১০
স্কুটারের শব্দ হল ঠিক সাতটাতেই। তারপর একতলার সদর-দরজায় বেল বাজাবার শব্দ। তারও খানিক পরে জুতোর খটখট আওয়াজ শুনে বুঝলুম একতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে কেউ দোতলায় উঠছে। মিনিট খানেক বাদে তার নেমে যাওয়ার শব্দও কানে এল।
কামিনী আমাদের ঘরে ঢুকে বলল, “লিজা এসেছিল। প্যাকেটটা ওকে দিয়ে দিয়েছি।”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “বেশ করেছিস। এখন সাতটা পাঁচ। মিনিট দশেক বাদে আমরা একটু বেরোব। কখন ফিরব, বলতে পারছি না। রাত বেশি হতে পারে। ভাবিস না।”
আমরা নীচে নামলুম সওয়া সাতটায়। গাড়ি তৈরিই ছিল, আমরা ভিতরে ঢোকার পর ভাদুড়িমশাই ইন্দরলালকে বললেন, “গাড়ি স্পিডে চালাও, উত্তরকাশীর রাস্তা ধরো। খানিক বাদে যদি একটা স্কুটার দ্যাখো, সেটাকে ওভারটেক কোরো না, তবে একটু ডিসট্যান্স রেখে সেটার পিছনে লেগে থাকবে।”
ইন্দরলাল কোনও কথা বলল না। তবে, গাড়ির স্পিড যে হঠাৎ বেড়ে গেছে, সেটা বোঝা গেল।
একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিলুম। আমি তো একেবারে খালি হাতে নেমেছি, কিন্তু সদানন্দবাবু হুঁশিয়ার মানুষ, তিনি তাঁর খেটে-লাঠিটা সঙ্গে নিতে ভোলেননি। ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে সেই বিগ শপার। বললুম, “ঝোলাটা নিলেন কেন? ওতে আছে কী?”
ভাদুড়িমশাই সেই আগের মতোই ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছেন। ঘাড় না-ঘুরিয়েই বললেন, “আর-এক প্যাকেট কালাকাঁদ। কাজে লাগতে পারে। খাবেন একটা?”
বললুম, “না।”
গাড়ি বেশ জোরে ছুটছে। বাঁ দিকে চোখ রেখে বসে আছি। কোথায় যাচ্ছি আমরা ভাদুড়িমশাইকে জিজ্ঞেস করেছিলুম এর মধ্যে। তিনি সেই একই উত্তর দিয়েছেন, গেলেই দেখতে পাবেন। তারপরে আর কোনও কথা হয়নি। পথে কোনও স্কুটারও চোখে পড়েনি আমার।
হাতঘড়ির দিকে তাকালুম। রেডিয়াম লাগানো কাঁটা বলছে, এখন প্রায় সাড়ে সাতটা।
আর-একটু এগোলেই বাঁয়ে পড়বে সেই সরকারি হাউসিং এস্টেটের ফ্ল্যাটবাড়িগুলো। লিজা ওরই একটা ফ্ল্যাটে থাকে। এস্টেট ছাড়িয়ে আরও খানিকটা এগোলে সেই শেষ-না-হওয়া ভুতুড়ে বাড়িটা পাব। ভাদুড়িমশাই যে ওখানেই যাবেন, তাতে আর আমার কোনও সন্দেহ নেই এখন। ওখানে আমাদের পৌঁছতে-পৌঁছতে প্রায় আটটাই বাজবে। কে যে ওখানে অপেক্ষা করছে, কে জানে। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি যে, যেই অপেক্ষা করুক, ভাদুড়িমশাইয়ের সঙ্গে তার একটা সংঘর্ষ হবেই।
আশ্চর্য ব্যাপার, কোথায় সেই অন্ধকার ভুতুড়ে বাড়িতে যাব, তা নয়, হাউসিং এস্টেটের কম্পাউন্ড শুরু হওয়া মাত্র ভাদুড়িমশাই চাপা গলায় ইন্দরলালকে বললেন, “স্পিড কমিয়ে বাঁয়ে টার্ন নিয়ে এই হাউসিং এস্টেটের গেট দিয়ে গাড়ি ভিতরে ঢোকাও।”
ভিতরে ঢুকে প্রথমেই একটা লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা পার্ক। সম্ভবত চিলড্রেন’স পার্ক। দোলনা, সি-স, জন্তু-জানোয়ারের আদলে ছাঁটা পাছপালা ইত্যাদি দেখে তা-ই অন্তত মনে হল। তবে রাত হয়েছে বলেই বোধহয় অল্পবয়সি বাচ্চা কোনও ছেলেমেয়ে দেখলুম না। পার্কের চারদিক ঘিরে রাস্তা। রাস্তার ধারে পরপর ফ্ল্যাটবাড়ি। ফ্ল্যাটের আলো রাস্তায় এসে পড়েছে। অনেক ফ্ল্যাটেই যে টিভি চলছে, আওয়াজ শুনে সেটা বোঝা যায়।
পার্কের বাঁ দিকের রাস্তা ধরে প্রথম দুটো ফ্ল্যাটবাড়ি ছাড়িয়ে এল ইন্দরলাল। তারপর, ভাদুড়িমশাইয়ের নির্দেশমতো, তৃতীয় ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করাল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে পার্কের ভিতরের গাছের আড়াল থেকে রেলিং টপকে একটি লোক এসে দাঁড়াল আমাদের গাড়ির পাশে। চাপা গলায় বলল, “ভাদুড়িসাবকো সাথ মিলনা হ্যায়।”
ভাদুড়িমশাই গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলেন। লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সে বলল, “মেরা নাম ভীম সিং। আপকা যো কাম থা, হো চুকা। দুসরা কোই কাম হ্যায়?”
“এস.পি. সাবকা আদমি?”
“হাঁ, হুজুর।” লোকটি তার শার্টের পকেট থেকে একটা চিরকুট বার করে এগিয়ে ধরল। ভাদুড়িমশাই একবার চোখ বুলিয়েই সেটা তাকে ফেরত দিয়ে বললেন, “আমি এই বাড়ির দোতলায় যাব, তুমিও আমার সঙ্গে চলো।” তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিরণবাবু, আপনিও চলুন।”
“আর আমি?” সদানন্দবাবু প্রায় ডুকরে উঠে বললেন, “আমি একা এই গাড়ির মধ্যে বসে থাকব?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “একা কেন, ইন্দরলালই তো রয়েছে।” তারপর তাঁর বিগ শপারের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা হুইসল বার করে সদানন্দবাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা রাখুন। বাবরি চুলওয়ালা কোনও লোককে যদি এই বাড়িতে ঢুকতে দেখেন, তা হলে সঙ্গে-সঙ্গে এটা বাজাবেন। মাত্র একবার বাজালেই চলবে।”
আমরা গিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লুম। সিঁড়িতে একটা কম পাওয়ারের বাল্ববের মিটমিটে আলো। তাতেও অবশ্য দেখা গেল যে, একতলার দু’দিকের দুটো ফ্ল্যাটেরই দরজার হুড়কোয় তালা ঝুলছে। অর্থাৎ হয় দু-টো ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না, কিংবা থাকলেও এখন কেউ বাড়িতে নেই। দোতলাতেও দু’দিকের ফ্ল্যাটেরই দরজা বন্ধ, তবে তার একটাতেও তালা দেখলুম না। ডান দিকের দরজায় একটা পেতলের প্লেট আঁটা। প্লেটে পদবি খোদাই করা ওয়েভার্লি।
বাঁ হাতে বিগ শপার, ডান হাতের তর্জনী তুলে ভাদুড়িমশাই ডোর-বেলের বোতাম টিপলেন।
ভিতরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। কেউ বলল, “মাস্ট বি বালু!” পরক্ষণেই যে দরজা খুলল, তাকে দেখেই বোঝা যায় যে, সে হকচকিয়ে গেছে। চিনতে অসুবিধে হল না। লিজা।
আমরা লিজাকে চিনতে পারলেও লিজা আমাদের চিনতে পারেনি। বিভ্রান্তির ভাবটা একটু কেটে যেতেই অস্ফুট গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কে? কী চাই?”
খোলা দরজার পাল্লার পাশ দিয়ে এরই মধ্যে ভিতরে একটা পা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন ভাদুড়িমশাই। যাতে দরজাটা ফের বন্ধ করে দেওয়া না যায়। সেই অবস্থাতেই ভীম সিংয়ের দিকে আঙুল তুলে বললেন, “এ লোকটি এসেছে থানা থেকে। আপনার বিশ্বাস না হলে আইডেন্টিটি কার্ড দেখাবে। আর আমরা দুজন সি.বি.আই.-এর লোক।” সি. বি. আই. মানে যে এক্ষেত্রে সেন্ট্রাল ব্যুরো অভ ইনভেস্টিগেশনস নয়, চারু ভাদুড়ি ইনভেস্টিগেশনস, সেটা অবশ্য বললেন, না।
লিজা ভয় পেয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, “কী চান আপনারা?”
ভাদুড়িমশাই তাঁর পা সরালেন না। বললেন, “কী চাই, তা আপনি খুব ভালই জানেন মিসেস এলিজাবেথ ওয়েভার্লি। ঘন্টাখানেক আগে ডুন্ডা ভ্যালির মিসেস কামিনী রাসেলের কাছ থেকে যে প্যাকেটটা নিয়ে এসেছেন, আপাতত সেটা চাই। …ওহো, সেটা তো আপনার হাতেই রয়েছে!”
দরজার খোলা পাল্লায় নিমেষে একটা ধাক্কা মেরে ভিতরে ঢুকে গেলেন ভাদুড়িমশাই। লিজার হাত থেকে প্যাকেটটা কেড়ে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, “ঝোলার মধ্যে রেখে দিন!”
পাল্লার ধাক্কা লেগে মেঝের উপরে পড়ে যেতে-যেতে টাল সামলে নিয়ে আবার সিধে হয়ে দাঁড়িয়েছিল লিজা। কাতর গলায় বলল, “ওটা নেবেন না। মিসেস রাসেলই ওটা এক জায়গায় রেখে আসার জন্যে আমাকে দিয়েছেন!’”
“আপনি এটা কোথাওই রেখে আসতেন না!” ভাদুড়িমশাই হেসে বললেন, “বালু না কার জন্যে তো আপনি অপেক্ষা করছিলেন, তাকে দেখিয়ে আপনার আলমারির লকারে তুলে রাখতেন। … নিন, এবারে আগের প্যাকেটটা বার করুন। …কুইক!”
“আগের প্যাকেট? তার মানে?”
“অত অবাক হচ্ছেন কেন? আগের প্যাকেট মানে গতকাল তো শুক্রবার ছিল, তার আগের শুক্রবার, মানে ছাব্বিশে এপ্রিল তারিখে যে প্যাকেটটা মিসেস রাসেল দিয়েছিলেন। মনে পড়েছে?”
লিজা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল, সে খুব কঠিন পাল্লায় পড়েছে, এখন আর না-বোঝার ভান করে কোনও লাভ নেই। বলল, “কিন্তু সেটা তো যেখানে রাখার কথা, সেখানেই আমি রেখে এসেছিলুম।”
“আবার মিথ্যে বলছেন?” প্রায় গর্জন করে উঠলেন ভাদুড়িমশাই। বললেন, “নো মিসেস ওয়েভার্লি, প্যাকেটটা আপনি কোথাও রেখে আসেননি। সেটা যে বিক্রি করতে পারেননি, তাও জানি। কেননা, প্যাকেটের মধ্যে যেমন বই ছিল না, তেমন সোনার গয়নাও ছিল না, ছিল একটা হিরের নেকলেস। তা হিরে, তাও অত বড় সাইজের হিরে কি অত সহজে বিক্রি করা যায় নাকি? তাও এই উত্তরকাশীতে? কিনবে কে? ওসব জিনিস বিক্রি করতে হলে দিল্লি-বোম্বাই যেতে হয়। তা এর মধ্যে তো আপনি উত্তরকাশী ছেড়ে কোথাও যাননি। পরে হয়তো যেতেন, কিন্তু এখনও যে যাননি, তা তো আমি জানি। তাই বলছি, ওটা দিয়ে দিন।”
“কী করে দেব, কোত্থেকে দেব?” লিজা বলল, “প্যাকেটটা কি আমার কাছে আছে যে আমি দেব? ওটা আমি খুলে দেখিনি, ওর মধ্যে কী ছিল তা আমি জানি না। প্যাকেটটা আমাকে যেখানে রাখতে বলা হয়েছিল, সেখানেই আমি রেখে এসেছি।”
একটু আগেই ধমক দিয়ে কথা বলছিলেন ভাদুড়িমশাই। তাঁর গলা হঠাৎই অনেক নিচু পর্দায় নেমে এল। খুব ধীরস্থিরভাবে তিনি বললেন, “ইউ আর ট্রায়িং টু সেল মি আ প্যাকেট অব লাইজ, হুইচ আই’ম নট বায়িং। কিন্তু সে-কথা থাক, আপনার একটি ছেলে আছে না?”
“আছে, আপনি কী করে জানলেন?”
যেমন করেই হোক, জানি। তা ছেলেটি এখন কোথায়?
লিজার মুখে একটা আশঙ্কার ছায়া পড়ল কি? এতক্ষণ মুখ নিচু করে কথা বলছিল সে। হঠাৎ মুখ তুলে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের এই হাউসিং এস্টেটে একটা চিলড্রেনস ওয়েলফেয়ার কমিটি আছে। এখানকার বাচ্চাদের নিয়ে তারা মাঝে-মাঝেই বেড়াতে বেরোয়। শুনলুম তাদেরই একজন লোক এসে নাকি জনিকে একটা ম্যাজিক শো দেখাতে নিয়ে গেছে। তা আপনি হঠাৎ জনির কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?”
কথাটার উত্তর না দিয়ে ভাদুড়িমশাই বললেন, “জনি ফিরবে কখন?”
“পাঁচটা-ছ’টা নাগাদ নিয়ে গেছে, আটটার মধ্যেই ফেরার কথা।”
“নাও ফিরতে পারে।”
লিজা আর্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “তার মানে?”
“মানেটা খুবই সহজ।” ভাদুড়িমশাই ঠান্ডা গলায় বললেন, “কোনও ওয়েলফেয়ার কমিটির লোক নয়, আমারই লোক এসে ম্যাজিক শোতে নিয়ে যাবার লোভ দেখিয়ে আপনার মায়ের হেফাজত থেকে জনিকে তুলে নিয়ে গেছে। আপনি যতক্ষণ না সেই প্রথম প্যাকেটটি তার ভিতরের নেকলেসটা সুদ্ধু আমার হাতে তুলে দিচ্ছেন, জনিকেও ততক্ষণ ফেরত পাবেন না। ইট’স অ্যাজ সিম্পল অ্যাজ দ্যাট।”
ফ্ল্যাটের ভিতরে আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেটা এদের লিভিং কাম ডাইনিং রুম। মাঝ-বরাবর একটা পর্দা। সেই পর্দার আড়াল থেকে এক ভদ্রমহিলা হঠাৎ বেরিয়ে এলেন। মুখের বলিরেখা দেখলে মাকড়সার জাল বলে ভ্রম হয়, মাথার চুল ধবধবে সাদা। পরনে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঝুলের একটা লম্বা কোট।
ভদ্রমহিলাকে দেখবামাত্র লিজা চেঁচিয়ে উঠল, “মা, তুমি জনিকে কার হাতে ছেড়ে দিয়েছ?”
মেয়ের কথার কোনও উত্তর দিলেন না বৃদ্ধা। বোতাম খুলে কোটের ভিতরকার পকেট থেকে একটা কাগজে-মোড়া প্যাকেট বার করে ভাদুড়িমশাইয়ের দিকে ছুড়ে দিয়ে বললেন, “এই নিন আপনার সেই প্যাকেট। খুলে দেখে নিন, নেকলেসটা ওর মধ্যে আছে কি না।”
প্যাকেটটা খুললেন না ভাদুড়িমশাই, সেটাকে আমার হাতে তুলে দিয়ে, বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি কি এতক্ষণ ওই পর্দার আড়ালেই দাঁড়িয়ে ছিলেন?”
“হ্যাঁ।” বিষণ্ণ হেসে ভদ্রমহিলা বললেন, “ওখান থেকে আপনাদের সমস্ত কথাই আমি শুনেছি। আমার মেয়ে যা করেছে, তার ক্ষমা নেই। তবু বলি, ও এ-কাজ স্বেচ্ছায় করেনি, ওকে দিয়ে জোর করে, খুন করার হুমকি দিয়ে বালু এ-কাজ করিয়ে নিয়েছে।
“কে বালু?”
“বাইরের লোক, খারাপ লোক, মাঝে-মাঝে এখানে আসে, আমার মেয়েকে ভয় দেখায়।”
“এর বেশি কিছু জানেন না?”
“না।” ভদ্রমহিলা হাত জোড় করে আর্ত গলায় বললেন, “যাই হোক, জিনিসটা যখন ফেরত পেয়েছেন, জনিকে তখন ফিরিয়ে দিন। ও আমার একমাত্র নাতি!”
ঠিক এই সময়েই হুইসলের শব্দ শোনা গেল। ভাদুড়িমশাইও তৎক্ষণাৎ “ভীম, তুমি এখানে থাকো” বলেই তাঁর ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা ভারী জিনিস তুলে নিয়ে দরজার বাইরে সিঁড়ির দিকে ছুট লাগালেন। আমি তাঁর পিছু নিতে-নিতে খেয়াল করলুম, ঝোলা থেকে যা তাঁর হাতে উঠে এসেছে, সেটা একটা রিভলভার।
যাকে এ-বাড়িতে ঢুকতে দেখে সদানন্দবাবু হুইসল বাজিয়েছেন, একতলায় নামার আগেই বাবরি চুলওয়ালা সেই লোকটির সঙ্গে সিঁড়ির মধ্যপথে আমাদের দেখা হয়ে গেল। ভাদুড়িমশাইকে দেখে যে সে হকচকিয়ে গেছে, তা বুঝতে কিছুমাত্র দেরি হল না আমার। সঙ্গে-সঙ্গেই সে পিছন ফিরে একতলায় নেমে যাবার উদ্যোগ করেছিল, কিন্তু সদানন্দবাবু ততক্ষণে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভাদুড়িমশাইয়ের হাতে রিভলভার দেখেই সদানন্দবাবু বুঝে গিয়েছিলেন যে, যাকে আমরা ধাওয়া করেছি, সে মোটেই সুবিধের লোক নয়, ফলে লোকটা যখন তাঁকে ধাক্কা মেরে তাঁর পাশ দিয়ে তড়বড় করে নীচে নেমে যাচ্ছে, তখন মাথায়-লোহার-বল-বসানো তাঁর সেই বিখ্যাত খেটে-লাঠি দিয়ে লোকটার কপালে এক ঘা বসিয়ে দিতে সদানন্দবাবুর একটুও ভুল হয়নি। তার ফল যা হবার তা-ই হল। সিঁড়ির উপরেই কপাল চেপে ধরে লোকটা বসে পড়ল।
ডান হাতে রিভলভার, সিঁড়ি দিয়ে দু’ধাপ নেমে বাঁ হাতে লোকটার শার্টের কলারের পিছন দিকটা মুঠো করে ধরে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে তাকে দাঁড় করালেন ভাদুড়িমশাই। তারপর মৃদু হেসে বললেন, “বালুচন্দ্রন, এটা তো ফিল্মি ফাইটিং নয়, তাই তোমার কপাল ফেটে যা গড়াচ্ছে, তাও টোমাটো সস নয়, রক্ত। আর আমার হাতের এটাও নকল নয়, আসল রিভলভার। তোমার ভাগ্য ভাল যে, লাঠির বাড়ি খেয়েছ, আমাকে রিভলভার চালাতে হয়নি। নাও, এখন উপরে চলো।”
নার্সের বাড়ি, ফার্স্ট এডের জিনিসপত্র সবই মজুত, ভাদুড়িমশাইয়ের নির্দেশে লিজা চটপট বালুর কপালে একটা অ্যান্টিসেপটিক লোশন লাগিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।
বালুচন্দ্রনের শার্টে রক্তের ছোপ। ব্রাউন রঙের ময়লা প্যান্টটাও হাঁটু পর্যন্ত গোটানো। সদানন্দবাবু তাঁর নিজস্ব হিন্দিতে বললেন, “এই তুম প্যান্ট নামাকে বৈঠো। দেখতা নেই যে, এখানে দুজন লেডি রয়েচেন?”
ভাদুড়িমশাই বললেন, “নামাবে কী করে? প্যান্টটা ছেঁড়া যে! কিন্তু আর তো দেরি করা চলে না। ভীম সিং, এই লোকটিকে নিয়ে আমরা এখন এস. পি. সাহেবের কাছে যাব। হাতকড়ি লাগিয়ে একে এখন নীচে নামিয়ে ট্যাক্সিতে তোলো।”
লিজার মা বললেন, “আমরা এখন কী করব?”
“আপনারা এখন এখানেই থাকুন।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “পরে যদি দরকার হয় তো আপনাদের ডেকে পাঠানো হবে।…ও হ্যাঁ, জনির জন্যে চিন্তা করবেন না, একটু বাদেই তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”