১
ভাদুড়িমশাই কোনও কথাই বলছিলেন না। হাতে একটা পেনসিল, পাশে একটা ইরেজার। চুপচাপ তিনি আজকের বাংলা কাগজের ভিতরের দিকের একটা পাতায় চোখ রেখে বসে ছিলেন। অথচ কিছু যে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন, তাও নয়। মাঝে-মাঝে পেনসিল দিয়ে কাগজের পাতাতেই কিছু লিখছেন, আবার ইরেজার দিয়ে দু-একটা কথা মুছেও দিচ্ছেন মাঝে-মাঝে। এদিকে আমরা যে একটা জরুরি বিষয়ে তুমুল তর্ক চালাচ্ছি, সেদিকে কোনও নজরই তাঁর নেই।
আজ শনিবার, সাতাশে এপ্রিল, ভাদুড়িমশাই এবারে বাংলা নববর্ষে কলকাতায় আসতে পারেননি, বাঙ্গালোরে কী একটা জরুরি কাজ পড়ে যাওয়ায় সেখানেই আটকে গিয়েছিলেন, সেটা মিটিয়ে গতকাল তিনি কলকাতায় এসে পৌঁছন। পৌঁছেই আমাকে খবর দিয়েছিলেন, ফলে আজ সকালে সদানন্দবাবুকে সঙ্গে নিয়ে আমি অরুণ সান্যালের কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয়েছি।
মামাবাবুর সঙ্গে কৌশিকও চলে এসেছে কলকাতায়। অরুণ সান্যালের স্বাস্থ্য মাঝখানে ভাল যাচ্ছিল না, কিন্তু এখন তিনি পুরোপুরি সুস্থ, ব্লাড প্রেশার ফ্লাকচুয়েট করছে না, একদম নৰ্মাল, বিকেলের দিকে নিয়মিত চৌরঙ্গীর চেম্বারে বসছেন, রোগী দেখছেন আগের মতোই। আড্ডাও তাই জমজমাট। একটু আগে ক্রিকেট নিয়ে কথা হচ্ছিল। কৌশিক বলছিল, সৌরভ যখন বড় একটা রান পেয়েছে, তখন আর দেখতে হবে না, সিরিজ আমরা জিতবই।
শুনে অরুণ সান্যাল বললেন, “তা নয় জিতলি, কিন্তু ফুটবলের কথাটা ভুলে যাসনি। যাতে আমরা এশিয়া-চ্যাম্পিয়ন ছিলুম, তার স্ট্যান্ডার্ড তো এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। যে-খেলা চুনি-পিকে বলরামরা দেখিয়ে গেছে, তার নখের জুগ্যি খেলাও কি আজকাল দেখতে পাস?”
কৌশিক বলল, “বোস-জেঠু সেই যে হাবলা বাঁড়ুজ্যের গপ্পো বলেছিলেন, সেই যিনি…”
সদানন্দবাবু ফুঁসে উঠে বললেন, “গপ্পো নয় হে ছোকরা, তাঁর খেলা আমি নিজের চোকে দেকিচি। ..কিন্তু খেলার কতা থাক, ইদিকে ফাইনান্স মিনিস্টার যে আমাদের ডুবিয়ে ছাড়লেন, সেটা ভেবে দেকেচ?”
“কেন, তিনি আবার কী করলেন?” আমি বললুম, “কিছু ছাড় তো দিয়েছেন।”
“ঘোড়ার ডিম দিয়েচেন।” সদানন্দবাবু বললেন, “আমরা সিনিয়ার সিটিজেনরা কী পেলুম? ভেবেছিলুম, অন্তত আমাদের বয়েসের কতা ভেবে সিনিয়র সিটিজেনদের জন্যে কিচু ব্যবস্থা করবেন, আর-কিচু না হোক ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ খানিকটে বাড়িয়ে দেবেন। তা দিলেন কি? … ঠিক আছে, ভোট আসুক, তখন ঠ্যালা বুজবেন অখন!”
অরুণ সান্যাল হেসে বললেন, “বোসদা, আপনি যে ভোটের কথা ভাবছেন, তাতে ওঁকে দাঁড়াতে হয় না, উনি রাজ্যসভার মেম্বার।”
“ঠিক কতা! আমি সেই জন্যেই একটা দাবি তোলার কতা ভাবচি।”
বললুম, “দাবিটা কী?”
সদানন্দবাবু বললেন, “খুবই সিম্পল ডিমান্ড। রাজ্যসভার মেম্বারকে ফাইনান্স মিনিস্টার করা চলবে না। তাঁকে লোকসভার মেম্বার হতে হবে, ইলেকশন ফেস করতে হবে।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “খুবই ন্যায্য দাবি! তো বোসদা, এই নিয়ে আপনি একটা চিঠি লিখে ফেলুন। খুব কড়া চিঠি। তারপর কাগজে সেটা ছাপিয়ে দিন।”
“ওই হয়েছে মুশকিল।” সদানন্দবাবু এতক্ষণ টগবগ করে ফুটছিলেন, হঠাৎ চুপসে গিয়ে বললেন, “লেকালিকি আমার আসে না। কিরণবাবু রাইটার মানুষ, এই কতাটা উনি যদি একটু গুচিয়ে গাচিয়ে লিকে দেন তো বেশ হয়। আমি অবিশ্যি সই করে দেব অকন।…তবে হ্যাঁ, চিঠিখানা বাংলায় লেকা চলবে না, ওটা ইংরিজিতে লেকা চাই। ইংরিজি কাগজে ছাপতে হবে, যাতে নিউ দিল্লির কর্তাদের চোকে পড়ে।”
চিঠি লেখার দায়িত্বটা যে কেন এত লোক থাকতে উনি বেছে-বেছে আমার ঘাড়েই চাপিয়ে দিলেন, তা ঠিক বোধগম্য হল না, তবে এটা ঠিকই বুঝলুম যে, সদানন্দবাবু যখন একবার ব্যাপারটাকে ধরেছেন, তখন নিস্তার পাওয়া শক্ত হবে। তাই তখনকার মতো রেহাই পাবার জন্যে বললুম, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, ও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবেখন।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “আমি একটা অন্য কথা ভাবছিলুম।”
“কী ভাবছিলেন?”
“ভাবছিলুম যে, ফিক্সড ডিপোজিটের উপরে সুদ যখন আর বাড়ছেই না, বরং দিনে-দিনে কমেই যাচ্ছে, তখন ব্যাঙ্কে টাকা না রেখে কিছু জমিজমা কিনে রাখলে কেমন হয়? জমির দাম তো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ওতে রিটার্ন অনেক বেশি। কী, কথাটা ভুল বললুম?”
“ষোলো আনার ওপরে আঠারো আনা ভুল বলেচেন।” সদানন্দবাবু বললেন, “জমি? ওতে তো ডাহা লোকসান।”
“এ-কথা কেন বলছেন?”
“বলচি আমার নিজের এক্সপিরিয়েন্সের কতা ভেবে।” সদানন্দবাবু বললেন, “আরে মশাই, জমি তো কিনবেন, তারপরে সেটা রক্ষে করবে কে?”
“কেন দরোয়ান রাখব।”
সদানন্দবাবু তেতো গলায় বললেন, “তবেই হয়েচে। তা হলে শুনুন, আমার কী হয়েছেল। বছর দশেক আগের কতা। সস্তায় পেয়ে বাঁশবেড়ের ওদিকে এক বিঘে জমি কিনেছিলুম। দরোয়ান রেখেছিলুম একটা। কাচেই হংসেশ্বরী দেবী আর রাধামাধবের মন্দির। অতি পবিত্র জায়গা। ভেবেছিলুম যে, কমলি তো বড় হচ্চে, বছর কয়েক বাদে ওর বে দিতে হবে। তখন মেয়ে-জামাইকে আমাদের শ্যালদার বাড়িতে বসিয়ে আমরা কত্তা-গিন্নি গিয়ে বাঁশবেড়েতে একটা ছোট্টমতন বাড়ি বানিয়ে নিয়ে সেখেনেই থাকব। কিন্তু তা আর হল কোতায়!”
“হল না কেন?”
“কী করে হবে। জমি কিনলুম, তার রেজিস্টারি হল, দরোয়ানও রেখেছিলুম একটা, লোক্যাল ম্যান, গাঁজাখোর বটে, তবে সবাই বলল, ভেরি অনেস্ট। মাইনে ঠিক হল মান্থলি পঞ্চাশ টাকা। তো বছরখানেক সেই টাকা তাকে পাটিয়েছিলুমও। তারপর একদিন মিসেস বোসকে সঙ্গে নিয়ে সেখেনে গিয়ে কী দেকলুম জানেন?”
“কী দেখলেন?”
“দেকলুম যে, আমার জমিতে গোলপোস্ট বসিয়ে গাঁয়ের ছেলেরা ফুটবল খেলচে। জিজ্ঞেস করতে বলল, ওটা ওদের খেলার মাঠ। এখন ফুটবল খেলচে, এরপরে শীত পড়লে ব্যাটবল খেলবে। তো ব্যাপার দেকেই যা বোজবার আমি বুজে গেলুম।”
“কী বুঝলেন?”
“বুজলুম, সব্বোনাশ হয়েচে!”
“থানায় যাননি?”
“গেসলুম। কিন্তু দারোগাবাবু বললেন, এখন ও জমির পজেশান পেতে গেলে ল’ অ্যান্ড অর্ডার প্রবলেম দেকা দেবে, শান্তিভঙ্গ হবে। এইসব বলে একগাল হেসে দারোগাবাবু অ্যাডভাইস দিলেন, মিটিয়ে ফেলুন মশাই। তো কী আর করব, যে দামে কিনেছিলুম, তার অর্ধেক টাকায় জমিটা ফের বেচে দিতে হল।….সান্যালমশাই, জমি কেনার কতা বলছিলেন তো? আমি বলি, জমি না কিনে টাকাটা বরং জলে ফেলে দিন।”
দ্বিতীয় রাউন্ডের চা নিয়ে কাজের মেয়েটি ড্রইংরুমে ঢুকল। সঙ্গে মালতী। সেন্টার টেবিলে ট্রেটা নামিয়ে রেখে কাজের মেয়েটিকে মালতী বলল, “তুই এবারে হেঁশেলে গিয়ে ডালটা নামা, তারপর ভাতটা চাপিয়ে দে। আমি একটু বাদে যাচ্ছি।”
তারপর পট থেকে কাপে-কাপে লিকার ঢালতে ঢালতে বলল, “বোসদা আর কিরণদা তো স্রেফ লিকার খান। কৌশিক, তুই তোর নিজের আর মামাবাবুর কাপে দুধ আর চিনি মিশিয়ে নে। তোর বাবার আর এখন চা খেয়ে দরকার নেই। বাড়তি এক কাপ চা আছে বটে, তবে সেটা আমিই খেয়ে নিচ্ছি।”
অরুণ সান্যাল কাতর কন্ঠে বললেন, “আমাকে দেবে না?”
কাল রাতে ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেছে। সকালটা এখনও তেতে ওঠেনি। সম্ভবত সেইজন্যেই মালতীর মেজাজ মোটামুটি ঠাণ্ডা। চায়ের কাপটা অরুণের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “যেই একটু সুস্থ হয়ে উঠেছ, অমনি অনিয়ম শুরু করলে। কাল থেকে কিন্তু সকালে ওই এক কাপই তোমার বরাদ্দ।…তা কী নিয়ে এতক্ষণ কথা হচ্ছিল?”
কৌশিক বলল, “অনেক কিছু নিয়ে। প্রথমে ক্রিকেট, তারপর ফুটবল, তারপর আমাদের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যশবন্ত সিনহার বাজেট, তারপর ল্যান্ডেড প্রপার্টি। বাবা বলছিলেন, ব্যাঙ্কে টাকা না রেখে জমি কেনাই ভাল।”
“সাধে বলছিলুম?” একটা চুমুক দিয়ে তাঁর চায়ের কাপটা সোফার পাশের সাইড টেবিলে নামিয়ে রেখে অরুণ সান্যাল বললেন, “ফিক্সড ডিপোজিটের সুদের হার তো ধাপে-ধাপে কমছে। এই সেদিনও ছিল থার্টিন পার্সেন্ট, সেখান থেকে কমতে-কমতে কোথায় নেমেছে দ্যাখো!”
সদানন্দবাবু বললেন, “ডাক্তারবাবু তাই জমি কেনার কতা বলচেন। তাতে আমি বললুম, অমন কাজটি করবেন না। জমি কিনেচেন কি মরেচেন। আরে মশাই, আপনার পাইক-বরকন্দাজ আচে? লেটেল আচে? তা যকন নেই, তকন জমিটা রক্ষে করবে কে?”
মালতী বলল, “তার মানে?”
“মানে অতি সিম্পিল।” সদানন্দবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করে বললেন, “জমি তো আমিও কিনেছিলুম, কিন্তু রাকতে পারলুম কি? হাপ প্রাইসে বেচে দিতে হল। না বেচে উপায় ছিল না, প্ৰায় বেহাত হয়ে গেসল।…ডাক্তারবাবুকে তাই বলছিলুম যে, আমরা হচ্চি নিদিরাম সদ্দার। আমাদের না আচে ঢাল, না আচে তরোয়াল, জমি রাকা কি আমাদের কম্মো?”
“যাচ্চলে!” বেজার মুখে মালতী বলল, “সারাটা জীবন কি তা হলে ফ্ল্যাটেই থাকব নাকি? সেই যতীন বাগচি রোডে ফ্ল্যাটে ছিলুম, আবার এই কাঁকুড়গাছিতেও সেই তিন-কামরার ফ্ল্যাট!”
কৌশিক বলল, “সেটা কম হল? জায়গার তো অভাব হচ্ছে না, দিব্যি কুলিয়ে যাচ্ছে। কী, কুলোচ্ছে না?”
“এখন কুলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তোর তো বিয়ে হবে, তখন কুলোবে না।”
“বুঝেছি, জমি কিনে বাড়ি করার প্ল্যানটা তা হলে তুমিই বাবার মাথায় ঢুকিয়েছ?”
“ঢুকিয়ে অন্যায় করেছি?”
সদানন্দবাবু বললেন, “ন্যায়-অন্যায়ের কতা হচ্চে না, মিসেস সান্যাল। কতা হচ্চে যা কিনবেন, তা দখলে রাকতে পারবেন কি না, তা-ই নিয়ে। তা আমি বলি কী, জায়গা নিয়ে যকন ভাবচেন, তকন বরং পাশের ফ্ল্যাটটাও কিনে ফেলুন।”
“সেভেন-বি ফ্ল্যাটটা?” ওটা বিক্রি হবে নাকি?”
“হবে।” এক গাল হেসে সদানন্দবাবু বললেন, “আজই সকালের কাগজে ক্লাসিফায়েড কলামে বিজ্ঞাপন দেকলুম। এই একই ঠিকানা, বাড়ির নামও আকাশবিহার, তার মানে এই একই বাড়ি। ইদিকে আবার ফ্ল্যাটের নম্বরও সাতের বি। তার মানে আপনাদের একেবারে পাশের ফ্ল্যাট। একবার কতা বলে দেকুন না, লেগে যেতে পারে।”
আমি বললুম, “যদি ডিসট্রেস সেল হয়…আই মিন ভদ্রলোকের যদি এখুনি টাকার দরকার হয়…মানে দরকার তো হতেই পারে…ধার শোধ করার জন্যে কি ধরুন এখানকার পাট তুলে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবার জন্যে, তা হলে দাম নিয়ে হয়তো তেমন ঝুলোঝুলিও করবেন না, মোটামুটি একটা রিজনেবল অ্যামাউন্ট পেলেই ছেড়ে দেবেন।”
“কিন্তু রিজনেবল প্রাইস মানেও তো বেশ কয়েক লাখের ধাক্কা।” অরুণ সান্যাল বললেন,”এই ধরুন দশ-বারো লাখ, তার কমে তো আর হচ্ছে না। তা সেটাই বা আমি এখন কোত্থেকে পাব?”
মালতী বলল, “ঠিক আছে, তোমাকে জমি কিনতে হবে না, ফ্ল্যাটও কিনতে হবে না। তার চাইতে বরং আমাকে কিছু টাকা দাও, আমি গোটা কয় গয়না কিনে রাখি।”
কৌশিক বলল, “তুমি আবার গয়না দিয়ে কী করবে?”
“ওরে বাবা, আমি নিজের জন্যে কিনছি না, আজ না হোক কাল তো তুই বিয়ে করবি, তখন’তোর বউকে দেব। ব্যাঙ্কে টাকা রাখার চাইতে সে অনেক ভাল, সোনার দাম তো আর কমবে না, বাড়বে। যা বাজার পড়েছে, তাতে গয়নাগাটি কেনাই দেখছি বুদ্ধিমানের কাজ।…দাদা কী বলো?”
মালতীর দাদা ভাদুড়িমশাই এতক্ষণ একটিও কথা বলেননি, বাংলা কাগজখানার আড়ালে মুখ ঢেকে বসে ছিলেন আর পেনসিল দিয়ে মাঝে-মাঝে কিছু লিখছিলেন। চা’ও খেয়ে নিয়েছিলেন নিঃশব্দে। এবারে হাতের কাগজ নামিয়ে রেখে বললেন, “পেয়েছি!”
সদানন্দবাবু হামলে পড়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী পেলেন?
“যেটার দরকার ছিল, সেটাই পেলুম।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “মালতী পাইয়ে দিল।” মালতী তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল। বলল, “আমি? আমি আবার কী পাইয়ে দিলুম?”
“গয়নাগাটি। ভার্টিক্যালি যে শব্দটা নেমেছে, তার শেষ অক্ষরটা হল ‘টি’। তাই হরাইজন্টালি যে পাঁচ অক্ষরের শব্দটা বসবে, তারও শেষ অক্ষরটা ‘টি’ হওয়া চাই। এদিকে সূত্র দেওয়া হয়েছে ‘অনেক মেয়েরই যা প্রিয়’। ব্যস, তোর মুখ থেকে বেরিয়েছিল বলেই গয়নাগাটি শব্দটা পেয়ে গেলুম, আর ছকও অমনি মিলে গেল!”
“মিলে গেছে, ভাল কথা!” মালতী বলল, “তবে কিনা সূত্রটা নির্ভুল নয়, দাদা।”
“এ-কথা বলছিস কেন?”
“এইজন্যে বলছি যে, গয়নাগাটি শুধু মেয়েদের নয়, অনেক ছেলেরও প্রিয়। কেন, ছেলেরা আংটি পরে না? হার পরে না? অনেকে তো মাকড়িও পরে।”
“ঠিক, ঠিক। এককালে অঙ্গদও পরত।”
অরুণ সান্যাল বললেন, “সেটা আবার কী বস্তু?”
“হাতের গয়না।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কনুইয়ের একটু উপরে ধারণ করতে হয়। সেকালে রাজা-রাজড়ারা পরতেন। কালিদাসের যক্ষও পরত। মেঘদূতের মধ্যেই তার প্রমাণ রয়েছে। বিরহের ঠ্যালায় বেচারা এমন রোগা হয়ে গেসল যে, হাতের অঙ্গদ ঢলঢলে হয়ে খসে পড়ে যায়।”
“তা-ই?” প্রশ্নটা সদানন্দবাবুর।
“হ্যাঁ, তা-ই!” ভাদুড়িমশাই বললেন, “কালিদাস অন্তত সেইরকমই লিখেছেন। প্যারীমোহন সেনগুপ্তের তর্জমা পড়েননি? ‘খসিয়া ভূমিপরে সোনার বালা পড়ে, নিটোল বাহু হল এমনই ক্ষীণ।’ ওই সোনার বালাজোড়া আসলে বিরহী যক্ষের অঙ্গদই।”
সদানন্দবাবু বললেন, “আমার দিদিশাশুড়িও অঙ্গদ পরতেন। তবে তাঁর কেসটা একটু আলাদা। “ অরুণ সান্যাল বললেন, “কী রকম?”
“তিনি রোগা হননি, মোটা হয়ে গেসলেন। ফলে অঙ্গদ তাঁর মাংসের মধ্যে কেটে বসে গেসল। শেষকালে স্যাকরা ডাকতে হয়। সে এসে কাতুরি দিয়ে সেই অঙ্গদ কেটে তা ধরুন আরও ইঞ্চিখানেক বাড়িয়ে দেয়। তবে কিনা আমার দিদিশাশুড়ি খুব দুধ-ঘি ছানা খেতেন তো, এরপর থেকে সে-সব বন্ধ হয়ে গেসল। দাদাশ্বশুর বলেছিলেন, ছি ছি, ফের যদি স্যাকরা ডেকে গয়নার সাইজ বাড়িয়ে নিতে হয় তো নাতি-নাতনি নাতবউয়েরা হাসাহাসি করবে।”
মালতী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে উঠে পড়েছিল। বলল, “আমি এবারে ওদিকে যাই। দেখি রান্না কদ্দুর এগোল।”
হাসতে হাসতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি বললুম, “কিন্তু একটা কথা যে বুঝতে পারছি না, ভাদুড়িমশাই।”
“কী কথা?”
“বরাবর তো ইংরেজি কাগজের ওআর্ড-জাম্বলটা করতেন দেখেছি। বাংলা কাগজের ক্রসওআর্ড · আবার কবে থেকে ধরলেন?”
“আজ থেকে ধরলুম।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “তবে ওআর্ড-জাম্বলও ছাড়িনি।”
“ওটা হয়ে গেছে?”
“আপনারা আসার আগেই হয়ে গেছে। যে অক্ষরগুলি পেয়েছিলুম, সেগুলি হল আর-ই-ডি-আর-ইউ-এম-ই-আর। ঠিক করে বসাতেই মার্ডারার শব্দটা বেরিয়ে পড়ল।”
“ওরেব্বাবা!” সদানন্দবাবু বললেন, “ই কী কাণ্ড! গয়নাগাটি নিয়ে কতা হচ্চিল, তার ওপরে আবার মার্ডারার। নাঃ, মাতাটা গরম করে দিলেন দেকচি।”
আমি বললুম, “যাদৃশী ভাবনা যস্য! এ-সব শব্দ বোধ হয় আপনার মতন লোকদের কথা ভেবেই বসানো হয়, ভাদুড়িমশাই।”
ভাদুড়িমশাই হাসলেন, তবে আমার কথার জবাবে কিছু বললেন না, সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মাথাটা কি খুব গরম হয়েছে?”
“খুব।”
“তা হলে চলুন, একটা ঠান্ডা জায়গা থেকে ঘুরে আসি।”
সদানন্দবাবু উৎফুল্ল গলায় বললেন, “তা হলে তো ভালই হয়। কোতায় যাবার কতা ভাবচেন? দার্জিলিং? কার্শিয়ং? শিলং?”
“না। ডুণ্ডা ভ্যালি।” ভাদুড়িমশাই বললেন, “হিমালয়ের কোলে। এখন যাকে উত্তরাঞ্চল বলে, সেই জায়গায়। আমার এক বন্ধু থাকেন, তিনি যেতে লিখেছেন, ভাবছি আজ তো সাতাশে, মঙ্গলবার তিরিশ তারিখে রওনা হব। আপনারা যাবেন?”
“যাব।” আমি বললুম, “কিন্তু কীসের জন্যে? স্রেফ বেড়ানো?”
আমার কথায় একটু সন্দেহের ছোঁয়া ছিল। ভাদুড়িমশাই সেটা বুঝতে পেরে হেসে বললেন, “ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। বেড়াব তো বটেই, তবে কিনা একটু কাজও আছে।”