কামিনীর কণ্ঠহার – ১১

১১

কামিনীদের বাড়ি থেকে যখন লিজাদের ফ্ল্যাটে আসি, ট্যাক্সিতে তখন ভাদুড়িমশাই ছিলেন ড্রাইভারের পাশের আসনে। পিছনের আসনে জায়গা পেয়েছিলুম আমি আর সদানন্দবাবু। লিজাদের বাড়ি থেকে উত্তরকাশীতে যাবার পথে জায়গা পালটা পালটি হয়েছে। বিগ শপারটাকে পায়ের কাছে নিয়ে আমি আর সদানন্দবাবু এখন সামনের সিটে ড্রাইভার ইন্দরলালের পাশে একটু ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছি, আর পিছনের সিটে বালুচন্দ্রনকে মাঝখানে নিয়ে তার দু’পাশে বসেছেন ভাদুড়িমশাই আর ভীম সিং। বালুকে হাতকড়ি পরানো হয়নি। তার কারণ, উত্তরকাশী পুলিশের এ. এস. আই. ভীম সিংয়ের হাতেও একটা ঝোলা ছিল বটে, তবে তার মধ্যে হুইসল, আইডেন্টিটি কার্ড, ব্যাটন, খইনির কৌটো ইত্যাদি অনেক কিছু থাকলেও একজোড়া হাতকড়ি ছিল না। তাতে অবশ্য কোনও ক্ষতি হয়নি। দু’দিকে শক্ত পাহারা, মধ্যিখানে বালু একেবারে ঝিম মেরে বসে আছে।

ট্যাক্সিতে উঠেই তাঁর মোবাইল বার করে ভাদুড়িমশাই কাউকে ফোন করেছিলেন। নিজের পরিচয় দিয়ে তাঁকে বলেছিলেন যে, কাজ শেষ, আধঘন্টা-পয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা এস.পি.সাহেবের দফতরে পৌঁছে যাব।

পৌঁছলুম সাড়ে ন’টায়। পুলিশ সুপারের নাম দেওনন্দন ঠাকুর। আমরা তাঁর দফতরে পৌঁছবামাত্র খবর পেয়ে তিনি তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভাদুড়িমশাইকে নমস্কার করে বললেন, “আসুন, আসুন, উপর থেকে আমাকে আপনার কথা বলা হয়েছে। দয়া করে আমার ঘরে এসে বসুন, তারপর আপনার সমস্ত কথা আমি শুনব, অ্যান্ড অফ কোর্স আই শ্যাল ডু দ্য নিডফুল।”

ভদ্রলোক আই. পি. এস. অফিসার। বয়স বছর চল্লিশেক। আমরা তাঁর ঘরে ঢুকে দেখি রাজেশ কুলকার্নি একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে সেখানে বসে আছে। বাচ্চাটির এক হাতে একটা বিশাল সাইজের চকোলেট বার, অন্য হাতে একটা ফুঁ-দিয়ে ফোলানো মস্ত বড় পেঙ্গুইন। ভাদুড়িমশাই বললেন, “রাজেশ, আর দেরি কোরো না, ওকে এবারে ওর মা’র কাছে পৌঁছে দিয়ে এসো। দরকার হয় তো আমাদের ট্যাক্সিটা নিয়েই চলে যাও।”

দেওনন্দন ঠাকুর বললেন, “না না, আপনাদের গাড়ির দরকার হবে না, গাড়ির ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি!” বলেই, ঘরের আর-এক দিকে বসে যে লোকটি কিছু টাইপ করছিল, তাকে বললেন, “রমেশ, তোমাকে যে-চিঠিখানা টাইপ করতে দিয়েছি, ওটা খুব জরুরি নয়, কাল টাইপ করলেও চলবে, প্রোফেসর কুলকার্নির জন্যে তুমি আর্দালিকে বলে একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দাও। ওদের সঙ্গে একজন সিকিওরিটিও যেন দিয়ে দেওয়া হয়।…প্রোফেসর কুলকার্নি, আপনি ওর সঙ্গে যান।”

বাচ্চাটিকে নিয়ে রাজেশ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দেওনন্দন ঠাকুর কলিং বেল টিপে তাঁর আর্দালিকে ডেকে বললেন, “আমাদের জন্যে কফি আর কিছু কাজুবাদাম দিয়ে যাও।…আর হ্যাঁ, এখন কিছুক্ষণ যেন কেউ আমাদের ঘরে না ঢোকে।” তারপর ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এখন বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি।”

ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “ইউ হ্যাভ অলরেডি ডান আ লট ফর আস। অ্যান্ড আই থ্যাংক ইউ ফর দ্যাট। এখন আর-একটা কাজ করে দিতে হবে।”

“বলুন।”

“যে-লোকটিকে আমি ধরে এনেছি, আপাতত আমাদের ট্যাক্সিতে আপনাদের এ. এস.আই. ভীম সিং তার পাহারায় আছে। লোকটিকে অন্তত দু’দিন, আজ আর কাল, আপনাদের লক-আপে আটকে রাখা দরকার। অথচ তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আমি লিখিতভাবে এখনই আপনার কাছে পেশ করতে পারছি না। শুধু এইটুকু আপনাকে বলতে পারি যে, এ অতি ভয়ঙ্কর লোক, একে আটকে না-রাখলে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের খুবই ক্ষতি হবার আশঙ্কা রয়েছে।”

কথাটা শুনে পুলিশ সুপার যে একটু বিস্মিত হয়েছেন, সে তাঁর মুখ দেখেই বোঝা গেল। বললেন, “মিঃ ভাদুড়ি, তা-ই যদি হয়, তবে সে-কথা আপনি লিখিতভাবে আমাদের জানাচ্ছেন না কেন?”

“অসুবিধে আছে। প্রধান অসুবিধে, ওই যে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের কথা বলেছি, তাঁদের মান-সম্মানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। তাঁদেরই স্বার্থরক্ষার জন্যে আমি কাজ করছি, অথচ কী কাজ করছি, তাঁদেরও সেটা জানতে দিইনি। কেন জানতে দিইনি? না কোন পথে আমি কাজটাকে গুছিয়ে তুলছি, তা জানলে হয়তো তাঁরাই আমাকে বাধা দিয়ে বসবেন। অথচ, আমাকে বাধা দিলে তাঁদের ভরাডুবি কেউ আটকাতে পারবে না, পরিবারটির সর্বনাশ হবে।”

“বুঝলুম,” দেওনন্দন ঠাকুর বললেন, “কিন্তু লোকটি কী অপরাধ করেছে, লিখিতভাবে তা যদি আপনি না জানান, তা হলে আমি ওকে হাজতে পুরে আটকে রাখব কী করে? সেটা তো ঘোর বে-আইনি কাজ হবে।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা কি আমি জানি না মিস্টার ঠাকুর? জানি। কিন্তু মাঝে-মাঝে কি দু’চারটে বে-আইনি কাজ আমরা করি না? আমি অন্তত করি। যদ্দুর জানি, আপনারাও করেন। না-করে যখন উপায় থাকে না, তখন করতেই হয়। এ-ক্ষেত্রে উপায় নেই। তবু যদি আইনের উদ্দেশ্যের কথা না ভেবে স্রেফ অক্ষরটাকে আপনি গুরুত্ব দেন তা হলে কিন্তু যে-উদ্দেশ্যে আইনটা করা হয়েছিল, সেটাই সিদ্ধ হবে না।”

দেওনন্দন তবু চুপ করে আছেন দেখে ভাদুড়িমশাই বললেন, “আমার অনুরোধটা আমি পরিষ্কারভাবে ফের আপনাকে জানাতে চাই, মিস্টার ঠাকুর। আজ আর কাল, জাস্ট দুটো দিন আপনি ওকে আটকে রাখুন। লিখিতভাবে যদি কোনও অভিযোগ জানাতেই হয়, তো পরশু সোমবার ফার্স্ট আওয়ারেই আমরা সেটা জানাব। তখন আপনি যে ডিসিশান নিতে হয়, নেবেন। তবে তার আগে ওকে ছাড়বেন না। এই সামান্য অনুরোধ রাখাটাও কি সম্ভব নয়?”

দরজা ঠেলে একটি লোক ঘরে ঢুকল। হাতের ট্রে থেকে চার পেয়ালা কফি আর এক প্লেট কাজুবাদাম টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে ঘর থেকে বেরিয়েও গেল তৎক্ষণাৎ। দেওনন্দন বললেন, “রাখতে যদি না-ই পারি?”

“তা হলে যে-কাজ আমি সাধারণত করি না, করতে চাইও না, সেটা আমাকেই করতে হবে। লোকটাকে একেবারে চিরকালের মতো চুপ করিয়ে দেবার দায়িত্ব নিতে হবে আমাকেই। নিতে হবে, কেননা যে-পরিবারটিকে আমি বলতে গেলে আমার নিজেরই পরিবার বলে মনে করি, তার কোনও অসম্মান আমি ঘটতে দেব না।”

দেওনন্দন প্রায় মিনিট খানেক একেবারে নিশ্চুপ বসে রইলেন। তারপর বললেন, “এরই মধ্যে অন্তত বার-তিনেক একটি পরিবারের মান-মর্যাদার কথা আপনি বলেছেন। প্রোফেসর কুলকার্নির কাছে শুনলুম, এখানে এসে আপনি আছেন ডক্টর রাসেলের বাড়িতে। তাই জানতে কৌতূহল হচ্ছে যে, ডক্টর রাসেলের পরিবারের কথাই আপনি বলছেন কি না।”

কথাটার সরাসরি জবাব না-দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তাঁকে চেনেন আপনি?”

পুলিশ সুপারের মুখে এতক্ষণে হাসি ফুটল। বললেন, “শুধু আমি বলে কথা কী, এই তল্লাটে, রাইট ফ্রম ধরাসু টু উত্তরকাশী, সবাই তাঁকে চেনে। সবাই চেনে, সবাই শ্রদ্ধা করে, সবাই ভালবাসে। পাহাড়ি বস্তির লোকেরা কী বলে জানেন? বলে, উনি মানুষ নন, ভগবান।”

“শুনেছি, খুবই নামজাদা ডাক্তার।”

“ঠিকই শুনেছেন। আর তা ছাড়া ডক্টর রাসেলের কাছে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব ঋণীও। আমার সাত বছরের মেয়েটা তো হেপাটাইটিস হয়ে মরতে বসেছিল। এখানকার ডাক্তাররা জবাব দেবার পরে আমি নিজে গিয়ে একটা পাহাড়ি বস্তি থেকে ওঁকে ধরে আনি। শেষ পর্যন্ত উনিই মেয়েটাকে বাঁচিয়ে তোলেন। তা আপনি যাকে নিয়ে এসেছেন, সে-লোকটা কি ডক্টর রাসেলের কোনও ক্ষতি করেছে নাকি?”

“করেছে।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “এখনও করছে। এমন সব কাজ করছে, যাতে ডক্টর রাসেলের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। তাই বলছিলুম যে, আপনি যদি একান্তই না পারেন, তো লোকটাকে চুপ করিয়ে রাখার দায়িত্ব নাহয় আমিই নেব।”

মুহূর্তের মধ্যে পালটে গেল দেওনন্দন ঠাকুরের চেহারা। টেবিলের উপরে দমাস করে একটা কিল মেরে বললেন, “না না, আপনি কেন দায়িত্ব নেবেন? তা হলে আমরা রয়েছি কী করতে?… ঠিক বলেছেন, সব সময় অত আইন মানলে চলে না!”

কথা শেষ করেই বেল বাজিয়ে আর্দালিকে ডেকে বললেন, “এ. এস. আই. ভীম সিং একটা গুণ্ডাকে এখানকার রাস্তা থেকে ধরে এনেছে। তাকে তোমাদের হেফাজতে নিয়ে এখানকার হাজতে পুরে দাও। আজ আর কাল হাজতে থাকুক, তারপর যা করার, সোমবার এসে করা যাবে।”

আর্দালিটি বুটে বুট ঠুকে সেলাম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আমরাও ‘ধন্যবাদ’ বলে ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের ট্যাক্সিতে ফের পিছনের সিটে উঠে পড়লুম। সদানন্দবাবু অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছিলেন, কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলছিলেন না। এখন শহরের সীমানা ছাড়িয়ে আমরা হাইওয়েতে পড়ামাত্র বললেন, “এই লোকটাকেই গতকাল বিকেলে আমি বাঁদর-কাঁধে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলুম।”

“ঠিক, ঠিক!” আমি বললুম, “সে তো আমিও দেখেছি।”

সামনের সিট থেকে ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা হলে এতক্ষণ সে-কথা বলেননি কেন?”

সদানন্দবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, “ভয়ে। একে তো ডেঞ্জারাস লোক, তায় আবার আমাদের গাড়ির মধ্যেই বসে ছিল কিনা, তাই বড্ড নার্ভাস লাগছিল।”

ভাদুড়িমশাই বললেন, “তা তো বুঝলুম, কিন্তু সদানন্দবাবু, যার কপালে লাঠির বাড়ি কষাতে আপনার হাত কাঁপেনি, হঠাৎ আবার তাকে অত ভয় পাবার মতো কী ঘটল?”

“লাঠিটা তো অত ভেবেচিন্তে মারিনি,” সদানন্দবাবু লজ্জিত গলায় বললেন, “ওই মানে ঝোঁকের মাথায় মেরে দিয়েছিলুম।”

“বেশ করেছিলেন। তবে কিনা লোকটার বাবরি চুলের কথাটা কাল আপনারা কেউই আমাকে বলেননি। আইডেন্টিফিকেশনের সময় কাজে লাগতে পারে ভেবে আমি কিন্তু সেটার কথাও মনে রেখেছিলুম। যেজন্যে আজ সদানন্দবাবুকে বলে রেখেছিলুম যে, লিজাদের বাড়িতে বাবরি চুলওয়ালা কোনও লোককে ঢুকতে দেখলেই যেন তিনি হুইসল বাজান।”

ভাদুড়িমশাই চুপ করে যাবার পর বাকি পথে আর কোনও কথা হল না। বেশ রাত হয়েছে, পথ ফাঁকা, ইন্দরলাল স্পিড বাড়িয়ে দিয়েছে, ডুণ্ডা ভ্যালিতে পৌঁছতে-পৌঁছতে তবু বারোটা বেজে গেল।

বেল বাজাবামাত্র দরজা খুলল কামিনী। বলল, “এত রাত হল যে?”

তার প্রশ্নের কোনও জবাব না দিয়ে বিগ শপারের ভিতর থেকে প্যাকেট দুটো বার করে আনলেন ভাদুড়িমশাই, সে-দুটো কামিনীর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “এই নে তোর হিরের নেকলেস আর মুক্তোর মালা।…বাস বাস, এখন আর এ নিয়ে কোনও কথা নয়, যা বলার কাল বলব।…বড্ড খিদে পেয়ে গেছে, খেতে দে।…বার্টি কখন ফিরল?”

“সাড়ে দশটায়।” কামিনী বলল, “ভীষণ টায়ার্ড ছিল। খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে। তোমরা আর এখন উপরে উঠো না, এখানেই হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসে যাও, আমি সব গরম করে রেখেছি।”

খাওয়া শেষ হবার পর ভাদুড়িমশাই বললেন, “মিনি, তোর হয়তো খেয়াল নেই, কিন্তু আমি জানি যে, কাল তোর জন্মদিন। জন্মদিনে সত্যকথা গোপন করতে নেই, সব কথা খুলে বলতে হয়। কাল ভোরে ঘুম থেকে উঠে বার্টিকে সব খুলে বলবি, কিচ্ছু গোপন করবি না। তা নইলে তোর উদ্ধার নেই।”

আমরা উপরে উঠে এলুম। ঘরে ঢুকে সদানন্দবাবু বললেন, “পুলিশ-সাহেবের ওখেনে কফি খাওয়াটা উচিত হয়নি। ভয়ে ভয়ে খেলুম। রাত্তিরে এখন ঘুম হবে কি না, কে জানে।”

শুয়ে পড়ার মিনিট খানেক বাদেই কিন্তু তাঁর নাক ডাকতে শুরু করল।