৫.
বিশাল প্রবেশদ্বার দাঁড়িয়ে আছে বহু যুগের ঐতিহ্য আগলে। পাথরের ফলকে লেখা আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম:
তক্ষশিলা। এর আক্ষরিক অর্থ ‘পাথরের ওপর নির্মিত’। তক্ষশিলা শহরের গোড়াপত্তন কয়েক হাজার বছর আগে করা হয়েছিল। বলা হয়, স্বয়ং সম্রাট ভরতের পুত্র, ‘তক্ষ’র নামে এই শহরের নামকরণ হয়েছিল। বিদ্যালয়ের স্থাপনাও বহু যুগ আগে। স্বয়ং অর্জুনের পৌত্র পরীক্ষিৎ এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।
প্রতি বছর কয়েক হাজার ছাত্র এখানে আসে উচ্চশিক্ষা নিতে। বিনা বেতনের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোটাই চলে বিভিন্ন রাজপরিবারের দানের অর্থে। শিক্ষা সকলের অধিকার, সেই মন্ত্রেই এখানকার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিনামূল্য রাখা হয়েছে একদম আদিকাল হতেই। আট বছর সময় থাকে এক একটা বিষয়ে পাণ্ডিত্য লাভ করতে। তবে ছাত্রর মেধা অনুযায়ী তার এর চেয়ে বেশি বা কম সময়ও লাগতে পারে। এখানকার অধ্যয়ন শেষে কোনো পরীক্ষা নেয়া হয় না বা উপাধি ভূষিত করা হয় না। কারণ ‘জ্ঞান’-ই হল জগতের সবথেকে বড়ো উপহার। এর চেয়ে বড়ো উপাধি আর কিছুই দেয়া সম্ভব নয়। শিক্ষা শেষে গুরুকে গুরুদক্ষিণা দেয়ার রীতি আছে। তবে তা কখনোই অর্থ নয়। আচার্যরা তাঁদের ছাত্রদের বলেন,
—এখান থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান যদি তুমি আরও ছড়িয়ে দিতে পারো মানুষের মাঝে, সেটাই আমার সবচেয়ে বড়ো গুরুদক্ষিণা। তোমার মাধ্যমেই আমার অমরত্ব লাভ হবে।
.
দিনের দ্বিতীয় প্রহরে, বহু বছর পর নিজের আদি কর্মস্থলে পা রাখলেন আচার্য চাণক্য। এই সেই জায়গা, যেখান থেকে অখণ্ড আর্যাবর্তর স্বপ্নের সূত্রপাত হয়েছিল। এই সেই জায়গা যেখানে প্রথম তিনি, বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য, অত্যাচারী রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লবের বীজ বপন করেছিলেন। আজ, এত বছর বাদে, তক্ষশিলার ‘বিদ্রোহী আচার্য’ ফিরে এসেছেন।
পরিচয়পত্র দেখিয়ে, ঘোড়া এবং সৈনিকদের ব্যবস্থা করে চাণক্য ও জীবসিদ্ধি চললেন প্রধানাচার্যর বাড়ির দিকে। তাঁর সঙ্গে আগে দেখা করাটা জরুরি। চলার পথে বেশ কিছু ছাত্রর দেখা পেলেন দু-জনে। একটা ভীতি যেন প্রত্যেকের চোখে-মুখে স্পষ্ট। চাণক্য জীবসিদ্ধিকে বললেন,
—একটা জিনিস লক্ষ করলে? এই দিনের বেলাতেও কোনো ছাত্ৰ একা বের হয়নি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। সম্ভবত আচার্য প্রমুখর নির্দেশ। আরও গুরুতর বিষয় হল, তারা সেটা মেনে চলছে।
আচার্যপ্রমুখর ঘরের দরজায় পৌঁছে চাণক্য ডাকলেন,
—প্ৰধানাচার্য!
—এসো। ভেতরে এসো।
ভেতর থেকে সাড়া পেয়ে ঢুকলেন চাণক্য ও জীবসিদ্ধি। একটা চারপায়ার সামনে মেঝেতে বসে আছেন বৃদ্ধ। পরনে বরাবরের মতোই লাল কাপড়ের সন্ন্যাসীর বেশ। সামনে একটা বই খোলা আর একটা ভূর্জপত্রতে কিছু লিখছিলেন বৃদ্ধ। চন্দন ও কপূরে সুবাসিত ঘর। সম্ভবত একটু আগেই দৈনিক পূজা প্রার্থনা সেরেছেন। তাঁদের দেখে মুখে হাসি ফুটেছে বৃদ্ধর। কিন্তু তাঁকে দেখে চমকে উঠলেন দু-জনে। এ কী চেহারা হয়েছে মানুষটার? বয়স এমনিতেই কিছুটা বেড়েছে বটে, কিন্তু তাই বলে স্বাস্থ্য এতটা ভেঙে পড়ার কথাও নয়। গত কয়েক মাসে বোধ হয় কয়েক সের ওজন কমেছে বৃদ্ধর। চোখের নীচে কালি, দুশ্চিন্তা আর অনিদ্রার প্রমাণ দিচ্ছে। তবে তাঁর চোখের তারায় এখনও জ্ঞানের দ্যুতি ঝিলিক দেয়।
—তোমরা এসেছ? আমি জানতাম! আমি জানতাম তুমি আসবেই, বিষ্ণুগুপ্ত!
উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি। দু-জনেই সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন বৃদ্ধকে। আচার্য প্রমুখ তাঁদের তুলে একে একে আলিঙ্গন করলেন। আশীর্বাদ করে বললেন,
—সদৈব জয়তি ভবঃ।
প্রধানাচার্যর মুখোমুখি বসলেন দু-জনে।
—কিন্তু এ আপনার কী অবস্থা, আচার্য প্রমুখ? আপনার কি শরীরে কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে?
না, জীবসিদ্ধি। সমস্যা মানসিক। শুধু আমি না, এই গুরুকুলের প্রতিটা শিক্ষক এবং ছাত্রর একই অবস্থা। তবে সেকথায় পরে আসছি। তোমরা দু-জন খাওয়া-দাওয়া করেছ? তোমাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই সৈনিক দল আর ঘোড়া আছে? তাদের খাবার আর বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছে কি?
এইবার উত্তর দিলেন চাণক্য,
—কৃপা করে আপনি ব্যস্ত হবেন না, আচার্য। সৈনিকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘোড়া আস্তাবলে পাঠিয়েছি। আমরা কেউই এখন ক্ষুধার্ত নই।
—আচ্ছা, বেশ। কেমন চলছে তোমাদের কাজ? চন্দ্রগুপ্ত, শশাঙ্ক আর বাকি ছাত্ররা কেমন আছে?
—প্রত্যেকে কুশল আছে, আচার্য। প্রত্যেকে যে-যার নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে লিপ্ত।
—আর তুমি?
—আমি পাটলিপুত্রতেই একটা তুলনামূলক নিরুপদ্রব জায়গায় নিজস্ব কুটিরে বসবাস করি। সেখানে আমি ‘অর্থশাস্ত্র’ লেখায় মনোনিবেশ করেছি। রাজ-বৈভব আমার জন্যে নয়। তবে মাঝে মাঝে বিশেষ প্রয়োজন পড়লে সম্রাটের সঙ্গে পরামর্শ করতে যাই। এই জীবসিদ্ধি আমার ভালো-মন্দর ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।
—উত্তম। তোমাদের দেখে আমি যে মনে কতটা বল পেয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না। এই বৃদ্ধর কথা রাখার জন্যে তোমাদের অনেক ধন্যবাদ।
—কিন্তু আচার্য প্রমুখ, কী এমন সমস্যা যা নিয়ে আপনি এত চিন্তিত? সারা গুরুকুল চিন্তিত?
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন প্রধানাচার্য। মনে হল তিনি কীভাবে কথাটা বলবেন তা মনস্থির করতে পারছেন না। চাণক্য তাঁকে সময় দিলেন। বৃদ্ধ বললেন,
—এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিশাপ লেগেছে। অপদেবতা জেগে উঠেছে। আবারও অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাঁর দিকে চাইল জীবসিদ্ধি। এই মানুষের মুখ থেকে এই কথা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। চাণক্যর দিকে তাকিয়ে দেখল, তাঁর মুখে কোনো ভাব ফুটে ওঠেনি। ভাবলেশহীন মুখেই তিনি প্রধানাচার্যর কথা শুনছেন।
—কয়েক মাস আগে কয়েকজন ছাত্র ভুলবশত এমন এক তন্ত্রক্রিয়া করে ফেলে যার ফলে এই তক্ষশিলায় নেমে এসেছে অপদেবতারা। ছাত্র আর শিক্ষকরা মানসিক সুস্থতা হারাচ্ছে। গত ত্রিশ দিনে দু-জনের মৃত্যু হয়েছে। ভয়ংকর প্রেতশক্তিরা ধীরে ধীরে তাদের করাল মৃত্যু ছায়ায় গ্রাস করছে সকলকে।
চাণক্য এইবার প্রশ্ন করলেন,
—ক্ষমা করবেন, আচার্য। আমি আপনাকে অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগছে। আপনি নিশ্চিত হচ্ছেন কী করে যে এইসবের মূলে অপশক্তি বা প্রেতের হাত আছে?
আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন প্রধানাচার্য ভদ্রভট্ট। এই প্রশ্নর উত্তর দিতে গিয়ে যেন তিনি নিজের সঙ্গেই দ্বন্দ্ব করছেন। মুখ তুলে তিনি আচার্য
চাণক্যর চোখে চোখ রাখলেন। বললেন,
—কারণ আমি নিজে তাদের অশুভ উপস্থিতি টের পেয়েছি। আমি সজ্ঞানে, নিজের চোখে সেই প্রেতকে দেখেছি!
৬.
এইবার জীবসিদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চাণক্যও অবাক হলেন। যদিও মুখের অভিব্যক্তিতে তা প্রকাশ হতে দিলেন না। প্রধানাচার্য বলতে থাকলেন,
—হ্যাঁ, বিষ্ণুগুপ্ত। আমি নিজে দেখেছি। সেই নরক থেকে উঠে আসা প্রেতদের। নিজের চোখে না দেখলে, নিজে তাদের অস্তিত্ব অনুভব না করলে
আমিও কখনোই এই বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য মনে করতাম না। কিন্তু এটাই সত্য।
চাণক্য একটু চিন্তিতভাবে বললেন,
—আপনাকে অবিশ্বাস করার স্পর্ধা আমার নেই, আচার্য জ্যেষ্ঠম। প্রার্থনা করি, আপনি ঘটনা শুরু থেকে বলুন। কবে এবং কী কারণে আপদ শুরু হয়েছে, আমায় বলুন।
—ঘটনার সূত্রপাত তিন মাস আগে। বিদ্যালয়ের চার ছাত্র গ্রন্থাগার থেকে একটা পুথির অংশ খুঁজে পায়। এই পুথিতে নরকের দরজা খুলে প্রেতদের এই জগতে এনে তাদের বশে আনার উপায় লেখা আছে বলে দাবি করা হয়েছে। তারা নিজেরাও ‘ইন্দ্রজাল বিদ্যা’র ছাত্র হওয়ায় তারা সেই লেখার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং সেই ক্রিয়া করবে বলে ঠিক করে। সবার নজর এড়িয়ে এক রাতে তারা প্রাঙ্গণের উত্তর পশ্চিম দিকের একটা জায়গায় তন্ত্রক্রিয়া শুরু করে। কী ঘটেছিল জানা নেই, তবে রাত তৃতীয় প্রহরের শেষের দিকে তাদের মধ্যে একজনের আর্তনাদ শুনতে পায় নিকটবর্তী নিবাসের ছাত্ররা এবং প্রহরীরা। রাতটা ছিল দুর্যোগের। তারা সেখানে গিয়ে দেখতে পায় চার ছাত্র অচেতন হয়ে ভূপতিত হয়ে আছে। হবন কুণ্ডর আগুন আর প্রদীপ আগেই ঝড়-বর্ষার দাপটে নিভে গেছে। কিন্তু এখানে যে কোনো তন্ত্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ দৃশ্যমান।
সেই ছাত্রদের রাতেই আয়ুরালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সবাই ভেবেছিল যে জ্ঞান ফিরলে সব জানা যাবে যে তারা কী করছিল আর কেন তারা জ্ঞান হারাল। খুব একটা চিন্তিত কেউই ছিল না। কিন্তু সমস্যা শুরু হল এরপর।
পরের দিন তাদের সংজ্ঞা ফিরে আসে, কিন্তু তাদের মনে রাতে যে ভয়টা বসে ছিল সেটা কাটে না। তাদের মধ্যে একজন অন্যদের তুলনায় কিছুটা স্বাভাবিক ছিল। সে বিশালগরের রাজকুমার সুভাষ। তার থেকেই পুরো ঘটনাটা জানতে পারা যায়। সেইদিন রাতে তাদের ঘিরে ধরেছিল প্রেতমূর্তিরা। তারা বুঝতে পারে যে তাদের তন্ত্র এই অপশক্তিদের বেঁধে ফেলতে সক্ষম হয়নি। এরপরেই আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে তারা।
ব্যাপারটাকে প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি কেউ। কিন্তু বাকি তিন জনের অবস্থা দেখে বৈদ্যরা চিন্তায় পড়ে। তারা অস্বাভাবিক আচরণ করছিল এবং প্রতি মুহূর্তে কিছু দেখে ভয় পাচ্ছিল। তারা গুছিয়ে কথাই বলতে পারেনি।
ঘটনাটা বিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। এরপরেই অন্যান্য ছাত্র, শিক্ষক এবং কর্মচারীও অদ্ভুত ভয়ংকর সব মূর্তি দেখতে পেতে শুরু করে। অনেকেই অভিযোগ করতে থাকে যে তারা নিজেদের বাড়িতে থাকতেও ভয় পাচ্ছে। সেই ভয় যে শুধু রাতের বেলায় পাচ্ছে তাই নয়, দিনের বেলাতেও তাদের মনে ভয় চেপে থাকছে। যতই দিন যেতে থাকে, এই সমস্যা বাড়তে থাকে। শিক্ষক এবং কর্মীরাও বলতে থাকে যে তারা অশুভ উপস্থিতি টের পাচ্ছে। রাতে মানুষজন ভয়ে চেঁচিয়ে উঠছে। তারা ভয়ংকর সব দৃশ্য দেখছে খোলা চোখে।
তুমি তো আচার্য ভীমরজকে চিনতে। ওঁর বয়স হয়েছিল, তার ওপর হৃদয়ের সমস্যায় বেশ কয়েক বছর ধরে ভুগছিলেন। এক রাতে ঘুমের মধ্যেই তিনি কিছু শব্দ পেয়ে ওঠেন। যদিও ওঁর স্ত্রী কিছু শুনতে পাননি। কিন্তু আচার্য খোলা জানলার দিকে চেয়ে কাঁপতে থাকেন। জানলার বাইরে তাকিয়ে তিনি এতটাই আতঙ্কিত হন যে সেখানেই তাঁর হৃদয় জবাব দেয়। ওঁর স্ত্রী জানলার বাইরে কিছুই দেখতে পেলেন না। মৃত্যুর আগে তিনি শুধু বলতে পেরেছিলেন ‘শাপ!’। এই হল প্রথম মৃত্যু। কিন্তু এই ঘটনার পরেই অভিশাপের কথাটা ছড়িয়ে পড়ে। নিবাসী ছাত্র, কর্মী, এমনকী আচার্যদেরও মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় যে সেইদিন ওই অজানা পুথির তন্ত্র ক্রিয়া দ্বারা অভিশাপ লেগেছে তক্ষশিলার।
আচার্যপ্রমুখ বিরতি নিতে থামলেন। অনেকক্ষণ একটানা কথা বলায় তাঁর কষ্ট হচ্ছে মনে হল। চাণক্য ওঁকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বললেন,
—আজকের মতো থাক তবে, আচার্য প্রমুখ। আবার পরে এসে শুনব।
—না, না। তোমাকে বলে আমার মনের বোঝা হালকা হবে, বিষ্ণুগুপ্ত।
—হুম। তবে আপনি সময় নিয়ে বলুন, আচার্য। আমাদের তাড়া নেই। আপনি একটু জিরিয়ে নিয়ে কথা বলুন। একটু জল পান করুন। ওহে জীবসিদ্ধি…।
জীবসিদ্ধি উঠে ততক্ষণে এক পাত্র জল কুঁজো থেকে ভরে এগিয়ে দিয়েছে বৃদ্ধর দিকে। তিনি কয়েক ঢোঁকে জলটা শেষ করে আবার শুরু করলেন,
—যা বলছিলাম। এইভাবেই আতঙ্ক গ্রাস করতে থাকে পুরো বিদ্যালয়কে। সত্যি বলতে, আমিও বেশ কয়েকদিন ধরেই নিজের আশেপাশে একধরনের অদ্ভুত বিষণ্নতা অনুভব করছিলাম। আমার মনে হয়েছে যেন এই পরিবেশ ভারী হয়ে আসছে। শ্বাসরুদ্ধকর মনে হত নিজেরই চেনা পরিচিত এই জায়গাকে। কিন্তু আমার যুক্তিবাদী মন বার বার বলে দিত যে এই সবই মনের দুর্বলতা। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমার মতিভ্রম হচ্ছে। অবসর নেয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু … কিন্তু …
—কিন্তু? বলুন, আচার্যজ্যেষ্ঠ।
কিছু একটা মনে পড়তে বৃদ্ধর চোখে যেন ভয় ঝিলিক দিয়ে গেল। বললেন,
—আমার সঙ্গে এমন একটা ঘটনা ঘটে যা আমার যুক্তিবাদী আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেয়। সেই রাতের কথা ভাবলে আমার এখনও বুক শুকিয়ে আসে, বিষ্ণুগুপ্ত।
জীবসিদ্ধি লক্ষ করল যে বৃদ্ধর কপালে ঘাম দেখা যাচ্ছে। তিনি সত্যি ভয় পাচ্ছেন।
—এক রাতের কথা। ঘুমের অসুবিধে বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছিলই। সেই রাতেও প্রথমে ঘুম আসছিল না। কিছুক্ষণ চোখ লাগে, তারপর হঠাৎ অকারণেই ঘুম ভেঙে গেল। জাগতেই বুঝতে পারলাম যে পরিবেশে কিছু পরিবর্তন এসেছে। আমার আশেপাশে কেউ বা কারা যেন আছে। তাদের দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তারা আছে। কায়াহীনের উপস্থিতি টের পেলাম। উঠে বসলাম। হৃদয়ের টিপটিপ শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হল আমার ঘরের কোনায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের কোনা অন্ধকার থাকায় দেখতে পেলাম না। পাশেই একটি ছোটো প্ৰদীপ নিভু নিভু হয়ে জ্বলছিল। সেটাতে তেল দিয়ে উসকে দিলাম। আলো এগিয়ে ধরলাম ঘরের কোণে।
ঢোঁক গিললেন বৃদ্ধ। তাঁর হাত কাঁপছে। চোখের মণিতে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। কিছুটা যেন বিষাদও।
—আমি দেখলাম তাদের! স্পষ্ট দেখলাম। আমার স্ত্রী এবং মেয়ে, যারা আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে গ্রামের বাড়িতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা গেছে। হ্যাঁ। কোনো ভুল নেই। তারাই দাঁড়িয়ে ছিল আমার ঘরে। আমার মেয়ের মৃত্যুর সময়ে একটা কাঠের পুতুল হাতে ছিল। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মেয়েটার হাতে সেই পুতুলটা পর্যন্ত আছে। তারা আমার দিকে চেয়ে আছে। কী… কী ভয়ানক তাদের সেই দৃষ্টি! আর তারপরেই… তারপরেই আমার হাতের প্রদীপ থেকে একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুটে গেল তাদের দিকে। আমি কিছু বোঝার আগেই, চোখের সামনে তাদের শরীর গ্রাস করল লেলিহান অগ্নিশিখা। যন্ত্রণায় কাতর আর্তনাদ করে চলেছে তারা। পুড়ে যাচ্ছে তাদের শরীর। পোড়া গন্ধ আমার নাকে আসছে… উফফ!!
আর বলতে পারলেন না। দু-হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেললেন। কাঁপছে তাঁর শরীর। প্রচণ্ড অসহায় আর ভগ্নপ্রায় লাগছে এই কঠিন মানুষটাকে। চাণক্য উঠে তাঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। ওঁর কাঁধে হাত রাখলেন।
—আচার্য প্রমুখ, দুর্বল হবেন না। আমি সত্যি দুঃখিত। আপনি এইবার বিশ্রাম নিন। আজকে আর বলতে হবে না।
মুখ থেকে হাত সরালেন বৃদ্ধ। নিজের দু-হাতে চেপে ধরলেন চাণক্যর হাত। কিছু বলতে পারলেন না। কিন্তু তাঁর দৃষ্টি থেকেই কাতর আবেদন স্পষ্ট।
চাণক্য তাঁকে বিশ্রাম নিতে বলে উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে জীবসিদ্ধিও দাঁড়াল। প্রধানাচার্যর এই একটাই ঘর, এখানেই তাঁর বাস এবং এটাই কার্যালয়। অতএব এই ঘরেই তিনি তাঁর মৃত পরিবারের প্রেত দেখেছেন। জীবসিদ্ধি চোখ বুলিয়ে খুঁজল কোথাও কোনো আগুনের ঝলসে যাওয়ার দাগ সত্যিই আছে কি না। চাণক্য ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন সে চেষ্টা বৃথা।
প্রধানাচার্যর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,
কী মনে হচ্ছে, আচার্য?
নিজের টিকিতে একবার হাত চালিয়ে উত্তর দিলেন,
—সমস্যা বড়োই জটিল হতে চলেছে।
৭.
অতিথিশালার দুটো পাশাপাশি ঘর বেছে নিয়েছেন চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি। সন্ধ্যার আঁধার নেমেছে তক্ষশিলায়। জীবসিদ্ধি সবে একটা চিঠি লেখা শেষ করেছে। সম্রাটকে নিজেদের পৌঁছোনোর খবর এবং এখানকার অবস্থার বিবরণ দিয়ে চিঠি। আগামীকালই এটা পাঠিয়ে দেবে। সান্ধ্যভ্রমণে বেরোবে কি না ভাবছে। আচার্যকে একবার বলে দেখলে হয়। তিনিও যাবেন আশা করি।
তখনই দরজায় মৃদু টোকা পড়ল। দরজা খুলতে একজন মানুষকে দেখা গেল। মুখটা ঢাকা। সচকিত হয়ে পিছিয়ে এল জীবসিদ্ধি। কোমরের কাছে লুকোনো কৃপাণটা ছুঁলো তার ডান হাত। হামলা? তার ওপর? তাও আবার তক্ষশিলায়?
কিন্তু পরক্ষণেই লোকটা হাতজোড় করে বলল,
—ক্ষমা করবেন, ব্রাহ্মণদেব। আমি শত্রু না। আমি এখানকার কর্মী। আপনাদের এই প্রদীপের তেল, ধুনি আর কর্পূর দিতে এসেছি।
—কিন্তু তোমার মুখ ঢাকা কেন?
—কয়েক বছর আগে একটা দুর্ঘটনায় আমার শরীরের অনেকটা অংশ ঝলসে যায়। আমার মুখও ঝলসে যায় তাতে। তাই…।
—ওহ। কোনো ব্যাপার না। তুমি মুখের কাপড় সরাতে পারো।
লোকটা মুখের কাপড় সরিয়ে ফেলতে তার আগুনে পুড়ে যাওয়া মুখ বেরিয়ে পড়ল। দাগ পুরোনো হলেও, চামড়া কুঁচকে তার মুখ ভয়ানক হয়ে আছে। একটা চোখও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত। এইবার তাকে দেখে জীবসিদ্ধির বড়োই দুঃখ হল। বয়স কতই-বা হবে এর? তারই সমান। অথচ তাকে বাকি জীবনটা মুখ লুকিয়ে চলতে হবে। কোমরের কাছে কৃপাণ ধরা হাতটা শিথিল হল জীবসিদ্ধির। লোকটা একটু দ্বিধা ভরে প্রশ্ন করল,
—আপনিই কি মহামান্য আচার্য চাণক্য?
মৃদু হেসে জীবসিদ্ধি উত্তর দিল,
—না। আমি আচার্য চাণক্যর শিষ্য। আমার নাম জীবসিদ্ধি।
লোকটার চোখে কৌতূহল দেখা গেল,
—ওহ। আপনিও নিশ্চয়ই এই মহাবিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন?
—হ্যাঁ। তা ছিলাম বটে। তবে সে অনেক আগের কথা।
লোকটা প্রদীপের তেল এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখতে শুরু করল। একটু লজ্জিত হয়ে লোকটি বলল:
—আমার বেশি কৌতূহল ক্ষমা করবেন, ব্রাহ্মণদেব। আসলে আমি বেশ কয়েকদিন থেকেই শুনছিলাম যে স্বয়ং মহামতি চাণক্য ফিরছেন এখানে। তাঁকে স্বচক্ষে দেখার বাসনা বহুদিনের।
—পাশের ঘরেই তিনি আছেন। পরিচয় করে নাও।
একটু ইতস্তত করে লোকটা বলল,
—আমায় একটু সাহায্য করতে পারবেন? দয়া করে আপনি যদি তাঁকে দরজা খুলতে বলেন তবে ভালো হয়। মানে আমার মুখ দেখে উনি হয়তো চমকে যাবেন।
—সে অসুবিধে নেই। এসো আমার সঙ্গে। ওহ… তোমার নামটাই তো জানা হল না।
—আজ্ঞে, আমার নাম বাসবজিৎ। সবাই বাসব বলে ডাকে।
—বেশ।
চাণক্যর ঘরের দরজায় করাঘাত করতে আচার্য বেরিয়ে এলেন। জীবসিদ্ধি বলল:
—শুভসন্ধ্যা, আচার্য। এ বাসবজিৎ। প্রদীপের তেল, কপূর্রাদি দিতে এসেছে। বাসব মাটিতে লুটিয়ে চাণক্যর পা ছুঁলো।
—আমি ভাবতেই পারছি না যে স্বয়ং মহামতি চাণক্যর সামনে আমি দাঁড়িয়ে। এই অধমের জীবন সার্থক হল।
—আশীর্বাদ করি। তা, তুমি এখানে কতদিন?
—তা, প্রায় দু-বছর হতে চলল, আচার্য। আমি আপনার জীবনের কাহিনি সব শুনেছি, আচার্য। আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ।
—হুম। কিন্তু আমি তো ওই তেল, কর্পূরাদি নেব না। আমি নিজের ব্যবহারের মতো জিনিস নিয়েই এসেছি।
লোকটা একটু অবাক হল। কী বলবে ভেবে পেল না। কারণটা জীবসিদ্ধি বলল:
—আসলে, আচার্য নিজের ব্যবহারের জন্যে বিনামূল্যে কোনো জিনিস গ্রহণ করেন না। তিনি নিজের বাড়িতেও সরকারি তহবিল থেকে কোনো জিনিস ব্যবহার করেন না। প্রদীপের তেলটুকুও নিজের সামান্য মাসোহারা থেকে কেনেন।
দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল বাসবের। বলল:
—লোকমুখে একটা কাহিনি শুনেছিলাম যে আচার্য চাণক্য নিজের ঘরে দুটো প্রদীপ রাখেন। একটা সরকারি তেলে, একটা নিজের কেনা তেলে। অতিথিদের তিনি প্রশ্ন করেন তাদের প্রয়োজন সরকারি না নিজস্ব। তার উত্তরের ওপর নির্ভর করে কোন প্রদীপ প্রজ্বলন করা হবে। আমি ভাবতাম এটা শুধুমাত্র অতিরঞ্জিত কাহিনি মাত্র। মানুষ এত অত্যধিক সৎ হতে পারে না। আজ আমার সেই সংশয় দূর হল।
চাণক্য উত্তর দিলেন,
—এটাকে অত্যধিক সততা বলে না। এটা অতি সাধারণ একটা নিয়ম মাত্র, যা সকলের মেনে চলা উচিত। দুঃখের বিষয় যে সাধারণ মানুষ তা ভুলে যেতে বসেছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ‘সততা’ জিনিসটাই মানুষের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হবে।
বাসবের দৃষ্টিতে প্রশংসা আর সমীহ ফুটে উঠল। বলল:
—আপনার কোনো প্রয়োজন হলে আমায় বলবেন, আচার্য। প্রধানাচার্য আপনাদের দেখাশোনার দায়িত্ব আমায় দিয়েছেন। তা ছাড়া আমায় আপনাদের আরও একটা সাহায্য করতে বলেছেন তিনি।
—হুম। কী সাহায্য?
—এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটতে থাকা সমস্ত ভয়াবহ ঘটনার খবর আমি রাখি। আপনারা যেখানে যা তদন্ত করতে যেতে চান আমায় বলবেন। আমি আপনাদের নিয়ে যাব।
—হুম। বেশ, বেশ। তুমি ওই চার ছাত্রদের চেনো? মানে ওই যারা সেই রাত্রে তন্ত্র-ক্রিয়া করেছিল?
—হ্যাঁ। আমি সবাইকেই চিনতাম।
—চিনতাম কেন? তারা কি এখানে নেই নাকি?
বাসব একটু বিস্মিত হয়ে বলল,
—আচার্যপ্রমুখ আপনাদের বলেননি? তাদের মধ্যে একজন ইতিমধ্যে আত্মহত্যা করেছে।
—সে কী? কবে?
—দিন কুড়ি আগেই। এদের মধ্যে তিন জনের মানসিক বিকার হয়েছিল সেই রাতের পর। প্রতি মুহূর্তে তারা ভয় পেত। আয়ুরালয় থেকে মাত্র কুমার সুভাষকে সুস্থ করা সম্ভব হয়েছে। বাকি দু-জন এখনও সেখানেই আছে। এদের মধ্যে একজন, তার নাম ছিত্রবান, আয়ুরালয়ের জানলা থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
—বড়োই দুঃখের পরিণতি। বাকি তিন জন ছাত্রর সঙ্গে আমার দেখা করা প্রয়োজন।
আমি ব্যবস্থা করে রাখব। কাল তাহলে সকালে দ্বিতীয় প্রহরে আমি আসব। আপনাদের নিয়ে যাব তাদের কাছে।
—হুম। সেই ভালো।
—বেশ। শুভরাত্রি, আচার্য। শুভরাত্রি, জীবসিদ্ধি মহাশয়।
—শুভরাত্রি।
.
বাসব বিদায় নিতে, চাণক্য বললেন,
—বীভৎসভাবে ঝলসে যাওয়া মুখ। কীভাবে হয়েছে কে জানে।
—বলল অনেক বছর আগের দুর্ঘটনায়।
—হুমম। তবে আমাদের কাজের জন্যে লোকটা বেশ উপযুক্ত।
—তা তো অবশ্যই। তা আচার্য, একটু সান্ধ্যভ্রমণে যেতে ইচ্ছুক নাকি আপনি? আকাশের চাঁদ রুপোলি হালকা জোছনা মাখিয়ে দিয়েছে লাল পাথরের এই প্রাঙ্গণে। বড়োই মনোরম পরিবেশ। আকাশে আজ মেঘ নেই। চাণক্য বললেন, চলো। একটু পায়চারি করে আসি। বেশ চিত্তাকর্ষক পরিবেশ।
দু-জন চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটছেন ফাঁকা প্রাঙ্গণে। এই নিস্তব্ধতার মাঝে কেউ অনুমানও করতে পারবে না যে এই মুহূর্তে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তত কয়েক হাজার মানুষ আছে। এই প্রাঙ্গণ তারা বরাবরই ছাত্রে ভরা দেখতে অভ্যস্ত। এখানকার নিয়ম দিনের বেলা সাধারণ ছাত্রদের পড়ানো হয় এবং সন্ধে থেকে রাজকুমারদের। তার কারণ রাজকুমারদের অনেক সময়েই দিনের বেলা অন্যান্য কাজ থাকে। কিন্তু এখন সূর্যাস্তর পর কেউ নিজের ঘরের বাইরে বের হয় না।
জীবসিদ্ধি ভাবছিল, আচার্য কি পারবেন এই বিশ্ববিদ্যালয়কে এই ত্রাসের ছায়া থেকে বের করে আনতে? পারবেন তিনি তক্ষশিলাকে আবার আগের মতো করে দিতে? হ্যাঁ। নিশ্চয়ই পারবেন! চাণক্যই পারেন এই রহস্যর সমাধান করতে। এই অদ্ভুত মানুষটার পক্ষে সব সম্ভব।
চাণক্য হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন এবং ফিরে যেতে শুরু করলেন অতিথি নিবাসের দিকে। জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,
—আর ভ্রমণ করবেন না?
—নাহ্। তুমি যুবক, আমি নই। আমি বিশ্রাম করতে গেলাম। এই এতদিনের একটানা যাত্রার ক্লান্তি দূর হয়নি আমার। আর তা ছাড়া…
—তা ছাড়া?
—এই রাতে বেশি ঘোরাঘুরি না করাই সমীচীন। কে বলতে পারে, হয়তো কোনো প্রেত আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে বসে আছেন।
হেসে উঠলেন দু-জনেই। ফাঁকা প্রাঙ্গণে তাঁদের হাসি প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল।
৮.
কথামতো দিনের দ্বিতীয় প্রহরে বাসব এসে হাজির হল অতিথি নিবাসে। আগে থেকেই তৈরি ছিলেন চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি। সঙ্গেসঙ্গেই তাঁরা বেরিয়ে পড়লেন। দক্ষিণ প্রাঙ্গণে আয়ুরালয় অবস্থিত। তক্ষশিলা বিশ্ববিদ্যালয়কে পৃথিবীর প্রথম চিকিৎসাশাস্ত্রর অনুসন্ধান কেন্দ্র বলা চলে। আয়ুর্বেদের জনক এবং চিকিৎসাশাস্ত্রর প্রথম বই চরক সংহিতা-র লেখক, মহামতি চরক স্বয়ং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন। এই চিকিৎসাকেন্দ্র তাঁর নিজের স্থাপনা করা।
আয়ুরালয়ে দেখা করার জন্যে প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা আর অনুমতি আগেই জোগাড় করে রেখেছিল বাসব। চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি দু-জনকেই সম্মত হতে হল যে বাসব বেশ কাজের মানুষ।
একতলার একটা আলাদা ঘরে রাখা হয়েছে সুনাভকে। তার ঘরে তিন জনকে ঢুকতে দেখে সুনাভ ভীত চোখে তাদের দিকে চাইল। চাণক্য তার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। বছর আঠারো-উনিশের এক কিশোর। চোখের মণি অস্বাভাবিক বড়ো এবং তাতে ঘোলাটে দৃষ্টি। চোখের কোলে গভীর কালি। চাণক্য এই ছাত্রর নামটা আগেই জেনেছেন বাসবের থেকে, তাই প্রশ্ন করলেন,
—সুনাভ, কেমন আছ?
ছেলেটা ঘাড় নেড়ে বলল,
—ভালো। শুধু…
—শুধু? কী?
—ওই… ওই ছায়াগুলো। ওরা আবার চলে আসবে।
—কোন ছায়াগুলো, সুনাভ?
—ওই যে, ওই কালো কালো ছায়ামূর্তিগুলো। মাঝে মাঝেই আসে। ওদের চোখ…
—ওদের চোখ?
—ল… লাল! কয়লার মতো আগুন জ্বলে।
—ওরা এখন আসবে না।
—তুমি ঠিক বলছ?
—হ্যাঁ। এখন কেউ আসবে না। তুমি কি শুধু তাদেরকেই দেখতে পাও? নাকি আরও কেউ এসে তোমাকে ভয় দেখায়?
—না। শুধু ওরা। আর সঙ্গে ওই মণি…
—তাদের লাল চোখের মণি?
—না না। মণি। কিন্তু তার চোখ লাল।
কথার স্বাভাবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে বুঝে চাণক্য প্রসঙ্গ বদল করলেন,
—হুমম। সেদিন রাতে কী হয়েছিল মনে পড়ে?
সুনাভ কথা শুনতে পেয়েছে বলে মনে হল না। বার বার শুধু সামনের দেয়ালের দিকে চাইছে ভয়ে ভয়ে। চাণক্য ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন। প্রশ্ন করলেন,
—তারা কি ওই দেয়াল থেকে বের হয়ে আসে?
—হ… হ্যাঁ। রাত হলেই বেরিয়ে আসে। কালো কালো, লাল চোখ। মণি।
—সেইদিন রাতেও কি এরাই এসেছিল?
—হ্যাঁ। ওরা… ওরা নরক থেকে এসেছে। ফিরে এসেছে। ও নিজের সঙ্গে নিয়ে এসেছে ওদের।
চোখে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে সুনাভর। চাণক্য বললেন,
—ভয় নেই। ওরা এখন আসবে না। বাইরে চেয়ে দেখো, দিনের আলো।
জানলার বাইরে চেয়ে কিছুটা যেন আশ্বস্ত হল সুনাভ। চাণক্য আবার বললেন,
—ওই রাতে কী হয়েছিল একটু মনে করে বলতে পারো?
—আমরা… আমরা নরকের দরজা খুলে প্রেতদের ডেকে এনেছি। ওরা… ওরা আমাদের ঘিরে ধরেছিল। আমার পেছনেই সে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি… আমরা তাকে…
আচমকা ভেঙে পড়ল সুনাভ। প্রচণ্ড কাঁদতে থাকল। একে প্রশ্ন করে আর লাভ নেই। চাণক্য ঘাড় নেড়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। ওঁর সঙ্গের দু-জনও ওঁর দেখাদেখি বেরিয়ে এল।
বাসব বলল:
—এবার দ্বিতীয় ছাত্র পুষ্পলের ঘরে যাব আমরা। পুষ্পলকে প্রথমে ওপরতলায় রাখা হয়েছিল। কিন্তু ছিত্রবানের মৃত্যুর পরেই, শঙ্কিত হয়ে প্রধান বৈদ্য তাকে নীচের একটা ঘরে রাখার নির্দেশ দেন। আসুন আমার সঙ্গে, এই চারটে ঘর ছেড়েই তার ঘর।
বাসবের দেখানো পথে এগিয়ে চললেন আচার্য ও জীবসিদ্ধি। একটা প্রায় একইরকম ঘরে এসে ঢুকলেন তাঁরা। সেখানে আধশোয়া অবস্থায় এক কিশোর বসে। পুষ্পলেরও বয়স ওই সুনাভর মতোই ষোলো-সতেরো হবে। তারও চোখে একইরকম দৃষ্টি। ভীত, বিষণ্ণ, অনিদ্রায় ক্লান্ত। কিন্তু পুষ্পল শান্ত নয়, সে প্রতি মুহূর্তে দৃষ্টি ঘোরাচ্ছে আশেপাশে। কিছুক্ষণ পর পর জানলার দিকে চাইছে ভীত দৃষ্টিতে। যেন কিছু একটা ভয়ংকর জিনিস এক্ষুনি ঢুকে আসবে ওখান থেকে। তাদের তিন জনকে ঢুকতে দেখে চেঁচিয়ে উঠল,
—এসো না! একদম এদিকে এসো না। ওই পাখিটা তোমাদেরও ধরে নেবে! তুলে নিয়ে যাবে তোমাদেরও। ভেতরে এসো না!
চাণক্য শান্ত স্বরে বললেন,
—চিন্তা নেই। আমাদের ওই শয়তানটা ধরতে পারবে না। কিন্তু আমি তাকে আগে কখনো চাক্ষুষ করিনি। কেমন দেখতে তাকে? বর্ণনা দিতে পারবে?
—মানুষের মতো শরীর। কিন্তু অনেক বড়ো। বিশাল বড়ো দানব পাখি। মাথাটা বড়ো কাকের মতো। না না… বাজপাখির মতো। বড়ো বড়ো দুটো ডানা আছে। পায়ে ধারালো নখ। ওটা দিয়েই তো মানুষকে ধরে নিয়ে যায়।
—হুমম। সেইদিন রাতে কি এই পাখিগুলোই এসেছিল?
—না, না। একটাই পাখি আছে। ওটাই।
—ওহ। সেই রাতের কথা মনে আছে? ওই যে রাতে প্রথম দেখেছিলে এই দানব পাখিকে?
—হ্যাঁ। এটাই তো এসেছিল। প্রথমে কুমারকে ধরে। তারপর আমার দিকে ফিরে তাকায়!
সারা শরীর কাঁপছে পুষ্পলের। আবার জানলা দিয়ে বাইরে চাইতে থাকে,
—ওই ওই! ওই যে দেখো। বাইরে আকাশে উড়ছে। খোলা জানলা দিয়ে ঢুকে পড়বে! এতবার বলেছি বন্ধ করো ওটা। কেউ শুনছে না!
জানলা দিয়ে চেয়ে খোলা আকাশে এক ঝাঁক পাখি ছাড়া কিছুই দেখা গেল না। চাণক্য বললেন,
—বেশ। আমি বলে দেব যেন জানলাটা বন্ধ করে দেয়।
—হ্যাঁ। করো, করো।
আর কথা না বাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন চাণক্য। হতাশভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
—এদের থেকে বেশি কিছুই জানা যাবে না। বরং কুমার সুভাষের থেকে কিছু জরুরি তথ্য পাওয়ার আশা আছে। সে তো শুনছি এদের চেয়ে সুস্থ?
—হ্যাঁ, আচার্য। এখন তার কাছেই যাব। তার আগে খাওয়া-দাওয়া সেরে নেয়া যাক?
—কিন্তু আমি ও জীবসিদ্ধি তো স্বপাক খাব আজ থেকে হে, বাসব। কথাটা শুনে জীবসিদ্ধি একটু অবাক হল। কারণ স্বপাক খাওয়ার কথা আগে বলেননি চাণক্য। বাসব বলল:
—ওহো। তা বেশ। কিন্তু আচার্য… আমি তো সেরকম কোনো ব্যবস্থা করিনি।
—আজকের আনাজ-চাল আমি আমাদের সৈনিকদের দিয়ে আনিয়ে রেখেছি। কালকের থেকে তুমি যদি ব্যবস্থা করে দিতে পারো রোজকার জিনিসপত্রর, তবে ভালো হয়। তবে তারজন্যে ন্যায্য মূল্য আমরা দিয়ে দেব তোমায়
—কোনো অসুবিধা নেই, আচার্য। হয়ে যাবে।
—বেশ। তবে তুমি খাওয়া সেরে নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসো। আজ্ঞে, আচার্য।
.
বাসব বিদায় নিতে জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,
—আচার্য, এই স্বপাকে খাওয়ার বিষয়টা বুঝলাম না।
চাণক্য পথ চলতে শুরু করলেন। জীবসিদ্ধি তাঁর সঙ্গেই চলেছে। ফাঁকা জায়গায় এসে বললেন,
—খাবারে কেউ কিছু মাদক দ্রব্য মিশিয়ে দিচ্ছে কি না, সে-বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। তাই নিশ্চিত না হওয়া অবধি এখানকার খাবার না খাওয়াই বাঞ্ছনীয়।
—তা আপনি সত্য বলেছেন। কিন্তু আচার্য, এই বিষয়ে নিশ্চিত কীভাবে হওয়া যায়?
—একটা উপায় আছে। তারজন্যে তোমায় কয়েক দিন কষ্ট করতে হবে। এর বেশি কিছু বললেন না চাণক্য। অতিথি নিবাসের দিকে পা বাড়ালেন।
৯.
দুপুরের সূর্য মুখ ঢেকেছে মেঘে। বোধ হয় বৃষ্টি হবে সন্ধ্যার দিকে। চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি চলেছে বাসবের সঙ্গে। গন্তব্য, কুমার সুভাষের ছাত্রনিবাস। পথ চলতে চলতে চাণক্য প্রশ্ন করলেন,
—ওহে বাসব, তুমি এখানে ঠিক কী কাজ কর?
—আচার্য, আমি এখানকার গ্রন্থাগারের কিছু সামান্য কাজকর্ম সামলাই। আসলে আমি শিক্ষিত। উচ্চশিক্ষা না থাকলেও, সাধারণ শিক্ষা আমার আছে। তাই গ্রন্থাগারে মাঝে মাঝে আমার কাজ পড়ে। আর বাকি সময়ে অন্যান্য আচার্যদের কাজকর্ম করি।
—বেশ, বেশ। তা, তোমায় প্রথম কে এখানে কাজ দেয়?
একটু থেমে বাসব উত্তর দেয়,
—আচার্য, বিন্দাচল। উনি এখানকার ‘উদ্ভিদবিদ্যা’-র আচার্য ছিলেন। আমায় স্নেহ করতেন। একটু খামখেয়ালি মানুষ ছিলেন, কিন্তু খুব ভালো মনের মানুষ।
—হ্যাঁ, জানি। ‘ছিলেন’ কেন? তিনি কি অবসর নিয়েছেন?
—হ্যাঁ। উনি একদিন হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে তক্ষশিলা থেকে বেরিয়ে চলে যান এক বছর আগে।
—সে কী? কেন?
—বলতে পারি না, আচার্য। খামখেয়ালি মানুষ ছিলেন। অত্যধিক জ্ঞানী। দিনরাত নিজের গবেষণাগারে কাজ করতেন।
—হুমম।
মুখে কিছু না বললেও, চাণক্যর মনে পড়ে গেল আচার্য বিন্দাচলের কথা। মানুষটা জ্ঞানী, পরিশ্রমী এবং অত্যন্ত মেধাবী। কিন্তু তিনি ছিলেন আচার্য শকুনির অন্ধভক্ত। এইরকম কয়েকজন আচার্য বরাবরই আচার্য শকুনির পক্ষে থাকতেন সেই সময়ে। এবং সেই কারণে চাণক্যর সঙ্গে তাঁদের সদ্ভাব ছিল না। তবে প্রত্যেকে একে অন্যকে যোগ্য সম্মান দিয়ে চলতেন। এইসব প্রসঙ্গ এখন আর তুলে লাভ নেই। অতীতের তিক্ততা থাকুক অতীতেই। প্রসঙ্গ বদলাতে চাণক্য প্রশ্ন করলেন,
—ওহে, বাসব। একটা কথা বলো, তুমি নিজে কি কখনো এই তক্ষশিলায় অপদেবতার দেখা পেয়েছ?
খানিকক্ষণ চুপ থেকে বাসব বলে,
—হ্যাঁ, আচার্য। আমি দেখেছি। আমিও কালো ছায়ামূর্তিদের দেখেছি। ওই লাল চোখ, জ্বলন্ত।
—কোথায় দেখেছ?
—নিজের বাড়িতে ফেরার পথে দেখেছি। উত্তরের জলাশয়ের পাড়ে। কয়েক সপ্তাহ আগের ঘটনা, আমার কাজ সেরে ফিরতে দেরি হয়েছিল। অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল। জলাশয়ের পাশ দিয়ে পার হচ্ছিলাম। তখনই একটা অদ্ভুত আওয়াজ পেলাম। সেটা জলাশয়ের দিক থেকেই আসছে। তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল, আচার্য। আজও সে- দৃশ্যর কথা ভাবলে আমার আতঙ্ক লাগে।
—কী দেখলে?
—আমি দেখলাম, জল থেকে উঠে আসছে অনেক আকৃতি। তাদের প্রত্যেকের চোখ জ্বলন্ত কয়লার মতো লাল। হাতে পাখির মতো ধারালো নখ। দলে দলে তারা উঠে আসছে জলের গভীর থেকে। আমি বুঝতে পারি যে এরা কেউ মানব নয়। এরা দানব! প্রেত! আমি ঈশ্বরের নাম জপ করতে থাকি আর সেখান থেকে পালাই। নিজের ঘরে এসে দরজায় খিল না দেয়া অবধি পেছন ঘুরে চাইনি আর মন্ত্রজপও থামাইনি। সে বড়োই ভয়ংকর!
—হুমম। ভয়ংকর বটে। আর কোনোদিন কিছু দেখেছ?
—না, আচার্য। সেই রাতের পর আমি পণ করেছি যে যাই ঘটুক, আমি রাতের বেলা আর প্রাঙ্গণে বের হব না।
—হুমম।
.
কুমার সুভাষ আগে অন্য ছাত্রদের সঙ্গে একই ছাত্রনিবাসে থাকত। কিন্তু সেই রাতের ঘটনার পর তাকে আলাদা ছাত্রাবাসে আনা হয়েছে। এখানে তার নিজস্ব কিছু দাসদাসী তার দেখাশোনা করছে। সে কিছুটা আরোগ্য লাভ করেছে।
বাসব এখানেও আগেই কথা বলে রেখেছিল। তাই তাঁদের কেউ বাধা দিল না। তাঁরা গিয়ে পৌঁছোলেন কুমারের ঘরে। কুমারের বয়স অন্য দুই ছাত্রর তুলনায় কম। প্রথম বর্ষের ছাত্র সে। নিজের ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। তাঁদের দেখে কুমার উঠে বসে হাত জোড় করে প্রণাম করল।
—প্রণাম, আচার্য চাণক্য। আপনাকে এতদূর চলে আসতে হয়েছে বলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমায় যদি বৈদ্যরা বারণ না করত তবে আমি নিজেই আপনার সঙ্গে ।
—আয়ুষ্মান ভবঃ, কুমার। তোমার রাজোচিত সৌজন্য তোমার কুল ও শিক্ষার পরিচয় দেয়। তুমি অসুস্থ। তাই এখন বৈদ্যদের নির্দেশ পালন করাটাই তোমার উচিত।
—মাননীয় অতিথিরা, আপনারা আসন গ্রহণ করুন। ওহে বাসব, ওঁদের আসন দাও। নিজেও বোসো।
সবাই আসন গ্রহণ করলে চাণক্য বললেন,
—পরিচয় করিয়ে দিই। এ আমার শিষ্য, জীবসিদ্ধি।
দু-জনেই একে অন্যের প্রতি নমস্কার জানাল। কুমার বলল:
—বলুন, মহামতি। আপনাদের কী সাহায্য করতে পারি?
—কুমার। আমরা সব ঘটনা শুরু থেকে জানতে চাই। কোনো সামান্য তথ্যও যেন বাদ না যায়।
—বেশ। তবে গোড়া থেকেই শুরু করি। আমি এবং আমার তিন বন্ধু সবাই ‘ইন্দ্রজাল বিদ্যা’-র ছাত্র। আমরা অনেকদিন থেকেই এমন কোনো রহস্যময় প্রাচীন পুথি বা লিপি খুঁজে চলেছিলাম যা থেকে অলৌকিককে উপলব্ধি করতে পারব। বেশ কয়েকবার আমরা গ্রন্থগারে গিয়ে খুঁজেছিলাম সেইরকম কিছু। কিন্তু পাইনি কিছুই।
আপনি তো জানেনই, এখানে অধ্যয়ন ছাড়াও আমাদের প্রত্যেক ছাত্রর সাপ্তাহিক আলাদা আলাদা কাজের ভার পড়ে। এরকমই একদিন পুষ্পলের কাজের ভার ছিল গ্রন্থাগারে। দৈবাৎ সে একটা প্রাচীন পুথি খুঁজে পায়। আমাদের এসে সেই কথা বলে। এরপর আমরাও গিয়ে সেই পুথি পড়ে বুঝি যে এটা সত্যি অলৌকিক কিছুর চাবিকাঠি হতে পারে। যদিও এই বইয়ের প্রথমদিকের পাতা নেই। তাই নিশ্চিত হওয়া যায় না কীসের বই বা কার লেখা। কিন্তু ওটা তন্ত্র মন্ত্রের বই, এইটুকু বোঝা যায় সহজেই। আমরা সেই বই নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আসি এবং তার থেকে প্রত্যেকের জন্যে আলাদা করে লেখাগুলো লিপিবদ্ধ করি। এরপর আমরা তিথি-নক্ষত্র বিচার করে এক রাতে সেই তন্ত্রক্রিয়া করে দেখতে যাই। আর তাতেই কাল হল আমাদের।
কুমারের দৃষ্টিতে পরিচিত ভয় আর বিষণ্ণতা ফুটে উঠল। কিছুক্ষণ থেমে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলতে লাগল,
—সেই রাতটা ছিল দুর্যোগের। ঈশান কোণের কালো মেঘ দেখেই আমাদের অশুভ সংকেত আঁচ করা উচিত ছিল। জানেন আচার্য, আমার ধুলো, ধোঁয়া সহ্য হয় না। তাই আমার বন্ধুরা বলেছিল যেন এইসব থেকে আমি বিরত থাকি। কারণ সেখানে হবন অগ্নি জ্বালতে হয়েছিল। আমি নিজের শারীরিক সমস্যা উপেক্ষা করে এই অনিষ্টর কাজে লিপ্ত হলাম। অত্যধিক কৌতূহল আমাদের অন্ধ করে দিয়েছিল। দুর্যোগ শুরুর আগেই আমরা আমাদের তন্ত্রক্রিয়া আরম্ভ করি।
—হুমম। তারপর?
—প্রথমে কিছু হয়নি। নিজের গতিতে চলছিল সব। কিন্তু শেষের দিকে আমার প্রচণ্ড ভয় করতে থাকল। টের পেলাম আমার পেছনেই কিছু একটা এসে দাঁড়িয়েছে। আমি পেছন ঘুরলাম, আর তখনই দেখলাম ওটাকে। একটা বিশাল মাকড়সা! আমার দিকে তাকিয়ে আছে… পরক্ষণেই আমার দিকে জাল ছুড়ে দিল সেটা। আমি চিৎকার করে উঠলাম! তারপর আর কিছু মনে নেই। পরের দিন আমার সংজ্ঞা ফেরে আয়ুরালয়তে।
—তার মানে তুমিই চিৎকার করেছিলে? তোমার বন্ধুরা তোমার চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিল। তারা আগে চিৎকার করেনি?
—না। তারা আমি আর্তনাদ করার কয়েক মুহূর্ত আগেই একে একে সংজ্ঞা হারায়।
—হুমম। তোমাদের লেখা ওই মন্ত্র বা আসল বইটা দেখা যায়?
—আচার্য, আমাদের লেখাগুলো তো পাবেন না। সেইদিন রাতে লোকজন শুধু আমাদের তুলে এনেছিল। আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র ওখানেই থেকে গিয়েছিল। শেষরাতে শুনেছি প্রবল বৃষ্টি আর তুফান হয়েছিল। সব ধুয়ে গেছে। ওই বই নষ্ট হয়ে গেছে।
জীবসিদ্ধি লক্ষ করল, বাসব কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। চাণক্য বললেন,
—ধন্যবাদ, কুমার। তুমি বিশ্রাম নাও।
কুমারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বাসব বলল :
—আচার্য, ভেতরে তখন বলিনি, কিন্তু আমি আপনাদের একটা সাহায্য করতে পারি।
—কী সাহায্য, বাসব?
—ওই পুথি। ওটা নষ্ট হয়নি। আমি জানি ওটা কোথায় রাখা আছে।
—তাই নাকি? এ তো দারুণ সুসংবাদ। তুমি কীভাবে জানলে এই কথা?
—কুমার সুভাষের এ তথ্য জানা নেই। সেই রাতে লোকজন আর কিছু উদ্ধার না করলেও পুথিটাতে গ্রন্থাগারের মোহর দেখে তুলে এনেছিল। পরের দিন যখন কয়েকজন ওটা গ্রন্থাগারে ফেরত দিতে যায়, সেইদিন সেই সময়ে আমি সেখানেই ছিলাম। সেখানেই আমার কাজের ভার ছিল। অন্তত আমি এটা জানি যে গ্রন্থাগারের কোন অংশে সেই বইটা রাখা আছে।
—বেশ, বেশ। তাতেই যথেষ্ট উপকার হবে। ওহে জীবসিদ্ধি, তুমি কি একটু কষ্ট করে সেই পুথিটা আমায় খুঁজে এনে দিতে পারবে? তবে আজ বা কালকের মাঝে একবার বাসবের সঙ্গে গ্রন্থাগারে যেয়ো।
—বেশ। নিশ্চয়ই যাব।