কাছের সঙ্গী – ১৫

।। ১৫।।

মাধবীলতা গ্রাম ছেড়েছে প্রায় বছর চারেক হলো।

গৌরীশঙ্কর চাকরি করছে বছর তিন-চার। রায়চৌধুরী পরিবারের বেশিরভাগ সম্পত্তি চোখের সামনে দিয়ে সরকার অধিগ্রহণ করে নিচ্ছে। এসব দেখেই উমাশঙ্কর অসহায়, নিরুপায় হয়ে রাগে-আক্রোশে মদ্যপান শুরু করেছিল বেশি বয়েসে। শেষ পর্যন্ত নেশা বাবাকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে নিচ্ছিলো। সাথে মারাত্মক রাগ জন্মেছিল গৌরীশঙ্করের ওপরে। উমাশঙ্করবাবুর দৃঢ় ধারণা হয়েছিল, গৌরীশঙ্কর একটু চেষ্টা করলেই জমিগুলোকে নিজেদের করে রাখতে পারতো। কিন্তু শিক্ষিত ছেলে হয়েও নিজের বংশের জন্য কিছুই করলো না গৌরী। এই আক্ষেপ থেকেই উমাশঙ্করের শরীর ভাঙতে শুরু করেছিল। নন্দিনীদেবীও তখন স্বামীর পক্ষ নিয়েই দোষারোপ করতে শুরু করেছিল গৌরীশঙ্করকে। বাধ্য হয়ে কাটোয়ার সেটেলমেন্ট অফিসে ছুটোছুটি শুরু করেছিল ও। অফিস সামলে কলকাতা থেকে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করতে হচ্ছিল কাটোয়ার অফিসে। সেদিনও হাফ অফিস করে ক্লান্ত বিধস্ত শরীরে কাটোয়ায় পৌঁছেছিল বিকেল তিনটে নাগাদ। হন্তদন্ত হয়ে স্টেশন থেকে নেমে ছুটেছিলো উকিলের বাড়ি। ওদের এসব জমি-জায়গা সংক্রান্ত বিষয়গুলো যিনি দেখছিলেন, তার কাছেই যাচ্ছিল গৌরী। সেই সময় সজোরে ধাক্কা লেগেছিল অত্যন্ত পরিচিত একটা গন্ধের সঙ্গে। ভীষণ চেনা এই গন্ধটা। না, কোনো বিশেষ পারফিউমের নয় অথবা কোন প্রিয় ফুলেরও নয়, তবুও বুনো বুনো মাদকতা মেশানো গন্ধটা ওর চেনা।

তাকিয়ে দেখেছিলো একটা অত্যন্ত সাদামাটা তাঁতের শাড়ি পরে, কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছে ওর ভীষণ পরিচিত গন্ধের উৎসটি। পা দুটো অবশ হয়ে গিয়েছিল। ধাক্কা খেয়ে অপর দিকের মানুষটিও চোখ তুলে তাকিয়ে বলেছিল, দেখে চলতে পারেন না?

মুহূর্তে তার চোখের দৃষ্টি থমকে গিয়েছিল। অস্ফুটে বলেছিল, শঙ্কর তুমি!

নিরাভরণ দুটো হাত আর দুই সিঁথির মাঝের সাদাটে অংশের দিকে তাকিয়ে শঙ্কর আচমকা বলে ফেলেছিলো, বিয়ে করো নি তুমি! তাহলে মহেশডাঙা থেকে পালিয়ে এলে কেন!

থরথর করে কাঁপছিল মাধবীলতার হালকা গোলাপি ঠোঁটদুটো। অনেক কষ্টে বললো, বিয়ে করতে হচ্ছিল বলেই তো পালিয়ে এলাম। একটা সংসার থাকতে আরেক সংসারে ঢোকা যে দ্বিচারিতা শঙ্কর। তোমার মাধবীলতা যে দ্বিচারিণী নয়। কাঞ্চনদীঘির জলের প্রতিটা পদ্ম বিদ্রূপ করতো যে আমায়, আমার গোছানো কাঠেরবাড়ির ছোট্ট সংসারটা ভ্রুকুটি করতো যে! বলতো মাধবীলতা, তোমার ঐ মাটির উননে তুমি একজনের প্রিয় খাবার রেঁধেছ, একজনের ঘরণী হয়েছ অবিরত, আজ সেসব ভুলে, সংসার ছেড়ে, কোথায় চললে! তাই আর দ্বিতীয় সংসার পাততে পারিনি শঙ্কর। বাবা ছিল অবুঝ, বাধ্য হয়ে মহেশডাঙা ছাড়লাম। সামান্য কিছু টাকা নিয়ে কাটোয়ার কলেজে ভর্তি হলাম, হোস্টেলে থাকতাম আর টিউশনি করতাম। এই বি.এ. পাশ করতেই আশ্রয় হারা হয়েছি। তবে কাগজে দেখলাম, একটি বাচ্চার গভর্নেস চাইছেন এক ভদ্রমহিলা, সেই কাজের আর আশ্রয়ের সন্ধানেই যাচ্ছি এখন।

রাস্তার লোকজনকে উপেক্ষা করে, নিজের সব কিছু ভুলে গৌরীশঙ্কর জড়িয়ে ধরেছিল মাধবীলতাকে। শঙ্করের ছোঁয়ায় ছটফট করে উঠেছিলো মাধবীলতা। সেই পরিচিত ছোঁয়া একই নির্ভরতার গল্প শুনিয়েছিলো ওর কানে কানে।

চলো মাধবী, আমার সাথে কলকাতা চলো এখুনি। আমি একটা ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকি, তোমার জন্য ওই ফ্ল্যাটের ঘর দুটো অপেক্ষা করছে। চলো মাধবী, গুছিয়ে নেবে তোমার পুতুল পুতুল সংসার।

মাধবীলতার চোখে নিষেধ না মানা জলের রেখা দেখেছিলো শঙ্কর। ফিসফিস করে মাধবী বলেছিল, তুমি আমার সব থেকে কাছের মানুষ, সব থেকে আপনজন। তবুও নাকি আমাদের বিয়ে হবে না! রায়চৌধুরী বাড়ির শেষ বংশধর তাদেরই কুলপুরোহিতের মেয়েকে বিয়ে করলে, সকলে তোমায় ব্রাত্য করবে শঙ্কর। আমি বেঁচে থাকতে তা হতে দিই কি করে?

শঙ্কর হেসে বলেছিল, মাধবী তুমি এত বড় কেন হয়ে গেলে! আগের মতই আবার বলো, এই শঙ্কর তুমি আমার বর হবে? তোমায় দই, মাংস দিয়ে ভাত দেব…মাধবী আজ যদি তুমি আমায় ফিরিয়ে দাও, তাহলে আর কোনোদিন কোনোখানে গৌরীশঙ্কর নামের মানুষটাকেই খুঁজে পাবে না।

মাধবী অসহায় গলায় বলেছিল, মহেশডাঙা ছেড়েছিলাম তুমি ভালো থাকবে বলে।

গৌরীশঙ্কর বললো, তাই বুঝি! নিজের শরীরের একটা অঙ্গ বাদ দিয়ে মানুষ ভালো থাকবে বলে তোমার মনে হয়? বিকলাঙ্গ জীবন কাটিয়ে মানুষ সুখী থাকবে বলে তোমার বিশ্বাস?

তোমায় ছাড়া আমি খুব অসহায় মাধবী, আমায় গুছিয়ে নাও প্লিজ। মাধবীর মেসের ছোট্ট স্যাঁতস্যাঁতে ঘর থেকে ওর সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওরা সেই রাতেই পৌঁছেছিল কলকাতা। মহেশডাঙায় যখন গৌরীশঙ্কর ফোন করেছিল তখন কাকভোর।

মা শুনেই আর্তনাদ করে বলেছিল, ওই মেয়েকে বিয়ে! আমারা মানিনা তোমার এসব উশৃঙ্খলতা। আমরা তোমার বনেদী বংশের মেয়ের সাথে বিয়ে স্থির করেছি। মৌখিক কথাও বলে রেখেছে তোমার বাবা, এখন তুমি যদি অন্যথা করো, তাহলে নিজের নামের শেষে রায়চৌধুরী পদবীটা আর বসাবে না।

ফোনটা রেখেই কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে বিয়ে সেরেছিলো মাধবীলতা আর গৌরীশঙ্কর।

গৌরীশঙ্করের মুখে ছিল প্রাপ্তির আনন্দ। মাধবীলতার চোখের কাজলে ভয় আর সংকোচের মিশেল।

অনভ্যস্ত হাতে শুরু করেছিল ওদের পুতুল খেলার সংসার। তবে এখন আর মাধবী আগের মত ধুলো বালি রেঁধে ধরে দেয়না শঙ্করের পাতে। রীতিমত যত্ন করে ওর পছন্দের পদগুলো রান্না করে দেয়। তবে ওর মনের মধ্যে যে যুদ্ধটা চলছে তার আভাস পায় গৌরীশঙ্কর। কেমন যেন থমথম করে ওর সরল সাধাসিধে মুখটা। সেদিকে তাকিয়ে গৌরী বারবার বলে, আমার পুরনো মাধবীলতা ফেরত চাই, প্লিজ ফিরিয়ে দাও।

মাধবী আনমনে বলে, তোমায় সংসার ছাড়া করলাম নিজের সংসার গোছাতে গিয়ে।

মাধবীকে নিয়ে রায়চৌধুরী বাড়ির সদর দরজা থেকে ফিরে এসেছিল গৌরীশঙ্কর। উমাশঙ্করের নিষেধ ছিল, ওই মেয়েকে নিয়ে যেন তার জীবিত কালে এ বাড়িতে প্রবেশ না করে গৌরী। একা ঢুকতে পারে কিন্তু ওকে নিয়ে নয়।

তারপর অনেক চেষ্টা করেও মাধবীকে স্বাভাবিক করতে পারেনি শঙ্কর।

একে একে ওদের বেশিরভাগ জমি সরকার অধিগ্রহণ করেছে, দোষারোপ করা হয়েছে অপয়া মাধবীলতা আর চূড়ান্ত অপদার্থ গৌরীশঙ্করকে। উমাশঙ্করের লিভারে পচন ধরেছিল, গৌরীশঙ্কর একাই যাতায়াত করছিল মহেশডাঙায়। বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্যদের দায়িত্ব নেওয়া সব সামলিয়েছিলো। তবুও মাধবী স্বীকৃতি পায়নি ও বাড়ির বউয়ের। উমাশঙ্করের কড়া নির্দেশ মেনে মাধবীলতাও যায়নি ও বাড়িতে। শুধু মাঝে মাঝে বলতো, শঙ্কর আমি গড়তে গিয়ে ভেঙে ফেললাম, তাই না!

বাবা যে বেশিদিন বাঁচবে না সেটা ডক্টররা বলেই দিয়েছিল। তাই মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল শঙ্কর।

সত্যিই বাবা বেশি দিন বাঁচেন নি। লিভারের পচনেই বাবার মৃত্যু হয়েছিল।

ভেঙে পড়েছিলো রায়চৌধুরী বাড়ির কাঠামো। সবাই চেয়েছিল, গৌরীশঙ্কর ফিরে আসুক মহেশডাঙায়। কিন্তু গৌরী জানতো, চাকরি ছেড়ে দিলে আর দুদিন পরে ও খেতেও পাবে না।

বাবা মারা যাবার পরের দুর্গাপুজোটা খুব নমনম করেই সারা হয়েছিল রায়চৌধুরী বাড়িতে। কিন্তু এ বছর মায়ের জেদ, সেই আগের মত জমজমাট করে করতে হবে এ বাড়ির পুজো। না, এখনও টাকার সে ভাবে জোগাড় করে উঠতে পারেনি শঙ্কর। ঠাকুর গড়ার সময় আসন্ন বলেই মা ডেকে পাঠিয়েছিল ওকে। সঙ্গে তেতো গেলা গলায় বলেছিল, ওই মেয়েকে এ বাড়িতে আসতে বলো। তোমার বউয়ের জন্য তোমার ঠাকুমা কিছু গয়না রেখে গিয়েছিলেন, সেগুলো ওর হাতে দিতে হবে ভাবিনি কখনো। তবুও তুমি যখন বিয়ে করেই ফেলেছো, তখন এ গয়না আগলে আমিই কেন বসে থাকি?

গিনির হার, টিকলি, বালা এগুলো মাধবীলতার হাতে তুলে দেবার সময়েও মা বলেছিল, না বাছা, আমি তোমায় সাধ করে বরণ করতে পারবো না। শঙ্করের বাবাই যখন তোমায় মেনে নেন নি, তখন ওসব লোকদেখানো বরণে কি লাভ? এসেছো যখন, তখন থাকো, খাও, আবার অতিথির মত চলে যেও।

মাধবীলতা ধীর গলায় বলেছিল, আমি এ পরিবারের সদস্য মা, অতিথি নই। তাই আমায় বরণ করতে হবে না, আমি এমনিই এই পরিবারের সুখে দুঃখে থাকবো।

নন্দিনীদেবী ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেছিলেন, ছলাকলা যে জানো, তা আমি বেশ বুঝেছি।

এই নিয়ে মাধবী দুবার এলো রায়চৌধুরী বাড়িতে।

মাধবীর কোনো আক্ষেপ নেই, কোনো অভিযোগ নেই শঙ্করের কাছে। শুধু ওর নীরব চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা মুচড়ে ওঠে শঙ্করের। কিছুই পারলো না ও। না পারলো নিজের স্ত্রীর অপমান আটকাতে, না রায়চৌধুরীদের জমি অধিগ্রহণ আটকাতে, না বাবাকে বাঁচাতে, না মায়ের প্রিয় সন্তান হতে। একেবারে লুজার হয়েই রয়ে গেল ও।

একমাত্র মাধবীর ”কাছের সঙ্গী” খেতাবটাই যা জিতেছে জীবনে। যদিও ওর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান খেতাব ওটাই।

সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে যাত্রা করেছে। মাধবীলতা এখনো ফিরল না বাড়িতে। কোথায় গেল! ওর বাবা তো ঢুকতে দেয় না ওই বাড়িতে। তবে কি এতদিন পরে মহেশডাঙায় এসে ও কোনো পুরোনো বন্ধুর বাড়িতে গেল? সে যাক, মেয়েটা তো ঘরেই থাকে, কোথাও যেতেই চায় না। বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে মাধবী।

গৌরীশঙ্কর চায়, সেই কোমরে হাত দিয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলা প্রতিবাদী মাধবীলতাকে ফিরে পেতে। সেই কুমারী পুজোর দিনে রুখে দাঁড়ানো মেয়েটাকে, যাকে ও ভালবেসেছিলো, তাকে ফেরত পেতে চায়।

ওর ভাবনার মধ্যেই হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকলো মাধবীলতা। ঠোঁটে একটা আলগা হাসি। তোমাদের বিন্দুপিসি দিলো। আমার তো তোমাদের রান্নাঘরে ঢোকা বারণ তাই আমি ভেবেছি রান্নাঘরে নয়, অন্য দিক দিয়ে ঢুকবো রায়চৌধুরী বাড়ির অন্দরে। এমন ভাবনা বাদ দিলাম, যে শুধু হেঁসেল দিয়েই মেয়েরা প্রবেশ করে নতুন সংসারে। অন্য অনেক পথও আছে গো।

শঙ্কর একটু ত্রস্ত স্বরে বললো, ছাড়ো না মাধু, আমরা তো দুদিন কাটিয়েই ফিরে যাব আমাদের ফ্ল্যাটে, কি দরকার এসব জটিলতায় ঢোকার!

মাধবীলতা একটু আত্মবিশ্বাসের সাথেই বললো, ফ্ল্যাট? ওটাতো শিকড় ছেঁড়া গাছ। ওকে জল দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছি ঠিকই, কিন্তু মাটির গভীরে যে শিকড় চলে গেছে, সেই গাছের ডালে ফুল না ফুটিয়ে তো আমি নড়ছি না শঙ্কর। তুমি চলে যাও, কদিন একটু কষ্ট করে হোটেলে খেয়ে নিও। আমি এই বাড়িতে থাকবো পুজো অবধি।

গৌরীশঙ্কর অবাক চোখে তাকালো চিরপরিচিত মেয়েটার দিকে। যার প্রতিটা নিঃশ্বাস ওর চেনা। যার ঠোঁটের ভিজে ভিজে আদ্রতায় ও নিজেকে সিক্ত করে বারবার। স্নানের পরে যার বুকের প্রতিটা জলবিন্দুতে ওর অধিকার, যার বুনো বুনো গন্ধে ও জংলী হয়ে ওঠে মধ্যরাতের বিছানায়, সেই মেয়েটাকেই কেমন অপরিচিত লাগছে ওর! রায়চৌধুরী বাড়ির এ হেন অপমানজনক পরিবেশের মধ্যে সে থাকতে চাইছে ওকে ছেড়ে!

গৌরীশঙ্কর ওর বাঁ হাতটা আলতো করে ধরে বলল, নেলপালিশ পরনি কেন?

মাধবীলতা মুচকি হেসে বললো, আলুথালু মাধুকে তোমার বেশি পছন্দ যে, পরিপাটি মাধবীলতার চেয়ে!

শঙ্কর ইতস্তত করে বললো, দেখো, পুজোর এখনো প্রায় দিন কুড়ি বাকি। আমি এতদিন অফিস কামাই করে এখানে থাকতে পারবো না। আর তুমি তো জানো এ বাড়ির কেউ তোমায় পছন্দ করে না। আমি সামনে আছি বলে হয়তো সেভাবে অপমান করার সুযোগ পাচ্ছে না। আমি এখান থেকে চলে গেলেই শুরু হবে বাঁকা কথার আক্রমণ। কেন মাধবী, কেন তুমি আমায় ছেড়ে এই মহেশডাঙায় থাকতে চাইছো? তাছাড়া দুর্গাপুজো হবে কিনা তারও ঠিক নেই। আমি একটা লোনের অ্যাপ্লাই করেছি অফিসে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি স্যাংশন হবে কিনা বলতে পারছি না। বুঝতেই তো পারছো, পুজোটা না হলে মা তোমায় আর আমায় কি ভাবে দোষারোপ করবে! ভেবেছিলাম, মাকে বোঝাতে পারব। মা হয়তো বুঝবে, আমার এই চাকরির থেকে দুর্গাপুজোর মত ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান করা জাস্ট অসম্ভব। কিন্তু মা কিছুই শোনার জন্য রেডি নয়। একটাই জেদ ধরে বসে আছে, পুজো করতেই হবে। এই বাজারে ঠাকুরের দামই কত, তারপরে আছে পুরোহিতের খরচ, ঢাকি, পুজোর সরঞ্জাম…না মাধবী এ অসম্ভব। তুমি চলে চল কলকাতা। এই দোলাচলে তুমি এ বাড়িতে থেকো না।

 মাধবীলতা গৌরীশঙ্করের ব্যাগটা গুছিয়ে দিতে দিতে বললো, সাবধানে থেকো। কটা দিন একটু কষ্ট করে খেয়ে নিও।

শঙ্কর জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বললো, তারমানে তুমি আমার কথা শুনবে না সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছ।

মাধবীলতা আবার বললো, আমাদের আলমারির দ্বিতীয় তাকে তোমার অফিসে যাবার সব জামা আমি আয়রন করে রেখে দিয়েছি, অসুবিধা হবে না।

হালছাড়া গলায় গৌরী বললো, যা ইচ্ছে হয় করো। তবে কষ্ট পাবে সেটাও জেনে রেখো।

মাধবীলতা নিস্তরঙ্গ গলায় বলল, এখনও তো পাচ্ছি। ভিতরে তো ভাঙাগড়া চলছেই।

।। ১৬।।

গৌরীশঙ্কর চলে গেল কলকাতা, ভ্রুর ভাঁজে আশঙ্কা আর অস্বস্তির চিহ্ন নিয়েই রওনা দিলো। মাধবীলতা থেকে গেল রায়চৌধুরী বাড়িতে। নন্দিনীদেবী বিদ্রূপ করে বললেন, তুমি এবার এখানে কি জন্য রয়ে গেলে, শাশুড়ির যত্নআত্তি করবে বলে বুঝি! ঢং দেখে বাঁচি না। মাধবীলতা নিশ্চুপ।

নন্দিনীদেবী বিন্দুপিসিকে কড়া নির্দেশ দিলেন, এই মেয়ে দুপুর হলেই কোথায় বেরোয় আমার খবর চাই। কেন এই মেয়ে আমার ছেলের সাথে কলকাতা গেল না, তার পিছনে বড়সড় কারণ আছে। খুঁজে বের কর বিন্দু। তারপর আমি একে তাড়াবো শঙ্করকে দিয়েই। নষ্ট মেয়েমানুষের লোভের শেষ নেই। শঙ্করের মত সুপুরুষ পেয়েও মন ভরে নি। আবার কার জন্য থেকে গেল মহেশডাঙায় খোঁজ নে। হাতে নাতে ধরবি। তারপর আমায় খবর দিবি। রায়চৌধুরী বাড়ি থেকে আমি কোনদিন পায়ে হেঁটে গ্রামে যাইনি, এবারে যাবো। ওই মেয়ের মুখোশ আমি খুলবই।

বিন্দু তক্কেতক্কে থাকে মাধবীলতার গতিবিধির ওপরে নজর রাখার জন্য। কিন্তু এমন গেছো মেয়ে, যে এ বাড়ি থেকে বেরিয়েই এ গলি, ও গলি দিয়ে ছুটে পালায়। বিন্দুর বয়েস তো কম হল না। আর দৌড়োতে পারে না। হাঁটুর ব্যথায় কাবু হয়ে যায়। এ বাড়ির গিন্নীর আবার কড়া নির্দেশ আছে পাঁচকান যেন না হয়। হাসিও পায় বিন্দুর, ঘরের কেচ্ছা জানবে, অথচ পাঁচকান হবে না। তাই কাউকে বলতেও পারে না। তবে কদিন ধরেই খেয়াল করলো, মাধবীলতা যখন বাড়িতে থাকে না তখন বিষ্ণুচরণেরও টিকি দেখতে পায় না বাড়িতে। যেহেতু দুপুরে সকলের জিরোনোর সময়, তাই কেউ কারোর খোঁজও রাখে না। কিন্তু পরশুদিন মাঠাকরুন বিষ্ণুচরণকে ডেকে দিতে বলেছিল, বিন্দু ওর ঘর থেকে নায়েবখানা, সব খুঁজেও তাকে পায়নি।

প্রায় দিন দশেক হয়ে গেল এখনো বিন্দু খবর আনতে পারলো না মেয়েটা কোথায় যায়।

নন্দিনীদেবী বিরক্ত হয়েই বললেন, বুঝলি বিন্দু তোকে বসিয়ে বসিয়ে এ বাড়িতে খাওয়ানো দেখি বুড়ো হাতি পোষার সমান। একটা সামান্য খবর জোগাড় করতে পারলি না। ওই মেয়ে বুকের ওপরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাও খবর পেলি না। আবার তো শঙ্কর আসার সময় হয়ে গেল, বোধহয় কালকেই আসবে। পুজোর তো দেরি নেই। এখনো তো ঠাকুর গড়া হলো না। চণ্ডীমণ্ডপ সাজানো হলো না। পুজো বোধহয় এবারে করবে না গৌরীশঙ্কর। আর যে কেন বেঁচে আছি, কে জানে!

বিন্দু একটু বেশি ভাত খায় বলে এত বড় কথাটা বললেন মাঠাকরুন। মনে কষ্ট হলো বিন্দুর, সাথে রাগও হলো মাধবীলতার ওপরে। ওই মেয়ে যেদিন থেকে এ বাড়িতে ঢুকেছে, বিন্দুর দ্বিপ্রহরিক ঘুমের বারোটা বেজে গেছে। রোজই ওর পিছন পিছন ছুটে বাড়ি ফিরে এসেছে।

আজ নন্দিনীদেবীর অমন একটা কথার পরে আর বসে থাকবে না বিন্দু। বিহীত ওকে করতেই হবে।

আগে ভাগেই রায়চৌধুরী বাড়ির গেটের পাশে দাঁড়িয়েছিল ও।

মাধবীলতা আসছে দেখেই লুকিয়ে পড়লো। তবুও কি করে যেন মাধবীলতা ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো, বিন্দুপিসি, মাকে গিয়ে বলো, আমি রায়চৌধুরী বাড়ির বউ, এমন কাজ করবো না যাতে এ বাড়ির নিন্দে হয়। যাও, বাড়ির ভিতরে যাও। মায়ের কাছে কাছে থাকো, শরীরটা ভালো নেই মায়ের, খেয়াল রেখো।

বিন্দু কেমন ঘাবড়ে গিয়েছিল মাধবীলতার চাঁচাছোলা কথা শুনে। মেয়েটাকে সেই ছোট্ট থেকে দেখছে, বড্ড স্পষ্ট কথা বলে। ইদানিংকালে এ বাড়িতে ঢুকে একটু যেন মিইয়ে গিয়েছিল, আবার যেন পুরোনো মাধবীকে দেখলো বিন্দু।

সময় নষ্ট না করে গটগট করে ভিতরের বাড়িতে ঢুকে গেলো বিন্দু।

।। ১৭।।

গৌরীশঙ্কর বাড়িতে ঢুকতেই নন্দিনীদেবীর ঘরে ডাক পড়লো। ব্যাগটা রেখে চিন্তাগ্রস্ত মুখে মায়ের ঘরে ঢুকলো ও। ভেবেছিল প্রায় দশদিন পরে বাড়ি ঢুকে প্রথম মাধবীকেই দেখবে। কিন্তু এদিক ওদিক তাকিয়েও তার নাগাল পেলো না। গৌরী জানে, মা দুর্গাপুজোর বিষয়েই আলোচনা করবে। হাতে তো মাত্র আট দিন বাকি। আগামীকাল মহালয়া। এই সময় রায়চৌধুরীদের দুর্গামণ্ডপে কুমোর ঠাকুর রেডি করে ফেলে। পুজোর বাজার রেডি হয়ে যায়। এবারে সেসব কিছুই হয়নি। এমনকি খুব বেশি টাকাও জোগাড় করতে পারেনি শঙ্কর। কি ভাবে যে মায়ের চোখের দিকে তাকাবে সেটাই ভাবছিলো ও।

পুরুষমানুষ যে কেন চিৎকার করে কাঁদতে পারে না কে জানে! গৌরীশঙ্করের ইচ্ছে হচ্ছিল মায়ের পায়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে বলে, মা ক্ষমা করো। আমি পুজোর জোগাড় করতে পারিনি।

—মায়ের ঘরের দিকে ধীর অবশ পায়ে এগোচ্ছিল ও।

—হঠাৎই বাইরে বেশ চ্যাঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেল। বেশ কয়েকজন একসাথে কথা বলছে। তার মধ্যে দুটো গলা ওর বেশ পরিচিত বলেই থমকে দাঁড়ালো। এল প্যাটার্নের লম্বা বারান্দার গ্রিল দিয়ে দেখতে পেলো, মাধবীলতা কোমরে শাড়ি গুঁজে বেশ জোর গলায় বলছে, এই এদিক দিয়ে নয়, বিষ্ণুকাকা ওদের বলো, যেন মায়ের হাতে না ধাক্কা লাগে পাঁচিলে। সাবধানে, আস্তে আস্তে আনো। চণ্ডীমণ্ডপে তুলবে সোজা। বিষ্ণুকাকা তুমি মণ্ডপ পরিষ্কার করিয়ে রেখেছো তো? বিষ্ণুচরণ ঘাড় নেড়ে বললো, হ্যাঁ বৌরানী, আপনার কথা মত ছেলেকে বলে রেখেছিলাম।

গৌরীশঙ্কর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখছে নতুন মাধবীকে। রায়চৌধুরী বাড়িতে প্রথম প্রবেশের দিনের সংকোচ, লজ্জা মাখানো চোখ দুটোতে আজ আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। বেশ নির্দেশের ঢঙেই বললো, একে একে নিয়ে এসো।

ঢাকটা বাজও। জানো না, এবাড়িতে যখন মা প্রবেশ করেন, তখন ঢাক বাজে!

স্থির চোখে তাকিয়ে আছে গৌরীশঙ্কর। খেয়ালও করেনি কখন ওর পাশে মা, বিন্দুপিসি, কাকিমারা এসে দাঁড়িয়েছে। মায়ের কথায় সম্বিৎ ফিরল ওর। ঠাকুর কি কলকাতা থেকে কিনে আনলে?

গৌরীশঙ্কর ঘাড় নেড়ে বললো, আমি কিছু জানি না না মা। আমিও এখন দেখছি ঠাকুর ঢোকাচ্ছে মাধবীলতা।

বিষ্ণুচরণ পায়ে পায়ে এদিকে এগিয়ে আসতেই নন্দিনীদেবী বললেন, বিষ্ণু…প্রতিমা কে গড়লো?

বিষ্ণুচরণ একটু ইতস্তত করে বললো, বৌরানী নিজের হাতে গড়লো কর্তামা। আমি তার নির্দেশ মত সব উপকরণ যোগান দিয়েছি, সে নিজের হাতে গড়েছে একটু একটু করে। ওই যে রায়চৌধুরীদের ঠাকুর গড়ার জন্য দক্ষিণ পাড়ার শেষে যে চালাটা তৈরি করেছিল বড়কর্তা, এখন তো ঝোপ ঝাড় হয়ে গেছে। সেটাই পরিষ্কার করে ওখানেই প্রতিমা গড়লেন বৌরানী। আসুন কর্তামা, দেখে যান। চোখ জুড়ানো রূপ মায়ের।

বহুদিন পরে নন্দিনীদেবী আবার চণ্ডীমণ্ডপের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। স্বামী মারা যাবার পরের বছরের পুজোয় উনি ভুলেও আসেন নি পুজোমণ্ডপে।

মায়ের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছেন নন্দিনীদেবী।

এ কি করেছে মাধবীলতা! এ যে নন্দিনীদেবীর অল্প বয়েসের মুখ। সিঁথিতে একঢালা সিঁদুর, পরনে লাল বেনারসী। মৃন্ময়ী মূর্তির মধ্যে নিজের কম বয়েসের ছবি দেখছেন যেন!

দুচোখে জল, অবাধ্য হয়ে উঠেছে নোনতা জলবাহী শিরাগুলো।

এককালে সবাই বলতো, নন্দিনীকে নাকি মা দুর্গার মত দেখতে। বড় বড় দুটো চোখ, এক ঢাল চুল, বেদানার মত গায়ের রং। এ বাড়িতে অবশ্য রূপের প্রশংসা কোনো কালেই পায়নি সে। নেহাত বড় বাড়ি থেকে এসেছিল বলে, একেবারে দূর ছাই করেনি কেউ। কিন্তু ওর অমন রূপের প্রশংসা বাপের বাড়িতে যত শুনেছে, শ্বশুরঘরে কোনোদিনই শোনে নি। বরং শাশুড়ি ছিলেন জমিদার বাড়ির মেয়ে, তার অহংকারেই আলোকিত ছিল রায়চৌধুরী পরিবারের অন্দর।

নন্দিনীদেবী সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললেন, একি করেছ মাধবীলতা! মায়ের মুখের সাথে মানুষের মুখের মিল কি করে হয়! পাপ লাগবে যে!

মাধবীলতার হাতে, তখনও কাঁচা রঙের দাগ। মুখটা নিচু করে বললো, জানো মা, আমার তখন বছর চারেক বয়েস। বাবার হাত ধরে এ বাড়িতে এসেছিলাম পুজো দেখতে। আমার মায়ের এক মাস ধরে খুব শরীর খারাপ ছিল। তাই পুজো আমার জামাও কেনা হয়নি সে বছর। আগের বছরের জামা পরেই ষষ্ঠীর দিন রায়চৌধুরী বাড়ির ঠাকুর দেখতে এসেছিলাম। বাবা চোখ আঁকবে, তাও বায়না করে পিছন পিছন এসে হাজির হয়েছিলাম আমি। হঠাৎ এ বাড়ির একজন মানুষ এসে বললো, রমেশদা, এই বুঝি আপনার মেয়ে?

বাবা ঘাড় নেড়ে বললো, হ্যাঁ।

আমি অবাক হয়ে একবার চণ্ডীমণ্ডপে আরেকবার সেই মানুষটির দিকে তাকাচ্ছিলাম। প্রতিমার মতই তারও পরণে লাল বেনারসী, নাকে বড় নথ, বড় বড় দুটো চোখে হালকা কাজল, পিঠ ময় ছড়িয়ে আছে একঢাল চুল।

বাবা বললো, ইনি হলেন মাঠাকরুন, এ বাড়ির গিন্নীমা।

আমি প্রণাম করতে যেতেই সে চোখ বড় বড় করে বললো, নতুন জামা নেই কেন গায়ে!

আমি বললাম, কিনে দেয়নি মা।

সে হাঁকল, বিষ্ণুচরণ….এই নাও টাকা, যাও পঞ্চাননের দোকান থেকে লাল রঙের একটা জামা এনে দাও, এর সাইজের। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি সেই নতুন জামা গায়ে মণ্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে এসে বললো, এই তো লক্ষ্মী মেয়ে। তুমিও এ বাড়ির সদস্য, এবাড়িতেই ভোগ খেয়ে যাবে রোজ। তুমি আমাদের পুরোহিতমশাইয়ের মেয়ে বলে কথা।

জানো মা, আমার সেদিনই ওই প্রতিমার মুখটা মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গিয়েছিল। ছোট থেকে কাঞ্চনদীঘির এঁটেল মাটি তুলে অনেক মূর্তি, পুতুল গড়েছি কিন্তু কখনো ওই প্রতিমার মুখটা গড়ি নি। কারণ ভেবেছিলাম, যেদিন ওই প্রতিমার মুখটা গড়বো, সেদিন যেন তার পুজো করতে পারি। অবহেলায় না পড়ে থাকে আমার খেলনাবাড়ির পুতুলের মধ্যে।

এবারে তোমার ছেলে বললো, তার কাছে নাকি টাকা নেই ঠাকুর বায়না দেবার। তাই আমি নিজের হাতেই গড়তে শুরু করলাম মায়ের মুখ। সেই ছোটবেলায় দেখা প্রতিমার মুখ। যে বাচ্চামেয়ের চোখ দেখেই বুঝেছিলো, তার নতুন জামা নেই বলে পুজোমণ্ডপে উঠতে সঙ্কোচ বোধ করছে। যে নিজের আঁচলের খুঁটে বাঁধা টাকা দিয়ে আমায় নতুন জামা কিনে দিয়েছিল, সে হোক না চিন্ময়ী মূর্তি, আমার কাছে মণ্ডপের মৃন্ময়ী মূর্তির থেকেও তাকে বেশি জাগ্রত মনে হয়েছিল। গৌরীশঙ্কর হাঁ করে শুনছে তার তিনবছরের বিবাহিত স্ত্রীর কথা, তার আজীবনের সাথীর কথা।

নন্দিনীদেবী ভাঙা গলায় বললেন, তুই মনে রেখেছিস এখনো? আমি যে ভুলেই গিয়েছিলাম।

মাধবীলতা বললো, তুমি তো দাত্রী ছিলে মা, সকলের হাতে পুজোর সময় কিছু না কিছু তুলে দিয়ে তুমি আনন্দ পেতে। দেখো তো মা, প্রতিমার গায়ের বেনারসীর মত তোমারও এমন একটা বেনারসী ছিল কিনা!

নন্দিনীদেবীর চোখে জল গৌরীশঙ্করও তেমন একটা দেখেনি। ঘাড় নেড়ে মা বললো, সাবধানে প্রতিমা মণ্ডপে তোলো। মানুষের মুখের সাথে যেটুকু মিল হয়েছে তার পাপ যেন আমার গায়ে লাগে, শিল্পীর কোনো পাপ নেই মা, ওকে তুমি রক্ষা করো।

মাধবীলতা বললো, মা, আরেকটা আব্দার আছে তোমার কাছে। পুজোয় তোমার কাছে আমার আব্দার।

নন্দিনীদেবী বললেন, রায়চৌধুরীরা সব হারিয়ে আজ নিঃস্ব। কি চাস বল, যদি ক্ষমতায় কুলোয় নিশ্চয়ই দেব।

শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় মাধবীলতা বললো, মা, এবারে দুর্গাপুজো আমি করতে চাই। পুরোহিত লাগবে না। বাবার পাশে বসে থেকে সব মন্ত্র আমার মুখস্ত, আমি পারবো মা।

নন্দিনীদেবী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বললেন, কিন্তু মেয়ে হয়ে দুর্গাপুজো করবি? অনাচার হবে যে!

মাধবীলতা বললো, তোমার ছেলের কাছে যে পুরোহিত বিদায়ের টাকা নেই মা। সে যে অনেক কষ্টে পুজোর সরঞ্জামের ব্যবস্থাটুকু করতে পারবে। রায়চৌধুরী বাড়ির সম্মান, এত দিনের পুজো বন্ধ হয়ে যাবে তবে?

জমির আয় থেকে চারদিনের ভোগের খরচ উঠবে, আমি হিসেব করেছি। বাকি থাকলো ঢাকির খরচ, ওটাও না হয় জুটবে।

নন্দিনীদেবী একটু ভেবে বললেন, যদি নিন্দে হয়। মহিলা তো কখনো পুজো করে নি রে।

মাধবীলতা স্থির কণ্ঠে বললো, মাও যে মেয়ে, তার পুজো একজন মেয়ে করলে দোষ কেন হবে?

গৌরীশঙ্করের দিকে দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে নন্দিনীদেবী বললেন, সাত রাত তোমরা আলাদা ঘরে থাকবে। বৌমা যদি পুজো করে, তবে দেবীপক্ষ থেকেই পৃথক থাকা উচিত।

নন্দিনীদেবী নিজের ঘরের দিকে এগোলেন।

মুগ্ধ হয়ে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছে শঙ্কর। এই জন্যই তো মাধবীলতা সবার থেকে আলাদা। সেই ছয় বছরের কুমারী পুজোর দিন থেকেই বুঝেছিলো শঙ্কর, এ মেয়ে আর পাঁচটা মেয়ের মত সাধারণ নয়।

।। ১৮।।

লাল পাড় গরদের শাড়ি পরে প্রতিমার মুখ আঁকতে যাচ্ছে মাধবীলতা। গৌরীশঙ্কর সামনে দাঁড়িয়ে বললো, আমার পাঞ্জাবির বোতাম পাচ্ছি না।

মাধবীলতা মুচকি হেসে বললো, বেশ আমি বিন্দুপিসিকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

গৌরীশঙ্কর ফিসফিস করে বললো, সাতদিন তো হয়ে গেছে, আজ তো ষষ্ঠী, আজ কেন দূরে দূরে আছো?

মাধবীলতা বললো, একাদশীর দিন কাছে আসবো বলে।

এ কেমন অত্যাচার আমার ওপরে মাধবী? তুমি আমার চোখের সামনে ঘুরছো, বেড়াচ্ছ, অথচ আমিই তোমায় ছুঁতে পাচ্ছি না।

মাধবীলতা গাঢ় গলায় বলল, কারণ তুমি আমার সব থেকে কাছের মানুষ, আমার বুকের মধ্যেই আছো সবসময়, তাই আলাদা করে ছুঁয়ে দেখার প্রয়োজন নেই।

গৌরীশঙ্কর মুখ ভেঙচে বললো, যত সব ভুলভাল যুক্তি! আমার বিয়ে করা বউকে নাকি আমি আদর করতে পারবো না?

মাধবীলতা গম্ভীর স্বরে বললো, পুরোহিতকে জিভ ভেঙালে কি হয় জানো? জিভ খসে যায়!

আর পুরোহিতকে জড়িয়ে ধরলে কি হয় গো? পুরোহিতের ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালে কি হয়…

ওর কথা শেষ হবার আগেই মাধবীলতা ছুটে পালালো ঘর থেকে।

।। ১৯।।

গোটা মহেশডাঙার লোক জড়ো হয়েছে রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো দেখতে। ফিসফিস কানেও আসছে নন্দিনীদেবীর। অনেকেই বলছে, এসব অনাচার। মহিলা হয়ে দুর্গাপুজো করবে! দুজন উঠতি ব্রাহ্মণও উপস্থিত হয়েছে, মাধবীলতার ভুল ধরার উদ্দেশ্যে। এমনকি রমেশ ঘোষালও এসেছেন মেয়ের এ হেন অনাসৃষ্টি দেখতে।

লালপাড় গরদের শাড়ি পরে, নাকে বড় নথ, কপালে লাল সিঁদুরের টিপ পরে ধীর পায়ে মণ্ডপে উঠলো রায়চৌধুরী বাড়ির ছোট বৌরানী।

সম্ভ্রমে মহেশডাঙ্গার মানুষ চুপ।

পরিষ্কার সংস্কৃত উচ্চারণে শুরু হলো মায়ের পুজো।

”যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা, যা দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ……….”

রমেশ ঘোষাল আচমকা মেয়ের সাথে গলা মিলিয়ে বলে উঠলেন—

যা দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ, যা দেবী সর্বভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ, যা দেবী সর্বভূতেষু ক্ষুধারূপেণ সংস্থিতা!

গোটা মহেশডাঙার মানুষ নিশ্চুপ হয়ে দেখেছিলো মাধবীলতার নিষ্ঠার সাথে মন্ত্র উচ্চারণ।

রমেশ ঘোষালের দুচোখে জল। কাঁপা গলায় বললেন, আমার রক্তে দোষ ছিল না গো। আমি মেয়ে মানুষ করতে ভুল করিনি।

নন্দিনীদেবী বললেন, রমেশদা, গৌরীশঙ্কর আর মাধবীলতার গাঁটছড়া স্বয়ং মা দুর্গা বেঁধেছিলেন, ওটা খোলার সাধ্য আমাদের নেই।

ঢাকের আওয়াজ, মাধবীলতার নির্ভুল মন্ত্রে আর ধূপের গন্ধে রায়চৌধুরী বাড়ির প্রতিমার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে, মা যেন প্রাণ পেয়েছেন। মৃন্ময়ী মূর্তি যেন চিন্ময়ী রূপে ধরা দিয়েছেন। গৌরীশঙ্কর কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছে এই মণ্ডপেই মাথায় সিঁথিময়ূর পরে, হাতে পদ্ম নিয়ে বসে আছে ছয় বছরের মাধবীলতা। আজ পূজারিণী মাধবীলতার দিক থেকেও চোখ সরাতে পারছে না ও।

একমনে মাধবীলতা উচ্চারণ করে চলেছে……

 নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ যা দেবী সর্বভূতেষু বৃত্তিরূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।

সমাপ্ত