কনক-শাস্ত্র – ৩০

৩০.

জীবসিদ্ধির প্রশ্নর উত্তরে চাণক্য পালটা একটা প্রশ্ন করলেন,

—আচ্ছা, ইন্দ্রজিৎ বা বাসবজিতের পুরো ষড়যন্ত্রর নেপথ্যে কী উদ্দেশ্য ছিল বলতে পারো?

একটু ভাবনাচিন্তা করে জীবসিদ্ধি উত্তর দিল,

—আপনার ওপর তার রাগ। তক্ষশিলায় শিক্ষালাভের সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ। এবং তার থেকে প্রতিহিংসাপরায়ণতা। আপনি নিজেই তো তাই বললেন।

—হুম। যুক্তিটা কি খুব জোরালো হল? নিজের উদ্দেশ্যে সফল হলেই-বা আমার ওপর কী ধরনের প্রতিহিংসা চরিতার্থ হত তাতে? যদি আমি তক্ষশিলার রহস্যর সমাধান করতে ব্যর্থ হতাম আমার কি বাস্তবে কোনো ক্ষতি হত?

—না… তা নয়।

—আমারও এই একটা হিসেব কিছুতেই মিলছিল না। তার উদ্দেশ্যটা ঠিক কী আমি কিছুতেই আন্দাজ করতে পারছিলাম না। বাসবের বলা আরও একটা কথায় আমার মনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়।

—কোন কথা?

—ধরা পড়ার পর বাসব বলেছিল, ‘আপনি যেদিন এসেছিলেন, সেইদিনই আমি জানতাম যে আপনি আমায় ধরে ফেলবেন।’ ভেবে দেখো জীবসিদ্ধি, এর অর্থ দাঁড়ায় যে বাসব তার ধরা পড়ার আশঙ্কা আছে জেনেও পালায়নি। কেন? দ্বিতীয়ত, শেষ অবধি সে বলে গেছে যে আমি যদি ভেবে থাকি, আমি জিতে গেছি, তবে আমি ভুল ভাবছি। এই কথার তাৎপর্য কী? শুধুই কি বুদ্ধির যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার বৃথা আস্ফালন? নাকি তার এই কথার কোনো অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা আছে?

খানিক থেমে আবার বলতে থাকলেন চাণক্য।

—আমার বার বার মনে হতে থাকে যে গোটা ঘটনাটায় কিছু যেন মিলছে না। কিছু যেন আমার অলক্ষে থেকে যাচ্ছে। কিছু একটার অভাব বোধ করছিলাম।

এইবার আসা যাক অন্য একটা ঘটনায়। আপাতদৃষ্টিতে যার সঙ্গে অন্য কোনো রহস্যর সম্পর্ক নেই। কয়েক মাস আগে, ‘পরিঘ’*-এর স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে ফেরা একটা ঘোড়ার গাড়ি লুঠ হয়। কিন্তু কয়েক দিন পর সেই স্বর্ণমুদ্রা ফিরিয়েও দেয়া হয়। সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে যায় যে দস্যুরা নির্ঘাত না জেনেই রাজসম্পত্তি লুঠ করেছিল। রাজরোষের ভয়ে তারা সেই অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি নিজেও তাই ভেবেছিলাম। সত্যি বলতে, সেই সময়ে তক্ষশিলার সমস্যা নিয়ে জড়িয়ে পড়ায় এই বিষয় নিয়ে ভাবনা আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমি স্পষ্ট চিত্র দেখতে পাচ্ছি। তুমি কি আন্দাজ করতে পারছ আমি কী বলতে চাইছি?

জীবসিদ্ধির দৃষ্টিতে বিস্ময় ফুটে উঠেছে। চাপা উত্তেজনায় তার স্বর কেঁপে উঠল,

—ওগুলো নকল মুদ্রা?!

নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চাণক্য বললেন,

—ধীরে বলো। পাশের ঘরে বিশ্রামরত গৃহস্বামী শুনতে পাবে যে।

জীবসিদ্ধির কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। চাপাস্বরে বলল:

—বাসব! সে বিঞ্জা অরণ্যে আপনার সঙ্গেই ছিল। সে এই নকল মুদ্রা বানানোর পদ্ধতি জানত।

—হুম। পুরোটা না জানলেও, কিছুটা জানতই। সম্ভবত কয়েক বছর আগে সে ফিরে গিয়ে সেই অরণ্যের পুরোনো বাসিন্দাদের কারুর থেকে বাকিটাও জেনেছে। যদিও সেই দস্যুদল আর নেই। যুদ্ধর সময়ে তারা আমাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু সেই রকম প্রাক্তন কোনো দস্যুকে খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর নয়। মৌর্য সাম্রাজ্যর পত্তনের পরে তাদের বেশিরভাগ লোকই তাদের আদি বাসস্থানে ফিরে গেছে।

—কিন্তু… কিন্তু আচার্য, এর সঙ্গে তক্ষশিলার সম্পর্ক কী? সেখানে সমস্যা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য কী হতে পারে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাণক্য বললেন,

—উদ্দেশ্য একটাই, জীবসিদ্ধি। আমাকে মগধ থেকে সরানো। আমারই ষড়যন্ত্র, আমারই ওপর ব্যবহার করা হয়েছে। আর সেই ষড়যন্ত্র বিফল করতে পারি একমাত্র আমি স্বয়ং! সেই কারণেই এই পরিকল্পনার সাফল্যের জন্যে আমায় পাটলিপুত্র থেকে সরিয়ে ফেলা অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল। আমায় অন্য একটা গভীর রহস্যর জালে জড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, যাতে আসল অপরাধের থেকে আমার দৃষ্টি ঘুরে যায়।

—এ তো অতি গভীর এবং কুটিল পরিকল্পনা, গুরুদেব!

—হুম। আশঙ্কাটা আমার মনে জাগে বাসবের মৃত্যুর পর। তাকে হত্যায় ব্যবহৃত বিষাক্ত তিরের সঙ্গে, মগধের সৈনিক হত্যায় ব্যবহৃত তিরের মিল থেকেই আমি দুটো ঘটনার মধ্যে যোগসূত্র অনুমান করতে পারি। তারপরেই পুরোনো চিঠিতে, রাজকোষের হিসেবে গরমিলের কথাটা মনে পড়ে যায়। সেই চিঠিগুলো আমি তখনই আবার পড়ি। স্বর্ণমুদ্রা লুণ্ঠন, তা সহজেই ফেরত পাওয়া এবং তারপর এই মুদ্রার হিসেবে গরমিল। সূত্রগুলো মেলাতে আর দেরি হয়নি আমার। বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে চুরি যাওয়া স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার করে নকল মুদ্রা বানানো হয়েছে। এবং ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে আসলের পরিবর্তে, সমপরিমাণ নকল মুদ্রা। তার পরের দেড় মাসে আমার অনুপস্থিতির সুযোগে দেশে বাসিন্দাদের দৈনিক লেনদেনের মাধ্যমে আরও বেশি নকল মুদ্রা ঢোকানো হয়। এটাই নিয়ম। আমিও তাই করেছিলাম। মুদ্রাশালে বানানো মুদ্রার চেয়ে বেশি মুদ্রা, বড়ো অঙ্কে দেশে ঢুকে গেলেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য। অর্থশাস্ত্র তাই নিদান দেয়।

চোখ বুজে কিছুক্ষণ ভাবলেন চাণক্য। তারপর বললেন,

—আমার মনস্তত্ত্ব নিয়ে খেলা করা হয়েছে। আমার হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের দুটো জায়গা যদি নির্বাচন করতে হয়, তবে প্রথমেই আসবে- মগধ। আমার জন্মভূমি। আমার হাতে স্থাপিত এই দেশ। আর তার পরেই যে জায়গার নামটা আসবে, সেটা হল তক্ষশিলা মহাবিদ্যালয়। আমার শিক্ষাভূমি এবং কর্মভূমি। আমার কর্মকাণ্ডের বীজ যেখান থেকে অঙ্কুরিত হয়েছিল। সেই আমার প্রাণাধিক প্রিয় তক্ষশিলা। অতএব, আমায় মগধ থেকে বের করতে, তক্ষশিলায় সৃষ্টি করা হয় সমস্যা। ষড়যন্ত্রী জানত যে ঘোর বিপদে প্রধানাচার্য ভদ্রভট্ট আমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করবেন। অথবা কে বলতে পারে, হয়তো আমার কাছে সাহায্য চাওয়ার পরামর্শ বাসবই সুচতুরভাবে প্রধানাচার্যর মাথায় ঢুকিয়েছিল। সেটাও সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপদের কথা শুনলে আমি চুপ থাকতে পারব না। এক বাড়ি থেকে আমায় বের করে আনতে আমার দ্বিতীয় বাড়িতে আগুন লাগানো হল।

—অর্থাৎ তক্ষশিলার ঘটনা, পুরোটা শুধুই আপনার মনোযোগ আসল সমস্যা থেকে সরিয়ে দেয়ার কৌশল মাত্র?

—হুম। ঠিক তাই। ভেবে দেখো, আমি এতটাই সেখানকার রহস্য সমাধানে জড়িয়ে পড়েছিলাম যে চন্দ্রগুপ্ত যখন তার দ্বিতীয় চিঠিতে, রাজকোষের হিসেব না মেলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিল, সেটাও আমার নজরে আসেনি। আমার একবারও মনে হয়নি যে বিষয়টা অস্বাভাবিক কিছু। এখন অনুমান করতে পারি, রাজকোষে হিসেব না মেলার কারণ। নকল মুদ্রা গত এক মাসে কিছু পরিমাণ লেনদেন মারফত ঢুকে গিয়েছিল। যার ফলে, মুদ্রাশালে বানানো মুদ্রার সংখ্যার সঙ্গে হিসেব মিলছিল না। জাল মুদ্রা ঢুকেছে সন্দেহ করলেও, ‘ভূরি ধাতু’র মুদ্রা পরীক্ষা করে, সেটা নকল প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব। আমার উপস্থিতিতে এই সমস্যা ঘটলে আমি সহজেই আসল সমস্যাটা অনুমান করতে পারতাম। কিন্তু ঠিক সেইসময়েই আমি এখানে অনুপস্থিত ছিলাম। ভারি গভীর ষড়যন্ত্র, জীবসিদ্ধি। ভারি গভীর ষড়যন্ত্র।

মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে জীবসিদ্ধি। সে এতদিন অনুমান করতে পারেনি যে এত ভয়ংকর পরিস্থিতি হতে পারে। আশ্চর্য এই যে এত কিছু মনে নিয়েও তার গুরুদেব এখনও এতটা শান্ত থাকতে পারছেন। জীবসিদ্ধি প্রশ্ন করল,

—তবে এখন উপায় কী, আচার্য? মগধের অর্থনীতি ব্যবস্থা কি তবে ভেঙে পড়বে?

চাণক্যর দৃষ্টিতে চকিত বিদ্যুৎ খেলা করল। হিমশীতল কণ্ঠে তিনি উত্তর দিলেন,

—চাণক পুত্র বিষ্ণুগুপ্ত চাণক্য জীবিত থাকতে তা কখনোই নয়। আমার সারাজীবনে অর্জিত অর্থশাস্ত্রর সমস্ত জ্ঞান আমি ব্যবহার করব। কিন্তু আর্যাবর্তর ওপর কোনো আঁচ আমি আসতে দেব না। কুটিলের বিরুদ্ধে আমিও মহা-কুটিল ‘কৌটিল্য’!

*পরিঘ – অর্থশাস্ত্রে উল্লিখিত ‘সুরক্ষা কর’, যা অন্যান্য ছোটো রাজ্য এবং জনপদের রাজারা দেশের সম্রাটকে দিত। এর বদলে সাম্রাজ্য তাদের বহিরাগত আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখত।

৩১.

নিজের ঘরে, চন্দন কাঠের পালঙ্কে শুয়ে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত। কয়েক দিন আগেই তাঁর গুরুদেবের থেকে দুটো চিঠি পেয়েছেন তিনি। দুটো একই চিঠি, একই নির্দেশ দেয়া তাতে। চন্দ্রগুপ্ত অনুমান করতে পেরেছেন যে বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নাহলে, নিশ্চিত হতে, তাঁর আচার্য একাধিক চিঠি তাঁকে পাঠাতেন না। এই নির্দেশের তাৎপর্য বুঝতে না পারলেও, তা পালন করতে চন্দ্রগুপ্ত দেরি করেননি। কিন্তু তিনি গত কয়েকদিন ধরে চিন্তিত। কারণ দু-দিন আগেই তক্ষশিলা থেকে আবার একটা চিঠি এসেছে তাঁর কাছে। সেটা লিখেছে, চাণক্য এবং জীবসিদ্ধির সঙ্গে পাঠানো সৈন্যদলেরই এক সৈনিক। আচার্য চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি নাকি কাউকে কিছু না জানিয়ে উধাও হয়েছেন সেখান থেকে। তাঁদের কোনো বিপদ হয়নি তো? সেই আশঙ্কাতেই চিন্তিত চন্দ্রগুপ্ত।

দরজার বাইরে থেকে একজন প্রহরীর গলা শোনা গেল,

—সম্রাট চন্দ্রগুপ্তর জয় হোক। সম্রাটের বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানোয় দুঃখিত। কিন্তু আচার্য চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি ফিরে এসেছেন। তাঁরা এই মুহূর্তে আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী।

প্রায় লাফিয়ে পালঙ্ক থেকে নেমে পড়লেন চন্দ্রগুপ্ত। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে বললেন,

—তাঁদের বিশ্রাম ও খাবার-পানীয়র ব্যবস্থা করো। আমি আসছি।

কোনোমতে অঙ্গবস্ত্র জড়িয়ে তিনি রাজসভায় চলে এলেন। অপেক্ষারত দু-জনকে দেখে হাসি ফুটল তাঁর মুখে। প্রতিবার গুরুর মুখদর্শন হলেই চন্দ্রগুপ্তর মনে একটা স্বস্তির ভাব আসে। অনেকটা নিশ্চিন্ত হন তিনি। চাণক্যর পায়ের ধুলো মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন সম্রাট। চাণক্য দু-হাতে তাঁর কাঁধ ধরে তাঁকে তুলে আশীর্বাদ করলেন,

—উৎকৃষ্ট ভারতম, সম্রাট। সদা জয়তু ভবঃ।

উঠে জীবসিদ্ধিকে আলিঙ্গন করলেন চন্দ্ৰগুপ্ত।

—কেমন আছ ভাই?

উত্তরে শুধু শুকনো হাসি হাসল জীবসিদ্ধি। বিপদের আভাস বুঝতে অসুবিধে হল না চন্দ্রগুপ্তর। প্রশ্ন করেন,

—কী ঘটেছে? সব কুশল তো?

উত্তর চাণক্য দিলেন,

—জানি না, চন্দ্রগুপ্ত। ঈশ্বরের কাছে শুধু প্রার্থনা যেন এখনও অপূরণীয় কোনো ক্ষতি না হয়ে থাকে। এই মুহূর্তে রূপাদর্শক*, অক্ষৎপাতালাদক্ষ* এবং সমস্ত অধ্যক্ষকে* তলব করো। তাদের আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে দেখতে চাই। আর সঙ্গে যেন গত চার মাসের সমস্ত হিসেব নিয়ে আসে।

কোনো প্রশ্ন না করেই, সম্রাট সৈনিকদের তলব করে যথাযথ নির্দেশ দিলেন। সৈনিকরা চলে গেলে তিনি প্রশ্ন করলেন,

—সকলের উপস্থিত হতে সময় লাগবে। ততক্ষণে কি আমায় বলবেন কী ঘটেছে?

—আমার চিঠি পেয়েছিলে? ক-টা চিঠি পেয়েছিলে?

—দুটো চিঠি পেয়েছি। দুটোতেই সমস্ত বড়ো আর্থিক লেনদেন বন্ধ করার নির্দেশ ছিল।

তাৎপর্যপূর্ণ দৃষ্টিতে একবার চাণক্য জীবসিদ্ধির দিকে চাইলেন। অর্থাৎ, ওঁর আশঙ্কাই ঠিক ছিল। প্রথম চিঠি সম্রাটের হাতে এসে পৌঁছোয়নি। আবার চন্দ্রগুপ্তকে প্রশ্ন করলেন,

—সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছ তো? সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন চন্দ্রগুপ্ত,

—হ্যাঁ, আচার্য। কিন্তু আমায় বুঝিয়ে বলুন, কী হয়েছে? কাউকে না জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করারই-বা কী প্রয়োজন পড়ল?

তিন জনে আসন গ্রহণ করলেন। প্রথম থেকে পুরো ঘটনাটা গুছিয়ে, চন্দ্রগুপ্তকে ব্যাখ্যা করলেন চাণক্য এবং জীবসিদ্ধি। মাঝে ফল, দুধ আর মধু দিয়ে গেল একজন ভৃত্য। কথার মাঝেই সেগুলো খেলেন দু-জন। দীর্ঘ ঘটনাক্রম বলে শেষ করতে অনেকটা সময় লাগল। স্তম্ভিত হয়ে পুরোটা শুনে গেলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত। সবটা শুনে কিছুক্ষণ কিছুই বলতে পারলেন না প্রথমে। পাথরের মতো বসে থাকলেন। তারপর বললেন,

একটা বিষয় আমায় বুঝিয়ে দিন। মৌর্য সাম্রাজ্য স্থাপনের সময়, নন্দর রাজ্যে আপনার ছড়িয়ে দেয়া নকল মুদ্রার কী গতি করেছিলেন?

চাণক্য উত্তর দিলেন,

—নতুন সাম্রাজ্যের সঙ্গেই, নতুন মুদ্রাও শুরু হয়েছিল, সম্রাট। সেই সময়েই আমি নকল মুদ্রা আলাদা করে ফেলেছিলাম। আমি একটা কৌশল অবলম্বন করেছিলাম নকল মুদ্রা বানানোর সময়ে, যাতে পরবর্তীকালে তা আলাদা করে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। নন্দ যুগের মুদ্রায় পাঁচটা চিহ্ন ব্যবহার হত। সূর্য, ছয় বাহু মগধ, পর্বতশৃঙ্গে বৃষ, হস্তী এবং বৃষ সদৃশ ইন্দ্ৰধ্বজ**। নকল মুদ্রায় ব্যবহৃত সিলমোহরের চিহ্নগুলো, আসল চিহ্নর প্রায় প্রতিরূপ হলেও, হুবহু এক ছিল না। যেমন ধরো, বৃষ চিহ্নর একটা পা অন্য তিনটের তুলনায় সামান্য ছোটো রাখতাম। এইরকমই অতি সামান্য পার্থক্য আমি রেখে দিয়েছিলাম সবকটা সিলমোহরে। এগুলো সাধারণ চোখে কেউই ধরতে পারবে না। কিন্তু আমি জানতাম। তাই পরবর্তীকালে আমার নির্দেশমতো, অধ্যক্ষরা সহজেই এই মুদ্রাগুলো আলাদা করতে পেরেছিল। কিন্তু এখন আসল-নকল এত সহজে পার্থক্য করা সম্ভব হবে না। কারণ এইবার নকল মুদ্রা আসলের সঙ্গে হুবহু এক হবে।

—তাহলে উপায়?

—একটাই উপায় আছে। সমস্ত মুদ্রা গলিয়ে ফেলা! সোনা এবং ‘ভূরি ধাতু’র গলনাঙ্কে বিস্তর পার্থক্য। সোনা তুলনামূলক অনেক আগে এবং সহজে তরলে পরিণত হয়। অর্থাৎ উচ্চ তাপে আসল মুদ্রা পুরো বিগলিত হবে এবং নকল মুদ্রার শুধু ওপরের সোনার আবরণ গলে যাবে।

ততক্ষণে একে একে অধ্যক্ষরা উপস্থিত হতে শুরু করেছেন। তাই চাণক্য আর সময় নষ্ট না করে উঠে দাঁড়ালেন। চন্দ্রগুপ্ত এবং জীবসিদ্ধির উদ্দেশে বললেন,

—তোমরা চাইলে বিশ্রাম নিতে পারো। কিন্তু আজ আমার সামনে দীর্ঘ রাত জাগা আছে।

—আমি আপনার সঙ্গেই থাকব আজকে রাতে।

—আমিও।

দুই শিষ্য একইসঙ্গে বলে উঠল।

মৃদু হেসে চাণক্য চন্দ্রগুপ্তর উদ্দেশে বললেন,

—আমার জন্যে কিছু পরিমাণ গুড়, মধু ইত্যাদির ব্যবস্থা করতে পারো, সম্রাট? ঈশ্বর জানেন, আজ আমার প্রচুর মধু-দ্রব্যর প্রয়োজন পড়তে চলেছে। জিভের মিষ্টি স্বাদ আমার মস্তিস্ক চালনায় সাহায্য করে।

.

সারারাত চাণক্য ডুবে থাকলেন রাজকোষের হিসেবের নথিতে। অন্যান্য অধ্যক্ষরাও ওঁর সঙ্গেই সারারাত ধরে কাজ করলেন। রাতের শেষ প্রহরে কাজ শেষ হল। কয়েকটা জরুরি নির্দেশ দেয়া হল সেই রাতে।

প্রথমত পরের দিন থেকে, মগধে স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার, নিষিদ্ধ করা হল। কোনোরকম বাণিজ্য বা লেনদেনে স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার করা যাবে না। শুধুমাত্র রৌপ্যমুদ্রা এবং তাম্রমুদ্রা ব্যবহার করা যাবে। দ্বিতীয়ত সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উপযুক্ত অধ্যক্ষর কাছে জমা করতে হবে। তার বদলে সমমূল্য রৌপ্যমুদ্রা, গো, অন্ন অথবা অন্য জিনিস লোকেদের হাতে তুলে দেয়া হবে। তৃতীয়ত যত স্বর্ণমুদ্রা গত চার মাসে জমা পড়েছে রাজকোষে এবং যা জমা পড়বে আগামী সময়ে, তা গলিয়ে সোনার পাত বানিয়ে ফেলতে হবে।

.

চাণক্য যখন উঠলেন তখন প্রায় ভোর হয় হয়। ক্লান্তিতে তাঁর চক্ষু কোটরাগত হয়েছে। পরিশ্রান্ত শরীরে উঠে এসে, চন্দ্রগুপ্ত এবং জীবসিদ্ধির পাশের আসনে শরীর এলিয়ে দিলেন তিনি।

*1. রূপাদর্শক – টাঁকশালের প্রধান / mint master

2. অক্ষৎ পাতালাধ্যক্ষ- auditor general

3. অধ্যক্ষ – চৌত্রিশ জন কর আধিকারিক।

**অর্থশাস্ত্রে এই সমস্ত পদ এবং মুদ্রায় ব্যবহৃত সিলমোহরের চিহ্নর উল্লেখ আছে।

৩২.

সকাল বেলা। দিনের প্রথম প্রহর শেষের দিকে। কয়েক মুহূর্ত বিশ্রাম নিয়ে, চোখ-মুখে ক্লান্তির ভাব খানিক দূর হয়েছে চাণক্যর। বিশ্রামের পরেই চাণক্য নিজের কুটিরে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে বাধা দিয়েছেন।

এখন তিন জনে প্রাতঃভোজ করছেন একসঙ্গে। গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাও শুরু হয়েছে সঙ্গে সঙ্গেই।

—আচার্য, এইভাবে স্বর্ণমুদ্রা ফিরিয়ে আনতে গেলে রাজকোষের কি ক্ষতি হবে?

চন্দ্রগুপ্তর এই প্রশ্নের উত্তরে চাণক্য বললেন,

—হুম। তা হবে। কারণ আমার ধারণা গত চার মাসে যথেষ্ট পরিমাণ নকল মুদ্রা ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার বন্ধ করায় নতুন করে নকল মুদ্রা আর ঢুকতে পারবে না। কিন্তু যা আগেই ছড়িয়ে পড়েছে, সেগুলো ফিরিয়ে আনতে, আমাদের সমমূল্য ফেরত দিতে হবে সাধারণ মানুষকে। এর ফলে দেশ জুড়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে। সব স্বর্ণমুদ্রা প্রত্যাহার করতে, এক বছর বা আরও বেশি সময় লাগারও সম্ভাবনা আছে। এরপর ধীরে ধীরে আবার দেশের অর্থনীতির হাল ফিরে আসবে। কিন্তু সময় লাগবে।

—চিন্তার কথা।

—না, সম্রাট। তক্ষশিলার রহস্যভেদে আরও দেরি হলে সেটা আরও বেশি চিন্তার হত। তবে শত্রুর ষড়যন্ত্র বিফল হয়েছে এটাই বড়ো কথা।

—শত্রুর শেষও হয়েছে। এটাও ভালো কথা।

জীবসিদ্ধির কথায় চাণক্য খাওয়া থামিয়ে একবার চাইলেন তার দিকে। বললেন,

—কার কথা বলছ?

—কেন? বাসব… মানে ইন্দ্রজিতের কথা বলছি। কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন চাণক্য। তারপর বললেন,

—জীবসিদ্ধি, তুমি কি সত্যটা এখনও বুঝতে পারোনি?

—অর্থাৎ?

—ইন্দ্রজিৎকে কে হত্যা করল?

—নকল স্বর্ণমুদ্রার এই ষড়যন্ত্রর কথা, জিজ্ঞাসাবাদে বলে ফেলার ভয়ে সে নিজেই আততায়ী দিয়ে সম্ভবত নিজের হত্যা করিয়েছে। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়েছে।

এই উত্তরটা চন্দ্রগুপ্ত দিলেন। উত্তরে ‘না’ সূচক মাথা নাড়ালেন চাণক্য।  বললেন,

—সেই সম্ভাবনা এড়াতে হলে বাসব আত্মহত্যা করত। গোপনে আততায়ী নিযুক্ত করত না।

—আপনি… আপনি কী ইঙ্গিত করতে চাইছেন, আচার্য? অন্য কেউও জড়িত এই ষড়যন্ত্রর সঙ্গে?

—পুরো ঘটনাক্রমের মধ্যে, কয়েকটা প্রশ্ন কি তোমার মাথায় জাগেনি? বাসব নামের একজন অপরিচিতকে আচার্য বিন্দাচল কেন নিজের সহকারী হিসেবে জায়গা দিলেন? সে তো জীববিদ্যা বা রসায়নশাস্ত্রর স্নাতক নয়। তা ছাড়া বাসব কিন্তু তক্ষশিলার ছাত্র ছিল না কোনোদিন। তাহলে সে কীভাবে তক্ষশিলায় এত বড়ো একটা ষড়যন্ত্রর পরিকল্পনা করল? আমি তাকে চিনি। সে বুদ্ধিমান অবশ্যই। কিন্তু তার পক্ষে একা এত পরিকল্পনা করা অসম্ভব। এই ষড়যন্ত্রর জন্যে প্রয়োজন বিদ্যা এবং বুদ্ধি। বাসবের মধ্যে এত শিক্ষা ছিল না কোনোকালেই।

খানিক বিরতি নিয়ে আবার বললেন,

—আরও কয়েকটা প্রশ্ন থেকে যায়। বাসবের সঙ্গে আমার পরিচয় এক বছরের সামান্য বেশি। তার পক্ষে আমার মনস্তত্ত্ব এতটা গভীরে জানার কথা নয়। এই পরিকল্পনা এমন একজন ব্যক্তির যে আমায় বহু বছর ধরে চেনে। সে জানে তক্ষশিলা মহাবিদ্যালয় আমার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সে জানে যে মগধ থেকে আমায় টেনে বের করে আনতে পারে একমাত্র তক্ষশিলা।

না না, জীবসিদ্ধি। এই আক্রমণ যতটা মগধের ওপর করা হয়েছে, ততটাই আমার ওপরেও করা হয়েছে। এটা ব্যক্তিগত। যুক্তি দিয়ে ভাবো একবার তোমরা। নিজেকে একবার আচার্য বিন্দাচলের জায়গায় কল্পনা করো। তুমি একদিন গবেষণা করতে গিয়ে হঠাৎ এক ভয়ানক ভয় সৃষ্টিকারী জিনিসের খোঁজ পেলে। তুমি বুঝতে পারলে যে এর পরিণাম ভয়ানক হতে পারে। তখন তুমি কী করবে?

—আমি খুবই বিচলিত হব। নিজের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমান পরিচিত ব্যক্তির কাছে পরামর্শ চাইব। এককথায়, আপনার পরামর্শ চাইব।

—ঠিক। আচার্য বিন্দাচলও তার ব্যতিক্রম নন। তিনিও সম্ভবত সেটাই করেছিলেন। তিনিও তাঁর নিজের পরিচিত সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তির পরামর্শ চেয়েছিলেন। অনুমান করতে পারো, কে সেই ব্যক্তি?

চন্দ্রগুপ্ত এবং জীবসিদ্ধি দু-জনেই সমস্বরে বলে উঠলেন,

—আচার্য শকুনি!

—ঠিক তাই। আমার অনুমান, শকুনি নিরুদ্দেশ থাকলেও, নিজের বিশ্বস্ত কয়েকজনের সঙ্গে সে যোগাযোগ রেখেছে। বিন্দাচল তাদেরই একজন। আমার ধারণা বিন্দাচলের বাড়িতে আমরা যে পোড়া নথিপত্র দেখেছিলাম, সেগুলো শুধুই গবেষণার তথ্য নয়। তার মধ্যে শকুনির লেখা চিঠিও ছিল। এই মাদক সম্বন্ধে জানতে পেরে, শকুনিই বাসবকে বিন্দাচলের কাছে পাঠায়। আচার্য বিন্দাচল সেই কারণেই বিশ্বাস করেছিল তাকে। সে ধারণাও করতে পারেনি যে সে নিজের মৃত্যুর আহ্বান নিজেই করছে।

—তার মানে এই সমস্ত ষড়যন্ত্রের মূল আসলে আচার্য শকুনি?

—হুম। আমি নিশ্চিত। ভেবে দেখো। সে ছাড়া আর কে আছে যার আমার এবং মগধ দুইয়ের প্রতিই বিদ্বেষ আছে? কে এমন ব্যক্তি যে জ্ঞানী, অসম্ভব বুদ্ধিমান এবং আমার স্বভাবচরিত্রর সঙ্গে পরিচিত? তক্ষশিলার সঙ্গে যার যোগ আছে এবং নিজের স্বার্থে সে দেশের ক্ষতি করতেও পিছপা হবে না। একজনই আছে এমন ব্যক্তি।

.

হতবুদ্ধির মতো দু-জনে নির্বাক বসে থাকল। এইভাবে তারা ভেবে দেখেনি একবারও। অথচ উত্তরটা সর্বক্ষণ তাদের সামনেই ছিল। চন্দ্রগুপ্ত প্রশ্ন করলেন,

—কিন্তু আচার্য, শকুনির সঙ্গে আপনার প্রাক্তন ছাত্র এই বাসবজিতের পরিচয় হল কী করে?

—একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বুকের ওপর এসে পড়া টিকিতে হাত বুলিয়ে চাণক্য বললেন,

—এর উত্তর আমার কাছে নেই। কোনোদিন জানতেও পারব না সম্ভবত তবে অনুমান করি যে হয় তাদের পরিচয় দৈবাৎ হয়েছিল অথবা শকুনি নিজেই আমার অতীত ঘেঁটে খুঁজে বের করেছিল তাকে। বাসবের থেকেই শকুনি এই নকল মুদ্রা বানানোর ঘটনা জানতে পারে। এরপরেই এই পরিকল্পনা বানায় শকুনি। কিন্তু বিন্দাচল শেষ পর্যন্ত শকুনির ষড়যন্ত্রে রাজি না হওয়ায়, তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেয় শকুনি। ভেবে দেখো, বিন্দাচলের মৃত্যু হয়েছে এক বছরের আগে। অতএব, ‘কাৎ’-এর মাদক তখন থেকেই বাসবের কাছে ছিল। তবে সেটা ব্যবহার শুরু করতে পরবর্তী ছ-মাস সে কেন অপেক্ষা করল? কারণটা সহজেই অনুমান করা যায়। শকুনি প্রতীক্ষা করছিল রাজকোষের স্বর্ণমুদ্রা লুণ্ঠন করার ঠিক সুযোগের। বহুদিন নজরদারির পর যখন তার পরিকল্পনা স্থির হল, সেই অনুযায়ী বাসব তার কাজ শুরু করল।

খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে চাণক্য বললেন,

—বাসব বোঝেনি যে সে নিজেও শকুনির হাতের পুতুল মাত্র। শকুনির চতুরঙ্গ খেলায় সে একটা ঘুঁটি মাত্র, প্রয়োজন শেষ হলেই যাকে খেলা থেকে সরিয়ে ফেলতে শকুনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। শকুনি গুপ্তচর রেখেছিল সর্বত্র। বাসব ধরা পড়তেই তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। বরং এতে শকুনির পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই তাকে গুপ্ত আততায়ী দিয়ে হত্যা করানো হয়।

জীবসিদ্ধি অন্যমনস্কভাবে একবার নামটা উচ্চারণ করল,

—আচার্য শকুনি।

নিজের কাপড়ের ঝোলা কাঁধে তুলে নিতে নিতে চাণক্য বললেন,

—হ্যাঁ। সে নিজেকে সেরা প্রমাণিত করতে সব সীমানা লঙ্ঘন করবে। এই অত্যন্ত ধূর্ত ব্যক্তি যতদিন জীবিত থাকবে, ততদিন মগধের ওপর অপ্রত্যাশিত আক্রমণ হতেই থাকবে। সারা দেশকে ধ্বংস করার মতো ভয়ানক ষড়যন্ত্র করেও সে আমাদের অধরা। বেশিরভাগ মানুষ তাকে চেনেও না। তার বর্তমান স্থিতি এবং ক্ষমতা সম্বন্ধে আমরা কেউ অবগত নই। তার নজর রয়েছে সর্বত্র, সর্বক্ষণ। আমায় পরাজিত করতে সে বদ্ধপরিকর। আমার স্বপ্নের আর্যাবর্তকে ধ্বংস করাই তার উদ্দেশ্য। অথচ তার অস্তিত্ব সম্বন্ধেই মানুষ অজ্ঞাত। সে আগেও মগধের ওপর আঘাত হেনেছে এবং ভবিষ্যতেও চেষ্টা করবে। যতদিন শকুনি জীবিত, ততদিন মগধের শান্তি নেই। আমার শান্তি নেই। স্বীকার করছি, এইবার সে আমায় বুদ্ধির খেলায় প্রায় পরাজিত করেছিল। সে সত্যই আমার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তাকে আমি ধ্বংস করবই।

শেষ কথাগুলো বলার সময়ে চাণক্যর উজ্জ্বল চোখের তারা যেন ঝলসে উঠেছিল। বহু বছর পর এই দৃষ্টি দেখল চন্দ্রগুপ্ত এবং জীবসিদ্ধি। তাদের হৃদয় কেঁপে উঠল একটু। এই মানুষটার সঙ্গে তারা পরিচিত। প্রয়োজনে এই মানুষটা কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা তারা জানে।

পরক্ষণেই দৃষ্টি নরম হল চাণক্যর। তাঁদের দিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন আচার্য। শান্ত সাগরের মতো গভীর দৃষ্টিতে তাঁদের পরিচিত আশ্বাসের শীতলতা

দুই শিষ্য প্রণাম করলেন তাঁদের গুরুকে। আচার্য তাঁদের মাথায় হাত রেখে উচ্চারণ করলেন,

—অসতো মা সদময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়।।

উপসংহার:

স্থান: আর্যাবর্তেরই কোনো এক অজানা জায়গা।

এক ব্যক্তি ঘোড়া ছুটিয়ে এসে থামল একটা বাড়ির সামনে। তার মুখ ঢাকা। বাড়ির দরজা খুলে এক ব্যক্তি বেরিয়ে এল। দু-জনের মধ্যে কিছু কথোপকথন হল। সেই ব্যক্তি আবার নিজের ঘোড়ায় চড়ে বিদায় নিল।

দরজা বন্ধ করে দ্বিতীয় ব্যক্তি বাড়িতে ঢুকল। বাড়ির প্রাঙ্গণে আরও চার জন মানুষ শরীরচর্চা করছে। সম্ভবত তারা প্রশিক্ষিত সৈনিক। একজন তিরন্দাজি অভ্যাস করছে। তাদের পাশ দিয়ে ভেতরের একটা ঘরে প্রবেশ করল লোকটি।

এক ব্রাহ্মণ বসে আছেন আসনে। দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে। ন্যাড়া মাথায় লম্বা টিকি এবং পইতে থেকে বোঝা যায় এই ব্যক্তি ব্রাহ্মণ। প্রবেশ করে প্রথম ব্যক্তি বলল :

—আচার্যদেব, আমাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। চাণক্য পাটলিপুত্রে পৌঁছে গেছে। এক্ষুনি গুপ্তচর খবর দিল, যে মগধ স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। পরাজিত হয়েছি আমরা।

নিজের আসনে বসা অবস্থাতেই এইবার মুখ ফেরালেন ব্রাহ্মণ। চোখে তাঁর নৃশংসতা এবং ধূর্ততার আভাস। ঠোঁটে কুটিল হাসি।

—চতুরঙ্গের একটা দান হেরে গেলে তাকে পরাজয় বলে না। যুদ্ধ তো সবে শুরু হল।

***

Author’s Note:

1. মৌর্য শাসনকালের কোনো স্বর্ণমুদ্রা ইতিহাসবিদরা খুঁজে পাননি। কোনো এক অজানা কারণে সেই সময় স্বর্ণমুদ্রার ব্যবহার বন্ধ করে শুধুমাত্র রুপো এবং তামার মুদ্রার ব্যবহার শুরু করা হয়েছিল। ইতিহাসবিদরা এর নিশ্চিত কোনো কারণ বলতে পারেননি।

2. ইতিহাসবিদদের মতে, বাস্তবে মৌর্য শাসনকালে দেশ জুড়ে মুদ্রাস্ফীতি দেখা গিয়েছিল।

3. চাণক্যকে নিয়ে বহু গল্প এবং উপকথা প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটা উপকথায় শোনা যায় যে চাণক্য বিঞ্জা অরণ্যে, একটা স্বর্ণমুদ্রাকে আটটা স্বর্ণমুদ্রা বানানোর অলৌকিক উপায় শিখেছিলেন। এই অর্থ পরবর্তীকালে যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। [7,13]

4. এখানে ‘ভূরি (খয়রি) ধাতু’ বলে যে বিশেষ ধাতুর কথা বলা হয়েছে, সেটাকে আমরা টাংস্টেন (Tungsten) নামে জানি। এর দাম আজকের দিনেও সোনার দামের চার-শো ভাগের এক ভাগ। কিন্তু টাংস্টেনের ঘনত্ব এবং ওজন সোনার প্রায় সমান। UNICEF ডেটা অনুযায়ী রাজস্থানের দেগনা, পশ্চিমবঙ্গের চাঁদপাহাড় এবং নাগপুরে সাকোলি নদীর চরে পাওয়া যায়। এই কাহিনিতে উল্লিখিত বিদর্ভ রাজ্য বর্তমানে নাগপুরে অবস্থিত।

5. এই কাহিনিতে উল্লিখিত মাদক ‘কাৎ’ বা ‘খাৎ’ (Khat) উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম Catha Edulis. Arabian Peninsula এবং Eastern Africa-তে এই বিশেষ গাছ পাওয়া যায়। এই মাদক পাতা মাত্রাতিরিক্ত খেলে ব্লাড প্রেশার ও নাড়ির গতি (pulse rate) বৃদ্ধি, insomnia, depression, delusion, sucidal tendencies, violence, cardiac complications ইত্যাদি লক্ষণ মানুষের শরীরে দেখা দেয়। এর ভয় সৃষ্টিকারী এফেক্ট অনেকটা Amphetamine-এর সঙ্গে তুলনা করা যায়। [10,11]

6. সেই যুগে কপূর, ধুনি ইত্যাদি ব্যবহার করে নিয়মিত নিজের বাড়ি অনুবাসন করার প্রচলন ছিল। [15]

References:

1. কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র (Translated into English by R Shamasastry ) 2. চাণক্যনীতি (https://www.hindisahityadarpan.in/2012/01/complete-chanakya-neeti-in-hindi.html?m=1)

3. বিজয় – দেবতোষ নাথ

4. Chandragupta Maurya TV series (2011)

5. Chanakya TV series (1991)

6. Theindiahistory.org

7. India: Brief History by Symist, vol. 3, pg- 39.

৪. Chanakya: The Great Indian Philosopher followed by the world, by Lata Tiwari, opennaukri.com, May ৪, 201৪.

9. Kautilya and Arthashastra: A statistical investigation of authorship and evaluation of text – Thomas R Trautman, Brill, 1971.

10. Khat- A controversial plant, Erica E Balint et al., 2009, Wein Klin Wochenschr.

11. National Library of Medicine, pubMed.gov

12. Takshila University (https://en.m.wikipedia.org/wiki/University of ancient Taxila)

13. Chanakya (https://en.m.wikipedia.org/wiki/Chanakya)

14. Asthi Shareera- Defination, Anatomy, Types of Bones. Dr Raghuram and Dr Manasa. Easy Ayurveda. (https://www.google.com/ amp/s/www.easyayurveda.com/2017/04/03/asthi-shareera-bones/)

15. Fumigation Ayurveda (https://www.sciencedirect.com/ science/article/pii/S097594761৪3065৪2#:~:text=Fumigation%20in%20 Ayurveda%20is%20described, disinfection%20environment%20 with%20various%20herbs)

***