।। ৫।।
বেশ কড়া গলায় ভর্ৎসনার সুরে মা বললো, আর লোক হাসিও না শঙ্কর। বাবার মৃত্যুর বছর না ঘুরতেই পুজো বন্ধ করে দিতে চাও কোন সাহসে? এ বাড়ির সম্মান তুমি বহুভাবে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছো, বারবার একই কাজ করো না। কলকাতায় চাকরি করো, সংসারে মাত্র কয়েকটা টাকা পাঠাও। জমি জায়গার কিছুই দেখছো না। যা ইচ্ছে করছ, আমি কিছুই বলছি না। তাই বলে দুর্গাপুজো বন্ধ করে দেবে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না।
গৌরীশঙ্কর ধীর গলায় বলল, মা, বাবা বেঁচে থাকতেই আমাদের ম্যাক্সিমাম জমি ভেস্ট করে নিয়েছিল সরকার। জমি অধিগ্রহণ কর্মসূচিতে একজন মানুষের নামে খুব বেশি পরিমাণ জমি রাখার নিয়ম নেই। আর আমাদের সব জমিই ছিল দাদুর নামে। খুব কম সংখ্যক জমি ছিল বাবার নামে। দাদুর মৃত্যুর পরে সেসব জমি সরকার ভেস্ট করে নিয়েছে। তাই এখন জমি থেকে বিশাল কিছু আয় হয়না। আমি অনেক লড়াই করে বাড়িটা বাঁচিয়েছি।
নন্দিনীদেবীর চোখে দৃঢ় অবিশ্বাস ফুটে উঠলো।
সেটা বেশ খেয়াল করলো গৌরী। বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো। নিজের মাও ওকে বিশ্বাস করে না, বাকিরা যে করবে না সেটাই তো স্বাভাবিক। বাবা মৃত্যুর আগে গৌরীকে বলেছিলেন, তোমায় শহরে রেখে পড়াশোনা করালাম এই জন্য? নিজেদের জমির কাগজগুলো নিয়ে গিয়ে সরকারের কাছে বেচে দিয়ে এলে? পড়াশোনা জানা ছেলে নিজের পরিবারের সর্বনাশ করলে?
তোমার দাদু আমি কত কষ্ট করে জমিগুলো আগলে রেখেছিলাম আর তুমি কিনা এই বংশের একমাত্র বংশধর হয়ে এভাবে পথে বসালে? বাবার ভেঙে পড়া অসহায় গলা শুনে কষ্ট হয়েছিল গৌরীশঙ্করের। কিন্তু ও বোঝাতে পারেনি গত একমাস ধরে বি.এল.আর.ও. অফিস, কোর্ট, কাছারি করেও সরকারের জমিঅধিগ্রহণ নীতির বিরোধিতা করতে পারেনি। করলে হয়তো শেষ পর্যন্ত বাবার জেল হয়ে যেত। ও জানে রায়চৌধুরী বাড়ির বেশির ভাগ ভালো জমিই এখন বেহাত। বাকি যে ক বিঘে ধানী জমি আছে তাতে উর্বরতা একটু কমের দিকেই। চাষ করতে গেলে ভালো মত খরচ হয়। দামি কীটনাশক, সারের যা খরচ, তাতে চাষে লোকসানই হয়। এছাড়াও বর্গাদারদের জমিগুলোও আর ওদের নেই। প্রায় চল্লিশ, পঞ্চাশ বছর ধরে বংশ পরস্পরায় যারা চাষ করছে সরকারের আনুকূল্যে সে সব জমির মালিকানা এখন তাদের। এসব কথা রায়চৌধুরী বাড়ির কেউ বুঝতে চায়নি। বাবা, মা থেকে কাকা, জ্যাঠারাও মনে করেছে, গৌরী নিজেদের জমি ভেস্ট করিয়ে সরকারের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছে।
গৌরীশঙ্কর জমিদারী সম্পর্কে উদাসীন। বংশ পরিচয় নিয়ে উদগ্রীব নয় ঠিকই কিন্তু অসৎ নয়, এটাই কাউকে বিশ্বাস করাতে পারেনি ও। এমন কি বিষ্ণুকাকাও বলেছিল, ছোটকর্তাবাবু, এমন ভাবে কেউ নিজেদের সর্বনাশ করে? দোষ না করেও দোষের বোঝা মাথায় বহন করছিল গৌরীশঙ্কর। যখন দেখেছিলো গোটা পরিবার রায়চৌধুরী বংশের এই মারাত্মক ক্ষতির জন্য শুধু ওকেই দোষী করে গেছে তখন নিজেকে আর এই পরিবারের একজন মনে হয়নি। চারিদিকে সবার চোখেই ভর্ৎসনার দৃষ্টি দেখেছে ওকে কেন্দ্র করে। এমনকি বাবার মদ্যপান অতিরিক্ত বেড়ে যাবার জন্যও মা অবশেষে দায়ী করেছে ওকেই। নন্দিনীদেবী মদ্যপানে অচেতন স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলেছিলেন, সম্পত্তি হারানোর যন্ত্রণা ও কি বুঝবে? কেন যে গর্ভে ধরেছিলাম, কেন যে গর্ভপাত হলো না। ও না থাকলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। মানুষটা একটু একটু করে নিজেকে শেষ করে দেবার খেলায় মেতেছে। আর ছেলে হয়ে সে খেলায় অগ্নিসংযোগ করে চলেছে। মায়ের বদ্ধমূল ধারণা গৌরিশঙ্করই দায়ী বাবার আকস্মিক মৃত্যুর জন্য।
নন্দিনীদেবী আরেকটা পান মুখে পুরে বললেন, আমি বিষ্ণুকে বলেছি দুর্গাপুজোর পুরো লিস্টটা করতে। ওই দেড়শ ঢাকিই হবে আর অষ্টমীর ভোগও হবে। শুধু এ বছর কুমারী পুজো হবে না।
মনে মনে কল্পনা করে চমকে উঠলো গৌরীশঙ্কর। গত বছরের পুজোর ধার এখনো পরিশোধ করে উঠতে পারেনি ও। তাও গতবছর বাবার মৃত্যুর কারণে নম নম করে পুজো হয়েছিল। দেড়শ ঢাকি দিয়েই পুজো শুরু করেছিলেন চন্দ্রশঙ্কর রায়চৌধুরীর পূর্ব পুরুষ। সেই থেকেই এ বাড়িতে দেড়শ ঢাকি চলে আসে পঞ্চমীর দিনই। সেদিন থেকে ওদের খাওয়া দাওয়া নতুন পোশাক সব এবাড়ির দায়িত্ব। তারপর আছে পুরোহিতের খরচ। এ অসম্ভব মা বলে প্রায় আর্ত চিৎকার করে উঠলো গৌরী।
নন্দিনী দেবী বিরক্ত মুখে বললেন, সব সম্ভব। তোমার বেতনের টাকাটা এ মাসে পুরোটাই আমার হাতে দিও।
গৌরীশঙ্কর কি করে বোঝাবে ওর বেতনের চল্লিশ হাজার টাকায় এখনকার দিনে চল্লিশ জনকে পাত পেড়ে খাওয়ানো সম্ভব নয়, সেখানে এই মস্ত আয়োজন!
নন্দিনীদেবী রায় ঘোষণা করে দেবার ঢঙে বললেন, এবারে তুমি এস। আমি বিষ্ণুচরণকে নিয়ে নিমন্ত্রণের লিস্টটা সেরে ফেলি। প্রতিবাদ করতে যাওয়ার দ্বিতীয় চেষ্টা না করে রায়চৌধুরীদের বিশাল ছাদের সিঁড়িতে পা দিলো গৌরী। মাথার মধ্যে হাজার পোকার কিলবিল, কি করে হবে! কোথায় পাবে টাকা! জমি বিক্রি করে যদি পুজো করে তাহলে মায়ের আশ্রিত এই বিষ্ণুচরণ, বিন্দু পিসি, শ্যামলীপিসির মত মানুষগুলোর পেট চলবে কি করে। ওই জমিগুলোর ধান, আলুতেই রায়চৌধুরীদের বিশাল হাঁড়ি থেকে ভাত ফোটার গন্ধ বেরোয়। কলকাতায় যে ছোট ফ্ল্যাটটা ও অনেক কষ্ট করে কিনেছে তার লোন শোধ হতে এখনো তিনটে বছর। বড় মামার মৃত্যুর পরে দুই ভাইই মামীকে নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। হাত পাতার মত কাউকেই খুঁজে পাচ্ছে না গৌরীশঙ্কর। মা চাইছে এবাড়ির দুর্গাপুজোটা হোক। ও এমন কুলাঙ্গার ছেলে যে সেটুকুর জোগাড় করার মত সামর্থ্যও ওর নেই।
অসহ্য অব্যক্ত কষ্টে দুমড়ে যাচ্ছে ওর বুকের ভিতরটা। এই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়লেই বোধহয় তার সুরাহা মিলবে। নীচের সবুজ ঘাস ছোঁবে ওর লাল রক্ত, মুক্তি পাবে ও। জমিদারের রক্ত নিয়ে নয়, আভিজাত্যের মুখোশ পরে নয়, পরজন্মে ও জন্মাতে চায় ওই দূরের জমিতে খালি গায়ে চাষ করা রাখালের মত। উন্মুক্ত আকাশের নিচে সবুজের মাঝে শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছে ছেলেটা। ওর মত ভারী বাতাসটাকে জোর করে প্রবেশ করাতে হচ্ছে না বেঁচে থাকার তাগিদে।
ছাদ থেকে একবার যদি লাফিয়ে পড়তে পারে তাহলেই মুক্তি, দুশ্চিন্তারাও নিশ্চিন্তে ঘুমাবে ওর সাথে।
।। ৬।।
কলকাতায় আসার পর থেকে আগের মামার বাড়িতে আসার আনন্দটা কি ভাবে যেন নিরানন্দে পরিণত হয়েছিল। আগে যখন মায়ের সাথে বছরে একবার মামা বাড়ি আসতো তখন এই হঠাৎ পাওয়া ঝাঁ চকচকে শহর, নানারকম নতুন খাবার, খেলনা দেখে আবেগে ভাসতো ও। ফিরতেই ইচ্ছে করতো না মহেশডাঙায়। কিন্তু এবারে কলকাতায় এসে থেকে মনটা সর্বক্ষণ পড়ে ছিল মহেশডাঙার কাঞ্চনদীঘির পাড়ে। মামী যতই আদর করে খেতে দিক, মামা নতুন ব্যাগ, ড্রেস কিনে এনে দিক, মনখারাপি বাতাসটা কিছুতেই ওর পিছু ছাড়ছিল না। মামা বলেছিল, দুদিন পর থেকে তোর স্কুল। শীতের মরা রোদের দিকে তাকিয়ে হালকা করে ঘাড় নেড়েছিলো ও।
মামী বলেছিল, দেখবি কত নতুন নতুন বন্ধু হবে তোর।
বন্ধু শব্দটা শুনেই ছুটে মামাবাড়ির ছাদে উঠে এসেছিল গৌরী।
কালো পিচের রাস্তা দিয়ে ঝড়ের বেগে চলছিল বাস, লরি। গৌরীর ইচ্ছে করছিল, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে একটা বাসের মাথায় চেপে বসতে। তারপর ড্রাইভারকে বলতে, মহেশডাঙা রায়চৌধুরীদের বাড়িতে নিয়ে চলো। ওরা তো জমিদার। চন্দ্রশঙ্কর রায়চৌধুরীকে নিশ্চয়ই সবাই চেনে। লাল রঙের বাসটার ড্রাইভার কাকুও নিশ্চয়ই চেনে। তাহলে এই বাসটায় চড়ে চলে যাবে কাঞ্চনদীঘির ধারে। তারপর মাধবীলতাকে অবাক করে দিয়ে বলবে, ওর পালিয়ে আসার গল্প। শুনে মাধবী নিশ্চয়ই চোখ বড় বড় করে বলবে, বাপরে শঙ্কর, তোমার কি সাহস! তারপর ওর মিথ্যে উনুনে চড়াবে গৌরীর পছন্দের রান্নাগুলো।
মাধবীর কথা ভাবতে ভাবতেই ওর ঠোঁটে হাসি ফুটেছিল। মনে পড়ছিল ওর পাকামী। মিথ্যে রান্নার অভিনয় করতে করতে কপালের ঘাম মোছা, আর গৌরীকে দোষারোপ করে বলা, তুমি তো দিনরাত ঘুরে বেড়াচ্ছ, সংসার কি করে চলে সে খেয়াল রাখো?
এসব ভাবতে ভাবতেই চোখের সামনে দিয়ে চলে গিয়েছিল লাল রঙের বাসটা। তখন আবার একমুঠো মনখারাপের কালচে রং এসে ঢেকে দিয়েছিল গৌরীর দৃষ্টিপথ। ঢাকা পড়ে গিয়েছিল রায়চৌধুরী বাড়ির উঠোন, ছাদ, বিষ্ণুচরণকাকার স্নেহ জড়ানো মুখটা। ঢেকে গিয়েছিল বিন্দুপিসির খাবার থালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। আবছা হয়েছিল দাদুর আদরগুলো। মায়ের ওপরে মারাত্মক অভিমান জমেই ছিল গৌরীর। বাবা ওর খুব কাছের মানুষ কোনোদিনই ছিল না। সামনের রাস্তার কোলে এখন অন্ধকার নামছে। নিভছে দিনের আলো।
তবে কলকাতায় অন্ধকার হয়না, স্ট্রিট লাইটের আলোয় আবার দিনের মতোই ঝকঝক করে ওঠে। সেই আলোর তীব্রতায় গৌরী বুঝেছিলো মামাবাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার রাস্তা নেই। রাস্তার কালো পিচের দিকে তাকিয়ে ও ভেবেছিল, একবার ঝাঁপ দিয়ে দেখবে? মরে গেলে যাবে।
ঠিক তখনই ছোট্ট দুর্গারূপী মাধবীলতা চোখ পাকিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছে, ছি, তুমি না আমার বন্ধু! আমায় কথা দিয়েছিলে সাঁতার শিখে কাঞ্চনদীঘি থেকে পদ্ম তুলে এনে দেবে, এখন বাজে কাজ করতে চাইছো? আমি খুব পাপ দেব।
কালো রাস্তার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে, সিঁড়ির দিকে টুকটুক করে পা বাড়িয়েছে গৌরী। নীচে নেমেই মামীকে বলেছিল, আমি সাঁতার শিখবো। মামী খুশি হয়ে বলেছিল, বেশ, তোকে সুইমিং ক্লাসে ভর্তি করে দেব কাল। সাঁতার শিখতেই হবে। নাহলে বাড়ি ফিরে ওই ডাকাত মেয়ের সামনে হেনস্তার চূড়ান্ত হতে হবে।
কলকাতায় এসে অবধি মনমরা হয়ে ছিল ও। মামা, মামীর অনেক চেষ্টাতেও মুখে হাসি ফোটেনি। তাই সাঁতার শেখার প্রস্তাবে মামা, মামী দুজনেই খুশি হয়ে বলেছে, এই তো, আমাদের ছোট জমিদার এবারে সাঁতরে মহেশডাঙা চলে যাবে।
দিন সাতেক স্কুলে গিয়েই গৌরীশঙ্কর বুঝতে পেরেছিল, গ্রামে ওর যতই সম্মান থাকুক, এখানের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে ওকে বেশ বেগ পেতে হবে। শহুরে ছেলে মেয়েগুলোকে ভীষণভাবে লক্ষ্য করছিল শঙ্কর, আর রোজই শিখছিলো নতুন নতুন আদব কায়দা। বেশ কয়েকজনের সাথে পরিচয় হয়েছিল ঠিকই, তবে ওদের ও ক্লাসমেট বললেও বন্ধু বলতে নারাজ। কম কথা বলা, নিজের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকা গৌরীশঙ্করের বন্ধু কোনোদিনই খুব বেশি নয়। মাধবীলতার মত সবাইকে বলতেও পারে না, তুমি আমার বন্ধু হবে?
এই যে এখন শঙ্কর মহেশডাঙায় নেই, এখন নিশ্চয়ই মাধবী অন্য কাউকে বন্ধু পাতিয়ে তাকেই রেঁধে খাওয়াচ্ছে ওর ধুলোবালির তরিতরকারি। হয়তো এই একমাসে শঙ্করকে ভুলেই গেছে। অন্য কারোর বলে হয়তো ছয় মারতে ব্যস্ত সে। তার তো সবার সাথে গল্প না করলে আবার চলে না। শঙ্কর কিন্তু কাউকেই আর বন্ধু ভাবতে পারে না। পারলেও এদের ভাষায় বেস্টফ্রেন্ডের নাম জিজ্ঞেস করলে, ও বলে মাধবীলতা। সেদিন শঙ্করের ইঁচড়পক্ব ক্লাসমেট বললো, মাধবীলতা কি তোর গার্লফ্রেন্ড? বলেই চোখ মটকে হাসলো। মফঃস্বলের ছেলে, ক্লাস সিক্সের বিদ্যেতে এটুকুই বোঝে, গার্ল মানে মেয়ে আর ফ্রেন্ড মানে বন্ধু। তাই সে ঘাড় নেড়েই উত্তর দিয়েছিল, হ্যাঁ।
ব্যস, ক্লাসের বেশ কয়েকটা মহা পাকা এসে ওকে ঘিরে ধরে বলেছিল, শঙ্কর তোর গার্লফ্রেন্ডের বয়েস কত? প্রেম করিস বুঝি!
অজানা ভয়ে কেঁপে উঠেছিলো শঙ্কর। কেউ আবার মাধবীকে খারাপ বলবে না তো! তাই ঠাণ্ডা মাথায় উত্তর দিয়েছিল, মাধবীলতা আমার খেলার সাথী, আমার বন্ধু।
ছেলেগুলো সদুত্তর না পেয়ে মুখ বেঁকিয়ে চলে গিয়েছিল।
সেই তবে থেকেই মাধবীকে আড়াল করতে শুরু করেছিল শঙ্কর। অধিকারবোধ ঠিক নয়, তবে মূল্যবান কিছুকে যে আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হয় এটা তখন থেকেই বুঝেছিলো শঙ্কর।
মামার বাড়িতে টেলিফোন থাকলেও মহেশডাঙায় তখনও টেলিফোন প্রবেশ করেনি। কালো ভারী যন্ত্রে কি সুন্দর শোনা যায় অন্যের গলা। এই টেলিফোনের গল্পটা যখন মাধবীকে বলেছিল শঙ্কর একমাত্র তখনই দামাল চোখদুটো স্থির হয়েছিল মুহূর্তের জন্য। অবাক হয়ে শঙ্করের হাতটা চেপে ধরে সে বলেছিল, সত্যি? এমন যন্ত্র আছে?
এর আগে বটগাছের কোটরে টিয়ার বাসা, কচুপাতায় জল থাকে না, হেলিকপ্টারের দুটো ডানা থাকে এসব গূঢ় তত্ত্ব যখনই ওই মেয়েকে বলতে বসেছে তখনই সে নাক কুঁচকে বলেছে, ধুর, আমি এগুলো সব জানি।
একমাত্র টেলিফোনের বিষয়টা সবজান্তা মেয়েটা জানেনা দেখে বেশ গুছিয়ে বসেছিলো শঙ্কর। নম্বর ডায়াল করার টেকনিক বোঝানোর সময় মাধবী তো রীতিমত উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, তারপর, কিরিং কিরিং সাইকেলের মত আওয়াজ হবে? মুশকিল হলো, মাধবীকে তো তাও দু চারটে নিজের জ্ঞান বিতরণের সুযোগ ছিল। কিন্তু এই স্কুলে তো, এরা সবাই ওর থেকে বেশি জানে। তাই ওকেই চুপ করে সকলের সবটা শুনতে হয়। শুনেই অবশ্য মাথার মধ্যে তালাবন্ধ করে রাখে গৌরীশঙ্কর, যেদিন মহেশডাঙা ফিরবে সেদিনই কাঞ্চনদীঘির ধারে বসে সব বলবে মাধবীকে। মেট্রোট্রেনের গল্প, চিড়িয়াখানা, তারামণ্ডল….এসব শুনে ওর মুখটা কেমন হবে সেটাই ভাবার চেষ্টা করছিল গৌরী।
।। ৭।।
গৌরীশঙ্কর মহেশডাঙা ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন কিছুতেই ওর সাথে দেখা করেনি মাধবী। এ কেমন বন্ধু, যে ওকে ছেড়ে কলকাতা চলে যায়। মায়ের অনেক ডাকেও দরজা খোলে নি ও। একটা ঘরের মধ্যে বসে কেঁদেই গেছে। ও ছোট বলে কি ওর কষ্ট হতে নেই? স্কুলে গিয়েও পুরোনো বন্ধুদের সাথে হাসি গল্প করতে পারেনি। মা বাবাকে আড়ালে বলেছে, কেন যে কুমারী পুজোর জন্য আমার মেয়েটাকে খুঁজে পেল রায়চৌধুরীরা, আর তুমিও যে কেন রাজি হলে! তিনটে সন্তান নষ্ট হবার পরে আমি মাধবীকে পেয়েছিলাম তুমি কি জানতে না? তারপরেও মা দুর্গার পাশে বসিয়ে ওকে পুজো করার কি দরকার ছিল। পুজোর পর থেকেই মেয়েটা আমার কেমন বয়েস ছাড়া বড় হয়ে গেল। কদিন ধরেই দেখছি মেয়েটা আনমনা থাকে। পছন্দের খাবার খেতেও চায়না। এমনকি বন্ধুরা এসে ফিরে গেছে, মেয়ে আমার খেলতে যায়না। মা বলে জড়িয়ে ধরেনি কতদিন। কি এমন হল মেয়েটার! সব সময় মুখ কালো করে, মনখারাপ করে বসে থাকে। সব হলো এই তোমার জন্য মাধুর বাপ। মেয়েটার বকবকে আমি রান্নাঘরে বসেও অতিষ্ঠ হতাম, মেয়েটার খলখল হাসিতে আমার দুপুরের ঘুম ভাঙত, সেই মেয়ে যেন বোবা হয়ে গেছে।
মাধবী আড়াল থেকে সব শুনেছিল। কিছুটা বুঝেছিলো, কিছুটা নয়। ও নিজেও জানে না কেন ওর আর খেলনাবাটি খেলতেও ইচ্ছে করছে না, কেন ওর কাঞ্চনদীঘির ধার দিয়ে গেলেই বুকের ভিতর কষ্ট হচ্ছে আর কারণ ছাড়াই চোখে জল বেরোচ্ছে। তবে জমিদার বাড়ির ছেলেটার জন্য খুব মনখারাপ করে। ক্রিকেট খেলতেও ইচ্ছে করে না। কেন যে ওর বন্ধুটা কলকাতা চলে গেল! রান্না করতেও ইচ্ছে করে না মাধবীলতার, শুধুই মনে হয়, কার জন্য আর করবো, কেই বা খাবে! সেদিন বিজয়া এক মুঠো দই পাতা নিয়ে এসে বলেছিল, চল দই পাতি, তাতেও মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল মাধবীর। শঙ্কর ওর পাতা সবুজ রঙের থক থকে দই দেখে বলেছিল, ওমা, একেবারে দইয়ের মত। তুমি কত কি জানো মাধবী। একমাত্র শঙ্করই স্বীকার করতো ওর গুণের কথা। বাকি সবাই তো দস্যি মেয়ে, বাচাল মেয়ে বলে ডাকে।
মাধবী জানে শঙ্কর এখন কলকাতায়, তবুও রায়চৌধুরীদের বিশাল বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রোজ তাকাত গৌরীশঙ্করের দোতলার দক্ষিণের ঘরের দিকে। বারবার মনে হতো এই বুঝি ওই সবুজ রঙের জানালাটা খুলে গিয়ে কেউ মুখ বাড়িয়ে বলবে, এই যে দুগ্গা ঠাকুরের বাহন চললে কোথায়! মাধবী কোমরে হাত দিয়ে বলতো, আমি নিজেই দুগ্গা ঠাকুর, তুমি আমার বাহন বললে? শঙ্কর জিভ ভেঙিয়ে বলতো, ওরে আমার ঠাকুর রে। বল করতে পারে না, আউট হলে ব্যাট দেয় না, সেও নাকি ঠাকুর।
স্কুলে যাওয়ার পথে ওই ঝগড়াটা আর এখন হচ্ছে না। তবুও ওই বন্ধ জানালার দিকে রোজ তাকায় মাধবী।
বাবাকেও জিজ্ঞেস করে, তুমি যে ওবাড়িতে পুজো করতে যাও, ও বাড়ির সব চেয়ে বদমাশ ছেলেটা কি কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরেছে?
বাবা ঘাড় নেড়ে বলে, কে গৌরী? না না সে এখন মস্ত ব্যস্ত আছে শুনলাম। নামী স্কুলে পড়ছে, পড়ার বড় চাপ।
মাধবী মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, থাকুক কলকাতায়, মহেশডাঙায় তার আছেই বা কে! মাধবীলতা হঠাৎই ছয়মাসে বেশ বড় হয়ে গেছে। গ্রীষ্মের ছুটিতে সে আর আম বাগানে, জাম বাগানে ঘুরে বেড়ায় না। মা অবাক হয়ে বলেছে, মেয়েটা আমার আচমকা বড় হয়ে গেল।
গ্রীষ্মের দাবদাহের দুপুরে মাধবীলতা ঘুমাচ্ছিলো ওদের একতলার ঘরে। হঠাৎই কেউ জানালায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলো ওকে, মাধবী….এই মাধবী…
মা বলে দুপুরে যারা রোদে ঘোরে তাদের নাকি দুপুর ভূতে ধরে। কিন্তু মাধবী তো এখন রোদে ঘুরছে না তবুও কেন ওর জানালায় টোকা পড়ছে। তবে কি ভূতে ঢিল ছুঁড়ছে!
ভয়ে ভয়ে রাম নাম জপ করছিল মাধবী।
তবুও দরজায় ধাক্কা কমলো না, বরং দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।
মা গেছে পাশের বাড়িতে, রমলা জেঠিমার কাছে। এসময় ওরা উলবোনা শেখে, গল্প করে। মাধবীও দিনদুই গিয়েছিল মায়ের সাথে। এখন আর যায় না। রমলা কাকিমা শুধুই বলে, এসব কাজ শিখে নে মাধু, অমন ছেলেদের মত ক্রিকেট খেলিস না। বিয়ের পরে এসবই কাজে লাগবে। ভিতরে ভিতরে রাগ হয়েছিল এসব শুনে। তাই মাধু আর যায় না মায়ের সাথে। বাবা বোধহয় এখনো পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে। মাধবী এখন কাকে যে ডেকে বলবে ওর জানালায় ভূতের ঢিল পড়ছে, সেটাই ভাবতে ভাবতে আবার শুনতে পেল, এই মাধবী আমি শঙ্কর….
আর এক মুহূর্ত দেরি না করে জানালাটা খুললো মাধবী।
ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখল, ফর্সা মত একটা ছেলে তাকিয়ে হাসছে ওর দিকে।
মাধবী ভয়ে ভয়ে বললো, তুমি সত্যিই শঙ্কর, নাকি ভূত! ওর গলা নকল করে ডাকছ আমায়? শঙ্কর তো এত ফর্সা ছিল না?
গৌরীশঙ্কর হেসে বললো, এই যে ভীতু ঠাকুর, আমি শঙ্করের ভূত, তোমার ঘাড় মটকাব বলেই তো কলকাতা থেকে একটু আগেই এলাম।
মাধবী ভয়ে ভয়েই বললো, দাঁড়াও আমি যাচ্ছি তোমার কাছে। তবে একটা কথা জেনে রাখ, আমার গায়ে খুব জোর, যদি ভূত হও তাহলেও আমি তোমায় বেঁধে রাখবো বুঝলে!
মাধবী দরজার বাইরে বেরোতেই ওর হাতটা ধরে হেঁচকা টান দিলো শঙ্কর। চলো এখুনি, তোমায় ম্যাজিক দেখাবো।
মাধবীর চোখে তখনও ঘোর লেগে ছিল। ফর্সা, দারুণ সুন্দর চুলের কাট, আরেকটু লম্বা ছেলেটা সত্যিই কি গৌরীশঙ্কর? নাকি ভূত বা ছেলেধরা।
মাধবীর হাত ধরে উষ্ণ হাওয়া উপেক্ষা করে ছেলেটা ছুটতে ছুটতে নিয়ে এলো কাঞ্চনদীঘির ধারে। তারপর বলল, মাধবীলতা, দীঘির দিকে তাকাও।
কথা শেষ হবার আগেই জলে ঝপাং আওয়াজ তুলে লাফ দিলো শঙ্কর। ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল মাধবীর।
কাঞ্চনদীঘিতে অনেক জল। গভীরতাও কম নয়। সেখানে সাঁতার না জানলে কেউ নামতে পারে না। আর এইটুকু ছেলে হয়ে দীঘির জলে নেমে পড়লো!
মাধবী বড় বড় চোখ করে দেখছিল ছেলেটা অবলীলায় কাঞ্চনদীঘিতে সাঁতার কাটছে। দুটো পদ্মপাতা তুলে এনে বললো, চলো তোমায় সাঁতার শেখাই।
মাধবী ভীতু গলায় বলেছিল, যদি ডুবে যাই।
গৌরীশঙ্কর বেশ দম্ভের সাথেই উত্তর দিয়েছিল, শঙ্কর বেঁচে থাকতে মাধবীলতার কোনো ক্ষতি হবে না। ওই ছোট ছেলেটার গলায় সেদিন যে কি ছিল জানে না মাধবী, শুধু মনে হয়েছিল, একে ভরসা করা যায়। ঠিক যেমন বাবাকে করে তেমন। শীতকালে টিউবওয়েলের ঠাণ্ডা জলে হাত দিয়েও বাবা বলে, মাধু একেবারে গরম জল, তাড়াতাড়ি এক বালতি মাথায় ঢেলে নে। শুধু বাবার কথায় বিশ্বাস করে ঠাণ্ডা জলকেও ওর গরম মনে হতো।
ঠিক ওরকমই মনে হয়েছিল, এই ছেলেটাও ওকে সামলে রাখবে। তাই কোনো কথা না ভেবেই শঙ্করের হাত ধরে নেমেছিল কাঞ্চনদীঘিতে।
জলের মধ্যেই শঙ্কর বলেছিল, সুইমিং শিখতে যেতাম ওখানে সপ্তাহে তিনদিন। তখন থেকেই ভাবতাম কবে তোমায় শেখাবো! এবারের ছুটিতে তোমায় সাঁতার শিখিয়ে ফিরবো। পরের বার দুজনের কম্পিটিশন হবে কিন্তু।
মাধু ওর গলাটা চেপে ধরে বলেছিল, ডুবিয়ে দিও না কিন্তু। শঙ্কর ফিসফিস করে বলেছিল, নিজে ডুবলেও তোমায় ডোবাব না।
।। ৮।।
এ সংসারটাকে ভরাডুবি না করলে বোধহয় তোমার চলছে না তাই না মাধবীলতা? পুরোহিতের মেয়ে হয়ে লজ্জা করে না এমন কাজ করতে! যার চরিত্রের ঠিক নেই সেই মেয়েই কিনা রায়চৌধুরী বাড়ির বংশধরের স্ত্রী।
মাধবীর স্থির চোখের দিকে তাকিয়ে কাটা কাটা স্বরে কথাগুলো বলে গেল নন্দিনীদেবী। আমার ছেলেটাকে কেড়ে নিয়েও শান্তি পাওনি তাই না? এখন পড়েছো এ পরিবারের ঐতিহ্য নষ্ট করার খেলায়!
আসলে কি বলতো, বংশপরিচয়, ঐতিহ্যের তুমি কি বুঝবে! তোমার বাবা আমাদের বাড়ি থেকে দুটো চাল কলা নিয়ে যেত আর সেই রান্না করে দিন কাটতো, সে বুঝবে রায়চৌধুরী পরিবারের সম্মান! তোমার বুদ্ধিতেই বোধহয় গৌরী এ বাড়ির এত বছরের পুজো বন্ধ করার কথা ভাবনার মধ্যেও আনতে পেরেছে? তিলতিল করে এ বাড়ির সম্মান মাটিতে মিশিয়ে কেন দিতে চাইছো? এ বাড়িতে তোমায় বৌরানী হিসাবে বরণ করা হয়নি বলে?
দেখো মাধবীলতা, তোমার যা চরিত্র তাতে গৌরী তোমায় মেনে নিলেও আমি অন্তত মেনে নিতে পারবো না।
মাধবীলতা স্থির চোখে তাকিয়ে আছে নিজের পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে। রায়চৌধুরী বাড়ির এই সাদা কালো দাবার ছকের মত মেঝেতে ছোটবেলায় অনেকবার পা দিয়েছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করতো সব সাদা বা সব কালো ঘর নয় কেন! কেন একটা সাদা একটা কালো?
মাধবীর বাবা সহজ সরল ভাষায় বলেছে, এ পৃথিবীর সব মানুষ কি সমান? কারোর মন কালো, কারোর সাদা। কিন্তু আমরা তো গা ঘেঁষাঘেঁষি করেই বেঁচে আছি। তাই এই মেঝেতেও সাদা পাথরের পাশেই কালো পাথর আছে।
মাধু বিস্ময়ের গলায় বলেছিল, বাবা সাদাগুলোই যে ভালো, বুঝলে কি করে?
আমাদের পাড়ার মনিপিসি তো খুব ফর্সা কিন্তু মনটা খারাপ। আর মেনকাদির গায়ের রং তো কাল কিন্তু মনটা আকাশের মত বড়।
মেয়ের জটিল প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে বাবা মাথা চুলকে বলেছিল, বেশ বেশ সাদা কালো দুই ভাই। তাই পাশাপাশি থাকে বুঝেছিস! তখন থেকেই এই সাদা কালো মেঝের প্রতি একটা মারাত্মক আকর্ষণ ছিল মাধবীর। শুধু মেঝের প্রতি কেন এবাড়ির বাগানের ওই কাঠচাঁপা গাছটার প্রতি ছিল ওর ভীষণ মায়া। তাই তো বাগানের এক কোণের অবহেলিত কাঠচাঁপা গাছটাকে যত্ন করতে নিজেই মাঝে মাঝে হানা দিতো এ বাড়ির বাগানে। মালি কাকাকে বলতো, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকাকে এত যত্ন করার পরেও তো এরা শুধু শীতকালেই ফুল দেয়। আর কাঠচাঁপাটা তো সারাবছর ফুল দেয় গো মালিকাকা, তারপরেও কেন ও একটুও যত্ন পায় না?
মালিকাকা হেসে বলতো, ও হলো এ পরিবারের পুরোনো সদস্য বুঝলে! তাই ওকে যত্ন না করলেও এ পরিবারেই থাকবে ও। কিন্তু নতুন অতিথিদের যদি আপ্যায়ন না করি তবে তারা মনমরা হয়ে পালাই পালাই করে পালাতে চাইবে। গোলাপ, ডালিয়ারা হলো কদিনের অতিথি, তাই তো ওদের যত্ন করতে হয়। আর তোমার ঐ কাঠচাঁপা তো জানেই এ পরিবারটা কেমন, তাই ওর রাগ-অভিমান হয় না। ও সারাবছর হাসি মুখে সুখ-দুঃখ সহ্য করে নেয়। ও যে পরিবারের অংশ। পরিবারের অংশ তো নিজেই অতিথি আপ্যায়নে মন দেবে, নিজে কি পেল না পেল তার হিসেব কষবে, পাগলী মেয়ে!
সেদিন থেকেই ছোট মাধুও হয়ে গিয়েছিল এই রায়চৌধুরী পরিবারের অংশ। কেউ ওকে সদস্য করেনি, নিজেই নিজেকে এ পরিবারের অংশ ভাবত ও। এবাড়ির প্রতি ওর টান যেন জন্মজন্মান্তরের। বাবার সাথে আসার ফলে এ বাড়িতে ওর যাতায়াত ছিল অবাধ। তাই বহুবার এই সাদা কালো মেঝেতে পড়েছে ওর পায়ের ছাপ। অবশ্য তখন ওকে এবাড়ির সবাই ভালোবাসতো, কারণ মাধবীলতা তখন এ বাড়ির সদস্য ছিল না। অতিথি বলেই হয়তো সাময়িক যত্ন করতো। গৌরীশঙ্করের মা, কাকিমা, জেঠিমারা আদর করে নাড়ু, মিষ্টি, লজেন্স হাতে দিয়ে বলতো, ভারী মিষ্টি মেয়ে। সেই মিষ্টি মেয়েটাই যখন ভাগ্যের চক্রান্তে এ বাড়ির অংশ হয়ে গেল তখন থেকেই সবাই বিরূপ হলো ওর প্রতি।
চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকো না মাধবীলতা? তোমার প্ররোচনাতেই ছেলেটা এ বাড়ির দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য নিয়ে ছেলেখেলা করার সাহস পাচ্ছে। তবে তুমিও শুনে রাখো, যদি এবাড়িতে দুর্গাপুজো বন্ধ হয়ে যায়, তবে তার দায় কিন্তু তোমার। আমরা সবাই দোষারোপ করবো তোমায়!
কেঁপে উঠলো মাধবীলতা। আবার দোষের ভাগিদার হতে চলেছে ও। অকারণে দোষী হয়ে ওঠাটা বোধহয় ওর ভাগ্যে আছে।
মেঝের দিকেই তাকিয়ে আছে ও। নন্দিনীদেবীর দোষারোপের কোটা তখনও পূর্ণ হয়নি বলেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাধবী। যতক্ষণ না ওকে এ ঘর ছেড়ে যেতে বলা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ও নড়তেও পারছে না। মাধবীলতা তো সেই কবে থেকেই এ পরিবারের সদস্য ভাবে নিজেকে তাই এই অকারণ দোষারোপে তেমন কষ্ট হচ্ছে না ওর বরং এসব অপমানকে তুচ্ছ করেও একটাই চিন্তা মাথার মধ্যে আঁকিবুঁকি কাটছে, শঙ্কর কোথায় পাবে এত টাকা! শঙ্করের চোখের ভাষা পড়ার ক্ষমতা এ বাড়ির কারোর না থাকলেও মাধবীর আছে। সেই খেলনাবাটির সময় থেকেই মাধবীলতা বুঝতো ওর না বলা ভাষাদের।
যেভাবে বুঝেছিলো ওর পছন্দের খাবার, ওর প্রিয় রং, রাগ অভিমানের অভিব্যক্তিগুলো। শঙ্করকে কখনো বলতে হয়নি মুখফুটে ওর পছন্দের তালিকা, মাধু নিজেই বুঝে নিতো। ঠিক তেমনই এই মুহূর্তে শঙ্করের অসহায়ত্ব বুঝেই চিন্তা হচ্ছিল মাধবীলতার। নন্দিনীদেবীর ওকে বলা তীক্ষ্ন কথার জ্বালা, শঙ্করের কষ্টের কাছে কিছুই না মাধবীর কাছে। মাধবী জানে কতটা নিরুপায় হয়ে আজ শঙ্কর মায়ের সামনে এসে বলেছে, এ পুজোর ব্যয়ভার সামলান সত্যিই দুঃসাধ্য তার কাছে। গৌরীশঙ্করকে মাধবীলতার মত করে কেউ বোঝেনা। মাধবী জানে নিতান্ত অসহায় না হলে শঙ্কর কোনোদিন কোনো দায়িত্ব থেকে পিছু হটে না। সেই ছয় বছর থেকে চিনেছে মানুষটাকে তাই বেশি করে চিন্তা হচ্ছে। কি করে সামলাবে ও রায়চৌধুরী বাড়ির এই বিশাল খরচের পুজো!
নন্দিনীদেবী আরো বিরক্ত হয়ে বললেন, এমন ভাব করে দাঁড়িয়ে আছো যেন কিছুই বোঝো না! বেরও আমার চোখের সামনে থেকে। মাধবীলতা এতক্ষণ এই আদেশটার অপেক্ষাতেই ছিল। শঙ্করের কাছে যেতে হবে ওকে, সময় নেই ওর হাতে। এমন চাপে পড়ে মানুষটা হয়তো শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করে নেবে জীবনের কাছে। শঙ্করের হার সব থেকে বেশি কষ্ট দেবে মাধবীকে। ওর হার কিছুতেই মেনে নিতে পারে না মাধবীলতা।
।। ৯।।
কোমরে হাত দিয়ে ঝগড়া করছে ক্লাস টেনের মাধবীলতা। মহেশডাঙার সবাই প্রায় পরিচিত রমেশ ঘোষালের মেয়ের এই রূপের সাথে। অন্যায্য কিছু দেখলেই সে প্রতিবাদ করবেই। তাই বলে আজ যেটা করছে সেটা সত্যিই অন্যায্য। আম্পেয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলেই গৌরীশঙ্করকে আউট ঘোষণা করেছে। গৌরীশঙ্কর নিজেও হেলমেট, প্যাড খুলে ব্যাট অন্যের হাতে দিয়ে দিয়েছে। সেই অবস্থায় মাধবীলতা জোর তর্ক করে চলছে, শঙ্কর নাকি আউট ছিল না। ওর প্যাডে লেগেছিল বল। ওকে সবাই বোঝানোর চেষ্টা করছে। এটা পাড়ার ক্রিকেট ম্যাচ, অত সিরিয়াস কিছু নয়, তবুও কিছুতেই শোনে না মেয়ে। গৌরীশঙ্করের সাথে মাধবীলতার অভিন্ন হৃদয় বন্ধুত্বের কথা মহেশডাঙার সকলেই জানে। গৌরী বছরে দুবার বাড়ি ফেরে কলকাতা থেকে। যে পনেরো দিন থাকে এখানে, বেশিরভাগ সময় ওকে মাধবীর সাথে বনেবাদাড়ে ঘুরতে দেখে লোকজন। ছেলেটা ভীষণ শান্ত ভদ্র কিন্তু মাধবী হলো ডাকাত মেয়ে। তাই দুজনের যে কি করে এমন বন্ধুত্ব হলো সেটাও লোকজনের কাছে বিস্ময়।
সে সব বিস্ময়ে পাত্তা না দিয়েই বেড়ে উঠেছিলো ওদের বন্ধুত্ব। কুমারী পুজোর দিন প্রথম দেখা, তারপরে ঝগড়া খুনসুটির মধ্যে একটাই শব্দ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সেটা হলো বন্ধুত্ব। গৌরীশঙ্কর কলকাতায় থাকে, মহেশডাঙায় আসে মাঝে সাজে তাতেও কমতি পড়েনি ওদের সম্পর্কের গভীরতায়।
মাধবীলতা একনাগাড়ে বলেই চলছে, আমি দেখেছি বলটা ব্যাটে নয়, প্যাডে লেগেছিল, তাই ও নট আউট।
কিছুতেই হারতে দেবে না গৌরীকে। ওর তর্কের ঝড়ে শেষ পর্যন্ত আম্পেয়ার বলেছিল, বেশ আবার তবে নামুক গৌরীশঙ্কর রায়চৌধুরী।
মাধবীলতা চিৎকার করে বলেছিল, হুর রে।
গৌরীশঙ্কর খুব শান্ত স্বরে বলেছিল, মাধবী প্লিজ, ঝগড়া করো না। আমি সত্যিই আউট হয়েছি। ওই গলার স্বরে মাধবী হেরে যাওয়ার যন্ত্রণা শুনেছিল, আর সেটা কিছুতেই সহ্য হচ্ছিল না মাধবীর। বারবার মনে হচ্ছিল, আউট হয়ে যাওয়াটা শঙ্করের কাছে হার। তাও আবার নব্বয়েই দোর গোড়ায় গিয়ে। সেদিন ও প্রথম বুঝেছিলো, শঙ্করের পরাজয়ে মাধবীর ভীষণ কষ্ট হয়, অদ্ভুত অব্যক্ত একটা কষ্ট। সেই খেলনাবাটির সময় থেকেই গৌরীশঙ্কর ওর সব থেকে কাছের বন্ধু কিন্তু সেদিন ওই খেলার মাঠে মাধবী প্রথম অনুভব করেছিল, শঙ্করের ওপরে ওর একটা অন্যরকম অধিকারবোধ আছে। শঙ্করের সব কিছুতেই যেন মাধবীর অলিখিত আধিপত্য কাজ করে। তাই ওর হেরে যাওয়াটা নিজের ব্যর্থতার মতই মনে হয়েছিল।
মুখ গোঁজ করে কাঞ্চনদীঘির সামনে বসে ছিল মাধবী। মাঠে বাকি খেলা দেখার উৎসাহ হারিয়ে চুপ করে জলের দিকে তাকিয়ে বসেছিলো ও। সাইকেলটা গাছে ঠেস দিয়ে রেখেছিলো। সাইকেলটাই মাধবীর সর্বক্ষণের সঙ্গী। মা বলে মাধুর ময়ূরপঙ্খী। গৌরীশঙ্করই ওকে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিল। সাঁতার থেকে সাইকেল মাধবীকে ওই শিখিয়েছে। যেদিন প্রথম ওর লাল রঙের সাইকেলটা ঠেলে ঠেলে মাঠে নিয়ে গিয়েছিল, সেদিন গৌরীর কলকাতা ফেরার দিন ছিল। তবুও ওর সাইকেল দেখে গৌরী বলেছিল, চলো মাধবী তোমাকে আজ সাইকেল শিখিয়ে দিয়ে তবেই আমি কলকাতা ফিরবো। ক্লাস সিক্সের মাধবীলতা বেশ গম্ভীরভাবে বলেছিল, থাক থাক তোমার আর শিখিয়ে কাজ নেই। তুমি যাও শহরে। আমিই সাত বার পড়ে, হাত পা ভেঙে ঠিক শিখে নেব।
শঙ্কর মুচকি হেসে বলেছিল, শুধু রাগ করা তাই না? চলো ওঠো সাইকেলে।
মাধবীলতাকে সাইকেলের সিটে চাপিয়ে কেরিয়ার ধরে ওর পিছনে ছুটে ছুটে নিজের হাতের তালু লাল করে ফেলেছিল ও। ঘন্টা দুয়েকের আপ্রাণ চেষ্টায় অবশেষে মাধবী সাইকেলে বসে নিজেই প্যাডেল করেছিল।
গৌরীশঙ্কর আবার সেদিন বলেছিল, বলেছিলাম না, মাধবীলতাকে সাইকেল শিখিয়ে তবেই আমি কলকাতা ফিরবো।
মাধবী ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, এ বাবা, রক্ত জমে গেছে যে!
সেদিকে তাকিয়ে নিজের কষ্ট ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে ও বলেছিল, কিছু পেতে গেলে কিছু তো দিতেই হবে।
ক্লাস টেনের গৌরীশঙ্করের অনেক গম্ভীর কথার মানেই মাধবীর ছোট মাথায় ঢুকত না, তবে এটুকু ও বুঝতো এই মানুষটা সঙ্গে থাকলে সব সমস্যার সমাধান আছে।
সেই থেকেই ওর সব সময়ের সঙ্গী ওই সাইকেল। কাঞ্চনদীঘির সবজে আর নীল মেশানো জলের দিকে একমনে তাকিয়ে ছিল মাধবী। খেয়াল করেনি কখন নিজের চোখদুটো জলে ভরে গিয়েছিল। আচমকা ওর সাইকেলের বেলের আওয়াজে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলো, একটা কাপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে গৌরীশঙ্কর। মাধবী জল ভরা চোখে মুখটা ফিরিয়ে নিয়েছিল। গৌরীশঙ্কর ওর পাশে বসে ওর হাতে কাপটা দিয়ে বলেছিল, এই নাও, ক্লাবের সভাপতি এটা তোমায় দিতে বললেন। আমি আজকের খেলায় ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়েছি, তারপরেও আমার হাতে কাপটা দিয়ে সভাপতি বীরেন্দ্র বাবু বললেন, এই কাপটা মাধবীলতাকেই দিও, যেভাবে ঝগড়া করে তোমাদের দলকে জেতাতে চাইছিলো, তাতে এটা ওর প্রাপ্য।
শঙ্করের ঠোঁটের মুচকি হাসিটার দিকে তাকিয়ে রেগে গিয়ে মাধবী বলেছিল, আম্পেয়ার যখন নিজেই বললো আরেকবার মাঠে নামতে ব্যাট নিয়ে, তখন তুমি কেন নামলে না, তাহলে সেঞ্চুরি হয়ে যেত তোমার।
ভারী গলায় গৌরীশঙ্কর বলেছিল, অন্যায় হতো আর মাধবী তো কখনো অন্যায়কে সাপোর্ট করে না। তাই তোমায় হারতে দিতে চাই না বলেই মাঠে নামলাম না।
মাধবী চোখগুলো লাল করেই কাপটা হাতে নিয়ে দেখছিলো। আচমকা গৌরীশঙ্কর বলেছিল, মাধবীলতা, একটা প্রশ্নের সত্যি উত্তর দেবে? কাঞ্চনদীঘিকে সাক্ষী রেখে সত্যি করে বলতো, আমার হারে তোমার এত কষ্ট হয় কেন?
মাধবী একটু ভেবে বলেছিল, আমি কি জানি, আমার কষ্ট হয় সেটাই বুঝি, কেন হয় জানতে গেলে তো যোগেন ডাক্তারের বাড়ি যেতে হয়। সেই টেস্ট করে বলবে।
শঙ্কর ফিসফিস করে বলেছিল, মাধু তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাও, তোমায় অনেক কিছু বলার আছে। কিছু অনুভূতির সঠিক মানে বোঝানো বাকি আছে। মাধবী হাঁ করে তাকিয়ে বলেছিল, আর কিছু শিখতে পারব না বাপু। সাঁতার শিখেছি, সাইকেল শিখেছি এমন কি কঠিন অঙ্কগুলো অবধি তুমি শিখিয়ে ছেড়েছ আর ওসব মানে টানে শিখতে পারবো না, এই বলেই দিলাম। গৌরীশঙ্কর বলেছিল, এই ম্যান অফ দ্য ম্যাচের কাপটা তুমি নাও মাধু, তোমার জন্যই আমি এটা পেয়েছি।
মাধবী বলেছিল, আমার জন্য কেন পাবে! তুমি ভালো খেলেছ তাই পেয়েছো।
শঙ্কর মুচকি হেসে বলেছিল, আমার শক্তি প্রদানকারীর শক্তি ধার করেই তো আমি জিতি মাধু, তাই এটা তোমার জন্য।
মাধু বিরক্ত হয়ে বলেছিল, যবে থেকে তুমি কলকাতা গেছ তবে থেকে শক্ত শক্ত কথা বলতে শিখেছো। আমার ভালো লাগে না।
শঙ্কর ওর একটা হাত ধরে বলেছিল, আরেকটু বড় হও মাধবীলতা তারপর দেখবে অজানা কষ্টের মানে বুঝবে, মনখারাপের কারণ চিনবে তুমি। তখনই বুঝবে শক্তির আধার কেন বলছি তোমায়! জানো মাধবীলতা, কলকাতায় প্রতিটা পরীক্ষার আগে দুশ্চিন্তার মুহূর্তে আমি তোমার মুখটা কল্পনা করি, ব্যস আমার সব দুশ্চিন্তা কেটে যায়, মনের আকাশ ঝলমল করে ওঠে।
মাধবীলতা আনমনে বলেছিল, সে তো আমি তোমার ভালো বন্ধু বলে তুমি আমায় ভালোবাসো।
শঙ্কর আলতো হেসে বলেছিল, ঠিক বলেছো ভালোবাসি।
মাধবীলতা কাপ হাতে করে সাইকেল চালিয়ে ফিরে এসেছিল বাড়ি। হয়তো গৌরীশঙ্কর ওর ফেরার পথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে সেদিন বলেছিল, মাধবী পরের বার যখন দেখা হবে তখন তোমায় বোঝাবো ভালোবাসা শব্দের নিজস্ব অনুভূতিগুলোকে। কাউকে ভালোবাসলে যে উপলব্ধিগুলো হয়, সেগুলো শেখাবো তোমায়।
কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে ঊর্মি নামের একটা ভীষণ স্মার্ট আর সুন্দরী মেয়ে গৌরীশঙ্করকে প্রোপোজ করেছিল।
শঙ্কর মুচকি হেসে বলেছিল, সরি ফ্রেন্ড, আমি এনগেজড। এনগেজড সেই ক্লাস ফাইভ থেকে। ঊর্মি বলেছিল, ইস কি পাকা ছিলে তুমি, তখন থেকেই প্রেম করতে?
শঙ্কর হেসে বলেছিল, উঁহু তখন প্রেম করতাম না, ওর সাথে কেউ বন্ধুত্ব করতে এলেই রাগ করতাম। অনেক পরে বুঝলাম এই অদ্ভুত পজেসিভনেসের নাম ভালোবাসা। তবে জানো ঊর্মি ও এখনো জানে না যে ও আমায় পাগলের মত ভালোবাসে। ভাবে আমরা শুধুই আর পাঁচটা বন্ধুর মত। উর্মি বলেছিলো, কে সেই লাকি গার্ল?
শঙ্কর চলে যেতে যেতে বলেছিল, আগে সে বুঝুক সে আমায় ভালোবাসে, তারপর নাম বলব তার।