকটা বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়া আমাদের চোখে পড়েছিল। কিন্তু চোখ ভরে সেগুলো দেখব কী! মাঝখানে ভাদুড়িমশাই যে-ই একবার উত্তরকাশীর নাম করেছেন, সদানন্দবাবু অমনি চমকে উঠে বললেন, “সে কী, এখানে আবার কাশী এল কোত্থেকে?”
ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “কাশী কি আর একটা? কাশী অনেক। কলকাতায় আছে কাশীপুর। তেমনি এখানেও আছে উত্তরকাশী।”
“যেমন ধরুন শ্রীনগর।” আমি বললুম, “ওটা কাশ্মীরেও আছে, আবার হরিদ্বার থেকে বদ্রীনাথে যাবার পথেও আছে।”
ইন্দরলাল বলল, “লঙ্কাকো নাম আপলোগ শুনা হোগা।”
সদানন্দ বললেন, “হাঁ হাঁ, জরুর শুনা। য়হাঁ রাচ্ছস রহতা থা।”
“দূর মশাই,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “শুধু লঙ্কায় কেন, রাক্ষস-খোক্কস সব জায়গাতেই ছিল। কিন্তু সে-কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে, লঙ্কাই কি মাত্র একটা নাকি?”
ইন্দরলাল বলল, “উয়ো ভি দোঠো হ্যায়!”
“অন্তত দুটো।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তার মধ্যে একটার কথা তো আমরা সবাই জানি। ওই মানে কলম্বো যার রাজধানী, আর আমাদের সত্যেন দত্ত যাকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন—ওই সিন্ধুর টিপ সিংহল দ্বীপ কাঞ্চনময় দেশ।”
সদানন্দবাবু বললেন, “ঠিক আচে, ঠিক আচে, ওটার কতা সবাই জানে। অন্যটা কোতায়?”
“এই রাস্তা দিয়ে গঙ্গোত্রী যাবার পথে পড়বে।” আমি বললুম, “সেখানে চড়াই-উতরাই ঠেঙিয়ে বেশ খানিকটা গিয়ে ভৈরবঘাটে পৌঁছতে হবে। স্রেফ হাঁটাপথ। নো ট্যাক্সি নো বাস।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “আপনি ও-পথে শেষ কবে গেসলেন?”
“সত্তরের দশকে। নাইন্টিন সেভেন্টিফাইভে টু বি প্রিসাইজ।”
“তখন হাঁটতে হত। এখন বোধহয় লঙ্কাতে ব্রিজ হয়ে গেছে। সারাসরি ওখান থেকে গাড়িতে করেই ভৈরবঘাট হয়ে গঙ্গোত্রী চলে যাওয়া যায়।”
সদানন্দবাবু এতক্ষণে একটা মজার মন্তব্য করলেন। বললেন, “তার মানে সেই লঙ্কার মতন এই লঙ্কাতেও অ্যাদ্দিনে সেতুবন্ধন হয়ে গেচে?”
“হওয়াই সম্ভব।…আরে, বাঁ দিকে দেখুন… দেখুন।”
এতক্ষণ ডান দিকে তাকিয়ে ছিলুম, চোখ সেদিক থেকে ফেরানো যাচ্ছিল না। কী করে ফেরাব, অনেক সৌভাগ্য করে জন্মালে তবেই এমন একটা নদী দেখা যায়। পাথরে ভরা খাতের উপর দিয়ে নাচতে-নাচতে চলেছে স্বচ্ছ জলধারা। প্রচণ্ড স্রোত, ওর মধ্যে পড়লে হাতিও নিমেষে ভেসে যাবে। অপলক চোখে সেই জলধারাকেই দেখছিলুম আমি, ভাদুড়িমশাইয়ের কথায় চমক ভাঙল। বাঁ দিকে তাকিয়ে আর-এক চমক। হিমালয় একেবারে কাছে চলে এসেছে, আর তারই ঢালে পরপর ফুটে উঠছে বাড়িঘরের ছবি।
ভাদুড়িমশাই বললেন, “কেমন দেখছেন?”
বললুম, “এই পথ দিয়ে আগেও তো গিয়েছি। কিন্তু যদ্দুর মনে পড়ছে, তখন এত বাড়িঘর ছিল না।”
“এখন অনেক বেড়ে গেছে। যাওয়াই স্বাভাবিক। অনেকেই একটু নিরিবিলি শান্তিতে জীবন কাটাতে চায় তো, তারা ঠিকই খবর পেয়ে যায়।”
“কারা থাকে এখানে?”
“মোস্টলি রিটায়ার্ড আর্মি অফিসারস।…কী সদানন্দবাবু, থাকতে ইচ্ছে হয় এখানে?”
সদানন্দবাবু বললেন, “জায়গাটার নাম কী?”
“ডুণ্ডা ভ্যালি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কয়েকটা দিন এখন এখানেই থাকব। …ইন্দরলাল, সামনের বাঁ দিকে যে রাস্তাটা গেছে, ওখানেই গাড়ি ঘুরিয়ে ভিতরে ঢোকো।”
ভ্যালিটা আদ্যন্ত পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। উঁচু পাঁচিল, তার উপরে কাঁটাতার। গেটটা ফুট বারো চওড়া। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকেই কিন্তু বাধা পেতে হল। দেখলুম, চুঙ্গি কর আদায় করার জন্যে হাইওয়ের এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো-অব্দি যেমন কাঠের ডাণ্ডা দিয়ে রাস্তা আটকে রাখা হয়, এখানেও ঠিক সেই রকমের ব্যবস্থা। ট্যাক্সি থামাতেই গেটের একদিকের সেন্ট্রি বক্স থেকে খাকি প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরা একটি লোক বেরিয়ে এসে আমাদের গাড়ির পাশে দাঁড়াল। হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল আমরা কার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
ভাদুড়িমশাইও ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনি তাঁর বন্ধুর নাম বলতেই যে আমরা ছাড়া পেলুম, তা নয়। সান্ত্রি তার পকেট থেকে একটা কর্ডলেস ফোন বার করে বোতাম টিপে কারও সঙ্গে কিছু কথা বলল। তারপর ওদিক থেকে জবাব শুনে বলল, “যাইয়ে…তেরা নাম্বার কোঠি।”
রাস্তা থেকে ভাদুড়িমশাই আবার গাড়িতে উঠে পড়লেন। কাঠের ডাণ্ডা উপরে উঠে গেল। বাড়ি খুঁজতেও বেগ পেতে হল না। কেননা, খানিক এগোতেই চোখে পড়ল যে, এক ভদ্রমহিলা তাঁর বাড়ির সামনের লনে দাঁড়িয়ে রুমাল নাড়ছেন। অনুমান করে নিতে অসুবিধে হল না যে, গেট থেকে সান্ত্রিটি এঁকেই ফোন করেছিল, তা নইলে আর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের জন্যে ইনি অপেক্ষা করবেন কেন?
আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলুম। ভাদুড়িমশাই এগিয়ে গিয়ে ভদ্রমহিলার দু’হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “আমি আমার কথা রেখেছি, মিনি। কেমন আছিস?”
ভদ্রমহিলা হেসে বললেন, “কেমন দেখছ?”
“দশ বছর বাদে দেখছি বলে মনেই হচ্ছে না। অ্যাজ প্রিটি অ্যাজ এভার। ….আয়, আমার বন্ধুদের সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দিই।”
ভাদুড়িমশাই আমাদের সঙ্গে ভদ্রমহিলার পরিচয় করিয়ে দিলেন। নাম তো একটু আগেই শুনেছি, এখন পুরো নাম শুনলুম। কামিনী রাসেল। এঁর স্বামী হারবার্ট রাসেল অবশ্য সাহেব নন, হিমাচল প্রদেশের মানুষ। আর্মিতে ডাক্তার ছিলেন। রিটায়ার করে এখানে জমি কিনে বাংলো বানিয়ে নিয়েছেন।
“বার্টি কোথায়?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাকে দেখছি না কেন?”
‘রোগী দেখতে গেছে।” কামিনী বললেন, “তোমরা আসার একটু আগে বেরিয়ে গেল।”
“কখন ফিরবে?”
“কিচ্ছু ঠিক নেই। মাইল দশেক দূরে একটা গ্রামে নাকি একই সঙ্গে জনা তিনেকের কলেরা হয়েছে। দরকার হলে রাত্তিরটা ও সেখানেই থেকে যাবে। ফিরতে-ফিরতে কাল সকাল। … কিন্তু তোমরা আর এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। ভিতরে চলো, হাতমুখ ধোও, কিছু খেয়ে নাও, তারপর কথা হবে।…ওহো, তোমাদের ট্যাক্সিটা কি ছেড়ে দেবে নাকি?”
“না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওর সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি, আমরা এখানে যে কদিন আছি, ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে। তোদের এখানে ড্রাইভারদের থাকার কোনও আলাদা ব্যবস্থা নেই? থাকলে ওকে দেখিয়ে দে।”
“আছে।” কামিনী বললেন, “কিন্তু ওর আলাদা থাকার দরকার কী, আমাদের একতলাটা তো খালিই পড়ে থাকে, ও বরং সেখানেই থাকুক।”
ইন্দরলালকে একতলায় তার ঘর দেখিয়ে দিয়ে আমরা দোতলায় উঠে আসি।
বাংলোটার বর্ণনা দেওয়া দরকার। কিন্তু তার আগে ডুঙা ভ্যালির আরও একটু বর্ণনা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।
প্রথম দর্শনেই ভাল লেগে যাওয়ার ব্যাপারটা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। এটা যেমন মানুষের সম্পর্কে, তেমনি সবকিছু সম্পর্কেই সত্য। কেন না, পরে যখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, তখন প্রথম দর্শনে যা খুব ভাল লেগেছিল, তার মধ্যে অনেক খুঁত বেরিয়ে পড়ে। ডুণ্ডা ভ্যালি সম্পর্কে কিন্তু কথাটা একটুও খাটছে না। জায়গাটাকে যে সেই উনিশশো পঁচাত্তর সালে প্রথম দেখেছিলুম, সে তো আগেই বলেছি। সেটা ছিল ঝলক-দর্শনের ব্যাপার। শিয়রে পাহাড়, সামনে বইছে স্বচ্ছতোয়া ভাগীরথী, গোমুখ থেকে নেমে আসা পার্বত্য যে নদীর জল সমতল ভূমির গঙ্গার মতো ঘোলাটে গেরুয়া নয়, কাকচক্ষুর মতো নির্মল। তার উপরে পড়েছে পড়ন্ত সূর্যের লাল আভা। সে এক অত্যাশ্চর্য রূপময় দৃশ্য। মনে হচ্ছিল আমি যেন এক অন্য জগতে এসে পৌঁছেছি। পূর্বজন্মের অনেক সুকৃতির ফলেই এমন একটা দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য আমার হল।
সেই ভাল লাগার ব্যাপারটা কিন্তু এবারেও কমতি হল না। ডুণ্ডা ভ্যালিতে তখন ছিল মাত্র গুটি পঁচিশ-তিরিশ বাড়ি। সবই বাংলো প্যাটার্নের। দোতলা বাড়ি, সামনে লন। জায়গাটা তখন পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল না। এখন পাঁচিল উঠেছে। বাংলোর সংখ্যাও তা প্রায় একশো-দেড়শো হবে। উঁচু ভিতের উপরে হাত-পা-ছড়ানো বাংলো। প্রতিটি বাংলোর সামনে সেই আগের মতোই লন আর বাগান। লনের ঘাস মসৃণভাবে ছাঁটা; বাগান দেখলেও বোঝা যায় যে, যত্নে কোনও ত্রুটি নেই। সেই পাহাড় আর সেই নদীও ইতিমধ্যে হাপিস হয়ে যায়নি। না, সে-বারে যাকে অত ভাল লেগেছিল, এবারেই বা তাকে তবে খারাপ লাগবে কেন। বাংলোর সংখ্যা ইতিমধ্যে বেড়েছে বটে, কিন্তু এই উপত্যকার রূপের বাহার তাতে কিছুমাত্র কমেনি।
আমরা ইটের বাড়ি দেখতে অভ্যস্ত। এখানে সবই পাথরের বাড়ি। রাসেলদের বাড়িটিও তা-ই। একতলার মেঝে মোজেইক করা। দোতলার মেঝে পালিশ করা কাঠের। সিঁড়িও কাঠের। টালির ছাত। জানলা সবই কাচের। একতলায় বড়-বড় দুটি ঘর। প্রথমটি ড্রয়িংরুম। তারই একদিক থেকে চওড়া কাঠের ধাপের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। একতলার দ্বিতীয় ঘরটি লাইব্রেরি। অধিকাংশ বই-ই হয় পাহাড় কিংবা ভ্রমণ সংক্রান্ত। নামজাদা শিল্পীদের বেশ কিছু অ্যালবাম ও কিছু রান্নার বইও চোখে পড়ল। তারই মধ্যে হঠাৎ শরৎচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের এক-এক সেট রচনাবলি দেখে চমকে যাই। কারণটা পরে বুঝতে পেরেছি। কামিনীর বাবা গুজরাতি হলেও মা ছিলেন বাঙালি। ও দুটি সেট সম্ভবত তাঁরই। একতলার পিছন দিকে কিচেন ও ডাইনিং রুম।
দোতলায় পাশাপাশি তিনটি বেডরুম। গেস্ট-রুমটি পিছনের দিকে। তার সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে দাঁড়ালে পাহাড় চোখে পড়ে। ফাঁকা জায়গাটুকুতে বড়-বড় কয়েকটি টব। তার থেকে গুটিকয় লতানে ফুলগাছ ছাতে উঠে গেছে।
বাড়ির পুবদিকে খাঁজকাটা টালি বসানো ড্রাইভ। ড্রাইভের শেষে গ্যারাজ। গ্যারাজটিও দোতলা। ড্রাইভার দোতলায় থাকে। মূল বাড়ির দোতলায় যে তিনটি বেডরুমের কথা বলেছি, তার শেষেরটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ভাদুড়িমশাইকে। আমি আর সদানন্দবাবু গেস্টরুমটির দখল নিয়েছি। ইন্দরলাল জায়গা নিয়েছে গ্যারাজের উপরকার ঘরে। কামিনীদের গাড়ি আছে, সেটা ওঁরা কর্তা গিন্নি দুজনেই চালান। এখনও ড্রাইভার রাখেননি। রাখলে একতলার ড্রয়িং রুমের একপাশে ইন্দরলালের জন্যে একটা বিছানার ব্যবস্থা করতে হত।
ভাদুড়িমশাই যে এখানে শুধুই বেড়াতে আসেননি, কিছু কাজও যে তাঁর আছে, তা জানি। কিন্তু কাজটা কী তা জানি না।
আর লিখতে পারছি না। রাত প্রায় একটা বাজে। এবারে শুয়ে পড়ব।