কামিনীর কণ্ঠহার – ১২

১২

আজ পাঁচুই মে, রবিবার। কাল ঘুমোতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। আজ কিন্তু সকাল সাতটার মধ্যেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছি। সদানন্দবাবু উঠেছেন তার আগে। ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যথারীতি তিনি মাইল তিনেক প্রাতঃভ্রমণও করে এসেছেন। ব্রেকফাস্ট করেছি ন’টায়। রাজেশও তার খানিক বাদেই এসে পড়ল। কামিনী তাকে কালই ফোন করে বলে রেখেছিল যে, আজ দুপুরে সে এখানে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ খাবে, তবে দুপুর অব্দি অপেক্ষা না করে সে যেন ব্রেকফাস্ট করেই উত্তরকাশী থেকে বেরিয়ে পড়ে। সে এল দশটা নাগাদ। এসেই একটু লজ্জিত গলায় বলল যে, দেরিতে ঘুম থেকে উঠেছিল বলে তাড়াহুড়োর মধ্যে ব্রেকফাস্ট করে আসতে পারেনি। “ভালই হল রাজু, আমিও এতক্ষণ পর্যন্ত কিছু দাঁতে কাটার সময় পাইনি, এখন চল, দু’জন মিলে ডাইনিং রুমে গিয়ে কিছু খেয়ে আসি।”—বলে মিনিদিদি তার রাজুভাইকে নিয়ে খাওয়ার ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়ল।

এখন সাড়ে দশটা বাজে। দোতলার বারান্দার মাঝখানে একটা গোল টেবিল রেখে সেটাকে ঘিরে খান কয়েক চেয়ার পেতে রাখা হয়েছে। আমরা—মানে বার্টি, ভাদুড়িমশাই, সদানন্দবাবু আর আমি একটু আগেই সেখানে এসে জমায়েত হয়েছিলুম, এখন ব্রেকফাস্ট করে কামিনী আর রাজেশও এসে পড়ায় আসর একেবারে জমজমাট। কামিনীর আজ জন্মদিন। সবাই মিলে তাকে শুভেচ্ছা জানানো হল। কামনা করা হল তার সুস্থ নীরোগ দীর্ঘজীবন। হাস্য-পরিহাস ঠাট্টা-তামাশাও চলল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর, সকলের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস যখন একটু থিতিয়ে এসেছে, তখন ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বার্টি রাসেল বলল, “আঙ্কল, আজ সকালে মিনি আমাকে সমস্ত কথাই খুলে বলেছে। আমি তো এর কিছুই জানতুম না।”

ভাদুড়িমশাই হাসলেন। তারপর হাসিটাকে তাঁর দু’চোখে ধরে রেখে বললেন, “তা জেনে এখন কী মনে হচ্ছে?”

“কী আবার মনে হবে?” বার্টিও হেসে বলল, “ভুল তো সবাই করে, মিনিও করেছিল, আবার সময়মতো সেটা শুধরেও নিয়েছে। বাস, মিটে গেল।…তা ও-সব কথা থাক, আপনি যদি অনুমতি দেন তো দু-একটা প্রশ্ন করি।”

“বেশ তো, করো।”

“আঙ্কল, মিনিকে কীভাবে ফাঁদে ফেলা হয়েছিল, মিনির কাছেই সেটা শুনেছি। অবনকশাস ফোটোগ্রাফগুলোও মিনি আমাকে দেখিয়েছে। আবার, যে সংকটে ও পড়েছিল, আপনিই যে মাত্র দু’দিনের মধ্যে তা থেকে ওকে উদ্ধার করেছেন, এমনকি ব্র্যাকমেলড হয়ে যে-দুটো ফ্যামিলি এয়ারলুম ও হাতছাড়া করতে বাধ্য হয়েছিল তাও যে আপনি ফিরিয়ে এনেছেন, এই সবই আমি আজ সকালে শুনলুম। কিন্তু একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না।”

“কী বুঝতে পারছ না?”

বার্টি বলল, “যে লোকটা ওই ফোটোগ্রাফগুলো পাঠিয়েছিল, তারপর ফোনে হুমকি দিয়ে, অ্যাজ আ প্রাইস ফর হিজ সাইলেন্স, প্রথম দফায় চেয়ে পাঠিয়েছিল ওই হিরের নেকলেস আর দ্বিতীয় দফায় ওই মুক্তোর মালা, লিজাই যে তার অ্যাকমপ্লিস বা অনুচর হিসেব কাজ করছিল…আই মিন স্বেচ্ছায় না-করলেও করতে বাধ্য হচ্ছিল, এমন সন্দেহ আপনার হল কেন?

ভাদুড়িমশাই আবার একটু হেসে বললেন, “সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?”

“কই, আমার তো তা মনে হয় না।” বার্টি বলল, “ছবির সঙ্গে যে চিঠি আসে, তাতে ‘উপযুক্ত’ দামের উল্লেখ ছিল বটে, কিন্তু উপযুক্ত দামটা যে কী, তার কোনও উল্লেখ ছিল না। দামটা কাকে দিয়ে কোথায় পাঠাতে হবে, চিঠিতে তাও বলা হয়নি। লোকটা পরে ফোন করে জানায় যে, দাম হিসেবে হিরের নেকলেসটা চাই। সেটা কখন কোথায় পাঠাতে হবে? না ছাব্বিশে এপ্রিল শুক্রবার রাত আটটায় হাইওয়ের ধারে পাহাড়ের গায়ে একটা হাফ-বিল্ট অ্যাবানডন্ড বাড়িতে। কিন্তু সেটা কার হাত দিয়ে পাঠাতে হবে, ফোনে তা বলা হয়নি।”

একটুক্ষণের জন্য চুপ করে রইল বার্টি। ভাদুড়িমশাই বললেন, “থামলে কেন, গো অ্যাহেড।”

বার্টি বলল, “হিরের নেকলেসটা লিজার হাত দিয়ে পাঠানো হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তাকে দিয়েই যে পাঠাতে হবে, লোকটা তো এমন কথা বলেনি।…কী মিনি, বলেছিল?”

“না, তা সে বলেনি।” কামিনী বলল, “হিরের নেকলেসটার সময়েও বলেনি, আবার তারপরে যখন মুক্তোর মালা পাঠাবার হুকুম দেয়, তখনও বলেনি। শুধু বলেছিল, যাকে দিয়েই পাঠাই না কেন, সে যেন কোনও চালাকি করার চেষ্টা না করে।…আর হ্যাঁ, পুলিশকে যেন কিছু না জানাই। মোট কথা, লিজার কোনও উল্লেখই সে করেনি।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “করেনি, তার কারণ আর কিছুই নয়, করার কোনও দরকারই তার হয়নি। লোকটা খুব ভালই জানত যে, জিনিস দুটো তুই লিজার হাত দিয়েই পাঠাবি।”

সদানন্দবাবু বললেন, “এ-কতা বলচেন কেন?”

বার্টি বলল, “রাইট। জিনিস দুটো মিনি যে লিজার হাত দিয়ে পাঠাবে, তা তো তার জানার কথা নয়। ইন ফ্যাক্‌ট মিনি তো ক্যারিয়ার হিসেবে আর-কাউকে বেছে নিতে পারত।”

“আর-কাউকে মানে কাকে?”

“ধরুন আমাকে।”

শুনে হো-হো করে হেসে উঠলেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “তোমাকে? অব অল পার্সনস? বাৰ্টি, লোকটা বজ্জাত, কিন্তু বোকা নয়। তুমি কি ধরেই নিচ্ছ যে, তোমাকে সে চেনে না? আরে বাপু, খুব ভালই চেনে। সে জানে যে, তুমি আপরাইট লোক, তুমি কোনও অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করবে না, ঘুষ দিয়ে কারও মুখ বন্ধ করতে তুমি রাজি হবে না, উলটে হয়তো রাইফেল নিয়ে তাকে শায়েস্তা করতে ছুটবে। আর তা ছাড়া—”

বললুম, “আর তা ছাড়া কী?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “লোকটা এটাও জানত যে, মিনি তার স্বামীকে কিছুতেই এর মধ্যে টানবে না, কেননা স্বামীর কাছ থেকে ব্যাপারটাকে সে লুকিয়ে রাখতেই চায়।”

রাজেশ এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। এবারে বলল, “আমি তো এত সব কথা জানতুম না। আঙ্কল আমাকে যা করতে বলেছিলেন, সেইটুকু করেছি মাত্র। একটু আগে ব্রেকফাস্ট করতে বসে মিনিদিদির কাছে সব শুনলুম। তো আমিও একটা কথা বুঝতে পারছি না আঙ্কল।”

“কী বুঝতে পারছিস না?”

“হোয়াই ডিড মিনিদিদি হ্যাভ টু চুজ লিজা? ডক্টর রাসেলকে না-ই পাঠাক, ক্যারিয়ার হিসেবে বাড়ির কাজের লোকদেরও কাউকে তো পাঠাতেই পারত।”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “তাও যে মিনি পাঠাবে না, লোকটা সে-কথাও ভালই জানত। ওরে মিনি, কাজের লোকদের যে কেন ক্যারিয়ার হিসেবে পাঠাসনি তুই, আমি তো তা জানি। এবারে রাজেশকে বুঝিয়ে দে।”

মিনি বলল, “রাজু, তুই দেখছি সেই ছেলেবেলার মতোই গাধা রয়ে গেলি, তোর বুদ্ধি একটুও পাকেনি। ওরে হাঁদারাম, কাজের লোকদের যদি এর মধ্যে টানতুম, কথাটা তা হলে পাঁচকান হতই, এক সময়ে বার্টির কানেও পৌঁছে যেত। সেই জন্যেই ওদের কাউকে কিচ্ছু বলিনি। আর তা ছাড়া, বললেও কেউ রাজি হত না। ওদের যা ভূতের ভয়। অন্ধকারে অত দূরে ওই ভুতুড়ে বাড়িতে যেতে হবে শুনলেই হাতজোড় করে বলত, মাফ কর দিজিয়ে ম্যাডাম!”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তো এই হচ্ছে ব্যাপার। মিনি যে তার স্বামীকেও পাঠাবে না, বাড়ির কাজের লোকদেরও পাঠাবে না, লোকটা তা জানত। তা হলে বাকি রইল কে?”

একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। তারপর নিজেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বললেন, “রইল বাকি এক। অর্থাৎ কিনা একমাত্র লিজাই বাকি রইল। লোকটা যে ক্যারিয়ার হিসেবে কারও নাম করেনি, তার কারণ, সে খুব ভালই জানত যে, তার অ্যাকমপ্লিস লিজার হাত দিয়েই ওই হিরের নেকলেস আর ওই মুক্তোর মালা পাঠানো হবে।

“কিন্তু আঙ্কল, লিজা তো আমার কাছ থেকে প্যাকেট নিতে রাজিই হচ্ছিল না।” কামিনী বলল, “প্রথম বারেও না, দ্বিতীয় বারেও না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওই রাজি না-হওয়াটা ওর ভান। অনুরোধ করামাত্র রাজি হলে পাছে তোর খটকা লাগে, সন্দেহ জাগে, তাই সঙ্গে-সঙ্গে রাজি হত না। গড়িমসি করত, বলত ওর অন্য কাজ আছে, তাই রাত আটটায় যেখানে তুই প্যাকেটটা পৌঁছে দিতে বলছিস, ওই সময়ে সেখানে যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে রাজি হয়ে যেত, সেটাই আসল ব্যাপার। প্রথমবারে যেমন প্রথমটায় রাজি না হয়ে পরে রাজি হয়, দ্বিতীয়বারেও তা-ই।”

“কিন্তু আঙ্কল,” কামিনী বলল, “এখন তো তোমার কাছে শুনছি যে, দু’বারের কোনওবারেই প্যাকেটটা সে ওই ভুতুড়ে বাড়িতে পৌঁছে দেয়নি, দু’বারেই ও প্যাকেট দুটো সরাসরি নিজের বাড়িতে নিয়ে তুলেছিল। এটা কেন করেছিল লিজা?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “কারণ সেই লোকটা তাকে সেইরকমই করতে বলেছিল। সে তোকে যা করতে বলেছিল, লিজাকে তা করতে বলেনি।”

“তার মানে লিজাকে সে প্যাকেট দুটো সেই অ্যাবানডন্ড ফাঁকা বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেনি?”

“কেন বলবে? নির্জন ফাঁকা বাড়ি কি সত্যিই ফাঁকাই থেকে যায় নাকি। দু’চারদিন ফাঁকা থাকার পরেই সেটা চোর-ডাকাত আর গুণ্ডা-বদমাসের আস্তানা হয়ে দাঁড়ায়। হিরের নেকলেস আর মুক্তোর মালা নিয়ে লিজা সেখানে যাক, লোকটা কি তা চাইতে পারে নাকি? চোরের উপরে বাটপাড়ি হবার ভয় নেই তার? ভয় অবশ্য তার আরও একটা ছিল।”

“কীসের ভয়?”

পুলিশের ভয়।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “লোকটা তোকে ফোনে বলেছিল যে, পুলিশকে জানালে পরিণাম খারাপ হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তুই পুলিশকে জানাতে পারিস, এই ভয় তার ছিলই। সত্যিই যদি জানাতি আর সত্যিই যদি লিজা এই প্যাকেট নিয়ে সেই ফাঁকা বাড়িতে যেত, ব্যাপারটা কী দাঁড়াত তা হলে? পুলিশের হাতে লিজা বমাল ধরা পড়ত, আর পুলিশের জেরার ঠেলায় লিজা ফাঁস করে দিত সেই লোকটার নামধাম। লোকটা তাই কোনও ঝুঁকি নেয়নি। তোকে বলেছে সেই ফাঁকা বাড়িতে লোক পাঠাতে, আর লিজাকে বলেছে, মাল নিয়ে সে যেন সোজা নিজের ফ্ল্যাটে চলে যায়।”

বার্টি বলল, “কিন্তু লিজা যে প্যাকেট নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে চলে যাবে, তা তো আপনার জানার কথা নয়, আঙ্কল। জানলেন কী করে?”

“জানতুম না তো। জাস্ট অনুমান করেছিলুম। তবে কিনা আমি যা অনুমান করি, তা বড়-একটা ভুল হয় না।”

মিনি বলল, “কিন্তু লিজা যার অ্যাকমপ্লিস, সে তো ইতিমধ্যে ওটা বেচে দিতেও পারত। মানে মুক্তোর মালা বেচার সময় না পাক, হিরের নেকলেসটা বেচে দেবার মতো সময় যথেষ্টই পেয়েছিল। ওটা তো বেহাত হয়েছিল পুরো এক হপ্তা আগে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওরে মিনি, অত দামি হিরে বিক্রি করা চাট্টিখানি কথা? তাও এই উত্তরকাশীর মতো জায়গায়? ভাল দামে বিক্রি করতে হলে দিল্লি, মুম্বাই, বাঙ্গালোর, কলকাতা কি চেন্নাই যেতে হয়। তা ও-সব জায়গায় কি আমাদের আপিস নেই, এজেন্ট নেই? নাকি সেখানকার জুয়েলারদের মধ্যে কারা চোরাই মালের খরিদ্দার, সে-খবর আমরা রাখি না? না রে, ও-সব জায়গায় আমাদের আপিসে আমি ফোন করেছি, কিন্তু কেউই তেমন কোনও খবর আমাকে দেয়নি। তার থেকেও আমি অনুমান করে নিই যে, তোর হিরের নেকলেস এখনও পাচার হয়নি, এখানেই আছে।”

“কিন্তু লিজা তো সেটা অত সহজে ফেরত দিতে নাও পারত।”

“দেবে না, এমন আশঙ্কা ছিল বলেই তো উলটো-চাপের ব্যবস্থা করেছিলুম। লিজাকে সাফ বলেছিলুম, নেকলেসটা যদি ফেরত না দেয় তো তার ছেলেকেও সে ফেরত পাবে না।”

শুনে শিউরে উঠল কামিনী। লিজার ছেলেকে যে তুলে নেওয়া হয়েছিল, রাজেশ সে-কথা তার মিনিদিদিকে ইতিমধ্যে জানিয়ে থাকবে। কামিনী তার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাচ্চাটার সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করিসনি তো রাজু?”

রাজেশ হেসে বলল, “এমন খারাপ ব্যবহার করেছি যে, আমাকে ছেড়ে জনি তার মায়ের কাছে ফিরতেই চাইছিল না। ওকে এক বাক্স চকোলেট, তিনটে পুতুল, এক প্যাকেট রং-পেনসিল আর একটা ছবির বই কিনে দিয়েছি। তা ছাড়া খাইয়েছি দুটো প্যাড়া আর একটা আইসক্রিম। একে তুমি খারাপ ব্যবহার বলবে?”

দোতলার কাজের লোকটি ইতিমধ্যে আর-এক রাউন্ড চায়ের ব্যবস্থা করে গিয়েছিল। ভাদুড়িমশাই টি-পট থেকে তাঁর পেয়ালায় লিকার ঢেলে নিয়ে দুধ আর চিনি মেশালেন, তারপর পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে বললেন, “এবারে তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি মিনি। বার্টিকে তুই সমস্ত কথা সত্যি খুলে বলেছিস তো?”

উত্তরটা বার্টির কাছ থেকে এল। “ও, ইয়েস। শি মেড আ ক্লিন ব্রেস্ট অব ইট।”

ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ হঠাৎ সরু হয়ে গেল। বললেন, “নেকলেসটা যেদিন বেহাত হয়, সে-দিন তারিখটা ছিল ছাব্বিশে এপ্রিল। আমার ধারণা তার ক’দিন আগে এক সন্ধেবেলায় এমন একটা লোক এসে মিনির সঙ্গে দেখা করেছিল, যে এখানকার স্থানীয় লোক নয়। মিনি কি তাও তোমাকে জানিয়েছে?”

মিনি বলল, “অফ কোর্স আমি তাও বার্টিকে জানিয়েছি। কিন্তু আঙ্কল, তুমি সে-কথা জানলে কী করে? তোমাকে তো জানাইনি।”

“জানালে ভাল করতি, তা হলে আর আমাকে কষ্ট করে মাথা খাটিয়ে সেটা অনুমান করে নিতে হত না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “যা-ই হোক, এবারে আমার অনুমানের কথাটা বলি। আমার অনুমান, বার্টি যে সে-দিন সন্ধেবেলায় বাড়িতে থাকবে না, লোকটা তা জানত। এটাও সে জানত যে, ওই সময়ে মিনি ছাড়া আর কেউ এ-বাড়িতে থাকে না, কাজের লোকেরা বিকেল-বিকেলেই যে যার পাহাড়ি বস্তিতে ফিরে যায়। এ-সব জেনেই সে মিনির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। প্রথম চেষ্টা করেছিল এই হাউসিং কমপ্লেক্সের সামনের গেট দিয়ে ঢুকতে। সেন্ট্রি তাকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কোন বাড়িতে কার কাছে সে যেতে চায়। লোকটা নিজের নাম জানিয়ে বলে, মিসেস রাসেলের সঙ্গে দেখা করতে চায় সে। তা এখানকার যা নিয়ম, সেন্ট্রি বক্স থেকে মিনিকে ফোন করে লোকটার নাম বলে জানতে চাওয়া হয় যে, মিনি তার সঙ্গে দেখা করবে কি না। মিনি জানিয়ে দেয়, না, সে কাজে ব্যস্ত, এখন কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। ফলে সেন্ট্রি-বক্স থেকে লোকটাকে ভাগিয়ে দেওয়া হয়।…কী রে, মিনি, ঠিক বলছি তো?”

“ঠিকই বলছ,” কামিনী বলল, “আই জাস্ট রিফিউজড টু সি হিম।”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “সেন্ট্রি-বক্স থেকে ভাগিয়ে দিলে কী হয়, সে কি সহজে ফিরে যাবার পাত্র? তার তো টাকা চাই। তাই সামনের গেট থেকে তাড়া খেয়ে সে এই হাউসিং কমপ্লেক্সের পিছন দিকে চলে যায়, তারপর অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পাঁচিল টপকে এই কমপ্লেক্সের মধ্যে ঢুকে পড়ে।… কী মিনি, আমার অনুমান কি ভুল?”

মিনি বলল, “আমি বলতে পারব না। ইন ফ্যাক্‌ট, সে কী করে এই কমপ্লেক্সের মধ্যে ঢুকেছিল, পাঁচিল ডিঙিয়ে, না পাহারাদারকে ঘুষ দিয়ে, সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই আমার নেই। আর ইউ সিয়োর যে, সে ওই উঁচু পাঁচিল টপকেছিল?”

“অফ কোর্স আই অ্যাম।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এ-কথা কেন বলছি, সেটা পরে জানাব। তার আগে বলি, তুই তো সাফ জানিয়ে দিয়েছিলি যে, লোকটার সঙ্গে তুই দেখা করবি না, অথচ তার খানিক বাদেই তোদের সদর দরজার কলিং বেল বেজে ওঠে, আর নীচে নেমে দরজা খুলে তুই অবাক হয়ে যাস।”

“অবাক হব না?” মিনি বলল, “আমি ভেবেছিলুম, নিশ্চয় বার্টি। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছে। অথচ দরজা খুলে দেখি, যার সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই না, দরজার সামনে সেই লোকটাই দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই আমার বুকের মধ্যে ধড়াস করে ওঠে। কিন্তু আমি চেঁচিয়ে ওঠার আগে সে-ই আমার বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে বলে, চেঁচালেই গুলি করব, ভিতরে চলো, কথা আছে।”

“তুইও তাকে ভিতরে ঢুকতে দিলি, কেমন?”

“তা নইলে তো গুলি খেয়ে মরতে হত।”

“ঠিক কথা।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “গুলি খেয়ে মরাটা কোনও কাজের কথা নয়। কিন্তু মিনি, সে তো আর ‘হাউ ডু ইউ ডু’ বলতে ভিতরে ঢোকেনি, নিশ্চয় টাকা চাইতে এসেছিল। তা-ই না?”

“সবই তো জানো দেখছি।”

“কত টাকা?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “নিশ্চয় বেশ মোটা অ্যামাউন্ট?”

“হ্যাঁ, পাঁচ লাখ।”

“তাতে তুই কী বললি?”

“অত টাকা বাড়িতে নেই, বাড়িতে বড়জোর শ-পাঁচেক থাকতে পারে। তাতে বলল, ঠিক আছে, আপাতত তা-ই দাও, তবে পরে কিন্তু আবার আমি আসব। আমি আর কথা না-বাড়িয়ে পাঁচশো টাকা দিয়ে দিই।”

শুনে ভাদুড়িমশাই একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি। ওকে বসিয়েছিলি কোথায়, আর ছিলই বা কতক্ষণ?”

মিনি বলল, “এত ময়লা জামাকাপড় পরে এসেছিল যে, আমি চাইনি বাইরের কেউ ওকে দেখে ফেলে। একতলার ড্রয়িংরুম আর লাইব্রেরি-রুমটা তো বাইরের দিকে, তাই সেখানে না বসিয়ে ওকে ডাইনিং রুমে নিয়ে আসি। সেখানেই তা প্রায় আধ ঘন্টা চল্লিশ মিনিটের মতন ছিল।”

“যতক্ষণ ছিল, তুই ওকে চোখে-চোখে রেখেছিলি?

“তা তো রেখেছিলুমই।”

“তার মধ্যে দু-চার মিনিটের জন্যেও কি ও তোর চোখের আড়াল হয়নি?”

“মনে তো হয় না…” বলে মিনি এক মুহূর্ত একটু ভেবে নিয়ে বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও, ওকে ডাইনিং রুমে বসিয়ে রেখে একটুক্ষণের জন্যে আমাকে একবার পাশের লাইব্রেরি-ঘরে যেতে হয়েছিল।”

ভাদুড়িমশাইয়ের চোখ দেখলুম আবার সরু হয়ে এসেছে। বললেন, “কেন গিয়েছিলি?”

“আমাদের খুচরো খরচপত্তরের জন্যে কিছু টাকা আমি ওখানেই একটা ড্রয়ারের মধ্যে রাখি। সেখান থেকে ওই পাঁচশো টাকা নিয়ে আসতে গেসলুম। টাকাটা নিয়ে আসতে তা ধরো মিনিট খানেক লেগেছিল।”

‘সেই একটা মিনিট ও একা ছিল তোদের ডাইনিং রুমে।”

“হ্যাঁ।”

উত্তরটা শুনে একেবারে সঙ্গে-সঙ্গেই ভাদুড়িমশাই প্রশ্ন করলেন, “হ্যাঁ রে মিনি, ওই যে এনার্জি প্লাস বলে একটা টনিক তুই খাস, ওর বোতলটা তুই রাখিস কোথায়?”

হঠাৎ এমন প্রশ্ন করা হবে, কামিনী তা ভাবতে পারেনি। বলল, “এ-কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?”

“কোথায় রাখিস, তা-ই বল। কেন জিজ্ঞেস করছি, পরে বলব। আগে আমার কথার জবাব দে।”

“টনিকটা তো খাই লাঞ্চ আর ডিনারের আগে। বোতলটা তাই ডাইনিং রুমের টেবিলের উপরেই থাকে। আজও তা-ই আছে। আজকেরটা অবশ্য নতুন বোতল। মানে পরশু দিন তুমি যে নতুন বোতলটা আমার জন্যে কিনে এনেছ।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওটার কথা হচ্ছে না, আমি বলছি এনার্জি-প্লাস টনিকের পুরনো বোতলটার কথা। লোকটা যে-দিন তোর কাছে আসে, টনিকের পুরনো বোতলটা সে-দিন তা হলে তোদের ডাইনিং টেবিলে ছিল, আর লোকটাকেও তুই বসিয়েছিলি তোদের ডাইনিং রুমেই। তা-ই না?”

“হ্যাঁ।”

“আর মাঝখানে তুই মিনিট খানেকের জন্য ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলি, এই তো?”

“হ্যাঁ, মাত্তর মিনিট খানেকের জন্যে।” মিনি বলল, “পাশের ঘর থেকে টাকাটা নিয়ে আসতে তার বেশি সময় লাগেনি।”

“ওরে মিনি,” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তুই বলছিস মাত্তর এক মিনিট। আর আমি ভাবছি যে, বিষ মেশাবার পক্ষে সে তো যথেষ্ট সময়।”

শুনে শুধু মিনি কেন, আমরা সবাই চমকে উঠলুম।

বার্টি বলল, “বিষ? কী বলছেন আপনি? কে বিষ মেশাল? কীসের সঙ্গে মেশাল?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “যে লোকটা সে-দিন পাঁচিল ডিঙিয়ে তোমার বউয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, টনিকের পুরনো বোতলে সে-ই বিষ মেশায়। তার জন্যে সে পুরো একটা মিনিট সময় পেয়েছিল।”

রাজেশ হাসছিল। বলল, “বিষটা যে আর্সেনিক, ল্যাবরেটরি-টেস্টের রিপোর্ট পেয়ে কালই তা আমি আঙ্কলকে জানিয়ে দিই।…কিন্তু আঙ্কল, টনিকে যে বিষ মেশানো হয়েছে, এমন সন্দেহ আপনার হল কী করে?”

“সন্দেহ হল স্রেফ মিনির একটা কথা শুনে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মিনি বলেছিল, টনিকটা স্বাদ অতি বিচ্ছিরি। শুনে আমার খটকা লাগে। তার কারণ, এনার্জি-প্লাস একটা বিখ্যাত কোম্পানির বিখ্যাত টনিক, চটপট এনার্জি বাড়াবার জন্য অনেকেই খায়। আমার বোন মালতীর কিছুদিন আগে টাইফয়েড হয়েছিল, সেরে ওঠার পরে তাকেও ওটা খেতে দেখেছি, কিন্তু কই, কাউকে তো কক্ষনো বলতে শুনিনি যে, ওটার স্বাদ খারাপ। মিনির তা হলে স্বাদটা খারাপ লাগছে কেন?…না রাজেশ, প্রথমেই যে বিষের কথা ভেবেছিলুম, তা নয়। শুধু সন্দেহ হয়েছিল যে, হয় ওটা স্পুরিয়াস, অর্থাৎ জাল, আর নয়তো ওতে কিছু মেশানো হয়েছে।”

“কিন্তু মিনিদিদিকে প্রথমেই সে-কথা আপনি বলেননি?”

“কেন বলব? তবে হ্যাঁ, মিনি ওটা খেয়ে যাক, তাও আমি চাইনি। তাই, আমারও এনার্জি বাড়ানো দরকার বলে ভুজুং দিয়ে বোতলটা আমি মিনির কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়ে উত্তরকাশী যাই, গিয়ে এক ফাঁকে বোতলটা তোকে দিয়ে বলি যে, এর কনটেন্টটা একটু পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তা পরীক্ষার ফল তো জানাই গেল।”

আমি বললুম, “কিন্তু টনিকটা তো লিজা এনে দিয়েছিল। কামিনীকে ওটা নিয়মিত খেতেও বলেছিল সে-ই। বিষ মেশাবার ব্যাপারে আপনার সন্দেহও তাই লিজার উপরেই পড়া উচিত ছিল, তা-ই না?”

“আপনি ঠিক কথাই বলেছেন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ইন ফ্যাক্‌ট এ-ব্যাপারে আমি প্রথম সন্দেহ করেছিলুম লিজাকেই। কিন্তু কাল রাত্তিরে হঠাৎ আমার খটকা লাগে।”

“কেন?” সদানন্দবাবু বললেন, “কেউ কি এমন কিছু বলেছিল, সন্দেহটা যাতে লিজার ওপর থেকে ওই লোকটার ওপরে গিয়ে পড়ে?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “না না, এটা কারও কিছু বলার ব্যাপার নয়, কোথাও কিছু দেখার ব্যাপার। দুটো জিনিস আমি দেখেছি। একটা পরশু দেখেছি, একটা কাল। একা আমি যে দেখেছি, তা নয়। যেমন আমি দেখেছি, তেমন সদানন্দবাবু আর কিরণবাবুও দেখেছেন। কিন্তু তার তাৎপর্য ওঁরা ধরতে পারেননি। আগে বলি, পরশু দেখা জিনিসটার কথা। জিনিসটা আর কিছুই নয়, ব্রাউন রঙের এক ফালি ছেঁড়া কাপড়। ফালিটা এই কমপ্লেক্সের কম্পাউন্ড-ওয়ালের উপরের কাঁটাতারে আটকে ছিল।…কী কিরণবাবু, মনে পড়েছে?”

বললুম, “তা কেন পড়বে না? তা ওটারও কি কোনও তাৎপর্য আছে নাকি?”

“আছে বই কী।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “ওই ফালি-কাপড় দেখে আমি বুঝে নিই যে, এখানকার কম্পাউন্ড-ওয়াল টপকে কেউ ভিতরে ঢুকেছিল, কিন্তু ওই পথে ঢোকার সময় কিংবা ওই পথে বেরিয়ে যাবার সময় কাঁটাতারে তার প্যান্ট আটকে গিয়ে ছিঁড়ে যায়, আর ছেঁড়া অংশটা ওখানেই ঝুলতে থাকে। তারপর কাল রাতে যে-লোকটার সঙ্গে একেবারে হঠাৎই আমাদের পরিচয় হল, দেখলুম যে, তার প্যান্টের পায়ের দিকটা হাঁটু অব্দি গোটানো। সদানন্দবাবুর সেটাকে ইনডিসেন্ট ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল, তবে আমি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলুম যে, প্যান্টটার পায়ের অংশ ছেঁড়া বলেই সেটা ঢাকা দেবার জন্যে লোকটা তার প্যান্টের পায়ের দিকটা ওইভাবে গুটিয়ে রেখেছে। সদানন্দবাবুকে আমি সে-কথা বলেছিলুমও।”

সদানন্দবাবু বললেন, “ওরেব্বাবা! তারপর?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তারপর আর কী, বুঝে গেলুম যে, এ লোকটাই পাঁচিল টপকে এই হাউসিং কমপ্লেক্সে ঢুকেছিল। আর সে-ই যে ভয় দেখিয়ে হিরের নেকলেস আর মুক্তোর মালা আদায় করার পাণ্ডা, তাও তো ততক্ষণে আমরা বুঝে গেছি। তাই এতেও আর আমার সন্দেহ রইল না যে, এই হাউসিং কমপ্লেক্সে সে মিনির কাছেই এসেছিল। তখন ভাবতে লাগলুম, কেন এসেছিল। তার কাজ তো ভয় দেখিয়ে যতটা পারে আদায় করে নেওয়া। তা ভয় দেখাবার কাজটা তো নোংরা কিছু ছবি পাঠিয়ে, চিঠি লিখে আর ফোনে হুমকি দিয়েও করা যায়। তা হলে সে-সব করার আগে সে দেখা করতে এসেছিল কেন? এমন কী কাজ ছিল তার, যার জন্যে এখানে আসতেই হয়েছিল তাকে?”

একটুক্ষণের জন্যে চুপ করে রইলেন ভাদুড়িমশাই। একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “একই সঙ্গে ভাবছিলুম বিষ মেশাবার কথাটাও। ওটা কি সত্যিই লিজা মিশিয়েছে? সে কেন এই বোকামি করবে? সে তো জানে যে, সে-ই যে মিনিকে টনিকটা এনে দিয়েছে আর মিনিকে সেটা নিয়মিত খেতেও বলেছে সে-ই, মিনির ডাক্তার স্বামীর পক্ষে সেটা জানাই স্বাভাবিক। তা হলে লিজা জেনেশুনে এই ঝুঁকি নেবে কেন? আর তখনই একেবারে বিদ্যুচ্চমকের মতন আমার মনে হল, পাঁচিল টপকে যে-লোকটা এসে মিনির সঙ্গে দেখা করেছিল, বিষটা সে-ই মিশিয়ে দিয়ে যায়নি তো? তা মিনির কথা শুনে এখন বুঝতে পারছি যে, এটাও আমার ভুল অনুমান নয়।”

রাজেশ বলল, “আপনার কোনও অনুমানই ভুল নয়, আঙ্কল।” তারপর মিনির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “ভয় পেয়ো না, মিনিদিদি, ল্যাবরেটরি-টেস্টের রিপোর্ট আমি দেখেছি, যে পরিমাণ আর্সেনিক তোমার পেটে গেছে, তাতে তুমি মরবে না।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “এবারে আসল কথায় আসি। পুলিশকে আমি লিখিতভাবে কিছুই জানাইনি। লিখিত অভিযোগ জানালে মামলা হবে। তা যদি হয়, তা হলে বালুর অন্তত বছর কয়েকের জেল তো হবেই, লিজাও বেকসুর খালাস পাবে না। অথচ আমার ধারণা, লিজা যা-ই করুক, সেটা স্বেচ্ছায় করেনি, প্রাণের ভয়ে করেছে। কিন্তু আদালত সে-কথা বিশ্বাস করলেই বা কী, জেল না হোক, হাসপাতালে তার চাকরিটা আর থাকবে না। সে-ক্ষেত্রে তো আসল শাস্তি হবে তার ওই বাচ্চা ছেলেটির। মায়ের চাকরি গেলে সে তো না-খেয়ে মরবে।”

বার্টি বলল, “ঠিক কথা

ভাদুড়িমশাই বললেন, “আর-একটা কথাও আমি ভাবছি। মামলা হলে তার খবর চাপা থাকবে না। কাগজে-কাগজে এমন হেডলাইন দিয়ে খবর বেরুবে যে, তোমাদের পারিবারিক মানমর্যাদা নষ্ট হবে। সেটাও ভাবো।”

“ভাবার কিছু নেই।” বার্টি বলল, “পুলিশের কাছে আমরা কোনও অভিযোগ জানাব না।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, বার্টি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “য়ু হ্যাভ টেকন দ্য রাইট ডিসিশান। তবে হ্যাঁ, এস. পি.-কে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানাব লোকটাকে ছেড়ে দেবার সময় যেন তাকে শাসিয়ে দেওয়া হয় যে, ফের যদি সে এই তল্লাটে ঢোকে, তো পুলিশ তার হাড়গোড় ভেঙে দেবে।”

বার্টি বলল, “ঠিক আছে, সত্যিই আমি চাই না যে, মামলা হোক। কিন্তু আঙ্কল, ছবিগুলোর কী হবে? ওগুলোর নেগেটিভ তো লোকটার কাছেই রয়ে গেল। ইচ্ছেমতো প্রিন্ট করবে আর এখানে-ওখানে পাঠাবে। সে তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার!”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ছবিগুলো তুমি দেখেছ?”

“মিনিই দেখিয়েছে!”

“অথচ তুমি বুঝতে পারোনি যে, ওগুলো জাল ছবি? তাও অত্যন্ত কাঁচা হাতের জাল? আশ্চর্য! ওহে বাৰ্টি, আমি তো দেখেছি মাত্র একটা ছবি, তাতেই বুঝেছি যে, ওতে শুধু মুখটাই মিনির, বাদবাকি শরীরটা অন্য কোনও মেয়ের!”

আমি বললুম, “তার মানে হাঁসজারু?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “ঠিক তা-ই। ব্ল্যাকমেল করার এই কায়দাটা আজকাল খুব চলছে।” কামিনী বলল, “বাদবাকি শরীরটা আমার নয়, তুমি সেটা বুঝলে কী করে?”

“ওরে বোকা মেয়ে, তুই নিজের শরীরটাও চিনিস না?” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তোর বাঁ হাতের কনুইয়ের এক ইঞ্চিটাক উপরে, হাতের সামনের দিকে, কোনও জড়ুল আছে?”

কামিনী তাড়াতাড়ি তার বাঁ-হাতটা দেখে নিয়ে বলল, “কই, নেই তো!”

“অথচ, ছবিতে যে-মেয়েটার শরীরকে তোর মুখের নীচে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, তার বাঁ-হাতের ওই জায়গায় রয়েছে একটা মস্ত জড়ুল। তাই বলছিলুম যে, এটা নেহাতই কাঁচা হাতের কাজ!”

শুনে কামিনী বলল, “যাক বাবা, বাঁচলুম! কী যে দুর্ভাবনা হচ্ছিল, সে আর বলবার নয়।” নীচ থেকে অর্জুন খবর পাঠাল, লাঞ্চ রেডি, ইচ্ছে হলে আমরা এবারে খেতে বসতে পারি। খাওয়ার টেবিলেই বার্টি ঘোষণা করল যে, রোগীদের কাছ থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়ে কালই সে সবাইকে নিয়ে গঙ্গোত্রী যাবার প্ল্যান এঁটেছে। কামিনীর জন্মদিন উপলক্ষে এটাই তার উপহার।

লাঞ্চের পরে বিকেল অব্দি জোর আড্ডা হল। রাজেশ বিদায় নিল বিকেলবেলায়। বলল, তার ছুটি পেতে কোনও অসুবিধে হবে না, গঙ্গোত্রী যাবার পথে উত্তরকাশী থেকে তাকে যেন আমরা তুলে নিই সন্ধে নাগাদ ভাদুড়িমশাই, সদানন্দবাবু আর আমি গিয়ে নদীর ধারে বসলুম। সদানন্দবাবু বললেন, “আচ্ছা মশাই, পাজি লোকটা মনে হল আপনার চেনা। কে ও?”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “বালুচন্দ্রন। মিনির সেকেন্ড হাজব্যান্ড। ফিল্মি ফাইটার। এককালে মারপিটের ছবিতে ওর চাহিদা ছিল, এখন আর কেউ পৌঁছে না।”

শুনে সদানন্দবাবু বললেন, “ছ্যা ছ্যা!”

রচনাকাল : ১৪০৯

***